Thursday 4 July 2019

ভারত মহাসগরে একা হয়ে যাচ্ছে চীন


চীনের ৮০ শতাংশ জ্বালানি তেলের সরবরাহ ভারত মহসাগর দিয়ে আশা-যাওয়া করে। চীনের ‘বেল্ট-এন্ড-রোড’ পরিকল্পনাকে হুমকি ভেবেই ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং সমমনা অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি ভারত মহাসাগরে তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে।
৪ঠা জুলাই ২০১৯

ভারত মহাসাগরে বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর মহড়া বেড়েই চলেছে। গত ১৭ থেকে ২৫শে মে বঙ্গোপসাগরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নৌ-মহড়া ‘লা পেরৌজি’; যাতে অংশ নেয় ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মোট ৬টা যুদ্ধজাহাজ। মহড়ার বিষয়বস্তুর মাঝে সাবমেরিন-ধ্বংসী এবং বিমান-ধ্বংসী সক্ষমতার পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহড়ার নেতৃত্ব ছিল ফ্রান্সের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘শার্ল দ্য গল’এর কাছে। জাপানের শক্তিশালী ফ্লোটিলার অংশ ছিল হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘ইজুমো’ এবং ডেস্ট্রয়ার ‘মুরাসামে’। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফ্রিগেট ‘টুঊম্বা’ এবং সাবমেরিন ‘কলিন্স’ অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অংশ নেয় ডেস্ট্রয়ার ‘উইলিয়াম পি লরেন্স’। ‘ফ্রি এন্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক’ ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করতেই এই মহড়ার আয়োজন করা হয়েছিল। ‘ফ্রি’ এবং ‘ওপেন’ বলতে যে চীনের প্রভাবমুক্ততাকেই বোঝানো হয়েছে, সেব্যাপারে বিশ্লেষকেরা মোটামুটি একমত। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের কমান্ডার ভাইস এডমিরাল ফিল সইয়ার বলেন যে, এই মহড়ার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তারা ইন্দো-প্যাসিফিকের যেকোন স্থানেই অপারেট করতে সক্ষম। একইসাথে তিনি এ-ও বলেন যে, এর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির চিন্তার একাত্মতা প্রকাশ পায়। এই মহড়া শুরুর আগেই ১৪ই মে ফরাসী নৌবহরের সাথে মার্কিন নৌবাহিনী যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। সেখানে ফরাসী নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ’ শার্ল দ্য গল’এর সাথে ছিল এয়ার-ডিফেন্স ডেস্ট্রয়ার ‘ফোরবিন’, ‘ডুর‍্যান্স’-ক্লাসের জ্বালানি সরবরাহকারী জাহাজ ‘মার্ন’, এন্টি-সাবমেরিন ফ্রিগেট ‘লা-টুশে-ট্রেভিল’ এবং ‘প্রোভেন্স’। এই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাবমেরিন-ধ্বংসী সক্ষমতাগুলিকে ঝালাই করে নেয়া।

এখানেই শেষ নয়। ফরাসীদের এই ফ্লোটিলাই পহেলা মে থেকে ১০ই মে পর্যন্ত আরব সাগরে ভারতের পশ্চিম উপকূলে ভারতীয় নৌবাহিনীর সাথে ‘ভারুনা’ নামে আরেক নৌমহড়ায় অংশ নেয়। উভয় দেশের মোট ১১টা যুদ্ধজাহাজ সেই মহড়ায় অংশ নেয়। এই একই মহড়ার দ্বিতীয় অংশটা অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব আফ্রিকার জিবুতির কাছে একই মাসের ২২ থেকে ২৫ তারিখ। সেখানে ফরাসী নৌবাহিনীর একটা পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের সাথে অংশ নেয় আরেকটা ভারতীয় সাবমেরিন। জিবুতিতে অন্যান্য দেশ ছাড়াও চীনের প্রথম ওভারসিজ নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর ভারতীয় নৌবাহিনী এর বাইরেও এপ্রিলের ১৫ তারিখে ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়ার কাছে মার্কিন নৌবাহিনীর সাথে সাবমেরিন-ধ্বংসী মহড়ায় অংশ নেয়। এখানে মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘স্প্রুয়্যান্স’এর সাথে যোগ দেয় মার্কিন এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর দু’টি অত্যাধুনিক ‘পি-৮’ সাবমেরিন-ধ্বংসী বিমান। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর সাথে ভিশাখাপত্তম-এর কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে ‘অসইনডেক্স-১৯’ নামের আরেক মহড়ায় অংশ নেয় ভারতীয় নৌবাহিনী। ৩রা এপ্রিলে শুরু হওয়া সাবমেরিন-বিধ্বংসী এই মহড়ায় অংশ নেয় অস্ট্রেলিয়ার হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘ক্যানবেরা’, ফ্রিগেট ‘নিউকাসল’ ও ‘পারামাত্তা’ এবং জ্বালানীবাহী জাহাজ ‘সাকসেস’।

২০১৫ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরে নৌমহড়া ‘মালাবার’এর মাঝে যুক্ত হয়েছে জাপান। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সাল থেকে এই মহড়ার আয়োজন করে আসছে। গত বছরের জুনেও এর আয়োজক ছিল ভারত। বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত আয়োজনের পাশাপাশি এক বছর এই মহড়া প্রশান্ত মহাসাগরের ফিলিপাইন সাগরেও হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াকে এই মহড়ায় নেবার জন্যে বিভিন্ন মহলের চাপ থাকলেও ভারত সরকার অস্ট্রেলিয়াকে এই মহড়ার অংশ করেনি। অন্ততঃ লোক দেখানো হলেও এই মহড়া থেকে অস্ট্রেলিয়াকে বাইরে রেখে ভারত বোঝাতে চাইছে যে, তারা চীনকে রাগাতে চায় না। অথচ এটা অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন যে, ‘মালাবার’ মহড়া এখন পুরোপুরিভাবেই চীনকে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। তদুপরি অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের আলাদাভাবে মহড়া তো হচ্ছেই। 

অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর সাথে ভিশাখাপত্তম-এর কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে ‘অসইনডেক্স-১৯’ নামের আরেক মহড়ায় অংশ নেয় ভারতীয় নৌবাহিনী। অন্ততঃ লোক দেখানো হলেও 'মালাবার' মহড়া থেকে অস্ট্রেলিয়াকে বাইরে রেখে ভারত বোঝাতে চাইছে যে, তারা চীনকে রাগাতে চায় না। অথচ এটা অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন যে, ‘মালাবার’ মহড়া এখন পুরোপুরিভাবেই চীনকে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। তদুপরি অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের আলাদাভাবে মহড়া তো হচ্ছেই।


দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হবার পরপরই জুন মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপ এবং শ্রীলংকা সফর করে আসেন। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ-এর সাথে বৈঠক ছাড়াও মোট ৬টা চুক্তি সই করেন মোদি; যার মাঝে ছিল ‘হোয়াইট শিপিং ইনফরমেশন’এর উপর চুক্তি। এর মাধ্যমে মালদ্বীপ সরকার মালদ্বীপের সীমানায় আসা যেকোন জাহাজের সম্পর্কে তথ্য ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে সরবরাহ করবে। উভয় নেতা একত্রে মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স ট্রেনিং সেন্টার এবং উপকূলীয় রাডার সিস্টেম-এর উদ্ভোধন করেন। এই রাডারগুলির মাধ্যমে মালদ্বীপ ও এর আশেপাশের এলাকায় যেকোন জাহাজের উপস্থিতি সম্পর্কে মালদ্বীপ সরকার ওয়াকিবহাল থাকবে এবং এসব তথ্য ভারতীয় নৌবাহিনীকে সরবরাহ করবে। শ্রীলঙ্কা সফরের সময়েও নরেন্দ্র মোদি সামরিক প্রশিক্ষণ সহায়তার চুক্তি সই করেন। শ্রীলংকার নৌবাহিনীর জন্যে যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করছে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে চীন তার স্থান করে নিতে চাইলেও তা তাদের জন্যে মোটেই সহজ ঠেকছে না।

‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক লেখায় ভারতীয় চিন্তাবিদ রাজা মোহন বলেন যে, মালে এবং কলম্বো সফরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রগুলিকে ভারত তার আঞ্চলিক ভূগোলের মাঝে শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে। একেবারে ছোট দ্বীপগুলিও এখন ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ভারত চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আফ্রিকার উপকূল থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করতে। চীনের ৮০ শতাংশ জ্বালানি তেলের সরবরাহ এই পথেই আশা-যাওয়া করে। চীনের ‘বেল্ট-এন্ড-রোড’ পরিকল্পনাকে হুমকি ভেবেই ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং সমমনা অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি ভারত মহাসাগরে তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে।

আফ্রিকার উপকূলেও ভারত তার সামরিক অবস্থান দৃঢ় করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে গত মার্চ মাসে সাইক্লোন ‘ইদাই’ আঘাত হানার পর সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর চারটি জাহাজ সবার আগে সেখানে ত্রানসামগ্রী নিয়ে পৌঁছায়। জুনের প্রথম সপ্তাহে মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট ফিলিপ নাইয়ুসি নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে ভারতের এই সহায়তার জন্যে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাঞ্জানিয়ার সাথে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনদিন। ২০১৭ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ তাঞ্জানিয়ার উপকূলে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের কাজও করে। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলিকে সাথে নিয়ে হয়ে গেল ‘কাটল্যাস এক্সপ্রেস-২০১৯’ নামের নৌ-মহড়া, যাতে নেতৃত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কমান্ড। পূর্ব আফ্রিকার ৯টা দেশের পাশাপাশি এই মহড়ায় অংশ নেয় ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, কানাডা এবং ভারত। ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘ত্রিকান্দ’ জিবুতির কাছে এই মহড়ায় অংশ নেয়। ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ মরিশাসের সাথে ভারতের সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। মরিশাসের কোস্ট গার্ডের জন্যে যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করেছে ভারত। আবার পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে মোজাম্বিক চ্যানেলে সেইশেল দ্বীপের অধীনে থাকা এসাম্পশন দ্বীপেও ভারত নৌঘাঁটি করতে চাইছে। 

ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্রিগেট 'ত্রিকান্দ' তাঞ্জানিয়ার রাজধানী দার-এস-সালাম-এ। ভারত চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আফ্রিকার উপকূল থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করতে। ভারত মহাসাগরের মাঝ দিয়ে যাওয়া চীনের সমুদ্র বাণিজ্য রুটগুলিকে নিজস্ব নৌবহরের মাধ্যমে রক্ষা করার সক্ষমতা থেকে চীনা এখনও বহুদূরে রয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনা যুদ্ধজাহাজের ব্যবহার করতে পারার মতো বন্দর খুব বেশি একটা নেই। মার্কিন বলয়ে থাকা দেশগুলি ভারত মহাসাগর জুড়ে নৌ-মহড়া চালিয়ে চীনকে সেই বার্তাই দিচ্ছে।  


গত বছরের মে মাসে ভারত মহাসাগরের অপর প্রান্তে ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর সাথে সামরিক সহযোগিতার ব্যাপারে একমত হন। সে অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তর প্রান্তে সাবাং-এ একটা নৌঘাঁটি করার প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। এই নৌঘাঁটির মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগরে ঢোকার সময় যেকোন সামরিক জাহাজের উপর নজরদারি করা সম্ভব হবে। মিয়ানমারের সাথেও ভারতীয় নৌবাহিনী গত বছরের মার্চ এবং সেপ্টেম্বরে যৌথ মহড়া করে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার ভারতীয় নৌবাহিনীকে তার নিজস্ব সীমানায় আসা সকল জাহাজের তথ্য সরবরাহ করছে। মিয়ানমারে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজের সফর বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। আরব সাগরেও ওমানের দুকম বন্দর ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীও দুকমে বড় আকারের নৌঘাঁটি তৈরি করছে; যেখানে ‘কুইন এলিজাবেথ-ক্লাস’এর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলি ঢুকতে পারবে।

চীন তার ‘বেল্ট-এন্ড-রোড’ পরিকল্পনার অধীনে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। মিয়ানমার, পাকিস্তান, তাঞ্জানিয়া এবং শ্রীলংকায় সমুদ্রবন্দর উন্নয়নের কাজও করছে চীন। কিন্তু ভারত মহাসাগরের মাঝ দিয়ে যাওয়া চীনের সমুদ্র বাণিজ্য রুটগুলিকে নিজস্ব নৌবহরের মাধ্যমে রক্ষা করার সক্ষমতা থেকে চীনা এখনও বহুদূরে রয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনা যুদ্ধজাহাজের ব্যবহার করতে পারার মতো বন্দর খুব বেশি একটা নেই। মার্কিন বলয়ে থাকা দেশগুলি ভারত মহাসাগর জুড়ে নৌ-মহড়া চালিয়ে চীনকে সেই বার্তাই দিচ্ছে। মিয়ানমার, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা – এই সবগুলি দেশেই চীনের সমুদ্রবন্দরগুলি রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে পরার আশংকা থেকে মুক্ত নয়। পাকিস্তানে বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্যে ভারতীয় সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে মুসলিম-বিরোধী গণহত্যা এবং ফলশ্রুতিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০ লাখ মানুষের শরণার্থী হিসেবে পালিয়ে যাবার পর থেকে রাখাইন অস্থিতিশীল রয়েছে। শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও নতুন করে উগ্রবাদী হামলা হবার পর থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

এমতাবস্থায় চীনের কাছে দু’টা পথ খোলা রয়েছে। প্রথমতঃ নিজেদের সামরিক শক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়া। এবং দ্বিতীয়তঃ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তিশালী বন্ধু খোঁজা, যার কিনা শক্তিশালী নৌবহর থাকবে। ভারত মহাসাগরে যথেষ্ট সংখ্যক সামরিক ঘাঁটি না থাকায় প্রথম অপশনটা চীনের জন্যে বর্তমানে প্রায় অসম্ভব। ভারত মহাসাগর চীনের সমুদ্রবন্দর থেকে যথেষ্ট দূরে থাকায় চীনের কাছে দ্বিতীয় অপশন ছাড়া আর গতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রও ভারত মহাসাগরে এভাবেই চলছে। সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুদ্ধজাহাজ ভাসিয়ে এনে ভারত মহাসাগর পাড়ি দেয়াটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রকে লজিস্টিক সহায়তা না দিলে এটা মার্কিনীদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব ছিল না। আর দ্বিতীয় অপশনটা এখন যুক্তরাষ্ট্রই ব্যবহার করছে; কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এখন একা সারা দুনিয়ার সমদ্রপথ টহল দেয়া সম্ভব নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন তার কাজ অন্যদের মাঝে ভাগ করে দিচ্ছেভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বের বেশিরভাগটাই নিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন এতে সহায়তা দিচ্ছে মাত্র। নৌ-মহড়া ‘লা পেরৌজি’তে ৬টা যুদ্ধজাহাজের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল মাত্র একটা। ‘কাটল্যাস এক্সপ্রেস-২০১৯’এও মার্কিন জাহাজ ছিল মাত্র একটা। আর মহড়ার মাধ্যমে এই সহযোগিতার মূল লক্ষ্যই হলো অত্র অঞ্চলে চীনা প্রভাব বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করা। মার্কিন-ব্রিটিশ-ফরাসী প্রভাব বলয়ে ভারত মহাসাগরে যে নৌশক্তির নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, চীনের হাতে এর ধারেকাছেও কিছু নেই। ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী নৌশক্তি-সম্পন্ন বন্ধু তৈরি নিয়ে চীনকে নতুন করে ভাবতে হবে। অন্ততঃ ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ভারত মহাসাগরে চীন-বিরোধী নৌ-মহড়ার জমজমাট আসর সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন দেশের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে নতুন কোন নৌশক্তির আবির্ভাব ঘটানো দুষ্কর। যদিও উভয় দেশই শুধুমাত্র চীনের প্রভাবে থাকতে চাইছে না; যদিও তারা চীনের বিনিয়োগকে স্বাগত জানাচ্ছে।

6 comments:

  1. এ ধরনের পরিস্থিতিতে সুইডেন ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন যে ভুমিকা রেখেছিল, সে ধরনের ভুমিকা রাখা বাংলাদেশ এর জন্য যুতসই নয় কি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুইডেন জার্মানির পক্ষ নিয়েছিল কোন ঘোষণা দেয়া ছাড়াই। নরওয়ে জার্মানির দখলে চলে যাবার কারণে সুইডেন জার্মানির পক্ষ নিতে বাধ্য হয়। ১৯৪০ সালে ব্রিটেন তাদের রক্ষাকর্তা হবার ক্ষমতা রাখেনি। সারা যুদ্ধে সুইডেন জার্মানিকে লোহা সরবরাহ করেছিল। ১৯৪২ এর পর থেকে বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে গেলে অবশ্য সুইডেনকে পশ্চিম ইউরোপিয় দেশগুলির তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল।

      তবে সুইডেনের বাস্তবতা আর বাংলাদেশের বাস্তবতা এক নয়। সুইডেনের অবস্থান ইউরোপে যতটা দুর্বল বাংলাদেশ ততটাই শক্তিশালী অবস্থানে। ভৌগোলিক দিক থেকে সুইডেনের আটলান্টিক পৌঁছানোটা কঠিন। আর জনসংখ্যার দিক থেকে সুইডেনের পক্ষে ইউরোপে বড় কিছু করা কঠিন। শুধুমাত্র সপ্তদশ শতকে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ ছাড়া সুইডেনের ইউরোপের মূল ভুখন্ডে বড় কিছু করার রেকর্ড নেই। তবে সুইডেনের আবির্ভাবের মাধ্যমে উত্তর জার্মানির হানসিয়াটিক লীগের ক্ষমতার সমাপ্তি হয়েছিল।

      অন্যদিকে ভারত মহাসাগরের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার কারণে বাংলাদেশের 'পাওয়ার প্রজেকশন' করতে পারার সম্ভাবনা অনেক বেশি। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি, উর্বর মাটি এবং বিরাট জনসংখ্যা বাংলাদেশকে শক্তিশালী করেছে। পুরো ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশ খুব কম সংখ্যক শক্তিশালী দেশগুলির একটা।

      কাজেই বাংলাদেশের অবস্থানকে সুইডেন বা অন্য কোন দেশের অবস্থানের সাথে তুলনা করা যেমন যাবে না, তেমনি সেসব দেশের নীতিকেও কপি করা যাবে না।

      Delete
  2. ২য় প্যারাতে আমার প্রশ্নের উত্তর নিহিত। এটা সত্য যে বাংলাদেশের ভৌগলিক ব্যাপার জটিল বটে কিন্তু সম্ভাব্য সিরিইয়া হওয়ার চেয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ভাল নয় কি? তদুপরি বঙ্গপোসাগরে ব্যালান্স এর কথা চিন্তা করলে নিজেদের অর্থনীতি আর সামরিক দিক বিবেচনা উত্তম। মৌসুমী বায়ু, বৃষ্টি, জনসঙ্খ্যা থাকলে তো হবে না, এর উত্তম ব্যবহার না করলে কিভাবে হবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাংলাদেশকে ইরাক বা সিরিয়া বা আফগানিস্তান বানাবার চেষ্টা করা হয়েছে হোলি আর্টিসান ইস্যুকে কেন্দ্র করে। শুধুমাত্র একটা ড্রোন বেইস এখানে বসিয়ে চট্টগ্রামের মাদ্রাসায় কিছু কোল্যাটেরাল ড্যামেজ করলেই সেটা হয়ে যেত। তবে এর আগেই মধ্যপ্রাচ্যে কিছু উদাহরণ সৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে সেটা থামানো গিয়েছে।

      আর বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থানের ব্যাপারে এই ব্লগ-এ বেশ কিছু লেখা আছে; সেগুলি পড়তে পারেন। আর ব্যালান্সের ব্যাপারে নিচের লেখাটা দেখতে পারেন।

      https://koushol.blogspot.com/2017/04/india-bangladesh-china-balance-power.html

      Delete
  3. চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা অন্যান্য দেশগুলির কাছে ইতিমধ্যেই খুইয়ে বসেছে। একান্ত বাধ্য না হলে কেউ চীনের সাথে জড়াতে চাইবে না। চীনের প্রয়োজন আছে আমাদের কাছে, তবে অন্যান্য শক্তিগুলির সাথে ব্যালান্স করার জন্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই লেখায় মূলতঃ ভারত মহাসাগরে চীনের অবস্থানের পিছনে চিন্তাগুলিকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আর কিছু দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে, যা কিনা চীনারা চিন্তা করতে পারে। চীনের মূল সমস্যা হলো তারা এখন আর আদর্শিক রাষ্ট্র নেই; বরং তাদেরকে এখন অথরিট্যারিয়ান ক্যাপিটালিস্ট রাষ্ট্র বলা চলে। এমতাবস্থায় আদর্শিক অবস্থানকে ধরে রাখার কোন প্রশ্ন তাদের সামনে নেই। একারণেই যেকোন বিষয়ে চীনকে ছাড় দিতে দেখা যাচ্ছে; যা কিনা সকলের সামনে চীনের ভাবমূর্তিকে ছোট করছে; এবং একইসাথে তার দুর্বলতাগুলিকে তুলে ধরছে। চীনের কোন আদর্শিক লক্ষ্য না থাকায় যেকোন ম্যাটেরিয়াল লক্ষ্য দিয়ে তাকে ঘায়েল করা যাচ্ছে। চীনের এই বাস্তবতাকে বুঝতে পারলেই এটা বুঝতে পারা যাবে যে, চীনকে অন্য কাউকে দিয়ে ব্যালান্স করাটা খুব কঠিন নয়।

      Delete