Sunday 18 April 2021

পূর্ব ইউক্রেনে কি চাইছেন পুতিন?

১৮ই এপ্রিল ২০২১

সাত বছর আগে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে তার সামরিক শক্তি প্রেরণ করে তা অস্বীকার করেছিল; এখনও করছে। সেটা ছিল রাশিয়া গোপন অপারেশন। কিন্তু এবারে রুশরা বড়সর আয়োজন করে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করছে। রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সামনে ভালবাসার বস্তু হিসেবে আবির্ভূত হবার আশা ছেড়ে দিয়েছে; বরং তারা চাইছে যে, পশ্চিমারা রাশিয়াকে ভয় করুক। রাশিয়া এবারে সৈন্য পাঠায়নি; বার্তা পাঠিয়েছে।


এপ্রিলের শুরু থেকেই ইউক্রেনের সীমান্তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী মোতায়েনের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। অনেকেই একে নতুন করে সহিংসতা শুরুর আভাস হিসেবে দেখছেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইম’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কয়েক বছর ধরে এই সুপ্ত অবস্থায় থাকার পর গত মার্চ মাস থেকেই পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর সাথে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘাত হঠাত করেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে রুশ সৈন্য সমাবেশ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সৈন্য সমাবেশের উদ্দেশ্য কি? রাশিয়া বলছে যে, ইউক্রেনের সীমান্তে রুশ সামরিক বাহিনী মোতায়েনের পিছনে মূল কারণ হলো ইউক্রেনের মাটিতে ন্যাটোর সামরিক মহড়া এবং হুমকি। রুশ সরকারি টেলিভিশনে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বক্তারা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর শত্রুতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। এই উত্তেজনার মাঝেই ১৩ই এপ্রিল হোয়াইট হাউজ বলে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে কয়েক মাসের মাঝে তৃতীয় কোন দেশে দু’জনের এক শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন। অনেক ইস্যুর মাঝে বাইডেন ইউক্রেনের বিষয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন যে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধ পরিকর। একই দিনে ক্রেমলিন থেকেও এই ফোনালাপের কথা স্বীকার করা হয়। ‘ডয়েচে ভেলে’র সাংবাদিক এবং রাশিয়া বিশ্লেষক কনস্টানটিন এগার্ট ‘বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, বাইডেন ও পুতিনের এই খেলায় বাইডেনই প্রথম চোখের পলক ফেলেছেন। বাইডেন কিছুদিন আগেও পুতিনকে ‘খুনি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন যে, এখন ফোন করে তিনি কি দুর্যোগ আটকালেন, নাকি বড় কোন ছাড় দিলেন? তবে শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা রুশ সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। কারণ তা পুতিনের জন্যে রাষ্ট্রনায়কোচিত হবে না। তবে যেহেতু বাইডেন প্রথমে এই বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাই পুতিন সেক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন।

পুতিনের সাথে বাইডেনের ফোনালাপের পরদিন তুর্কি কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানায় যে, যুক্তরাষ্ট্র বসফরাস প্রণালী অতিক্রমের জন্যে দু’টা মার্কিন যুদ্ধজাহাজের জন্যে যে অনুমতি চেয়েছিল, তা তারা বাতিল করেছে। এর পাঁচদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র এই অনুমতি চেয়েছিল। অর্থাৎ কৃষ্ণ সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন আপাততঃ বাতিল করা হয়েছে। তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, সামনের দিনে নতুন করে কোন যুদ্ধজাহাজের বসফরাস অতিক্রমের অনুমতিও চাওয়া হয়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, তুরস্কের কর্মকর্তারা হয়তো বুঝতে পারেননি যে, জাহাজগুলি মোতায়েন করার সিদ্ধান্তটা কখনোই নিশ্চিত করা হয়নি। অপরদিকে তুরস্ক বলছে যে, মার্কিনীরা ১৫ দিন আগেই ‘মনট্রিউ কনভেনশন’ অনুযায়ী তুর্কি সরকারকে জানিয়েছিল যে, জাহাজগুলি ১৪ বা ১৫ই এপ্রিল বসফরাস অতিক্রম করবে এবং ৪ঠা মে পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগরে থাকবে। ১৯৩৬ সালের এই কনভেনশন অনুযায়ী কৃষ্ণ সাগরের দেশ নয় এমন কোন দেশ কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করতে গেলে কমপক্ষে ৮ দিন আগে তুরস্ককে জানাতে হবে। আর একসাথে ৯টার বেশি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা যাবে না; যেগুলি সর্বমোট ১৫ হাজার টনও অতিক্রম করতে পারবে না। আর একটা জাহাজ ১০ হাজার টনের চাইতে বেশি বড় হতে পারবে না। বিদেশী যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণ সাগরে ২১ দিনের বেশি থাকতে পারবে না। তবে রাশিয়া নিজেই সাম্প্রতিককালে এই কনভেশনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।

