Friday 7 May 2021

ব্রিটিশ সামরিক শক্তির ভবিষ্যৎ কি?

০৭ই মে ২০২১
ছবিঃ জিবরালটারের অদূরে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘ফোর্দ’। নতুন সমন্বিত নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের কূটনৈতিক মিশনগুলিকে প্রতিরক্ষা এটাশের সংখ্যা বাড়ানো হবে। পররাষ্ট্র কর্মকান্ডে প্রতিরক্ষা স্টাফদের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি করা হবে। বিদেশে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলিকে আরও শক্তিশালী করা হবে। জিবরালটার এবং সাইপ্রাস ছাড়াও ওমান, সিঙ্গাপুর এবং কেনিয়াতে ব্রিটেন তার সামরিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে।



ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার সরকার আগামী এক দশকের কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রকাশ করার পর থেকেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। গত ২২শে মার্চের ‘গ্লোবাল ব্রিটেন ইন এ কম্পিটিটিভ এইজ’ শীর্ষক এক প্রকাশনার মাঝে ব্রিটিশরা নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, উন্নয়ন সহায়তা এবং পররাষ্ট্রনীতিকে সমন্বিত করেছে। অর্থাৎ প্রতিরক্ষা নীতিকে অন্য নীতি থেকে আলাদা করে দেখছে না তারা। ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়টাকে ব্রিটিশরা একটা সুযোগ হিসেবে দেখতে চাইছে। নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন, বিশেষ করে ইন্দোপ্যাসিফিক দুনিয়ার ভূরাজনৈতিক এবং ভূঅর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশরা ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনেছে। এই বাস্তবতাতেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নিতে সম্পূর্ণ জাতীয় শক্তিকে তারা ব্যবহার করতে চাইছে। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের জন্যে আয়োজন করা গণভোটের কিছু সময় পর থেকেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটা সামনে আসতে থাকে। নতুন এই নীতিপত্রের মাধ্যমে এই চিন্তাটাকে ভিত্তি দেয়া হলো।

প্রতিরক্ষার বাইরেও তারা অনেক বিষয়কে জাতীয় নিরাপত্তার শক্তিশালী অংশ হিসেবে দেখছে; যার মাঝে রয়েছে ব্রিটিশদের প্রযুক্তিগত উতকর্ষতা, ইন্টেলিজেন্স, নিরাপত্তা, কূটনীতি বিষয়ে শক্তিশালী বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, বৃহৎ আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার, শক্তিশালী সাইবার সক্ষমতা, সকল গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিজেদের শক্তিশালী উপস্থিতি, পরিবেশ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যের দিক থেকে দুনিয়ার নেতৃত্বশীল অবস্থান, ইত্যাদি। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা। ইন্দোপ্যাসিফিকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্রিটেন এই দেশগুলিকে সহায়তা করবে। এছাড়াও ভারতকেও এই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হিসেবে দেখছে ব্রিটেন। তবে অনেকেই বলছেন যে, এই নীতিতে ব্রিটিশ সামরিক শক্তিকে খর্ব করা হচ্ছে। অপরদিকে ব্রিটিশ সরকার বলছে যে, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামরিক শক্তির বাইরে অন্যান্য বিষয়কেও হিসেবে আনতে হবে; কারণ বর্তমান বাস্তবতা আগের মতো নেই।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর প্রতিটা অংশই কর্তন করা হচ্ছে; বিশেষ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যাওয়ায় এর মাধ্যমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব, তা নিয়েই প্রশ্ন করছেন অনেকে। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, এই পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মাঝে সেনাবাহিনীর আকার সাড়ে ৭২ হাজারে নামিয়ে আনা হবে; যা কিনা ১৭১৪ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। বর্তমানে এটা ৭৬ হাজারে রয়েছে; আর এর পিছনে কারণ হলো ৮২ হাজার সেনার টার্গেট বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। নতুন রিক্রুট যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি বর্তমান সেনাদেরও ধরে রাখা যাচ্ছে না। বাহিনীর রিক্রুটমেন্টের যা অবস্থা, তাতে এর আকার এমনিতেই সাড়ে ৭২ হাজারে চলে আসবে; কাউকে ছাটাই করতে হবে না। এছাড়াও সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলির প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। বাকি থাকা ১’শ ৪৮টা ট্যাঙ্কের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে খরচ হবে প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কার বিরুদ্ধে মোতায়েন হবে?

নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, সেনাবাহিনীর পদাতিক সেনাদেরকে ৪টা ডিভিশনের মাঝে পুনর্বিন্যাস করা হবে। বর্তমানের একটা পদাতিক ব্যাটালিয়ন বাতিল করে দেয়া হবে; অন্যদিকে সেনাবাহিনীর স্পেশাল অপারেশনস ব্রিগেডের অধীনে একটা নতুন রেনজার রেজিমেন্ট তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে প্রচলিত যুদ্ধের দরকারের চাইতে স্পেশাল ফোর্সের দরকারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা করার জন্যে একটা আলাদা ব্যাটালিয়ন তৈরি করা হচ্ছে; যা কিনা বাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যে একটা ‘সিকিউরিটি ফোর্স এসিসট্যান্স’ ব্রিগেড তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলির সামরিক শক্তিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির সাথে সমন্বিত করার প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নেয়া হবে। বিশ্বব্যাপী যেকোন স্থানে দ্রুত মোতায়েনের উদ্দেশ্যে ১৬তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেড এবং ১ম কমব্যাট এভিয়েশন ব্রিগেড নিয়ে ‘গ্লোবাল রেসপন্স ফোর্স’ গঠন করা হচ্ছে। ১৬তম এয়ার এসল্টে রয়েছে বিমানে পরিবহণ করার মতো প্যারাশুট সেনারা; আর ১ম কমব্যাট এভিয়েশনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের এটাক হেলিকপ্টার। ৬ষ্ঠ ডিভিশনের কাজ হবে সাইবার যুদ্ধ, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, ইনফরমেশন যুদ্ধ এবং অন্যান্য অপ্রচলিত সক্ষমতা। সেনাবাহিনীর ৩য় এবং ১ম ডিভিশনকে পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। এগুলি সেনাবাহিনীর বড় ইউনিট হলেও এগুলি নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা হয়েছে নীতিপত্রে। পুরোনো সরঞ্জাম সরিয়ে প্রায় ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নতুন প্রযুক্তির সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। ‘আইএইচএস জেন্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৪৪টা মাল্টিপল রকেট আর্টিলারি পাঁচ বছরের মাঝে প্রযুক্তিগতভাবে আপগ্রেড করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ এগুলি ১’শ ৫০ কিঃমিঃ দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে। এছাড়াও ২০২৪ সালের মাঝে একই সিস্টেম ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপ করা ‘প্রিসিসন স্ট্রাইক মিসাইল’ ছোঁড়া সম্ভব হবে; যার পাল্লা হবে প্রায় ৫’শ কিঃমিঃ।

সেনাবাহিনীর বর্তমানের ২’শ ২৭টা ‘চ্যালেঞ্জার ২’ ট্যাঙ্ক থেকে কমিয়ে ১’শ ৪৮টায় নামিয়ে আনা হচ্ছে; যেগুলি ১ম ডিভিশনের অধীনে থাকবে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী একটা ডিভিশন বিশ্বব্যাপী মোতায়েন করার সক্ষমতা রাখতে চাইছে। এই একটা ডিভিশনের ২টা রেজিমেন্টে মোট ১’শ ১২টা ট্যাঙ্ক থাকবে। কিন্তু যেহেতু মেরামত এবং মেইনটেন্যান্সের জন্যে কিছু ইউনিট ওয়ার্কশপে থাকবে, তাই ১’শ ৪৮টা ট্যাঙ্কের মাঝ থেকে ১’শ ১২টাকে অপারেশনে রাখা বেশ কঠিন হবে। আর যুদ্ধ করতে গিয়ে এর মাঝ থেকে কিছু যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে সেগুলি প্রতিস্থাপন করাও কঠিন হয়ে যাবে। কোন রিজার্ভও রাখা সম্ভব হবে না। এছাড়াও ওয়াটলিং বলছেন যে, এই ট্যাঙ্কগুলি মূলতঃ দরকার হবে ইউরোপের পূর্ব সীমানা রক্ষার্থে। একসময় ইউরোপে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলি সোভিয়েত সীমানার কাছে ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই ঘাঁটিগুলি রুশ সীমানা থেকে প্রায় ২ হাজার কিঃমিঃ দূরে। ট্যাঙ্কগুলির এই দূরত্ব পাড়ি দেবার জন্যে রয়েছে মাত্র ৭১টা ট্যাঙ্ক ট্রান্সপোর্টার। তদুপরি শ’খানেক ‘এএস ৯০’ সেলফ প্রোপেল্ড আর্টিলারিও এই ট্রান্সপোর্টারগুলিকেই বহণ করতে হবে; যা পুরোপুরি অবাস্তব। আর রুশ সীমানার সাথে দূরত্ব কমাতে হলে ঘাঁটিগুলিকে সরিয়ে পোল্যান্ডে নিতে হবে; যা কিনা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। ওয়াটলিং বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকারকে হয় ট্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়াতে হবে; নতুবা ট্যাঙ্কের চাইতে হাল্কা আর্মার্ড ভেহিকলের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আগে ঠিক করতে হবে যে, তারা সেনাবাহিনীকে দিয়ে কি করাতে চান। ওয়াটলিংএর কথাগুলিতে যে ব্যাপারটা স্পষ্ট তা হলো, ব্রিটেন ইউরোপের স্থলসীমানাকে ব্যাপক হুমকির মাঝে দেখছে না। ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা কি আসলেই রাশিয়ার সাথে স্থলযুদ্ধের আশঙ্কা করেন? আর ব্রিটিশদের এই চিন্তার সাথে তাদের প্রধান কৌশলগত সহযোগী যুক্তরাষ্ট্র কতটা সহমত?

