Friday 9 April 2021

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাপানের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য কি?

১০ই এপ্রিল ২০২১
৩০শে মার্চ। টোকিওতে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোভো সুবিয়ান্তো এবং জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোশিমিতসু মোতেগি। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণেই জাপানের সাথে হাত মেলাচ্ছে। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবেই চীন এবং জাপান উভয়েই তাদের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় সামরিক শক্তি ধরে রাখতে সহায়তা করছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়ার বন্ধু দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে; যা জাপানের সামরিকীকরণে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।  


গর ৩০শে মার্চ জাপান এবং ইন্দোনেশিয়া একটা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ‘ডিফেন্স ইকুইপমেন্ট এন্ড টেকনলজি ট্রান্সফার এগ্রিমেন্ট’ নামক চুক্তি অনুযায়ী জাপান ইন্দোনেশিয়াতে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করবে। টোকিয়োতে দুই দেশের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকের মাঝেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাপানের ‘কিয়োদো নিউজ’ বলছে যে, এই চুক্তির পিছনে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের প্রভাব বিস্তারকে নিয়ে জাপানের দুশ্চিন্তা প্রকাশ পাচ্ছে। এক যৌথ সাংবাদিক সন্মেলনে জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোশিমিতসু মোতেগি বলেন যে, দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন সাগরে চীনের জোরপূর্বক অবস্থান শক্তিশালীকরণের ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে আলোচনা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে চীন সরকারের জারি করা আইন অনুযায়ী চীনা কোস্ট গার্ড চীনের দাবি করা সমুদ্রসীমায় অন্য দেশের জাহাজকে গুলি করতে পারবে। জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও কিশি বলেন যে, এই আইনের মাধ্যমে চীনারা অন্য দেশের বৈধ অধিকার এবং স্বার্থের লঙ্ঘন করতে পারে না। ইন্দোনেশিয়ার সাথে এই চুক্তির আগে জাপান ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইতালি, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এরূপ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। মোতেগি বলেন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার সাথে জাপানের নিরাপত্তা সম্পর্ক এগিয়ে নেবার জন্যে শক্ত ভিত তৈরি হলো; এবং একইসাথে আঞ্চলিক হুমকি মোকাবিলায় তা দুই দেশের যৌথ উদ্যোগের প্রতীক হয়ে থাকবে। তিনি আরও বলেন যে, ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জাপান সরকার ৪’শ ৫৩ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। অপরদিকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোভো সুবিয়ান্তো বলেন যে, তার দেশ জাপানকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নে অংশীদার হতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার সাথে জাপানের প্রতিরক্ষা চুক্তি আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে এখন শুরু হয়েছে আলোচনা।

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, চুক্তিতে কি রয়েছে তার বিস্তারিত বলা না হলেও এর মাধ্যমে জাপান হয়তো ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর কাছে ‘মোগামি ক্লাস’এর ফ্রিগেট রপ্তানি করতে পারে, যা তারা নিজেদের নৌবাহিনীর জন্যে বর্তমানে তৈরি করছে। দুই দেশের মাঝে সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা চলছে কয়েক বছর ধরেই। ২০২০ সালের শেষের দিকে একটা সমঝোতার ফলশ্রুতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। সেসময় জাপানের জাহাজ নির্মাণ সংস্থা ‘মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ’এর সাথে ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী তাদের ফ্রিগেট ক্রয় প্রকল্পের জন্যে চারটা ডিজাইনকে শর্টলিস্ট করেছিল; যার মাঝে ছিল হল্যান্ডের ‘ডামেন’ ইতালির ‘ফিনকানতিয়েরি’, জাপানের ‘মিতসুই’ এবং ব্রিটেনের ‘ব্যাবকক’ কোম্পানির ডিজাইন।

গত বছরের অগাস্টে জাপান ফিলিপাইনের কাছে ১’শ ৩ মিলিয়ন ডলারে ৪টা অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা রাডার বিক্রয়ের চুক্তি করে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে জাপানি পার্লামেন্ট প্রতিরক্ষা আইনের আর্টিকেল ‘১১৬এর ৩’ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিদেশে অস্ত্র রপ্তানিকে বৈধতা দিয়েছিল। সেই মোতাবেক জাপান সরকার দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের নজরদারিতে সহায়তা দিতে ৫টা ‘টিসি ৯০’ সার্ভেইল্যান্স বিমান অনুদান হিসেবে দেয়। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ফিলিপাইনের কাছে বিক্রি করা রাডারগুলি মূলতঃ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা সামরিক কর্মকান্ডের উপর নজর রাখতে ব্যবহৃত হবে, যেখানে চীনারা বেশকিছু কৃত্রিম দ্বীপ ডেভেলপ করে সেখানে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। জাপান চাইছে তাইওয়ান এবং ফিলিপাইনের মাঝ দিয়ে যাওয়া বাশি চ্যানেলে চীনা জাহাজের গতিবিধির উপর নজরদারি করতে। আর সেক্ষেত্রে তারা ফিলিপাইনের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে চাইছে। এর আগে ফিলিপাইনের কোস্ট গার্ডের জন্যে ১’শ ৯১ মিলিয়ন ডলারে ১০টা ৪৪ মিটার লম্বা প্যাট্রোল বোট বিক্রি করে জাপান। আর বর্তমানে ১’শ ৩২ মিলিয়ন ডলারে ২টা ৯০ মিটার অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলও তৈরি করছে জাপান। এছাড়াও গত জুলাই মাসে জাপান ভিয়েতনামের কাছে ৪’শ মিলিয়ন ডলারে ৬টা ৭৯ মিটার লম্বা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল রপ্তানি করার চুক্তি করে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি’ বা ‘জাইকা’ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। আর সবগুলি জাহাজের মূল কাজ হবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা। ‘ফোর্বস’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এতকাল বিদেশে রপ্তানি করতে না পারার কারণে জাপানের সামরিক সরঞ্জাম ছিল দুর্মূল্য। এখন বিভিন্ন প্রকার বিমান, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্যাট্রোল বোট, ইত্যাদি সরঞ্জাম রপ্তানি করে সেগুলির খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে জাপান; যাতে তারা তাদের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে আরও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে অস্ত্র বিক্রি করতে পারে।

