চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে মিডিয়াতে অনেক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, যেখানে কি কি বিষয়ে চুক্তি হতে পারে, তা নিয়ে বিরাট লিস্ট উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর বেশিরভাগই হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। রেলপথ, বিদ্যুত বিতরণ, জ্বালানি পরিবহণ, পানি সরবরাহ, কনটেইনার ডিপো, এক্সপ্রেসওয়ে, মেরিন ড্রাইভ, আইটি অবকাঠামো, মংলা বন্দরের উন্নয়ন, কয়লা খনি উন্নয়ন এই প্রকল্পগুলির মূল। চীন বাংলাদেশের সবচাইতে বড় বিনিয়োগ পার্টনার হতে চলেছে – শুধু এই কারণে নয়, এই সফর ভূরাজনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্টের আগমণের উপরে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানসহ এই এলাকার সব দেশকেই গভীর নজর রাখবে।
বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে কেবল চীনেরই। এমনকি চীনের অর্থনীতির গতি কমার পরেও এটাই বাস্তবতা রয়ে গেছে। চীনারা এশিয়া এবং আফ্রিকাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। সেসব বিনিয়োগের একটি বড় অংশ গেছে অবকাঠামো খাতে। এই খাতে চীনা বিনিয়োগ নতুন কিছু নয়। তবে আমাদের এটা খেয়াল রাখতে হবে যে এই অবকাঠামো তৈরিতে আমাদের এখানেও একসময় স্থবিরতা আসবে। পরবর্তী অবকাঠামো প্রকল্পগুলি গুরুত্ব হারাতে থাকবে। পদ্মা নদীর উপরে প্রথম সেতু অর্থনীতির জন্যে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ হবে, দ্বিতীয় সেতুটি ততটা হবে না। একইভাবে বিভিন্ন রাস্তা এবং রেলপথের ব্যাপারও তা-ই। কাজেই আমাদের এটা চিন্তা করতে হবে যে চীনাদের হাতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ যতদিন থাকবে ততদিন আমরা কি ধরনের বিনিয়োগ তাদের কাছ থেকে আশা করবো। বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থান আফ্রিকার দেশগুলির মতো নয়। কাজেই আফ্রিকার দেশগুলির মতো শুধু অবকাঠামো বিনিয়োগে আমাদের খুশি থাকাটা চিন্তাহীনতার লক্ষণ। শিল্পোন্নয়নের পরিধি বাড়িয়ে দেশকে শক্তিশালী করতে আমাদের সামনের দিনগুলির চাহিদার দিকে দেখতে হবে।
প্রযুক্তি নিয়ে ভাবতে হবে…
ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ পশ্চিমা দেশগুলি থেকে পাওয়া কঠিন। ঠিক একারণেই পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে আমাদের রাশিয়ার কাছে যেতে হয়েছে। আমাদের সামরিক সরঞ্জামের বেশিরভাগই চীন এবং রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের সামরিক সরঞ্জাম তৈরির সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা-ই। চীনের সহযোগিতায় খুলনা শিপইয়ার্ড বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে ৫টি প্যাট্রোল বোট তৈরি করেছে। এখন দুর্জয়-ক্লাসের ৬৪ মিটারের দু’টি গাইডেড-মিসাইল এলপিসি তৈরি করছে তারা। সামনের দিনগুলিতে কর্ভেট এবং ফ্রিগেটও তৈরি করবে এই শিপইয়ার্ড। এগুলির জন্যে চীনাদের সহায়তা ছাড়া গত্যন্তর নেই, কারণ পশ্চিমারা মুসলিম দেশের সামরিক শিল্প তৈরিতে সহায়তা করতে চায় না। তবে সামরিক সরঞ্জাম তো আসলে বড় অর্থে প্রযুক্তির অংশ। এই প্রযুক্তি বেসামরিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক দরকার হচ্ছে আমাদের। কালিয়াকৈরে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফোর টিয়ার ডাটা সেন্টারে চীনারা ১৫৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এখানে এদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকবে। সারা দেশের সরকারী অফিসগুলিকে ফাইবার অপটিক কেবলে যুক্ত করার প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজ ‘ইনফো সরকার-২’ বাস্তবায়নে চীনা সরকার প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। ইনফো সরকার-৩ প্রকল্পের জন্যেও এবার ১৫০ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হচ্ছে। চীন তথ্য প্রযুক্তিতে ব্যাপক উন্নতি করেছে। চীনের তথ্য প্রযুক্তি বাংলাদেশে এনে শিল্প স্থাপনের কোন প্রকল্প নেয়া গেলে এবং সরকারি পরিকল্পনায় এধরণের কিছু থাকলে উতফুল্ল হবার কারণ বাড়তো বৈকি।
