Monday 20 May 2019

ব্যাটল ফর দ্যা ইন্ডিয়ান ওশান – (পর্ব ১ - মুসলিম লেক)


পারস্য উপসাগরের বসরা থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত ৭০ দিনে যাওয়া যেতো। ভুমধ্যসাগরে একটা জাহাজের গতি ছিল এর প্রায় অর্ধেক। দ্রুত এবং সহজ পরিবহণের কারণেই ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের প্রসার সহজ ছিল।

২০শে মে ২০১৯

ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ রবার্ট ডি ক্যাপলান ভারত মহাসাগরকে বুঝতে গিয়ে অত্র অঞ্চলের অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন; বুঝতে চেষ্টা করেছেন এখানকার ভূমি, মানুষ, জলবায়ু, কৃষি, ভাষা, সংস্কৃতি। তাঁর কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এই মহাসাগরের মৌসুমি বায়ু। এই মৌসুমী বায়ু অন্যান্য মহাসমুদ্রেও রয়েছে; তবে সেসব সাগরের মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতি ভারত মহাসাগরের মতো পরিবর্তনশীল নয়। ভারত মহাসাগরে বছরের ছয় মাস এই বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে প্রবাহিত হয়; বাকি ছয় মাস পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে উত্তর-পূর্ব দিক হতে প্রবাহিত হয়। অন্যান্য সাগরে ঋতুর পরিবর্তনে বাতাসের গতি এবং কিছুটা ক্ষেত্রে দিক পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ভারত মহাসাগরের মতো একেবারে উল্টো দিক প্রবাহিত হয় না। তা-ও আবার এই মৌসুমী বায়ুর ধরণ অতি নিয়মিত। এটা কোন দিন থেকে দিক পরিবর্তন করবে, সেটা মোটামুটিভাবে জানাই থাকে। একারণে অত্র এলাকার মানুষ তাদের জীবন-জীবিকাকে এই মৌসুমী বায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। ক্যাপলানের কাছে এই ব্যাপারটাই ভূরাজনৈতিক দিক থেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এই মৌসুমী বায়ুকে কাজে লাগিয়েই ভারত মহাসাগরের আশেপাশে বাস করা মানুষেরা পাল তোলা জাহাজের ব্যবহার করে পরিবহণ এবং বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। সময় বুঝে জাহাজের পাল তুলে দিলেই হলো; মৌসুমী বায়ুই জাহাজকে একেবারে সাগরের ওপাড়ে নিয়ে যাবে – রেকর্ড সময়ে। পারস্য উপসাগরের বসরা থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত ৭০ দিনে যাওয়া যেতো। ভুমধ্যসাগরে একটা জাহাজের গতি ছিল এর প্রায় অর্ধেক। দ্রুত এবং সহজ পরিবহণের কারণেই ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের প্রসার সহজ ছিল।

বাণিজ্যের সাথে ইসলাম...

বাণিজ্য করতো আরবের মানুষ। মরু এলাকায় শস্য হয় খুব কম। তাই বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক কিছুই দূর দেশ থেকে কিনে আনতে হতো। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীন ছিল বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদনকারী এবং একইসাথে বড় বাজার। আর অত্র অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথে বাণিজ্যের প্রসার ঘরে আরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর আন্দ্রে উইঙ্ক বলছেন যে, ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অবস্থানে ভারত এবং এর পূর্ব-পশ্চিমে চীন এবং আরব থাকার যে ভৌগোলিক সুবিধা তৈরি হয়েছিল, তা ইসলামের অধীনেই সবচাইতে বেশি কার্যক্ষমতা লাভ করে। ইসলামিক দাওয়া পৌঁছে দেবার চেষ্টা এতে আরও গতি সঞ্চার করে। আরবের মুসলিম বণিকেরা পুরো ভারত মহাসাগর চষে বেড়িয়েছেন। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া-ফিলিপাইন এবং চীন পর্যন্ত বাণিজ্যের সাথে সাথে ইসলামের দাওয়া পৌঁছে যায়। পুরো ভারত মহাসাগর জুড়ে মুসলিম বণিকেরা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির প্রসার ঘটান। প্রতিটা বাণিজ্য কেন্দ্রে ছিল মুসলিম জনগণ এবং এর সাথে ছিল মুসলিম সংস্কৃতির উদাহরণগুলি; যেমন মসজিদ। ভারতের কর্ণাটক উপকূল, বাংলার চট্টগ্রাম বন্দর, বার্মার উপকূল, আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্বের মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, মালাক্কা, মালুকু দ্বীপপুঞ্জ, ব্রুণাই, ফিলিপাইনের মাইনিলা (বর্তমান ম্যানিলা) এবং মিন্দানাও – সকল স্থানেই মুসলিম সংস্কৃতি শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে যায়।

