Sunday 2 May 2021

আফগানিস্তান ... যুক্তরাষ্ট্রের পর...

০২রা মে ২০২১


২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলীকে পুঁজি করে প্রায় দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই সামরিক অভিযান শেষ করার বহু চেষ্টার পর অবশেষে গত ১৪ই এপ্রিল আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন এবং পশ্চিমা সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ঘোষণা মোতাবেক আগামী ১১ই সেপ্টেম্বরের মাঝে সকল সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হবে। মার্কিনীদের আফগানিস্তান ত্যাগের সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে, তা নিয়ে ব্যাপক জল্পনা কল্পনা চলছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন নিশ্চয়তা না দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে। ‘কাবুল ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ফাইজ জালান্দ ‘সিজিটিএন’কে বলছেন যে, শান্তি আলোচনা চললেও বাস্তবিকপক্ষে আফগানিস্তানে কোন শান্তি নেই। আলোচনার টেবিলে এগিয়ে থাকার জন্যে সকল পক্ষই আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে। তিনি মনে করছেন না যে, শান্তি প্রক্রিয়ায় খুব বেশি একটা আশা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রায়নের নামে দুর্নীতিবাজ এবং অপরাধপ্রবণ লোকদের উপর বিনিয়োগ করেছে। আফগানরা বেশিরভাগই তালিবানের পক্ষে না থাকলেও আফগান সরকারকে সমর্থন দেয় না। আর যুদ্ধের মাঝে গণহত্যা ও মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ করার কারণে তারা মার্কনীদেরকেও বিশ্বাস করে না। আফগান রাজনীতিবিদ ইহসানুল্লাহ সেদিকের মতে দেশটাতে বহু রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে ক্ষমতা দখলের জের ধরে নতুন করে গৃহযুদ্ধ লাগতে পারে। আর মার্কিনী সেনারা তো আফগানিস্তানের মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে সন্মান করার জন্যে প্রশিক্ষিতই হয়নি। তাদের সমর্থিত সরকারও আফগান সাধারণ জনগণ এবং তালিবানের মাঝে কোন পার্থক্য খুঁজে পায়নি। গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র আফগান জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সরকার দিতে পারেনি। জাতিসংঘের হিসেবে ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১২ই এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসের তিনজন রিপাবলিকান সদস্য মাইকেল ওয়াল্টজ, লিজ চেনি এবং স্কট ফ্রাঙ্কলিন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেনের কাছে এক চিঠিতে লেখেন যে, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স বারংবার সাবধান করেছে যে, মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ালে তালিবান এবং অন্যান্য অস্ত্রধারী গ্রুপগুলি নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করবে।

মার্কিন সহায়তা ছাড়া আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা কতদূর?