টেক্সটাইল, লেদার, ইত্যাদি রপ্তানি পণ্যে বিনিয়োগ ছাড়াও বড় শিল্প স্থাপনে চীনারা সহায়তা দিচ্ছে। পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের অংশ হিসেবে ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল সার কারখানায় চীনারা ৫’শ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পেও চীনের সহযোগিতা আশা করাটা দোষের কিছু হবে না, কারণ এই সেক্টরে পশ্চিমারা বিনিয়োগ-বিমুখ। এই সেক্টরে আমাদের প্রযুক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কৃষিজ যন্ত্রপাতি, যেমন ট্রাক্টর তৈরি করার জন্যে চীনাদের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। বর্তমানে আমরা এই ক্ষেত্রে পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর। বেলারুশ থেকে প্রতিনিধিদল এসেছিল এই সেক্টরে বিনিয়োগ করতে, যা এখন পর্যন্ত কোনদিকেই এগোয়নি। আমরা বর্তমানে এই সেক্টরের বহু যন্ত্রাংশ তৈরি করার সক্ষমতা রাখি। তাই এখন এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আমাদের জন্যে একটি ন্যায্য দাবি। চীনারা এক্ষেত্রে সহায়তা করলে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের জন্যে বিরাট অগ্রগতি হবে। ইলেকট্রনিক্স শিল্পে, বিশেষত বর্তমানে নির্মীয়মান হাই-টেক পার্কগুলিতে চীনা বিনিয়োগ আশা করা যেতে পারে। এরপর রয়েছে বিদ্যুত উতপাদন, যা বর্তমানে সরকারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। বড়পুকুরিয়া কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিটে চীনারা বিনিয়োগ করেছে। পটুয়াখালী, মাতারবাড়ী এবং বাঁশাখালীতে তিনটি বড় কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে চীনারা বিশাল বিনিয়োগ করছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াতে আরেকটি বিদ্যুতকেন্দ্রে চীনাদের বিনিয়োগ চাওয়া হচ্ছে। তবে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি বহুলাংশে বদলে দেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চরিত্র। এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের ব্লু ইকনমি। তাই এক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগের গুরুত্ব অনেক।
কয়লা নিয়ে কথা…
বাংলাদেশে ডিসেম্বর ২০০৬-এ যেখানে ৮৩% বিদ্যুত উতপাদিত হতো গ্যাস থেকে, সেখানে ২০১৪-এর ডিসেম্বরে এসে এটা কমে হয়ছিল ৬০%; আর পিডিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ৫ই অক্টোবর ২০১৬ তারিখে পিক আওয়ারে উতপাদিত ৮ হাজার ৭৪৮ মেগাওয়াটের মাঝে গ্যাস থেকে বিদ্যুত উতপাদিত হয়েছিল ৫ হাজার ৫৬ মেগাওয়াট বা প্রায় ৫৮%। গ্যাস থেকে বিদ্যুত উতপাদন কমতে থাকলেও এটা এখনও বড় অংশ। অপরপক্ষে কয়লা থেকে বিদুত উতপাদিত হয়েছে ২%-এরও কম বা ১৬৬ মেগাওয়াট। সরকার ২০২১ সাল নাগাদ ৭ হাজার মেগাওয়াট বা প্রায় ৩০% বিদ্যুত কয়লা থেকে উতপাদন করার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র এবং কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের অর্থ হলো ৬০% বিদ্যুত উতপাদন করতে জ্বালানি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে না। অন্যদিকে ৩১% বিদ্যুত উতপাদিত হচ্ছে তেল থেকে, যা আমদানি-নির্ভর। এই আমদানি করা হচ্ছে সমুদ্রপথে। গ্যাসের একটি বড় অংশও আসবে আমদানি করা তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজি থেকে। সরকার কয়েকটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। সামনের দিনগুলিতে আমদানি করা কয়লা থেকে বিদ্যুত উতপাদন করতে হলে বছরে দুই থেকে আড়াই কোটি টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্যের ৯০%-এর বেশি সম্পাদিত হচ্ছে সমুদ্রপথে, যার প্রায় ৯৩% হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬ কোটি ৪২ লক্ষ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি চালু হলে সমুদ্রপথ, তথা বঙ্গোপসাগরের উপরে আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়বে বহুগুণে। কয়লা, তেল এবং এলএনজি মিলিয়ে বেশিরভাগ বিদ্যুতই তখন উতপাদিত হবে সমুদ্রপথে আমদানি করা জ্বালানি দ্বারা। কিন্তু আমাদের তো জাহাজই নেই। (বাণিজ্যিক জাহাজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এর আগেও লিখেছি।) আর আমরা এ-ও আশা করতে পারি না যে আমাদের দেশের কলকারখানাগুলি চালু রাখতে আমাদের সমুদ্রপথের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা অন্য কেউ দেবে। তাই বঙ্গোপসাগরের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইনের নিরাপত্তা দেয়াটা তখন জাতীয় নিরাপত্তায় আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। আগামী কয়েক বছরের মাঝেই সমুদ্র নিরাপত্তার এই বিষয়টি আমাদেরকে বঙ্গোপসাগরসহ পুরো ভারত মহাসাগর নিয়েই ভাবাবে।
সমুদ্রপথের নিরাপত্তা…
প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের পরিবহণ ক্ষমতা বাড়াবার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের পর এই প্রথম ১৮৪ মিলিয়ন ডলার ঋণে চীন থেকে প্রতিটি ৩৯ হাজার টন ধারণক্ষমতার ৬টি জাহাজ কেনা হচ্ছে। তবে দুই কোটি টন কয়লা পরিবহণের জন্যে এটি তেমন কিছু নয়। এক’শ মিলিয়ন ডলারে প্রতিটি ১ লক্ষ টন ধারনক্ষমতার দু’টি অপরিশোধিত তেলবাহী মাদার ট্যাংকারও কেনা হচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হচ্ছে, যেটি এর সক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে নিয়ে যাবে; বহুগুণে বাড়বে তেল পরিবহণের গুরুত্ব। পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের বৃদ্ধির সাথে সাথে তেলের জাহাজ আরও লাগবে আমাদের। আরও বহু জাহাজ আমাদের সংগ্রহ করতে হবে, যেখানে বড় জাহাজ ক্রয়ে (যা পানির গভীরতা বা অন্য টেকনিক্যাল কারণে আমাদের দেশে তৈরি করা কঠিন) চীনাদের সহায়তা দরকার হতে পারে। বর্তমান সরকার ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়ন করতে দেশের সমুদ্র-নিরাপত্তার উপরে গুরুত্ব দিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডকে শক্তিশালী করা হচ্ছে, যা চীনাদের সহায়তা ছাড়া করাটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। নৌবাহিনীর জন্যে প্রায় দু’শ মিলিয়ন ডলারে কেনা হচ্ছে দু’টি সাবমেরিন, যা এই বছরের কোন এক সময়েই আসার কথা রয়েছে। দু’টি কর্ভেট তৈরির পর আরও দু’টি কর্ভেট এখন চীনে নির্মীয়মান। চীনা সহায়তায় আমাদের যুদ্ধজাহাজ তৈরির সক্ষমতা বাড়ছে।
সমুদ্রপথ যত গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকবে, নৌবাহিনীর গুরুত্বও ততো বাড়তে থাকবে। আমরা নিজেদের দেশে নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি করতে পারলে খরচ অনেক কম পড়বে। আর এক্ষেত্রে চীনারা হতে পারে প্রযুক্তি পার্টনার। খুলনা শিপইয়ার্ডে বর্তমানে নির্মীয়মান দুর্জয়-ক্লাসের জাহাজই আমাদের শেষ চেষ্টা হওয়া উচিত নয়। কর্ভেট এবং ফ্রিগেট তৈরির দিকে দ্রুত যেতে হবে আমাদের। কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের এগুতে হবে। একটা পুরোপুরি শেষ হবে; এরপর আরেকটা শুরু করবো – এই থিউরিতে দুনিয়া কোনদিনও চলেনি; একটি কাজ আরেকটির জন্যে থেকে থাকতে পারে না। বিশেষতঃ সেটা যখন জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হয়। কাজেই নৌবাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা বৃদ্ধি একই সাথে হতে হবে। খুলনা শিপইয়ার্ড এবং চট্টগ্রাম ড্রাইডকের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা চীনাদের সহায়তা চাইতে পারি। চট্টগ্রাম ড্রাইডককে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার সরকারি সিদ্ধান্ত এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
