Friday 8 September 2023

ভারত মিয়ানমারকে শক্তিশালী করছে কেন?

০৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৩

মিয়ানমারের প্রথম ফ্রিগেট 'অংজেয়া' ২০১৬ সালে ভারতের বিশাখাপত্নম সফরে। জাহাজের উপরে ভারতে তৈরি রাডার দৃশ্যমান। এই রাডার এবং এর সাথে সোনার ও এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো মিয়ানমারের এই জাহাজগুলিকে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছে; যা কিনা চোরাচালান বা সন্ত্রাস দমনে নয়, বরং অন্য রাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে।

মিয়ানমারকে কে অস্ত্র দিচ্ছে না? তবে এক্ষেত্রে ভারত যে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভারত মূলতঃ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তারা কিছু অস্ত্র রপ্তানি শুরু করেছে। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইন্সটটিউট’ বা ‘সিপরি’র হিসেবে ভারত ২০০৮ থেকে ২০২২এর মাঝে ৫’শ ১৩ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করেছে। এর মাঝে সর্বোচ্চ ২’শ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৯ শতাংশ তারা রপ্তানি করেছে মিয়ানমারে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে শ্রীলংকা (১৮ শতাংশ) এবং মরিশাস (১৫ শতাংশ)। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই ভারত মিয়ানমারের কাছে ১’শ ৪৮ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মাঝে মিয়ানমার ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অস্ত্র আমদানি করেছে। এর মাঝে বেশিভাগটাই বা ৪৯ শতাংশ এসেছে চীন থেকে; যা অবাক কোন ব্যাপার নয়। কারণ চীন কয়েক যুগ ধরেই মিয়ানমারের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছে রাশিয়া থেকে; ১৮ শতাংশ। তবে ২০০৮ থেকে ২০২২এর মাঝে হিসেব করলে তা ৩৫ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ এসেছে ভারত থেকে; যা ১৪ শতাংশ। ২০১৪ সাল পর্যন্তও ভারত মিয়ানমারের অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলির মাঝে কোন অবস্থানেই ছিল না। ২০০৮ থেকে ২০১৪এর মাঝে মিয়ানমার মোট ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি অস্ত্র আমদানি করেছিল; যার মাঝে চীন থেকে এসেছিল ৫০ শতাংশ এবং রাশিয়া থেকে ৪২ শতাংশ। ভারত থেকে এসেছিল মাত্র ১ শতাংশ।

মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করা ভারতের কৌশলগত চিন্তার অংশ

২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিয়ানমারের সাথে ভারতের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় ওঠে এবং মিয়ানমারে অস্ত্র রপ্তানি নতুন এক চেহারা পায়। একারণেই ২০১৬-১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গণহত্যা চালাবার পর ১০ লক্ষ মুসলিম শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ভারতের অবস্থান ছিল সরাসরিভাবে মিয়ানমারের পক্ষে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে প্রথমবার এবং ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বার মিয়ানমার সফর করেন। দ্বিতীয় সফর উপলক্ষে ভারতের ‘ইকনমিক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর উপর সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত মিয়ানমারের সাথে নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চাইছে। মোদির মিয়ানমার সফরের অল্প কিছুদিন আগেই ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মিয়ানমারের সামরিক শাসক জেনারেল মিন অং হিলাইং ৮ দিনের জন্যে ভারত সফর করেন। ‘দ্যা ইকনমিক টাইমস’ বলে যে, মিয়ানমার জেনারেলের এই ভারত সফরের আগেই ভারত মিয়ানমারকে যেসকল অস্ত্র সরবরাহ করছিল, তার মাঝে ছিল ১০৫মিঃমিঃ আর্টিলারি কামান, রকেট লঞ্চার, রাইফেল, রাডার, মর্টার, বেইলি ব্রিজ, কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি, নাইট ভিশন ডিভাইস, ওয়ার-গেমিং সফটওয়্যার, রাস্তা তৈরির যন্ত্রপাতি, নৌবাহিনীর গানবোট, সোনার, একুস্টিক ডোম, ডিরেক্টিং গিয়ার, ইত্যাদি। এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৩৮ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে মিয়ানমারকে সাবমেরিন ধ্বংসী টর্পেডো সরবরাহ করছে ভারত। দুই দেশের মাঝে উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক, সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃবর্গের সফরের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের নৌবাহিনী নিয়মিতভাবে মিয়ানমার সফর করছে এবং একত্রে যৌথ মহড়ার আয়োজন করছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জেনারেল হিলাইং আবারও দিল্লী সফর করেন এবং সেই সফরে দুই দেশের মাঝে সামরিক সহযোগিতার এক সহঝোতা সাক্ষরিত হয়।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ২০২২এর ২৭শে অক্টোবর ভারতীয় সরকারি কোম্পানি ‘ইয়ানত্রা ইন্ডিয়া’র পশ্চিমবঙ্গের ইশাপুরের মেটাল এন্ড স্টীল ফ্যাক্টরিতে তৈরি ২০টা ১২২মিঃমিঃ কামানের ব্যারেলের প্রথম চালান মিয়ানমারে আনুষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ করা হয়। ২০২২এর মে মাসে, অর্থাৎ অভ্যুত্থানের পরেই মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কাছ থেকে এই অস্ত্রের অর্ডার নেয় ভারত, যার অংক ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার। ২০২৩এর মে মাসে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ভারতের ২২টা আলাদা কোম্পানি মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। এই কোম্পানিগুলির মাঝে রয়েছে সরকারি কোম্পানি ‘ভারত ডাইনামিক্স’, ‘ভারত ইলেকট্রনিক্স’ এবং ‘ইয়ানত্রা ইন্ডিয়া’। বেসরকারি কোম্পানিগুলির মাঝে রয়েছে ‘সান্দীপ মেটালক্রাফট’ এবং ‘লারসেন এন্ড টুব্রো’। এই অস্ত্রগুলির মাঝে গুরুত্বপূর্ণগুলির মাঝে রয়েছে বিভিন্ন সার্ভেইল্যান্স যন্ত্র, আর্টিলারি এবং ক্ষেপণাস্ত্র বা এর যন্ত্রাংশ। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ভারতের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবার কথা না বলে বরং ভারত সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে চিন্তা করতে আহ্বান জানানো হয়। ভারত সরকার জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের জবাবে বলে যে, ভারত মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারী নয়। আর মিয়ানমারকে বর্তমানে সরবরাহ করা অস্ত্রগুলি সামরিক অভ্যুত্থানের আগেই গণতান্ত্রিক সরকার থাকার সময়েই সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। আর এই অস্ত্র সরবরাহ ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা চিন্তার একটা অংশ।