পূর্ব আফ্রিকার পুরো উপকূল মুসলিমদের অধীন ছিল। অষ্টম শতকেই মোজাম্বিক পর্যন্ত ইসলাম পৌঁছে যায়। আর ১০ম শতক নাগাদ ইসলাম ছিল পূর্ব আফ্রিকার একমাত্র শক্তি। ভারতের দক্ষিণের কর্ণাটকে ইসলাম পৌঁছে যায় সপ্তম শতকে। মুসলিম বণিকেরা আফ্রিকা থেকে কফি, ইন্দোনেশিয়া থেকে মসলা, আর চীন থেকে কাগজ নিয়ে আসে কর্ণাটকে। অষ্টম শতকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধু অঞ্চল ইসলামের অধীনে আসে; আর তের শতক নাগাদ পুরো ভারতেই ইসলামের শাসন কায়েম হয়ে যায়। সপ্তম শতকেই ইন্দোনেশিয়া এবং চীন পর্যন্ত ইসলামের বাণী পৌঁছে যায়। ত্রয়োদশ শতকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার উত্তরের আচেহ এলাকায় ইসলামের শাসন কায়েম হয়। চতুর্দশ শতকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বের মালুকু দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম পৌঁছায়। সেখানকার মসলা ছিল ভারত মহাসাগরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার মাঝে অন্যতম। একই সময়ে ফিলিপাইনের দক্ষিণে মিন্দানাও-এ ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায় ১৩৯০ সাল নাগাদ। মালয়, ব্রুণাই এবং ফিলিপাইনের বাকি এলাকায় ইসলাম কায়েম হয় পঞ্চদশ শতক থেকে ষোড়শ শতকের মাঝে।
ইউরোপিয়দের আগমণের আগ পর্যন্ত ভারত মহাসাগর ছিল একটা “মুসলিম লেক”। এই বিশাল মহাসমুদ্রের চারিদিকে ছিল মুসলিম সভ্যতা। অমুসলিমরা যারা এই মহাসাগরে বাণিজ্য করেছে, তারা মুসলিমদের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখেই বাণিজ্য করেছে। কোন যুদ্ধ ছিল না এই সাগরে; ছিল না যুদ্ধজাহাজ। বন্দর দখলের কোন প্রতিযোগিতাও ছিল না।

“মুসলিম লেক”?

পঞ্চদশ শতক নাগাদ ভারত মহাসাগর-সহ এর আশেপাশের লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, মালয় দ্বীপপুঞ্জের সাগরসমূহ, দক্ষিণ চীন সাগর এমনকি ফিলিপাইনের আশেপাশের সাগরগুলিতেও মুসলিম বণিকরাই মূলতঃ বাণিজ্য করতো। আর এর বেশিরভাগ অঞ্চলে ইসলামিক শাসন কায়েম হয়ে যাওয়ায় এই বাণিজ্যের ভিত ছিল বেশ শক্ত। চীনের শাসকেরা ইসলাম না নিলেও তাদের কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় লোকেরা ছিলেন মুসলিম। আর মুসলিমদের সাথে চীনারা বাণিজ্য করে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করায় চীনের উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা ছিল; মসজিদও ছিল অনেক। ভারত মহাসাগর-জুড়ে বাণিজ্য জাহাজ চলতো শুধু মুসলিমদেরই। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সেসময়ের এই ইতিহাসের নিদর্শন পাওয়া যায়। সেখানকার বাণিজের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলির মাঝে ছিল জানজিবার, মোম্বাসা, মোগাদিশু, মালিন্দি, কিলওয়া, পেমবা, ছাড়াও মোট প্রায় ৪০টার মতো বন্দর। এই বন্দরগুলিতে আজও পাওয়া যায় আরব, ভারতীয়, ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমদের এবং তাদের নিয়ে আসা সংস্কৃতিকে।

ব্রিটিশ ভূগোলবিদ এবং ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার ‘ক্লোজড সী’-এর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। ‘ক্লোজড সী’ হলো এমন এক সাগর, যার চারিপাশের স্থলভাগ একটা শক্তির নিয়ন্ত্রণে। একসময় রোমান সাম্রাজ্য পুরো ভূমধ্যসাগর নিজেদের অধীনে নিয়ে নিয়েছিল। এর উত্তরের পুরো উপকূল (বর্তমান স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস, তুরস্ক) ছিল তাদের অধীন; পুর্বের সিরিয়া উপকূল এবং দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকার পুরো উপকূলও (বর্তমান, মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো) চলে আসে তাদের দখলে। অর্থাৎ পুরো ভূমধ্যসাগরের উপকূল তাদের সাম্র্যাজের মাঝে চলে আসে। এমতাবস্থায় এই সমুদ্রে তাদের নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউই ছিল না। তাই এই সাগর ধরে রাখতে তাদের কোন নৌবাহিনীই দরকার ছিল না। উত্তর আফ্রিকার কার্থেজ সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধের সময় রোমানদের বিরাট নৌবাহিনী তৈরি করতে হয়েছিল। তবে কার্থেজদের সাথে জিতে যাবার পর এই নৌবহরের আর দরকার ছিল না। রোমানদের মতো এরকম উদাহরণ আরও রয়েছে। যেমন সপ্তদশ শতক পর্যন্ত উথমানি খিলাফতের অধীনে ছিল পুরো কৃষ্ণ সাগর। অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ রাশিয়ার অধীনে চলে যাবার পর কৃষ্ণ সাগরের নিয়ন্ত্রণ হারায় উথমানিরা। এরপর থেকেই কৃষ্ণ সাগরে রুশদের মোকাবিলায় তাদেরকে নৌবহর রাখতে হয়েছে। 

