Thursday 31 October 2019

পুতিনের আফ্রিকায় অবতরণ!

৩১শে অক্টোবর ২০১৯
 


২৩শে অক্টোবর রুশ বিমান বাহিনীর দু’টা ‘তুপোলেভ টিইউ-১৬০’ পারমানবিক বোমারু বিমান দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে অবতরণ করে। এটা ছিল আফ্রিকার মাটিতে রুশ পারমানবিক বোমারু বিমানের প্রথম অবতরণ। রাশিয়া থেকে ১১ হাজার কিঃমিঃ উড়ে আসা এই বিমানগুলির মিশনকে প্রশিক্ষণ মিশন হিসেবে বলা হলেও এর রয়েছে বিশেষ কৌশলগত তাতপর্য। বিমানগুলি যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় অবতরণ করছিল, তখনই রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরের উপকূলের শহর সোচিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল প্রথম রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ বৈঠক। বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে সেখানে যান আফ্রিকার ৪৩ জন রাষ্ট্রপ্রধান এবং ৩ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী। পুরো অনুষ্ঠানটির কান্ডারী হিসেবে পুতিনের সাথে ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি।

‘দ্যা মস্কো টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই অনুষ্ঠানটি সোচির অলিম্পিক ভিলেজে আয়োজন করাটা একটা প্রতীকি ব্যাপার ছিল। এই অলিম্পিক ভিলেজেই ২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের সময় পুতিন তার নতুন বহিঃর্মুখী পররাষ্ট্রনীতির আভাস দেন। সেই গেমসের প্রায় সাথে সাথেই রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পরে। সেবছরের এপ্রিলে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়; এবং সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের পূর্বে ডনবাস এলাকায় রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হয়। এর পরের বছর সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সিরিয়ার যুদ্ধে বাশার আল-আসাদের সরকারের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষপের অভিযোগ, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সদস্য এডওয়ার্ড স্নোডেনকে আশ্রয় প্রদান, ভেনিজুয়েলার সরকারকে সামরিক সমর্থন প্রদান এবং তুরস্কের কাছে অত্যাধুনিক ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রয়সহ আরও অনেক আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অংশ হয় রাশিয়া। ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের যে অবরোধের চাপ নেমে এসেছে, সেটাই রাশিয়ার পৃথিবীব্যাপী বন্ধু খোঁজার কাজকে ত্বরান্বিত করেছে। রাশিয়ার আফ্রিকায় গমনের কারণও সেটাই। সোচির রাশিয়া-আফ্রিকা বৈঠকের অনেক অগেই রাশিয়া আফ্রিকাতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই বৈঠকের মাধ্যমে সেই চেষ্টাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলো রাশিয়া।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে বৈঠক শেষ করেই পুতিন আফ্রিকার বৈঠকে যোগ দেন। মধ্যপ্রাচ্যে একটা সাফল্যমন্ডিত সফর শেষ করেই পুতিন সোচিতে আসেন। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে একটা শক্তিশালী অবস্থান পাকাপোক্ত করেই তবে তিনি সোচিতে আফ্রিকা নিয়ে বসেছিলেন। সাম্প্রতিককালে আফ্রিকাতে রাশিয়ার অবস্থান নিয়ে খুব কমই কথা হয়েছে। আফ্রিকার সাথে চীন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি, জাপান, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যতটা গভীর সেক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থান তেমন কিছুই নয়। আফ্রিকার সাথে রাশিয়ার বাৎসরিক বাণিজ্য ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো; যেখানে এই মহাদেশের সাথে ইইউ-এর বাণিজ্য ৩’শ বিলিয়ন ডলার; চীনের বাণিজ্য ২’শ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এমনকি ফ্রান্সের বাণিজ্যও ৫০ বিলিয়ন ডলারের উপর। ‘ইউরোস্ট্যাট’এর হিসেবে আফ্রিকার বৃহত্তম পাঁচ বাণিজ্য সহযোগী দেশের মাঝে রাশিয়ার নাম নেই; ইইউ, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর আসে রাশিয়ার নাম। ভ্লাদিমির পুতিন এক্ষেত্রে আর্থিক সম্পর্ককে সামনে না টেনে আফ্রিকার দেশগুলির স্বাধীনভাবে চলতে পারার প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন। সন্মেলনের আগে রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’এর সাথে এক সাক্ষাতে তিনি বলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি আফ্রিকার দেশগুলির উপর চাপ প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং ব্ল্যাকমেইলের পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলিকে কোন শর্ত ছাড়াই সহায়তা করতে প্রস্তুত। তিন বলেন যে, রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলিকে ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হতে সহায়তা দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফ্রিকার সাথে রাশিয়ার দূরত্ব তৈরি হলেও ইতিহাস মুছে যায়নি। যেমন, মোজাম্বিক পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশের পতাকায় একটা কালাশনিকভ রাইফেল রয়েছে। সন্মেলনে অংশ নেয়া অনেকেই পুতিনের কথাগুলির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাহায্যের বদলে সহযোগিতা এবং বশ্যতার পরিবর্তে সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলেন। আফ্রিকার দেশগুলির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে রাশিয়া সরব থাকলেও নিজের সীমানাতেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং অন্যান্য দেশের ব্যাপারে রাশিয়া চুপ থেকেছে।
 


আফ্রিকার নিরাপত্তায় রাশিয়া

অর্থনীতিবিদ চার্লস রবার্টসন ‘দ্যা মস্কো টাইমস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, আফ্রিকাতে রাশিয়ার মোট রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ যায় মাত্র দু’টা দেশে – মিশর এবং আলজেরিয়াতে। তবে আফ্রিকার দেশগুলির সাথে নিরাপত্তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়া অনেকের থেকেই এগিয়ে। সোভিয়েত সময় থেকেই আফ্রিকার বহু দেশ রুশ অস্ত্রের উপরে নির্ভরশীল। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর হিসেবে গত পাঁচ বছরে রাশিয়া আফ্রিকার সবচাইতে বড় অস্ত্র রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা সরকারগুলি যখন আফ্রিকার দেশগুলিতে মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে অস্ত্র সরবরাহে লাগাম টেনেছে, তখন রাশিয়া সেই শূণ্যস্থান পূরণ করে নিয়েছে।

সোচির সন্মেলনের বাইরেই রুশ নির্মিত অস্ত্রের এক বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়; যা ছিল অস্ত্র কেনাবেচার আলোচনায় মুখর। রুশ সামরিক রপ্তানিকারক কোম্পানি ‘রসবরনএক্সপোর্ট’এর ডিরেক্টর জেনারেল আলেক্সান্ডার মিখিভ বলেন যে, আফ্রিকার ২০টি দেশে তাদের মোট অস্ত্র রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ যাচ্ছে; যার মূল্যমান ১৪ বিলিয়ন ডলার। সোচির বৈঠকের সাইডলাইনে ‘রসবরনএক্সপোর্ট’ ১৫টা দেশের সাথে আলোচনায় বসে। ‘আরআইএ’ সংবাদ সংস্থা বলছে যে, বৈঠকের ফাঁকে রাশিয়া নাইজেরিয়ার কাছে ১২টা ‘এমআই-৩৫পি’ এটাক হেলিকপ্টার বিক্রয়ের চুক্তি করে। নাইজেরিয়া বলছে যে, এই হেলিকপ্টারগুলি বোকো হারাম জঙ্গীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাল্লা আনকুরাও-এর বরাত দিয়ে রুশ মিডিয়া ‘আরটি’ বলছে যে, রুশ মিলিটারি একাডেমিগুলিতে এখন ১’শরও বেশি নাইজেরিয়ান সামরিক সদস্য ট্রেনিং নিচ্ছে। ‘রাশান হেলিকপ্টারস’ কোম্পানির ডিরেক্টর জেনারেল আন্দ্রেই বোগিনস্কি বলেন যে, বর্তমানে আফ্রিকায় উড়ছে ৯’শরও বেশি রুশ-নির্মিত হেলিকপ্টার, যা কিনা পুরো মহাদেশের মোট হেলিকপ্টারের এক-চতুর্থাংশ। আর সেখানে সামরিক হেলিকপ্টারের প্রায় ৪০ শতাংশই রুশ-নির্মিত। কাজেই এই হেলিকপ্টারগুলি সার্ভিসিং, আধুনিকায়ন এবং নবায়নের অনেক ব্যবসায়িক কনট্রাক্ট রুশরা পেতে পারে।

‘মস্কো স্টেট ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’এর আইভান লোশকারেভ বলছেন যে, রাশিয়া চাইছে পৃথিবীর শক্তির কেন্দ্রকে একটা দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) হাতে থাকতে না দিয়ে অনেকগুলি দেশের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া; যার মাঝে একটা দেশ হবে রাশিয়া। আর আফ্রিকাতে কয়েকটা দেশকে রাশিয়া শক্তির কেন্দ্র হিসেবে দেখতে চাইছে; যেমন, উত্তর আফ্রিকায় মিশর; পশ্চিম আফ্রিকায় নাইজেরিয়া; আর আফ্রিকার দক্ষিণে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই শক্তির কেন্দ্রগুলিতে রাশিয়া শক্ত অবস্থানে বসার লক্ষ্য নিয়েই এগুচ্ছে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফ্রিকাতে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধির একটা প্রমাণ ছিল ২০১৮ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে তিনজন রুশ সাংবাদিককে হত্যা। এই সাংবাদিকেরা সেই দেশে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ নামের গোপন রুশ ভাড়াটে সেনাদের অবস্থান নিয়ে রিপোর্ট করতে এসেছিলেন। সোচিতে পুতিন এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ফস্টিন-আরশাঞ্জ তুয়াদেরা এই হত্যাকান্ডের তদন্তের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন বলে ক্রেমলিন থেকে বলা হয়।

আফ্রিকাতে মস্কোর প্রভাব বৃদ্ধির সাথেসাথে এই অঞ্চলের পুরোনো শক্তিরা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে মনোযোগী হয়েছে বলে বলছেন ‘কন্ট্রোল রিস্কস’এর টিম স্ট্যানলি এবং বার্নাবি ফ্লেচার। ‘দ্যা মস্কো টাইমস’এ এক লেখায় তারা বলছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি তাদের রাজনৈতিকভাবে কর্মকান্ড বাড়াবার সাথে সাথে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থগুলিকেও বেশি করে সামনে নিয়ে আসছে। জুন মাসে ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রসপার আফ্রিকা’ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আফ্রিকাতে উন্নয়নের জন্যে সহায়তা দেবার সাথে সাথে সেই প্রকল্পগুলিতে মার্কিন কোম্পানিগুলিকে কাজ পাইয়ে দেবার চিন্তা আসছে। এর আগে মার্কিন নীতি ছিল মূলতঃ রাজনৈতিক সংস্কারকে ঘিরে। অন্যদিকে চীন আফ্রিকাতে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাবকে রাজনৈতিক প্রভাবে রূপান্তরিত করতে চাইছে।

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের টানাপোড়েন চলছে। পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে রাশিয়া তার অর্থনীতিকে ইউরোপ থেকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফোকাস কমে যাবার ফলে রাশিয়ার জন্যে সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও আফ্রিকার দেশগুলির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শরণার্থী সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং আফ্রিকার সরকারগুলির উপর নানামুখী চাপের সৃষ্টি করেছে। এই সুযোগে রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলির সাথে সামরিক সম্পর্ক গভীর করেছে, বাণিজ্যিক সম্পর্কও বাড়িয়েছে, এবং সেসব দেশের স্বেচ্ছাচারী শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়েছে। প্রাক্তন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ব্রেগাদজে এখন পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে রুশ এলুমিনিয়াম কোম্পানি রুসালে রয়েছেন; যেখান থেকে তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডেকে সমর্থন যোগাচ্ছেন। প্রাক্তন রুশ ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা ভ্যালেরি জাখারভ এখন সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট ফস্টিন-আরশাঞ্জ তুয়াদেরার নিরাপত্তা উপদেষ্টা। সেন্ট্রাল আফ্রিকা এবং মোজাম্বিকে রুশ ভাড়াটে সেনারা সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলেও বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছে। গত জুনে রাশিয়ার প্রাক্তন ধনকুবের মিখাইল খদরকভস্কির মাধ্যমে পাওয়া কিছু নথি জনসম্মুখে আনে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’। সেখানে বেশ লম্বা বর্ণনা দেয়া হয় যে, কিভাবে নিরাপত্তা, রাজনীতি, ব্যবসা, মিডিয়া, এনজিও, ইত্যাদির উপর ভর করে রাশিয়া আফ্রিকায় তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। সেখানে ১৩টা দেশকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের হৃদ্যতার উপর ভিত্তি করে রেটিং করা হয়।






রাশিয়ার সক্ষমতা আসলে কতটুকু?
রাশিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। ‘দ্যা আফ্রিকা রিপোর্ট’এর এক লেখায় অলিভিয়ে মারবো মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকায় রাশিয়া বেশকিছু বন্ধু হারিয়েছে, যার মাঝে রয়েছে সুদান এবং আলজেরিয়া। এই দেশগুলিতে বহুকাল ক্ষমতায় থাকা নেতৃবৃন্দের পতন হয়েছে। একইসাথে কয়েক বছর ধরে আফ্রিকার মাটিতে একটা সামরিক ঘাঁটি বসাবার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করলেও রাশিয়া এখনও সেই প্রচেষ্টায় সফল হতে পারেনি। তদুপরি আফ্রিকার দেশগুলির সামরিক বাহিনীগুলির সাথে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক আফ্রিকার মাটিতে রাশিয়ার স্বার্থকে সমুন্নত রেখেছে।

রাশিয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে রয়েছে আরও বড় প্রশ্ন। ২০১৮ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন আফ্রিকাতে ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চ্যাটহ্যাম হাউজের আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান এলেক্স ভাইন্স বলছেন যে, এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে রাশিয়াকে অনেক চতুর হতে হবে। কম খরচে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করতে হবে তাদের, নতুবা সক্ষমতার বাইরে গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হতে পারে। ‘মেডুজা’ বার্তা সংস্থা বলছে যে, লিবিয়ার সামরিক নেতা খলিফা হাফতারের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে কয়েক ডজন রুশ ভাড়াটে সেনার মৃত্যু হয়েছে। ‘কারটা ডে মোজাম্বিক’ জানাচ্ছে যে, পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাঁচজন রুশ ভাড়াটে সেনার মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবর মাসের শুরুতে মোজাম্বিকে একজন রুশ নাগরিকের মৃত্যুর পর ক্রেমলিন থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, মোজাম্বিকে কোন রুশ সেনা নেই।

রাশিয়ার আফ্রিকাতে টিকে থাকার সক্ষমতা কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। ‘রাশান একাডেমি অব সাইন্সেস’এর ইন্সটিটিউট ফর আফ্রিকান স্টাডিজের ওলগা কুলকোভা রাশিয়ার আফ্রিকায় ফেরত আসাকে রেলগাড়ির শেষ কম্পার্টমেন্টে বসার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলছেন যে, আফ্রিকাতে রাশিয়াকে চেনে পুরোনো সোভিয়েত প্রজন্মের মানুষগুলি। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের সাথে রাশিয়ার সেই সম্পর্ক নেই। পুরোনো প্রজন্মের প্রস্থানের আগেই রাশিয়াকে সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তবে সেই সুযোগ রাশিয়ার জন্যে কখনও না-ও আসতে পারে। ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর আফ্রিকা প্রোগ্রামের ডিরেক্টর জাড ডেভারমন্ট বলছেন যে, পুরোনো সূত্রে রাশিয়া ‘গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতা’য় নেমেছে; কিন্তু এক্ষেত্রে তারা কতটুকু সক্ষমতা রাখে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। রুশরা জাতিসংঘেও আফ্রিকার দেশগুলিকে নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশেষতঃ ইউক্রেনের যুদ্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘে যে কোন আলোচনায় রাশিয়া আফ্রিকাতে বন্ধু খুঁজেছে। তবে এই চেষ্টার উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের রিচার্ড গোওয়ান বলছেন যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আফ্রিকার পক্ষে রাশিয়ার দাঁড়ানোর বিষয়টা রাশিয়ার নিজের ‘স্ট্যাটাস’ ঘোষণা করা এবং পশ্চিমা শক্তিদের ত্যাক্ত করার চাইতে বেশি কিছু বলে মনে হয় না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে পরিবর্তন করার কোন মাস্টার প্ল্যান রাশিয়ার নেই।


No comments:

Post a Comment