পেশী শক্তির প্রদর্শন – শুধু ইউরোপ নয়; বিশ্বের সকল প্রান্তে
২০২৩এর অগাস্টে ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে 'ডালো ইন্ডাস্ট্রি ডেইজ ২০২৩' নামের সামরিক মেলায় ডেনমার্কের নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল হেনরিক রাইবার্গ 'নেভাল নিউজ'কে বলেন যে, ডেনমার্কের নৌবাহিনী প্রতি বছর অন্যান্য ন্যাটো সদস্যদেশের কমপক্ষে একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের স্ট্রাইক গ্রুপের সাথে একত্রিত হয়ে ডেনমার্ক থেকে দূরের গন্তব্যে বিভিন্ন মিশনে অংশ নেয়ার লক্ষ্য রেখেছে। এই মুহুর্তে ন্যাটোর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সাথে তারা কাজ করতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে ভূমধ্যসাগর ও পারস্য উপসাগরে ফরাসী বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সাথে ড্যানিশ যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন ছিল। ড্যানিশ নৌবাহিনী প্রধানের কথাগুলি যে শুধু ডেনমার্কের নয়; পুরো ইউরোপ, তথা পশ্চিমা দেশগুলির, যেটার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা শক্তি প্রদর্শনের হিরিকএর মাঝে।
২০২৪এর দ্বিতীয়ার্ধে ইতালিয়ান নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ক্যাভুর' ও ফ্রিগেট 'আলপিনো'কে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়। এই গ্রুপের প্রধান শক্তি ছিল ৮টা 'এফ-৩৫বি' স্টেলথ যুদ্ধবিমান ও ৭টা 'এভি-৮বি হ্যারিয়ার' যুদ্ধবিমান। 'ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট'এর খবরে বলা হচ্ছে যে, চলতিপথে জ্বালানি ও অন্যান্য সরবরাহের জন্যে এই জাহাজগুলি তাদের মিত্র দেশগুলির সাপ্লাই জাহাজের উপর নির্ভর করেছে। এই জাহাজদু'টাকে ভূমধ্যসাগরে এসকর্ট করেছে ফরাসি ফ্রিগেট 'একোনিট' ও স্প্যানিশ ফ্রিগেট 'নুমানসিয়া'; এরপর লোহিত সাগরে এসকর্ট করেছে ফরাসি ফ্রিগেট 'ফোরবিন' এবং দক্ষিণ চীন সাগরে এসকর্ট করেছে মার্কিন ডেস্ট্রয়ার 'রাসেল'। এরপর ভারত মহাসাগরে ইতালিয় গ্রুপের সাথে ছিল ফরাসি ফ্রিগেট 'ব্রেটানি'। ইতালিয় এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হয় আরেকটা ইতালিয় ফ্রিগেট 'রাইমন্ডো মন্টেকোকুলি'। এই জাহাজটা হাওয়াই দ্বীপে 'রিমপ্যাক ২০২৪' মহড়ায় অংশ নেয়। ইতালিয় জাহাজের গ্রুপ ২০২৪এর অগাস্টে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের পূর্বে ফিলিপাইন সাগরে জাপানি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ইজুমো', ডেস্ট্রয়ার 'ওনামি', ফরাসি ফ্রিগেট 'ব্রেটানি', জার্মান ফ্রিগেট 'বাডেন-উট্টেমবার্গ' ও সাপ্লাই জাহাজ 'ফ্রাঙ্কফুর্ট আম-মেইন' এবং অস্ট্রেলিয়ান ডেস্ট্রয়ার 'সিডনি'র সাথে 'নোবেল র্যাভেন ২৪-৩' যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। এই মহড়ায় জাপানিরা ইতালিয়দের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে 'এফ-৩৫বি' যুদ্ধবিমান অপারেট করার অভিজ্ঞতা নেয়। চীনকে মোকাবিলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে জাপান বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ অপারেট করছে। আর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের আক্রমণাত্মক কনসেপ্টকে ধোঁয়াশার মাঝে রাখতে এই জাহাজগুলিকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ না বলে বলা হচ্ছে 'হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার'! জাপানিদের সাথে মহড়া দেয়া ছাড়াও ইতালিয়রা অস্ট্রেলিয়াতে সেই দেশের বিমান বাহিনীর সাথে 'পিচ ব্ল্যাক' সামরিক মহড়ায় 'এফ-৩৫বি' স্টেলথ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভূমিতে বিমান আক্রমণের মহড়া দেয়; এবং মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুয়ামে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'আব্রাহাম লিংকন'এর সাথে 'এফ-৩৫বি' বিমানে বহণ করা 'এমর্যাম' ক্ষেপণাস্ত্রের লাইভ ফায়ারিং মহড়ায় অংশ নেয়। ফেরত যাবার সময় অক্টোবরে ইতালিয়রা ভারত মহাসাগরে আবারও মার্কিন 'আব্রাহাম লিংকন' গ্রুপের সাথে মহড়ায় অংশ নেয়।
পাঁচ মাস সমুদ্রে থাকার পর গত অক্টোবরের শেষে ইতালিয় নৌবাহিনীর গ্রুপ দেশে ফেরত যায়। তবে এর পরপরই নভেম্বরের শেষে যাত্রা করে ফরাসী যুদ্ধজাহাজের গ্রুপ; যার কেন্দ্রে রয়েছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'শার্ল দ্য গল'। ফরাসি নৌবাহিনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী এই গ্রুপটার ভারতীয় নৌবাহিনীর সাথে 'ভারুনা' মহড়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় 'লা পেরৌজি' মহড়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরে 'প্যাসিফিক স্টেলার' মহড়ায় অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। 'জাপান টাইমস' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে ফরাসি উপনিবেশ এবং সামরিক উপস্থিতি থাকলেও গত চার দশকের মাঝে প্রথমবারের মতো কোন ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন হচ্ছে। এই যাত্রার পথিমধ্যে ভূমধ্যসাগরে মার্কিন ডেস্ট্রয়ার 'পল ইগনাশিয়াস', ইতালিয় ফ্রিগেট 'ভারজিনিও ফাসান', গ্রীক ফ্রিগেট 'কুনটুরিওটিস' ও মরক্কোর ফ্রিগেট 'মোহাম্মদ ৬' এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়। 'ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট' বলছে যে, ৩১শে ডিসেম্বর ফরাসি গ্রুপ সুয়েজ খাল অতিক্রম করে লোহিত সাগরে প্রবেশ করে। এই গ্রুপে ছিল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'শার্ল দ্য গল', ডেস্ট্রয়ার 'ফোরবিন', দু'টা ফ্রিগেট, সাপ্লাই জাহাজ 'জাক শেভালিয়ের' এবং একটা পারমাণবিক শক্তিচালিত এটাক সাবমেরিন। ২রা জানুয়ারি সোশাল মিডিয়া 'এক্স'এর এক বার্তায় ফরাসি নৌবাহিনী বলে যে, ফরাসি নৌবাহিনীর গ্রুপ লোহিত সাগর অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে। মার্কিন নৌবাহিনীর এক বার্তায় বলা হচ্ছে যে, ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ফিলিপাইন সাগরে 'প্যাসিফিক স্টেলার' নামের মহড়ায় ফরাসি গ্রুপের সাথে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'কার্ল ভিনসন' এবং জাপানি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'কাগা'র অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মিডিয়া 'গ্লোবাল টাইমস'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে 'বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি'র বিশ্লেষক ঝুও হুয়া বলছেন যে, এশিয়াতে ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের উদ্দেশ্য ফ্রান্সের সামরিক সক্ষমতার জানান দেয়া এবং ইইউএর নিরাপত্তায় ফ্রান্সের ভূমিকাকে হাইলাইট করা। একইসাথে এশিয়াতে ইউরোপিয় সামরিক শক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউরোপের সামরিক গুরুত্বকে তুলে করা হচ্ছে; যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোতে তার অবস্থান ধরে রাখে। কিছুদিন আগেই ইতালিয় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ক্যাভুর' ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন হয়েছিল; আর ২০২৫ সালে ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'প্রিন্স অব ওয়েলস'এরও ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন হবার কথা রয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালির অত্র অঞ্চলে সামরিক শক্তি মোতায়েনের পিছনে লক্ষ্যের ভিন্নতা রয়েছে, তথাপি বাইরে থেকে সামরিক শক্তি মোতায়েন হওয়ার অর্থ হলো এখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে এবং এশিয়ার দেশগুলির স্বাধীনভাবে কোন নিরাপত্তা বলয় তৈরির প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে।
ন্যাটোর লক্ষ্য আসলে কি?
ন্যাটো তাদের লক্ষ্যকে বারংবার পরিবর্তন করছে। বিশেষ করে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অংশ হয়ে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে ন্যাটো তাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে বের হয়ে এসেছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত লোহিত সাগর, আরব সাগর, আদেন উপসাগর ও বাব-এল-মান্ডেব প্রণালি এলাকায় জলদস্যুতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে ন্যাটো তাদের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রাখে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ন্যাটো তাদের লক্ষ্যকে আবারও নতুন করে সাজাচ্ছে। ২০২২এর এপ্রিলে ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান্স স্টলটেনবার্গ জোটের এক আলোচনার পর তার বক্তব্যে বলেন যে, চীন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে ধিক্কার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এবং বেইজিং মস্কোর সাথে যুক্ত হয়ে একটা রাষ্ট্রের নিজস্ব পথ খুঁজে নেয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এমতাবস্থায় স্টলটেনবার্গ তাদের 'আদর্শ'কে রক্ষা করার জন্যে একত্রিত থাকার আহ্বান জানান। তিনি আরও জানান যে, ন্যাটোর লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের এশিয়ার সহযোগী দেশগুলি (অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া) সাইবার নিরাপত্তা, নতুন প্রযুক্তি ও মিথ্যা তথ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এছাড়াও এই দেশগুলির সাথে ন্যাটো নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করছে। কারণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন। ন্যাটো দেশগুলির মন্ত্রীরা একমত হয়েছেন যে, ন্যাটোর সামনের দিনগুলির প্রধান কনসেপ্ট হবে কিভাবে রাশিয়াকে মোকাবিলা করা হবে। এবং প্রথম বারের মতো এর মাঝে হিসেবে নিতে হবে যে, কিভাবে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি এবং আগ্রাসী নীতি ন্যাটোর নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। স্টলটেনবার্গের কথায় বলার অপেক্ষা নেই যে ন্যাটো চীনকে টার্গেট করছে।
২০২৪এর জুনে প্রকাশিত ন্যাটোর এক অফিশিয়াল ডকুমেন্টারিতে বলা হচ্ছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যাটোর আবির্ভাব হয়েছিল শান্তিরক্ষা করা এবং যুদ্ধ এড়াবার জন্যে। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি মোকাবিলায় ১২টা পশ্চিমা দেশ নতুন এই জোট গঠন করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা ছাড়াও এর মাঝে ছিল নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, ইতালি, পর্তুগাল ও আইসল্যান্ড। এর মূল কনসেপ্ট ছিল যে, এই জোটের একটা দেশের উপর হামলা হলে বাকি দেশগুলিও নিজেদের উপর হামলা হয়েছে বলে মনে করবে। সেই সময় থেকে ন্যাটো তাদের সদস্য দেশগুলির জন্যে শান্তি ধরে রেখেছে। ন্যাটোর বর্তমান ৩২টা সদস্য দেশ একমত হলে এই জোটে নতুন রাষ্ট্রকে নেয়া যেতে পারে। তবে সেই দেশকে আদর্শের ব্যাপারে একমত হতে হবে; যেগুলি হলো - ব্যাক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। এর বাইরেও সেই দেশকে জাতিসংঘের চার্টারের সাথে একমত পোষণ করতে হবে। সেই দেশের কিছু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে; যেমন, সেই দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়িত থাকতে হবে এবং বিভিন্ন সংঘাত মোকাবিলায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ইউরোপ তৈরি করবে। এছাড়াও ন্যাটো বিশ্বের অন্যান্য দেশকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করে; যেমন – সন্ত্রাসবাদ, সাইবার নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন। ন্যাটোর আদর্শের সাথে একমত পোষণকারী দেশগুলির সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে ন্যাটোর সীমানার বাইরেও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং একইসাথে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে।
তবে ন্যাটোর এই লক্ষ্যকে কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখে। চীনারা ন্যাটোর লক্ষ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে। চীনা মিডিয়া 'নিউ চায়না টিভি'র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান্স স্টলটেনবার্গ একদিকে চীনকে ন্যাটোর জন্যে হুমকি হিসেবে তুলে ধরছেন; অথচ অন্যদিকে ন্যাটোই অন্যান্য দেশকে একটা নির্দিষ্ট পক্ষাবলম্বন করার জন্যে চাপ দিচ্ছে। বহু বছর ধরেই ন্যাটো মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও শান্তিরক্ষার নামে বারংবার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করে সমস্যা তৈরি করে যাচ্ছে। নিউ নিয়র্কের 'বার্ড কলেজ'এর সিনিয়র ফেলো জন প্যাং 'নিউ চায়না টিভি'র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে মূল দায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা ন্যাটো জোটকেই নিতে হবে। এই যুদ্ধ ২০২২এর ২৪শে ফেব্রুয়ারি শুরু হয়নি; বরং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলিকে ন্যাটোর