‘মস্কো স্টেট ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’এর প্রফেসর মিখাইল ট্রইটস্কির মতে, রাশিয়া পশ্চিমাদের সাথে পুরো ভূরাজনৈতিক খেলাটাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে চাইছে। বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের জবাব দিতে চাইছে রাশিয়া। পশ্চিমারা যেমন বলছে যে, রাশিয়ার কর্মকান্ডের জন্যে তাদেরকে মূল্য দিতে হচ্ছে, তেমনি রাশিয়াও বলতে চাইছে যে, তারাও পশ্চিমাদের কর্মকান্ডের উপর মূল্য নির্ধারণ করতে পারে; যদিও এতে রাশিয়ার উপর অবরোধ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘রাশান ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স কাউন্সিল’এর প্রধান আন্দ্রেই করতুনোভের কথায় রাশিয়ার জনগণ এখন তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়েই জর্জরিত। করোনাভাইরাস, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন রাশিয়ার অর্থনীতিকে ব্যাপক ক্ষতির মাঝে ফেলেছে। এমতাবস্থায় একটা বড় সামরিক মিশন রাশিয়ার জন্যে বাহুল্যই বটে।

করতুনোভ বলছেন যে, ইউক্রেন সরকার পূর্বের সীমান্ত অঞ্চলে নিজেদের সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। রুশরা সীমান্তে সামরিক শক্তি মোতায়েন করে ডনবাসে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর নতুন করে যুদ্ধ শুরুর চিন্তাকে প্রতিহত করতে চাইছে। মার্কিন এবং ইউরোপিয়রা সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাটা রাশিয়ার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে করতুনোভ মনে করছেন যে, রাশিয়া খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেন আক্রমণ করবে না। কারণ রুশ কৌশল হলো পূর্ব ইউক্রেনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা এবং ইউক্রেনের অভ্যন্তরের ব্যাপক সমস্যার ফলশ্রুতিতে কিয়েভে রাজনৈতিক গোলযোগের অপেক্ষা করা। ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক হামলা রাশিয়াকে কিছুই দেবে না।

রুশ সিনেটর কনস্টানটিন কসাচেভ বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, সামরিক দিক থেকে রাশিয়াকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়; এবং দুই দেশের আলোচনায় ফেরত আসা ছাড়া গতি নেই। কসাচেভের কথায় বোঝা যাচ্ছে যে, রাশিয়া মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা চাইছে; যার প্রস্তাব বাইডেন ইতোমধ্যেই ফোনালাপের মাধ্যমে দিয়েছেন। মার্কিন থিকট্যাঙ্ক ‘সিএনএ কর্পোরেশন’এর ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান ‘দ্যা মস্কো টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, রাশিয়ার সমরশক্তি মোতায়েন মূলতঃ ভীতি প্রদর্শনের জন্যে; দেখানোর জন্যে। কারণ ইউক্রেনে সামরিক হামলা করে রাশিয়ার কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না। ‘বিবিসি’ এক বিশ্লেষণে বলছে যে, সাত বছর আগে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে তার সামরিক শক্তি প্রেরণ করে তা অস্বীকার করেছিল; এখনও করছে। সেটা ছিল রাশিয়া গোপন অপারেশন। কিন্তু এবারে রুশরা বড়সর আয়োজন করে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করছে। রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সামনে ভালবাসার বস্তু হিসেবে আবির্ভূত হবার আশা ছেড়ে দিয়েছে; বরং তারা চাইছে যে, পশ্চিমারা রাশিয়াকে ভয় করুক। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়া এবারে সৈন্য পাঠায়নি; বার্তা পাঠিয়েছে।

No comments:

Post a Comment