Friday 10 May 2019

“ব্লু হোমল্যান্ড” নৌ-মহড়া তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক আকাংক্ষাকেই তুলে ধরে

১০ই মে, ২০১৯

গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে তুরস্কে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নৌ-মহড়া ‘ব্লু হোমল্যান্ড’। তুর্কী নৌবাহিনী বলছে যে, এটা ছিল ১৯২৩ সালে তুরস্কের জন্মের পর থেকে সবচাইতে বড় নৌ-মহড়া; যাতে কিনা ১’শ ৩ খানা যুদ্ধজাহাজ অংশ নিয়েছে। ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ নৌ-মহড়া দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তুরস্ক একটা নৌ-শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।


গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে তুরস্কে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নৌ-মহড়া ‘ব্লু হোমল্যান্ড’। তুর্কী নৌবাহিনী বলছে যে, এটা ছিল ১৯২৩ সালে তুরস্কের জন্মের পর থেকে সবচাইতে বড় নৌ-মহড়া; যাতে কিনা ১’শ ৩ খানা যুদ্ধজাহাজ অংশ নিয়েছে। একইসাথে তুর্কী বিমান বাহিনী এবং সেনাবাহিনীও এই মহড়ায় অংশ নেয়। মহড়ায় ১৩টা ফ্রিগেট, ৬টা কর্ভেট, ১৬টা এসল্ট বোট, ৭টা সাবমেরিন, ৭টা মাইন-হান্টার, ১৪টা প্যাট্রোল বোট-সহ আরও অন্যান্য জাহাজ অংশ নেয়। তুর্কী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার বলেন যে, তুরস্ক তার শক্তিকে অন্যান্য দেশের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে পুরোপুরি সফল হয়েছে। ২৭শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ই মার্চের মাঝে পরিচালিত এই মহড়া ছয় মাস আগ থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছিল; এবং মহড়ার ব্যাপারে গ্রীসকে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল, যাতে করে গ্রীকদের সাথে কোনরূপ বিরোধের সূত্রপাত না হয়। তুরস্কের নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার এডমিরাল চেম গুরদেনিজ-এর মতে, ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ নৌ-মহড়া দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তুরস্ক একটা নৌ-শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের নৌশক্তির মুলে রয়েছে তুরস্কের সামরিক শিল্প; বাহিনীর সংখ্যা বা আকার নয়। মহড়াতে অংশ নেয়া বেশিরভাগ সমরশক্তিই তুরস্কের নিজস্ব কারখানা থেকে তৈরি।

এডমিরাল গুরদেনিজ এ-ও বলছেন যে, এই মহড়া দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণের জন্যে অন্য দেশগুলি একত্রিত হচ্ছে। প্রভাবশালী এই এডমিরালই ২০০৬ সালে ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ নামের জন্ম দেন, এবং একই নামে ২০১৩ সালে তিনি ‘আইদিনলিক’ পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করেন। তুরস্কের ‘হুরিয়েত’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাতে তিনি বলেন যে, তিনি তখনই চিন্তা করেছিলেন যে, ২১-শতকে তুরস্কের জন্যে ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ মহড়া হতে যাচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই মহড়ার মাঝে কৃষ্ণ সাগর, ইজিয়ান সাগর এবং ভূমধ্যসাগর অন্তর্ভূক্ত; আর সামনের দিনগুলিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সাথে অন্যান্য দেশের বিভেদ বাড়তেই থাকবে। আর তুরস্কের সামনে ভূরাজনৈতিক যে চ্যালেঞ্জগুলি রয়েছে, তার মাঝে রয়েছে সমুদ্র-তলদেশের সম্পদ আহরণ, সমুদ্র-বন্দরসহ একটা কূর্দী রাষ্ট্রের জন্ম এবং উত্তর সাইপ্রাসের ভবিষ্যৎ। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ‘এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন’ বা ‘ইইজেড’এর আকার-আকৃতি নির্ধারিত হয়নি, যা কিনা তুরস্ককে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। ইউরোপিয়রা তুরস্কের এই ব্যাপারটাকে সমাধান করার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়। মার্কিন এবং ইউরোপিয় কোম্পানিগুলি গ্রীক-নিয়ন্ত্রিত সাইপ্রাসে খণিজ সম্পদ আহরণে চেষ্টা করছে। গ্রীকরা বহুকাল ধরেই চিন্তা করছিল যে, তুর্কীরা স্থলভাগের শক্তি; ম্যারিটাইম শক্তি নয়। কিন্তু কয়েক’শ বছরের মাঝে প্রথমবারের মতো তুর্কীরা ঘোষণা দিচ্ছে যে, তুরস্ক একটা ম্যারিটাইম শক্তি। গুরদেনিজ বলছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি নিজেদের গ্রুপের বাইরের কোন দেশকে ম্যারিটাইম শক্তি হিসেবে দেখতে চায় না। তারা চায় যে, এই গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান-সহ কয়েকটা দেশই থাকুক। সেই দেশগুলি তাই তুরস্কের নৌ-শক্তিকে আটকাতে বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্র করেছে। এসব ষড়যন্ত্র বানচাল করার পরই ২০০৮ সাল থেকে তুরস্ক ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণসাগরের বাইরে ভারত মহাসাগরেও স্থায়ীভাবে পদার্পণ করেছে। সোমালিয়ার উপকূলে তুর্কী বাণিজ্য জাহাজ হাইজ্যাক হচ্ছিল; যা কিনা সেখানে তুরস্কের নৌ-শক্তি মোতায়েনের সিদ্ধান্তকে প্রেরণা যুগিয়েছে।
 

