১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ের কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। যারা তখন জন্মেনি বা বয়সে খুব বেশি ছোট ছিল, তারা অগ্রজদের কাছ থেকে জেনেছেন সেই দুর্যোগের দিনটির কথা। সেদিনের বহু দুর্যোগের মাঝে একটি দুর্যোগের কথা অনেকেই মনে রাখেনি, বা মনে রাখার চেষ্টা করেনি। চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে ওই মুহুর্তে অবস্থান করছিলো বিমান বাহিনীর বিরাট সংখ্যক ফাইটার জেট। ঝড়ের পরপর বিমান বন্দর থেকে তোলা আলোকচিত্রে গোটা চল্লিশেক যুদ্ধবিমানের তালগোল পাকানো চিত্র চোখে পড়ে। কয়েক লক্ষ মানুষের মৃতদেহের মাঝে সেই ছবিগুলি গৌণ হয়ে গেলেও এটা বোঝা প্রয়োজন যে ওই মুহুর্তে রাষ্ট্র ছিল ভয়ংকরভাবে দুর্বল। শুধু দুর্যোগের কারণেই নয়, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হবার কারণেও। আর এই ধ্বংসজজ্ঞকে শুধু সৃষ্টিকর্তার উপর চাপিয়ে কিছু লোক পার পাবার চেষ্টা করেছিল সেদিন। এদের বিচার হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রের যে ক্ষতি তারা সেদিন করেছিল, সেটা এই লোকগুলিকে শতবার শিরচ্ছেদ করলেও পোষাবে না! দেশের প্রতিরক্ষাকে এক সুযোগে পঙ্গু করার উদ্দেশ্যেই এতগুলি বিমানকে ঘুর্ণিঝরের পূর্বাভাষের পরেও চট্টগ্রাম থেকে সরাবার কোনরূপ চেষ্টাই করা হয়নি। এটাই হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতার উতকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা সেই ঘটনা থেকে কিছু শিখেছিলাম কিনা। এদেশের মানুষের হাত দিয়েই বিদেশী শক্তি যে এই দেশকে দুর্বল করতে পারে, সেটা আমরা কি বুঝেছিলাম কিনা। খুব যে কিছু একটা এখনো বুঝতে পারিনি, সেটার উদাহরণ কিন্তু আমরা সেদিন পেয়েই গেলাম।
নাট-বল্টু নয়, নাট-বল্টু যার হাতে ছিল তার কথা বলছি…
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিমান তুর্কমেনিস্তানে জরুরী অবতরণ করার সাথে সাথে যেসকল প্রশ্ন সামনে আসতে শুরু করেছিল, তার মাঝে প্রথমটিই ছিল – নিরাপত্তায় কোনরকম ঘাটতি ছিল কি না। প্রধানমন্ত্রীর বিমানে নিরাপত্তার সমস্যা মানে যেকোন বিমানেই এই সমস্যা হতে পারে। আর যদি মনুষ্য-সৃষ্ট কারণে নাট-বল্টু হাল্কা হয়ে গিয়ে থাকে, তার মানে হলো নিরাপত্তার ঘাটতি খুঁজতে আমাদের বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দিকে তাকাতে হবে। কিছুদিন আগেই পশ্চিমাদের প্রবল চাপে বিমান বন্দরের নিরাপত্তা তুলে দেয়া হলো বিদেশী কোম্পানির হাতে। এখন সেই সিদ্ধান্তের পর যদি নিরাপত্তার এই অবস্থা হয়, তাহলে প্রশ্ন আসবে – ওই নিরাপত্তা কাদের জন্যে ছিল? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের নিরাপত্তা যেই নিরাপত্তা-বিষয়ক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আসে না, সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল, তা কি এখন প্রমাণ করার কিছু বাকি থাকে? বিমান বন্দরের বিশেষ কিছু এলাকার দখল নিয়েই পশ্চিমারা ক্ষান্ত ছিল – কারণ সেটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। এই দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব অন্যের হাতে দিলে আমরা ‘হোলি আর্টিসান’ ছাড়া ভালো কিছু আশা করতে পারি না।
