Thursday, 19 December 2013

জাতীয় নিরাপত্তা আজ কোথায়?



২০ ডিসেম্বর ২০১৩ 

বাংলাদেশের সর্ববৃহত যুদ্ধজাহাজ বিএনএস সমুদ্র জয়ের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এবং নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল ফরিদ হাবিব. ১২ ডিসেম্বর ২০১৩. ছবিঃ বিডিনিউজ২৪


জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কতটুকু ভাবি, আর কতটুকু বলি? আপাতদৃষ্টে এর আগে প্রশ্ন জাগে, আসলে কতটুকুই বা বুঝি? বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই এসব গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনা মাথার অনেক উপর দিয়ে যাবে; সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এটা খুব একটা হলফ করে বলা যায় না যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারটা খুব একটা বোঝেন। আর কোন কারনে তাঁরা যদি এই না বোঝার ব্যাপারটা অস্বীকার করেন, তবে কিন্তু আমরা ধরে নিতে বাধ্য হব যে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য জাতীয় নিরাপত্তা জলাঞ্জলি দিতে কার্পণ্য করছেন না। কাজেই ইচ্ছে করেই হোক আর অবুঝ শিশুর মত নিশ্চিন্ত থেকেই হোক, তাঁরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছেন। 
 
এক.
জাতীয় নিরাপত্তার কথা মনে হতেই আমাদের সামনে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, কালো চশমা পড়া নম্বরবিহীর গাড়িতে চড়া লোকজনের চেহারা, ইত্যাদি ভেসে ওঠে। কিন্তু সেগুলি আসলে হলিউডেই মানায়। জাতীয় নিরাপত্তা অনেক বড় জিনিস; যার বেশীরভাগ ব্যাপারই গুরুগম্ভীর; রস-কস-হীন। তবে এর শুরুটা কিন্তু হাজার বছরের শিক্ষা। সেই স্কুলে পড়া বৃদ্ধ আর তার ছেলেদের গল্প মনে আছে? কঞ্চি ভেঙ্গে বৃদ্ধ তাঁর ছেলেদের শিখিয়ে দেন একতাই বল। মনে পড়ে? হয়তো মনে পড়ে; কিন্তু সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার মত চিন্তা-চেতনা কি আমাদের আছে? আমার মনে হচ্ছে না। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের উপরে বিভিন্ন দেশের ছড়ি ঘোরানোর আগ্রহ দেখেও কি আমাদের বোধ হচ্ছে না? এখনো কি বুঝতে পারছি না যে আমরা কতটা দূর্বল হয়ে গেছি? 

পরাশক্তিদের ডেকে আনছি আমরা; আমাদের ঝগড়া বিবাদ থামানোর জন্য। বিদেশীরা কিন্তু তাদের স্বার্থ দেখবেই; সেটাই স্বাভাবিক। তাদের জায়গায় আমরা হলেও তা-ই করতাম। তারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করেই আমাদের সাথে কথা বলবে। আর আমরা যখন আমাদের দূর্বলতা তাদের সামনে তুলে ধরবো, তখন কিন্তু তারাও চাইবে আমাদের দূর্বলতার সুযোগ নিতে। আমাদের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তারা চাইবে নিজেদের একটা সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করে নিতে; যেটা তাদেরকে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে আমাদের উপরে একটা ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ করে দেবে। আমরা হয়ে পড়বো শৃঙ্খলিত। নিজেরা শৃঙ্খলিত থেকে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলাটাই বোকামি। 

আমাদের দেশের স্থিতিশীলতার বিষয়ে প্রেসক্রিপশন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; কারা ক্ষমতায় আসলে তাদের সুবিধা, সেটা মোটামুটি বলেই দিয়েছে ভারত; এমনকি আমাদের দেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কথা বলার মত সাহস নিয়েছে পাকিস্তানের মত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র! তবে এটা ঠিক যে আমরা নিজেদের ভাল নিজেরা খুব দ্রুত না বুঝতে পারলে আমরাও একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবো, যেটা হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের অপমান!

