Monday, 5 January 2015

লুঙ্গি, গামছা এবং ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ

০৬ ডিসেম্বর ২০১৪

ফিজি-এর অভ্যুত্থানের নেতা জর্জ স্পেইট এবং তার সহযোগী। স্যুটের সাথে ঐতিহ্যবাহী পোষাক পড়াটা দেশের ব্র্যান্ডিং-এর একটা উদাহরণ




জর্জ স্পেইট নামে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ ফিজির এক ব্যক্তি অভ্যুত্থান করে বসেন ২০০০ সালে। বহু দূরের ছোট্ট একটা দ্বীপে প্রায় ১৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না ঠিকই, কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মনে দাগ কেটেছিল তাঁর পোষাক। লোকটা স্যুট-টাই পড়তেন ঠিকই, কিন্তু তারই সাথে প্যান্টের বদলে লুঙ্গির মতো একটা কাপড় পড়তেন, যেটা পুরো গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছতো না। এটা ফিজি-এর ঐতিহ্যবাহী পোষাক; বেশিরভাগ মানুষই পড়ে সেটা। তবে এখানে ব্যাপার হচ্ছে, জর্জ স্পেইট বা তাঁর মতো অন্যান্য মানুষেরা সেটা অফিশিয়াল ড্রেস হিসেবে পড়ছেন; শুধু শখে নয়। অতো দূরে যাওয়ার তো দরকার নেই; এই ব্যাপারটা আমরা আমাদের প্রতিবেশী ভারতেই দেখতে পাই। পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের অনেক রাজনীতিবিদেরাই তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরিধান করে থাকেন। ঐ পোষাকে তাঁরা অফিশিয়াল মিটিং-ও করেন। মার্কেটিং-এর ছাত্র হওয়ায় এবং মার্কেটিং রিসার্চে ক্যারিয়ার করার সুবাদে আমি এই পোষাকের মাঝে মার্কেটিং-এর ভেতরের উচ্চ চিন্তার একটা বিষয়ের গন্ধ পাই, যেটা হলো ব্র্যান্ডিং। 

 "বাংলাদেশ - ল্যান্ড অব স্টোরিস" - বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং-এর জন্যে সুন্দর একটা বিজ্ঞাপণ এটি। কিন্তু ব্র্যান্ডিং-এর জন্যে বিজ্ঞাপণ ছাড়াও আরও কিছু জিনিস লাগবে

শুধু বিজ্ঞাপণে চলবে না!

বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার কতো প্রয়াসই না আমাদের চোখে পড়েছে বিগত বছরগুলিতে, যদিও তার সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এই সাফল্য শুধু ছোটখাটো কিছু ব্র্যান্ডিং চেষ্টায় বেশিদূর এগুবে না। এক্ষেত্রে দরকার দেশের প্রতিটি মানুষের একাত্মতা। ব্যাপারটা বোঝার সবচাইতে সহজ উদাহরণ হলো দশজন মানুষের চিতকার একজন মানুষের চিতকারের চেয়ে বেশি জোরে হবে; তাই দেশের মার্কেটিং করার জন্যে যতো বেশি মানুষ পাওয়া যাবে, ততোই ভালো। তবে এখানে ব্র্যান্ডিং এলিমেন্ট-গুলি অনুধাবন করার বিষয় রয়েছে। যেগুলি জিনিস শুধুমাত্র আমাদের, শুধু সেগুলিই ব্র্যান্ডিং-এর ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে। আবার কিছু জিনিস পুরোপুরি আমাদের একার না হলেও আমাদের বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের সাথে যায়; সেগুলিও গুরুত্ব পাবে। শুধু কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য জেলা আর চা বাগান নিয়ে থাকলেই হবে না; আরও ব্র্যান্ড এলিমেন্ট চাই। তবে আমি আজকের এই আলোচনায় সব ব্র্যান্ড এলিমেন্টের লিস্ট নিয়ে বসবো না; বরং কিছু পথ বাতলে দেবো, যেখানে দৃষ্টি সহজে যায় না। একটা দেশের ব্র্যান্ডিং আরেক দেশে কি করে করা হয়, সেটা বুঝতে হবে। ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ কি শুধু পর্যটনের জন্যে? একটু চিন্তা করে দেখুন তো। এক নিঃশ্বাসে বলতে বললে কোন কোন দেশের নাম প্রথমেই আপনার মনে আসে? পজিটিভ চিন্তা নিয়ে কোন কোন দেশের নাম প্রথমে আসে মনে? এবার মনে করে দেখুন তো, এই দেশগুলির কয়টি দেশের পর্যটন-ভিত্তিক বিজ্ঞাপণ আপনি দেখেছেন? যদি আমার এই লেখাগুলি পড়তে পড়তে এই প্রশ্নগুলি মনে মনে আউড়িয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে দেশের ব্র্যান্ডিং শুধুমাত্র বিজ্ঞাপণ তৈরি করে হবে না। আরও কিছু লাগবে; সেই কথাতেই আসছি। 