জাপানের পররাষ্ট্রনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের রচিত যুদ্ধবিরোধী সংবিধানের উপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রক্ষণশীলদের শক্ত অবস্থানের ফলে আইনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জাপান বিশ্বব্যাপী সামরিক বাহিনী মোতায়েন এবং বিদেশে অস্ত্র রপ্তানি করছে। চীন এবং উত্তর কোরিয়ার আক্রমণাত্মক অবস্থান জাপানকে সামরিক শক্তি বাড়াতে একপ্রকার বৈধতা দিয়েছে। তবে জাপানের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় তা এখনও ওয়াশিংটনের আশীর্বাদপুষ্ট হচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আগ্রাসনের ইতিহাস ভুলে না গেলেও জাপানের নতুন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শুধু চীনারাই কথা বলছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণেই জাপানের সাথে হাত মেলাচ্ছে। জাপানের সামরিক শিল্প যথেষ্ট উন্নত হলেও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তা এখনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীন নয়। দক্ষিণ চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরের সমুদ্রপথগুলি শুধু চীনের জন্যে নয়, জাপান এবং কোরিয়ার জন্যেও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেগুলি নিয়ন্ত্রণে জাপানের এমন কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই, যা কিনা মার্কিন নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। প্রতিরক্ষা রপ্তানির ক্ষেত্রে জাপানের আর্থিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশটা তাদের বিরাট অর্থনীতিকে পুঁজি করে প্রভাব বিস্তারে অগ্রগামী হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাব বিস্তারে তারা এখনও শিশুমাত্র। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবেই চীন এবং জাপান উভয়েই তাদের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় সামরিক শক্তি ধরে রাখতে সহায়তা করছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়ার বন্ধু দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে; যা জাপানের সামরিকীকরণে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।


4 comments:

  1. জাপানের সামরিককরন ভর্বিষত রাজনীতিতে কিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে

    ReplyDelete
    Replies
    1. আলোচনাটা বরং হতে পারে যে, ভবিষ্যতের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন জাপানের সামরিকীকরণের উপর কতটা প্রভাব রাখতে পারে?

      মূলতঃ চীন এবং জাপানের সামরিকীকরণ যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়াতে অবস্থান ধরে রাখতে সহায়তা করছে। যতদিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াতে এই দুই শক্তির প্রতিযোগিতা দেখাতে পারবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াতে তার অবস্থান রাখার পিছনে যুক্তি দেখাতে পারবে। যেমন, ১৯৫০ সালের পর থেকে কোরিয়ার উত্তেজনা উত্তর পূর্ব এশিয়াতে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে মার্কিন সামরিক অবস্থানকে বৈধতা দিয়েছে।

      যুক্তরাষ্ট্র যতদিন সুপারপাওয়ার থাকবে, ততদিন সে এই খেলাই খেলতে চাইবে। চীন অনেক বড় শক্তি; তাই তাকে ব্যালান্স করতে জাপানকে তার খোলস থেকে বের করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পর কোন শক্তি যদি চীন এবং জাপানকে নিরাপত্তাহীনতার মাঝে না ফেলে, তাহলে চীন এবং জাপান উভয় দেশই সামরিকীকরণ থেকে দূরে সড়ে আসবে।

      Delete
  2. জাপানকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে আর বিংশ শতাব্দীর প্রথমে পশ্চিমারাই সাহায্য করেছিল জাপান সাগরে রাশিয়ার প্রভাব কমাতে। সেইখান থেকেই বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ। আবার
    চায়নার ইকনমি গ্রো করতে পশ্চিমারাই সাহায্য করেছে। এখন তাঁরাই আবার চায়নাকে তাঁদের আইনের শৃঙ্খলে আনতে চাচ্ছে। একই সাথে আবার তারা জাপানকে খোলস থেকে বের করে আনছে। ঐতিহাসিকভাবে বিষয়গুলো আপনি কিভাবে দেখছেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো একটা দিক তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা আদর্শিক রাষ্ট্রগুলি, বিশেষ করে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাকি দুনিয়াকে নিজেদের মতো করে তৈরি করেছে। বর্তমান দুনিয়ার জাতিরাষ্ট্রগুলির সংজ্ঞা তাদেরই তৈরি করা। তারা সর্বদাই চেয়েছে তাদের সংজ্ঞায়িত সেই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মাঝে কি সম্পর্ক রাখবে, সেটা তারা নিয়ন্ত্রণ করবে। যেমন উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছে। হ্যাঁ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সেখানে অংশ নিয়েছিল; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই সেই দুই দেশের সীমানার স্থিতাবস্থা নিশ্চিত করছে। কোরিয়ার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখছে। একইসাথে তারা রাশিয়া এবং চীনকে ব্যালান্স করছে এবং তাদের আঞ্চলিক প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

      চীন, জাপান এবং কোরিয়ার মাঝে সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াতে তার অবস্থানকে ধরে রাখে। এই দেশগুলির মাঝে শত্রুতা না থাকলে, বা কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়া ছেড়ে যেতে বলবে সবাই; যা যুক্তরাষ্ট্র চায় না।

      Delete