দুই.
যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র। সেটা শুধু কি তাদের সামরিক শক্তির জোরে? অবশ্যই নয়। তাদের রয়েছে পৃথিবীর সবচাইতে বড় অর্থনীতি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধে জয়ী হবার প্রধান কারনই কিন্তু ছিল শক্তিশালী অর্থনীতি। বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার কিন্তু আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই বানিয়েছিল। কিন্তু পেটে ক্ষুধা নিয়ে যে বেশিদিন বোমা বানানো যায় না, সেটা সোভিয়েত পতনেই প্রমাণিত। 

স্নায়ুযুদ্ধের পরের উদাহরণও আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা কে না জানেন? তবে এটা কি জানেন যে দক্ষিণ কোরিয়া এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবহরের একটির মালিক? উত্তর কোরিয়া তাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রধান স্তম্ভ ছিল বহুকাল। কিন্তু এখন সেটা চীনের দিকে মোড় নিয়েছে। আর তাই অত্যাধুনিক দক্ষিণ কোরিয় যুদ্ধজাহাজগুলি আজকাল তাদের উপকূলের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে মহাসমুদ্রে পাড়ি জমাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলে তাদের নিজেদের প্রভাব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে আজ। কৌশলগত দিক থেকে কোরিয়া এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বন্ধু; আর চীনের মাথাব্যাথার কারন। কৌশলগত দিক থেকে এই প্রভাব অর্থনীতি আর নৌ-কূটনীতি, উভয়ের ফসল। তবে তাদের সেই টাইগার অর্থনীতি ছাড়া কিন্তু বর্তমান এই অবস্থায় আসার প্রশ্নই উঠতো না। আর এখানে আরেকটা ব্যাপার -যার সিন্দুকে টাকা থাকে, তারই কিন্তু দারোয়ান লাগে। কোরিয়া ঠিক আমাদের মতই তাদের সকল বাণিজ্যের জন্য সমুদ্র-পথের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। আর তাই অর্থনীতি সুযোগ দেওয়ার সাথে সাথেই তারা তাদের নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে মনোনিবেশ করেছে। 

এখন এত কথা বলে কোথায় যেতে চাচ্ছি? জ্বি; আমাদের অর্থনীতি নিয়েই কথা বলছি। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা দেশকে কতটা পিছিয়ে দিল, সেটা সময়ই বলে দেবে। বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তো অভাব নেই। আমাদের দুর্দশা দেখে অনেকেই মনে মনে খুশি হবে। আমাদের তৈরি পোষাক শিল্প ভারত, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, প্রভৃতি দেশের কাছে পুরোপুরি চলে যাবার পথে। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রম বাজার দখলের জন্য অনেকেই উন্মুখ হয়ে রয়েছে। দুবাইতে ২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড এক্সপো হচ্ছে। তার পেছনে নেপাল দুবাইকে সমর্থন দিয়ে শ্রম বাজারের একটা ভাল অংশ বাগিয়ে নিয়েছে। আমরা দুবাইয়ের বদলে রাশিয়াকে সমর্থন করে আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজারের একটিকে হুমকির মুখে ফেলেছি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি অনেক দেশের জন্যেই ঈর্ষার কারন। আমাদের জনসংখ্যার কারনে আমরা অনেকের চক্ষুশূল। ভৌগোলিক দিক থেকে আমরা একটা ছোট দেশ হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে বিরাট একটি জাতি। ১ কোটি মানুষের একটি দেশের বছরে ১% প্রবৃদ্ধি আর ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের ১% প্রবৃদ্ধি এক হবে না। শুধু জনসংখ্যার কারনেই আমাদের অর্থনীতির আকৃতি হয়ে যাবে বিশাল। যেটা ভারত আর চীনের ক্ষেত্রে হয়েছে। বাংলাদেশকে তাই অনেকেই পরবর্তী অর্থনৈতিক শক্তি ভেবে ভয় পাচ্ছে। তারা জানে যে আমরা যে বাজারে ঢুকবো, খুব শিগগিরই সেই বাজার আমরা অন্যদের হাত থেকে নিয়ে নেবার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু যখন আমরা নিজেরাই আমাদের নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনার চেষ্টায় লিপ্ত, তখন অন্যরা শুধু যে হাসবে, তা-ই নয়; সুযোগ পেলে তারা আগুনে ঘি-ও ঢালবে। এই সহজ জিনিসটি না বোঝার মত বোকা আমরা নই বলেই আমার মনে হত।