http://www.gopixpic.com/1024/levis-jeans-wallpaper/http:||www*bollywoodmantra*com|albums|wallpapers|levis-501-jeans|akshay-kumar___48543*jpg/
বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার লিভাইজ জিন্সের বিজ্ঞাপণে। লিভাইজ জন্ম দিয়েছে এমন একটা সংস্কৃতির, যা একসময় এদেশে ছিল না।


ব্র্যান্ডটা কার, আর প্রডাক্টটাইবা কার?

ব্র্যান্ডিং-এর ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরে আর কাউকে দেখানো দুষ্কর। তারা তাদের দেশের নাম দিয়ে দেশের মার্কেটিং করেনি; করেছে তাদের দেশ থেকে উতপন্ন ব্র্যান্ড দিয়ে। উদাহরণস্বরূপ কোকা-কোলা, হলিউড, ম্যাকডোনাল্ডস, নাইকি, লিভাইজ, প্লেবয়, মাইক্রোসফট, ইন্টেল, এপল, আইবিএম... আরও অনেক আছে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এখানে বেশিরভাগ ব্র্যান্ডই হচ্ছে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড, মানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ব্র্যান্ড নয়। কিন্তু এই ব্র্যান্ডগুলি এতটাই সাফল্য পেয়েছে যে মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় সঙ্গী হয়ে গেছে। এখানে লাইফস্টাইলের কথা যখন বলছি, তখন ব্র্যান্ডের কার্যকলাপকে আরও একটু ভালো করে বিশ্লেষণের ব্যাপার রয়েছে। এখানে প্রতিটি ব্র্যান্ডই কিছু নির্দিষ্ট লাইফস্টাইল মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে, যেগুলি এই ব্র্যান্ডগুলির সংস্পর্শে আসার আগে মানুষ জানতো না। যেমন কোকা-কোলা নিয়ে এসেছে সফট ড্রিংকস; ম্যাকডোনাল্ডস নিয়ে এসেছে ফাস্ট ফুড; লিভাইজ নিয়ে এসেছে জিন্স। এখন আমরা এই লাইফস্টাইলগুলিকে নিয়ে যদি একটু ঘাটাঘাটি করি, তাহলে দেখবো যে এই নতুন লাইফস্টাইলগুলি কিছু পুরোনো লাইফস্টাইলকে সড়িয়ে দিয়ে সেগুলির জায়গা দখল করেছে। যেমন, বিভিন্ন ধরনের পানীয় এবং শরবতের জায়গা দখল করেছে সফট ড্রিঙ্কস-এর বোতল; নাস্তা-জাতীয় বেশকিছু খাবারের জায়গা দখল করেছে ফাস্ট ফুড; আর বেশ অনেক ধরনের পরিধেয় কাপড়ের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে জিন্স। এই সবগুলি লাইফস্টাইল প্রডাক্টই কিন্তু আমেরিকান; কিন্তু এখন দুনিয়ার সকলে নিজের মনে করে নিয়েছে। এই প্রডাক্টগুলির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ব্রান্ডিং করেছে এবং বাকি বিশ্বের সাথে তাদের সংস্কৃতিগত দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করেছে। তারা নিজেরা বাকি দুনিয়ার সকলের সাথে মিশে যাবার চেষ্টা করেনি, বরং এই শক্তিশালী ব্রান্ডিং-এর মাধ্যমে বাকি বিশ্বকেই বাধ্য করেছে তাদের সাথে মিশে যেতে। আর এই প্রসেস যুগ যুগ ধরে চলেছে, তাই বেশিরভাগ মানুষের চোখেই পড়েনি। প্রতিটি দেশের বাজারেই এই প্রডাক্টগুলির অনেক লোকাল ব্রান্ড রয়েছে, তাই অনেকেই মনে করতে পারেন যে একই জিনিস তো আমরাও তৈরি করছি; আমাদেরই তো ব্রান্ডিং হচ্ছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে খোদ প্রডাক্টটাই যে আমেরিকার!