উপরেই উল্লেখ করেছি যে এই দেশের মানুষের হাত দিয়েই দেশের বিরুদ্ধে কাজ করানো হয়ে থাকে। নাট-বল্টু হাল্কা করার একটা লোকও যদি সেই ভবনের ভেতর রয়ে যায়, এটা যে জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে একটা ভয়াবহ হুমকি, তা আজ দিনের মতো পরিষ্কার। আর আমাদের বিমান বন্দরের সাথে একই রানওয়ে ব্যবহার করছে আমাদের বিমান বাহিনী। একটা ঢিল মারলেও একটা ফাইটার প্লেনের উপরে গিয়ে পড়বে। এটা বুঝতে কি আমাদের কোয়ান্টাম ফিজিক্স পড়ে আসতে হবে? যেদিন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ফাইটার বিমানগুলি উড়বে, সেদিন ওই ভবনের কেউ যে বিমানের দিকে বা ফুয়েল ডিসপেন্সারের দিকে একটা ঢিল ছুঁড়বে না, বা সিগারেটের লাইটখানা নেভাতে ভুলে যাবে না বা পকেট থেকে ভুল করে তার কুকুরের জন্যে জমিয়ে রাখা হাড্ডি রানওয়েতে পড়ে যাবে না, সেটার গ্যারান্টি আমাদের কে দিচ্ছে? রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে রাষ্ট্রের জন্যে পুরোপুরি বিশ্বস্ত লোকদের ছাড়া আর কাউকে দায়িত্ব দেয়ার কোনরূপ সুযোগ নেই – তার যতবড় পশ্চিমা ডিগ্রীই থাকুক না কেন! এই একই রানওয়ে দিয়ে ক’দিন আগেই চীনা প্রেসিডেন্টের বিমান নেমেছিল। সেই নেতার বিমানকে এসকর্ট করেছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফাইটার বিমান – এ তো বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো ব্যাপার হয়ে গেলো। মোটকথা যার উদ্দেশ্য ক্ষতি করা, সে যে কোন সময়েই সেটা করতে পারে; যে কোন উপায়েই করতে পারে। এখানে শুধু উপায় ঠেকিয়ে কাজ হবে না; মানুষ ঠিক করতে হবে। আর মানুষ ঠিক করতে গেলে কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় কাজ কি সামরিক না বেসামরিক?
বিমান বাহিনীর সবচাইতে বড় ঘাঁটি ‘বিএএফ বঙ্গবন্ধু’কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিনই জাতীয় পতাকা প্রদান করে আসলেন। এখানে ঘাঁটি বলতে বোঝানো হয়েছে ঘাঁটিকে যারা সচল রাখে সেই বিমান-সেনারা; মানে গ্রাউন্ড-ক্রু। এর মাঝে মেইনটেন্যান্স, সিকিউরিটি, রাডার অপারেটর, সাপ্লাই চেইন, ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত। এই পুরো চেইন-এর একটা স্থানে ফাটল মানে পুরো ঘাঁটির প্রতি হুমকি। ভারতের পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে জঙ্গী হামলার কথা আমরা এখনও ভুলে যাইনি। আর আমাদের সমস্যা তো আরও ব্যাপক। সবচাইতে বড় এই ঘাঁটি যে সম্ভাব্য রাষ্ট্রদ্রোহীদের আড্ডাখানা থেকে আড়াই ফুট দূরে, সেটা আমরা কতটুকু চিন্তা করে দেখেছি? সবচাইতে বড় সিভিল এবং সবচাইতে বড় মিলিটারি এয়ারপোর্ট তো এখানে একইসাথে। এখন কেউ কি বলবেন যে সিভিল আর মিলিটারি এয়ারপোর্ট আলাদা করে ফেলার জন্যেই এই লেখার অবতারণা? তাহলে সিভিল এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি কি বিদেশী এজেন্সির ‘নিরাপদ’ হাতে তুলে দেয়া হবে? দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিমান তখন রাষ্ট্রদ্রোহীদের আড্ডাখানা থেকেই উড়বে, তাই তো? একটু খেয়াল করে দেখুন তো – এটাই আজ হচ্ছে কিনা? সামরিক-বেসামরিক বিভেদ তৈরি করে আমরা এমন একটা বাজে অবস্থার অবতারণা করেছি, যা থেকে বের হবার কোন তরিকা আমরা পাচ্ছি না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিমানের নাম হলো – ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’, অর্থাৎ সেটা বিমান বাহিনীর বিমান। রাষ্ট্রনায়ককে রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার একটা অংশ। তাই বিমান বাহিনীর হাতে তাদের দেশের প্রেসিডেন্টের বিমান। যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করা উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হচ্ছে মনে করিয়ে দেয়া যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মাঝে কোন সামরিক-বেসামরিক ব্যাপার নেই; রাখা যাবে না। বিমান বন্দরের যেকোন কোণায় নিরাপত্তার চ্যুতি হলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় চ্যুতি। আমরা আজ যদি প্রধানমন্ত্রীর বিমানের নাট-বল্টু খোলাকে মেনে নিই, তাহলে মিগ-২৯-এর দিকে ঢিল ছোঁড়াকে তো খেলা হিসেবেই দেখবো; তাই না? এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না।
প্রথমতঃ যে পশ্চিমারা এই রাষ্ট্রের অংশ নয় এবং এই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করে না, তাদের হাতে বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে যে আমরা ভুল করেছি, সেটা তো বুঝতে বাকি নেই। এতে শুধু যেসব সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে এটা করা হয়েছে, তাদের স্বার্থই রক্ষিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়তঃ বিমান বন্দরের ওই ভবনকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের আড্ডাখানা হিসেবে পোষা যাবে না। আমরা এফ-৭ স্যাবোটাজ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি না। এদেশী লোক দিয়ে বিদেশী স্বার্থ রক্ষা করার দিন শেষ। তারা যতো শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদের পেছনে যতো শ্রমিক সংগঠকই থাকুক না কেন, এদের শেকড় উপড়াতে হবেই। জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে ছাড় দেবার প্রশ্নই আসে না।
তৃতীয়তঃ যে রানওয়ে ব্যবহার করে দেশের সামরিক বিমান এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের বিমান ওড়ে, সেই রানওয়েকে সামরিক-বেসামরিক বিভেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা থেকে বাদ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত রানওয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অংশ হতে হবে; পুরোটার নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা হতে হবে। পুরোটা একটা শরীরের মতো কাজ করবে; শরীরের এক অংশে চিমটি কাটলে সারা শরীর টের পাবে এবং সাথে সাথে ব্যবস্থা নেবে।
চতুর্থতঃ নাট-বল্টুর উপর দোষ চাপানোর মানে কি? অর্থাৎ আবারও সেই ১৯৯১-এর মতো সৃষ্টিকর্তার উপর দিয়ে চালিয়ে নেবার চেষ্টা নাকি? দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া এই ক্ষেত্রে কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ‘আমার অধীনে এগুলি হয়েছে, তবে আমি জানতাম না’ – এধরনের যুক্তি অবান্তর। জাতীয় নিরাপত্তা যেখানে ভূলুন্ঠিত, সেখানে এধরণের গা-বাঁচানো কথা শুনতে আমরা প্রস্তুত থাকবো কেন?
‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের পথে আমরা যদি এসব আবর্জনা পেছনে জমিয়ে রেখে সামনে এগুনোর চেষ্টা করি, তাহলে আমরা হোঁচট খেতে বাধ্য। বিমান বন্দর এবং বিমান বাহিনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলিকে আলাদা করে দেখতে গেলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেয়াও সম্ভব হবে না। এই সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা রাষ্ট্রকে করবে দুর্বল। এই রাষ্ট্রের অতি-গুরুত্বপূর্ণ এই ‘গেইটওয়ে’র নিরাপত্তা এই রাষ্ট্রের হাতেই থাকতে হবে।
quite elaborate and investigative... thanks!
ReplyDeleteঅবশ্যই এইসব আবর্জনা ছুড়ে ফেলতে হবে।
ReplyDeleteসময়োপযোগী লেখা
ReplyDelete