২০২৫এর ২১শে জুলাই একটা ট্র্যাজেডির দিবস হিসেবে মনে থাকবে বাংলাদেশের অনেক মানুষের। কমপক্ষে ২০ জন মানুষের প্রাণ ঝরে গেছে বিমান বাহিনীর বিমান দুর্ঘটনায়; যার মাঝে বেশিরভাগই ছিল শিশু; যারা ছিল উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের ছাত্র। তবে এই স্মৃতি কতদিন এদেশের মানুষ মনে রাখবে, সেটা দেখার বিষয়। মাত্র দশ দিন আগে, অর্থাৎ ১১ই জুলাই ছিল আরেকটা ট্র্যাজেডির ১৪তম বার্ষিকী। ২০১১এর ১১ই জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইএ একটা সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হয়েছিল; যারে মাঝে ৪৩ জনই ছিল শিশু শিক্ষার্থী। এর মাঝে ৩৪ জনই ছিল মিরসরাই উপজেলার মায়ানী ইউনিয়নের আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৭১ সালের পর থেকে একসাথে এতজন শিশুর মৃত্যু ঘটেনি। দুর্ঘটনায় এরূপ অপমৃত্যু বাংলাদেশে নতুন নয়। কিছুদিন সেই ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হয়; বিশেষ করে রাজনৈতিক পক্ষগুলি এর থেকে 'পলিটিক্যাল পয়েন্টস' বের করার চেষ্টায় থাকে; এরপর সকলেই ভুলে যায়। এই ব্যবস্থাটাই চলছে বাংলাদেশে যুগের পর যুগ ধরে। মানুষের আবেগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়; কিন্তু সমস্যার সমাধান করার ইচ্ছা কারুরই থাকে না। বরং যতদিন সমস্যা থাকে, ততদিনই সেটা ভোটের রাজনীতির জন্যে ব্যবহারযোগ্য হয়। একারণেই বিমান বাহিনীর বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে একটা 'হোলিস্টিক ভিউ' থাকাটা জরুরি।
১। অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে, 'মান্ধাতার আমলের বিমান ওড়ায় কেন'? খুবই যৌক্তিক কথা। 'এফ-৭' যুদ্ধবিমান তো ১৯৫০এর দশকে সোভিয়েত ডিজাইনের 'মিগ-২১' বিমানের চীনা কপি। একারণেই বাংলাদেশের উচিৎ এই মুহুর্তে কয়েক স্কোয়াড্রন 'জে-১০সি' এবং 'জেএফ-১৭বি' যুদ্ধবিমান যোগাড় করা। একদিকে যেমন এগুলি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে অতি জরুরি; তেমনি পুরোনো বিমানগুলিকে (যেমন – ‘এফ-৭এমবি') প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রেও অতি প্রয়োজনীয়। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই কিছুদিন আগেই বিমান বাহিনীর একটা অনুষ্ঠানে বলেছেন যে, বিভিন্ন দিক থেকে যুদ্ধের হুমকি আসছে। তাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। আর প্রস্তুতি নিতে গেলে অর্ধেক প্রস্তুতি নিলে হবে না; পুরো প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতীয় মিডিয়া (ওয়াশিংটনেরও সমর্থন রয়েছে) চাইছে বিমান নির্মাতা চীনের সাথে বাংলাদেশের একটা দ্বন্দ্ব উস্কে দিতে। কাজেই এদেশের মানুষকে সাবধানে পা ফেলতে হবে।
২। মান্ধাতার আমলের বিমানগুলিকে সরিয়ে ফেললেই তো বিমান দুর্ঘটনা আর হবে না তাই না? মার্কিন বিমান বাহিনী হলো দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী বিমান বাহিনী। তাদের দিকে তাকালে কি দেখা যায়? তাদের রয়েছে 'বি-৫২এইচ' বোমারু বিমান; যা প্রথম উড়েছিল ১৯৬০ সালের ১০ই জুলাই; অর্থাৎ ৬৫ বছর আগে! এটা সার্ভিসে আসে ১৯৬১ সালের ৯ই মে। শেষ 'বি-৫২এইচ' বিমান ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়েছিল ১৯৬২ সালের ২৬শে অক্টোবর। তবে এই বিমানের প্রথম ভার্সনটা প্রথম আকাশে উড়েছিল আরও প্রায় দশ বছর আগে ১৫ই এপ্রিল ১৯৫২ সালে। তাহলে ৬০-৭০ বছর আগে তৈরি এই বিমানগুলি যুক্তরাষ্ট্র কেন এখনও ব্যবহার করছে? তারা 'বি-১বি' এবং 'বি-২' বোমারু বিমানও তৈরি করেছে। এরপরও তারা 'বি-৫২'এর মতো মান্ধাতার আমলের বিমান আকাশে ওড়াচ্ছেই শুধু নয়; সারা দুনিয়ার বহু দেশ ধ্বংস করতে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র তো জানে যে, এই বিমানগুলি যে চালানো বিপজ্জনক; নাকি জানে না?