উদাহরণ চাই

যুক্তরাষ্ট্রকে বিষোগদার করার জন্যে আজকে লিখছি না। বরং নিজেদের ব্রান্ডিং-এর ক্ষেত্রে ওদের থেকে কিছু শেখার রয়েছে কিনা, সেটাই আজকের বিষয়। উপরে যে প্রডাক্টগুলির কথা বলেছি, সেখানে কিন্তু উল্লেখ করেছি যে এই প্রডাক্টিগুলি পুরোনো কিছু প্রডাক্টকে বাজার থেকে সড়িয়ে দিয়েছে। এই সড়ে যাওয়া প্রডাক্টগুলি বেশিরভাগক্ষেত্রেই একেকটি দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রডাক্ট, যেগুলি নিজেদের ব্রান্ডিং-এর ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ হতে পারতো। এখন নিশ্চয়ই বোঝাতে পারছি কেনো উপরের লেখাগুলি লিখেছি। পশ্চিমা ধাঁচের কাপড়ের উপরে আমরা এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি যে একসময় দেশের বাইরে থেকে কেউ আসলে তাকে আমরা বোঝাতেই পারবো না যে আমাদের নিজস্ব কোন পরিধেয় কাপড় একসময় ছিল! চিন্তা করে দেখেছি কি যে লুঙ্গি, গামছা, শাড়ী এগুলি এখন শহরের কত শতাংশ মানুষ নিয়মিত পড়ে? কত শতাংশ মানুষ বাড়িতে বা বাইরে পড়ে? আর কত শতাংশ মানুষ অফিশিয়ালি পড়ে? অফিশিয়াল ড্রেস হিসেবে মহিলাদের মাঝে অনেকেই এখনো শাড়ী পড়ে থাকেন। আমাদের রাজনৈতিক নেত্রীরাও শাড়ী পড়েন। কিন্তু কয়জন পুরুষ রাজনীতিককে দেখেছেন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিধান করে অফিসে যেতে? জর্জ স্পেইট এবং তাঁর মতো অনেকেই নিজের দেশের ব্র্যান্ডিং-এর চলমান উদাহরণস্বরূপ। এই উদাহরণ তৈরি করতে যে সাহসটুকু প্রয়োজন, সেটা আমাদের নেতৃবর্গের আছে কি?

ভারতীয় ডিওডোরেন্টের বিজ্ঞাপণগুলি এখন অন্য ধরনের লাইফস্টাইলের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।