 
মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তারা ভারতের সোনার ফ্যাক্টরি ভিজিট করছেন। ভারত বলছে যে, মিয়ানমারকে সরবরাহ করা অস্ত্র ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা চিন্তার একটা অংশ।

পশ্চিমারাও মিয়ানমারে ভারতীয় অস্ত্র সরবরাহের সাথে জড়িত

‘দ্যা ওয়্যার’এর এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলির বৈশ্বিক বাণিজ্য তথ্যের ভান্ডার ‘পাঞ্জিভা’র ডাটাবেসের উপর গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, ২০২২এর নভেম্বর থেকে ২০২৩এর এপ্রিল পর্যন্ত ৬ মাসে ভারতের সরকারি কোম্পানি ‘ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড’ বা ‘বিইএল’ মিয়ানমারে ৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে। এই সরঞ্জামগুলি মোট ৭টা শিপমেন্টে আলাদাভাবে পাঠানো হয়েছে; যার ৩টা মিয়ানমার সরকারকে সরাসরি পাঠানো হয়েছে; আর বাকিগুলির মাঝে ৩টা ‘মেগা হিল জেনারেল ট্রেডিং’এর এবং ১টা ‘এলায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস’এর হাত ঘুরে মিয়ানমার সারকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। ‘বিইএল’এর প্রধান শেয়ারহোল্ডার ভারত সরকার হলেও এতে মার্কিন এবং কানাডিয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে; যার মাঝে রয়েছে মার্কিন কোম্পানি ‘গোল্ডমান সাক্স’, বিনিয়োগ জায়ান্ট ‘ভ্যানগার্ড’ ও ‘ব্ল্যাকরক’; রয়েছে ‘কানাডা পেনশন প্ল্যান’, ‘ক্যালিফোর্নিয়া পাবলিক এমপ্লয়িজ রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম’ এবং ‘ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট টিচার্স রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম’। অর্থাৎ শুধু ভারত সরকারই নয়, ভারতের সামরিক শিল্পে বিনিয়োগকারী পশ্চিমারাও মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহের সাথে জড়িত। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ২০২২এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত মিয়ানমারকে কমপক্ষে ৫১ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। একই প্রতিবেদনে বলা হয় একই সময়ে বহু কোম্পানির নামে সিঙ্গাপুর থেকে ২’শ ৫৪ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে; থাইল্যান্ড থেকে সরবরাহ করা হয়েছে আরও ২৮ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। এই সময়ে মিয়ানমারের মোট অস্ত্র আমদানি ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের। এই অস্ত্রের বাণিজ্য সম্ভব হচ্ছে, কারণ জাতিসংঘের কোন সদস্য রাষ্ট্র ‘মিয়ানমার ফরেন ট্রেড ব্যাংক’ বা ‘এমএফটিবি’র উপর অবরোধ দেয়নি। এই ব্যাংক ব্যবহার করেই মিয়ানমার খুব সহজেই অস্ত্র কেনার পেমেন্ট দিতে পারছে।

