ইউক্রেনের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে তার সামরিক শক্তি সরিয়ে নেবার প্রসেস শুরু করেছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মিউনিখ বক্তব্য যারা শুনেছেন, তাদের এই ব্যাপারটা বুঝে নিতে এক মুহুর্তও লাগার কথা নয়। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শক্তিকে অর্ধেক করে তুরস্কের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে। এখন তুরস্ক ইস্রাইলের নিরাপত্তা দেবে। একইসাথে ইরানকে, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। উদ্দেশ্য হলো, ইরানকে ভয় দেখিয়ে চুক্তি করতে বাধ্য করা; যাতে করে ইস্রাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এগুলির অর্থ হলো - যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়া থেকে সামরিক শক্তি সরিয়ে নিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতা চীনাদের তুলনায় নস্যি; চীনের একটা শিপইয়ার্ডের সক্ষমতা সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতার চাইতে বেশি! তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন কোরিয়াকে নিয়োজিত করতে চাইছে মার্কিন নৌবহরের জন্যে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর, রেয়ার আর্থ ম্যাটেরিয়াল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ফাইভ-জি প্রযুক্তি, ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এখন যুদ্ধাবস্তা প্রায়। এই সবগুলি ঘটনা দেখিয়ে দিছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একারণে বাকি বিশ্বও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামরিক শক্তি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছে। বাংলাদেশ কি এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে অবহিত রয়েছে? অনুধাবন করার এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের সামনে প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে দুই বছর রয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না! অন্য কথা বলতে গেলে, সময় এখন আপাততঃ মাসের হিসেবে এগুচ্ছে!
প্রথমতঃ বাংলাদেশকে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব বিদেশ-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে; বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে। কারণ দুনিয়াতে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি হবার সাথেসাথেই বৈদেশিক বাণিজ্য-কেন্দ্রিক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন বাতাসে মিলিয়ে যাবে! কোন কোন পণ্য বাংলাদেশের না হলেই নয়, সেগুলির একটা তালিকা করতে হবে এবং সেগুলিকে যথাসম্ভব দেশে উৎপাদনের জন্যে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিছু পণ্য বাইরে থেকে আনতেই হবে। সেগুলির উৎস নিয়ে গভীর চিন্তা ব্যয় করতে হবে - কোথা থেকে কিভাবে সেগুলি আনা সম্ভব হবে; এবং সেগুলির বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা কিভাবে দেয়া যাবে। এক্ষেত্রে কোন কোন দেশ বাংলাদেশের দুর্যোগের সময় সাথে থাকতে পারে, তার একটা তালিকা করতে হবে। যেসকল দেশের উপর নির্ভর করা কঠিন, বা যেগুলি বাংলাদেশকে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, সেগুলিকে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে - এখানে কোন ভালোবাসার সম্পর্ক রাখা যাবে না।
দ্বিতীয়তঃ যত দ্রুত সম্ভব কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল সক্ষমতা বাংলাদেশে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে।
১। ফ্ল্যাট স্টিলের উৎপাদন শুরু করতে হবে। বর্তমানে উৎপাদিত স্টিল প্লেটের মান যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে একাধিক ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেগুলিতে ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস বা ইএএফ চুল্লি রয়েছে। এসব চুল্লিতে তৈরি স্টিলের মান ফ্ল্যাট স্টিলের জন্যে সঠিক মানের (বিশুদ্ধতা বিবেচনায়)। ফ্ল্যাট স্টিল ছাড়া কোন কৌশলগত সামগ্রী তৈরি করা যাবে না; বিশেষ করে যানবাহন তৈরি করতে গেলে ফ্ল্যাট স্টিল লাগবেই।
