Tuesday, 22 July 2014

ফরাসী সামরিক কূটনীতি কি নতুন কিছু?

২২ জুলাই ২০১৪



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা যে অপার শক্তিশালী হয়ে দেখা দেয়, সেটা মেনে নিতে কিছুটা হলেও কষ্ট হচ্ছিল এতোদিনের বিশ্বকর্তা বৃটেন আর ফ্রান্সের। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের পর থেকেই বৃটেন আর ফ্রান্স বুঝতে পারে যে চাবি হাতবদল হয়ে গেছে। ১৯৬০-এর দশকে এসে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানুষের স্বাধীনচেতা অনুভূতি চাড়া দিয়ে উঠে; সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে একই সাথে। এই দুটি ঔপনিবেশিক শক্তি ছাড়াও বাকি দেশগুলিও তাদের উপনিবেশ গুটিয়ে ফেলতে শুরু করে; দিন বদলের হাওয়া লেগেছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই আন্দোলন দমন করতে যেয়ে তারা বুঝতে পারে যে তাদের সামরিক বাহিনীর গঠনে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। সামনের দিনগুলিতে এইরকম গেরিলা যুদ্ধের সম্মুখীন তাদের হতেই হবে। তখন থেকেই পরিবর্তন শুরু হলেও ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরূদ্ধে স্নায়ূযুদ্ধই ছিল তাদের প্রাধান্য। সোভিয়েত পতনের সাথে সাথে বিরাট আকৃতির যুদ্ধের সম্ভাবনা কমতে থাকে। আর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পর থেকে গেরিলা-টাইপের যুদ্ধের সম্ভাবনাই বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাকিরাও তাদের সামরিক বাহিনীতে আনে পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ফ্রান্স।

মালির রাজধানী বামাকো-তে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর 'সি-১৭' পরিবহণ বিমান থেকে ফরাসী সেনাবাহিনীর 'ভিএবি' আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) নেমে আসছে। ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ ইউনিটই আকাশপথে পরিবহণ করা সম্ভব।


ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনী দ্রুতিই যেখানে এখন একমাত্র চাহিদা
ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর গঠন জানান দিয়ে দেয় যে তারা কোন ধরনের মিশনকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের এই বাহিনী তৈরি করেছে। একসময় আমরা সেনাবাহিনীর ডিভিশনকেই প্রধান ইউনিট হিসেবে জানতাম; ডিভিশনের মধ্যে থাকবে কয়েকটি করে ব্রিগেড, রেজিমেন্ট; সেগুলির মাঝে থাকবে কয়েকটি করে ব্যাটালিয়ন (উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে রয়েছে ৮টা ডিভিশন)। কিন্তু মজার ব্যাপার যে এখন ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ইউনিট হলো ব্রিগেড। তাদের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যত চিন্তা তাদেরকে বলে দিচ্ছে যে সামনের দিনগুলিতে বড় আকারের যুদ্ধ (যেখানে ডিভিশনের পর ডিভিশন সৈন্য দরকার হবে) কমে যাচ্ছে। ১০ থেকে ২০ হাজার সৈন্যের ডিভিশনের যায়গায় প্রধান ফর্ম্যাশন হয়ে যাচ্ছে ৩ থেকে ৬ হাজার সৈন্যের ব্রিগেড বা রেজিমেন্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের দরকার হবে ছোট আকারের বাহিনী, যা খুব দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মোতায়েন করা যাবে। আর সেই বাহিনী অনেক কম শক্তি নিয়েও তার কাজ হাসিল করে নিতে পারবে, কারণ এই বাহিনীর পেছনে বিমান, স্যাটেলাইট ছাড়াও যত ধরণের উন্নত প্রযুক্তি আছে সবকিছুই থাকবে। এই কম শক্তির সেনাবাহিনীর গঠন খুঁটিয়ে দেখলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে। 

ফরসী সেনাবাহিনীর 'এমএক্স-১০আরসি' আর্মার্ড কার। যেখানেই দ্রুত সৈন্য পাঠানো দরকার, সেখানেই ট্যাঙ্কের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে এই দ্রুতগামী সাঁজোয়া গাড়িগুলি। ১৫ টনের এই গাড়িগুলি বিমানে পরিবহন করা সম্ভব।


ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর এখন মোটামুটিভাবে ৮টা ফাইটিং ব্রিগেড রয়েছে। এর মধ্যে দুটা হলো আর্মার্ড ব্রিগেড, ২টা মেকানাইজড ব্রিগেড, ২টা লাইট আর্মার্ড ব্রিগেড, ১টা প্যারাশুট ব্রিগেড ও ১টা মাউন্টেন ব্রিগেড। এর বাইরেও অবশ্য আরো ৪টা বিভিন্ন সাপোর্ট ব্রিগেড ও স্পেশাল ফোর্সের ১টা ব্রিগেড ও ৩টা রেজিমেন্ট রয়েছে। দ্রুত পৃথিবীর যেকোন জায়গায় পাঠাতে এই বাহিনীকে এভাবে গঠন করা হয়েছে। এখানে দুটা মাত্র আর্মার্ড ব্রিগেড রয়েছে; যার একেকটিতে ১০০ থেকে ১২০টার মতো এএমএক্স-৫৬ লেক্লার্ক ট্যাঙ্ক রয়েছে। এই ট্যাঙ্কগুলি ৫৪-৫৭টন ওজনের। এছাড়াও ট্যাঙ্কের সাথে সাপোর্ট দেবার জন্যে রয়েছে জিটিসি সেলফ-প্রপেল্ড আর্টিলারি; এগুলি ৪২ টন ওজনের। এই হেভি ইকুইপমেন্টের জন্যে এই ইউনিটগুলি (আর্মার্ড ব্রিগেড) বিমানে করে পৃথিবীর কোথাও পাঠানো যাচ্ছে না; জাহাজ ছাড়া গতি নেই। কাজেই যেখানে ট্যাংক ছাড়া যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না, সেখানে জাহাজের সাহায্য নিতে হবে; সময় বেশি লাগবে। কিন্তু যেখানে সময় কম, আর ট্যাঙ্ক ছাড়াও কাজ হাসিল করা সম্ভব, সেখানে পুরো ইউনিটই আকাশপথে চালান করার পদ্ধতি রাখা হয়েছে। মেকানাইজড আর লাইট আর্মার্ড ব্রিগেডগুলি এমনই। এগুলিতে লেক্লার্ক ট্যাংকের জায়গায় রাখা হয়েছে এএমএক্স-১০আরসি আর্মার্ড কার (১৫টন) আর ইআরসি-৯০ আর্মার্ড কার (৮টন)। আর জিটিসি সেলফ-প্রপেল্ড আর্টিলারির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে সীজার সেলফ-প্রপেল্ড আর্টিলারি, যার ওজন ১৮টন। আর্মার্ড আর মেকানাইজড সবগুলি ইউনিটেই রয়েছে ভিএবি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), আর ভিবিসিআই ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিকল (আইএফভি)।ভিএবি-এর ওজন ১৪টন আর ভিবিসিআই-এর ওজন ২৬টন। এই সবগুলি গাড়িই বিমানে করে স্থানান্তর সম্ভব। প্যারাশুট আর মাউন্টেন ব্রিগেডগুলি আরও অনেক হাল্কা। ইউরোপের যেকোন যুদ্ধের ময়দানে এই হাল্কা ইউনিট খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। তার মানে এটাই যে ফ্রান্স ইউরোপে বড় কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রায় উড়িয়েই দিয়েছে। এখন তাদের কূটনীতি পৃথিবীর এমন সকল জায়গাকে ঘিরে যেখানে কোন একটা দ্বন্দে জয় পেতে খুব বেশি ভারি যন্ত্রপাতির দরকার হবে না। ফ্রান্সের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু যে এখন আফ্রিকা, সেটা বুঝতে খুব বেশি হিসেব কষতে হয় না। প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ফ্রান্স এই এলাকার অনেকগুলি দেশকে ভালোভাবেই চেনে। আর তারা এ-ও দাবি করে যে তারাই এই এলাকায় সবচেয়ে দক্ষতার সাথে অপারেট করতে পারবে। আফ্রিকাতে তারা একাধিক যায়গায় তাদের পা-রাখার পথ খোলা রেখেছে। যেকোন আন্তর্জাতিক দ্বন্দে তারা এই পথ ব্যবহার করবে। 

