০৯ নভেম্বর ২০১৩
সাংবাদিকদের দেখি
বিদেশীদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়তে – “আমাদের দেশ সম্পর্কে আপনাদের ধারনা কি?” অথবা “আমাদের দেশে
শান্তি আসবে কিনা বা শান্তি আনতে তারা সাহায্য করবেন কিনা” ইত্যাদি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই প্রশ্নগুলি যতটা না
সাংবাদিকতার খাতিরে করা, তার চাইতে বেশি একজন সাধারণ নাগরিকের হতাশার বহিঃপ্রকাশ।
আমার কাছে এর একটা খুব সহজ মনস্তাত্মিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বাবা-মা-র মধ্যে বিবাদ হলে
অথবা বাবা-মা বাড়ির সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হলে সন্তানের মুরুব্বি খুঁজে ফেরে;
আবির্ভাব হয় চাচা-মামা-ফুপাদের। তারাই তখন হয়ে যান পরিবারের রক্ষক। আমাদের
ব্যাপারটাও মনে হয় সেরকমই। তবে বরাবরের মত বিদেশীরা সাংবাদিকদের বলেন যে, আমাদের
সমস্যা আসলে আমাদেরই সমাধান করতে হবে। অন্য কারো তো বয়েই গেছে যে আমাদের ভালো করার
জন্য উঠে পড়ে লাগবে। আমাদের সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে কেউ যদি নিজের স্বার্থ দেখে,
তাকে আমরা তখন দোষ দিতে পারি না। সবাই নিজের স্বার্থ দেখে; আমাদেরও সময় এসেছে।
বঙ্গোপসাগরের ফানেলের
এক্কেবারে গোড়ায় থাকা এই দেশটি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারন কি? মালাক্কা, সুয়েজ
খাল, কলম্বো বা সিংগাপুরের মত কোন আন্তর্জাতিক নৌপথ বা আকাশপথ এই দেশের উপর দিয়ে
যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের মত তেলের উপরেও ভাসছে না এই দেশ। তাহলে কিভাবে
বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে? বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে তার ভৌগোলিক
অবস্থান আর আর্থসামাজিক অবস্থা। বিগত এক-দুই দশক দেখিয়ে দিচ্ছে সামনে কি আসতে
পারে। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশ যে কি গতিতে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা সম্ভবত দেশের
মানুষগুলাও জানে না। প্রধানতঃ মুসলিম হলেও ধর্মীয় দিক থেকে এদেশের মানুষের
অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি বিদেশীদের আগ্রহী করে তোলে। ধর্মান্ধতায়
অস্থির পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের একটা প্রধান পার্থক্য খুঁজে পায় তাঁরা। এতো
সমস্যার পরেও বছর বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জানান দেয় এদেশের সম্ভাবনার। তবে এগুলি
তো আর্থ-সামাজিক গুরুত্বের কথা বলছি। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভৌগোলিক দিক থেকে
এদেশের কৌশলগত গুরুত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু কিভাবে?
চীনের জন্য প্রাচীর?
