Tuesday 20 August 2019

কাশ্মির – আবার অগ্নুৎপাতের অপেক্ষায় ভূরাজনৈতিক অগ্নিগিরি


কাশ্মিরের পরিস্থিতির জন্যে মূলতঃ দায়ী অত্র অঞ্চলের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের চিন্তাগুলি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় অবিভক্ত ভারতের ৪০ শতাংশ এলাকা ছিল বিভিন্ন রাজন্যদের হাতে; কাশ্মির ছিল এরকমই একটা রাজ্য। এই রাজ্যগুলির শাসকরা বিভিন্ন চুক্তির বদৌলতে ব্রিটিশ অধীনতা মেনে চলতো। ব্রিটিশ-পরবর্তী জাতীয়তাবাদী ভারতে কাশ্মিরকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কিনা হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আমলে কঠোর আকার ধারণ করে। তবে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যে বলপ্রয়োগের পদ্ধতিগুলি ব্রিটিশ সময় থেকে বিজেপির সময় পর্যন্ত খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। 
২১শে অগাস্ট ২০১৯


ভারতের সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৩৭০’এর মাধ্যমে কাশ্মিরকে আলাদা কিছু সুবিধা দেয়া হতো; যেমন পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি ব্যাপারগুলিতে ভারত সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ভারতের ইতিহাস নিয়ে গবেষক করা লেখক জন উইলসনের মতে, এই আর্টিকেল কাশ্মিরকে ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে আলাদা কোন সুবিধা দিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা মোতাবেক এই আর্টিকেল বাতিল ঘোষণার পর থেকে কাশ্মিরে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে ইন্টারনেট এবং মিডিয়া। ‘বিবিসি’র ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায় যে শ্রীনগরে শুক্রবার জুমআর নামাজের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের উপর কাঁদানে গ্যাস এবং গুলি ব্যবহার করছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, হাসপাতালগুলিতে নেই কোন স্টাফ; আর প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে রাস্তায় বের হলেই জনগণের উপর চলছে নিরাপত্তা বাহিনীর মারধর। ‘এনডিটিভি’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১২ই অগাস্ট ঈদ-উল-আজহার দিন শ্রীনগরের মসজিদগুলি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল; ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতে দেয়া হয়নি।

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কাশ্মিরের এহেন পরিস্থিতির জন্যে মূলতঃ দায়ী অত্র অঞ্চলের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের চিন্তাগুলি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় অবিভক্ত ভারতের ৪০ শতাংশ এলাকা ছিল বিভিন্ন রাজন্যদের হাতে; কাশ্মির ছিল এরকমই একটা রাজ্য। এই রাজ্যগুলির শাসকরা বিভিন্ন চুক্তির বদৌলতে ব্রিটিশ অধীনতা মেনে চলতো। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ব্রিটিশদের আনুগত্য করেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার তাদের স্বায়ত্বশাসন মেনে নিয়েছে। ব্রিটিশ-পরবর্তী জাতীয়তাবাদী ভারতে কাশ্মিরকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কিনা হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আমলে কঠোর আকার ধারণ করে। তবে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যে বলপ্রয়োগের পদ্ধতিগুলি ব্রিটিশ সময় থেকে বিজেপির সময় পর্যন্ত খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভাগের সময় কাশ্মিরের হিন্দু রাজা হরি সিং কাশ্মিরকে ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেন, যদিও বর্তমান কাশ্মিরের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের মতো জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ শতাংশই মুসলিম। কাশ্মিরের হিন্দু রাজাদের শুরু ১৮৪৬ সালে; যখন প্রথম এংলো-শিখ যুদ্ধে শিখদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয়ের পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হেনরি লরেন্স-এর অনুগত দোগরা রাজপুত বংশীয় গুলাব সিং-কে ৭৫ লক্ষ রুপির বিনিময়ে সিন্ধু নদের পূর্ব এবং রাভি নদীর পশ্চিম পাড়ের মাঝের কাশ্মির উপত্যকা নামের পাহাড়ি এলাকাটার রাজত্ব দিয়ে দেয়া হয়। অমরিতসরের চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মির ব্রিটিশদের অধীনে আলাদা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় কাশ্মিরের দোগরা রাজারা বিপ্লব দমনে ব্রিটিশদেরকে যথাসাধ্য সহায়তা করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে ভারতের অংশ হবার সিদ্ধান্ত নেবার আগে রাজা হরি সিং কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেননি। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পাকিস্তান প্রান্তের পুশতুন গোত্রীয় মিলিশিয়ারা কাশ্মির আক্রমণ করলে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন রাজাকে ভারতের কাছে নতি স্বীকার করতে বলেন। সেই হিসেবে ১৯৪৭ সালের ২৬শে অক্টোবর রাজা হরি সিং কাশ্মিরকে ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে চুক্তি সই করেন। তখন কাশ্মিরের অংশ হিসেবে ছিল জম্মু, কাশ্মির, উত্তরের গিলগিট-বালতিস্তান, লাদাখ, ট্রান্স-কারাকোরাম এবং আকসাই চিন। ব্রিটিশ ভারতের সীমারেখার ভাগবাটোয়ারার উপরেই শুরু হয় ১৯৪৭-৪৮ সালের প্রথম পাক-ভারত যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালে ১৩ই অগাস্টের জাতিসংঘ ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়। কাশ্মিরের দুই-তৃতীয়াংশ দেয়া হয় ভারতকে; আর বাকি এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানকে দেয়া হয়। এই যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে পাকিস্তান কাশ্মির থেকে তাদের নিয়মিত এবং অনিয়মিত বাহিনী সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। অল্পসংখ্যক সেনা মোতায়েনের বদলে কাশ্মিরের বেশিরভাগটার নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয় ভারতকে। তবে এখনও পাকিস্তান পুরো কাশ্মিরকে নিজের বলে মনে করে; ভারতও একই নীতিতে রয়েছে। আর অন্যদিকে আকসাই চিন অংশটার দাবিদার হলো চীন।
কাশ্মিরের কিছু ভৌগোলিক বাস্তবতা পাকিস্তান-ভারতকে আটকে রেখেছে। পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মির থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের দূরত্ব মাত্র ৬৭ কিঃমিঃ। এর মাঝের অংশটা বেশ দুর্গম হলেও তা পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়ে পাকিস্তান তার ‘কৌশলগত গভীরতা’ বৃদ্ধি করতে চায়। অন্যদিকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে কাশ্মিরের শ্রীনগরের সড়কপথে দূরত্ব ৯শ’ ১৪ কিঃমিঃ। এই দূরত্ব বেশি মনে হলেও এর মাঝে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা নেই তেমন। অর্থাৎ কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে না থাকলে দিল্লীর নিরাপত্তা হুমকির মাঝে পড়বে। একারণেই দিল্লীর চিন্তাবিদেরা কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অংশ তো নয়ই, কোন প্রকারের স্বাধীনও দেখতে চান না। 



