Friday 6 May 2016

‘জার্নি বাই বোট’ থেকে ‘জার্নি বাই ক্রুজ লাইনার’

০৬ মে ২০১৬

 
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ক্যামুফ্লাজ পেইন্টে দেখা যাচ্ছে ক্রুজ লাইনার Olympic-কে, যা কিনা Titanic এবং Britannic-এর সিস্টার শিপ ছিল। ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে যখন জাহাজখানা দার্দানেলিস প্রণালীর দিকে রওয়ানা দেয়, তখন জাহাজখানা তার বেসামরিক পরিচয়কে প্রশ্নের মুখেই ফেলে বৈকি!


সমুদ্রগামী বিলাশবহুল ক্রুজ লাইনারের নাম বললে বিলাশবহুল জীবনযাপন অথবা যথেচ্ছা খরচাপাতি করা করা ব্যাতীত খুব বেশি কিছু অনেকের মনে না-ই আসতে পারে। কিন্তু একটু গভীরে গেলে আরও অনেক কিছুই বের করা যায়। বেশ কিছুদিন আগে একখানা লেখায় সামরিক ও বেসামরিক ব্যাপার-স্যাপারের মাঝে অত্যন্ত চিকন পার্থক্যটুকু দেখানোর জন্যে উদাহরণস্বরূপ ক্রুজ লাইনারের কথা তুলেছিলাম। আজকে এই ক্রুজ লাইনারের অন্য রকম কিছু ইতিহাস তুলে ধরতে চাই যাতে পাঠক অন্য একটা দিক নিয়ে চিন্তা করতে পারেন। কৌশলগত দিক থেকে এই চিন্তার রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।

ক্রুজ লাইনারে ভ্রমণ একধরনের জীবনযাত্রার অংশ। যারা নদী-সমুদ্র-পানিকে কাছের মনে করে, এটা সেই মানুষগুলির জীবনযাত্রার অংশ। একসময় এই লাক্সারী লাইনার ছিল না। তবে ছিল সমুদ্রগামী জাহাজের বহর; হাজার হাজার বছর ধরেই ছিল। এই জাহাজগুলি হয়তোবা শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহণের জন্যে তৈরি হয়নি; আবার শুধু যুদ্ধের জন্যেও তৈরি হয়নি। তবে যাত্রীরা সেগুলিতে চড়তে আলাদা কিছু চিন্তা করেননি; কারণ তখন এ ধরনের জাহাজে চড়াটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন নাহয় কার্গো জাহাজ আলাদা; সামরিক যুদ্ধজাহাজও আলাদা; যাত্রীবাহী জাহাজতো বটেই। তবে মজার ব্যাপার হলো দরকারের সময়ে এই বিভাগের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলেন অনেকেই। যারা সংজ্ঞায়িত করেন, তারাই কিন্তু সংজ্ঞা ভাঙ্গেন। যারাই সামরিক-বেসামরিক জাহাজের সংজ্ঞা দিয়েছেন, তারাই কিন্তু সর্বপ্রথম সেই সংজ্ঞাকে নতুর রূপ দেন। তারাই বেসামরিক যাত্রীবাহী জাহাজের রঙ পরিবর্তন করেন; অস্ত্রসজ্জিত করেন; যাত্রীদের সীটে সৈন্যদের স্থান দেন। ষোড়শ শতকে ব্রিটিশ নৌ-অফিসার ফ্রান্সিস ড্রেইক যেমন এই সামরিক-বেসামরিক সংজ্ঞাকে ভূলুন্ঠিত করেছিলেন, ঠিক সেই কাজটাই ব্রিটিশরা চার’শ বছর পর করেছিল ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়ে। অর্থাৎ এই নিয়মগুলি আমাদের কাছে অর্থবহ হলেও যারা নিয়ম বানিয়েছেন, তাদের কাছে অর্থহীন; তারা যখন ইচ্ছে সেটা পরিবর্তন করেন।