কারো অজানা নয় যে সারা
বিশ্বের পুলিশম্যান এখন একজনই – মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই পুলিশম্যানের সবচেয়ে চিন্তার জায়গাগুলির একটি হল চীন। চীনকে
অর্থনৈতিক আর সামরিক দিক থেকে আলাদা করার একটা প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই করে
যাচ্ছে। আর সেটা জেনে চীনও সমান বা তার চাইতেও বেশী দ্রুততার সাথে তাদের প্রভাবের
পরিধি বাড়িয়েই চলেছে। চীনকে আটকানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে মালাক্কা প্রণালী থেকে
শুরু করে জাপান পর্যন্ত দ্বীপের এক বেষ্টনি গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্যাস্ত
যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য দেশগুলি এই
বেষ্টনি তৈরির পার্টনার। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের জ্বালানি তেলের ৮০% যাতায়াত
করে। এই জায়গা যে নিয়ন্ত্রণ করবে, সে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কাজেই বলার
অপেক্ষা রাখে না যে চীন খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা বিকল্প পথের। এই বিকল্প পথ হতে পারে
বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের পূর্ব তীরে মিয়ানমারের উপকূলে কায়াকফাউ দ্বীপে চীন তৈরি
করছে গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানী করা তেল আবতরণ
করার পরে একেবারে চীনের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে দীর্ঘ এক তেলের পাইপলাইনের
মাধ্যমে। এরই সমান্তরাল আরেক পাইপলাইনের মাধ্যমে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তোলিত
গ্যাস। মিয়ানমারের সামরিক শক্তি পুরোপুরিভাবে চীন নির্ভরশীল হলেও সেই নির্ভরশীলতার
পরিবর্তন চায় মিয়ানমারের সবাই। যে কারনেই রাশিয়া আর ভারতের দিকে ঝুঁকছে মিয়ানমার।
স্বভাবতই চীনও চাইছে এই এলাকায় অবস্থান শক্ত করার জন্য মিয়ানমারের উপরে
নির্ভরশীলতা কমাতে। তারাও বঙ্গোপসাগর এলাকা ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে নারাজ।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের জন্য অপরিমেয় গুরুত্ব বহন করছে। একই সাথে ভারত মহাসাগরে
চীনকে ধরে রাখার জন্য একটা শক্ত সহযোগী চাইছে যুক্তরাষ্ট্র; যে কারণে ভারতকে
শক্তিশালী দেখতে চায় আমেরিকানরা। কিন্তু এতকাল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর রাশিয়ার কাছাকাছি
থাকার পর ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা এখনো প্রশ্নাতীত নয়। তারপরেও
একই উদ্দ্যেশ্য থাকার কারনে ইন্দো-মার্কিন সহযোগিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আমেরিকানরা চাইছে ভারতীয়রা বাংলাদেশ-সহ পুরো দক্ষিন এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে এগিয়ে
আসুক। এতে চীনকে ঠেকানোর কাজটি কিছুটা হলেও সহজ হবে। কিন্তু ভারতের পক্ষে দক্ষিন
এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করাটা এখনো অনেক দূরের পথ বলেই মনে হয়। তবে ভারত নিজেদের
চিন্তাধারার মধ্যে থেকেই সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ভারতের পূর্ব চিন্তা
ভারত মহাসাগরে ভারতকে
ব্যালান্স করার জন্য চীন দক্ষিণ এশিয়াতে অনেক আগে থেকেই সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী।
পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের সামরিক শক্তির বেশিরভাগটাই চীনের সহযোগীতায়
গড়া। এই দেশগুলির জাতীয় নিরাপত্তায় চীনের গুরুত্ব অপরিসীম। আর তাই পারস্পরিক
বিশ্বাসও সেইরকমই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জানে যে যাদেরকে আমরা আমাদের বাড়ির
নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছি, তাদের উপর থেকে আমাদের বিশ্বাস এতো সহজে উঠে যাবে না।
তাই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের উপরে চীনের প্রভাব কমানোর চেষ্টা না করে বরং আমাদের সাথে
সম্পর্কোন্নয়নে বেশি আগ্রহী। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে চায় তারা।
ঠিক যেমনটি চাচ্ছে চীন সহ জাপান, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং সর্বোপরি আমাদের
প্রতিবেশী ভারত। ভারতের ব্যাপারটা অবশ্য কিছুটা অন্যরকম, কারন ভারত আমাদের
প্রতিবেশী, যাদের সাথে আমাদের স্থল সীমান্ত রয়েছে। তাই বাংলাদেশের সমরশক্তি গঠনে
চীনের ভুমিকা যে ভারত খুব একটা ইতিবাচক দিক থেকে দেখবে না সেটা বলাই বাহুল্য। বিগত
বিএনপি সরকারের সময় পাকিস্তানের সাথে সামরিক সহযোগীতাও ভারত খুব একটা ভালো চোখে
দেখেনি। সেসময় পাকিস্তান থেকে বিমান বাহিনীর জন্য আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা কমান্ড
এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম, এয়ার ম্যানুভারিং-এর ট্রেনিং সিস্টেম (এসিএমআই) এবং
সেনাবাহিনীর জন্য ২০০ ‘বাকতার-সিকান’ ট্যাঙ্ক-ধ্বংসী মিসাইল কেনা হয়। এছাড়াও ২০০৬ সালের
ফেব্রুয়ারী মাসে ততকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাকিস্তান সফরের পর বাংলাদেশ
পাকিস্তান থেকে দুটি সাবমেরিন পাচ্ছে বলে ২০০৬ সালের জুনে ভারতীয় মিডিয়াতে গুজব
ছড়ায়; যেটা বাংলাদেশ নৌবাহিনী সংবাদ সন্মেলন করে নাকচ করে দেয়। এরশাদের সময়েও
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সামরিক সম্পর্ক ছিল উন্নত। সেসময় পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
৪০-টার মত ‘এফ-৬’ জঙ্গীবিমান পায়। পাকিস্তানের সাথে সামরিক সম্পর্কের
গুরুত্ব কিন্তু চীনকে ডিঙ্গিয়ে নয়। তবে পাকিস্তান হোক আর চীনই হোক সেটা ভারতের
জন্য খুব একটা সুখকর নয়। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গঠনে ভারতের কোন আবদান খুঁজে
পাওয়া দুষ্কর –সেটা
বাংলাদেশের দিক থেকে না-চাওয়ার কারনে হোক, অথবা ভারতের অনিচ্ছার কারনেই হোক। এটাও
ঠিক যে ভারত তাদের পূর্ব দিকে পাকিস্তানের মত আরেকটা প্রতিবেশী চায় না। অনেক
ভারতীয়দের কাছে আধিকাংশ মুসলিম অধ্যুসিত বাংলাদেশ ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসী তৈরির
কারখানা। তাই বাংলাদেশের সাথে ভারতের সীমান্তে অনাকাংক্ষিত শক্তিপ্রোয়োগের
ঘটনাগুলিকে তারা অনেকেই সমর্থন করে থাকেন। এতকিছু সত্তেও বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক
ও আর্থসামাজিক সম্পর্কের দিক থেকে ভারতের দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই। ভারতের
উত্তর-পূর্বের সেভেন সিসটারস প্রদেশগুলিকে হাতের মুঠোয় রাখতে বাংলাদেশের গুরুত্ব
অনেক। শুধু এই প্রদেশগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলেও ভারত সবসময় চাইবে বাংলাদেশের
সাথে সম্পর্ক যেন হৃদ্যতাপূর্ণ থাকে। আবার এই প্রদেশগুলিরই রয়েছে চীনের সাথে
স্থলসীমান্ত। আর এরপর বিশাল সম্ভাবনাময় বাণিজ্য তো রয়েছেই। বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে
ট্রানজিট, বিদ্যুত রপ্তানী, রামপাল কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র, দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতু,
ইত্যাদি প্রজেক্টগুলি জানান দেয় ভারত বাংলাদেশে নিজেদের বন্ধুপ্রতিম একটা সরকার
কতটা চেয়ে থাকে।
নতুন বাজারে দখলের খেলা
বিএনপির চাইতে আওয়ামী