কাশ্মিরকে বলা যায় ভূরাজনৈতিক অগ্নিগিরি। এই অঞ্চলে ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে সংঘটিত হয়েছে চারটা পাক-ভারত যুদ্ধ। ১৯৮৯ সাল থেকে পাকিস্তানের সমর্থনে কাশ্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে; আর ভারত বলছে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের ইন্ধনদাতা। এবছরের ফেব্রুয়ারিতেও পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর আরেকটা ছোটখাটো পাক-ভারত সংঘর্ষ হয়ে গেছে। শুধু ভারত-পাকিস্তানই নয়, আকসাই চিন-এর দাবি করা চীনও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর বিশ্লেষক কেভিন এলিসন বলছেন যে, মোদি সরকারের এই ঘোষণায় কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। পাকিস্তান বলছে যে, ভারতের এই ঘোষণায় কাশ্মিরের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলছেন যে, এই ঘোষণা ভারত সরকারের একটা কৌশলগত ভুল। অন্ততঃ কাশ্মিরের নরমপন্থী রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তারি পরওয়ানা পর সেটাই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে ৬ই অগাস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ ঘাফুর বলেন যে, পাকিস্তান ভারতীয় সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৩৭০’কে কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি; কারণ এই আর্টিকেল কাশ্মিরকে ভারতের অংশ হিসেবে মনে করিয়ে দেয়। কেভিন এলিসন বলছেন যে, কাশ্মিরের জনগণ স্বভাবগতভাবেই নিজেদের মুক্ত দেখতে যায়, যা ভারত সরকার সহজে এড়িয়ে যেতে পাববে না। আর এই আর্টিকেল-ই এতকাল কাশ্মিরের জনগনের একটা বড় অংশকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়ানো থেকে দূরে রেখেছিল। এখন কাশ্মিরের বাইরের জনগণও কাশ্মিরে জমি কিনতে পারবে, যা কিনা কাশ্মিরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে চ্যালেঞ্জ করবে, এবং উত্তেজনা বাড়াবে।