৩। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের তো এটাও হিসেবে রয়েছে যে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সালের মাঝে সর্বাধুনিক 'এফ-৩৫' যুদ্ধবিমানের ১৬টা দুর্ঘটনা ঘটেছে। সর্বাধুনিক বিমানের ক্ষেত্রেই যদি এতগুলি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে এটা কি বলা যায় যে, বিমান দুর্ঘটনা শুধুই বিমানের বয়সের উপর নির্ভরশীল? আর বিমানের বয়স বলতে কি বোঝানো হবে? বিমানের টাইপের প্রথম ফ্লাইট? নাকি দুর্ঘটনায় পতিত বিমানটার ফ্যাক্টরি থেকে বের হবার তারিখ? উভয় ক্ষেত্রেই 'বি-৫২' বিমানের আকাশে ওড়ার যোগ্যতা থাকার কথা নয়। তবে বাস্তবতা হলো, একটা দেশ ধ্বংস করার যোগ্যতা কিন্তু এই বিমানগুলির রয়েছে! অনেক ধরণের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এখন এই বিমানে বহণ করা যায়; যার ফলে বিমানগুলি এখনও অত্যন্ত শক্তিশালী কমব্যাট প্ল্যাটফর্ম। অর্থাৎ বিমান মান্ধাতার আমলের হতে পারে; কিন্তু এর বহণ করা অস্ত্র মোটেই মান্ধাতার আমলের নয়।
৪। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর 'এফ-৭বিজিআই' বিমানগুলি ২০১১ সালে তৈরি এবং ২০১২ সালে এগুলি বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়। তৈরি করার বয়স বিচারে এগুলি বেশ নতুন। আর এই বিমানগুলি এখন চীনা 'এলএস-৬' জিপিএস গাইডেড গ্লাইড বোমা এবং তুরস্কের 'তেবার' লেজার গাইডেড বোমা ছুঁড়ে ভূমিতে নিখুঁতভাবে টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম। কাজেই যদি প্রাযুক্তিক সক্ষমতার কথা বলা হয়, তাহলে এগুলি একেবারে ফেলে দেবার জিনিস নয়। যে সক্ষমতার অভাব রয়েছে তা হলো, এগুলি দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারে না। এটা এই মুহুর্তে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মাত্র ৬টা 'মিগ-২৯' বিমান পারে ('আর-২৭' ক্ষেপণাস্ত্র)। একারণেই বাংলাদেশের প্রয়োজন 'জে-১০' এবং 'জেএফ-১৭' ফাইটার বিমান। একমাত্র চীন থেকেই দূরপাল্লার এরূপ ক্ষেপণাস্ত্র (‘পিএল-১৫') পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না। তাই এটা ভুলে যাওয়া যায় যে, ‘ইউরোফাইটার টাইফুন' অথবা ফরাসি 'রাফাল' অথবা মার্কিন 'এফ-১৬'এর সাথে দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পাওয়া সম্ভব।
৫। অনেকেই বলছেন যে, এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফাইটার বিমান ওড়ানো হচ্ছে কেন? খুবই যৈক্তিক প্রশ্ন। তাহলে কি করা উচিৎ? সিঙ্গাপুর বা ইস্রাইলকে অনুসরণ করা উচিৎ। সিঙ্গাপুর ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার ভূমি এবং আকাশসীমা ব্যবহার করে তাদের পাইলটদের ট্রেনিং দেয়; আর ইস্রাইল তুরস্কের আকাশসীমা ব্যবহার করে। কাজেই সিঙ্গাপুর এবং ইস্রাইলের মানুষ থাকে পুরোপুরিভাবে নিরাপদ। যেহেতু বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে নতুন করে আরেকটা বিমান ঘাঁটি তৈরি করা অসম্ভব, তাই যারা এই যুক্তি দিচ্ছেন, তাদের অবশ্যই সমাধান হিসেবে বিমান মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা উচিৎ যে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে যেন ভারতের বিশাল আকাশসীমায় ট্রেনিং নেবার সুযোগ করে দেয়া হয়। এর আগে মুন্সিগঞ্জে বিমানবন্দর প্রকল্প ভেস্তে যাওয়া, বাগেরহাটে খান জাহান আলী বিমানবন্দর প্রকল্প ভেস্তে যাওয়া এবং লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু করা প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়া থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশের যেকোন সরকারের পক্ষে কোন বিমানবন্দর তৈরি বা পুরোনো বিমানবন্দর চালু করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ ভারত এবং মার্কিন সরকারের আরও কাছাকাছি (পড়ুন অনুগত) হতে পারলে বাংলাদেশের মানুষকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জেট ফুয়েল দ্বারা পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো যাবে! অন্য কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাতে 'আউটসোর্স' (চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিএর মতো) করে দিতে পারলেই এদেশের মানুষকে যুদ্ধবিমানের শব্দ শুনতে হবে না। থাকবে শুধু শান্তি; আর শান্তি!
৬। কিন্তু বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে অন্যস্থানে (যেমন ভারতে) সরিয়ে ফেললেই কি জনগণকে নিরাপদে রাখা যাবে? একটা 'বোয়িং ৭৮৭' যাত্রীবাহী বিমান সর্বোচ্চ ১২৬টন পর্যন্ত জেট ফুয়েল বহণ করতে পারে! এই পরিমাণ জেট ফুয়েল নিয়ে যদি একটা বিমান কুর্মিটোলার আশেপাশে কোন একটা স্কুলের উপর ধ্বসে পড়ে; অথবা প্রধান উপদেষ্টার অফিসের উপর ধ্বসে পড়ে, তাহলে কি হতে পারে? কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে গত ১২ই জুলাই ভারতের আহমেদাবাদে এই রকমই একটা বিমানের দুর্ঘটনা থেকে; যেখানে বিমানের ২৪২ জন আরোহী ছাড়াও ভূমিতে আরও ১৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে আসা এই বিমানটা ৫৪ টনের বেশি জেট ফুয়েল বহণ করছিল! এর তুলনায় ঢাকায় ধ্বংসপ্রাপ্ত 'এফটি-৭বিজিআই' যুদ্ধবিমানটা সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৮ টন জেট ফুয়েল বহণ করতে পারে (যদিও তা নিঃসন্দেহে অনেক কম ফুয়েল বহণ করছিল)। কাজেই এই 'এফ-৭'এর স্থলে যদি একটা 'বোয়িং-৭৮৭' বিমান থাকতো, তাহলে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের কোন নিশানা পাওয়া যেতো কিনা সন্দেহ! সুতরাং যারা প্রশ্ন করছেন যে, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর বিমান ওড়ে কেন, তাদের উচিৎ সরকারের কাছে আবেদন জানানো, যাতে করে ঢাকা বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। থার্ড টার্মিনালের মতো মার্কিন প্রকল্পও বন্ধ করার দাবি জানানো উচিৎ; যেটা বাস্তবায়নের উছিলায় মুন্সিগঞ্জে বিমানবন্দরের প্রকল্প বাতিল করা হয়।
৭। অনেকেই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে গালাগালি দিচ্ছেন – তাদের পাইলট অনভিজ্ঞ; অনভিজ্ঞ পাইলট দিয়ে ঢাকা শহরের উপর দিয়ে বিমান ওড়ানো হচ্ছে; দুর্নীতির আখড়া হয়ে গেছে বিমান বাহিনী; ইত্যাদি। যারা বলছেন, তারা হয়তো জানেন না যে, একটা 'এফ-৭' ফাইটার পাইলট হতে গেলে কতগুলি ধাপ পার করে আসতে হয়। প্রথমে 'পিটি-৬' এবং 'গ্রোব জি-১২০পি' বিমানে ওড়া শিখতে হয়। যারা বিশেষভাবে ভালো পারদর্শিতা দেখায়, তাদের মাঝ থেকেই সাধারণতঃ ফাইটার পাইলট সিলেক্ট করা হয়। এরা আবার 'কে-৮' জেট প্রশিক্ষণ বিমানে ওড়া শেখে। এরপর 'ইয়াক-১৩০' এডভান্সড ট্রেইনার বিমানে অস্ত্র চালনা শেখে। এরপর সে 'এফ-৭' স্কোয়াড্রনে 'এফটি-৭' বিমানে প্রশিক্ষণ নিয়ে টাইপ ফ্লাইং কোয়ালিফাই করে। এই ফ্লাইং কোয়ালিফিকেশনের শেষ ধাপের 'সোলো ফ্লাইট' ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোঃ তৌকির ইসলামের। প্রায় ১০ মিনিট ভালোভাবে ওড়ার পর বিমানটাতে সমস্যা দেখা দেয়। তার সহকর্মীরা বলেন যে, বিমানটা মধ্য আকাশে হঠাত বন্ধ হয়ে যায়। তৌকির শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করছিলেন বিমানটাকে একটা খোলা স্থানে ল্যান্ডিং করাতে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন যে, দু'টা বিমান একসাথে উড়ছিল। এর মাঝে একটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে সমস্যা পড়েছে। এই বিমানটা মাইলস্টোন কলেজের ১০-১২ তলা উঁচু ভবনের সাথে ধাক্কা খেয়ে এরপর দুই তলা স্কুল ভবনের উপর ধ্বসে পড়ে।
৮। পৃথিবীর অনেক দেশের বিমান বাহিনীতেই এতগুলি ধাপ পার হয়ে ফাইটার পাইলট হতে হয় না। একজন ফাইটার পাইলট হতে গেলে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। আর একজন পাইলট খুব বেশিদিন সুপারসনিক বিমানের পাইলট থাকতে পারেন না। এক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আবার অভিজ্ঞ পাইলটদের মূল গুরুত্ব হলো ট্রেইনার হিসেবে। তাই বিমান বাহিনী সাধারণতঃ তাদেরকে বেশি বয়সে ফাইটার বিমান ওড়াতে দেয় না। টাকা খরচ করলে মোটামুটি দ্রুতই একটা বিমান কেনা সম্ভব। কিন্তু একজন পাইলট তৈরি করতে 'অমূল্য' সময় লাগে; যা অর্থ দিয়েও পাওয়া যায় না। গত ২০২৪এর মে মাসেও একটা 'ইয়াক-১৩০' বিমান ধ্বংস হয়ে স্কোয়াড্রন লীডার আসীম জাওয়াদ মৃত্যুবরণ করেন। জাওয়াদ এবং তৌকিরের পেছনে ব্যয় করা পুরো সময়টা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হারিয়েছে; যা পূরণ করতে কয়েক বছর লাগবে।
৯। যারা বলছেন যে, অনভিজ্ঞ পাইলট দিয়ে কেন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার উপর দিয়ে বিমান ওড়ানো হচ্ছে, তাদের অবশ্যই জানা উচিৎ যে গত ২৯শে জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে সামরিক 'ব্ল্যাক হক' হেলিকপ্টারের সাথে যাত্রীবাহী বিমানের সংঘর্ষে ৬৭ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। হেলিকপ্টারের পাইলট ক্যাপ্টেন রেবেকা লোবাক ছয় বছর ধরে সেনাবাহিনীর পাইলট ছিলেন। তার সাথের দু'জন এনসিও ছিলেন, যারা ছিলেন যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এরপরেও একটা অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার একটা বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমানের সাথে ধাক্কা লাগা এড়াতে পারেনি। আর পৃথিবীর সবচাইতে বিপজ্জনক আকাশপথ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এই সামরিক ট্রেনিং মিশনকে বাতিল করেনি। কারণ এই ট্রেনিং মিশনটাকে তারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে; তাই বলে জাতীয় নিরাপত্তাকে ছোট করার মতো ক্ষুদ্র চিন্তা তাদেরকে গ্রাস করেনি।
১০। যারা দুর্নীতির কথা বলছেন, তারা দুর্নীতির আসল আখড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। এই ব্যবস্থায় মানুষকে শেখানো হয় যাতে করে ব্যক্তিগত বেনেফিট ছাড়া কেউ কোন কাজ না করে। দুর্নীতি করলে তো ব্যক্তিগত বেনেফিট হয়; তাহলে কেন সেটা খারাপ হবে? ব্যক্তিগত বেনেফিটের এই একই চিন্তা বাংলাদেশের সকল মানুষকেই শুধু দেয়া হয় না, রাষ্ট্রও চলে বেনেফিটের উপর ভিত্তি করে। যেমন, হাসিনা সরকার বেনেফিটের কথা চিন্তা করেই ভারতের আদানির সাথে রাষ্ট্রবিরোধী চুক্তি করেছিল; যা আবার অন্তর্বর্তী সরকারও বজায় রেখেছে। বেনেফিট চিন্তা করেই সরকার এই চুক্তি বাতিল করেনি অথবা সীমান্ত ও অন্যান্য ইস্যুতে ভারতের সাথে ঝামেলায় জড়ায়নি। বেনেফিট রয়েছে বলেই সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশীদেরকে দিতে চাইছে। বেনেফিট চিন্তা করেই ভারতের সুবিধার্থে তৈরি করা মাতারবাড়ি বন্দরকে সরকার অর্থনৈতিক বিষফোঁড়া মনে করছে না; অথচ পায়রা বন্দরকে ক্ষতিকর মনে করছে। বেনেফিট চিন্তা করেই প্রধান উপদেষ্টা চাডিগাঁও ভাষায় চট্টগ্রামের মানুষকে বুঝিয়েছেন যে মাতারবাড়ি বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশের কি কি বেনেফিট হবে। যখন পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাটাই চলছে বেনেফিটের উপর ভিত্তি করে, তখন এই ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে নির্দিষ্ট কোন একটা গোষ্ঠীকে টার্গেট করার অর্থ হলো, কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলি বলা হচ্ছে।
যারা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি সরিয়ে ফেলার কথা বলছেন, তারা ভারতের ন্যারেটিভ অনুসরণ করছেন। ভারতীয় মিডিয়া এই ঘটনাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি করতে এবং বাংলাদেশের সাথে চীনের (বিমান নির্মাতা) দূরত্ব তৈরি করতে। তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, ‘এফ-৭' বিমানের স্থলে 'বোয়িং-৭৮৭' বিমান থাকলে মাইলস্টোন কলেজ, স্কুল ও আশেপাশের বহু স্থাপনার অস্তিত্বই থাকতো না! যারা বিমান বাহিনীর সমালোচনা করছেন, তাদের উচিৎ 'প্রকৃত' সমালোচনা করা। এই বিমান বাহিনী হলো সাইফুল আজমের উত্তরসুরী; যিনি ১৯৬৭ সালে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের 'হান্টার' যুদ্ধবিমান উড়িয়ে একদিনে ৩টা ইস্রাইলি যুদ্ধবিমান (অপেক্ষাকৃত উচ্চমানের) ভূপাতিত করেছিলেন। এই বিমান বাহিনী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে যখন সাইফুল আজমের শত্রুরা ৫৬ হাজারেরও বেশি মুসলিম ভাই-বোনদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাইলটরা নিঃসন্দেহে অতি উচ্চমানের পাইলট। কিন্তু নিজের ভাই-বোনদের মৃত্যুতে যাদের অন্তর কাঁদে না, তারা আর কারুর চোখে না হলেও আল্লাহর চোখে অপরাধী হবে। ইস্রাইলের বিরুদ্ধে না লড়েও তারা যে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবেন না, সেই প্রমাণ তারা পেয়েছেন। মৃত্যু আসবেই; কিন্তু তাদের কাছে অপশন ছিলো - মৃত্যুটা কতটা সন্মানের হবে। হয়তো ২০২৫ সালের ২১শে জুলাইয়ের মর্মান্তিক ঘটনা তাদেরকে সেটাই মনে করিয়ে দেবে।
সূত্রঃ
‘Stratofortress... The Big One from Boeing’ by Robert F Dorr in Air Enthusiast, Summer 1990
‘Pilot is safe after crash of F-35 fighter jet seen in dramatic video’ in CNN, 29 January 2025
‘What we know so far about Air India crash investigation’ in BBC, 12 July 2025
‘AI-171’s flight to tragedy: A minute-by-minute account of events that led to Ahmedabad plane crash’ Deccan Herald, 12 July 2025
‘মিরসরাই ট্র্যাজেডি: সেদিন যেভাবে প্রাণ হারিয়েছিল ৪৩ শিশুসহ ৪৫ জন' প্রথম আলো, ১১ই জুলাই ২০২৪
‘Pilot tried to avoid disaster by steering crashing jet away from populated area: ISPR’ in The Business Standard, 21 July 2025
‘At least 27 Air Force jet crashes in last 3 decades’ in Dhaka Tribune, 11 July 2025
‘Palestinians mourn death of a Bangladeshi war hero’ in Al-Jazeera, 15 June 2020
‘What we know about the deadly air crash between a passenger jet and a US Army helicopter’ in Associated Press, 28 March 2025
‘Friends say Army captain killed in midair collision was a ‘brilliant and fearless’ patriot’ in Associated Press, 03 February 2025