'রয়টার্স' বলছে যে, ২৮শে জানুয়ারি 'এম২৩' বিদ্রোহী গ্রুপ ডিআর কঙ্গোর পূর্বের সবচাইতে বড় শহর গোমা-র বিমানবন্দর দখল করে নিয়েছে। এই বিমানবন্দরের মাধ্যমে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে লাখো বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্যে খাদ্য সহায়তা আসতো। এর মাত্র একদিন আগে 'এম২৩' বিদ্রোহীরা গোমা শহরে ঢোকে। ২০১২ সালের পর থেকে কঙ্গোতে এটা সবচাইতে মারাত্মক সহিংসতা; যার মূলে রয়েছে তিন দশক আগের রুয়ান্ডার গণহত্যা এবং কঙ্গোর খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রতিযোগিতা। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজাররিক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, গোমায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী সেনারা নিজেদের ঘাঁটির অভ্যন্তরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে যে, ‘এম২৩'এর ৩ হাজারের মতো সদস্যকে সরাসরি ইন্ধন যোগাচ্ছে রুয়ান্ডা। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল জঁ-পিয়েরে লাক্রোঁয়া এক সংবাদ সন্মেলনে বলছেন যে, এব্যাপারে কোন প্রশ্ন নেই যে, কঙ্গোর অভ্যন্তরে গোমায় অবস্থান করে রুয়ান্ডার সেনাবাহিনী 'এম২৩'কে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে। এখানে রুয়ান্ডার সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা কতো, তা নিয়ে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না; কেউ বলছে ৩ হাজার; কেউ বলছে ৪ হাজার। ডিআর কঙ্গোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসে কাইকওয়াম্বা ওয়াগনার বলছেন যে, কূটনীতির পিছনে রুয়ান্ডার যুদ্ধ ঘোষণা এখন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে 'ডয়েচে ভেলে' বলছে যে, ‘এম২৩'এর জন্যে রুয়ান্ডার সেনাবাহিনীর সমর্থন এখন আর রুটশুরু, মাসিসি এবং নিরাঙ্গোংগো এলাকার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। রুয়ান্ডা এখন সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। এর মাধ্যমে রুয়ান্ডা এবং 'এম২৩' তাদের নিয়ন্ত্রণকে কঙ্গোর ইতুরি প্রদেশে এডওয়ার্ড হ্রদের তীর পর্যন্ত বর্ধিত করবে। ভৌগোলিক কারণেই খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ রুটশুরু এবং মাসিসি শহরের সাথে রুয়ান্ডার যোগাযোগের রাস্তা সীমান্ত শহর গোমা-র মাঝ দিয়ে যায়। একারণে গোমা রুয়ান্ডার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
'সিএনএন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, হাজারো মানুষ গোমা শহর ছেড়ে পালাচ্ছে এবং অরাজকতার সুযোগ নিয়ে গোমার কারাগার থেকে অনেক কয়েদী পালিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে যে, ২০২৫এর জানুয়ারি মাসে সহিংসতার কারণে ৪ লক্ষাধিক বেসামরিক জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের মাঝে অনেককেই একাধিকবার বাড়িছাড়া করা হয়েছে। এদের অনেকরই রাত্রিযাপনের জায়গাটুকুও নেই। ২০১২ সালে শেষবারের মতো 'এম২৩' গোমা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। সাম্প্রতিক সহিংসতায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমপক্ষে ১২ জন সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। 'সিএনএন' বলছে যে, ডিআর কঙ্গো সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী রুয়ান্ডা 'এম২৩' গ্রুপকে ইন্ধন যোগাচ্ছে; তবে রুয়ান্ডা এটা অস্বীকার করে। একইসাথে রুয়ান্ডা সরকার বলছে যে, তারা রুয়ান্ডার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিআর কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে সেনা ও বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন রেখেছে।
রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর সহিংসতা - একই সূত্রে গাঁথা
মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' বা 'সিএসআইএস'এর সিনিয়র ফেলো ক্যামেরন হাডসন 'সিএনএন'এর সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, এর আগেরবার যখন 'এম২৩' বিদ্রোহীরা গোমার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। তবে ডিআর কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে সহিংসতা চলছে কয়েক দশক ধরে; সাম্প্রতিক সময়ে যা থেকে মুক্ত ছিল গোমা। এই এলাকায় ইতোমধ্যেই বাস্তুচ্যুত লক্ষ লক্ষ মানুষ অবস্থান করছিলো। এখন তারা দলে দলে পালাতে শুরু করেছে। সংঘাতের ইতিহাসকে টেনে এনে হাডসন বলছেন যে, তিন দশক আগে ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার টুটসি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যায় অংশ নেয়া হুটু মিলিশিয়ারা ডিআর কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে 'এফডিএলআর' মিলিশিয়ার সদস্যরা নিয়মিতভাবে রুয়ান্ডার জাতিগতভাবে টুটসি সেনাবাহিনীর উপর হামলা চালাতে থাকে। এই হামলা ঠেকাতে রুয়ান্ডা ডিআর কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে নিজেদের প্রক্সি হিসেবে 'এম২৩' বিদ্রোহী গ্রুপকে সহায়তা দিতে থাকে। 'এম২৩' কঙ্গোর অভ্যন্তরে ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে এবং হুটু মিলিশিয়াদেরকে ঠেলে পশ্চিম দিকে পাঠাতে থাকে। এখন তারা কঙ্গোর সেনাবাহিনীকেও হটিয়ে দিচ্ছে; যার মাধ্যমে তারা রুয়ান্ডা এবং কঙ্গোর মাঝে একটা বাফার জোন তৈরি করছে; যা কিনা রুয়ান্ডার নিরাপত্তাকে বৃদ্ধি করবে।
‘ফিনানশিয়াল টাইমস'এর এক লেখায় 'সায়মন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটি'র প্রফেসর এবং লেখক জেসন স্টিয়ার্নস অবশ্য বলছেন যে, যারা বলছেন যে, হুটু বিদ্রোহী 'এফডিএলআর'কে মোকাবিলা করতেই 'এম২৩'কে সহায়তা দিচ্ছে রুয়ান্ডা, তারা পুরো ইতিহাসটাকেই উল্টো করে ফেলেছেন। কারণ 'এম২৩'এর সহিংসতার কারণেই কঙ্গোর অভ্যন্তরে টুটসিদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে এবং কঙ্গোর সরকারকে হুটু মিলিশিয়া 'এফডিএলআর' সাথে সখ্যতা তৈরি করিয়েছে। যদিও কঙ্গোর সরকার 'এফডিএলআর'কে সহায়তা দিয়ে ভালো কাজ করেনি, তথাপি শহরগুলিতে 'এম২৩'এর সহিংসতা নতুন মাত্রা নিয়েছে।
কঙ্গোর খনিজ সম্পদের জন্যেই এই লড়াই
‘রয়টার্স' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৯৯৪ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন হুটুরা টুটসিদের উপর গণহত্যা চালানোর পর টুটসি সেনারা রুয়ান্ডার ক্ষমতা দখল করে। এবং সেই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত টুটসিরা (যারা জনসংখ্যার ১০ শতাংশের মতো) রুয়ান্ডায় ক্ষমতাসীন রয়েছে। কঙ্গোর সরকার বলছে যে, কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের খনিজ সম্পদ লুট করার লক্ষ্যে রুয়ান্ডা তার প্রক্সি মিলিশিয়াদেরকে সহায়তা দিচ্ছে। এই খনিজের মাঝে রয়েছে কলটান (এবং এর থেকে উৎপাদিত ট্যানটালাম), যা কিনা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও জেট ইঞ্জিন এবং অন্যান্য টারবাইন ইঞ্জিনের উচ্চ তাপমাত্রার যৌগ তৈরিতে কলটানের একটা বড় অংশ ব্যবহৃত হয়। জাতিসংঘের ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, রুয়ান্ডা-সমর্থিত বিদ্রোহীরা কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেবার পর কলটান বিক্রি করে প্রতিমাসে ২০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে থাকে। আর রুয়ান্ডাও ১৯৯০এর দশকের শেষের দিক থেকে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেবার পর থেকে হঠাৎ করেই কলটানের বৃহৎ রপ্তানিকারক বনে যায়। ২০০০ সালে বিশ্বের মোট কলটান উৎপাদনের ৯ শতাংশ আসতো কঙ্গো থেকে, আর ১২ শতাংশ আসতো রুয়ান্ডা থেকে। আর ২০১৪ সাল নাগাদ কঙ্গো বিশ্বের ১৭ শতাংশ কলটানের সরবরাহকারী হলেও রুয়ান্ডা ৫০ শতাংশ সরবরাহকারী হয়ে সারা বিশ্বের মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলির মাঝে নাম লিখিয়ে নেয়।
২০২৩ সালের 'স্ট্যাটিস্টা'র এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, কঙ্গোর সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের কলটানের উপর সবচাইতে বেশি নির্ভরশীল কোম্পানি হলো 'আমাজন'। এছাড়াও 'এলফাবেট' (গুগল), ‘এপল', ‘মেটা' (ফেইসবুক) এবং 'মাইক্রোসফট'এরও নির্ভরশীলতা রয়েছে কঙ্গোর খনিজের উপর। 'বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রুয়ান্ডার সীমানার সাথে লাগোয়া এলাকাগুলিতে থাকা খনিজগুলির মাঝে রয়েছে কলটান, টিন এবং স্বর্ণ – যেগুলির সবগুলিই মোবাইল ফোন এবং ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে, সংঘাতের নামে রুয়ান্ডা কঙ্গোর খনিজ সম্পদ লুট করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে 'এম২৩' খনিজ সমৃদ্ধ এলাকাগুলি দখলে নিয়েছে। গত ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলছে যে, বিদ্রোহীরা প্রতি চার সপ্তাহ অন্তর অন্তর এই অঞ্চল থেকে ১২০ টন কলটান রপ্তানি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রুয়ান্ডার কলটান উৎপাদনের বেশিরভাগটাই মূলতঃ কঙ্গো থেকে আসা। তবে রুয়ান্ডা এই অভিযোগ পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করে আসছে।
‘ডয়েচে ভেলে'র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘এম২৩'এর সাম্প্রতিক আক্রমণের মূল লক্ষ্যই হলো খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকাগুলি দখলে নেয়া; যেখানে স্বর্ণ, ক্যাসিটেরাইট (টিন অক্সাইড), কোবাল্ট ও হীরার খনি রয়েছে। প্রথমদিকে রুটশুরু ও মাসিসি এলাকা দখলে নেবার পর তারা ওয়ালিকালে এলাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা রুবায়া শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যেখানে কলটানের বড় খনি রয়েছে। ২০২৪এর এপ্রিলে 'এম২৩' সাকে শহরকে ঘিরে ফেলে। এই শহরটা খনিজ সম্পদ পরিবহণের হাব হিসেবে পরিচিত। কঙ্গোলিজ বিশ্লেষক অগাস্টিন মুহেসি-র মতে, যদি 'এম২৩' ওয়ালিকালে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, তার অর্থ হলো, তারা এর খনিজ বিক্রি করে সামরিক অপারেশনের অর্থায়ন করতে চায়। জাতিসংঘের হিসেবে 'এম২৩' মাসিসি এবং রুটশুরু খনির কলটানের উপর কর থেকে প্রতি মাসে ৩ লক্ষ ডলার আয় করছে। ২০২৪এর অগাস্টে এঙ্গোলার মধ্যস্ততায় রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মাঝে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে ২০শে অক্টোবর থেকেই 'এম২৩' উত্তর-পশ্চিম এলাকায় আক্রমণ শুরু করে। ডিসেম্বরে রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মাঝে শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়।
পশ্চিমা ইন্ধনেই কঙ্গোর সহিংসতা?