পশ্চিমারা কখনোই মিয়ানমারকে ভারতের সরবরাহকৃত অস্ত্রের সাথে নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে পারে না। ভারত যেসকল অস্ত্র নিজেরা তৈরি করে, তার অনেকগুলিই পশ্চিমা কোম্পানিগুলির কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তৈরি করা । অর্থাৎ এগুলি অন্য কারুর কাছে রপ্তানি করতে হলে সেই কোম্পানির কাছ থেকে অনুমতি লাগবে। আর সেই কোম্পানি যেই দেশে অবস্থিত, সেই দেশের রাজনৈতিক অনুমোদন ছাড়া তারা ভারতকে অস্ত্র রপ্তানির অনুমতি দেবে না। এটা পশ্চিমা দেশগুলির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ভারত এই প্রক্রিয়ার অধীনে একটা দেশ মাত্র। মিয়ানমার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওয়েবসাইট ‘জাস্টিস ফর মিয়ানমার’ তথ্য প্রকাশ করে যে, ২০১৯ সালে ভারতীয় কোম্পানি ‘সান্দীপ মেটালক্রাফট’ মিয়ানমারে সুইডিশ ৮৪মিঃমিঃ এন্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্র ‘এম৪ কার্ল গুস্তাফ’এর জন্যে ফিউজ সরবরাহ করেছে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরেও খুব সম্ভবতঃ আরেকটা শিপমেন্ট গিয়েছে মিয়ানমারে। ২০২৩এর ২৯শে মার্চ সুইডিশ পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী টোবিয়াস বিলিস্ট্রোমকে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন যে, সুইডেন ভারতের কাছে ‘এম৪ কার্ল গুস্তাফ’ এন্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্র রপ্তানি করেছিল এবং ২০২২ সালে সুইডিশ কোম্পানি ‘সাব’ ভারতে এই অস্ত্রের কারখানা স্থাপন করে। এর মাঝ থেকে কিছু অস্ত্র মিয়ানমারের কাছে যেতে থাকতে পারে। ২০১২ সালে এব্যাপারে একটা তদন্ত হয়েছিল এবং সেই তদন্তে উঠে এসেছিল যে, ভারত তাদের লাইসেন্সের শর্ত মেনে চলছে। তবে ২০১২ সালের পর আর কোন তদন্ত হয়নি। অর্থাৎ গত এক দশকে ভারত এই অস্ত্রগুলি মিয়ানমারের কাছে বিক্রি করেছে কিনা, সেব্যাপারে সুইডিশ সরকারের খুব বেশি একটা মাথাব্যাথা নেই।

 
মিয়ানমারের সাবমেরিন-চেজারের উপর ভারতে তৈরি 'শায়েনা' টর্পেডোর লঞ্চার। বাংলাদেশেও অনেকেই বিদেশী মিডিয়ার রিপোর্টিংএর সাথে তাল মিলিয়ে বলছেন যে, ভারত মিয়ানমারকে অস্ত্র দিচ্ছে চীনকে ব্যালান্স করার জন্যে। কিন্তু তারা পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, এই অস্ত্র কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। মিয়ানমারকে ভারত চোরাচালান ও সন্ত্রাস দমনে অত্যাধুনিক রাডার, সোনার, টর্পেডো এবং সাবমেরিন সরবরাহ করছে - এই কথাগুলি বিশ্বাস করা উন্মাদীয়।