আফ্রিকার পুলিশম্যান এখন কি করছে?
ফরাসীদেরকে আফ্রিকার পুলিশম্যান বললে দোষ হবে নাতারা গত অর্ধ-শতাব্দীতে এতবার আফ্রিকাতে তাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে যে, তাদের আফ্রিকাতে আসা-যাওয়াটা প্রায় গা-সওয়াই হয়ে গেছে। আর সুপার-পাওয়ার না হবার কারণে ফরাসীরা খুব বেশী ডেউ তৈরি না করেই বারংবার তাদের কাজ করে গেছে আফ্রিকাতে। মার্কিনীদের পক্ষে অবশ্যই এত্ত সহজে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না। আমেরিকার সামরিক কার্যকলাপ ফলাও করে হেডলাইন হলেও ফ্রান্সের অভিযানগুলি কেন যেন ছোট অভিযান হিসেবেই কভার করা হয়েছে। অথচ জাতসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হবার পুরো ফায়দাটা কিন্তু তারা নিয়েছে। আফ্রিকাতে এতবার আসা-যাওয়া করলেও বেশিরভাগক্ষেত্রেই জাতিসংঘের অনুমতি তাদের নিতে হয়নি। আফ্রিকানরাই প্রথমে সুযোগ করে দিয়েছে ফরাসীদের। আফ্রিকাতে গণতন্ত্রের চর্চা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতোসেসব দেশে বারংবার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ফরাসীদেরকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দিয়েছে। একই ব্যাপার ঘটিয়েছে ঘন ঘন গৃহযুদ্ধ। চাদ, গ্যাবন, সেনেগাল-এর মতো দেশে তারা স্থায়ীভাবে রয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতিতে আফ্রিকা অনেক বড় স্থান করে রেখেছে। তাদের সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। 

২০১২ সালের অক্টোবরের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে চাদ-এর রাজধানী নিজালমিনাতে ফরাসী বিমান বাহিনীর দু'টা 'মিরাজ এফ-১সিআর' এবং দু'টা 'মিরাজ-২০০০' জঙ্গী বিমান। পরের বছরে মালি-এর যুদ্ধে এই ঘাঁটি বিরাট ভূমিকা রাখে।


মরুভূমিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ!
পূর্ব আফ্রিকার হর্ন অব আফ্রিকা’ এলাকাটা এখন বেশ গরম। সোমালিয়া এখানে একটা প্রায় সরকার-বিহীন এলাকা (দেশ বলা দুষ্কর)এখানে বহুদিন ধরে গেড়ে বসে আছে আস্ত্রধারী আল শাবাব গোষ্ঠি। আল-কায়েদার সাথেও এদের আঁতাত রয়েছে বলে জানা যায়। এই এলাকায় কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, এবং অন্যান্য দেশে বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী হামলার জন্যে এরা দায় স্বীকার করেছে। এদের বিরূদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র; আর সেই যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হচ্ছে জিবুতি, যা একটা ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ। এর কিছুটা পশ্চিমে সাব-সাহারান আফ্রিকাতে প্রায় পুরোটাই মরু অঞ্চল। এই বিশাল এলাকায় কোন ধরনের সরকারই কাজ করে না। এই দেশগুলির হাজার হাজার মাইল সীমানা রক্ষা করা অসম্ভব। অত্যন্ত গরীব হওয়ায় এই দেশগুলির সমস্যা আরও বেশি প্রকট। এই এলাকায় আল-কায়েদা সমর্থিত অনেক অস্ত্রধারী গোষ্ঠী রয়েছে। এদেরকে মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকা যেমন উঠে পড়ে লেগেছে, তেমনি ফ্রান্সও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। মার্কিনীরা এখানকার খুব বেশি দেশে তাদের সৈন্য মোতায়েনের সাহস পায়নি জনরোষ সৃষ্টি হতে পারে ভেবে। তবে ফ্রেঞ্চরা এখানে রয়েছে বেশ অনেকদিন ধরেই। ১৯৮৩ সাল থেকে থাকলেও ১৯৮৬ সালে চাদ-এর সাথে গাদ্দাফীর লিবিয়ার যুদ্ধের সময় ফরাসীরা এখানে একেবারে গেড়ে বসে প্রেসিডেন্ট হিসেন হাব্রের হাত ধরে। লিবিয়ার সাথে চাদের যুদ্ধের শেষে, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতে চাদ-লিবিয়ার সীমান্ত সমস্যা মিটমাট হয়ে যাবার পরেও ফ্রেঞ্চরা এখানে রয়ে যায়। অপারেশেন ইপারভিয়ে সেই ৮৬-তে শুরু হয়ে এখনো চলছে। ফরাসীদের কাছে চাদ মরুভূমির মাঝে একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। ফরাসী বিমান বাহিনীর ৬ থেকে ৮টা ফাইটার বিমান চাদের রাজধানী নিজালমিনাতে সবসময়ই থাকে। এই ঘাঁটি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ২০১৩ সালে মালি-এর যুদ্ধের সময় হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের পিছনে থাকার নীতি
চাদ থেকে দক্ষিণে গ্যাবনের রাজধানী লিব্রেভিলে ফ্রান্সের ছোট একটা সেনাদল স্থায়ীভাবে রয়েছে বহুকাল ধরে। আবার আফ্রিকার পশ্চিম উপকুলে সেনেগালের রাজধানী ডাকার-এও ফ্রান্সের একটা ঘাঁটি ছিল ৫০ বছর ধরে; ২০১০ সালে ঘাটিটি ছেড়ে দেয়ার কথা দেয় ফ্রান্স। কিন্তু সন্ত্রাস বিরোধী মিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে ফ্রেঞ্চরা ডাকারে রয়েই যায়। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, সিয়েরা লিওন আর কুট-ডে-ভোয়া (আইভোরি কোস্ট) এই দেশগুলিতেও ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি বহু বছর ধরে থেকে-থেকে রয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চলে আল-কায়েদা সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে মোকাবিলা করতে ফ্রান্সের এই ঘাঁটিগুলির অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা ঠিকমতোই জানে। আর আফ্রিকাতে তাদের অনভিজ্ঞতার কারণেও তারা এখানে ফ্রান্সের পিছনে থাকতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আমেরিকানরা বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন পাঠিয়েছে। ফরাসী বাহিনীকেও তারা বিভিন্ন মিশনে লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে। তবে নিজেরা সরাসরি সংঘাতে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকছে। সেই কাজটা আফ্রিকানদের আর ফরাসীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে তারা।