তিন.
২০০৮ সালের নভেম্বরে সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণে মিয়ানমারের সাথে গ্যাস ড্রিলিং-কে কেন্দ্র করে যে নৌ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গত ৫ বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র পেয়েছে বা পেতে চলেছে। বাতসরিক সামরিক বাজেট ৫ বছরে হয়েছে দ্বিগুণ। সবগুলি বাহিনীই লাভবান হলেও সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে নৌবাহিনীতে। ২০০৮ সালের নৌবাহিনী আর ২০১৩-২০১৪ সালের নৌবাহিনী আকাশ আর পাতাল। এখনও অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার মিটমাট হবার পরে নৌবাহিনীর কদর যেন আরও বেড়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের জলরাশির ভেতরে আমাদের জন্য কতটুকু প্রাচুর্য রয়েছে, সেটা সময়ই বলে দেবে। আমাদের সীমানার ওপাড়ে মিয়ানমারও কিন্তু তাদের নৌবাহিনীতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই ব্যাপারটা ছোট-খাট একটা স্নায়ুযুদ্ধে মোড় নিয়েছে ইতোমধ্যেই। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সবাই আমাদের সহায়তা করেছে সামরিক দিক থেকে। সেই সহায়তা অব্যহত রয়েছে। এই ডিসেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রিগেট বিএনএস সমুদ্র জয়’ এসে পৌছেছে। জানুয়ারীতে চীন থেকে আসছে আরও দুটি ফ্রিগেট। ২০১৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে আরও একটি ফ্রিগেট। আমাদের এই নৌবহরের অগ্রগতিতে মিয়ানমারের স্বস্তি পাবার কথা নয়। তবে আমাদের সমুদ্রসীমা যে আরও একটি দেশের সাথে রয়েছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। 

আমাদের নৌবাহিনীতে সাবমেরিন সংযোজনের কথা আমরা বহু বছর ধরে শুনছি। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশী অগ্রগতি হয় ২০১৩ সালে। চীন থেকে দুটি সাবমেরিন অর্ডার করা ছাড়াও সাবমেরিনের জন্য আলাদা ঘাঁটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে এই বছরেই। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে চীনে তৈরি সাবমেরিন মেনে নিতে পারেনি আমাদের বিশাল প্রতিবেশী ভারত। ভারতের নৌবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করার কাছাকাছিও আমরা এখনো পৌছাতে পারিনি। কিন্তু তার অনেক আগেই ভারত আমাদের জানিয়ে দিলো যে তাদের সীমান্তে শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রের উপিস্থিতি তারা ভালো চোখে দেখবে না। আর ২০১৪ সালের মাঝামাঝি ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের আন্তর্জাতিক রায় আসছে। সময়ই বলে দেবে আমরা কোথায় আছি।

এখন উপড়ে যে ৪ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্রের গল্পটি লিখলাম, সেই গল্প চালিয়ে নিতে যে পরিমাণ অর্থের দরকার পড়বে, ২০১৩ সালের পরে আমাদের অর্থনীতি সেটা যোগান দিতে পারবে তো? এখন নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে যে জাতীয় নিরাপত্তার গুরুগম্ভীর কথাগুলি কিভাবে একত্রে মিশে যায়?

চার.
আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা খুব একটা সংকটাপন্ন ছিল না কখনোই। ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইত্যাদি দেশের মত সহিংসতা আমাদের দেখতে হয়নি কখনো। কিন্তু ২০১৩ সালের পরে খানিকটা সন্দিহান হয়ে যাচ্ছি। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরে পাকিস্তানের তালিবান ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রমণের হুমকি দিয়েছে। এখন কোন কিছুই অবাস্তব বলে ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। সহিংসতা যে আরও খারাপ দিকে মোড় নেবে না, সেটার গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবে? 

নিজের ঘরে শান্তি না থাকলে অন্যের সাথে বুক ফুলিয়ে কথা বলা যায় না। আমাদের ঘরের অশান্তির খবর কিন্তু আজ দ্বারে দ্বারে পৌঁছে গেছে। আমাদের রাজনীতিবিদেরা তাদের দেশীয় প্রতিদ্বন্দীদের এতটাই বড় শত্রু ভাবেন যে, শত্রু দমনে বাইরের কারও হাত ধরতেও তাঁরা কার্পণ্য করেন না। দেশীয় শত্রু দমনে করেন সর্বশক্তি নিয়োগ। তাঁরা বাইরের মানুষকে বিশ্বাস করেন, কিন্তু দেশের মানুষকে করেন অবিশ্বাস। তাঁরা একবারও নিজেদেরকে প্রশ্ন করেননি যে দেশের মানুষের স্বার্থ বিদেশের মানুষ কেন দেখবে! আমাদের রাজনীতিকেরা দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে ধুলিস্মাত করে দেশের কি ভালো করার স্বপ্ন দেখছেন সেটা বোঝা দুষ্কর!

No comments:

Post a Comment