 
২০০৩ সালে ক্রুজ লাইনার Queen Elizabeth 2-এর উপরে হেলিপ্যাডের মার্কিং দেখা যাচ্ছে। এর ২১ বছর আগে এই জাহাজখানা হাজার হাজার সৈন্য বহণ করে নিয়ে গিয়েছিল ফকল্যান্ড দ্বীপে, যা কিনা ব্রিটেন থেকে ৮ হাজার মাইল দূরে! ছবিটা এত বছর পরেও জাহাজটার আসল উদ্দেশ্য বর্ণনা করে।

ক্রুজ লাইনারের রূপান্তরের কাহিনী

যুদ্ধের সময়ে বিলাশবহুল ক্রুজ লাইনারকে সৈন্যবাহী জাহাজে রূপান্তর করার কাহিনীর সামনের দিকে যে জাহাজগুলি থাকবে, সেগুলি হলো - Mauretania, Olympic, Leviathan, Nieuw Amsterdam (II), Queen Mary এবং Queen Elizabeth. এই জাহাজগুলি একেতো প্রচুর সৈন্য নিতে পারতো, আবার যেহেতু যাত্রী পরিবহণ করতো মহাসাগর পেরিয়ে, তাই এগুলি ছিল বেশ দ্রুতগামী; ঠিক যেমনি আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম যাত্রীবাহী বিরতিহীন ট্রেনগুলি মালবাহী ট্রেনের চাইতে অনেক বেশি গতিতে চলে। এই জাহাজগুলির দ্রুতি এদেরকে শত্রুর সাবমেরিন থেকে বাঁচতে সাহায্য করতো। দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেশিরভাগক্ষেত্রেই এই জাহাজগুলি কোন এসকর্ট জাহাজ ছাড়াই আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে। জেট বিমানের আগমণে যুদ্ধে ক্রুজ লাইনারের ব্যবহারের গুরুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হলেও সেটা আবার নতুনভাবে জীবন পেয়েছে ১৯৮২-এর ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়।

দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ক্রুজ লাইনারগুলিকে বিশেষ ধরনের রঙ করা হতো, যাকে কিনা “Dazzle paint” বলে। এর মাধ্যমে জাহাজের আকৃতি, গতি, দিক ও টাইপ যাচাই করা শত্রুর জন্যে কিছুটা হলেও কঠিন হতো বলে অনেকে মনে করতেন। অনেক সময়ে গ্রে পেইন্টও করা হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে Titanic-এর সিস্টার শিপ Olympic এবং Britannic উভয়কেই বর্তমান তুরস্কের দার্দানেসিল প্রণালীর গ্যালিপোলিতে উভচর অপারেশনের সময়ে ব্যবহার করা হয়েছিল।১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বরে উসমানিয়া খিলাফতের বিরূদ্ধে চালিত ওই অপারেশনে অংশ নিতে Olympic জাহাজখানা ব্রিটেন থেকে ৬,০০০ সৈন্য পরিবহণ করে গ্রীসে নিয়ে গিয়েছিল।Britannic-কে ব্যবহার করা হয়েছিল ভাসমান হাসপাতাল হিসেবে। ওই অপারেশনে থাকার সময়েই ১৯১৬ সালের নভেম্বরে Britannic জার্মান সাবমেরিনের পেতে রাখা মাইনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ডুবে যায় (জার্মানী আর উসমানিয়া খিলাফত ব্রিটেন-ফ্রান্সের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিল)। ১,০৬৫ জন মানুষের মাঝে মাত্র ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল এতে। এই দুই জাহাজের সাথে Mauretania এবং Aquitania নামের আরও দুইটি বিশাল লাইনার হাজার হাজার সৈন্য পরিবহণ করেছিল আর যখন গ্যালিপোলিতে ব্রিটিশরা জিততে পারছিল না, তখন জাহাজগুলিকে হসপিটাল শিপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে Olympic-এর জন্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেশ ঘটনাবহুল ছিল। ১৯১৬-১৭-এর মাঝে জাহাজখানা কানাডা থেকে হাজার হাজার সৈন্য ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যায়। আর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগদান করার পর জাহাজটি হাজার হাজার মার্কিন সেনাদের ইউরোপে নিয়ে যায়। ১৯১৮-এর মে মাসে এরকম এক মিশনের মাঝেই জাহাজটা এক জার্মান সাবমেরিনের (U-103) সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এবং এর মাঝে ধাক্কা দিয়ে সাবমেরিনটাকে ডুবিয়েও দেয়।


সাদা রঙের পেইন্টে (যাতে কেউ আক্রমণ না করে) দেখা যাচ্ছে হসপিটাল শিপ Mauretania-কে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জাহাজটি গ্যালিপোলি অপারেশনের সময়ে আহত সৈন্যদের সেবা করেছে। কিন্তু এর মাত্র কিছুদিন আগেই জাহাজটি কয়েক হাজার সৈন্য পরিবহণ করেছে। আবার এই ছবির মাত্র সাত মাসের মাঝেই জাহাজটি মার্কিন মুল্লুক থেকে হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে এসে জার্মানদের বিরূদ্ধে মোতায়েন করতে থাকে। জার্মানরা কিন জানতো না যে এই একই জাহাজ কিছুদিন পরে এই কাজে লিপ্ত হবে? অবশ্যই জানতো। তারা শুধু ম্যারিটাইম বিশ্বের নেতা ব্রিটেনের তৈরি করা নিয়মের মারপ্যাঁচে পড়ে গিয়েছিল!


সংজ্ঞা পরিবর্তন

এখানে বলে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে ব্রিটিশ সরকার এধরনের জাহাজের সামরিক ব্যবহারের জন্যে সর্বদাই প্রস্তুত ছিল। কারণ এটা ছিল তাদের শত বছরের ম্যারিটাইম নীতির এক অংশ। জাহাজ তৈরির আগেই ব্রিটিশ এডমিরালটি (নৌ মন্ত্রণালয়) এসবক্ষেত্রে জড়িতে হয় এবং ডিজাইন থেকে শুরু করে অনেকভাবে সাহায্য-সহায়তা করে। ব্রিটিশ সরকার Olympic এবং Britannic তৈরি করতে (Titanic-সহ) White Star Line-কে এবং Mauretania এবং Aquitania তৈরি করতে (Lusitania-সহ) Cunard Line-কে সাহায্য করেছিল। অর্থাৎ তৈরি করার সময়েই এই জাহাজে সৈন্য পরিবহণ করার ব্যবস্থা ব্রিটিশরা রেখেছিল। বেসামরিক জাহাজকে সামরিক ব্যবহারের চিন্তা করে তৈরি করার চমতকার উদাহরণ এটি। আরও একটা মজার ব্যাপার হলো উপরে যে সংজ্ঞা তৈরি এবং পরিবর্তনের কথা বলছিলাম, সেটারই একটা চমতকার উদাহরণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পাওয়া যায়। গ্যালিপোলি অপারেশনের সময়ে হসপিটাল শিপ হিসেবে ব্যবহার হবার সময়ে জাহাজগুলিকে সাদা রঙ করে রেডক্রসের মার্কিং দেয়া হয়েছিল, যাতে শত্রুর জাহাজ এগুলিকে আক্রমণ না করে। কিন্তু এই অপারেশনে আক্রান্ত না হয়ে বেঁচে যাবার মাত্র সাত মাস পরেই Mauretania এবং Aquitania কানাডা থেকে হাজার হাজার সৈন্য ইউরোপে নিয়ে আসতে থাকে; আর মার্কিনীরা যুদ্ধে যোগ দেবার পরে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য পরিবহণ করে। জার্মানরা হয়তো ঐ সংজ্ঞার মারপ্যাঁচে পড়ে গিয়ে চিন্তাই করেনি যে এই একই হসপিটাল শিপ তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে হাজারো সৈন্য পরিবহণ করবে! ব্রিটিশরা সত্যিই বোকা বানিয়েছিল জার্মানদের! ব্রিটিশরা ম্যারিটাইম দেশ হবার কারণেই সমুদ্রের আইনকানুন ও সংজ্ঞাগুলি তারাই লিখতো। জার্মানরা খুব অল্প সময়ের জন্যে ব্রিটিশদেরকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু intellectual ability-তে ব্রিটিশদের কাছে হেরে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে জার্মানির HAPAG লাইনের জাহাজগুলিকে মার্কিনীরা ব্যবহার করেছিল ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাদের সৈন্যদের নিজ দেশে ফেরত নিতে। অর্থাৎ জার্মানি তার জাহাজগুলিকে যুদ্ধে ব্যবহার তো করতে পারেই নাই, বরং তার শত্রুরা তাদের হারাবার পরে সেগুলি ব্যবহার করেছে!

নতুন যুগে ক্রুজ লাইনার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ব্রিটিশদের ওই ম্যারিটাইম সংস্কৃত অব্যাহত ছিল। Queen Mary এবং Queen Elizabeth-কে ব্যবহার করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে সৈন্য পরিবহণ করে ব্রিটেনে নিয়ে আসার জন্যে। এই জাহাজগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জাহাজগুলি থেকেও অনেক বড় ছিল; ১৫,০০০-এরও বেশি সৈন্য এগুলি বহণ করতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে Olympic যেখানে মোট ২ লক্ষ ১ হাজার সৈন্য পরিবহণ করেছিল, সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে Queen Mary বহণ করেছিল ৭ লক্ষ ৬৫ হাজার ৪২৯ জন সৈন্য, আর Queen Elizabeth বহণ করেছিল আরও ৭ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি সৈন্য। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে অন্তত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ক্রুজ লাইনারের সামরিক গুরুত্ব কমেনি। প্রশ্ন হলো, বিশ্বযুদ্ধের পর জেটলাইনারের যুগে এসব জাহাজের গুরুত্ব কি আগের স্থানেই আছে? অবশ্যই নেই; পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশদেরকে অনুকরণ করে SS United States নামের ক্রুজ লাইনার তৈরি করে, যার ডিজাইন করা হয়েছিল সৈন্য পরিবহণকে মাথায় রেখে। মার্কিন সরকার জাহাজটা তৈরির সময় জাহাজের মালিকপক্ষ United States Lines-কে সাবসিডি দিয়েছিল। এমনকি সামরিক গুরুত্ব বিবেচনায় তৈরি করার সময়ে জাহাজের হাল তৈরির পদ্ধতিকে গোপন রাখা হয়েছিল। বাকি বিশ্বের ক্রুজ লাইনারগুলি মোটামুটি ২০ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলতে পারলেও এই মার্কিন জাহাজখানা টেস্ট করার সময়ে ৪৩ নটের উপরে গতি অর্জন করেছিল। মাত্র কয়েকদিনের মাঝে এই জাহাজটাকে ক্রুজ লাইনার থেকে সৈন্য পরিবহণের জন্যে তৈরি করা যেত। ১৯৬৯ সালে জাহাজটা রিটায়ার করে। ৪০ বছরেরও বেশি সময় পরে জাহাজখানা মার্কিনীর কৌশলগত রিজার্ভ হিসেবে রেখে দিয়েছে; যদি কখনো দরকার হয়!

আর এসব জাহাজের গুরুত্ব যে এখনো রয়ে গেছে, সেটার প্রমাণ হলো ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধ। ব্রিটিশরা খুব দ্রুত কয়েকটা ক্রুজ লাইনারকে সৈন্য পরিবহণের জন্যে তৈরি করে ফেলে। Queen Elizabeth 2 জাহাজখানার উপরে একটা হেলিপ্যাডও বসিয়ে ফেলা হয় ঝড়ের গতিতে। জাহাজটার বিশাল রেঞ্জ ৮ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আটলান্টিকের এই মিশনে যাবার জন্যে বিরাট সহায়তা ছিল। নিরাপত্তার গুরুত্ব বিবেচনা করে জাহাজের রাডার সার্বক্ষণিকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। সবগুলি পোর্টহোল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল যাতে কোন বাতি রাতের বেলায় দেখা না যায়। পৃথিবীর সকল স্থানে সকল সময়ে পরিবহণ বিমানের বহর যে নামানো যাবে না, তা পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তাবিদেরা জানেন। তাই তারা আজও যখন এসব ক্রুজ লাইনারের ডিজাইন করেন, সৈন্য পরিবহণের কথাটা তারা মাথায় রাখেন।


১৯৪৫ সালের জুন মাস। ক্রুজ লাইনার Queen Mary যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ফেরত এসেছে। এর কার্গো হিসেবে এসেছে যুদ্ধফেরত কয়েক হাজার মার্কিন সেনা। এই জাহাজটা ১৫ হাজারেরও বেশি সৈন্য বহণ করতে পারতো। ম্যারিটাইম সংস্কৃতি গড়ার যে ভিত্তি ব্রিটিশরা গেঁড়েছিল, সেটার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে এইসব জাহাজের ইতিহাস। সেই ভিত্তি না জেনে ইতিহাস পড়লে আসল গল্প কিছুই জানা হবে না।

‘জার্নি বাই বোট’এর সংস্কৃতি

আগেই বলেছি যে ক্রুজ লাইনারে ভ্রমণ একটা সংস্কৃতি। যদি গতিই হতো পরিবহণের একমাত্র চাহিদা, তাহলে কেউ জাহাজে উঠতো না। সব ট্রিপই তো বিজনেস ট্রিপ নয়। এখানেই চলে আসে ‘জার্নি বাই বোট’ রচনার কথা। জীবনের হাজার হাজার বিজনেস ট্রিপের মাঝে একটা কাহিনীও কেউ বলতে পারে না। ‘জার্নি বাই জেটপ্লেন’ নিয়ে আসলে লেখার কিছুই নেই। সেটা তো আসলে বিজনেস ট্রিপ। কয়েক ঘন্টা বায়ুমন্ডলের উপর দিয়ে চলার পরে ধপাস করেই আরেক এয়ারপোর্টে এসে নেমে পড়া। যারা ওই ‘জার্নি’ ব্যাপারটাকে অনুভব করতে পারেন, তাদের জন্যেই অপেক্ষাকৃত গদাইলস্কর চালের বাহণগুলি। তাদের কাছে সমুদ্র এবং বিশাল জলরাশিকে ‘অনুভব’ করাটা একটা সংস্কৃতি। আমরা যেমন এককালে নদীমাতৃক দেশ বলে রচনা লিখেছি, ঠিক সেরকমই ব্যাপারটা। পানিতে পা ভেজানো; বৈঠা মারা; পালতোলা নৌকার দড়ি ধরে বাতাসের সাথে যুদ্ধ; দাঁড় টেনে এগিয়ে যাওয়া; সাঁতড়িয়ে পাড়ে ওঠা – এগুলি হচ্ছে পানির সংস্কৃতি। এই ব্যাপারটা নিয়েও লিখেছি এর আগেই। ক্রুজ লাইনারের সাথে সম্পর্কটা ঠিক এখানেই। এই পানির সংস্কৃতিই একদিন ক্রুজ লাইনারকে জাতীয় নিরাপত্তার রক্ষাকর্তারূপে আবির্ভূত করায়। ব্রিটিশরা এই জাহাজগুলিকে তৈরি করেছিল কেন? মিউজিয়ামে রাখার জন্যে? যুদ্ধতো প্রতিদিন হয় না। তাহলে কি যুদ্ধ হবার আগ পর্যন্ত জাহাজগুলি বসিয়ে রাখার জন্যে বানানো হয়েছে? না; তাদের রয়েছে ‘ক্রুজ লাইনার’ সংস্কৃতি – মানুষ জাহাজে ভ্রমণ করতে ভালোবাসে। সমুদ্রে ভ্রমণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মানুষের চিন্তা; তৈরি হয় অর্থনীতি; রচিত হয় সাহিত্য। রাষ্ট্র তৈরি করে সেই সংস্কৃতি; আর সেই সংস্কৃতি তৈরি করে ম্যারিটাইম দেশ। সেই সংস্কৃতিই সমাজের বিত্তবানদের অনুপ্রাণিত করে ক্রুজ শিপ তৈরি করতে। আর এভাবেই তৈরি হয় সমুদ্র জয়ের এক একখানা ভিত্তি।

আমরা এখন ‘জার্নি বাই বোট’ সংস্কৃতি থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি পৌঁছানোটাই যেন সবকিছু; অথচ সেই তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্যে এতটা মারামারি করেও শেষ পর্যন্ত রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামেই আটকে থাকছি! এভাবে না পারলাম আমরা গতিময় জাতি হতে; না পারলাম ‘জার্নি বাই বোট’ রচনা লিখতে। যে জাতি ‘জার্নি বাই বোট’ কি জিনিস সেটা ভুলতে বসেছে, তাকে সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া কষ্টকর। সে সাধারণ ভ্রমণগুলিকেও বিজনেস ট্রিপ বানিয়ে ফেলেছে। তাই সকল ভ্রমণই তার কাছে বিমানে ভ্রমণ। অথচ বিমানে ভ্রমণ হবার কথা শুধু সময় বাঁচানোর জন্যে। বিদেশে কাজ করার জন্যে দলবেঁধে যাবার সময় কি এমন সময়ের স্বল্পতা? একসময় এই এলাকার মানুষ হজ্জ্ব করতে যেত জাহাজে চড়ে; এখন হজ্জ্বযাত্রাও হয়ে গেছে বিজনেস ট্রিপ! যে জাতি সমুদ্রকে চেনেই না, সে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার লাখ লাখ জনগণের দেখভাল কিভাবে করবে? বিশ্বে নিজেদের বন্ধুদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে কি করে? জরুরী সময়ে জিহ্বা কামড় দিয়ে বৈরি দেশের পায়ে পড়ে তাদের জাহাজের উপরে নির্ভর করাও যেন জায়েজ হয়ে যাবে! দেশের স্বার্থ রক্ষা করার আগে বুঝতে হবে দেশের স্বার্থ কোনটা; তারপর কথা আসবে কিভাবে সেই স্বার্থকে রক্ষা করা যায়। দেশের স্বার্থ অন্তর্নিহিত রয়েছে সেই সংস্কৃতিতে; সেই ‘জার্নি বাই বোট’ রচনার মাঝে! সংস্কৃতি তৈরি না করে ক্রুজ লাইনার পেতে চাইলে সেটা আমাদের না, বরং বিদেশী স্বার্থের তৈলমর্দন হবে!

‘জার্নি বাই বোট’ রচনাই শিশুদেরকে পানির সাথে যোগাযোগ করাবে। মুখস্ত করা রচনা নয়; জীবন থেকে নেয়া রচনা। ‘জার্নি বাই বোট’ সংস্কৃতিই স্থান করে দেবে ‘জার্নি বাই ক্রুজ লাইনার’-এর। নদীর সাথে তার বন্ধন হলেই সে একসময় নদীর মোহনায় সমুদ্রকে খুঁজে পাবে; নদীর লঞ্চ একসময় স্থান করে দেবে সমুদ্রগামী ক্রুজ লাইনারের।

2 comments:

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই

    ReplyDelete
  2. আমি একটা মহা চোর তাই কখনো কখনো আপনার লেখা চুরি করি ভাল লাগে বিদায় কিনতু ক্রেডিটে আপনার নাম বা সাইটের নাম ইউজ করি ক্ষমা করে দিবেন আললাহ আপনার পরিবারের সহায় হোন উভয় জাহানে উত্তম কল্যান দান করুন আমীন । দেশের আপনার মত সৎ থিঙ্ককার বড়ৈ প্রয়োজন ।

    ReplyDelete