২। ডিজেল ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক মোটর এবং কম্প্রেসারের উৎপাদন করার জন্যে ফ্যাক্টরি দিতে হবে। এগুলি খুব জটিল কোন ইন্ডাস্ট্রি নয়। সদিচ্ছা থাকলে এসব ফ্যাক্টরি করতে এক বছরও লাগার কথা নয়। এই তিনটা জিনিস ছাড়া কোন ইন্ডাস্ট্রিই তৈরি করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বাংলাদেশ এগুলির জন্যে আমদানির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।
৩। পেট্রোকেমিক্যাল এবং বেসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে। মিথানলের উৎপাদন বাংলাদেশে শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন মিথানলের পরের পণ্যগুলিকে উৎপাদনে নিয়ে আসতে হবে। নাইট্রিক এসিড, ফরমালডিহাইড, এমোনিয়া এবং এগুলির মাধ্যমে তৈরি আরও কিছু যৌগ রয়েছে, যেগুলি উৎপাদন না করতে পারলে এক্সপ্লোসিভ ইন্ডাস্ট্রি করা সম্ভব নয়। আর এক্সপ্লোসিভ উৎপাদন না করতে পারলে সামরিক শক্তি তৈরির কথা ভুলে যেতে হবে। প্লাস্টিকের ধরণগুলির মাঝে শুধুমাত্র পিভিসি উৎপাদনে গিয়েছে বাংলাদেশে। এখানে পিইউ, পিএস, পিইটি, ইত্যাদি রেজিনের উৎপাদন শুরু করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। কারণ এগুলি ছাড়া কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা যাবে না।
৪। সিএনসি মেশিন যত বেশি সম্ভব আনার ব্যবস্থা করতে হবে এবং দেশেই সিএনসি মেশিন তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ সিএনসি মেশিন হলো মিলিং মেশিন, ডব্লিউডিএম; কিছু লেজার কাটিং মেশিনও রয়েছে। একইসাথে সিএনসি লেদ মেশিন প্রয়োজন অনেক। দেশে এই মুহুর্তে লেদ মেশিন (নন সিএনসি) তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। এটাকে আরও বাড়াতে হবে; সাথে মিলিং, সারফেস গ্রাইন্ডিং, শিয়ারিং, ইত্যাদি বেসিক মেশিন তৈরির সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে হবে। বিএমটিএফ, বিওএফ, ইএমই ওয়ার্কশপ, ওয়াল্টন এবং আরও কিছু কারখানায় টুলস তৈরি করা হয়। এই সক্ষমতাগুলিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং দীর্ঘস্থায়ীত্ব দিতে হবে।
৫। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের নিজস্ব কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্ল্যান্ট ডিজাইন, কম্পোনেন্ট উৎপাদন এবং ইন্সটলেশনের সক্ষমতা রয়েছে। এগুলিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে হবে। নলেজ বেইজটাকে আরও বাড়াতে হবে এবং ইন্সটিটিউশনাল জ্ঞানসম্পন্ন নতুন ইঞ্জিনিয়ারদেরকে এসব ক্ষেত্রে জড়িত করতে হবে।
৬। ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। টেলিকমিউনিকেশন, রাডার, জিপিএস এবং স্যাটকমসহ ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম নিয়ে কাজ করা সকল ধরণের যন্ত্র উৎপাদন শুরু করতে হবে। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংএর যন্ত্রের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে; বিশেষ করে মাল্টিলেয়ার পিসিবি তৈরির মেশিন, প্রোটোটাইপিং মেশিন, অটোম্যাটিক টেস্টিং ইকুইপমেন্ট, ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। লিথিয়াম ব্যাটারির উৎপাদন (শুধু সংযোজন নয়) শুরু করতে হবে। ইপিজেডগুলিতে এই মুহুর্তে কিছু অপটিক্যাল সরঞ্জাম তৈরি হয়। এগুলি বাংলাদেশের জন্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। কোন যুদ্ধাস্ত্রই এসকল সরঞ্জাম ছাড়া কার্যকর হবে না।
৭। টায়ার তৈরির সক্ষমতা বাড়াতে হবে; বিশেষ করে রেডিয়্যাল টায়ার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে কিছু বিদেশী শক্তি এদেশের গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি ধ্বংস করে ফেলে। এটা ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ফ্যাক্টরি, যেখানে ট্রাকে ব্যবহার করা কমার্শিয়াল ভেহিকল টায়ার তৈরি করা হতো। এটা ধ্বংস করে ফেলার কারণে ট্রাক টায়ার ভারত থেকে আনা ছাড়া কোন পদ্ধতিই থাকেনি। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। চীনের প্রযুক্তিতে আরও একটা টায়ার ফ্যাক্টরি (রেডিয়্যাল টায়ারসহ) তৈরি হবার প্রসেস শুরু হলেও সেটার ভবিষ্যৎ অনেক আগেই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। টায়ার তৈরির ফ্যাক্টরি এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ – সকল প্রকারের টায়ার তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন।
