Friday 2 April 2021

সুয়েজ খাল আটকে যাওয়া কি দেখিয়ে দিচ্ছে?

৩রা এপ্রিল ২০২১
সুয়েজ বা পানামা খালের মতো মানবসৃষ্ট খালগুলি সর্বদা সরুই হয়। তবে মালাক্কা প্রণালী, হরমুজ, বাব এল মান্ডেব বা জিবরালটারের মতো স্রষ্টার তৈরি পথগুলি সেতুলনায় অনেক চওড়া। আর দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বা আর্কটিকের ‘এনএসআর’ হয়ে বা মধ্য এশিয়ার রেলপথ হয়ে পণ্য পরিবহণ কিছু ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের বিকল্প হলেও খরচ, সময় বা অন্য কারণে সেগুলি সুয়েজের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারছে না। মানবসৃষ্ট সুয়েজ খালের উপর নির্ভরশীলতা যেমন কমে যাচ্ছে না, তেমনি ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। একারণেই সরু এই পথগুলি সামনের দিনগুলিতে ভূরাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই থাকবে।


অতি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ সুয়েজ খালে আটকে পড়া দৈত্যাকৃতির কনটেইনারবাহী জাহাজ ছাড়ানো সম্ভব হওয়ায় সারা বিশ্বের মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে বিশ্লেষকেরা একমত যে, এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ‘এনপিআর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ৪’শ মিটার লম্বা জাহাজ ‘এভার গিভেন’ যখন খালের সরু জায়গায় আটকে যায়, তখন অনেকেই এর অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসেব করতে শুরু করে। এই পথে প্রতিদিন গড়ে ৫০টা জাহাজ যাতায়াত করে। দৈনিক ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ এই পথের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সাপ্লাই চেইন কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘ইনটেরোস’এর প্রধান নির্বাহী জেনিফার বিসেইলি বলছেন যে, ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে হঠাত করেই অনেকে বুঝতে শুরু করলো যে, সাপ্লাই চেইনের বেশিরভাগটাই চীনে পুঞ্জীভূত হয়ে গেছে। তাই অনেকেই চীনের বিকল্প সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখন সমুদ্রপথে এহেন ঘটনার ফলে একটা বড় জাহাজে সকল পণ্য তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে দু’বার চিন্তা করার সময় এসেছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, খুব বেশি সময়ের জন্যে খাল না আটকানোর ফলে বিশ্ব বাজারে পণ্য মূল্যের উপর এর প্রভাব খুব একটা হবে না। আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে বিকল্প পথগুলিকে নিয়ে।

সুয়েজ খাল আটকানো আবস্থায় বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে পথটাকে কেউ কেউ ব্যবহার করেছে। তবে এতে দুই থেকে চার সপ্তাহ দেরি হবে এবং কয়েক মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াতে হবে। তেলের মূল্য কমে যাবার সময় কেউ কেউ এই পথ ব্যবহার করলেও সময় কিন্তু বেশি লাগছেই। আরেকটা বিকল্প হলো প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করা পানামা খাল। তবে এই খাল দিয়ে ‘এভার গিভেন’এর মত বেশি বড় জাহাজগুলি যেতে পারবে না। নতুন একটা বিকল্প পথ হিসেবে সামনে আসছে রাশিয়ার উত্তরে উত্তর মেরু ঘেঁষে ‘নর্দার্ন সী রুট’ বা ‘এনএসআর’। এই পথকে বড় কনটেইনারবাহী কোম্পানিগুলি এখনও উপযুক্ত মনে করছে না। তবে রুশরা এব্যাপারে এখন বেশ সরব। রাশিয়ার পারমাণবিক সংস্থা ‘রোসাটম’এর বিশেষ প্রতিনিধি ভ্লাদিমির পানোভ রুশ বার্তা সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, সুয়েজ খালের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে বাণিজ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিকল্প পথ হিসেবে ‘এনএসআর’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ‘এনএসআর’ বেশ প্রতিযোগিতামূলক খরচে পণ্য পরিবহণ করার সুবিধা দিচ্ছে। নরওয়ের সংস্থা ‘সেন্টার ফর হাই নর্থ লজিসটিক্স’এর হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাঝে ‘এনএসআর’ দিয়ে জাহাজের যাতায়াত বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। পরিবাহিত পণ্যের পরিমাণ ৭৫ লক্ষ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ১০ লক্ষ টন। সুয়েজ খালের ১’শ কোটি টনের তুলনায় এটা কিছুই নয়। তবে ‘এনএসআর’এর সবচাইতে বড় সুবিধা হলো চীন থেকে ইউরোপে যাতায়াত ৩৪ থেকে ৪০ দিনের বদলে মাত্র ২৩ দিনে সম্ভব।

এছাড়াও রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে যাওয়া রেল সংযোগকে কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে চিন্তা করছেন; বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স এবং জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের ক্ষেত্রে। অনলাইন লজিসটিক্স প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়াইকিউএন লিঙ্ক’এর প্রধান নির্বাহী ঝৌ শিহাও চীনা সরকারি মিডিয়া ‘গ্লোবাল টাইমস’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, রেলপথে চীন থেকে একটা কনটেইনারের ইউরোপ যেতে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৫ দিন লাগে। আর বড় পরিসরে হিসেব করলে সমুদ্রপথ এবং রেলপথে কনটেইনার পরিবহণ খরচের মাঝে পার্থক্য খুবই কম। তবে একটা জাহাজের সাথে একটা রেলগাড়ির তুলনা দেয়া সম্ভব নয়। ‘এভার গিভেন’এর মত একটা দৈত্যাকৃতির কনটেইনার জাহাজ বহণ করতে পারে ২০ হাজার কনটেইনার; যা পরিবহণে লাগবে প্রায় ৫০টা রেলগাড়ি।

সুয়েজ খাল বন্ধ হওয়া নতুন কিছু নয়। ১৯৫৬ সালে এবং ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের কারণে খাল বন্ধ হয়েছিল। এর মাঝে ১৯৬৭ সালে বন্ধ হবার পর তা ৮ বছর পর ১৯৭৫ সালে খুলেছিল। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘প্লাইমাউথ হেরাল্ড’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সুয়েজ খালে এর আগেও জাহাজ আটকে গিয়েছিল। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ থেকে ফেরত আসা ব্রিটিশ রয়াল নেভির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ইউনিকর্ন’ খালে আটকে যায়। প্রায় চার ঘন্টা আটকে থাকার পর দু’টা টাগবোট দিয়ে প্রায় ২’শ মিটার লম্বা জাহাজটাকে টেনে বের করা হয়। তবে কেউ কেউ দুর্ঘটনা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ আটকে যাবার কথা বলছেন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার স্কট সাভিতজ প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক লেখায় মার্কিন সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের কারণে সরু সমুদ্রপথ বন্ধ হওয়া প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেবার কথা বলছেন। তিনি বলছেন যে, একটা পুরোনো জাহাজকে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরের মুখে আড়াআড়ি রেখে দিয়ে বন্দর আটকে দেবার কৌশল অনেক পুরোনো। ২০১৪ সালেই রাশিয়া ক্রিমিয়ার দখল নেবার সময় বন্দরের মুখে দু’টা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জাহাজগুলির পালানোর পথ রুখে দিয়েছিল। তিনি বলছেন যে, এই কাজটা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেও সম্ভব; আবার সাইবার হ্যাকিংএর মাধ্যমে কোন জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও করা সম্ভব।

মার্কিন থিঙ্কট্যাক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’এর এক লেখায় ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রিডম্যান বলছেন যে, সুয়েজ খালের ঘটনা একটা দুর্ঘটনা হলেও তা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, যেকোন যুদ্ধে কত সহজে এরকম একটা সরু নৌপথ আটকে দেয়া যেতে পারে; কারণ এর আগেও যুদ্ধের কারণে নৌপথ আটকানো হয়েছে। সুয়েজ বা পানামা খালের মতো মানবসৃষ্ট খালগুলি সর্বদা সরুই হয়। তবে মালাক্কা প্রণালী, হরমুজ, বাব এল মান্ডেব বা জিবরালটারের মতো স্রষ্টার তৈরি পথগুলি সেতুলনায় অনেক চওড়া। আর দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বা আর্কটিকের ‘এনএসআর’ হয়ে বা মধ্য এশিয়ার রেলপথ হয়ে পণ্য পরিবহণ কিছু ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের বিকল্প হলেও খরচ, সময় বা অন্য কারণে সেগুলি সুয়েজের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারছে না। মানবসৃষ্ট সুয়েজ খালের উপর নির্ভরশীলতা যেমন কমে যাচ্ছে না, তেমনি ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। একারণেই সরু এই পথগুলি সামনের দিনগুলিতে ভূরাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই থাকবে।

2 comments:

  1. আমার তো মনে হয়েছিল এটা একটা কৃত্রিম ঘটনা। সম্ভাব্য উদ্দেশ্য দুটো হতে পারেঃ ১। মিশরকে চাপ দিয়ে তুর্কি-মিশরিয় সম্ভাব্য ঘনিষ্ঠতা ব্ন্ধ করে আফ্রিকায় ফরাসি-ইউরোপীয়-পশ্চিমা প্রভাব বজায় রাখার জন্য চেষ্টা। ২। ইসরাইলের মধ্য দিয়ে অথবা ইসরাইল-মিশর সীমান্তে ইসরাইলি নিয়ন্ত্রনে বিকল্প খাল-বানিজ্য পথ চালু করা যার ফলশ্রুতিতে একই সাথে গাজা উপত্যকাকে স্থায়ীভাবে মিশর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফিলিস্তিনের শেষ অস্তিত্বও ইসরাইলের মাঝে চিরতরে বিলীন করে দেওয়া সম্ভব হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্যাপারটা এমন নয় যে, আর কোন কোন খাল খুঁড়লে এধরণের সমস্যা আর হবে না। বরং আলোচনার বিষয়টা হলো সরু খালের উপর সমুদ্র বাণিজ্য কতটা নির্ভরশীল এবং সেটার বিকল্প কতটা কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য। খালের উপর নির্ভরশীলতা থাকার কারণেই খালের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা বা এর কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার পিছনে এত প্রচেষ্টা। এসব খাল বন্ধ করার চেষ্টা এর আগেও হয়েছে; ভবিষ্যতেও থাকবে।

      Delete