মার্কিনীরা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবার পর আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী কতদিন নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। বাইডেন সরকারের কাছে অবশ্য এর উত্তর রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ‘এবিসি’ টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাতে বলেন যে, মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবার পর আফগান সামরিক বাহিনী শহরাঞ্চলগুলি ধরে রাখার সক্ষমতা রাখে। এটা যথেষ্ট শক্তিশালী একটা বাহিনী। আর মার্কিনীরা আফগানদের বিভিন্ন সহয়াতা দিতে থাকবে। তবে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন বাহিনী থাকা অবস্থাতেই আফগানিস্তানের বিশাল এলাকা তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আফগান সেনাবাহিনীর অনেক সেনাসদস্যই অনেক বছর ধরে নিজেদের গ্রামে ফেরত যেতে পারছে না; কারণ তালিবানরা সেই গ্রামগুলির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আফগান সেনাবাহিনী যথেষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ এবং ইতোমধ্যেই প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরুদ্দেশ হয়েছে। কাগজে কলমে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩ লাখের বেশি হলেও বাস্তবে তা অনেক কম। কারণ অনেক অফিসার মৃত বা অনুপস্থিত অফিসারদের বেতন ভোগ করছে। এছাড়াও সামরিক অপারেশনে উচ্চ হতাহতের সংখ্যা এবং নতুন রিক্রুট পেতে হিমসিম খাওয়ায় বাহিনীর সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে কমপক্ষে ২’শ ৮৭ জন সেনা নিহত এবং ১’শ ৮৫ জন সেনা আহত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৯ থেকে ১০ জন আফগান সেনা প্রাণ হারাচ্ছে। ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে যেখানে সাড়ে ৩ হাজার পশ্চিমা সেনা নিহত হয়েছে, সেখানে প্রায় ৬৬ হাজার আফগান সেনা প্রাণ হারিয়েছে। বহু সেনা আহত অবস্থায় বেঁচে আছে। বেসামরিক মানুষ হতাহতের তো হিসেবই নেই। আফগানিস্তানের উত্তরে উজবেক ও তাজিক জাতিগোষ্ঠির লোকদের মাঝ থেকে পুশতুন তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে বেশি রিক্রুট পাওয়া যেতো। কিন্তু একসময় যেখানে মাসে ৩ হাজার রিক্রুট পাওয়া যেতো, তা এখন মাসে ৫’শতে দাঁড়িয়েছে। অতি কম বেতনে ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে অনেকেই নাম লেখাতে চাইছে না। সরকারি কর্মকর্তারা এবং বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বেতনের একটা বড় অংশ নিজেদের পকেটে পুরে নিচ্ছেন। শুধুমাত্র অতি দরিদ্র লোকেরাই সামরিক বাহিনীতে নাম লেখাচ্ছে। বাইডেনের সিদ্ধান্তের বহু বছর আগ থেকেই মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, এত উচ্চ হতাহতের সংখ্যা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তান ধরে রাখা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ইউনিটে গোলাবারুদের সরবরাহও যথেষ্ট অপ্রতুল। এদের বিপক্ষে রয়েছে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তালিবান; যাদের বেশিরভাব অস্ত্রই আফগান সরকারকে মার্কিনীদের সরবরাহ করা। যুদ্ধের মাঝে অনেক সময়েই আফগান সামরিক অফিসাররা নিজেদের অবস্থান তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে পিছু হটেছে। অনেকেই বাহিনী ছেড়ে পালিয়েছে।

আফগান সামরিক বাহিনীতর জন্যে রিক্রুট পাওয়া কঠিন হওয়ায় বিভিন্ন আঞ্চলিক জাতিগত ও রাজনৈতিক গ্রুপের অধীন মিলিশিয়াগুলির গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে। এই মিলিশিয়াগুলি সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরকেও রিক্রুট করছে। ক্ষয়ক্ষতি এবং মেইনটেন্যান্স সাইকেলের মাঝে পড়ে আফগান বিমান বাহিনীর অনেক বিমানই কর্মক্ষম অবস্থায় নেই। কম বিমান সার্ভিসে থাকায় শুধুমাত্র স্পেশাল ফোর্সের সেনাদেরকে আকাশ থেকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আফগান বাহিনীর হাতে কিছু ড্রোন থাকলেও তা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ব্যাতীত বাকি স্থানে মোতায়েন করা সম্ভব হচ্ছে না। আফগান বিমান বাহিনীর বিমানগুলি ডাক দেবার পর যতক্ষণে সাড়া দিচ্ছে, ততক্ষণে তালিবানরা এলাকা ছেড়ে গেছে। আর তখন বিমান হামলা নয়; বরং দরকার এয়ার এম্বুল্যান্স।