'অপারেশন সেরভাল'- ফরসীরা দূরত্বকে জয় করেছে।


‘অপারেশন সেরভাল’
২০১২ সালে মালি-এর গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। সরকার-বিরোধী এমএনএলএ বিদ্রোহীরা দেশের বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেবার পর সরকারের অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময়ে লিবিয়া যুদ্ধের পর সেখান থেকে প্রচুর অস্ত্রের যোগান পাওয়া ইসলামিক জঙ্গীরা এমএনএলএ-এর বিরূদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই নতুন ইসলামিক সসস্ত্র গোষ্ঠীরা মালি-এর বেশিরভাগ এলাকা সরকারী বাহিনী ও এমএনএলএ-এর কাছ থেকে খুব দ্রুত দখলে নিয়ে সেখানে কঠোর শারিয়া আইন জারি করে। ঠিক যখন মনে হচ্ছিল যে আল-কায়েদা সমর্থিত এই জঙ্গীরা মালি-এর রাজধানীও আয়ত্তে নিয়ে নেবে, ঠিক তখনই ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে ফরাসীরা জাতিসংঘের ম্যান্ডেট পেয়ে মালি-তে রওয়ানা হয়। ফ্রান্সের প্রথম উদ্দেশ্যই ছিল জঙ্গীদের জানান দেওয়া যে তারা এখানে এসেছে। শুরু হলো অপারেশন সেরভাল ফ্রেঞ্চ স্পেশাল ফোর্সের গ্যাজেল হেলিকপ্টারগুলি হামলা চালায় জঙ্গীদের অগ্রবর্তী বাহিনীর উপরে। ঠিক তার পরপরই ফ্রান্স থেকে ৩,৫০০ কিঃমিঃ উড়ে এসে ৪টা রাফাল জঙ্গীবিমান মালির উত্তরে গাও শহরে বোমাবর্ষণ করে, যেখানে ছিল জঙ্গীদের হেডকোয়ার্টার্স । মালির উত্তরের আলজেরিয়া আর মরক্কো এই মিশনে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায়। বিমানগুলি বোমাবর্ষণ শেষ করে ১,৩০০ কিঃমিঃ দূরে চাদ-এর নিজালমিনাতে গিয়ে অবতরণ করে, আর বাকি অপারেশনে সেখান থেকেই কাজ চালায়। এই দূরত্বে হামলা করে ফ্রান্স তাদের হাত কতটুকু লম্বা, সেটার একটা প্রমাণ দিল। নিজালমিনাতে আগে থেকেই ফ্রান্সের ২টা মিরাজ এফ-১সিআর গোয়েন্দা বিমান আর ৪টা মিরাজ ২০০০ ফাইটার বিমান ছিল, যেগুলি এর পর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয়। সেনেগালের ডাকারে অবস্থিত ফরাসী নৌবাহিনীর ৫টা আটলান্টিক গোয়েন্দা বিমানও উড়ে আসে ফরাসী বাহিনীকে ইন্টেলিজেন্স সরবরাহ করার জন্যে। কমপক্ষে ৫টি ফ্রেঞ্চ  এয়ার-রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার বিমান এই অপারেশনে অংশ নেয়, যার কারণেই ফরাসীরা মূলত দূরত্বকে জয় করতে পেরেছে। 

পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ডাকারে অবস্থিত ঘাঁটি থেকে ফরাসী নৌবাহিনীর 'আটলান্টিক' গোয়েন্দা বিমান মালি-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে।


আর বিমান হামলার পরপরই শুরু হয় ফরাসী সেনাবাহিনীর আগমণ। ফ্রান্স এবং মালির রাজধানী বামাকো-এর মাঝে ৩,৫০০ কিঃমিঃ লম্বা একটা এয়ার ব্রিজ তৈরি করে ফেলা হয়। ফ্রান্সের বিমান বাহিনীর পরিবহণ বিমানগুলি ব্যবহার হবে এটা তো জানা কথা। তবে যখন যখন ১০টা দেশ থেকে ২৫টারও বেশি পরিবহণ বিমান এই কাজে যোগ দেয়, তখন আলাদাভাবে তাকাতে হবে পুরো ব্যাপারটার দিকে। এটা হলো কালেকটিভ সিকিউরিটি-এর একটা অংশ। ফ্রান্স মাঠে যুদ্ধ করবে ঠিকই; কিন্তু বাকিরাও যে যেভাবে পারে, তাকে সাহায্য করবে। এতগুলি দেশের সাহায্য না পেলে সৈন্যসমাবেশ করতে ফরাসী বিমান বাহিনীর অনেক বেশি সময় লেগে যেত। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই ২৫টিরও বেশি বিমানের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল মাত্র ৫টি। এই পরিবহণ বিমান ছাড়াও এয়ার-রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার এবং গোয়েন্দা বিমান সরবরাহ করেও ফ্রান্সকে সাহায্য করেছে কয়েকটি দেশ। ফ্রান্সের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ পশ্চিম আফ্রিকার ডাকার বন্দরে এসে কয়েকশ সৈন্য নামায়; যারা বিমানযোগে চলে আসে মালি-তে। তবে দ্রুত অভিযানের সাফল্যের বেশিরভাগটাই পাবে ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনী। তারা তাদের সেনাবাহিনীকে তৈরিই করেছিল এই আদতে। মাটিতে নামার সাথে সাথে তাদের গতি সেটা প্রমাণ করে। তাদের দ্রুতগামী লাইট আর্মার্ড ও পদাতিক ইউনিটিগুলির সামনে জঙ্গীরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। তার উপরে আকাশের পুরো আধিপত্ত ছিল ফ্রেঞ্চদের হাতে। নিজালমিনা থেকে উড়ে আসা রাফাল আর মিরাজ-২০০০ জঙ্গী বিমান ছাড়াও ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল সেনাবাহিনীর গ্যাজেলটাইগার এটাক হেলিকপ্টারগুলি। জানুয়ারীর ১১ তারিখে অভিযান শুরুর পর থেকে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে মালি-এর বেশিরভাগ এলাকা ফ্রান্সের সমর্থনপুষ্ট মালি-এর সরকারী বাহিনীর দখলে চলে আসে। এরপর দখলকৃত এলাকায় নিরাপত্তা দেওয়ার পরবর্তী কাজ শুরু হয়। ২০১৩-এর জুলাই পর্যন্ত এই মিশনে ফ্রান্সের ৭জন সৈন্য নিহত হয়। মালিয়ান বাহিনী আর আফ্রিকার অন্যান্য সাহায্যকারী দেশের ১৪৪জন সৈন্য নিহত  হয়। অপরদিকে জঙ্গীদের ৬০০ থেকে ১,০০০ নিহত হয়। 

মালি-এর রাস্তায় ফরাসী সাঁজোয়া যান। বেশিরভাগ মালিয়ানরাই ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ সমর্থন করেছিল, যা ছিল ফ্রান্সের কূটনীতির বিরাট এক সাফল্য।