মিয়ানমারের জন্যে ভারতীয় অস্ত্রের ধরণ আলাদা

তবে মিয়ানমারে সরবরাহ করা ভারতীয় অস্ত্রের ধরণ বেশ কিছুটাই অন্যরকম। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘জেনস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সেবছরের জানুয়ারি মাসে ভারতীয় কোম্পানি ‘বিইএল’ মিয়ানমার নৌবাহিনীর জন্যে রাডার এবং সোনার সরবরাহের চুক্তি করে। এর মাঝে রয়েছে ৩টা ‘আরএডব্লিউএল-০২ মার্ক৩’ এল-ব্যান্ডের টু-ডি লং-রেঞ্জ রাডার; যা কিনা ডাচ কোম্পানি ‘সিগনাল’এর ডিজাইন করা ‘এলডব্লিউ-০৮’ রাডারের লাইসেন্স কপি। এছাড়াও এই চুক্তির মাঝে রয়েছে ন্যাভিগেশন রাডার এবং সাবমেরিন খোঁজার সোনার। এই সোনার খুব সম্ভবতঃ ‘এইচইউএমএসএ’ বা ‘হুমসা’ সোনার সিস্টেম। এটাও পশ্চিমা টর্পেডোর আদলে ভারতীয় ডেভেলপমেন্ট। এগুলি মিয়ানমারের ফ্রিগেটগুলিতে লাগানো হবে। এই চুক্তির আগেই মিয়ানমারের প্রথম ফ্রিগেট ‘অংজেয়া’র উপর ভারতে তৈরি ‘আরএডব্লিউএল-০২’এর আগের ভার্সনের একটা রাডার লাগানো হয়েছে। দ্বিতীয় ফ্রিগেটটা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে পানিতে ভাসানো হয়েছিল। আর তৃতীয় ফ্রিগেটটা ২০১০ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১২ সাল নাগাদ পানিতে ভাসানোর জন্যে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। ‘জেনস’এর ধারণা ছিল যে, হয়তো মিয়ানমার তিনটা নতুন ফ্রিগেট তৈরি করছে; যেগুলির জন্যে এই রাডারগুলি কিনেছে তারা। তবে পরবর্তীতে দেখা যায় যে, ২০১৬ সাল নাগাদ মিয়ানমারের তৃতীয় কর্ভেট ‘তাবিনশোয়েহতি’তে এই একই রাডার শোভা পায়। মিয়ানমারে এই রাডারের রপ্তানি বিষয়ে ডাচ কোম্পানি পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়ালেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল সময়ক্ষেপণ মাত্র। পত্রিকায় সমালোচনা সত্ত্বেও ভারত রাডারগুলি মিয়ানমারকে ডেলিভারি দিয়ে যেতে থাকে এবং ইউরোপ থেকেও ভারতের উপরে কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা আসেনি।

২০১৯এর ১২ই জুলাই ভারতীয় কোম্পানি ‘ভারত ডাইনামিক্স লিমিটেড’ বা ‘বিডিএল’ ঘোষণা দেয় তারা মিয়ানমারকে তাদের নিজস্ব ডেভেলপ করা ‘শায়েনা’ এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডোর ডেলিভারি দিয়েছে। ভারতীয় বিশ্লেষণধর্মী ম্যাগাজিন ‘দ্যা ডিপ্লোম্যাট’ বলছে যে, এই ডেলিভারি ২০১৭ সালের ৩৮ মিলিয়ন ডলারের অর্ডারের অংশ। তবে ঘোষণার আগেই ২০১৯ সালের মে মাসে মিয়ানমার নৌবাহিনীর মহড়ায় তাদের ফ্রিগেট ‘কায়ান সিত্তার’ এবং ‘সিন ফায়ু শিন’এ উপর এই ভারতীয় টর্পেডো দেখা যেতে থাকে। এই একই টর্পেডো দেখা যায় মিয়ানমারের দু’টা সাবমেরিন চেজার জাহাজে; যেগুলি ২০২০এর ডিসেম্বরে কমিশনিং করা হয়। প্রতিপক্ষের সাবমেরিন ধ্বংসের জন্যে এগুলির একেকটাতে ৬টা করে টর্পেডো লঞ্চার যুক্ত করা হয়। তবে সেই দিনের সবচাইতে বড় আলোচ্য বিষয় ছিল মিয়ানরের প্রথম সাবমেরিনের কমিশনিং। রাশিয়ায় তৈরি ‘কিলো-ক্লাস’এর সাবমেরিন হলেও ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের ব্যবহারের পর এই সাবমেরিন মিয়ানমারকে উপহার হিসেবে দেয়।

চোরাচালান এবং সন্ত্রাস দমনে রাডার, সোনার, টর্পেডো এবং সাবমেরিন?

ভারতীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, মিয়ানমারের উপকূলে মৎস্য সম্পদ পাহাড়া দিতে, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে এবং সন্ত্রাসী দমনে ভারত মিয়ানমার নৌবাহিনীকে সহায়তা দিচ্ছে। এবং একইসাথে তারা বলছেন যে, ভারত মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে সেই দেশে চীনের প্রভাবকে ব্যালান্স করছে। কিন্তু সমস্যা হলো, তারা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না কিভাবে ভারতের এয়ার ডিফেন্স রাডার, সাবমেরিন খোঁজার সোনার এবং এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো মিয়ানমারের চোরাচালান ও সন্ত্রাসী দমনে সহায়তা করবে। তারা এ-ও ব্যাখ্যা করছেন না যে, মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজে অত্যাধুনিক রাডার, সোনার এবং টর্পেডো বসালে কোন পদ্ধতিতে মিয়ানমারের উপকূল থেকে চীন বিতাড়িত হবে। মিয়ানমারকে ভারত যে সাবমেরিন দিয়েছে, সেটাই বা কিভাবে মিয়ানমারের মৎস্য সম্পদ রক্ষা করবে এবং চীনের প্রভাবকে কমাবে, সেটাও তারা পরিষ্কার করেননি। যতোই উদ্ভট হোক না কেন, এই যুক্তিগুলিই ভারতীয়রা দিচ্ছেন এবং পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এই যুক্তিগুলিই তুলে ধরছেন তাদের বিশ্লেষণে এবং একইসাথে পশ্চিমা মিডিয়াগুলিও এই কথাগুলিই কপি-পেস্ট করছে!