‘রয়টার্স' বলছে যে, গোমার ১৬'শ কিঃমিঃ পশ্চিমে কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসাতে বিক্ষোভকারীরা জাতিসংঘের অফিস এবং বিভিন্ন দূতাবাসের উপর হামলা করে। হামলারীরা বলে যে, কঙ্গোর অভ্যন্তরে 'এম২৩'র হামলায় বিদেশী ইন্ধন রয়েছে। হামলার শিকার দূতাবাসগুলির মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রুয়ান্ডার দূতাবাস রয়েছে। হামলাকারীরা কেনিয়ার দূতাবাসে হামলা করে লুটপাট করে।
‘সিএসআইএস'এর ক্যামেরন হাডসন বলছেন যে, রুয়ান্ডার সরকার এখনও পর্যন্ত স্বীকার করছে না যে, তারা 'এম২৩' বিদ্রোহীদেরকে সহায়তা দিচ্ছে। যদি এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, কঙ্গোর অভ্যন্তরে রুয়ান্ডার সেনাবাহিনী যুদ্ধরত অবস্থায় রয়েছে, তাহলে এটা শুধু কঙ্গোর অভ্যন্তরের সংঘাত থাকবে না; বরং মধ্য আফ্রিকায় এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের যুদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হবে। এটা হয়তো শক্তিশালী দেশগুলিকে এমনভাবে জড়াবে, যেভাবে তারা এতদিন জড়ায়নি। রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামি পশ্চিমাদের খুব কাছাকাছি রয়েছেন। পশ্চিমা সাহায্যকারী দেশগুলির সাথে কিভাবে সম্পর্ক রাখতে হবে, সেটা তিনি বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছেন এবং তার উপর পশ্চিমাদের আস্থা বৃদ্ধি করেছেন। কিছুদিন আগেই পল কাগামি ব্রিটেন থেকে অভিবাসীদেরকে রুয়ান্ডায় ফেরত নিয়ে আসার জন্যে লন্ডনের সাথে চুক্তি করেছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষেই পশ্চিমাদের 'ডার্লিং' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এগুলির উপর ভিত্তি করেই রুয়ান্ডার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পশ্চিমারা কাগামিকে সুযোগ করে দিয়েছে। আর ৩০ বছর আগে রুয়ান্ডার টুটসি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে গণহত্যা চলেছিল, সেটা পশ্চিমারা থামাবার কোন চেষ্টাই করেনি। সেটা নিয়ে পশ্চিমাদের মাঝে একটা অপরাধবোধ রয়েছে। তবে হাডসন কাগামির প্রতি পশ্চিমাদের ভালোবাসার কারণ হিসেবে কঙ্গোর কলটান খনির কথা উল্লেখ করেননি।
লেখক জেসন স্টিয়ার্নস বলছেন যে, কঙ্গোর জনগণ মনে করে যে, যখন কঙ্গোলিজরা ব্যাপক কষ্টের মাঝে পড়ছে এবং শক্তিশালী দেশগুলি তা চেয়ে চেয়ে দেখছে, তখন এর অর্থ দাঁড়ায় যে, শক্তিশালী দেশগুলি এটাই দেখতে চেয়েছে। আশ্চর্য্য হবার উপায় নেই যে, কঙ্গোলিজদের মাঝে রাশিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। 'এম২৩' বিদ্রোহীদের প্রধান ইন্ধনদাতা রুয়ান্ডা সরকারের বাজেটের এক-তৃতীয়াংশই পশ্চিমা অর্থনৈতিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। কাজেই এই সংঘাত বন্ধ করাটা খুবই সহজ হবার কথা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইইউ সকলেই রুয়ান্ডার কর্মকান্ডের সস্তা নিন্দা জানিয়েছে। কঙ্গোর সংঘাত চলার মাঝেই ২০২২ সালে মোজাম্বিকে মুসলিম বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনী প্রেরণের জন্যে ইইউ রুয়ান্ডাকে ৪০ মিলিয়ন ইউরো দিয়েছে। ফ্রান্সও এতে খুশি থেকেছে; কারণ রুয়ান্ডার সেনারা ফরাসি কোম্পানি 'টোটাল'এর গ্যাসের খনিগুলিকে রক্ষা করেছে। এছাড়াও 'গ্লোবাল গেইটওয়ে' প্রকল্পের অধীনে ইইউএর সদস্য রাষ্ট্রগুলি রুয়ান্ডাতে ৯০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। ইইউএর কিছু কর্মকর্তা আবার রুয়ান্ডার স্মার্ট কূটনীতিকদেরকে কঙ্গোর কূটনীতিকদের চাইতে বেশি পছন্দও করে থাকেন। মার্কিন বাস্কেটবল সংস্থা 'ন্যাশনাল বাস্কেটবল এসোসিয়েশন' বা 'এনবিএ' রুয়ান্ডাতে 'বাস্কেটবল আফ্রিকা লীগ'এর উদ্যোগ নিয়েছে। ইউরোপিয় ফুটবল দল 'প্যারিস সেন্ট-জারমেইন' এবং 'আর্সেনাল'এর জার্সিতে শোভা পাচ্ছে 'ভিজিট রুয়ান্ডা' বিজ্ঞাপণ। মোটরগাড়ির প্রতিযোগিতা 'ফর্মূলা-১'এর টুর্নামেন্টের স্বাগতিক দেশও হতে চাইছে রুয়ান্ডা। ২০১২ সালে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামির পশ্চিমা সমর্থকেরা 'এম২৩'এর লাগাম টানতে চাপ প্রয়োগ করেছিলো। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কাগামির উপর চাপ সৃষ্টি করার কয়েক মাসের মাঝেই 'এম২৩' সহিংসতা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলো। তবে বর্তমানে বিশ্বটা অনেকটাই ভিন্ন; যেখানে মানবতার চাইতে আফ্রিকা থেকে পশ্চিমা দেশে অভিবাসী যাওয়া ঠেকানো, ব্যবসায়িক বিনিয়োগ এবং অন্যান্য জাতীয় স্বার্থ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সকলেই একতাবদ্ধ; অথচ মধ্য আফ্রিকাতে লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুত হবার ব্যাপারটাকে সকলেই ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে।
পশ্চিমা স্বার্থের বলি হয়েছে মধ্য আফ্রিকার রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর জনগণ। রুয়ান্ডায় টুটসিদের উপর হুটুদের ব্যাপক গণহত্যাকে পুঁজি করে ক্ষমতা নিয়েছিলেন পশ্চিমা-সমর্থিত টুটসি নেতা পল কাগামি। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রুয়ান্ডার টুটসি সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে থাকার পর প্রায় ২৫ বছর ধরে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন তিনি। ক্যামেরন হাডসনের কথায় তিনি পশ্চিমাদের 'ডার্লিং' বনে গেছেন। তবে সেটা বর্তমানের প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির মাঝে একটা - কলটান-এর নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী হবার কারণেই। বিশ্ব বাজারে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের কলটানের সরবরাহ নিশ্চিত করতেই কাগামির ইন্ধনে 'এম২৩' বিদ্রোহীরা কঙ্গোর জনগণের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। আর পশ্চিমারা জাতিসংঘের অধীনে একটা শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন রেখে কলটানের সরবাহ লাইনকে সুরক্ষা দিচ্ছে। পশ্চিমাদের নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের উপর নির্ভর করেই কখনো সহিংসতা বেড়েছে; কখনো কমেছে। কিন্তু কঙ্গোর লাখো বাস্তুচ্যুত জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়নি। অতি সম্পদশালী অঞ্চলের মালিক হবার পরেও তারা চরম দারিদ্র্যের মাঝে বসবাস করে যাচ্ছে। পশ্চিমা নেতৃত্বে নব্য উপনিবেশবাদের উত্থানে ধ্বসে পড়া বিশ্ব ব্যবস্থার এটা একটা চমৎকার উদাহরণ।
No comments:
Post a Comment