৮। গ্লাস তৈরির সক্ষমতাকে নতুন ধাপে নিয়ে যেতে হবে। বুলেটপ্রুফ গ্লাস এবং ফাইটার বিমানের ককপিটের ক্যানোপি তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন।
৯। আর্মার প্লেট এবং সিরামিক আর্মার তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সিরামিক এবং গার্মেন্টস শিল্পে কিছু বিশেষ দক্ষতা রয়েছে; যেগুলিকে সমন্বয় করতে হবে।
তৃতীয়তঃ কৌশলগত অবকাঠামো নির্মাণে মনোনিবেশ করতে হবে।
১। বিমানবন্দরের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সংখ্যা বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। ইউক্রেনে ৫০টার মতো বিমানবন্দর থাকার কারণে তারা রুশ হামলা থেকে তাদের বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পেরেছে। ইউক্রেনের তুলনায় আকৃতিতে বাংলাদেশ অনেক ছোট। কাজেই বাংলাদেশের পুরাতন সকল বিমানবন্দরের রানওয়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে; যাতে করে মোটামুটিভাবে পরিবহণ বিমান হলেও যেন ওঠানামা করতে পারে। এছাড়াও নতুন করে বহু স্থানে রানওয়ে তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে যতগুলি হাইওয়ে রয়েছে, তার সকল স্থানে খুঁজে দেখতে হবে যে, কোথায় কোথায় ফাইটার বিমান ওঠানামা করার মতো দীর্ঘ রানওয়ে তৈরি করা যায়। সেই স্থানগুলির সারফেসকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভারত ইতোমধ্যেই হাইওয়েতে ফাইটার বিমান নামানোর পরীক্ষা চালিয়ে ফেলেছে।
২। নদীবন্দরের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বেশকিছু নদীবন্দর রয়েছে বর্তমানে; সেগুলিকে নতুন অবকাঠামো যোগ করে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর মাঝে প্রথমেই থাকবে ড্রেজিং। নদীপথে নাব্যতা না থাকলে নদীবন্দর দিয়ে কি হবে? নাব্যতা নিশ্চিত করতে ড্রেজার এবং আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়াতে হবে। ড্রেজারের ভেসেলগুলি বাংলাদেশে তৈরি হলেও ড্রেজারের কাটিং মেশিন এবং ডিজেল ইঞ্জিন আমদানির উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
৩। শিপবিল্ডিংএর ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে; বিশেষ করে খুলনা শিপইয়ার্ড ও নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে আরও অনেক স্থানে উচ্চমানের জাহাজ তৈরির ফ্যাসিলিটি গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ জাহাজ তৈরির জন্যে বরিশাল ও পটুয়াখালি এলাকা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, গজারিয়া, ভৈরব, আশুগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা ভালো এলাকা হতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং খুলনা অঞ্চলকে সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরির জন্যে আলাদাভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
চতুর্থতঃ সামরিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
১। বিমান সংযোজন ও নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ 'পিটি-৬', ‘বেল-২১২', ‘বেল-২০৬', ‘এমআই-১৭১' এবং 'এফ-৭' বিমান ওভারহোলিং করে থাকে। এছাড়াও 'গ্রোব জি-১২০টিপি' বিমানের কম্পোজিট স্ট্রাকচার তৈরির সক্ষমতাও রয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অতি সম্প্রতি নিজস্ব দু'টা প্রোটোটাইপ বিমান তৈরি করে উড্ডয়ন করেছে। এই সক্ষমতাগুলিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে হবে। বিমান সংযোজনের সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হবে এবং ফাইটার বিমান নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
২। নৌবাহিনীর ফ্রিগেট তৈরির সক্ষমতা অর্জন করার কথা ছিলো কয়েক বছর আগেই। মিয়ানমার তাদের নৌবাহিনীর জন্যে প্রথম ফ্রিগেট পানিতে ভাসিয়েছে ১৩ বছর আগে। বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত ফ্রিগেট তৈরির উপযোগী একটা ডকইয়ার্ডও তৈরি করতে পারেনি! এই লজ্জা নিয়েই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।