রয়াল নেভি ছোট হচ্ছে; কিন্তু সক্ষমতা বাড়বে... কিভাবে সম্ভব?

ব্রিটিশ রয়াল নেভি বর্তমানে পূর্বের ছায়ামাত্র; তদুপরি এর উপর আসছে আরও কর্তন। বর্তমানের ১৯টা ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ার থেকে আগামী ১৮ মাসের মাঝে ১৭টা জাহাজে কমিয়ে আনা হচ্ছে। ১৩টা ‘টাইপ ২৩’ ফ্রিগেটের মাঝে দু’টাকে ডিকমিশনিং করে ফেলা হচ্ছে। ‘নেভাল টেকনলজি’ ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাতে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল টনি রাডাকিন বলছেন যে, তারা নৌবাহিনীর বেশকিছু জাহাজ বিশ্বব্যাপী স্থায়ীভাবে মোতায়েন করতে চাইছেন। এতে করে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ অবস্থান ধরে রাখতে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক জাহাজ লাগবে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ব্রিটিশ ফ্রিগেট ‘মনট্রোজ’এর কথা বলেন, যা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ীভাবে অবস্থান করছে। কিছুদিন পরপর এই জাহাজের ক্রু পরিবর্তন করা হচ্ছে। মেইনটেন্যান্সের কাজগুলিও মধ্যপ্রাচ্যেই করে নিচ্ছে তারা। এবছরেই রয়াল নেভির দৈত্যাকৃতির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’ স্থায়ীভাবে মোতায়েন হচ্ছে ইন্দোপ্যাসিফিকে। এছাড়াও একটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল মোতায়েন রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে; আরেকটা রয়েছে মধ্য আমেরিকার ক্যারিবিয়ানে। আর মার্চ মাসেই আরেকটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ‘ট্রেন্ট’ মোতায়েন করা হয় জিবরালটারে। এই জাহাজটা ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষা করবে। আরও দু’টা প্যাট্রোল ভেসেল সবেমাত্র কমিশনিং করা হয়েছে, যেগুলি ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করা হবে। এই প্যাট্রোল ভেসেলগুলি এমন সব এলাকায় মোতায়েন করা হবে, যেখানে হুমকি অপেক্ষাকৃত কম। এতে করে দামি ফ্রিগেটগুলিকে বেশি প্রতযোগিতাপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন করা যাবে।

নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, ‘বে ক্লাস’এর একটা উভচর সাপোর্ট জাহাজকে পরিবর্তন করে উপকূলীয় অঞ্চলে যুদ্ধ করার নতুন সক্ষমতা দেয়া হবে। এতে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা থাকবে এবং জাহাজটাকে স্থায়ীভাবে দূরবর্তী কোন একটা সমুদ্রে মোতায়েন করা হবে। নতুন এক ধরনের সক্ষমতা তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সমুদ্রের নিচে সাবমেরিন ক্যাবলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। মাইন ধ্বংসকারী জাহাজগুলিকে নতুন প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় সক্ষমতা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হবে।