বাংলাদেশেও অনেকেই বিদেশী মিডিয়ার রিপোর্টিংএর সাথে তাল মিলিয়ে বলছেন যে, ভারত মিয়ানমারকে অস্ত্র দিচ্ছে চীনকে ব্যালান্স করার জন্যে। কিন্তু তারা পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, এই অস্ত্র কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। মিয়ানমারকে ভারত চোরাচালান ও সন্ত্রাস দমনে অত্যাধুনিক রাডার, সোনার, টর্পেডো এবং সাবমেরিন সরবরাহ করছে - এই কথাগুলি বিশ্বাস করা উন্মাদীয়। একইসাথে যখন মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্যে ভারতের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের কোন উচ্চবাচ্য নেই, তখন পশ্চিমারা বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থানরত মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত মুসলিম শরণার্থীদেরকে ফেরত পাঠাতে ‘বাংলাদেশের সাথে আছে’ - এই কথাগুলি শুধু হাস্যকরই নয়, বরং কপটতার স্বাক্ষর। ভারতের মতোই বঙ্গোপসাগরে পশ্চিমা প্রতিটা দেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। আর সেই স্বার্থের কেন্দ্রে রয়েছে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে ভারত ব্যাতীত কোন সামরিক শক্তি, বিশেষ করে নৌশক্তির আবির্ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা। সেই লক্ষ্যে তারা একদিকে যেমন চীনা নৌবাহিনীর ভারত মহাসাগরে বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ডেভেলপমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই দুই লক্ষ্য একত্র হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইনে; যেখানে রয়েছে চীনা গভীর সমুদ্র বন্দর, মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের সমুদ্রতট ও সমুদ্রবন্দরের নৈকট্য। বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সাথে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে একটা নৌশক্তির উত্থান ঠেকাতে চাইছে ভারত এবং তার পেছনে থাকা পশ্চিমা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি। মিয়ানমারে বাংলাদেশ সংঘাতে জড়ালে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হবে এবং চীন বাংলাদেশের শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এহেন পরিস্থিতিতে ভারত এবং পশ্চিমারা বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে এগিয়ে আসবে, যাতে করে বাংলাদেশী সেনারা নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণকে নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করে নেয়। মিয়ানমারের তথাকথিত মানবাধিকারের ধোঁয়াশা ভেদ করে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির এই ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য বেরিয়ে আসছে; যা এখন এড়িয়ে যাবার কোন পদ্ধতিই নেই।




সূত্রঃ



‘India supplying fuzes to Myanmar military, deepening complicity in its atrocity crimes’ in Justice for Myanmar, 15 July 2022 (https://www.justiceformyanmar.org/stories/india-supplying-fuzes-to-myanmar-military-deepening-complicity-in-its-atrocity-crimes)

‘Swedish Arms Exported to Myanmar via India Despite EU Embargo: JFM’ in Irrawaddy, 21 June 2023

‘PM Narendra Modi's visit to expand strategic and economic footprint in Myanmar’ in The Economic Times, 31 August 2017

‘India rolls out the red carpet for Myanmar military chief, with an eye firmly on China’ in The Economic Times, 08 July 2017

‘India and Myanmar Sign Mou on Defence Co-Operation’ in Ministry of Defence, India, 29 July 2019 (https://pib.gov.in/PressReleasePage.aspx?PRID=1580637)

‘India supporting Myanmar junta atrocities through supply of gun barrels’ in Justice for Myanmar, 01 March 2023 (https://www.justiceformyanmar.org/stories/india-supporting-myanmar-junta-atrocities-through-supply-of-gun-barrels)

‘How India is supporting Myanmar's military with arms’ in DW, 25 May 2023

‘China, Russia arming Myanmar junta: UN rights expert’ in DW, 22 February 2022

‘Indian PSU Sold Arms, Equipment Worth Over $5 Million to Myanmar Junta in 6 Month Period: Report’ in The Wire, 21 June 2023

‘‘Death trade’. India supplied ₹422 crore worth arms to Myanmar junta: UN’ in The Hindu Business Line, 19 May 2023

‘Indian Torpedoes Delivered to Myanmar Navy’ in The Irrawaddy, 15 July 2019 (https://www.irrawaddy.com/news/burma/indian-torpedoes-delivered-myanmar.html)

‘India Delivers Initial Batch of Indigenously Built Torpedoes to Myanmar Navy’ in The Diplomat, 16 July 2019

‘India to Supply Torpedoes to Myanmar’ in The Diplomat, 31 March 2017

‘Indian manufacturer continues supplying vital technology to Myanmar junta, arms brokers’ in Myanmar Now, 22 June 2023 (https://myanmar-now.org/en/news/indian-manufacturer-continues-supplying-vital-technology-to-myanmar-junta-arms-brokers/)