সাফল্য আগে থেকেই লেখা ছিল কি?
ফ্রেঞ্চরা অভিনযানে নামার দুসপ্তাহের মাঝেই মালি-তে অবতরণ করা শুরু করে আফ্রিকার ৯টা দেশের সমন্বয়ে গঠন করা প্রায় ৭,৫০০ সৈন্যের এক বাহিনী। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে এদেরও বড় একটা অবদান ছিল। এরপরে জুলাই মাস থেকে ফ্রেঞ্চ আর আফ্রিকান বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হওয়া শুরু করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী, যার সদস্যসংখ্যা ১২,০০০ ছাড়িয়ে যাবার কথা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ এই মিশনে ১,৬০০ সৈন্য পাঠিয়েছে। ফ্রান্স মালি থেকে বেশিরভাগ সৈন্য সরিয়ে নিলেও ১,০০০ সৈন্য রেখে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও আশেপাশের দেশগুলিতে (নিযের-এর রাজধানী নিয়ামি-তে এবং বুরকিনা ফাসো-এর রাজধানী উগাডুগু-তে) গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন-এর জন্য ঘাঁটি গেড়েছে এই সংঘাতের জের ধরে। জাতিসংঘ মিশনের চোখ-কান এখন এই বিমান ও ড্রোন। আফ্রিকার সন্মিলিত বাহিনী আলাদা আলাদাভাবে মালি-তে অবতরণ করেছিল। তারা ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর মত দ্রুত সাফল্য পাবার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর জাতিসংঘের মিশন তো বরাবরের মতোই বেশ ঢিলেঢালাভাবে এগোয়। জাতিসংঘের উপরে ভরসা করলে মালিয়ানরা হয়তো অন্য একটা ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতো। আফ্রিকানরা প্রায় ৭,৫০০ সৈন্য যোগার করেছে; জাতিসংঘ জোগাড় করছে ১২,০০০-এরও বেশি; যার তুলনায় ফ্রান্সের বাহিনী ছিল অনেক ছোট। এখানেই ফ্রান্সের সামরিক সাফল্য; তারা অতি দ্রুত এই কাজটা করতে পেরেছে। তারা মাত্র হাজার চারেক সৈন্যই ব্যবহার করেছে; তবে মালি-কে বাঁচিয়ে দেবার জন্যে সেটাই যথেষ্ট ছিল। এই মিশনের মাধ্যমে ফ্রান্সের বাহিনী তাদের কূটনীতিতে এক বিরাট ভূমিকা রাখলো। বেশিরভাগ মালিয়ানরাই মনে করছেন যে ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ না হলে তাদের দেশ আল-কায়েদা জঙ্গীদের হাতে চলে যেত। মালিয়ানদের এই সম্মতি ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের একটা অনেক বড় সাফল্য। প্রথমেই বলেছি যে ফ্রান্স তাদের সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছে ঠিক এই ধরণের মিশনের জন্যেই। আর তাদের আফ্রিকার মরুতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ (বিমান ঘাঁটি) খোঁজার কাজটা পুরো সাফল্য এনে দিয়েছে এবারে। চাদের রাজধানী নিজালমিনা-তে ফ্রান্সের ফাইটার বিমানগুলি না থাকলে ফ্রান্সের এই মিশন সফল  হতো না। ফ্রান্সের এই সাফল্য বহুদিন ধরে লালন করা সামরিক নীতি আর তাদের আফ্রিকা নীতির উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল; যদিও শেষ মুহূর্তে মালিয়ানদের সম্মতির ব্যাপারটা আগে থেকে বলা মুশকিল ছিল। তবে তাদের বাহিনীর পুরো গঠনটাই কিন্তু তাদের কূটনীতিকে সমর্থন করে। এক্ষেত্রে তাদের রাজনীতিবিদদের দূরদর্শীতাকে প্রশংসা করতেই হয়। শুধুমাত্র বর্তমান সরকার নয়, অতীতের সকল সরকারই ফ্রান্সের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টা একইভাবে লালন করে গেছে। এই কারণেই ফ্রান্স এই মিশনের জন্য ছিল প্রস্তুত। তারা অন্য দেশের সার্বভৌমত্বকে কতটা উপরে তুলে ধরবে সেটা সবসময়ই বিতর্কের বিষয় হবে। ফ্রান্স তাদের উপনিবেশ ছেড়ে এলেও সেখানে তাদের পুলিশি প্রহড়া দেবার দায়িত্বখানা ভুলে যায়নি! কিন্তু নিজের দেশের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে তাদের সামনে চিন্তা করার প্রবণতাটা আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে একটা উদাহরণস্বরূপ।

1 comment: