মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি - তিন দশকে সর্বোচ্চ
‘রয়টার্স'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানে দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক অবস্থানের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেপ্টেম্বর নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ পুয়ের্তো রিকো দ্বীপে ২০০৪ সালে বন্ধ করে দেয়া রুজভেল্ট রোডস ঘাঁটিকে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়েছে। এছাড়াও পুয়ের্তো রিকো এবং ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডসের বেসামরিক বিমানবন্দরগুলিতেও নতুন করে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে। গত অগাস্ট মাস থেকে ক্যারিবিয়ানে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, ফাইটার বিমান এবং গোয়েন্দা বিমান মোতায়েন শুরু হয়েছে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'জেরাল্ড ফোর্ড' বর্তমানে ক্যারিবিয়ানের পথে রয়েছে। এছাড়াও ইতোমধ্যেই অত্র এলাকায় মোতায়েন করা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধজাহাজগুলির মাঝে রয়েছে উভচর এসল্ট শিপ 'আইও জিমা', স্পেশাল ফোর্সের মিশনের জাহাজ 'ওশান ট্রেডার', ক্রুজার 'লেক এরি', ডেস্ট্রয়ার 'গ্রেভলি', ‘স্টকডেল', 'জেসন ডানহ্যাম' এবং উভচর ডক ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম 'স্যান এন্টোনিও'। এর বাইরেও পুয়ের্তো রিকোতে বিমান বাহিনীর ১০টা 'এফ-৩৫' স্টেলথ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছে।
অক্টোবরে মার্কিন বিমান বাহিনীর 'বি-১' এবং 'বি-৫২' বোমারু বিমান ভেনিজুয়েলার উপকূল ঘেঁষে উড়ে যায়। 'রয়টার্স'এর ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায় যে, ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডসের সেইন্ট ক্রোয়া-তে 'হেনরি ই রোহলসেন' বিমানবন্দরে দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা রাডার স্থাপন করেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। পুয়ের্তো রিকোর রাফায়েল হেরনানডেজ বেসামরিক বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর 'এমকিউ-৯ রীপার' ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অত্র অঞ্চলে মার্কিন 'সি-১৭' সামরিক পরিবহণ বিমান এবং 'পি-৮' গোয়েন্দা বিমানের ফ্লাইটও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' বা 'সিএসআইএস'এর সিনিয়র ফেলো ক্রিস্টোফার হেরনানডেজ-রয়-এর মতে, এগুলি সবই করা হচ্ছে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং তার সমর্থিত জেনারেলদেরকে ভয় দেখাবার জন্যে। প্রাক্তন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা মার্ক ক্যানসিয়ানের মতে, এই সামরিক স্থাপনাগুলি স্বল্পমেয়াদী হতে পারে; আবার লম্বা সময়ের জন্যে অত্র অঞ্চলে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অপারেশনেও ব্যবহৃত হতে পারে। ১৯৯৪ সালে হাইতিতে সামরিক অপারেশনের পর থেকে ক্যারিবিয়ানে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় সামরিক কর্মকান্ড। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে কমপক্ষে ১৪টা হামলায় যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত মাদক ব্যাবসায়ীদের ৬১ জনকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকান্ডগুলিকে কেন্দ্র করে ভেনিজুয়েলা এবং কলম্বিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-কলম্বিয়া সম্পর্কের অবনতি
সকলেই শুধু ভেনিজুয়েলা নিয়ে কথা বললেও যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা শুধু ভেনিজুয়েলাই নয়। অত্র অঞ্চলের বেশকিছু নেতৃত্বের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি সংঘর্ষে নেমেছেন। কলম্বিয়ার বামপন্থী লিবারাল প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো 'বিবিসি'র সাথে সাক্ষাতে হামলাগুলিকে জুলুম বলে আখ্যা দেন এবং এই হত্যাকান্ডের জন্যে দায়ী মার্কিন কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেন। এর জবাবে ট্রাম্প কলম্বিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ ঘোষণা করেন এবং হুমকি দেন যে, পেত্রো যদি নিজে