‘India's BEL Signs Sensor Deal with Myanmar Navy’ by Janes quoted in Defense Studies, 14 March 2013 (http://defense-studies.blogspot.com/2013/03/indias-bel-signs-sensor-deal-with.html)

‘Myanmar Navy has commissioned seven new warships and one submarine’ in Navy Recognition, 26 December 2020

‘The Kilo impact’ by Commodore (ret) Mohammad Abdur Razzak, in New Age, 19 November 2020 (https://www.newagebd.net/article/121954/the-kilo-impact)

13 comments:

  1. "যা এখন এড়িয়ে যাবার কোন পদ্ধতিই নেই।" সত্যিই কি তাই?
    সেটা হলে বাংলাদেশের পক্ষে খুব খারাপ দিন আসছে?
    প্রক্সি ওয়ারের জড়িয়ে গেলে, সাম্নের দিন গুলো খুব ভয়াবহ আকার ধারন করতে পারে।
    এই ব্যাপারে সাম্নের নির্বাচন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

    আপনার আগের লেখা আর এটা পড়ে বোঝা গেল, বাংলাদেশকে চেপে রাখা চক্রান্ত চলছে।
    বাংলাদেশ কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছে? বিভিন্ন সামরিক প্রকল্পগুলির স্ট্যাটাস কি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই লেখার উদ্দেশ্য না যে বাংলাদেশের কি কি সামরিক প্রকল্প আছে সেটা নিয়ে কথা বলা। প্রকৃতপক্ষে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো, যা যা নেই, সেগুলিকে ঠিক করা। অর্থাৎ নিজেদের ঘাটতিগুলিকে পূরণ করা। আপনি হয়তো যুদ্ধ করতে চাইবেন না; কিন্তু আপনার উপরে কেউ যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে। ঠিক যেমনটা করেছে রাখাইনের শরণার্থীদেরকে নিয়ে। আপনি ফেঁসে গেছেন; অথবা আপনাকে ফাঁসানো হয়েছে। সমস্যা হলো, আমাদের রাষ্ট্রের (রাজনৈতিক দলের নয়) রাজনৈতিক দূরদর্শন কতটা রয়েছে, সেটা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যদি অন্যদের কথা অনুযায়ী নিজেদেরকে গোছানোর চেষ্টা করি, তাহলে অন্যদের চিন্তাকেই পূঁজি করে কাজ করা হবে। যেটা বুঝতে হবে তা হলো, অন্যরা তাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী কথা বলে; আমাদের স্বার্থ অনুযায়ী নয়। কাজেই নিজেদের চিন্তা ডেভেলপ করাটা খুবই জরুরি। আপনার কাজগুলি কেমন হবে, তা নির্ভর করবে আপনার চিন্তাটা কেমন, সেটার উপর।

      উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে যাতে বাংলাদেশ চীন থেকে দূরে সরে আসে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের একটা কাজ বা চিন্তার আউটকাম। এই কাজের পিছনে একটা চিন্তা রয়েছে; যা হলো - অন্য যেকোন রাষ্ট্রকে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে না দেয়া। এটা যুক্তরাষ্ট্র করে, কারণ পুঁজিবাদী চিন্তায় বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হলো দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ। আর বেশিরভাগ বাণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। কাজেই যে সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করবে, সে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে; সে-ই দুনিয়ার সকল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করবে; সে-ই দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী এবং নিয়ন্ত্রক হবে। এর আগে ব্রিটেন এটা করেছিল; এখন যুক্তরাষ্ট্র এটা করছে। এটা একটা চিন্তা। পৃথিবীর কোন দেশ যদি তাকে সমুদ্রে চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে সেই তাকে শত্রু মনে করে তার সাথে যুদ্ধ করবে। আবার কেউ যদি পুঁজিবাদী চিন্তা বিরোধিতা করে, তাহলেও তাকে সে সামরিক দিক থেকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবে। আমরা যদি আরেকজনের চিন্তা বহণ করি, তাহলে তার লক্ষ্যই বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবো; আমাদের সামনে কোন অপশন থাকবে না।

      Delete
    2. এখন করণীয় কি? সেটা একটু বলুন। বাচার রাস্তা কি? নিজের চিন্তা নিয়ে এগুনোর সামর্থ কি আমাদের আছে যেখানে আমাদের অর্থনীতি পুরোপুরি পশ্চিমা নির্ভর

      Delete
    3. এর আগের পোস্টের এক কমেন্টে লিখেছিলাম; এখানেও সেটাই বলছি - নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা; বিশেষ করে নিজেদের হেভি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা। অন্যান্য দেশ থেকে সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে এসে নিজেদের সামরিক উৎপাদন বৃদ্ধি করা। একইসাথে মিয়ানমারকে এক হাত দূরে রাখা এবং কোন প্রকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সামরিক সংঘাতে জড়িত হওয়া থেকে দূরে থাকা।

