১৩ অগাস্ট ২০১৫
এই নশ্বর পৃথিবীতে এটা
চিন্তা করার উপায় নেই যে কোন একটা ধারণা সারাজীবন টিকে রইবে। ইউনিভার্সাল ট্রুথ ছাড়া
এই কথাটা সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিশেষভাবে প্রযোজ্য ওইসব ক্ষেত্রে যেখানে পরিবর্তন
আসে বেশ দ্রুততার সাথে। আর দ্রুত পরিবর্তন সেখানেই আসে, যেখানে ধারণাটা কোন জাতির অস্তিত্বের
সাথে সম্পর্কিত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চীনের প্রাচীরের কথা। হল্যান্ডের সমুদ্র
উপকূলের বাঁধের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলি তেমন একটা দ্রুত
পরিবর্তনশীল নয়। হল্যান্ডের বাঁধ তৈরির পরে সমুদ্রের ঢেউ হঠাত দু’শ ফুট উপর দিয়ে আসতে
শুরু করেনি। চীনের প্রাচীরের উপর দিয়েও মোঙ্গলরা উড়ে উড়ে আসেনি (যদিও তারা প্রাচীরের
দরজা পার হয়েই চীন জয় করেছিল)। আসলে কথাটা যেখানে নিতে চাচ্ছি, তা হচ্ছে যুদ্ধ। যুগে
যুগে মানুষ বহিঃশত্রুকে মোকাবিলায় নতুন নতুন ধারণার আবির্ভাব ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধ-প্রযুক্তি
এবং কৌশলে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই এই পরিবর্তন হতে হয়েছে দ্রুত।
যারাই এব্যাপারে শম্ভুক গতিতে এগিয়েছে, তারাই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, অথবা অস্তিত্ব
পুরোপুরিই হারিয়েছে। এরই মাঝে কিছু ধারণা রয়েছে যেগুলি সময়ে সময়ে পুণরুজ্জীবিত হয়েছে;
ইতিহাসের হয়েছে পূণর্লিখন। এমনই কিছু ধারণা নিয়ে আজ কথা বলতে চাইছি।
সুইডিশ আর্মি বাকি দুনিয়ার বাহিনীগুলি থেকে পুরোপুরি আলাদা, কারণ তারা বরফকে মাথায় রেখেই তাদের বাহিনী তৈরি করেছে |
পরিবর্তন আসলে কি?
একটা সেনাবাহিনীর গঠনতান্ত্রিক
চিন্তাধারার মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মাঝে একটা হচ্ছে কোন ধরনের বাহিনী
বা অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনী সাজাবে। এক্ষেত্রে সেই দেশের ভৌগোলিক গঠন, রাজনীতি, অর্থনীতি,
জনসংখ্যা ইত্যাদি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুতপূর্ণ সে দেশের সামরিক চিন্তাবিদেরা
কোন ঐতিহাসিক চিন্তাকে প্রাধাণ্য দিচ্ছেন। যেমন বিংশ শতকের যুদ্ধগুলির কথা চিন্তা করে
সামর্থ্য থাকা সেনাবাহিনীগুলি হেলিকপ্টারকে স্থলযুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে
চিন্তা করতে শিখেছে। এক্ষেত্রে কেউ যদি এই হেলিকপ্টারের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে যায়,
তাহলে সে হয়তো শুধু হেলিকপ্টারের টাইপ পরিবর্তন বা যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের অবস্থানগত
পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হবে; অর্থাৎ এই পরিবর্তন যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যাকরণে আমূল পরিবর্তন
আনবে না। অন্যভাবে বললে, আমূল পরিবর্তন আনার জন্যে যতটা সাহসী চিন্তার প্রয়োজন, সেটা
সবাই প্রদর্শন করবে না। তবে এখানে আরেকটি ব্যপারও গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে – সেই পরিবর্তন
কতটা প্রয়োজনীয়, সেটার সঠিক অনুধাবন করতে পারা। ব্যাপক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে মনে হতে
পারে যে নিজেদের সেনাবাহিনী আশেপাশের দেশের সেনাবাহিনীর তুলনায় প্রায় অন্য গ্রহে অবস্থান
করছে। কিন্তু নিজেদের ধারণা যদি শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এরকম চিন্তার আবির্ভাব
নাও আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সুইডেনের সেনাবাহিনীর কথা বলা যেতে পারে। তাদের পুরো সেনাবাহিনীই
বরফের উপরে চলাচলের উপযোগী। এটা করতে গিয়ে সুইডেনের সমরবিদদের কঠিন পক্ষেপ নিতে হয়েছে
- অন্যান্য দেশের সেনাসদস্যরা শক্তিশালী অস্ত্র বলতে যা বোঝায়, সেগুলি পুরোপুরি উপেক্ষা