কাশ্মিরের কিছু ভৌগোলিক বাস্তবতা পাকিস্তান-ভারতকে আটকে রেখেছে। পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মির থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের দূরত্ব মাত্র ৬৭ কিঃমিঃ। এর মাঝের অংশটা বেশ দুর্গম হলেও তা পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। ‘দ্যা ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়ে পাকিস্তান তার ‘কৌশলগত গভীরতা’ বৃদ্ধি করতে চায়। অন্যদিকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে কাশ্মিরের শ্রীনগরের সড়কপথে দূরত্ব ৯শ’ ১৪ কিঃমিঃ। এই দূরত্ব বেশি মনে হলেও এর মাঝে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা নেই তেমন। অর্থাৎ কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে না থাকলে দিল্লীর নিরাপত্তা হুমকির মাঝে পড়বে। একারণেই দিল্লীর চিন্তাবিদেরা কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অংশ তো নয়ই, কোন প্রকারের স্বাধীনও দেখতে চান না। বিজেপির বিরোধী দল কংগ্রেস ‘আর্টিকেল ৩৭০’ বাদ দেয়ার সমালোচনা করলেও ভারতের বেশিরভাগ মানুষই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তকমা পাবার ভয়ে তেমন কিছু বলতে নারাজ।

অন্যদিকে কাশ্মিরে রয়েছে চীনের স্বার্থ। পাকিস্তানের মাঝ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিপিইসি’, যা আরব সাগরে গোয়াদর সমুদ্রবন্দর থেকে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের উইঘুর বা শিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ‘সিপিইসি’র মাধ্যমে চীন পূর্ব এশিয়ার মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করে এবং মার্কিন নৌবাহিনীকে এড়িয়ে তার জ্বালানি তেলের সরবরাহ পাওয়া নিশ্চিত করতে চাইছে। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতাতে এই ‘সিপিইসি’ চীনের জন্যে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। অন্যদিকে পাকিস্তান এই প্রকল্প চাইছে তার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে। ‘সিপিইসি’-কে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখে বলেই বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে ভারত সরকার সমর্থন দিয়েছে। ‘সিপিইসি’ চীনে পৌঁছাবার আগে পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মিরের উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভারত-অধিকৃত কাশ্মির থেকে এই ‘সিপিইসি’র এর দূরত্ব ইসলামাবাদের কাছাকাছি ১’শ কিঃমিঃ-এর মতো। চীন শুধু এ-ই দেখতে চায় যে ‘সিপিইসি’র নিরাপত্তা যেন হুমকির মাঝে না পড়ে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির আহ্বানে ১৬ই অগাস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বদ্ধদুয়ার বৈঠকে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুন বলেন যে, ভারতের সংবিধানে পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হতে যাচ্ছে। চীন এক্ষেত্রে সকল পক্ষকে রয়েসয়ে চলার উপদেশ দিচ্ছে। কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে ঐকমত্যে পৌঁছে এই উপদেশ দেয়া সম্ভব হয়নি।

কাশ্মির ইস্যু বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাত্মতা প্রকাশের একটা মাধ্যম। তবে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্ব এই ইস্যুতে ততটা সক্রিয় কিনা, তা প্রশ্ন করাই যায়। ৮ই অগাস্ট সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘গালফ নিউজ’ জানায় যে, সৌদি সরকার কাশ্মিরের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, এবং সেখানে কোন সহিংসতা হোক, তারা তা চাচ্ছেন না। আর এব্যাপারে জাতিসংঘের চুক্তিগুলিকে মেনে চলতেই তারা উপদেশ দিচ্ছেন। ২০১৮ সালে ভারতের সাথে সৌদি আরবের বাণিজ্য ছিল সাড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার; যা হয়তো ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাওয়া থেকে সৌদি সরকারকে বাধা দিতে পারে। অন্যদিকে ১৭ই অগাস্ট তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, তারা চাইছেন যে জাতিসংঘ কাশ্মির ইস্যুতে আরও অগ্রগামী ভূমিকা নিক। আগের দিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এব্যাপারে আলোচনা হওয়াকেই তুরস্ক সরকার ভালো দিক বলে দেখছে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দুই দেশের জাতিসংঘের উপর নির্ভরশীলতাই জানিয়ে দিচ্ছে যে, ১৬ই অগাস্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক থেকে তেমন কিছু না আসাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যদিকে ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরে যেকোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতকে সাবধান করেন। তিনি বলেন যে, ভারত যদি আজাদ কাশ্মিরে সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তাহলে পাকিস্তান তার উচিৎ জবাব দেবে। ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মিরের ব্যাপারে পাকিস্তান অবশ্য জাতিসংঘের দিকেই তাকিয়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, পাকিস্তান সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না জড়াতে চাইলেও কাশ্মিরের উত্তেজনা পাক-ভারত প্রক্সি যুদ্ধকে আবারও উস্কে দিতে পারে। আর সেটার উপর ভর করে বিশ্বব্যাপী মুসলিম আবেগকে নেতৃত্বস্থানীয়রা জনমত আদায়ে ব্যবহার করতে পারেন।