এছাড়াও আফগানরা এবং মার্কিনীরা একে অপরকে কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি। মার্কিন সেনারা নিয়মিতভাবেই আফগান সেনাদের হাতে হতাহত হয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, আফগান সেনাদের মার্কিনীরা সর্বদাই দ্বিতীয় সাড়ির বাহিনী হিসেবে দেখেছে। এই সেনারা এতটাই কম বেতন পায় যে, তাদের রাইফেলের মূল্য তাদের কয়েক মাসের বেতনের সমান। এমনকি একই মিশনে আহত হবার পর মার্কিন সেনারা বিশ্বমানের মেডিক্যাল সুবিধা পেলেও আফগান সেনাদের দেয়া হয়েছে নিম্নমানের সেবা। আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনীর পিছনে মার্কিনীরা ৭০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসস্ত্র এবং ট্রেনিং খরচ করেছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাহিনীর করুন দশা দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে, সেই অর্থ আসলে কোথায় ব্যয় হলো। আফগান বাহিনীকে প্রতিশ্রুত সামরিক গাড়ির বেশিরভাগই সরবরাহ করা হয়নি। সেনা কমান্ডাররা কালোবাজার থেকে স্নাইপার রাইফেল কিনছে। সেনারা দরকারের বেশি বুলেট ছুঁড়ছে; যাতে করে বুলেটের খোসাগুলি বিক্রি করে কিছু আয় করা যায়। বিভিন্ন ইউনিটে সোভিয়েত আমলের সাঁজোয়া যান দিয়েই কাজ সাড়ছে আফগান সেনারা। সেনারা অনেকেই তাদের নাইট ভিশন গিয়ার বিক্রি করে দিয়েছে অর্থের জন্যে। আর অপরদিকে সেই নাইট ভিশন গিয়ার কাজে লাগিয়েই তালিবানরা রাতের বেলায় হামলা করছে আফগান বাহিনীর উপর। এত করুন দশাতেও আফগান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল ইয়াসিন জিয়া বলছেন যে, তারা বেঁচে থাকার কোন না কোন পদ্ধতি বের করবেন।

মার্কিনীদের আফগান বন্ধুদের কি হবে?

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর এক লেখায় সিনিয়র ফেলো কেমাল কিরিশচি এবং ‘ইস্তাম্বুল য়িলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি’র ফুলিয়া মেমিসোগলু বলছেন যে, মার্কিনীরা আফগানিস্তান ছেড়ে গেলে একটা বড় ধরনের উদ্বাস্তু পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। তারা বলছেন যে, ২০১৫ সালে সিরিয়া যুদ্ধের কারণে লাখো উদ্বাস্তু যখন ইউরোপমুখে যাত্রা করে, তখন ইইউএর ভিতই নড়ে গিয়েছিল। সেটা মূলতঃ হয়েছিল ২০১১ সালে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর ইরাক এবং সিরায়াতে ব্যাপক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে বাস্তুহারা হতে হয়। আফগানিস্তান থেকে মার্কিনীরা সড়ে আসার পর যদি এমনই কোন উদ্বাস্তু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও দুর্বল হবে।

‘দি আটলান্টিক’এর এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, যে আফগানরা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছে, তাদেরকে ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে কি? উত্তরে বলা হচ্ছে যে, বিভিন্ন দেশে জনবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়ার এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষে মার্কিনীদের সমর্থন দেয়া লাখো মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে মার্কিনীদের কাছে সাহায্য চায়। জেরাল্ড ফোর্ডের রিপাবলিকান সরকার যখন ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ভিয়েতানামীকে উদ্ধ্বার করে নিয়ে আসার জন্যে কংগ্রেসের কাছে ৩’শ মিলিয়ন ডলার চায়, তখন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। সেসময় বিরোধিতাকারী ডেমোক্র্যাটদের মাঝে ছিলেন ডেলাওয়্যার রাজ্যের ৩২ বছর বয়সী সিনেটর জো বাইডেন। তিনি বলেছিলেন যে, মার্কিন সেনাদের সরিয়ে আনার জন্যে তিনি যেকোন আকারের বাজেটের পক্ষপাতি ছিলেন; কিন্তু ভিয়েতনামীদের সরিয়ে আনার জন্যে নয়। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড তার জবাবে বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একসময় হাঙ্গেরিয়ান, কিউবান, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইহুদীদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দিয়েছিল। এখানে ভিয়েতনামীদেরকে কেন অন্য চোখে দেখা হবে? ডেমোক্র্যাটরা এতেও তাদের অবস্থান থেকে নড়েনি। বাইডেন সিনেটে তার বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের এক লক্ষ কেন, একটা মানুষকেও বের করে নিয়ে আসার দায়বদ্ধতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঠিক ভিয়েতনামের মতোই ১৭ হাজার আফগান যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাবার জন্যে লাইন ধরে আছে। এই ব্যক্তিরা বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে কতটা সহায়তা পাবে, তা এখন কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