করতে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সুইডেন এমন একটা বাহিনী তৈরি করেছে, যা কিনা বরফের উপরে যুদ্ধ
করার ক্ষেত্রে দুনিয়ার সেরা। তবে বরফ ছাড়া অন্য কোথাও যুদ্ধ করার তেমন একটা চিন্তা
তারা করেনি, কারণ দেশের বাইরে যুদ্ধ করাটা তাদের সরকারের রাষ্ট্রনীতির মাঝে পড়ে না।
অবশ্য আজকের এই আলোচনায় সুইডেনের ভৌগোলিক-চিন্তার সেনাবাহিনীকে প্রাধান্য দেয়াটা উদ্দেশ্য
নয়। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে ভৌগোলিকতাকে সাধারণ ধরে বিশ্বের স্থলযুদ্ধ-কৌশল নিয়ে কথা বলা,
যেখানে ঐতিহাসিক পরিবর্তনগুলি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর এই ঐতিহাসিক চিন্তার
কারণেই ভৌগোলিক চিন্তা বাদ দিয়েই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রেই স্থলযুদ্ধের ধারণাগুলি
হয়েছে বৈশ্বিক ইতিহাস-নির্ভর, যেটার উদাহরণ হিসেবেই উপরের হেলিকপ্টারের কথা টেনেছি।
পরিবর্তনের ঐতিহাসিক
চেইন
হেলিকপ্টারের কথাই যদি
টেনে নিয়ে যাই, তাহলে দেখবো যে গত পঁচিশ বছরের ইতিহাসে স্থলযুদ্ধে ট্যাঙ্ক-ধ্বংসী হিসেবে
হেলিকপ্টারের সুনাম তৈরি হয়েছে। অথচ এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই এই দায়িত্ব পালন
করেছে রাশিয়ার ইল-২ এবং ইল-১০ বিমান, কারণ তখন হেলিকপ্টার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধাস্ত্র
হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দেখলে দেখবো তেমন কোন শক্তিশালী
বিমানই ছিল না; ট্যাঙ্কের আবির্ভাবই তো তেমন ভয়ঙ্করভাবে হয়নি। এসবের অর্থ হচ্ছে, মাত্র
এক’শ বছরের মাঝেই যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগামীতেও যে এরকম দ্রুত পরিবর্তন
অব্যহত থাকবে না, সেটা কি করে বলি? যাই হোক, যে কারণে ট্যাঙ্ক-ধ্বংসী হেলিকপ্টারের
কথা আনা – ট্যাঙ্ক না থাকলে এমন হেলিকপ্টারের তো দরকারই হতো না, ঠিক কিনা? আর ট্যাঙ্ক-ধংসী
হেলিকপ্টার না বানালে হেলিকপ্টার-ধ্বংসী হেলিকপ্টার বানানোর দরকারও যে হতো না! তাহলে
শুরু কোথায়? ট্যাঙ্ক, ঠিক কিনা? কিন্তু ট্যাঙ্ক তৈরি হয়েছিল কেন? কারণ পরিখা থেকে কেউ
বের হতে পারিছিলো না। সেটা কেন? কারণ পরিখা থেকে মেশিন গান চালালে কোন সৈন্যের পক্ষেই
শত্রুর পরিখা দখল করা সম্ভব ছিল না। তাহলে তো সমস্যা মেশিন গান; ঠিক কিনা? কিন্তু মেশিন
গানের আবির্ভাব হয়েছিল তো পদাতিক সৈন্যদের ফর্মেশন ভাঙ্গার জন্যে। তাহলে পদাতিকের এই
ফর্মেশনই বা কেন দরকার হলো? ঘোড়সওয়ার-বাহিনী বা ক্যাভালরি – এদেরকে ঠেকানোর জন্যেই
পদাতিকের ফর্মেশন দরকার হয়েছিল। ক্যাভালরি-কে ঠেকানোর জন্যে কামান বা আর্টিলারির আবির্ভাবও
হয় গেল। তবে আর্টিলারি কিন্তু পদাতিকের ফর্মেশন ভাঙ্গার জন্যেও ব্যবহৃত হতো। একই কাজে
হাতি, উট এবং ঘোড়াচালিত চ্যারিয়টও ব্যাবহৃতও হয়েছে। ক্যাভালরির আবির্ভাব হওয়ার আগে
তীরন্দাজ এবং অন্যান্য ছুঁড়ে মারা অস্ত্র (মিসাইল) ব্যবহার করা হয়েছে পদাতিকের ফর্মেশন
ভাঙ্গার জন্যে। আমরা তাহলে সেই একেবারে শুরুতে এমন একটা সময়ে পৌঁছে যাচ্ছি যখন একজন
একক সৈন্যের অস্ত্র ধরার মাঝ দিয়েই পদাতিকের আবির্ভাব। আর ডিসিপ্লিনের মাধ্যমে পদাতিকের
ফর্মেশন গঠন করে শত্রুর বিরূদ্ধে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। ঠিক এসময়েই পদাতিকের ফর্মেশন ভাঙ্গার
জন্যে একে একে আবির্ভাব হতে থাকলো ঘোড়া, তীরন্দাজ, হাতি, উট, চ্যারিয়ট, আর্টিলারি,
মেশিন গান এবং অবশেষে ট্যাঙ্ক।
জামা-র যুদ্ধ (খ্রীষ্টপূর্ব ২০২)। হস্তিবাহিনী পদাতিকের সামনে আবির্ভূত হতো ভয়ঙ্কর এক শক্তি-রূপে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পদাতিকের ডিসিপ্লিনের সামনে হস্তিবাহিনী টেকেনি। |
যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা
আসলে কে?