আর এডমিরাল রাডাকিন বলছেন যে, ব্রিটিশরা ৮টা ‘টাইপ ২৬’ এবং ৫টা ‘টাইপ ৩১’ ক্লাসের যে ফ্রিগেটগুলি তৈরি করছে, সেগুলি অনেক রকমের কাজ করতে পারবে। তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন যে, ‘টাইপ ২৬’ ফ্রিগেটগুলি ১৪টা কনটেইনার বহণ করতে পারে। একেকটা কনটেইনারের ভেতর বিভিন্ন মিশনের সরঞ্জাম নেয়া যাবে; যেমন, লেজার অস্ত্র, মাইন ধ্বংস করার সরঞ্জাম, থ্রিডি প্রিন্টার সহ মিনি ফ্যাক্টরি, একটা দূতাবাসের পুরো অফিস, মেডিক্যাল সরঞ্জাম, আকাশ বা পানিতে বা পানির নিচ দিয়ে চলা ড্রোন, ইত্যাদি। এভাবে একটা জাহাজ অনেকগুলি বিশেষায়িত জাহাজের কাজ করতে পারবে; অর্থাৎ কম সংখ্যক জাহাজ দিয়ে তারা কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন, তাই শুধু নয়, নতুন জাহাজগুলি অনেক নতুন সক্ষমতাকে বাহিনীর সাথে যুক্ত করবে। প্রতিটা জাহাজ, সাবমেরিন এবং নাবিক তথ্য সংগ্রহের কেন্দ্র হওয়া ছাড়াও ইন্টেলিজেন্স স্টেশন হিসেবে কাজ করবে এবং বহু ধরনের প্রযুক্তির বহণকারী হবে। একইসাথে তারা স্পেশাল ফোর্সের কর্মকান্ডকে সহায়তা দেবে। এডমিরাল রাডাকিন রয়াল নেভির এই চিন্তাগুলিকে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ বলে বলেন।

তবে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ হিসেবে ব্রিটিশরা বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান ধরে রাখতে অন্য দেশের উপর নির্ভর করছে। যেমন, ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে রক্ষার জন্যে যেসব জাহাজ সাথে থাকবে, তার মাঝে থাকবে একটা মার্কিন ডেস্ট্রয়ার এবং একটা ডাচ ফ্রিগেট। এছাড়াও বিমানবাহী জাহাজের ডেকের উপরে ব্রিটিশ ‘এফ৩৫’ বিমানের সাথে থাকবে মার্কিন ম্যারিক কোরের ‘এফ৩৫’ বিমান। ২০২০ সালে ক্যারিবিয়ান, আর্কটিক, বল্টিক এবং ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাথে ছিল অন্যান্য দেশের নৌবাহিনীর জাহাজ। গত মার্চ মাসে আর্কটিকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘ল্যাংকাস্টার’এর সাথে ছিল নরওয়ের ফ্রিগেট ‘থর হেয়ারডাল’। এছাড়াও মার্চে বল্টিক সাগরে দু’টা ব্রিটিশ ফ্রিগেট এবং একটা সাপ্লাই জাহাজের সাথে ছিল লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া এবং সুইডেনের কয়েকটা সামরিক ইউনিট।
ছবিঃ রয়াল এয়ার ফোর্সের ‘সি ১৩০’ পরিবহণ বিমান। ব্রিটিশ সরকার এরকম সবগুলি বিমান রিটায়ার করতে যাচ্ছে। ব্রিটেন মনে করছে না যে, ২০৩০ সালের মাঝে বড় কোন সামরিক মিশনে তাকে জড়াতে হবে। তাই ট্যাঙ্ক এবং সামরিক বিমানের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পিছপা হচ্ছে না তারা।



ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের লক্ষ্য কি হবে?