সমুদ্রবন্দর এবং উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা
এর আগেও লিখেছি যে সমুদ্রবন্দরগুলির কারণে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা আমাদের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তায় বিমান প্রতিরক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামোগুলির নিরাপত্তা প্রদান করা আমাদের জন্যে ফরয কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যমুনা এবং পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার জন্যে যেমনি সেনাবাহিনী ইউনিট তৈরি করেছে, ঠিক তেমনি উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যেও বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক জরুরি। কক্সবাজার এবং বরিশাল বিমানবন্দরের উন্নয়নের সাথে সাথে এখানে বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি, যাতে বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলির উপরে বিমান প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। যারা এখন মনে করছেন যে আমাদের আবার বিমান প্রতিরক্ষা কেন লাগবে, তাদের জন্যে প্রশ্ন – যদি ভারত তার সমুদ্র এবং বিমান প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজের দেশে মার্কিন ঘাঁটির অনুমতি দিতে পারে, তাহলে কোন যুক্তিতে তারা বাংলাদেশের বিমান প্রতিরক্ষা নিয়ে চিন্তিত নন? তারা এই দেশের নিরাপত্তা কি অন্য কোন দেশের হাতে দেখতে আগ্রহী? অন্য দেশের উপরে নির্ভরশীলতাই কি তারা চাননি সবসময়? পদ্মা সেতু দেশের নিজস্ব অর্থে তৈরি করাতে তাদের পরনির্ভরশীল এজেন্টের চেহারাটাই তখন প্রকাশ পেয়েছিল। যাই হোক, দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপত্তা যে সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে, তা সরকারের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কথাতেই প্রতীয়মান। বিমানবন্দরের উন্নয়নের সাথে সাথে এখানে শক্তিশালী রাডার নেটওয়ার্ক বসানো গুরুত্বপূর্ণ। চীন এবং রাশিয়ার রাডার এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে যেহেতু আমাদের সমুদ্রবন্দরের কর্মকান্ডের বড় অংশ সমুদ্রের মাঝখানে (বহিঃনোঙ্গরে) হয়, তাই সমুদ্রের বিমান প্রতিরক্ষা দিতে নৌবাহিনীর জাহাজের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। গভীর সমুদ্রের সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে সমুদ্র প্রতিরক্ষার গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। সরকার যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার লাইসেন্স দিচ্ছে, তখন এই ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপত্তাহীনভাবে আমারা আমাদের নাগরিকদের সমুদ্রে পাঠাতে পারি না। এয়ার ডিফেন্স ফ্রিগেট এক্ষেত্রে ভালো সমাধান হতে পারে। চীনের কাছে এই ব্যাপারে সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। শিপইয়ার্ডের ডেভেলপমেন্টের সাথে যুক্ত করে লাইসেন্স প্রডাকশনের মাধ্যমে টেকনলজি-ট্রান্সফার করতে পারলে এই পদক্ষেপ খুবই ফলপ্রসু হবে। জাহাজের নিরাপত্তার পূর্ণ হবে না যদি হেলিকপ্টার যোগ না করা হয়। আমাদের নৌবাহিনীতে হেলিকপ্টারের সংযোজন একটি বড় ঘটনা ছিল। কিন্তু এখন আমাদের সেই আবেগঘন মুহূর্ত থেকে বের হয়ে সামনের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের আরও হেলিকপ্টার দরকার, যা কিনা সমুদ্রে সার্ভেইল্যান্স ছাড়াও এন্টি-সাবমেরিনের কাজ করবে। বঙ্গোপসাগরে বিদেশী সাবমেরিনের গোপন আনাগোনা শোনা যায় বহুদিন ধরে। সমুদ্রে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আহরণ করতে শুরু করার পরে আমাদের স্থাপনার আশেপাশে দিয়ে বিদেশী সাবমেরিনের এধরনের গোয়েন্দা কার্যকলাপ আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই হেলিকপ্টার নিশ্চিত দরকার। চীনারা আমাদের এই চাহিদা পূরণে সহায়তা করতে পারে, যদিও আমাদের অন্য দেশ থেকেও হেলিকপ্টার সংগ্রহের চেষ্টা করে যেতে হবে।