অবসরপ্রাপ্ত এডমিরাল গুরদেনিজ বলছেন যে, তুরস্ক এখন পৃথিবীর ১৭তম বৃহৎ অর্থনীতি; এবং পৃথিবীর সকল আনাচে-কানাচে তুর্কীরা বসবাস করে এবং সেখানে তুরস্কের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। দেশটার ৯০ শতাংশ বাণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। এই সমুদ্র-বাণিজ্যের পথগুলিকে রক্ষা করার জন্যেই শক্তিশালী নৌবাহিনীর প্রয়োজন। যেখানেই তুর্কী বাণিজ্য জাহাজ যাচ্ছে, সেখানেই তুর্কী নৌবাহিনীর জাহাজকে নিরাপত্তা দেবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। গুরদেনিজের বক্তব্যগুলি তুরস্কের সামরিক নীতিরই প্রতিফলন।


তবে এডমিরাল গুরদেনিজের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য সম্ভবতঃ তুরস্কের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত। তিনি বলছেন যে, তুরস্ক এখন পৃথিবীর ১৭তম বৃহৎ অর্থনীতি; এবং পৃথিবীর সকল আনাচে-কানাচে তুর্কীরা বসবাস করে এবং সেখানে তুরস্কের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। দেশটার ৯০ শতাংশ বাণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। এই সমুদ্র-বাণিজ্যের পথগুলিকে রক্ষা করার জন্যেই শক্তিশালী নৌবাহিনীর প্রয়োজন। যেখানেই তুর্কী বাণিজ্য জাহাজ যাচ্ছে, সেখানেই তুর্কী নৌবাহিনীর জাহাজকে নিরাপত্তা দেবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। গুরদেনিজের বক্তব্যগুলি তুরস্কের সামরিক নীতিরই প্রতিফলন। ইস্তাম্বুলে এখন তৈরি হচ্ছে তুরস্কের প্রথম হাল্কা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আনাদোলু’। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ২০২০-এ এই জাহাজ কমিশনিং-এর পর থেকে তা তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে।     



‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর ‘সেন্টার অন দ্যা ইউনাইটেড স্টেটস এন্ড ইউরোপ’এর এক লেখায় সিনিয়র ফেলো ওমার তাসপিনার তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনশীলতার ব্যাপারগুলিকে তুলে ধরেন। ঠান্ডা যুদ্ধের শেষে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তুরস্ক চলেছে মুস্তফা কেমাল-এর অনুসারীদের কথায়, যাদেরকে চিন্তাগত দিক থেকে ‘কেমালিস্ট’ বলা হয়। ‘কেমালিস্ট’রা ছিলেন ইউরোপ-ঘেঁষা এবং কট্টর সেকুলার। উথমানি সময়ের কোন কিছুই তারা ফিরিয়ে আনতে রাজি ছিলেন না, মূলতঃ ইসলামের ফিরে আসার ভয়ে। সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অফিসারই একসময় কেমালিস্ট ছিলেন। উথমানি সময়ের বৈশ্বিক চিন্তাধারাকে তারা পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে ইউরোপের সাথে মিলিত হবার চেষ্টা করছিলেন। তবে ২০০২ সালে রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের ‘একে’ পার্টি ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র যখন তুরস্কের নতুন ‘মডারেট ইসলামিক’ ধারাকে সমর্থন দিতে শুরু করলো, তখন ‘কেমালিস্ট’রা ‘একে’ পার্টির সকল নীতিরই বিরোধিতা শুরু করলো। ‘একে’ পার্টি ‘ইইউ’এর সাথে একত্রিত হবার জন্যে যখন যারপরনাই চেষ্টা শুরু করলো, তখন ‘কেমালিস্ট’রা ‘ইইউ’এ অন্তর্ভূক্তির বিরোধিতা শুরু করলো। তারা বরং তখন ইউরোপ থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাশিয়া, চীন, মধ্যপ্রাচ্য,এবং অন্যান্য দেশের সাথে কৌশলগত বন্ধুত্ব খোঁজার পরামর্শ দিতে লাগলো। ইতোমধ্যে ‘একে’ পার্টি উথমানি সময়ের গৌরবকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে উথমানি প্রভাবে থাকা এলাকাগুলিকে তুরস্কের প্রভাবে আনার চেষ্টা করা শুরু করে। এই চিন্তাধারাকে তুরস্কে ‘নিও-অটোমান’ বলা হতে থাকে। তবে ‘একে’ পার্টিই এই চিন্তার আবিষ্কারক নয়। তুর্কী প্রেসিডেন্ট তুরগুত ওজাল-ই তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিকে পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে এই চিন্তাকে ‘নিও-অটোমানিজম’ বলে আখ্যা দেন তুর্কী লেখক চেঙ্গিজ চান্দার। চান্দার বলা শুরু করেন যে, তুরস্কের ‘কেমালিস্ট’ চিন্তা বর্জন করা উচিৎ। তুরগুত ওজালের ‘মাদারল্যান্ড’ পার্টির চিন্তাই ‘একে’ পার্টি’র জন্ম দিয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০২ সালে ‘একে’ পার্টি ক্ষমতায় আসার পর এরদোগান তার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আহমেত দাভুতোগলুর নেতৃত্বে তুরস্কের বঞ্চিত পররাষ্ট্র দপ্তরকে বড় করেন এবং এই দপ্তরের কর্মকান্ডকে নতুন রূপ দেন। দাভুতোগলু একজন চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং কূটনীতিবিদ, যিনি তার “স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ” বই-এর মাধ্যমে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘নিও-অটোমান’এর দিকে ধাবিত করেন। “স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ” বলতে তিনি ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক – উভয় দিক থেকেই তুরস্কের কৌশলগত প্রভাবের কথা বলেন, যেক্ষেত্রে উথমানি সময়ের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলিকে পুঁজি করেই সামনে এগুতে হবে বলেন তিনি। দাভুতোগলুর নীতি অনুসরণ করেই তুরস্ক আশেপাশের দেশগুলির সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। কুর্দী বিদ্রোহীদের ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে তুরস্ক একাধারে ইরান, ইরাক এবং সিরিয়ার সাথে আলোচনা শুরু করে। এরপর ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন তুরস্কের ভূখন্ড ব্যবহার করে ইরাক আক্রমণের চিন্তা করে, তখন দাভুতোগলুর নীতি অনুসরণ করেই তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে ‘না’ বলে। এরপর সিরিয়া যুদ্ধের সময় তুর্কীরা সিরিয়া এবং ইরাকে পুরোপুরি জড়িয়ে যায়। সোমালিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে তুরস্ক। সৌদি গ্রুপের সাথে উত্তেজনার জের ধরে কাতারেও সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে তুরস্ক। ২০১৮-এর সেপ্টেম্বরে এরদোগান ঘোষণা দেন যে, আফ্রিকাতে তুরস্কের দূতাবাসের সংখ্যা ১২ থেকে বাড়িয়ে বর্তমানে ৪১ করা হলেও, সেই সংখ্যাকে বর্তমানে ৫৪-তে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। সুদানেও নৌঘাঁটি তৈরির চেষ্টায় রয়েছে তুর্কীরা। ইউরোপে বসবাসরত তুর্কীদেরকেও তুরস্ক ব্যবহার করছে সেসব দেশে তুর্কী প্রভাব বাড়াতে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতেও তুরস্ক তার প্রভাব বাড়াচ্ছে কাজাখস্তান, জর্জিয়া এবং আজেরবাইজানের মাধ্যমে।