কলম্বিয়ার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সেটা করবে এবং সেটা সুখকর ভাবে করা হবে না। কলম্বিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, ট্রাম্পের কথাগুলি মূলতঃ কলম্বিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের বেআইনী হস্তক্ষেপের হুমকি। বহু দশক ধরে কলম্বিয়ায় মার্কিন সহায়তায় বামপন্থীদের গ্রুপগুলি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছে। তবে ২০১৬ সালে বিদ্রোহীদের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে কলম্বিয়াতে মার্কিন সামরিক এবং আর্থিক সহায়তা কমতে থাকে; সেইসাথে কমতে থাকে রাজনৈতিক প্রভাবও। ট্রাম্প ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই শেষ মুহুর্তে কোনক্রমে কলম্বিয়ার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তবে জুন মাসে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটাতে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিগেল উরিবে তুরবে হত্যাকান্ডের শিকার হবার পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও সেই ঘটনার সাথে কলম্বিয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। উভয় দেশের রাষ্ট্রদূতদেরকে নিজ দেশে ডেকে পাঠানো হয়। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভার পর প্রেসিডেন্ট পেত্রো ফিলিস্তিনের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার পর মার্কিন সরকার প্রেসিডেন্ট পেত্রোর ভিসা বাতিল করে। 'বিবিসি' বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, কলম্বিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
কিউবার সাথে ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়ার বন্ধুত্ব
মার্কিন মিডিয়া এবং প্রাইভেট সেক্টরের অর্থায়নে তৈরি 'প্রজেক্ট সিন্ডিকেট'এর ২০২৪এর অক্টোবরের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ২০০২ সালে ভেনিজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর থেকে কিউবা ভেনিজুয়েলাতে হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স, খেলাধূলা প্রশিক্ষক, নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট পাঠিয়েছে। কিউবার এই সমর্থনই ভেনিজুয়েলার বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারার মূল কারণ। নিকারাগুয়া থেকে পরিচালিত মিডিয়া 'হাভানা টাইমস'এর ২০২৪এর অগাস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত ১৫ বছর ধরে কিউবা ভেনিজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনী এবং ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসকে নতুন করে তৈরি করতে সহায়তা দিয়েছে। 'রয়টার্স'এর ২০১৯ সালের এক তদন্তের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০০৮ সালে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত চুক্তির বলে তৈরি 'জেনারেল ডিরেক্টরেট অব মিলিটারি কাউন্টারইন্টেলিজেন্স' বা 'ডিজিসিআইএম' নামের এক সংস্থার মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উপর ব্যাপক নজরদারি শুরু হয়। একইসাথে কিউবা ভেনিজুয়েলার সামরিক সদস্যদেরকে ট্রেনিং দেয়, বাহিনীর কাঠামোতে পরিবর্তন আনে, হাভানাতে ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্স সদস্যদেরকে ট্রেনিং দেয়, এবং ইন্টেলিজেন্সের মূল কাজকে অন্য দেশের উপর গোয়ান্দাগিরি থেকে সরিয়ে নিজ দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উপর কেন্দ্রীভূত করে। ভেনিজুয়েলা থেকে পালিয়ে আসা প্রাক্তন জেনারেল এন্টোনিও রিভেরো বলেন যে, ২০০৮ সালে দুই দেশের মাঝে ১৫টা গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনীকে কিউবার বাহিনীর ধাঁচে গড়ে তোলা হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে ভেনিজুয়েলার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উঠে এসেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও গত ফেব্রুয়ারিতে কোস্টারিকা ভ্রমণে গিয়ে বলেন যে, কিউবা, ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়ার সরকার হলো মানবতার শত্রু। তিনি আরও বলেন যে, এই তিন দেশের কারণে পশ্চিম গোলার্ধে শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে; কারণ এই দেশগুলির ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করছে না। কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ-কানেল রুবিওর এই মন্তব্যকে নির্লজ্জ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন যে, কিউবার উপর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণেই কিউবানরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। মার্কিন রাজনীতিবিদদের নব্য ফ্যাসিস্ট চিন্তার কারণে মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে। অর্ধেক দুনিয়াতে অরাজকতা এবং দৈন্যতার জন্যে মার্কিন যুদ্ধবাজরাই দায়ী। আর ভেনিজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল বলেন যে, রুবিও এই তিন দেশ নিয়ে করুণ এবং অসুস্থ্য চিন্তার মাঝে রয়েছেন।
কিউবা যে সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে, তার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় গত ফেব্রুয়ারিতে; যখন নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারের সেনাপ্রধান জেনারেল জুলিও আভিলেসের অভিষেক অনুষ্ঠানে কিউবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আলভারো লোপেজ মিয়েরা উপস্থিত ছিলেন বলে বলছে 'কিউবান নিউজ এজেন্সি'। ১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়াতে বামপন্থী স্যান্ডানিস্টা সরকারের উত্থানের সময় থেকে কিউবার সাথে নিকারাগুয়ার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। ক্যারিবিয়ানে চলমান উত্তেজনার মাঝেই ৮ই অক্টোবর নিকারাগুয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল আভিলেস কিউবার রাজধানী হাভানা ভ্রমণ করেন।
রাশিয়ার ভূমিকা এবং কিউবার কৌশলগত গুরুত্ব
তবে ভেনিজুয়েলা এবং কিউবার সামরিক সহযোগিতার খবরগুলি নতুন নয়। কাজেই হঠাত করেই বা কেন যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকবে, তা অন্ততঃ এই দুই দেশের নিরাপত্তা চুক্তির মাঝে পাওয়া যায় না। মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান 'জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স'এর এক লেখায় তার ধারণা প্রকাশ করছেন যে, ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধির পেছনে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের 'টোমাহক' ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের হুমকির সম্পর্ক থাকতে পারে। হয়তো রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সেই হুমকি মোকাবিলায় কিউবার সাথে সামরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে এবং ল্যাটিন আমেরিকার ড্রাগ ব্যাবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক পুনর্নিমাণ করেছে। অক্টোবরের শুরুতেই রুশ পার্লামেন্টে কিউবার সাথে গত মার্চে স্বাক্ষরিত সামরিক চুক্তিকে অনুমোদন দেয়া হয়। এই চুক্তি মোতাবেক দুই দেশের মাঝে যৌথ সামরিক মহড়া, অস্ত্র সরবরাহ সহ কিউবাতে রুশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে এটা মোটেই সুখকর খবর নয়। কিউবা ক্যারিবিয়ান সাগরে এমন অবস্থানে রয়েছে, যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে মেক্সিকো উপসাগরের উপকূলে সমুদ্রবন্দরগুলির সমুদ্র বাণিজ্যকে হুমকির মাঝে ফেলে দেয়া সম্ভব। কিউবা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপদ্বীপের মাঝে সমুদ্রপথ মাত্র ১৪৫কিঃমিঃ চওড়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক বাণিজ্য হয় এই বন্দরগুলির মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাতে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। আর পুরো ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ল্যাটিন আমেরিকাতে মাদক ব্যবসায়ীদেরকে এবং বামপন্থী বিদ্রোহী গ্রুপ এবং সরকারগুলিকে সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্স সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারগুলিকে সমস্যায় ফেলার জন্যে। আর এই পুরো অপারেশনের কেন্দ্র ছিল কিউবা। ফ্রীডম্যানের কথাগুলি সপ্তাখানেক পরেই মস্কোতেও প্রতিফলিত হয়। ২৯শে অক্টোবর রুশ পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির ডেপুটি চেয়ারপার্সন আলেক্সেই ঝুরাভলিয়ভ বলেন যে, রাশিয়া ভেনিজুয়েলা বা কিউবাতে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারে; যা কিনা রাশিয়ার প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগী যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছে অবস্থিত। রাশিয়ার কাছে বহু ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে; যেগুলি প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার করা যেতে পারে। মার্কিন সামরিক থিঙ্কট্যাঙ্ক 'ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার' বা 'আইএসডব্লিউ' বলছে যে, ঝুরাভলিয়ভের এই হুমকি ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
'ডিফেন্স নিউজ'এর খবরে বলা হচ্ছে যে, একটা রুশ 'ইলিউশিন-৭৬' পরিবহণ বিমান ২৬শে অক্টোবর ভেনিজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে অবতরণ করে। এর দু'দিন পর বিমানটা কিউবার রাজধানী হাভানাতে যায়; সেখান থেকে নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়াতে গিয়ে ২৯শে অক্টোবর নাগাদ আবারও কারাকাসে ফেরত আসে। পরদিন বিমানটা রাশিয়ার উদ্দেশ্যে কারাকাস ছেড়ে যায়। বিমানটা রুশ সরকারের না হলেও তা সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখা বিমান সংস্থা 'এভিয়াকন জিটোট্রান্স'এর। যাবার পথে তা আফ্রিকার মৌরিতানিয়ার নুয়াকছোট এবং আলজেরিয়ার আলজিয়ার্সে অবতরণ করে। 'ডিফেন্স নিউজ' বলছে যে, বারবার অবতরণ করার একটা কারণ হতে পারে যে, বিমানটা অতিরিক্ত ভার বহণ করছিলো। অথবা রাশিয়ার উপর অবরোধের কারণে উদ্ভূত সমস্যাকে বাইপাস করার জন্যে বিমানটা কোথা থেকে এসেছে, সেটা ঘোলাটে করার কৌশল হতে পারে। যদিও বিমানটার মিশন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, তথাপি যেহেতু বিমানটার মালিক সংস্থার উপর যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সরঞ্জাম পরিবহণ করার কারণে অবরোধ আরোপ করেছে, তাই এর উদ্দেশ্য ধোঁয়াশার মাঝেই থাকবে।
কিউবাতে রাশিয়ার উপস্থিতি ছাড়াও চীনের উপস্থিতি নিয়েও কথা শুরু হয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সিএসআইএস' ২০২৪এর ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে; যেখানে বলা হয় যে, এতকাল নির্দিষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও এখন প্রায় নিশ্চিত যে, কিউবার কমপক্ষে চার স্থানে চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের উপর নজরদারি করার জন্যে গোয়ান্দা স্থাপনা বসিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক চাপে পড়ার কারণে কিউবা চীনের আরও কাছে গিয়েছে।
কিউবা-মেক্সিকো বন্ধুত্ব
কিউবা যে পুরো ক্যারিবিয়ান এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল, তা নিশ্চিত। ‘মেক্সিকানস এগেইনস্ট করাপশন এন্ড ইমপিউনিটি' নামক থিঙ্কট্যাঙ্কের বরাত দিয়ে 'মায়ামি হেরাল্ড' বলছে যে, মেক্সিকোর বর্তমান বামপন্থী লিবারাল প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শাইনবাউম ক্ষমতায় আসার পর থেকে মেক্সিকো কিউবাতে জ্বালানি তেলের সরবরাহ তিন গুণ করেছে। গত মে মাস থেকে অগাস্টের মাঝে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের তেল ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করেছে মেক্সিকো। আগের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল ওব্রাদরের সরকার দুই বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের তেল সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, প্রেসিডেন্ট শাইনবাউম কিউবাকে রাজনৈতিকভাবেও জোরালো সমর্থন দিচ্ছেন। ১৩ই অক্টোবর তিনি ঘোষণা দেন যে, ডিসেম্বরে ডোমিনিকাতে অনুষ্ঠেয় আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলির শীর্ষ সন্মেলন তিনি বয়কট করেছেন; কারণ সেই সন্মেলন থেকে কিউবা, ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়াকে বাদ দেয়া হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও লস এঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত সন্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দনীয় রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে আমন্ত্রণ জানাননি।
ট্রাম্প প্রশাসনের উপ-পররাষ্ট্র সচিব ক্রিস্টোফার ল্যানডাউ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কিউবাকে সমর্থন দেয়ার জন্যে মেক্সিকোর ব্যাপক সমালোচনা করেন। স্প্যানিশ ভাষার পত্রিকা 'এল পাইস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর জাতিসংঘে ভোটাভুটি হয়ে চলেছে কিউবার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ উঠিয়ে দেয়ার জন্যে। মেক্সিকো এই প্রস্তাবে প্রতি বছর কিউবাকে সমর্থন দিয়ে গেছে। এবছরও মেক্সিকো কিউবাকে সমর্থন করায় ল্যানডাউ বলেন যে, মেক্সিকোর বন্ধু হিসেবে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। কিউবার প্রতি মেক্সিকোর সমর্থন বিভিন্ন সরকারের আমলে অটুট থেকেছে। প্রেসিডেন্ট শাইনবাউমের আগে তার দলেরই প্রেসিডেন্ট ওব্রাদর কিউবাকে তেল সরবরাহের বিনিময়ে কিউবা থেকে ডাক্তার পেয়েছেন। করোনা মহামারির সময় মেক্সিকোকে ডাক্তার দিয়ে সহায়তার করার জন্যে ওব্রাদর ২০২৩ সালে কিউবার নেতা মিগেল দিয়াজ-কানেলকে মেক্সিকোর সর্বোচ্চ পুরষ্কার 'অর্ডার অব দ্যা আজটেক ঈগল'এ ভূষিত করেছিলেন। ওব্রাদরের আগে 'পিআরআই' পার্টির প্রেসিডেন্ট পেনা নিয়েতোর সময় মেক্সিকো কিউবার বড় অংকের ঋণ মওকুফ করে দেয়। 'ইবেরো আমেরিকান ইউনিভার্সিটি'র বিশ্লেষক পিয়া তারাসেনা 'এল পাইস'কে বলছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধকে মোকাবিলার সময় মেক্সিকো কিউবা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে অত্র অঞ্চলে মেক্সিকোর অবস্থানও শক্তিশালী হয়েছে। জাতিসংঘে মেক্সিকোর দূত হেক্টর ভাসকনচেলস যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ঠান্ডা যুদ্ধের চিন্তাধারা পরিত্যাগ করতে পারেনি। কিউবার উপর অবরোধ বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত বেশিরভাগ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আবেলারডো রডরিগেজ 'এল পাইস'কে বলছেন যে, ট্রাম্প প্রশাসন এখন তাদের অপছন্দের কথা বলা কাউকেই সহ্য করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে 'মনরো ডকট্রাইন'কে কাজে লাগিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে হারিয়ে যাওয়া প্রভাবকে পুনরূদ্ধার করতে চাইছে। 'জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স'এর লেখায় জর্জ ফ্রীডম্যানও 'মনরো ডকট্রাইন'কে মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এবং সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হিসেবেই উল্লেখ করেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাকি বিশ্বে জনসমর্থনের কথা বললেও পশ্চিম গোলার্ধ বা আমেরিকা মহাদেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে জনসমর্থনের কোন তোয়াক্কা করেনি কখনও।
কিউবার অর্থনীতিতে মার্কিন অবরোধের প্রভাব
কিউবার অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। ‘হাভানা টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিউবাতে সবচাইতে বেশি পর্যটক আসে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, বিদেশে কিউবান সম্প্রদায় এবং রাশিয়া থেকে। ২০২৪ সালের পর্যটক সিজন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কিউবায় ২ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি কানাডিয় পর্যটক গিয়েছিল; বিদেশে থাকা কিউবানরা গিয়েছিল ৪৫ হাজার, মার্কিনীরা গিয়েছিল ২৮ হাজার এবং রুশরা গিয়েছিল ৪৩ হাজার। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কিউবাতে পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপিয়রাও কিউবাতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। কিউবার সরকার বলছে যে, এর মূল কারণ হলো কিউবার উপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ভিসা নিয়ন্ত্রণ। কারণ ইউরোপিয়রা কিউবাতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে যাবার জন্যে আলাদাভাবে ভিসা নিতে হবে। ২০২৪ সালে কিউবাতে ২৭ লক্ষ পর্যটক গিয়েছিল। ২০২৫ সালে ২৬ লক্ষ টার্গেট থাকলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, এই টার্গেটও পুরণ হবে না।
কিউবা পশ্চিম গোলার্ধে একটা বড় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন পায় কানাডার কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের মাঝে কানাডা কিউবাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে। কানাডার লিবারাল সরকার সর্বদাই কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে এসেছে। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, কানাডার সাথে কিউবা সরকারের রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো এবং কানাডা কিউবার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর পর কানাডিয় পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য হলো কিউবা। আর কিউবার জন্যে কানাডা হলো পর্যটকের সবচাইতে বড় উৎস। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত বছরে প্রায় ১০ লক্ষ কানাডিয় কিউবাতে যেতো। বর্তমানে কিউবাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগ কানাডার; যা মূলতঃ খনিজ, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সেক্টরে। কিউবার নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি, অবকাঠামো এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কানাডা উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে থাকে। এছাড়াও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে কিউবাকে সহায়তা দিচ্ছে কানাডা।
কিউবার অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল ভেনিজুয়েলার তেল-ভিত্তিক অর্থনীতির উপর। তবে 'ট্রেডিং ইকনমিকস'এর হিসেবে ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সালের মাঝে ভেনিজুয়েলার জিডিপি প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হয়ে যায়। এর প্রভাব কিউবার অর্থনীতিতেও পড়েছে। ভেনিজুয়েলার পর রাশিয়া এবং মেক্সিকো কিউবার তেলের উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০২৫ সালে রাশিয়া কিউবাতে প্রায় ১ লক্ষ টন তেল রপ্তানি করেছে। 'মায়ামি হেরাল্ড' বলছে যে, অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে কিউবা ইউক্রেনে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করার জন্যে যোদ্ধা পাঠিয়ে থাকতে পারে। অপরদিকে চীন কিউবার প্রধান রপ্তানি বাজার। ২০২১ সালে কিউবা চীনে প্রায় তিন'শ মিলিয়ন ডলারের নিকেল এবং অন্যান্য খনিজ দ্রব্য রপ্তানি করে। প্রায় ৪ লক্ষ চিনি একসময় চীনে রপ্তানি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিউবার চিনি উৎপাদনে ধ্বস নেমেছে।
ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রশ্নের মুখে পড়েছে বহুদিন ধরেই। কিউবার বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করতে না পেরে অর্থনৈতিক অবরোধের মাঝে রেখে যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃপক্ষে কিউবার সমর্থন বৃদ্ধিই করেছে। বিশেষ করে কিউবায় সরকার পরিবর্তন না করতে পারা, অথবা পশ্চিম গোলার্ধে কিউবাকে পুরোপুরিভাবে একঘরে না করতে পারাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বড় ব্যার্থতা। মধ্য আমেরিকাতে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মেক্সিকো, কলম্বিয়া, নিকারাগুয়া এবং ভেনিজুয়েলাতে বামপন্থী এবং লিবারালরা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কারণে কিউবা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন পেয়েছে। অর্থনৈতিক ধ্বসের আগ পর্যন্ত ভেনিজুয়েলা কিউবার অর্থনীতিকে সবচাইতে বড় সহায়তা দিয়েছে। এখন সেই ভার বহণ করছে মেক্সিকো, কানাডা, রাশিয়া এবং অন্যান্যরা। তবে পশ্চিম গোলার্ধে কিউবার সবচাইতে বড় বন্ধু হলো কানাডা; যার সমর্থন না পেলে মার্কিন অবরোধের মাঝে কিউবার পক্ষে টিকে থাকাটাই দুষ্কর হতো। এই সম্পর্কের মাধ্যমে কানাডাও ক্যারিবিয়ানের মতো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রভাব ধরে রাখছে। কানাডার এই প্রচেষ্টা 'গ্লোবাল ব্রিটেন'এর অংশ। ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে যাবার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি, বিশেষ করে রাশিয়া এবং চীনের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কৌশলগত হুমকি। নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট ভেনিজুয়েলার সরকার উৎখাত নয়; বরং পুরো ক্যারিবিয়ান এবং ল্যাটিন আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা। তবে শুধুমাত্র সামরিক হুমকির মাধ্যমে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।