যুদ্ধক্ষত্রে এতকিছুর আবির্ভাব
আসলে কি লক্ষ্যে? যুদ্ধ জয় অবশ্যই। কিন্তু সেটা কখন আসবে? যখন বিপক্ষের সৈন্যরা পালাবে
বা হাত তুলে আত্মসমর্পণ করবে। সেটা কখন হবে? যখন শত্রুসৈন্যরা যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে
ফেলবে বা মনে করবে যে এখন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর মানে হয় না। এই শত্রুসৈন্য বলতে আমরা
কাদের বোঝাচ্ছি? অবশ্যই পদাতিক, কারণ পদাতিকেরাই যুদ্ধক্ষেত্রে ‘অবস্থান’ করে দখল অব্যহত
রাখে। পালিয়ে যাওয়া মানেই যুদ্ধক্ষেত্রের দখল ছুটে যাওয়া। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রের দখল
নেবার জন্যেই শত্রুপক্ষের পদাতিকের মনোবল ভাঙ্গাটা জরুরি। যখন হাজার হাজার তীর আকাশ
কালো করে পদাতিকের উপরে আবির্ভূত হয়; যখন ভূমিকম্পের মতো শব্দ করে ক্যাভালরি, চ্যারিয়ট
বা হস্তিবাহিনীর অবির্ভাব হয়; যখন বিকট শব্দে আর্টিলারি হামলা শুরু হয়; যখন ট্যাঙ্কের
ইঞ্জিনের ধোঁয়া এবং শব্দে মাথা ভারি হয়ে ওঠে; যখন ডাইভ বোম্বার বিমানের সাইরেন-মার্কা
শব্দ মৃত্যুর কথা মনে করায় – ঠিক তখনই, ঠিক তখনই – পদাতিকের মনোবলের উপরে আসে আঘাত।
এতসকল অস্ত্রের মনস্তাত্বিক একটা চাপ প্রবলভাবে ঘিরে ধরে পদাতিক সৈন্যদের। হাজার হাজার
বছর ধরে এই চাপ সহ্য করে আসছে পদাতিক। আর চাপ সহ্য করতে হবেই বা না কেন, তীরন্দাজ,
ক্যাভালরি, হাতি, উট, চ্যারিয়ট, আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক, বিমান – এরা কেউই তো যুদ্ধক্ষেত্রে
দখল কায়েম করে না, বরং নিজেদের পদাতিকের জন্যে দখল কায়েম সহজ করে দেয়। এসকল কারণেই
পদাতিকের ডিসিপ্লিন শিক্ষা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ; পদাতিক বেঁকে বসলেই যুদ্ধ শেষ! এটা
মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন যুগের যুদ্ধে রাজা বা জেনারেলের মৃত্যুর ব্যাপারটা। রাজা শেষ
তো যুদ্ধ শেষ; অনেক যুদ্ধেই রাজাকে টার্গেট করা হয়েছে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করার জন্যে।
পদাতিকের ব্যাপারটাও ঠিক তা-ই। অন্য যতো বাহিনীর পরাজয় হোক না কেন, পদাতিকেরা যুদ্ধক্ষেত্র
ছাড়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। অর্থাৎ গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখবো যে
পদাতিকই যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা। এমনকি সাম্প্রতিক ইরাক যুদ্ধের দিকে তাকালেও আমরা দেখবো
যে মার্কিন আর্মার্ড ফর্মেশনগুলি ইরাকের উপর দিয়ে প্রায় হেঁটেই পার হয়ে গেছে; কিন্তু
এরপরে দেশের দখলের দায়িত্ব পড়েছে পদাতিকের হাতে। সেই পদাতিকদের শেষ পর্যন্ত রাস্তার
পাশে রাখা বোমা আর চোরাগুপ্তা হামলায় নাভিস্বাস উঠেছিল। মার্কিন ট্যাঙ্ক, বিমান, আর্টিলারি
– এগুলি কোনকিছুই ইরাক যুদ্ধের যবনিকা টানতে পারেনি। যতক্ষন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের
রাজা, মানে পদাতিকের একটা গতি না হয়েছে, ততক্ষণ যুদ্ধ চলেছে।
রাশিয়ার কাদায় আটকে গেছে জার্মান পদাতিকের ট্রান্সপোর্ট। কিছু বাহিনী সামনে পৌঁছে গেলেই যুদ্ধ শেষ হয় না; সবাই যখন পৌঁছায় তখনই যুদ্ধ শেষ হয়। আর সবার সামনে পৌঁছাতে অনেক সমস্যা উতড়াতে হবেই। |
যুদ্ধক্ষেত্রের গতি
আসলে কি?
দখল মানেই অবস্থান; আর
অবস্থান মানেই গতিবিহীন অবস্থা। তাহলে যুদ্ধক্ষেত্র দখল মাধ্যমে পদাতিকেরা কি গতির
পথ রূদ্ধ করছে? সেটা নয়; কারণ পদাতিকেরা পয়েন্ট-এ থেকে পয়েন্ট-বি পর্যন্ত গিয়ে দখল
কায়েম করছে – এটা কিন্তু গতি; স্ট্র্যাটেজিক গতি। যুদ্ধক্ষেত্রে তার গতি কম, মানে ট্যাকটিক্যাল
গতি কম, কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক গতি যে একেবারেই কম, সেটা কিন্তু বলা যাবে না। পদাতিকেরা
পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করলেও পায়ে হেঁটেই যে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছাবে, তা কিন্তু নয়।
একসময় ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি, খচ্চর, উট ব্যাবহার করা হয়েছে পদাতিকদের পরিবহণের জন্যে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা ঘোড়ার গাড়ি, রেল এবং মোটর গাড়ি ব্যাবহার করতো পদাতিকদের পরিবহণ
করার জন্যে। মার্কিন ম্যারিন সৈন্যরা নৌবাহিনীর জাহাজে করে লিফট নেয়। আজকাল মার্কিনরা
সামরিক পরিবহণ বিমান ব্যবহার করে পদাতিক পরিবহণের জন্যে। বাংলাদেশের সৈন্যরা পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী মিশনে গিয়েছে সিভিলিয়ান যাত্রীবাহী বিমানে। ব্রাজিলের নৌবাহিনীতে
বেশকিছু জাহাজ আছে আমাজন নদীর ভেতরে সৈন্য পরিবহণ করার জন্যে। ব্রিটিশ সৈন্যরা সর্বদাই
ইউরোপের মেইনল্যান্ডে যুদ্ধ করতে গিয়েছে জাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেবার পরে।
ব্রিটিশ মার্চেন্ট মেরিনের জাহাজগুলি রাজার নির্দেশে এই সৈন্যদের পরিবহণ করতো। ১৯৮২
সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনী সিভিলিয়ান প্যাসেঞ্জার লাইনার জাহাজ
রিজুইজিশন করেছিল সৈন্য পরিবহণের জন্যে। মালয়ের গৃহযুদ্ধে ব্রিটিশরা এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে
মার্কিনরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে জঙ্গলের ভেতরে পদাতিকদের নিয়ে যাবার জন্যে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আকাশ থেকে প্যারাশুটের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে পদাতিক সৈন্য
ফেলে দেবার চলও শুরু হয়েছে। এই সবই হচ্ছে স্ট্র্যটেজিক গতি।
যখন যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ক্যাভালরি-নির্ভর,
তখন কিন্তু ক্যাভালরি একা একা যুদ্ধক্ষেত্রে যায়নি; অপেক্ষা করেছে নিজেদের পদাতিক সৈন্যদের
আসার আগ পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অপারেশন বার্বারোসার (১৯৪১) সময় জার্মান আর্মার্ড
ফর্মেশনগুলি বিশাল এক সোভিয়েত বাহিনীকে ইউক্রেনে ঘিরে ফেলেছিল গতির মাধ্যমে। কিন্তু
এই এনভেলপ বা পকেট চারিদিক দিয়ে বন্ধ করে দিতে তাদেরকে পদাতিকের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা
করতে হয়েছে। এই অপেক্ষাটা না করলে অগ্রগামী জার্মান আর্মার্ড ফর্মেশনকে পিছন থেকে সোভিয়েত
বাহিনী কেটে ফেলতে পারতো। মোটকথা ট্যাঙ্কের গতি দিয়ে একটা বাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক গতি
মাপা সম্ভব নয়। ট্যাঙ্ক কিছুদূর গিয়েই অপেক্ষা করবে নতুন করে তেল নেবার জন্যে। তেলের
ট্রাক যুদ্ধক্ষেত্রের শেষমাথায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ট্যাঙ্কগুলি বসে থাকবে। তার মানে
যে গতিতে তেলের ট্রাক এগুবে, যুদ্ধ তার চেয়ে বেশি গতিতে এগুবে না। রাস্তায় কোন কারণে
তেলের ট্রাকের এগুতে সমস্যা হলে শত শত ট্যাঙ্ক থাকার পরেও যুদ্ধক্ষেত্রে গতি থাকবে
না। সকল খাড়াই-উতড়াই পার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের শেষমাথা পর্যন্ত তেলের ট্রাকের গতিই হলো
আর্মার্ড ফর্মেশনের জন্যে স্ট্র্যাটেজিক গতি। যাই হোক, এই গতি আসলে দরকার হচ্ছে কেন?