আগে ব্র্যান্ড এলিমেন্ট, তারপরে ব্র্যান্ডিং

আমেরিকাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আমাদের এখানে ব্র্যান্ডিং করছে আমাদের বৃহত প্রতিবেশী ভারত। তারা তাদের সংস্কৃতির মার্কেটিং করছে বেশ কিছু প্রডাক্টের মাধ্যমে, যেমন বলিউড, টিভি সিরিয়াল, সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, ক্রীম, হেয়ার অয়েল, ডিওডোর‌্যান্ট, মোবাইল ফোন, ইত্যাদি। এই প্রতিটি প্রডাক্টই কিন্তু আমাদের দেশের লোকাল ব্র্যান্ডগুলির রয়েছে। কিন্তু এখানে পার্থক্য হচ্ছে যে লাইফস্টাইলটা প্রমোট করা হচ্ছে সেটা। আমাদের দেশের ব্র্যান্ডগুলির মেসেজ সেই লাইফস্টাইল থেকে অনেক অনেক দূরে। আর এই প্রডাক্টগুলির বেশিরভাগেরই মার্কেট লীডার হচ্ছে ভারতীয় ব্রান্ড অথবা মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ড, যেগুলির মূল মার্কেটিং মেসেজ ঠিক করা হয় ভারতে। ডাবিং করা এবং অতি ঘন ঘন প্রচার করা এই এডভার্টাইজমেন্টগুলিতে এমন ধরনের লাইফস্টাইল পোমোট করা হয়, যেগুলি আমাদের দেশের ১% মানুষের মাঝেও পাওয়া যাবে না। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। এই প্রডাক্টগুলি সবই কিন্তু লাইফস্টাইল প্রডাক্ট। বেশিরভাগ অত্যাবশ্যকীয় প্রডাক্টে কিন্তু বাংলাদেশী ব্র্যান্ডগুলিই বেশি ভালো করছে। আবার কিছু প্রডাক্ট রয়েছে এশীয় দেশগুলির দখলে যেমন জাপান, চীন, কোরিয়া, মালেশিয়ার মতো দেশের ব্র্যান্ডগুলি। এগুলি কিন্তু এমন ধরনের ব্র্যান্ড, যা খুব সহজে মানুষের মানষিকতায় পরিবর্তন আনতে পারবে না। তার মানে এসব দেশের ব্র্যান্ডগুলির ক্ষেত্র শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষের লাইফস্টাইলে সেগুলির ছাপ কমই। অর্থাৎ আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ড এলিমেন্টগুলির অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি করেছে এই এশিয়ান ব্র্যান্ডগুলি। ব্র্যান্ডিং-এর এই বিষয়গুলি বুঝে উঠতে পারলে তবেই কিন্তু আমরা নিজেদের ব্র্যান্ড এলিমেন্ট নিয়ে মার্কেটিং-এ নামতে পারবো। আগে রক্ষা করতে হবে ব্র্যান্ড এলিমেন্টগুলিকে, তারপরে ব্র্যান্ডিং! বিলুপ্তপ্রায় ব্র্যান্ড এলিমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং এগুবে না। 

 বলার মতো একটা বিজ্ঞাপণ প্রচার করেছে আমানত শাহ লুঙ্গি। দেশের নিজস্ব ব্র্যান্ড এলিমেন্টগুলি টিকিয়ে রাখতে মেধার সমন্বয় ঘটাতে হবে

আশা, নাকি নিরাশা?

আমানত শাহ লুঙ্গির একটা বিজ্ঞাপণের কথা মনে পড়ে গেল। আমি সাধুবাদ জানাই সেই কোম্পানি এবং এডভার্টাইজিং এজেন্সি দুটোকেই। আবার অন্যদিকে ভারতে লুঙ্গি ড্যান্স-এর মতো ফালতু একটা সিনেমার গানের মাধ্যমে আমাদের লুঙ্গি হারাবার একটা শঙ্কাও কিন্তু তৈরি হয়েছে। খেলাধূলার ক্ষেত্রেও অবস্থা ভালো নয়। কাবাডি যে আমাদের জাতীয় খেলা, সেটা কয়জনের মনে আছে? ক্রিকেট আমাদের খেলা নয়, তবু বহু যুগে খেলতে খেলতে নিজেদের খেলা হয়ে গেছে। আর ক্রিকেটে চিয়ার লীডার এবং বেইসবল ক্যাপের গুরুত্ব এখনো খুব বেশি নয়। খেলা ছেড়ে যাই খাবারে। ব্রিটিশরা চা খাওয়ানো শিখিয়েছিল আমাদের। কিন্তু আমেরিকার কফি সংস্কৃতি ব্রিটিশ এই সংস্কৃতিকে ধরলো বলে। চা আমাদের প্রডাক্ট না হলেও আমরা চা উতপাদন করি; আর অন্যদিকে কফি পুরোটাই আমদানি নির্ভর। একসময় দেশের মানুষ সরিষার তেলে রান্না করতো। কিন্তু কিভাবে যে আমেরিকান সয়াবিনের প্রতি বাঙ্গালীর আসক্তি হয়ে গেল। এখন আবার সয়াবিনের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে আমদানী করা পাম তেলকেই আমাদের সয়াবিন বলে খাওয়ানো হচ্ছে। খাওয়া ছেড়ে যানবাহনের ক্ষেত্রে গেলে দেখি যে, বাংলাদেশের একেবারেই নিজস্ব বাহন রিক্সার শেষ দিনগুলিও এখন গুনতে হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় এলিমেন্ট হচ্ছে আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষাকে আমরা এখনো বলার মতো কোন উচ্চতায়ই নিয়ে যেতে পারিনি। বাংলা ভাষায় এখনো আমরা টেকনিক্যাল ফিল্ডের (যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার) জন্যে উচ্চশিক্ষার বই লিখতে পারিনা। অথচ পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই পুরোপুরি নিজেদের ভাষায় পড়াশুনা করা যায়। এমতাবস্থায় হিন্দি এবং ইংরেজীর সাথে বাংলা কতটুকু পেরে উঠবে, সেটা চিন্তার বিষয়ই বৈকি। অথচ এই ভাষার নাম এই দেশের নামেরই অর্ধাংশ! এত কিছুর পরেও আমি আশাবাদী। এদেশের তরুন প্রজন্ম অনেক প্রতিভাবান। তবে তাদেরকে মুক্ত চিন্তা করতে দিতে পারলেই কেবল তারা তাদের প্রতিভাকে দেশের ব্র্যান্ডিং-এর ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবে, নইলে নয়। কাজটা সহজ মনে হলেও, বাস্তবে ভীষণ কঠিন! এত্তো এত্তো ব্র্যান্ডিং মেসেজের মাঝে মুক্ত চিন্তার সুযোগ কোথায়?

কিছুদিন আগে ডক্টর জিল্লুর রহমানের একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম, যেখানে তিনি ইলিশকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং-এর বেশ বড় একটা এলিমেন্ট হিসেবে দেখেছেন। আমি তাঁর সাথে একমত। তবে ইলিশের সাথে আরও একটা বড় ব্র্যান্ডিং এলিমেন্ট আছে, যেটি চোখে পড়ে না। ইলিশ কিন্তু কাঁটা-চামচ দিয়ে খাবার জিনিস নয়; কব্জি ডুবিয়ে খেতে হবে। বাঙ্গালীর ঐতিহ্য কিন্তু কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া; কাঁটা-চামচ দিয়ে খাওয়া নয়। কাজেই যে মানুষটি কব্জি ডুবিয়ে খেতে পছন্দ করেন, এবং বিদেশীদের সাথে মিটিং-এ লুঙ্গি-গামছা-পাঞ্জাবী পড়েন, তার ক্ষেত্রে বিদেশী শক্তিদের ধারণা অন্যরকম থাকবে। তারা ধরেই নেবেন, যে ব্যক্তিকে এত্তো এত্তো ব্রান্ডিং মেসেজ দেবার পরেও তাঁর ঐতিহ্য থেকে সড়াতে পারা যায়নি, তাকে আর যাই হোক খুব সহজে কিনে ফেলা যাবে না!

4 comments:

  1. ভাল লাগল লেখাটা... ব্রান্ডিং এ আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে দু একটা কোম্পানি এগিয়ে আসলেই আমাদের অনেক কিছু পরিবর্তন সম্ভব। মনে আছে কি বাংলা লিংক যখন প্রথম দেশে ব্র্যান্ডিং শুরু করে তাদের, তখনকার কথা? দেশের কিছু সাধারণ জিনিশ তুলে ধরেছিল আর এদিয়ে তারা কি কি যেন পুরস্কার ও জিতে আনে। কিন্তু একটা সময় পর তা বন্ধ করে নাচেগানে ভরপুরের দিকে চলে যায়।

    এবার আসি কাপড় চোপড়ের ব্যপারে। ৯০ এর দশকেও আমরা যারা গ্রামের বিদ্যায়তন থেকে পড়ালেখা করেছি তারা লুঙ্গি পরে শ্রেণী কক্ষে গমন করেছি। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষকের মাঝে একমাত্র নতুন স্যার প্যান্ট পরে বিদ্যায়তনে আসতেন। আর বাকি চারজন লুঙ্গি পরে পাঞ্জাবী গায়ে আসতেন। তাদের কেউ গরীব ছিলেন বলে এভাবে আসতেন না। আমার প্রধান শিক্ষক ছিলেন এলাকার সামন্ত কৃষক। তখনকার দিনের বাজারের দামী লুঙ্গীটাই পরতেন আর এসব পোশাকে কিভাবে স্বদেশী আন্দোলন হয় তাও শোনাতেন। তার একটা কথা আমার প্রায় মনে পড়ে এই পোশাকে আমরা ইংরেজদের তাড়াতে পারলে কেন দেশ গড়তে পারব না?


    আপনি ফিজির কথা বললেন পাশেরদেশ মায়ানমার এর কথা বা ছোট দেশ শ্রীলংকার কথা ভাবুন। তাদের প্রধান মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি কোন অনুষ্ঠানে গেলে তাদের জাতীয় পোশাক পরেই যান। আমাদের তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না...।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ চমতকার একটা কমেন্টের জন্যে!
      চমতকার কিছু উদাহরণ দিয়েছেন আপনি। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আসলে ছিল আমাদের বিলুপ্তপ্রায় সত্তাকে জাগিয়ে তোলা, যে সত্তা ছাড়া নিজেদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা বৃথাই। আমি নিজেই যে জিনিসকে বিসর্জন দিয়েছি, সেটাকে কি করে আমি আমার নিজের বলে বাকি বিশ্বের কাছে তুলে ধরবো?

      গত কয়েক যুগের শিক্ষা আমাদের সমাজকে একটা পর্যায়ে নিয়েছে যেখান থেকে আমরা অনেক কিছুই চিন্তা করতে পারি এবং অনেক কিছুই করতে পারার আশা দেখি। এই অবস্থায় নিজেদেরকে সঠিক পথ দেখাতে না পারলে এই শিক্ষা বিফলে যাবে।

      Delete
    2. বাংলাদেশ সরকারের একটা প্রকল্প ছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নিয়ে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৮ হতে ৯০ সময়কালের দিকে নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার দত্তেরবাগ গ্রামে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। সেখানে মেয়েদের বিভিন্ন বিষয়ে শেখানো হতো। আমি দেখেছি পাটিপাতা দিয়ে সুন্দর ট্রে যা তারা ১০টাকা হতে ২৫ টাকায় বিক্রি করত। বা অন্যান্য জিনিশ। আস্তে আস্তে সেখানে অস্ত নামল সূর্য। বন্ধ হতে হতে বিল্ডিংটী রয়েগেল। ১জন কর্মকর্তা সপ্তাহে একদিন ২ ঘণ্টার জন্য আসেন সেখানে।

      কিছুদিন আগে মার্কিন এক সুপার স্টোর হতে ঠিক সেরকম একটি ট্রে কিনি যার দাম ২৫ মার্কিন ডলার। দেখে আমার সেই কুটির শিল্প সংস্থার কথা মনে পড়ল... এসব তো আমার বা আমাদের ঐতিহ্য...

      আমরাই আমাদের এসব ঐতিহ্য রক্ষা করছি না। নির্ভর করছি অন্যদের জাঁকজমকে ভরা পণ্যের উপর...

      Delete
    3. শিক্ষার অভাবের কারণে দেশে প্রকৃত মেধাবী মানুষ তৈরি হতে সময় লেগেছে। আর মেধাবী মানুষ তৈরি না হলে তো আপনি পলিসি বিষয়ে চিন্তা করার মতো মানুষও পাবেন না, যারা সামনের দিনগুলিকে চিন্তার মধ্যে আনতে পারে। এখানে সমস্যা হলো, আই মেধা-টা তৈরি হতে হতে আমরা অনেক কিছুই হারাতে বসেছি; অনেক কিছু প্রায় হারিয়েও ফেলেছি। এখন নিজেদের চিন্তা করা পালা। কোনটা আমাদের দরকার সেটা অন্য কেউ প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিলে সেটা আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে কোন উপকারে আসবে না। নিজেদেরটা নিজেদেরই বুঝতে হবে।

      Delete