ব্রিটিশ সরকার এর আগে বলেছিল যে, তারা মোট ১’শ ৩৮টা ‘এফ ৩৫বি’ স্টেলথ বিমান কিনবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যেগুলি কিনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের উপর থেকে উড়তে সক্ষম। এবারের পরিকল্পনায় তারা বলছে যে, এখন পর্যন্ত যে ৪৮টা বিমান তারা ডেলিভারি পেয়েছে, সেগুলির পর তারা আরও ক্রয় করবে। কিন্তু তারা বলছে না যে, সেই সংখ্যা ১’শ ৩৮ পর্যন্ত যাবে কিনা। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মন্ত্রী জেমস হিপ্পি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেন যে, ব্রিটেন কয়েকটা দেশের সহযোগিতায় নিজস্ব স্টেলথ ফাইটার ‘টেমপেস্ট’ ডেভেলপ করছে। ভবিষ্যতে রয়াল এয়ার ফোর্স কেমন হবে, তা নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। ব্রিটিশরা যে ‘এফ ৩৫বি’ বিমান ক্রয় করছে, তা মার্কিন ম্যারিন কোরও ক্রয় করছে। ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, ব্রিটিশরা যদি নির্দিষ্ট করে না বলে যে, তারা কতগুলি ‘এফ ৩৫বি’ ক্রয় করতে যাচ্ছে, তাহলে তা এই বিমানের নির্মাতা ‘লকহীড মার্টিন’কে যেমন শান্ত করবে না, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকেও অস্বস্তিতে রাখবে। মাত্র ৪৮টা ‘এফ ৩৫বি’ দিয়ে ব্রিটিশরা তাদের বিশ্বব্যাপী সক্ষমতাকে ধরে রাখতে পারবে না, কারণ এই বিমানগুলি সবসময় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের উপরেই থাকবে; এর বাইরে মোতায়েনের জন্যে আর কোন স্টেলথ বিমান তাদের হাতে থাকবে না। ব্রিটিশ সরকার খুব সম্ভবতঃ অর্থায়নের ক্ষেত্রে নিজেদের ‘টেমপেস্ট’ স্টেলথ বিমান ডেভেলপমেন্টকে ‘এফ ৩৫বি’ বিমান মোতায়েনের উপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ব্রঙ্ক বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকার ১’শ ৩৮টা ‘এফ ৩৫বি’ কিনতে পারবে কিনা, তা নিয়ে প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। কিন্তু ‘টেমপেস্ট’কে ঘিরে ব্রিটিশ আকাংক্ষা বলছে যে, ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত খুব সম্ভবতঃ ৬০ থেকে ৭২টা ‘এফ ৩৫বি’ কিনতে পারবে। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, ২০১৮ সালে ‘টেমপেস্ট’এর মডেল উন্মোচিত করার সময় অনেকেই প্রশ্ন করেছিল যে, ‘এফ ৩৫বি’ বিমান ক্রয় করে এর সমান্তরালে আরেকটা নতুন বিমান ডেভেলপ করার মতো অর্থায়ন ব্রিটিশ সরকার পাবে কিনা। আগামী চার বছরের জন্যে ব্রিটিশ সরকার ‘টেমপেস্ট’ প্রকল্পে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার কথা বলছে। এই প্রকল্পের ফলে ইতোমধ্যেই ১৮’শ প্রযুক্তিগত কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে এবং এর মাধ্যমে আরও ১৮ হাজার বর্তমান কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা বেড়েছে।