      Delete
    4. বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে পশ্চিমা-নির্ভরতা এর কেন্দ্রে রয়েছে। এটা থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন; তবে তা অসম্ভব নয়। বিশেষ করে নিজেদের হেভি ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে পারলে পশ্চিমা বাজার-কেন্দ্রিক রপ্তানিমুখী শিল্পগুলির প্রয়োজন অনেকটাই কমে আসবে। স্টীল, এলুমিনিয়াম, ইলেকট্রনিক্স, কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রি, পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, জাহাজ নির্মাণ, গাড়ি তৈরি, বিমান নির্মাণ, বিভিন্ন কম্পোনেন্ট ইন্ডাস্ট্রি - যেমন রাবার, প্লাস্টিকের কম্পোনেন্ট, ইঞ্জিন, মোটর, কমপ্রেসার, গিয়ারবক্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি, টেলিকম যন্ত্রপাতি, কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল, ইত্যাদি। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের দিকেও যেতে হবে দ্রুতই; যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে, ততো ভালো।

      আর দুনিয়াকে বহু কোম্পানি এবং লোক আছে যারা টেকনলজি শেয়ার করতে ইচ্ছুক; শুধু তাদেরকে ভালো পেমেন্ট দিলেই হলো। চীন বহু টেকনলজি পেয়েছে এভাবেই। তুরস্ক টেকনলজি শেয়ার করতে ইচ্ছুক; তাই তাদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্টনার করা উচিৎ। ইন্দোনেশিয়ার সাথে কিছু যৌথ কাজ হতে পারে; তারা কিছু জিনিস ভালো বানায়।

      এগুলি করতে পারলে পশ্চিমা প্রভাব অনেকটাই কমে আসবে।

      Delete
  2. বিভিন্ন এংগেল বিবেচনা করে চমৎকার লেখা লিখেছেন। আচ্ছা বাংলাদেশ যদিও যুদ্ধ এড়ানোর সর্ব প্রকার চেষ্টা করবে কিন্তু বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের যুদ্ধটা পশ্চিমারা কিভাবে চাপিয়ে দেবে তার যদি একটা সম্ভাব্য পথ বা রুপরেখা বা অনুমান বলেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. একটা উদাহরণ তো আমাদের সামনেই রয়েছে - শরণার্থী সমস্যা। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে হামলার পিছনে বাইরের হাত ছিল এটা নিশ্চিত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একটা পাশবিক বাহিনী। এটাকে একবার উস্কে দিলে আর কিছুই লাগে না। তারা এটাকে শুধু উস্কে দিয়েছে; বাকিটা মিয়ানমারই করেছে। ফলাফল দেখুন তো - ১১ লক্ষ শরণার্থী দিয়ে কক্সবাজার অঞ্চল ডুবে গেছে। এখন এই শরণার্থীদেরকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা বহু ধরণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর যতদিন এই ষড়যন্ত্র চলবে, ততদিন মিয়ানমার সরকার মনে করবে বাংলাদেশ হলো পশ্চিমা প্রক্সি; পশ্চিমাদের কথা শুনে বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ মিয়ানমার থেকে আলাদা করে ফেলতে চায়। এই চিন্তাটা মিয়ানমারে বেশ প্রবল। তাই তারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না। আবার বাংলাদেশকে তারা ভয়ও পায় না।

      বাংলাদশের নিজস্ব সামরিক শিল্প গড়ে তুলতে পারলে মিয়ানমার একদিকে যেমন শক্তিশালী বাংলাদেশকে ভয় করবে, তেমনি তারা বিশ্বাস করা শুরু করবে যে বাংলাদেশের সরকার পশ্চিমাদের ক্রীড়নক নয়। তখন তারা বাংলাদেশর কথা শুনবে। এবং একইসাথে শক্তিশালী বাংলাদেশ একত্রে ভারত এবং চীনকে শক্ত হাতে ব্যালান্স করবে - এটা মিয়ানমারের জন্যে যথেষ্ট ডেমোনস্ট্রেশন হবে। তারা বাংলাদেশকে এটা করতে দেখলে নিজেরাই সাবমিট করবে এবং স্বেচ্ছায় শরণার্থীদেরকে যত্ন করে ফেরত নেবে; তাদেরকে তাদের ভূমিতে যেতে দেবে এবং তাদেরকে নিরাপত্তা দেবে। কারণ তারা জানে যে, এই মানুষগুলিকে নিরাপত্তা না দিলে বাংলাদেশ তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবে এবং সেটা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধ। মোটকথা শক্তিশালী বাংলাদেশই পারবে মিয়ানমারকে নিয়ন্ত্রণ করতে। তবে এটা করাটা সহজ নয়। সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো চিন্তাগত দিক থেকে নিজেদের উন্নয়ন। অন্যের চিন্তা বহণ করলে অন্যের স্বার্থই বাস্তবায়ন করা হবে। তখন মিয়ানমার বা চীন বা ভারতের মতো কোন দেশই বাংলাদেশকে আমলে নেবে না বা ভয় করবে না। কারণ তারা নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের নিজস্ব কোন চিন্তা নেই; সকল চিন্তাই অন্যের কাছ থেকে পাওয়া।