লীগ সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো হলেও চীন থেকে সামরিক সরঞ্জামাদি কেনা
কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। তবে সেখানেও ব্যালান্সিং চলছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে
মিয়ানমারের সাথে সেন্ট মার্টিনের কাছে গ্যাস রিগ নিয়ে বিরোধের পর থেকে বাংলাদেশ
সরকার সসস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের বিশাল পরিকল্পনা নিয়েছে। মাত্র চার বছরে দুই
বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনা হয়েছে; প্রতিরক্ষা বাজেটও বেড়ে হয়েছে দিগুন। আরও অনেক
অস্ত্রসস্ত্র সরবরাহের পথে বা পরিকল্পনাতে রয়েছে। এই কেনাকাটাতে চীনের আধিক্য
থাকলেও সেখানে অন্যদেরও সুযোগ দেয়া হয়েছে। ‘এফ-৭’ ফাইটার
বিমান চীন থেকে কেনা হলেও ‘এমআই-১৭১’ হেলিকপ্টার কেনা হয়েছে রাশিয়া থেকে। ‘এমবিটি-২০০০’ ট্যাঙ্ক
চীন থেকে কেনা হলেও ‘নোরা বি-৫২’ স্ব-চালিত আর্টিলারি কেনা হয়েছে সার্বিয়া থেকে। আবার
আর্টিলারির জন্য ওয়েপন লোকেটিং রাডার কেনা হয়েছে চীন থেকে। নৌবাহিনীর জন্য ব্রিটেন
থেকে কেনা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলে চীনা ‘সি-৭০৪’ মিসাইল সজ্জিত করে বানানো হয়েছে গাইডেড মিসাইল কর্ভেট।
বিমান-ধ্বংসী ‘এফএম-৯০’ মিসাইল কেনা হয়েছে চীন থেকে, কিন্তু বিমান প্রতিরক্ষা
রাডার কেনা হচ্ছে রাশিয়া থেকে। জার্মানি থেকে নৌবাহিনীর জন্য ম্যারিটাইম প্যাট্রোল
বিমান; ফ্রান্স থেকে সেনাবাহিনীর জন্য হেলিকপ্টার; ইটালি থেকে নৌবাহিনীর জন্য
হেলিকপ্টার। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাবসা করে নিচ্ছে রাশিয়া। এমনিতেই বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীর জন্য কয়েক’শ ‘বিটিআর-৮০’ এপিসি কেনা
ছাড়াও এগুলির জন্য এদেশে একটা সার্ভিসিং প্ল্যান্ট করার প্রসেস চলছিল বলে জানা
গেছে। বাংলাদেশের অস্ত্র বাজার ধরার জন্য ২০১৩-এর জানুয়ারী মাসে রাশিয়ার
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরের সময় ১ বিলিয়ন
ডলারের ঋণের ব্যাবস্থাও করে দিলেন। এযাবতকালে এটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড়
সামরিক ক্রয়ের চুক্তি। শুধু এ-ই নয়; একই সাথে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে বিনিয়োগ
আর গ্যাজপ্রমের মাধ্যমে কোন বিডিং ছাড়াই বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজও
পেয়ে গেল রাশিয়া। এর আগে বিএনপি-র সময়ে পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য চীনের সহায়তা
দেবার কথা শোনা যাচ্ছিল। পুতিন এক মাস্টার স্ট্রোকে চীনের একচেটিয়া বাজারে তো
প্রবেশ করলেনই, একই সাথে তেল-গ্যাসের বাজারে মার্কিন-ইউরোপিয়দের টেক্কা দেবার একটা
সুযোগ পেয়ে গেলেন।
বাংলাদেশ শুধুমাত্র
সামরিক খাতেই ব্যালান্সিং এক্টে নেই। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রজেক্ট এরকমই
একটা উদাহরণ। সরকার বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় এই
প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। কারো কাছেই মনোপলি যাচ্ছে না। ঠিক যেমনটি হয়েছে
আমাদের খণিজ গ্যাস আহরণ সেক্টরে।
মার্কিনী প্রভাব
সামরিক দিক দিয়ে
মার্কিনীরা আমাদের দিয়েছে ট্রেনিং। নৌবাহিনীর স্পেসাল ফোর্স ‘সোয়াডস’ আর পুলিশের ‘সোয়াট’ মার্কিন
সহায়তার তৈরি করা হয়েছে। ইটালি থেকে নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার কেনা হলেও সেগুলি
জাহাজের উপর থেকে কিভাবে অপারেট করতে হবে তা দুই-দেশের নৌ-মহড়ার সময় শিখিয়ে গেছে
আমেরিকানরা। আমরা জাতিসংঘ মিশনে সৈন্য পাঠিয়ে যে প্রশংসা কুড়িয়েছি, সেটা আমাদের