গত ১৬ই এপ্রিল প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্যে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ১৫ হাজারের মাঝে নিয়ন্ত্রিত রেখে নির্দেশ স্বাক্ষর করেন। আবার এই ১৫ হাজারের মাঝে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কতজন আসতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করা আছে। মূলতঃ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন ইতিহাসের সর্বনিম্ন এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছিলেন। বাইডেন এর মাধ্যমে সাড়ে ৬২ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেবার পরিকল্পনা বাতিল করলো। তবে হোয়াইট হাউজ বলছে যে, ১৫ই মেএর মাঝে আরও বড় একটা সংখ্যার অনুমোদন দিতে পারেন বাইডেন। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বাইডেন পরবর্তী অর্থ বছরের জন্যে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১ লক্ষ ২৫ হাজার করতে চেয়েছিলেন। ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া অকাসিও কর্তেজ এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। বাইডেন অভিবাসীদের আসতে দেবেন, সেই আশাতেই জনগণ তাকে ভোট দিয়েছিল। আরেক ডেমোক্র্যাট প্রমিলা জয়পাল বাইডেনের এই সিদ্ধান্তকে বিবেকহীন বলে আখ্যা দিয়েছেন। রিপাবলিকানরা বলছেন যে, ২০২২ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভালো করার উদ্দেশ্য নিয়েই বাইডেন অভিবাসী আসা কমাতে চাইছেন।

মধ্য এশিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাটা আসলে কি?

মধ্য এশিয়াকে বাদ দিয়ে আফগানিস্তানের চিন্তা করাটা ঠিক নয়। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার স্থলবেষ্টিত দেশগুলির সমুদ্রে পৌঁছাবার করিডোর হিসেবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে; যা কিনা যুদ্ধের কারণে কখনোই বাস্তবায়িত করা যায়নি। পাকিস্তানের গোয়াদর সমুদ্রবন্দর থেকে চীনের সীমানা পর্যন্ত নির্মাণাধীন ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিপেক’এর সাথে আফগানিস্তানকে যুক্ত করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সম্পদকে সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে আসার চিন্তা করছেন পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও মধ্য এশিয়ার খনিজ সম্পদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা হলো চীন। ‘ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম’এর হিসেবে চীনের মোট গ্যাস আমদানির প্রায় ৩৮ শতাংশই আসে মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান থেকে। একইসাথে মধ্য এশিয়ার রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চীনারা ইউরোপের সাথে বাণিজ্য করছে। একারণে মধ্য এশিয়ায় চীনা বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। আর বিনিয়োগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়াতে রুশ প্রভাবকে চীন অনেকটাই প্রতিস্থাপিত করছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘নিউলাইন্স ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসি’র ডিরেক্টর কামরান বোখারি ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলের মাঝে মধ্য এশিয়া একটা অন্ধকার কূপের মতো; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি খুবই কম। তিনি মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। মধ্য এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বৈশ্বিক নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের চাবি হতে পারে। মার্কিনীদের ছেড়ে আসার পর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতাকে ধরে রাখতে বিশেষ করে কাজাকস্তানের কথা বলছেন তিনি। তার মতে, ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে কাজাকস্তান একইসাথে তুরস্ক এবং ইরানের উচ্চাকাংক্ষাকে ব্যালান্স করতে কাজ করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পর...

বিশ্বের সবচাইতে বড় সামরিক শক্তি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র দুই দশকে আফগানদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। উল্টো এই দুই দশকে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও মার্কিন সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা হ্রাসে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে আফগানিস্তান। দুই দশক পাহাড়ের পাদদেশে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর তারা হঠাত করেই আবিষ্কার করেছে যে, চীন ও রাশিয়ার সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার জন্যে তারা প্রস্তুত নয়। প্রফেসর ফাইজ জালান্দ বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছে; কিন্তু কেউ তো আর পরাজয় স্বীকার করে না। মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানের পর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা রাখার স্বার্থ থাকবে পাকিস্তান, তুরস্ক এবং রাশিয়ার। পাকিস্তান চাইছে আফগানিস্তানের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার সাথে যুক্ত হতে। এতে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। মধ্য এশিয়ার দেশগুলিও আফগানিস্তানের মাঝ দিয়ে ভারত মহাসাগরে পৌঁছাতে চাইছে। ফলশ্রুতিতে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার সাথে তুরস্ক ও পাকিস্তানের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা বাড়বে। তবে আফগানিস্তানকে স্থিতিশীল দেখাটা রাশিয়ার জন্যেও নিরাপত্তার প্রশ্ন; যা এই দেশগুলিকে একটা সমঝোতার দিকে হাঁটাবে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে না জড়িয়ে মধ্য এশিয়াতে এই শক্তিগুলির মাঝে একটা ব্যালান্স দেখতে চাইবে।

4 comments:

  1. আফগানিস্তানে বর্তমানে বিভিন্ন দেশের নাগরিক মার্কিন সেনাবাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করছে। মার্কিন সেনারা ফিরে গেলে তখন তারা কি করবে? তারা কি নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আফগানিস্তান এবং ইরাকে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রধানতম উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিম দেশগুলি সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করা। এই দেশগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পর বিভিন্ন দেশ থেকে যোদ্ধারা আসবে এবং পরবর্তীতে সেই যোদ্ধাদের পিছন পিছন মার্কিন ড্রোন ও বোমারু বিমানগুলিও সেই দেশগুলিতে যাবে - সেইরকমই একটা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং ইরাক-সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্কের সামরিক শক্তি ধ্বংস না হওয়ায় সেই উদ্দেশ্য যে বাস্তবায়ন করা যায়নি, তা বোঝা যাচ্ছে। তাই বাকি মুসলিম দেশগুলির সামরিক শাক্তিও ধ্বংস হয়নি।

      পশ্চিমাদের আদর্শিক চিন্তা যেমন নিম্নগামী, তেমনি তাদের কর্মকান্ডও আশানুরূপ ফলাফল দিচ্ছে না। নিজেদের পুঁজিবাদী আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতেই তারা মুসলিম দেশগুলির সামরিক শক্তি ধ্বংস করতে চেয়েছিল; যদিও প্রতিটা মুসলিম দেশই বর্তমানে সেকুলার সংবিধান অনুসারে চলছে। কারণ পশ্চিমারা জানে যে, এই দেশগুলির সামরিক বাহিনীই একসময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে; তখন তাদের মহাবিপদ হবে। সেই অবস্থা ঠেকাতে গিয়েই তারা আফগানিস্তান ও ইরাকে ঢুকেছিল। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত তো হয়ই নি, বরং চীনের আবির্ভাবে তাদের মাথাব্যাথা অন্যদিকে ধাবিত করতে বাধ্য হয়েছে। এখন তারা চেষ্টা করছে যাতে চীন মুসলিম দেশগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা না দেয়।

      Delete
  2. কিন্তু বেশীরভাগ মুসলিম দেশের সামরিক বাহিনীর অবস্থা তথইবচ। এখন কম্পিউটার আর সাইবার স্পেসে দক্ষ না হলে শুধু ট্যাংক-বিমান নিয়ে যুদ্ধ করা মানে পরাজয় বরন করা। এক্ষেত্রে তুরস্ক, ইরান এর মত কিছু দেশ উন্নত। ইন্দোনেশিয়া,সউদি আরব,পাকিস্তানের মত কিছু দেশের বৃহৎ সামরিক কারখানা রয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে এরা কি এদের প্রযুক্তি দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্রের কাছে বা একে অপরের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এখানে আগে বুঝতে হবে যে, পঞ্চাশের অধিক মুসলিম দেশ কিসের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। এই দেশগুলির সবগুলিই তৈরি করেছে ইউরোপিয়রা এবং এদের ভিত হলো সেকুলার সনবিধান এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি হলো সেকুলার জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদই ইউরোপিয়দের এঁকে দেয়া বাউন্ডারিগুলিকে এখনও রক্ষা করে চলেছে। এই জাতীয়তাবাদী ভিত্তিতে এরা সর্বদাই পশ্চিমাদের কথায় উঠবে আর বসবে।

      পশ্চিমাদের ভয় হলো এই রাষ্ট্রগুলির সম্পদ, বিশেষ করে সামরিক শক্তি যাতে কোন আদর্শিক শক্তির কাছে চলে না যায়, যা কিনা পশ্চিমা সেকুলার পুঁজিবাদী আদর্শকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলতে পারে।

      Delete