‘ক্লোজড সী’ হলো এমন এক সাগর, যার চারিপাশের স্থলভাগ একটা শক্তির নিয়ন্ত্রণে। একসময় রোমান সাম্রাজ্য পুরো ভূমধ্যসাগর নিজেদের অধীনে নিয়ে নিয়েছিল। এর উত্তরের পুরো উপকূল (বর্তমান স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস, তুরস্ক) ছিল তাদের অধীন; পুর্বের সিরিয়া উপকূল এবং দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকার পুরো উপকূল (বর্তমান, মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো) চলে আসে তাদের দখলে।

এরও আরও অনেক পর ব্রিটিশরা ভারত মহাসাগরের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল ঊনিশ শতকে। সেসময় ভারত মহাসাগর এবং তৎসংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরে ফরাসী, জার্মান, ডাচ, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, এমনকি মার্কিনীরাও পরবর্তীতে যোগ দেয়। রুশ এবং জাপানিরাও একসময় নিজেদের নৌশক্তি প্রতিষ্ঠা করে। এরপরেও ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার দরজাগুলি। দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ব্রিটিশদের হাতে; আর সুয়েজ খাল তৈরি হবার আগ পর্যন্ত ইউরোপের যেকোন জাহাজকে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে আসতে হতো। ভারত মহাসাগরের পূর্ব আফ্রিকা উপকূল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, বার্মা ছিল ব্রিটিশ অধীনে। তাই কারুর সাধ্যি ছিল না ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে। সিঙ্গাপুর ছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বিরাট ঘাঁটি; যা কিনা পূর্ব দিক থেকে ভারত মহাসাগরে ঢোকার পথ নিয়ন্ত্রণ করতো। সুয়েজ খাল খনন শেষ হয় ১৮৬৯ সালে। ব্রিটিশরা সেটারও নিয়ন্ত্রণ নেয়। এছাড়াও ভূমধ্যসাগরে জিব্রালটার, মাল্টা এবং সাইপ্রাস দ্বীপ তাদের অধীনে থাকায় সুয়েজ খাল দিয়ে ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া কারুর পক্ষে ভারত মহাসাগরে ঢোকা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ঊনিশ শতকে সম্পূর্ণ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে ছিল ভারত মহাসাগর। এই মহাসাগর হয়ে গিয়েছিল একটা “ব্রিটিশ লেক”!

তবে ইউরোপিয়দের আগমণের আগ পর্যন্ত ভারত মহাসাগর ছিল একটা “মুসলিম লেক”। এই বিশাল মহাসমুদ্রের চারিদিকে ছিল মুসলিম সভ্যতা। অমুসলিমরা যারা এই মহাসাগরে বাণিজ্য করেছে, তারা মুসলিমদের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখেই বাণিজ্য করেছে। কোন যুদ্ধ ছিল না এই সাগরে; ছিল না যুদ্ধজাহাজ। বন্দর দখলের কোন প্রতিযোগিতাও ছিল না। ইসলামিক চিন্তাতে অর্থ তেমন গুরুত্ব বহণ করে না; যেকারণে বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদশালী হলেও আট’শ বছরের মাঝে জোর করে নিজেদের একচেটিয়া বাণিজ্য ধরে রাখার চেষ্টা কেউ করেনি। অপরের গলা কেটে নিজে বিত্তবান হবার প্রবণতা ছিল না। বাণিজ্যের প্রসারে পুরো ভারত মহাসাগরের চারিদিকের মানুষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছিল। “মুসলিম লেক” পাল্টে যায় চতুর্দশ শতকের শেষে ভারত মহাসাগরে পর্তুগীজদের আবির্ভাবের পর থেকে। ভারত মহাসাগরের পরবর্তী ইতিহাস রক্তপাতের।


-------------------------------------------------------

‘Monsoon: The Indian Ocean and the Future of American Power’ by Robert D Kaplan, 2011

‘Al-Hind: The Making of the Indo-Islamic World’ by Andre Wink, 2002

‘Democratic Ideals and Reality: A Study in the Politics of Reconstruction’ by Sir Halford J Mackinder, 1919

1 comment:

  1. অপেক্ষায় থাকলাম পরবর্তী পর্বের জন্য। জানার আছে অনেক কিছুই।

    ReplyDelete