পেশাদারীত্বের জন্য। আর এই পেশাদারীত্বের পেছনে বেশ বড় অবদান রয়েছে আমেরিকানদের।
আমাদের বিমান বাহিনীর ‘সি-১৩০’ পরিবহন বিমান ও ‘বেল-২১২’/’বেল-২০৬’ হেলিকপ্টার ও নৌবাহিনীর কিছু স্পেশাল ফোর্সের বোট
মার্কিনী। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইউএস কোস্ট গার্ডের একটি জাহাজ এখন বাংলাদেশের পথে।
মজার ব্যাপার হলো, দেশে আসার পর ‘বিএনএস
সমুদ্র জয়’ নামের এই
জাহাজটি গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট হবার আগে সম্ভবত তাতে চীনা অস্ত্রই শোভা পাবে। তবে
বেসামরিক দিকেই মার্কিনীদের আগ্রহ বরাবরের মত বেশি থাকবে। তেল-গ্যাস মার্কেটের দখল
নেয়া থাকবে একটা গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা; সেখানে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের অবারিত সুযোগের
হাতছানি।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন
সংস্থা ইউএসএআইডি-র অনেক ভুমিকা রয়েছে। এরপর রয়েছে বিশ্ব ব্যাংক; সেটাও মার্কিন
বললে ভুল হবে না। তাদের সাথে একই রকমভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইউরোপিয়ানরা আর জাপানীরা।
মেঘনা সেতু, মেঘনা-গোমতি সেতু, পাকশির লালন শাহ সেতু, রূপসার উপরে খান জাহান আলী
সেতু – এগুলি সবই
জাপানের সহায়তায় তৈরি। যমুনার উপরে বঙ্গবন্ধু সেতুতেও রয়েছে জাপানের বিরাট অঙ্কের
অবদান। ফেঁসে যাওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পেও থাকার কথা। আরও বহু প্রজেক্টে জাপানী
সহায়তা রয়েছে। এসব সহায়তা ছাড়াও বাংলাদেশে জাপানের বেশ বড়সর বিনিয়োগও রয়েছে। চীনের
উপরে নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশে জাপানের হোন্ডা একটা মোটর সাইকেল সংযোজন কারখানাও
স্থাপন করেছে। ব্রিটেনের
উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি বহু প্রজেক্টের মাঝে অর্থায়ন করেছে ভৈরব সেতু। এতটা সহায়তা
দেবার পর যুক্তরাষ্ট্র আর তার সহযোগীরা বিনিময়ে আমাদের কাছ থেকে কিছুটা হলেও
কুটনৈতিক সুবিধা চাইবে সেটাই বলাই বাহুল্য। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে টিকফা
চুক্তি সই করানোর বহু চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু প্রায় দুই দশক পরেও সেই চেষ্টা
শুধু চেষ্টাই রয়ে গেছে। তেল-গ্যাসের প্রজেক্টগুলির ক্ষেত্রে অনেক চেষ্টা করেও
একচেটিয়া আধিপত্যের কাছেধারেও যেতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এতে প্রমাণ হয় যে
বাংলাদেশের উপরে পশ্চিমা দেশগুলির কুটনৈতিক চাপ থাকলেই সেটা সফল হবে তার কোন
গ্যারান্টি নেই।
মিউজিক্যাল চেয়ার
মার্কেটিং-এ পড়েছিলাম, যে বাজারে বিক্রেতার সংখ্যা বেশি,
সেখানে ক্রেতার হাতে ক্ষমতা বেশী। বাংলাদেশে প্রায় সেইরকমই অবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে
বাংলাদেশ হল ক্রেতা। অপার সম্ভাবনার এই বাজার কেউই হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। সবাই
কিছু না কিছু অংশ কামড়িয়ে ধরে রাখছে। অনেকটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মত; চেয়ার থেকে
উঠলেই অন্য কেউ চেয়ার দখল করে নিবে। চেয়ার হারানোর ভয়ে কেউই এখন বাংলাদেশের উপরে
যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশকে এখন তাই মনে হচ্ছে
পরাশক্তির মিউজিক্যাল চেয়ার। পরাশক্তিরা যখন একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে,
তখন সেটার সুযোগ ছোট একটা দেশের পক্ষেও নেয়া সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের
রাজনীতি আর কুটনীতি তা-ই বলছে।
No comments:
Post a Comment