মাঝে ঢুকাবার মাধ্যমেই এর সূচনা। মিশরের থিংকট্যাঙ্ক 'আল-আহরাম সেন্টার ফর পলিটিক্যাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ'এর গবেষক আহমেদ এলিবা 'নিউ চায়না টিভি'কে বলছেন যে, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির সরকারকে উৎখাতের পিছনে ন্যাটো সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এবং বড় পরিসরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অরাজকতা তৈরিতে পশ্চিমা দেশগুলি ইন্ধন যুগিয়েছে। মেক্সিকোর 'ইউনিভার্সিটি অব গুয়াদালাজারা'র রিসার্চ ডিরেক্টর জাইমে তামায়ো 'নিউ চায়না টিভি'কে বলছেন যে, ন্যাটো প্রকৃতপক্ষে এক মেরুর বিশ্ব বজায় রাখার যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিচ্ছে। ন্যাটো আসলে একটা অপরাধী সংস্থা; যা বিভিন্ন দেশকে ধ্বংস করেছে এবং আরও অনেক দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ওয়াশিংটনের 'আমেরিকান ইউনিভার্সিটি'র এসিসট্যান্ট প্রফেসর এনটন ফেদিয়াশিন চীনা মিডিয়া 'সিজিটিএন'কে বলছেন যে, ন্যাটো ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরিই জড়িয়েছে এবং সেটা ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলি মোটেই গোপন রাখার চেষ্টা করেনি। এমনকি বাইডেন প্রশাসনের মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো রাশিয়ার সক্ষমতাকে খর্ব করা।
শুধু ন্যাটোই নয়; ইউরোপিয় সংস্থা হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ইইউ বৈশ্বিক নিরাপত্তায় অংশ নেয়া থেকে বাদ থাকতে চাইছে না। নিরাপত্তা সংস্থা না হয়েও তারা অনেক বছর ধরেই সামরিক মিশনে অংশ নিচ্ছে। ইইউএর অনেক দেশই ন্যাটোরও সদস্য। তাই ন্যাটোর মিশন থেকে ইইউএর মিশনে যেতে তাদের শুধু নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে আদেন উপসাগর ও আরব সাগরে ইইউ 'অপারেশন আটলান্টা' নামে একটা মিশনের মাধ্যমে জলদস্যুতা মোকাবিলার ছুতোয় যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রেখেছে। ২০২৩এর অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজা থেকে ইস্রাইলের অভ্যন্তরে হামলা হলে গাজার উপর ইস্রাইলের নির্বিচার বোমাবর্ষণ শুধু হয়। হাজারো ফিলিস্তিনিকে হত্যার প্রতিবাদে ইয়েমের হুথি মিলিশিয়ারা ইস্রাইলের উপর এবং লোহিত সাগর ও বাব-এল মান্ডেব প্রণালিতে ইস্রাইলি ও ইস্রাইলের সাথে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক জাহাজের উপর হামলা করা শুরু করে। এর জবাবে ২০২৪এর ফেব্রুয়ারিতে ইইউ লোহিত সাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন শুরু করে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সামরিক শক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে পরিষ্কার করে বলা হচ্ছে যে, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়' সমুদ্র বাণিজ্যের রুটের উপর 'সন্ত্রাসী হামলা'র বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দিতে একত্রে দাঁড়াবে। তবে বেয়ারবক 'আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়' বলতে যে শুধুমাত্র পশ্চিমা দেশগুলিকেই বুঝিয়েছেন, সেটা নিশ্চিত। 'আল-জাজিরা' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপের এলএনজি সরবরাহের ১৩ শতাংশ লোহিত সাগর হয়ে আসে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাহাজগুলি লোহিত সাগর এড়িয়ে চলছে বিধায় ইউরোপে পণ্য সরবরাহের সময় ও খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ন্যাটোর ২০২৪ সালের ডকুমেন্টারিতে পরিষ্কার যে, ন্যাটো তাদের সদস্য রাষ্ট্রদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে। আর ন্যাটোর সদস্য হবার শর্ত হলো পশ্চিমা আদর্শের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা; যার কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। পশ্চিমা আদর্শ রক্ষা করা ও সকলকে এই আদর্শ মেনে চলতে বাধ্য করার জন্যেই পশ্চিমা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলি একের পর এক এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোতায়েন হচ্ছে। অথচ গাজায় ইস্রাইলের বর্বরতার সময় পশ্চিমারা মানবাধিকার ইস্যুতে টিনের চশমা পড়ে ছিল! পশ্চিমা আদর্শের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইস্রাইল আইনের শাসনকে বাইপাস করলেও পশ্চিমারা ইস্রাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। লোহিত সাগরের বাণিজ্য রুট ও ইস্রাইলের নিরাপত্তা বিধানে ইউরোপিয় ইউনিয়নের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন বলে দিচ্ছে যে, ন্যাটো হোক বা ইইউ হোক, পশ্চিমাদের একটা প্রধান স্বার্থ হলো মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ। ইউরোপকে নিজেদের গন্ডি থেকে বের করে ইন্দোপ্যাসিফিকে নিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্র সফল হয়েছে এবং একইসাথে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে বহু যুদ্ধজাহাজের আনাগোণায় ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পেশী শক্তিই যেন এখন পশ্চিমা আদর্শকে দুনিয়ার বুকে জারি রাখার সর্বশেষ উপায়!
No comments:
Post a Comment