চীনারা ড্রোন প্রযুক্তিতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে। আমাদের সমুদ্রসীমায় দীর্ঘ সময় ধরে সার্ভেইল্যান্স চালানোর ক্ষেত্রে চীনাদের দূরপাল্লার ড্রোন খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। |
বিমান শক্তিকে প্রাধান্য দেয়া…
তবে শুধুমাত্র গ্রাউন্ড বা সী-বেজড এয়ার ডিফেন্স যথেষ্ট হবে না যদি না বিমান শক্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। বঙ্গোপসাগরের উপরে এয়ার সার্ভেইল্যান্স বাড়াতে আরও সার্ভেইল্যান্স বিমান দরকার। একইসাথে দূরপাল্লার ড্রোনের দিকে আমরা যেতে পারি। ড্রোন বহু ঘন্টা আকাশে থাকতে পারে; তাই সার্ভেইল্যান্সে এর গুরুত্ব অপরিসীম। সার্ভেইল্যান্স বিমান এবং ড্রোনের ক্ষেত্রেও আমরা চীনের কাছে সহায়তা পেতে পারি। তবে শক্তিশালী কোন অবস্থান না নিতে পারলে সার্ভেইল্যান্সের গুরুত্ব নেই। এক্ষেত্রে শক্তিশালী ফাইটার স্কোয়াড্রনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের এফ-৭ বিমানের পক্ষে এই কাজটা বেশ কঠিন। মাত্র ৮টি মিগ-২৯ বিমানের পক্ষেও সারা দেশের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ কঠিন। যেহেতু অত্যাধুনিক ফাইটার বিমানের ক্ষেত্রে খরচের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে, তাই চীনারা এক্ষেত্রে সবচাইতে ভালো সমাধান দিতে পারে। কম খরচের ট্যাকটিক্যাল ফাইটার আমরা এমন একটি সংখ্যায় কিনতে পারবো, যা কিনা ৪.৫ বা ৫ম জেনারেশনের এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটারের ক্ষেত্রে কঠিন, যদিও সেটা আমাদের শেষ পর্যন্ত লাগবেই। যাই হোক, চীনাদের আধুনিক ট্যাকটিক্যাল ফাইটারের বহর থেকে আমরা যা পাবো, তা অন্য কোন দেশ থেকে পাবার আশা করাটা কঠিন। উপকূলী অঞ্চলের উপরে এয়ার ডিফেন্স নিশ্চিত করতে দুই থেকে তিনটি স্কোয়াড্রন ফাইটার-ইন্টারসেপ্টর বিমান জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের ব্লু ইকনমিতে চীনের অংশগ্রহণকে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখবে না। কিন্তু আমাদের সামনে পথ খোলা আছে খুব কমই। চীন আমাদের এমন কিছু ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারছে, যেগুলি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। রেল-রাস্তা, সেতু, টানেল, ফ্লাইওভারের মতো প্রকল্পগুলি মানুষ সরাসরি অনুভব করে, কারণ তারা সেগুলির সুফল কোন হিসেব কষা ছাড়াই দেখতে পায়। কিন্তু রাষ্ট্রের জন্যে অপেক্ষাকৃত কম দৃশ্যমাণ প্রকল্পগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব বহণ করে – সেগুলি সাধারণ জনগণ বুঝুক আর না বুঝুক। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করেই রাষ্ট্র প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃশ্য-অদৃশ্য সমস্যা মোকাবিলা করে। বঙ্গোপসাগরে শক্তিধর দেশগুলির প্রতিযোগিতা থাকবেই; যা কিনা সেসব সমস্যার জন্ম দেবে; আবার সমস্যার সমাধানও দেবে। চীনারা আমাদের জন্যে কি সমস্যা বয়ে আনবে, নাকি সুযোগ তৈরি করবে – সেটা বাইরের কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমাদের শুনতে হবে না। আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দেবো, নাকি দেশের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেবো।
Good one to read and to know more rather getting information from social media.
ReplyDeleteSome people had been so naive... While the Chinese President was visiting BD, some had been celebrating International Egg Day.... Its beyond stupidity, actually....
Delete