রয়াল এয়ার ফোর্স তাদের মূল ফাইটার বিমান ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’এর ‘ট্রানশ ১’ ভার্সনের সবচাইতে পুরোনো ২৪টা বিমান ২০২৫ সালের মাঝে সার্ভিস থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। বিমান বাহিনীর চিফ অব স্টাফ এয়ার চিফ মার্শাল মাইক উইগস্টন বলছেন যে, পুরোনো বিমানগুলির চাইতে নতুন ‘ট্রানশ ২’ এবং ‘ট্রানশ ৩’ ভার্সনের বিমানগুলির সক্ষমতা বহুগুণে বেশি। কাজেই পুরোনো বিমানগুলি রিটায়ার করিয়ে দিলে তাতে বিমান বাহিনীর সক্ষমতায় কোন পরিবর্তন আসবে না। পুরোনো বিমানগুলি বর্তমানে ট্রেনিংএর জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাতটা ‘টাইফুন’ স্কোয়াড্রনের মাঝে একটা কাতারি বিমান বাহিনীর সাথে যৌথভাবে অপারেট করা হবে। ‘আইএইচএস জেন্স’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রয়াল এয়ার ফোর্স মোট ১’শ ৩১টা ‘টাইফুন’ বিমান অপারেশনে রাখতে চাইছে। তবে তারা বলছে যে, পুরোনো ‘ট্রানশ ১’ বিমানগুলি সফটওয়্যার সীমাবদ্ধতার কারণে শুধু ব্রিটেনের আকাশ প্রতিরক্ষার কাজ করে; যার ফলে অপেক্ষাকৃত নতুন মাল্টিরোল বিমানগুলিকে বিশ্বব্যপী মোতায়েন করা যাচ্ছে। ‘ট্রানশ ১’ বিমানগুলিকে আপগ্রেড করতে খরচ অনেক বেশি হবে বিধায় এগুলিকে আগের মতোই রেখে দেয়া হয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকার বিমান বাহিনীর ‘সি ১৩০’ পরিবহণ বিমানগুলিকেও বাদ দিচ্ছে ২০২১ সালের মাঝে। বর্তমানে এধরণের ১৪টা বিমান রয়েছে রয়াল এয়ার ফোর্সে। এই বিমানগুলির মেইনটেন্যান্সের দেখাশুনা করতো ‘মার্শাল এরোস্পেস এন্ড ডিফেন্স গ্রুপ’। কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন যে, ব্রিটিশরা বিমানগুলিকে বাদ দিলে বেশ কিছু কর্মী কর্মসংস্থান হারাতে পারে। ‘সি ১৩০’ বিমানের কাজগুলি চালিয়ে নেবে নতুন ‘এ ৪০০এম’ এবং ‘সি ১৭’ পরিবহণ বিমান। এছাড়াও ব্রিটিশ সরকার আগাম সতর্কীকরণ ও আকাশ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ৩টা ‘ই ৩ডি সেন্ট্রি’ বিমানকে ২০২১ সালেই রিটায়ার করিয়ে দিচ্ছে। এই বিমানগুলি প্রকৃতপক্ষে ‘বোয়েইং ৭০৭’ বিমানের উপর বড় আকৃতির অত্যাধুনিক রাডার। এগুলিকে ২০২৩ সালে প্রতিস্থাপন করবে ‘ই ৭এ ওয়েজটেইল’ বিমান। ‘ওয়েজটেইল’ বিমানগুলি ‘বোয়েইং ৭৩৭’ বিমানের উপর ভিত্তি করে তৈরি। বাজেট কমাবার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ৫টা ‘ওয়েজটেইল’ বিমান থেকে কমিয়ে এখন ৩টা বিমান ক্রয় করছে। পুরোপুরিভাবে নতুন বিমান তৈরি না করে পুরোনো বিমান পরিবর্তন করে এগুলি তৈরি করা হবে। ‘ফ্লাইট গ্লোবাল’ বলছে যে, এর ফলে দুই বছরের জন্যে ব্রিটেনের আকাশসীমা রক্ষা করার জন্যে কোন সতর্কীকরণ বিমান থাকবে না। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, আগাম সতর্কবার্তা পাবার জন্যে তারা শুধুমাত্র বিমানের উপর নির্ভর করবে না। তারা ২০২২ সাল থেকে গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের আকাশসীমায় প্রতিপক্ষের বিমান ঢোকার আগেই আগাম সতর্ক করতে পারবে।
ছবিঃ গত নভেম্বরে উদ্ভোধন হলো ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল সাইবার ফোর্স’। সাইবার প্রতিরক্ষাকে নীতিপত্রে অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সাইবার সক্ষমতা বাড়াবার কারণ হিসেবে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলছেন যে, একুশ শতকে আকাশ থেকে বোমা ফেলার চাইতে সাইবার হামলা বা ‘এআই’ ও ড্রোনএর যথেচ্ছ ব্যবহার বেশি হুমকির সৃষ্টি করবে। সেকারণেই তারা সাইবার এবং ‘এআই’ ছাড়াও বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে চাইছে।



বৈশ্বিক কৌশলগত অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে চায় ব্রিটেন