গতির দরকার বিপক্ষের সৈন্যদের ঘিরে ফেলার জন্যে; আর ঘিরে ফেলার দরকার বিপক্ষের সৈন্যদের
সাপ্লাই লাইন কেটে ফেলতে এবং পালানোর পথ বন্ধ করতে, যাতে তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। এই
পুরো গতিটাকেই ব্যবহার করা হয়েছে শত্রুর মনোবল ভাংতে। যখনই পদাতিক সেই গতি দিতে পারেনি,
তখনই আবির্ভাব হয়েছে নতুন নতুন বাহিনীর; এরা যুদ্ধক্ষেত্রে দিয়েছে গতি; ফলাফল নির্ধারনে
রেখেছে বিরাট ভূমিকা। আর বিপক্ষের মনোবল ভাঙ্গার মাধ্যমে কম হতাহতের বিনিময়ে জয় তুলে
নেবার চেষ্টা করেছে; হাতাহাতি পদাতিকের যুদ্ধে যেখানে হতাহতের সংখ্যা বেশি হতো বলে
মনে হয়েছে। যদিও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে হাতাহাতির চাইতে অনেক
কম সময়েই বেশি সৈন্যকে মেরে ফেলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গোল ক্যাভালরি সকলের কাছে ভীতির বস্তু ছিল। তাদের গতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু তাদের গতিকে কাজে লাগিয়েই মুসলিমরা তাদের এমবুশ করে হারিয়েছিল আইল জালুতের যুদ্ধে। |
পদাতিক থেকে ক্যাভালরি
যুদ্ধক্ষেত্রে দুই পক্ষই
আক্রমণে থাকে না। একজন আক্রমণে গেলে আরেকজন রক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। আক্রমণে যেতে গেলেই
দরকার হয় গতির – স্ট্র্যাটেজিক এবং ট্যাকটিক্যাল উভয়েরই। ডিফেন্সে যারা থাকবে তারা
চাইবে সেই গতিকে রোধ করতে। ক্যাভালরিকে আটকাতে একসময় পদাতিক ফর্মেশন ব্যবহৃত হয়েছে।
খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেক্সান্ডার দি গ্রেটের বাবা মেসিডোনিয়ার ফিলিপ ‘ফ্যালাংস’
ফর্মেশনকে চমতকারভাবে তৈরি করেছিলেন, যেটা তার ছেলে পরবর্তীতে বিশাল এলাকা বিজয়ে ব্যবহার
করেছিলেন। অস্ত্র এবং ডিসিপ্লিনের অভূতপূর্ব এক সমন্বয় ছিল এই ফ্যালাংস। শত্রুর ক্যাভালরি,
চ্যারিয়ট এবং হাতির আক্রমণকে বহুবার হারিয়েছে এই ফর্মেশন। তবে এই ফর্মেশনের জন্যে খোলা
জায়গা ছিল জরুরী। চিপা বা বন্ধুর পথে ফ্যালাংস সমস্যার পড়েছে। এই কারণে রোমানরা তৈরি
করেছিল তাদের ‘লিজিয়ন’, যা কিনা ফ্যালাংস-এর চাইতে আরও বেশি স্থিতিস্থাপক (ফ্লেক্সিবল)
ছিল। পাহাড়ি এলাকায় এবং বনে-বাঁদাড়ে লিজিয়ন রোমানদের জয় এনে দিয়েছে। কিন্তু লিজিয়নের
আসল শক্তি ছিল এর ডিসিপ্লিন, যা কিনা রোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে একেবারেই নিচে নেমে
যেতে থাকে; ঠিক সেসময়েই পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতকে রোমান সাম্রাজ্য গল, ভিসিগোথ, ভ্যান্ডাল
এবং অস্ট্রোগোথ-দের দ্বারা আক্রান্ত হয়। অপেক্ষাকৃত কম ডিসিপ্লিনের সেনাবাহিনীর আক্রমণ
ঠেকাতে ব্যর্থ হয় রোমান লিজিয়ন। ডিসিপ্লিনের অধঃপতনের কারণে মধ্যযুগে অপেক্ষাকৃত এগ্রেসিভ
জাতিগুলি যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যায়; আর সেখানে মূখ্য ভূমিকা নেয় ক্যাভালরি। সপ্তম শতাব্দী
থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের নিয়ন্ত্রণে আরবরা এবং এর কিছু পরে দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ
শতাব্দীতে পূর্ব-মধ্য এশিয়ার মোঙ্গলরা এসময়ে বিশাল এলাকা নিজেদের অধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম
হয়। এসব যুদ্ধে ক্যাভালরি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
ন্যাপোলিয়নের সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ বন্দুকধারী এবং কামানসজ্জিত পদাতিকের হাতে ফিরে আসে। |