‘আর্টিকেল ৩৭০’ বাতিল করার পর আপাততঃ নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা বাড়বে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দীর্ঘ মেয়াদে কাশ্মিরের উপর ভারত সরকারের আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে এই ঘোষণা। তবে স্বল্প মেয়াদে কাশ্মিরে ভারত-বিরোধী চিন্তা দানা বাধার সম্ভাবনাই বেশি, যা কিনা দীর্ঘ মেয়াদে মোদির সফলতাকে চ্যালেঞ্জ করবে। আর কাশ্মিরে সহিংসতা বৃদ্ধি মানেই পাক-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। মুসলিম বিশ্বে কাশ্মির ইস্যুতে আবেগ থাকলেও মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্ব ভারতের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু করা থেকে বিরত থাকবে। এই আর্টিকেল বাতিলের ঘটনা চীনের ‘সিপিইসি’ বা আকসাই চিন-কে আপাততঃ চ্যালেঞ্জ করবে না; তাই চীনও এব্যাপারে বিশেষ কিছু করা থেকে বিরত থাকবে। পশ্চিমারাও ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত ‘স্থিতাবস্থা’কে পরিবর্তন করতে চায় না বলেই এব্যাপারে খুব বেশি কিছু করবে না। কাশ্মিরের জনগণের কষ্টকে নয়, বরং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে সবাই।

2 comments:

  1. পাকিস্তান কেবল আযাদ কাশ্মির নিয়েই চিন্তিত, জম্নু ও কাশ্মিরকে নিয়ে অতটা নয়। বিশেষ করে ইমরান খানের আমলে। মোদি এতে করে আরও সাহসী হয়ে পড়বে। যা করার করতে হবে কাশ্মিরী জনগনকেই। বিশ্বে এখন নৈতিকতা বলতে কিছুই নেই স্বার্থবাদীতা ছাড়া, আগে যা আন্তর্জাতিক অংগনে ঢেকেঢুকে ছিল এখন তা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা বিশেষ ভাবে চিন্তিত, কারন ভারতকে কোনভাবেই বিশ্বাস করা যায় না।

    আচ্ছা, মোদী মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বেচতেছে ঠিক আছে । কিন্তু আমাদের কাছেও বেচার জন্য চেষ্টা করছে কেন? এর জন্য আমাদেরকে নির্লজ্জ্বভাবে চাপ দিতেও দ্বিধা করছে না। আমাদের ঠিক কিভাবে বার্তা দেয়া উচিৎ ভারতকে? গতকাল এক টক'শ তে দেখলাম মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধ বাংলাদেশ একটু শক্ত অবস্থানে যাবে রোহিংগা প্রত্যাবশ্যন নিয়ে, সেটা কিভাবে বুঝতে পারলাম না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কমেন্টের জন্যে ধন্যবাদ।

      প্রথমতঃ ৭২ বছর পরেও এই উপমহাদেশ ব্রিটিশের তৈরি করা নিয়ম থেকে বের হতে পারেনি। কারণ পাক-ভারতের সৃষ্টিই হয়েছে ১৯৪৭-এর র‍্যাডক্লিফ লাইনকে ধরে রাখার জন্যে। ইমরান খান বা মোদি এই লাইনকে মুছতে পারবে না; কারণ তারা পাকিস্তান-ভারতের সৃষ্টির বাইরে যেতে পারবে না। আর কাশ্মির একটা সমস্যা ১৯৪৭-এর লাইনের কারণেই। এই লাইনই কাশ্মিরকে প্রশ্নের মাঝে ফেলে যে কাশ্মির কার সাথে থাকবে। লাইন না থাকলে এই প্রশ্নের আবির্ভাবই হতো না। পাকিস্তানের পক্ষে এই লাইনের বাস্তবতা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। যদি সেই চেষ্টা কেউ করে, তবে সেটার নাম পাকিস্তান হবে না; অন্য কিছু। পাকিস্তানের সৃষ্টিতত্ত্বের মাঝে এই লাইন মুছে ফেলার ব্যাপারটা নেই; বরং লাইনকে রক্ষা করার ব্যাপারটা আছে।

      দ্বিতীয়তঃ মিয়ানমারের ব্যাপারে আপনি নিচের লেখাটা দেখতে পারেন। সেখানে ভারত এবং চীনের অবস্থানকেও হাইলাইট করা হয়েছে।
      https://koushol.blogspot.com/2018/11/why-myanmar-should-be-under-bangladesh-influence.html

      Delete