      Delete
    2. যদি সরকার আগামীকাল থেকেও উদ্যোগ নেয় ভারী শিল্প গঠনে তাতেও তো সময় লাগবে। আর প্রতিবেশীরা তো বসে থাকবে না। খুবই দ্রুত কি করা উচিত এ মুহুর্তে যেন আত্মনির্ভরশীল হতে হতে ব্যাক আপ দেয়া যায়।

      Delete
    3. এই যুক্তিটা দিয়েই এতকাল বেসিক ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে না তুলে আমদানির দিকে যাওয়া হয়েছে। আর আমদানি করার পর বেসিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্যে অর্থ কখনোই থাকে না। কাজেই এই কাজটা সবসময় শর্ট-কাটএর কথা বলে পেছানো হয়েছে - ঠিক এইভাবেই। এতকাল তো বেসিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা হয়নি; অথচ মিয়ানমারের কাছে মান ইজ্জত তো ঠিকই গেছে। ওরা বাংলাদেশের সৈন্যের প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পড়িয়েছে; সেটাও দেখতে হয়েছে। এখন দেখতে হচ্ছে যে, ওরা নিজেদের শিপইয়ার্ডে বিশাল বিশাল যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে; যেগুলির উপরে ভারত রাডার, সোনার আর টর্পেডো বসাচ্ছে। আর আমরা বহু বছর ধরে অন্যের উপর নির্ভরশীল থেকে নিজেদের ফ্রিগেট প্রোগ্রাম শুরুই করতে পারিনি অর্থাৎ এভাব চলতে থাকলে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মাঝে মিয়ানমারকে সামরিক দিক থেকে বাংলাদেশের ৩ থেকে ৪ গুণ শক্তিশালী করে ফেলা হবে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হবে।

      Delete
  3. আগামী নির্বাচন কি পরাশক্তিদের প্রক্সি ওয়ারের ক্ষেত্রে পরিনত হতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি গত মে মাসে পোস্ট করা এই লেখাটা পড়তে পারেন। আশা করি আপনার বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর এর মাঝেই পেয়ে যাবেন।
      https://koushol.blogspot.com/2023/05/bangladesh-election-us-visa-threat-what-is-real-motive.html

      Delete
  4. What is your thinking on the converging world with the consequences from Russo-Nato current war? USA will no longer be able to cover more than two conflicting zone and both China and Russia in the Myanmar side, we will be sitting ducks with primitive doctrine and weapons.
    A defensive conflict can be withstand but that will destabilise the entire east southern zone. Such a big risk to be left out as it can diminish the achievements of 50 years!

    ReplyDelete
    Replies
    1. Probably you had missed out on my writings on China-India conflict. That said, let me give a recap of the perspective, which is important to make a sense of the complex scenario. US aim is to contain China; which is their primary geopolitical objective of the moment. To achieve this, US wants to restrict Russia within Ukraine; so that, in case of a US-China conflict, Russia remains neutral.

      That done, US wants to divide China's resources and to distract it's focus during a conflict centered on Taiwan. To achieve that, US devised their "Indo-Pacific Strategy", which is to involve India in the contain China project. India would engage China in the Himalayas; which would divide China's resources during any conflict over Taiwan against US and its allies. Here, India would play a proxy for US and hold a substantial portion of Chinese Army in the Himalayas.

      To achieve such objective, India needs fastest logistical link with its Seven Sisters; NOT depending on "Chicken Neck"; as China can easily cut off Chicken Neck using ballistic missile or air attack. In such a scenario, India would demand logistical corridor THROUGH Bangladesh. US would support this and would put pressure of Bangladesh to let Indian soldiers go through Bangladesh; especially using Padma Bridge and Matarbari Deep Seaport.

      In the face of impending danger, Bangladesh can try to strengthen itself by developing militarily; but that would not be enough to prevent destruction of most of the country's infrastructure, as well as cession of a part of Bangladesh (Rangpur and Dinajpur) and Matarbari Port to India under pressure of USA.

      To avoid such a disaster, Bangladesh try to elevate itself by some transformative politics (as contrast to superficial cosmetic change). Such a way would prevent such a conflict, as the powerful states described here would not longer look that powerful. I would rather not go into further details here.

      Delete