বন্দুক, কামান – আবারো
পদাতিক
ক্যাভালরির জয়জয়কার এই
সময়ে পদাতিকেরা যুদ্ধে জিতেছে অনেকবার; জিতেছে একটা অভিনব ডিফেন্সিভ পন্থায় – এমবুশ।
ক্যাভালরির ট্যাকটিক্যাল গতিকে ব্যবহার করেই ক্যাভালরিকে ফাঁদে ফেলেছে পদাতিকেরা। ৬২৭
সালে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন করে মুসলিমরা কুরাইশ বাহিনীকে আটকে দেয়। ১২৬০ সালে আইন
জালুতের যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দী বলে খ্যাত মোঙ্গোল ক্যাভালরিকে হারিয়েছিল কুতুয-এর অধীন
মুসলিম সেনাবাহিনী। ১২৯৭ সালে উইলিয়াম ওয়ালেসের অধীন স্কটিশরা ইংলিশ হেভি ক্যাভালরিকে
আগে থেকে তৈরি করে রাখা যুদ্ধক্ষেত্রে পরাভূত করেছিল। ক্রেসি-এর যুদ্ধে (১৩৪৬) এবং
এজিনকোর্ট-এর যুদ্ধে (১৪১৫) ইংলিশরা তীরন্দাজ ব্যাবহার করে দেখিয়েছিল কিভাবে সঠিকভাবে
এর ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুতগামী আক্রমণকারী বাহিনীকে পরাভূত করা যায়। ষোড়শ শতকের ইউরোপে
ম্যাকিয়াভেলি তার লেখার মাধ্যমে ইউরোপিয়ান জেনারেলদের বোঝাতে সক্ষম হন যে পদাতিকের
ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে না আনলে ক্যাভালরির বিরূদ্ধে নিয়মিত বিজয় পাওয়া কঠিন হবে। তিনি কামানের
ব্যবহার বাড়ানোর জন্যেও বলেন, যদিও কামানকে যুদ্ধক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা
অস্ত্র হিসেবে তৈরি হতে সময় লেগেছিল। প্রথম দিকের বন্দুকের মতো কামানের নিশানা ভালো
ছিল না। তাই একত্রে ফর্মেশন আকারে ব্যবহার না করতে পারলে বন্দুক এবং কামানের কার্যকারিতা
ছিল কম। তবে এখানে সবচাইতে বড় লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে বন্দুক এবং কামান ব্যবহার করা
হয়েছে ডিফেন্সিভ অস্ত্র হিসেবে। যখন একত্রে অনেক বন্দুক ফায়ার করা হচ্ছে, তখন সেটা
ক্যাভালরির বিরূদ্ধে একটা সীসার দেয়াল-রূপে দেখা দিল। এর সাথে কামান যোগ হওয়ায় ক্যাভালরির
প্রতিপত্তি কমতেই থাকে। অষ্টাদশ শতকে প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডরিক দ্যা গ্রেট পদাতিকের
ডিসিপ্লিনকে লৌহ-কঠিন অবস্থানে নিয়ে যান। এর পরে ন্যাপোলিয়ন কামানের ব্যবহারকে শৈল্পিক
পর্যায়ে নিয়ে যান উনিশ শতকের শুরুতে এবং পদাতিককে সেনাবাহিনীর প্রধান ফর্মেশন রূপে
সামনে নিয়ে আসেন। ১৮৫৪ সালের বালাক্লাভার (রাশিয়ার ক্রিমিয়ায়) যুদ্ধে মোটামুটি বোঝা
হয়ে যায় যে ক্যাভালরির দিন শেষ। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) সময় ক্যাভালরির যায়গা
হয় সেনাবাহিনীর স্কাউট হিসেবে; মূল যুদ্ধক্ষেত্র পুরোপুরি চলে যায় বন্দুকধারী পদাতিক
আর আর্টিলারির হাতে। যুদ্ধের গতি হয়ে আসে মন্থর। এখানে উল্লেখ্য যে বন্দুক এবং কামানের
ব্যবহারে এমবুশ ছাড়াই পদাতিক বাহিনী হয়ে ওঠে প্রবল শক্তিশালী। সবাই তখন পদাতিকের ধারণা
নিয়ে বসে আছে। দুপক্ষয়ই যখন ডিফেন্সিভ ট্যাকটিকস নিয়ে এগোয়, তখন যুদ্ধ যে স্থবির হবে,
সেটা বলাই বাহুল্য। পদাতিক আবার সেই গ্রীক ফ্যালাংস এবং রোমান লিজিয়নের মতো ক্ষমতাধর
হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে ট্যাঙ্কের ব্যবহারে আসে বিরাট পরিবর্তন। গুডেরিয়ান, রমেল, মানস্টেইন প্রমুখ জার্মান জেনারেলরা ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে গতির সংজ্ঞাই পালটে দেন। |
স্থবিরতা থেকে গতি
এরই মাঝে উনিশ শতকের শেষের