একইসাথে দাভুতোগলু পুরো মুসলিম দুনিয়াকে 'এক উম্মা' হিসেবে চিন্তা করতে চাইছেন। এবং জাতিরাষ্ট্রের ভিতকেও তিনি প্রশ্ন করছেন তার লেখায়। তিনি আরও বলছেন যে, দুনিয়ার ১৬টা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের আটটাই মুসলিম দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে, যা কিনা মুসলিম দুনিয়াকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে। তবে তিনি তুর্কী জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করেই মুসলিম উম্মাকে এক বলে চিন্তা করেছেন। বর্তমান তুরস্ক জাতিরাষ্ট্র কনসেম্পট-এরই অংশ, যা নিয়ে প্রশ্ন করে তিনি তুর্কী জাতীয়তাবাদীদের ক্ষেপিয়ে তুলতে চাননি।  
  
আহমেত দাভুতোগলু একজন চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং কূটনীতিবিদ, যিনি তার “স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ” বই-এর মাধ্যমে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘নিও-অটোমান’এর দিকে ধাবিত করেন। “স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ” বলতে তিনি ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক – উভয় দিক থেকেই তুরস্কের কৌশলগত প্রভাবের কথা বলেন, যেক্ষেত্রে উথমানি সময়ের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলিকে পুঁজি করেই সামনে এগুতে হবে বলেন তিনি।



তবে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই ‘নিও-অটোমান’ এবং ‘কেমালিস্ট’ উভয় দলই বর্তমানে তুরস্কের বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক প্রভাবকে পুনরুদ্ধ্বার করার চেষ্টায় মনোযোগী হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে উভয় পক্ষই তুরস্ককে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দেখার চেষ্টা করছে; উভয় পক্ষই তুরস্কের সামরিক শক্তিকে উন্নত করে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ক্ষেত্রে এর উপযোগী ব্যবহার খুঁজতে চাইছে। এই দুই গ্রুপের এক গ্রুপ উথমানি খিলাফতের সময়কার ইসলামিক ভাবধারাকে যেমন বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করতে চাইছে, তেমনি আরেক গ্রুপ কট্টর সেকুলার চিন্তাকে লালন করেই তুরস্ককে পশ্চিমা চাপের মাঝ থেকে বের করে আনতে চাইছে। উভয় পক্ষই মূলতঃ জাতীয়তাবাদী চিন্তা দ্বারা ধাবিত। তবে এই চিন্তা ক্রমশঃ তুরস্ককে পশ্চিমাদের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে।

অনলাইন নিরাপত্তা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রকস’এর এক লেখায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার নেভাল পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্কুলের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের প্রফেসর রায়ান জিনগেরাস বলছেন যে, যদিও বর্তমানে তুরস্ক ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক জটিল সম্পর্কের মাঝে আটকে আছে, তদুপরি তুর্কী জনগণের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন এখন প্রবল। আর এই স্বপ্নের প্রমাণ তুরস্কের রাজনৈতিক ক্যানভাসের সর্বকোণেই দৃশ্যমান হচ্ছে। রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, মিডিয়ার লোকজন, সামরিক অফিসার, ব্যবসায়ী, ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ এখন তুরস্কের বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে কথা বলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের উথমানি খিলাফতের সময়ের স্মৃতিকেই তুরস্কের জনগণ এখন আঁকড়ে ধরে সামনে এগুতে চাইছে। তুরস্কের বিভিন্ন মহলে এখন মুস্তফা কেমাল আতাতুর্কের সময়কার ক্ষুদ্র পরিসরের পররাষ্ট্রনীতিকে সমালোচনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, উথমানি সময়ে তুরস্কের যেমনি একটা বৈশ্বিক চিন্তা ছিল, সেটা আতাতুর্কের সময় অব্যহত না রাখার কারণে জন্মের পর থেকেই তুরস্ক উথমানি সময়ের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানের কিছুই ধরে রাখতে পারেনি। বিশেষ করে উথমানি সময়ে ইস্তাম্বুলের সরাসরি শাসনের অধীনে থাকা পুর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চল, সিরিয়া, মিশর, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা, এবং পারস্যে (ইরাক) ১৯২৩-পরবর্তী তুরস্কের কোন প্রভাব ছিল না বললেই চলে। প্রফেসর জিনগেরাসের মতে, তুরস্কের জনগণের আকাংক্ষা তুরস্ককে এমন এক দিকে ধাবিত করছে, যা কিনা দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের ভবিষ্যৎ বিভেদের গল্পটা লিখে দিচ্ছে।

No comments:

Post a Comment