Saturday 24 April 2021

আফ্রিকার দেশ শাদে ‘ফরাসী’ অভ্যুত্থান?

২৪শে এপ্রিল ২০২১

রাজধানী নিজালমিনায় সাঁজোয়া যান মোতায়েনের ব্যাপারটা অনেকেকই চিন্তিত করেছে। ইদ্রিস দেবির মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতিকে পশ্চিমারা সর্বদাই এড়িয়ে গেছে; কারণ সাহেলে তিনিই ছিলেন পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষক। শাদের অভ্যুত্থান এমন সময়ে ঘটলো, যখন মালির যুদ্ধ প্রতিবেশী নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে ছড়িয়ে গেছে এবং শেষ হবার কোন লক্ষনই দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্স এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ক্রমেই তার পশ্চিমা বন্ধুদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে; যা বন্ধুদেরকে ফ্রান্সের নীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিচ্ছে। এমনই এক অবস্থায় সাহেলের প্রধান ঘাঁটি শাদকে নিয়ে চাপের মাঝে পড়েছে প্যারিস। ফ্রান্স যত বাধ্য হচ্ছে বন্ধুদের চাপ সহ্য করতে, ততটাই দুর্বল হচ্ছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ।


গত ১৯শে এপ্রিল মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদের প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস দেবির হঠাত করেই মৃত্যু হয়। ১৯৯০ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি দেশটার ক্ষমতা নেন। দেশটার সামরিক বাহিনী বলছে যে, শাদের উত্তরে বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে যুদ্ধে অংশ নেবার সময় তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিতর্কিত নির্বাচনে ষষ্ঠবারের মতো নির্বাচিত হবার সাথেসাথেই তার মৃত্যু হলো। বিদ্রোহী গ্রুপ ‘ফ্রন্ট ফর চেঞ্জ এন্ড কনকর্ড ইন শাদ’ বা ‘এফএসিটি’ গত ১১ই এপ্রিল লিবিয়া থেকে শাদের সীমানায় প্রবেশ করে। দেবির মৃত্যুর পর ২১শে এপ্রিল তার ছেলে জেনারেল মাহামাত ইদ্রিস দেবিকে সামরিক সরকারের প্রধান ঘোষণা করে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হয়। সংবিধান স্থগিত করে ১৮ মাসের মাঝে নির্বাচন দেয়ার কথা বলা হয়। অথচ সংবিধান অনুযায়ী দেশটার পার্লামেন্টের স্পিকার হারুন কাবাদির নেতৃত্ব নেবার কথা। ইদ্রিস দেবির রহস্যজনক মৃত্যু এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেবার ঘটনাকে বিশ্লেষকেরা অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখছেন। শাদে যা কিছুই হোক না কেন, সেখানে ফ্রান্সের ভূমিকা থাকে গুরুত্বপূর্ণ। শাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স কখনোই এই দেশ ছেড়ে যায়নি। তাই ইদ্রিস দেবির মৃত্যুতে ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া ছিল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

‘ফ্রান্স ২’ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ ইভস লে ড্রিয়ান শাদে ইদ্রিস দেবির ছেলের ক্ষমতা নেয়ার ব্যাপারটা সমর্থন করে বলেন যে, স্পিকার হারুন কাবাদি দেশের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষমতা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর কাবাদি এই ব্যাপারটা মেনেও নিয়েছেন। তিনি দেশটার স্থিতিশীলতাকেই সবচাইতে গুরুত্ব দিচ্ছেন; তবে লে ড্রিয়ান ১৮ মাস সময়ের মাঝে নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি। ফরাসী সরকারের বক্তব্য অনেককেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। শাদের বিরোধী ‘রিফরমিস্ট পার্টি’র প্রধান ইয়াসিন আব্দেরামানি সাকিনে বলছেন যে, এটা পরিষ্কার যে এর পিছনে সামরিক বাহিনী এবং ফ্রান্স জড়িত। এটা একটা অভ্যুত্থান; যার মাধ্যমে বাবার কাছ থেকে ছেলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। লিবিয়া থেকে হামলা করা সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ ‘এফএসিটি’এর নেতৃত্ব বলছে যে, শাদ কোন রাজতন্ত্র নয় যে, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব আসবে।

 

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, শাদের প্রেসিডেন্টের প্রধান বন্ধু ছিল ফ্রান্স। সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্স ৫ হাজার ১’শ সেনা মোতায়েন রেখেছে; যার হেডকোয়ার্টার্স হলো শাদের রাজধানী নিজালমিনাতে। এছাড়াও ফরাসী সেনারা উত্তরে ফায়া লারগিউতে লিবিয়ার সীমানায় নজর রাখছে এবং পূর্বের আবেশেতে সুদানের সীমানার উপর নজর রাখছে। প্রতিবেদনে শাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কথাটাই তুলে ধরা হয়; যেকারণে ইদ্রিস দেবি এতকাল ফ্রান্সের বন্ধু ছিলেন; যদিও তার সরকারের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন ছিল ব্যাপক। স্থলবেষ্টিত শাদের উত্তরে রয়েছে লিবিয়া; যেখানে এখন চলছে গৃহযুদ্ধ। পশ্চিমে শাদ হ্রদকে ঘিরে রয়েছে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া এবং নিজের, যেখানে বোকো হারাম সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে ফরাসী নেতৃত্বে যুদ্ধ চলছে। দক্ষিণে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং পূর্বে সুদানের দারফুর অঞ্চলেও চলছে গৃহযুদ্ধ। জাতিসংঘের হিসেবে গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মোতায়েন রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার ৭’শ শান্তিরক্ষী সেনাসদস্য এবং দারফুরে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার শান্তিরক্ষী। অর্থাৎ শাদের চারিদিকের সবগুলি অঞ্চলেই চলছে যুদ্ধ। শাদ হ্রদ অঞ্চলে শাদের সামরিক বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে জড়িত। মালির গৃহযুদ্ধে ফরাসী নেতৃত্বে শাদের সেনারা যুদ্ধ করছে। এবছরের শুরুতেই শাদের ১২’শ সেনাকে নিজের, মালি এবং বুরকিনা ফাসো, এই তিন দেশের সীমানার সংযোগস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে, যা কিনা সাহেলে ফরাসী সামরিক কৌশলের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অপরদিকে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং দারফুরে শাদের বিদ্রোহী গ্রুপগুলি যুদ্ধ করছে। লিবিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়া শাদের যোদ্ধারাই এখন শাদে হামলা করেছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, এই সেনারা লিবিয়ার যুদ্ধ থেকে অর্থ, অস্ত্র এবং অভিজ্ঞতা পেয়েছে, যা ব্যবহার করে তারা শাদ আক্রমণ করেছে। এরা একসময় লিবিয়ার সামরিক নেতা খলিফা হাফতারের পক্ষে যুদ্ধ করেছে।

শাদের রাজধানী নিজালমিনা হলো অত্র অঞ্চলের সবচাইতে বড় সামরিক বিমান ঘাঁটি। আশেপাশের সবগুলি দেশে যুদ্ধ তদারিক করার ক্ষেত্রে শাদের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ আর নেই। ২০১৯এর ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়া থেকে আসা বিদ্রোহী সামরিক বাহিনীর উপর ফরাসী বিমান বাহিনী ব্যাপক বোমা হামলা করে। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, চলমান বিদ্রোহী হামলায় প্যারিস এখনও পর্যন্ত সরসরি সামরিক সহায়তা না দিলেও শাদের সামরিক বাহিনীকে ইন্টেলিজেন্স এবং লজিস্টিক্যাল সহায়তা দিচ্ছে ফ্রান্স। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দি আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় সিনিয়র ফেলো ক্যামেরন হাডসন বলছেন যে, ফ্রান্স তার ইউরোপিয় বন্ধুদের চাপের মুখে রয়েছে। সাহেলের সামরিক মিশনে সহায়তার দেবার অংশ হিসেবে তারা দাবি করছে যে, ফ্রান্স যেন শাদের অভ্যন্তরীণ কলহতে না জড়ায়।

সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আজিম বেরমানদোয়া আগুনা ১৭ই এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন যে, লিবিয়া থেকে আসা বিদ্রোহীদেরকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা হয়েছে। কিন্তু দেবির মৃত্যুর আগের দিন মার্কিন এবং ১৭ই এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার যখন নিজালমিনাতে তাদের দূতাবাস খালি করতে বলে, তখন দেশটার স্থিতিশীলতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। রাজধানী নিজালমিনায় সাঁজোয়া যান মোতায়েনের ব্যাপারটা অনেকেকই চিন্তিত করেছে। ১৬ই এপ্রিল ‘এফএসিটি’ দাবি করে যে, তারা গুরি নামের এলাকায় একটা সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। এবং ফরাসী লজিস্টিক্যাল সহায়তার পরেও শাদের সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়েছে। ইদ্রিস দেবির মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতিকে পশ্চিমারা সর্বদাই এড়িয়ে গেছে; কারণ সাহেলে তিনিই ছিলেন পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষক। শাদের অভ্যুত্থান এমন সময়ে ঘটলো, যখন মালির যুদ্ধ প্রতিবেশী নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে ছড়িয়ে গেছে এবং শেষ হবার কোন লক্ষনই দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্স এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ক্রমেই তার পশ্চিমা বন্ধুদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে; যা বন্ধুদেরকে ফ্রান্সের নীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিচ্ছে। এমনই এক অবস্থায় সাহেলের প্রধান ঘাঁটি শাদকে নিয়ে চাপের মাঝে পড়েছে প্যারিস। ফ্রান্স যত বাধ্য হচ্ছে বন্ধুদের চাপ সহ্য করতে, ততটাই দুর্বল হচ্ছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ।

No comments:

Post a Comment