দিকে আবিষ্কার হয় মেশিন গান, যা কিনা দুই পক্ষকেই পরিখা খুড়তে বাধ্য করে। ফর্মেশনে
থাকা মানেই মৃত্যু! কাজেই প্রথমে ছড়িয়ে পড়া এবং পরবর্তীতে পরিখা খুড়ে লুকানো। বুর
(বোয়ার) যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) এই মেশিন গান এবং পরিখার স্থবির যুদ্ধের অগ্রবার্তা দেয়,
যা কিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সময়ে সবাইকে হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। আর এই
হতাশা থেকেই গতি আনতে আবির্ভাব হয় ট্যাঙ্কের। যদিও টেকনিক্যাল কিছু সমস্যার কারণে ট্যাঙ্ক
যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে ব্যর্থ হয়, পরিখা থেকে পদাতিক সৈন্যদের বের করে নিয়ে আসার একটা
পদ্ধতি কিন্তু আবিষ্কার হয়ে গেল। বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশরা ট্যাঙ্কের ব্যবহার করতে
থাকে পদাতিকের সহযোগী হিসেবে। তবে ব্যাসিল লিডেল হার্ট, হেইঞ্জ গুডেরিয়ানের মতো অল্প
কিছু স্ট্র্যাটেজিস্টের চিন্তার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাঙ্ক আবির্ভাব হয় যুদ্ধক্ষেত্রের
মূল পরিচালক হিসেবে। ফর্মেশন হিসেবে ট্যাঙ্কের আবির্ভাব হবার পরে এই ফর্মেশনকে ঠেকাতে
তৈরি হতে থাকে বহু প্রকারের অস্ত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিমান ততটা শক্তিশালী না হলেও
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমান হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। আর বিমান আক্রমণের একটা অংশ কেন্দীভূত
হয় শত্রুর ট্যাঙ্ক বা আর্মার্ড ফর্মেশনের উপর। এই সময় থেকে আকাশে বিমান ছত্রছায়া ছাড়া
ট্যাঙ্ক খোলা জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি। মেশিনগানের আবির্ভাবের পরে পদাতিকেরা ছড়িয়ে পড়েছিল
জীবন বাঁচাতে; তখন থেকেই বিমান থেকে একেকটি পদাতিক সৈন্যকে টার্গেট করা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ
হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ট্যাঙ্কের অপেক্ষাকৃত বৃহত আকার এবং কম সংখ্যার কারণে ট্যাঙ্ক হয়ে
দাঁড়ায় বিমানের প্রধান টার্গেট। আর মিসাইলের ব্যাপক প্রচলনের পর থেকে একজন পদাতিক সৈন্যও
একটা ট্যাঙ্ককে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখছে অনায়াসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্যাঙ্ক
যতটা না সহজ টার্গেট ছিল, আজ সেটা আরও অনেক সহজ টার্গেট। ট্যাঙ্ককে নিরাপত্তা দেবার
জন্যে আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) দিয়ে পদাতিক সৈন্য সাথে নিতে হচ্ছে। এর
ফলশ্রুতিতে এপিসি-গুলি বিপক্ষের পদাতিকের হাতে থাকা মিসাইলের সহজ শিকার হচ্ছে। এর উপরে
রয়েছে বিমান এবং হেলিকপ্টার। ফলশ্রুতিতে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো – যুদ্ধক্ষেত্রে ডিফেন্সিভ
পদাতিকের বিরূদ্ধে গতি আনতে যে যন্ত্রগুলি তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলি আজ পদাতিকের সহায়তা
ছাড়া এগুতে পারেনা এবং এগুলিকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পদাতিকের শুধু কষ্টই করতে হচ্ছে
না, নিজেরাও একটা লোভনীয় টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
আধুনিক মিসাইল বর্তমানের পদাতিক সৈন্যের হাতে এনে দিয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা। সামনে দিনে এই সৈন্যরাই পরিবর্তন করবে যুদ্ধক্ষেতে গতির সংজ্ঞা। |
নতুন ভবিষ্যত?