নতুন সমন্বিত নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের কূটনৈতিক মিশনগুলিতে প্রতিরক্ষা এটাশের সংখ্যা বাড়ানো হবে। পররাষ্ট্র কর্মকান্ডে প্রতিরক্ষা স্টাফদের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি করা হবে। বিদেশে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলিকে আরও শক্তিশালী করা হবে। জিবরালটার এবং সাইপ্রাস ছাড়াও ওমান, সিঙ্গাপুর এবং কেনিয়াতে ব্রিটেন তার সামরিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে। সেনাবাহিনীতে ট্যাঙ্কের সংখ্যা কমালেও জার্মানিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবস্থান শক্ত করতে সরঞ্জাম স্টোরেজে বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে ব্রিটেন বল্টিক সাগরের দেশগুলিতে এবং পোল্যান্ডে তার নৌবাহিনীকে নিয়মিত মোতায়েন করবে এবং বিমান বাহিনী বল্টিকের আকাশে প্যাট্রোল অব্যহত রাখবে। এই কাজগুলি মূলতঃ রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যেই করা হবে। বলকান, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন এবং ইন্দোপ্যাসিফিকের দেশগুলিকে সামরিক সহায়তা দেবার কথাও বলা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের ঘাঁটি, স্পেশাল ফোর্সেস, সাইবার প্রতিরক্ষা, সামরিক ইন্টেলিজেন্স, সামরিক তথ্যের নিরাপত্তা, এবং বিশ্বব্যাপী তাদের সামরিক অপারেশন সমন্বয় করার জন্যে রয়েছে ‘স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড’। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী সকল সামরিক কর্মকান্ডকেই তারা কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখছে। এই কমান্ডের অধীনে সাইপ্রাস, ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ, জিবরালটার এবং ভারত মহাসাগরে দিয়েগো গার্সিয়ায় স্থায়ী ঘাঁটি পরিচালিত হয়। গত নভেম্বরে এই কমান্ডের অধীনে ‘ন্যাশনাল সাইবার ফোর্স’ উদ্ভোধন করা হয়। ‘স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড’এর প্রধান জেনারেল প্যাট্রিক স্যানডার্স ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বলেন যে, যারা ব্রিটেনের ক্ষতি করতে চায়, তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা এবং অবকাঠামো অচল করা বা ধ্বংস করে দেবার সক্ষমতা ব্রিটিশ সাইবার ফোর্সের রয়েছে। ‘স্কাই নিউজ’ বলছে যে, জেনারেল স্যানডার্স না বললেও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বলতে প্রতিপক্ষের বিদ্যুৎ গ্রিড, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই ও বিল্ডিংকেই বোঝানো হয়েছে। জেনারেল স্যানডার্স তার বক্তব্যে ব্রিটিশ সাইবার নেটওয়ার্কের উপর প্রতিনিয়ত হামলার ব্যাপারটাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিমান বাহিনীর ব্রিটেনের উপর হামলার সাথে তুলনা করেন। তিনি বলেন যে, ব্রিটিশ সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে প্রতিদিন ৬০টা বড় রকমের হামলা প্রতিরোধ করে থাকে।

সাইবার প্রতিরক্ষাকে নীতিপত্রে অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘হারভার্ড কেনেডি স্কুল’এর ‘বেলফার সেন্টার’এর গবেষণায় ব্রিটেন বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী সাইবার রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরেই ব্রিটেনের স্থান। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল নিক কার্টার বলেন যে, বর্তমানে সাইবার যুদ্ধ থেকে শুরু হয়ে কোন একটা সংঘর্ষ সর্বাত্মক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে। সাইবার যুদ্ধের গুরুত্ব বোঝাতে ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় ‘মাইক্রোসফট’ কোম্পানিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি সায়মন মেহডিয়ান স্টাফেল চেষ্টা করেছেন। তিনি বলছেন যে, বেসামরিক অর্থনীতি থেকে এখন প্রতিরক্ষাকে আলাদা করাটাই কঠিন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলছেন যে, ২০১২ সালে চালু হওয়া একটা গেমিং সফটওয়্যার তৈরির ব্যবসা এখন সামরিক বাহিনীর জন্যে বহু ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করছে। তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর এত দ্রুত ডেভেলপ করছে যে, এখন প্রতিরক্ষা বাজেটের উপর ভিত্তি করে কর্মক্ষমতা নির্ধারণের সীমাবদ্ধ চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি বলছেন যে, নির্দিষ্ট বাজেটের মাঝে যতটা সম্ভব সক্ষমতা ক্রয় করার চিন্তা এখন অতীত। কারণ শুধু বাজেট বাড়িয়ে সাইবারস্পেসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে জেনারেল স্যানডার্স বলেন যে, সাইবার সক্ষমতা বাড়াতে তিনি বেসামরিক জনগণের মাঝ থেকে দক্ষ ব্যক্তিদেরকে মধ্যম বা উঁচু সাড়ির সামরিক পদে সরাসরি নিয়োগ দিতে চান। এরকম ব্যক্তিরা যেকোন সময় সামরিক সার্ভিসে ঢুকতে পারবে; আবার বের হয়ে যেতেও পারবে। তিনি ইস্রাইলের রিক্রুটিং ব্যবস্থাকে হিংসা করেন; কারণ তারা বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিস ব্যবহার করে অনেক বড় জনগোষ্ঠী থেকে সাইবার বিশেষজ্ঞ রিক্রুট করতে পারে। তিনি বলেন যে, উচ্চ বেতনের বেসরকারি চাকুরির সাথে এই কাজের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে এই ব্যক্তিরা কোন গেমের এভাটার নয়, বরং সত্যিকারের শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে; যা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। সাইবার শক্তি ধরে রাখার ক্ষেত্রে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মাঝে রয়েছে ব্রিটেন। ‘ডিপার্টমেন্ট অব কালচার, মিডিয়া এন্ড স্পোর্ট’এর হিসেবে ২০২০ সালে ব্রিটেনে সাইবার সেক্টরে ১০ হাজার দক্ষ জনবলের ঘাটতি ছিল। ব্রিটিশ ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘জিসিএইচকিউ’ বর্তমানে ‘নিউরোডাইভার্স’ বা মানসিক প্রতিবন্ধীদের মাঝ থেকে সাইবার সক্ষমতার ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ‘জিসিএইচকিউ’এর সফলতাকে অনুসরণ করতে চাইতে সামরিক বাহিনী।