গতি থেকে আবারও স্থিতির
দিকেই হয়তো এগুচ্ছি আমরা। ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন বিমান শক্তি দানবীয় এবং ভারী
গাড়িগুলিতে (যেগুলিকে বলা হয়েছে এমআরএপি) চলা তাদের নিজস্ব পদাতিক বাহিনীকে আকাশ থেকে
পুরো নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধ সবসময় খোলা মাঠে লক্ষ লক্ষ সৈন্যের মধ্যে
সংগঠিত হবে – এটা কেউ বলতে পারে না। শহরে-শহরে এবং গ্রামে গ্রামে যুদ্ধ এখন স্বাভাবিক
ব্যাপার। গত এক’শ বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমান মানুষ শহরে চলে এসেছে; ভবিষ্যতে আরও আসবে।
সামনের দিনগুলিতে শহুরে যুদ্ধই আমরা বেশি দেখবো। স্ট্যালিনগ্রাদের মতো শহুরে যুদ্ধ
(১৯৪২-৪৩) এখন দেখা যাবে দেশে দেশে। বিশাল ফর্মেশনের চাইতে ছোট ছোট ফর্মেশন হয়ে উঠবে
বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এরই মাঝে দশজন সৈন্যকে আলাদাভাবে আক্রমণ করার চাইতে তাদের পরিবহণকারী
দামী এপিসি-টাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট হয়ে উঠবে। শহরের ভিতরে শত্রুর পদাতিক সৈন্যদের
চোরাগুপ্তা হামলা ঠেকাতে নিজেদের পদাতিক সৈন্যদের গড়তে হবে অত্যাধুনিক সৈন্য হিসেবে।
এর ফলশ্রুতিতে শহরের ভিতরে যুদ্ধ করার জন্যে পঞ্চাশ পদের যন্ত্রে সজ্জিত অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত
পদাতিক সৈন্যও টার্গেটে পরিণত হবে। এরকম একজন সৈন্য তার যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে
যতটা না দীক্ষিত হবে, তার চাইতে বেশি সময় তাকে দিতে হবে যন্ত্র এবং অস্ত্র পরিচালনা
শিক্ষায়। অত্যন্ত ‘দামী’ এই সৈন্য যাতে সহজে জীবন না হারায়, সেজন্য তাকে দিতে হবে বহুল
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অর্থ দিয়ে যে সৈন্যকে মূল্যায়ন করা হবে, যুদ্ধ সম্পর্কে তার মতামত
অন্য দিকে ঘুরে যেতে বাধ্য; যুদ্ধে উদ্দেশ্যগত দিক থেকে তার থাকবে বিভ্রান্তিকর চিন্তা।
ত্রিশ লক্ষ ভিয়েতনামীদের
বিপক্ষে মার্কিনী নিহত হয়েছিল আটান্ন হাজার; যুদ্ধে কিন্তু জিতেছিল ভিয়েতনাম। উইলিয়াম
ওয়ালেসের অধীনে স্কটিশরা ইংলিশদের গর্ব হেভি ক্যাভালরির উপরে আরোহিত নাইটদেরকে পরাজিত
করেছিল স্বাধীনতার স্বাদ নিতে। একইভাবে আরবের মরুভূমির প্রথম দিকের মুসলিমরা খুব অল্প
সময়ের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর এক বিরাট অংশ নিজদের অধীনে নিয়ে নিয়েছিল ইসলামের
দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে। সামনের দিনগুলিতে অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশে যুদ্ধ করার জন্যে সৈন্যের
অভাব হবে; তাই অল্প সৈন্যে বেশি কাজ করিয়ে নেবার একটা প্রবণতা থাকবে, যার ফলশ্রুতিতে
তাদের পদাতিকেরা উপরে উল্লিখিত দামী হাই-টেক টার্গেটে পরিণত হবে। এসময়ে শক্তভাবে দীক্ষিত
কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম খরচে সজ্জিত পদাতিক সৈন্য যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে বেশি সক্ষম হবে।
পদাতিক সৈন্যের বহন করা অস্ত্র শত্রুর ট্যাঙ্ক,
বিমান, হেলিকপ্টার ধ্বংস করার সক্ষমতা রাখবে। অন্যদিকে এই একেকজন সৈন্যকে শহুরে যুদ্ধে
খুঁজে ফিরে হতাশ হবে বিমান বাহিনী। বরং ছোট ছোট পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন পদাতিকের
সাপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শহরের বিল্ডিংগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখার
মতো (বা এর চাইতে ভালো) কাজ করবে। যেসব বাহিনী এরকম যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা ধরতে না
পেরে ট্যাঙ্ক এবং অনান্য হেভি অস্ত্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে অক্ষম হবে, তারা খুব
দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হবে; কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা তাদের বিশাল এলাকা
হারিয়ে বসবে। যুদ্ধক্ষেত্রের ধারনার দিক থেকে স্বল্প পরিবর্তন যে কোন পরিবর্তনই নয়,
সেটা তারা বুঝতে পারবে; কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে যাবে। পদাতিকের গতি তখনই সবাই উপলব্ধি
করতে সক্ষম হবে, যতক্ষন না সে তারই মতো আরেকটি পদাতিকের সন্মুখে না পরে। তখন শুরু হবে
নতুন পরিবর্তনের খেলা।
চমৎকার বিশ্লেষন।
ReplyDelete