এছাড়াও গত ১২ই মার্চ ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দেয় যে, এবছরের মাঝেই ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এআই’এর সক্ষমতা বাড়াবার জন্যে একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তারা। ব্রিটিশ ডিজিটাল সেক্রেটারি অলিভার ডাউডেন বলেন যে, ‘এআই’এর মূল ফোকাস হবে এর ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে বৃদ্ধি করা, এর সঠিক ডেভেলপমেন্টের দিকে আগানো এবং দক্ষ জনবল তৈরি করা। গত জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা ‘এআই কাউন্সিল’ একটা ‘এআই রোডম্যাপ’ তৈরি করে।
ছবিঃ ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর উপর যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত ‘এফ ৩৫বি’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান। প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্রিটেন এখন অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। অন্য দেশের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা আপাতঃদৃষ্টিতে চতুর মনে হলেও পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক চিন্তার অধঃপতনের মাঝে এর সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।


গ্লোবাল ব্রিটেনের কৌশলগত চিন্তা

ব্রিটেন মনে করছে না যে, ২০৩০ সালের মাঝে বড় কোন যুদ্ধে তাকে জড়াতে হবে। বরং ছোটখাটো আঞ্চলিক সংঘাতই তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। স্পেশাল ফোর্সের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের সমর্থনে নৌবাহিনীর নতুন সাপোর্ট জাহাজ এই কৌশলেরই অংশ। তাই ট্যাঙ্ক এবং সামরিক বিমানের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পিছপা হচ্ছে না তারা। একইসাথে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তায় ব্রিটেন কমনওয়েলথের সদস্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে একত্রে নিয়ে কাজ করতে চাইছে। এছাড়াও তার কূটনৈতিক সক্ষমতা বাড়াবার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে অন্য দেশের সামরিক সক্ষমতাকেও নিজেদের পক্ষে কাজ করাতে চাইছে তারা। সামরিক সহায়তা দেবার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপ এবং ইন্দোপ্যাসিফিকের দেশগুলিকে তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজে লাগাচ্ছে তারা। অপরদিকে সাইবার সক্ষমতা বাড়াবার কারণ হিসেবে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলছেন যে, একুশ শতকে আকাশ থেকে বোমা ফেলার চাইতে সাইবার হামলা বা ‘এআই’ ও ড্রোনএর যথেচ্ছ ব্যবহার বেশি হুমকির সৃষ্টি করবে। সেকারণেই তারা সাইবার এবং ‘এআই’ ছাড়াও বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে চাইছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার সুযোগ নিতে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর বিশ্বব্যাপী অবস্থানকে আরও সুসংহত দেখতে চাইছে তারা। ইন্দোপ্যাসিফিকে নতুন করে সামরিক ঘাঁটি তৈরি এবং তাদের একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করাটা এই কৌশলেরই অংশ। তবে ব্রিটেনের সমস্যা তার অপ্রতুল সম্পদ। ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের এসকর্ট হিসেবে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ছাড়াও থাকবে ডাচ এবং মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। জাহাজের ডেকে যে ‘এফ ৩৫বি’ যুদ্ধবিমান থাকবে, তার কিছু ব্রিটিশ; বাকিগুলি মার্কিন ম্যারিন কোরের। সামরিক বাহিনীতে কাজ করাবার জন্যে যথেষ্ট জনবল খুঁজে পাচ্ছে না ব্রিটেন। আবার নিজেদের আদর্শিক চিন্তাকে সমুন্বত রাখতে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে কাউকে সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে বাধ্যও করতে পারছে না তারা। প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্রিটেন এখন অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। অন্য দেশের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা আপাতঃদৃষ্টিতে চতুর মনে হলেও পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক চিন্তার অধঃপতনের মাঝে এর সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

No comments:

Post a Comment