৩। ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সকল প্রকারের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন। এন্টি-ট্যাঙ্ক, ম্যানপ্যাডস, শোরাড, মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স, এন্টি-শিপ, এয়ার-টু-সারফেস, এয়ার-টু-এয়ার, সারফেস-টু-সারফেস ব্যালিস্টিক, সারফেস-টু-সারফেস ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা প্রয়োজন। এই মুহুর্তে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ওভারহোলিং (এবং প্রয়োজনে এসেম্বলি) করার সক্ষমতা রয়েছে; যেগুলিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে হবে।
৪। ড্রোন তৈরির কারখানা তৈরি করতে হবে। ড্রোন বহু প্রকারের; তবে এর মাঝে কিছু প্রকারের ড্রোনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। গোয়েন্দা কাজের জন্যে ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর (উপরে আলোচিত) সমৃদ্ধ ড্রোন প্রয়োজন। আর আক্রমণকারী ড্রোন হিসেবে 'ফার্স্ট পারসন ভিউ' বা 'এফপিভি' ড্রোন তৈরি করতে হবে। এই ড্রোনগুলি কোয়াডকপ্টার, হেক্সাকপ্টার, অক্টাকপ্টার, ফিক্সড-উইং হতে পারে। এই ড্রোনের প্রপালশন হিসেবে বিভিন্ন আকৃতির ইলেকট্রিক মোটর (উপরে মোটরের কারখানার কথা আলোচিত হয়েছে) এবং ছোট পেট্রোল ইঞ্জিন (মূলতঃ মোটরসাইকেল ইঞ্জিন) তৈরির কারখানা বসাতে হবে। এগুলিতে ব্যবহার করা জিপিএস, রিমোট-কন্ট্রোল কমিউনিকেশন ডিভাইস, লিথিয়াম ব্যাটারির (উপরে আলোচিত) আলাদা কারখানা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলির বডি (বিশেষ করে এফপিভি ড্রোনের) কার্বন-ফাইবার ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করতে হয়। কার্বন-ফাইবার কিভাবে যোগাড় করা যায়, অথবা কিভাবে এগুলি নিজেদের দেশে উৎপাদন করার প্রযুক্তি আনা যায়, সেটা খুঁজতে হবে।
৫। আর্টিলারি কামান তৈরির কারখানা প্রয়োজন। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে, ন্যাটোর মতো এয়ার সুপেরিয়রিটি না থাকলে (যেটার ব্যাপারে এখন অনেকেই সন্দিহান) যেকোন দেশকে আর্টিলারির উপরেই নির্ভর করতে হবে। ১০৫মিঃমিঃ এবং ১৫৫মিঃমিঃ আর্টিলারি ব্যারেল অবশ্যই তৈরি করতে হবে। ১০৫মিঃমিঃ, ১৫৫মিঃমিঃ আর্টিলারি এমুনিশন তৈরির ব্যাপক সক্ষমতা প্রয়োজন। এছাড়াও আরও দূরের পাল্লার টার্গেটে আঘাত করার লক্ষ্যে ১২২মিঃমিঃ, ২৩০মিঃমিঃ, ৩০০মিঃমিঃ আর্টিলারি রকেটের কারখানা করতে হবে। এছাড়াও বিমান বিধ্বংসী কামান তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন। ২০মিঃমিঃ অথবা ১৪ দশমিক ৫মিঃমিঃ (যেকোন একটা), ৩৫ অথবা ৩৭মিঃমিঃ (যেকোন একটা), ৫৭মিঃমিঃ কামান নিজস্ব কারখানায় তৈরি করতে হবে। এগুলির সাথে ব্যবহার করার জন্যে নিজস্ব তৈরি ইলেকট্রো-অপটিক ডিভাইস এবং রাডারের সমন্বয় করতে হবে।
৬। সামরিক অফরোড গাড়ির কারখানা তৈরি করতে হবে। এগুলি সকল প্রকারের পরিবহণ ছাড়াও আর্টিলারি ট্রাকটর হিসেবে কাজ করবে। এগুলির মাঝে 'বাগি' প্রকারের হাল্কা যানও প্রয়োজন, যেগুলি মোটরসাইকেলের সাথে চলার উপযোগী। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে এধরণের যানবাহন উপযোগী হবে। বেশকিছু গাড়ি প্রয়োজন, যেগুলি উভচর হবে; অর্থাৎ নদী-খাল-বিল পার হতে পারবে। গাড়িগুলিকে পরিবর্তিত করেই এধরণের উভচর যান তৈরি করা সম্ভব। এসকল গাড়িতে ব্যবহারের জন্যে ডিজেল ইঞ্জিন, স্টিল প্লেট, আর্মার, বুলেটপ্রুফ গ্লাসের কারখানার কথা উপরে উল্লিখিত হয়েছে।
৭। বন্দুকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের এসল্ট রাইফেল তৈরির সক্ষমতা মোটেই যথেষ্ট নয়। অতি দ্রুত এই উৎপাদন সক্ষমতাকে কয়েক গুণ করতে হবে। একইসাথে ৭ দশমিক ৬২মিঃমিঃ জিপি মেশিন গান এবং ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ হেভি মেশিন গান (এয়ার ডিফেন্সের জন্যে) তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এসকল বন্দুকের জন্যে ৭ দশমিক ৬২মিঃমিঃ (রাইফেল ও মেশিন গান) এবং ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ এমুনিশন উৎপাদন কয়েক গুণ করতে হবে।
৮। এয়ারড্রপ এমুনিশন এবং নেভাল মাইন তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
এছাড়াও আরও বেশকিছু সামরিক সক্ষমতা রয়েছে, যেগুলি উল্লেখ করতে থাকলে তালিকা বড় হতেই থাকবে। কিন্তু উপরে উল্লেখ করা সক্ষমতাগুলি অর্জিত না হলে এর সাথে আরও কয়েক'শ সক্ষমতা যুক্ত করাটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে।
উপরে দেয়া তালিকার বাইরে বাংলাদেশকে আরও অনেক কিছুই করতে হবে। যেমন, অতি দ্রুত কয়েক স্কোয়াড্রন চীনা 'জে-১০' এবং পাকিস্তানি 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান যোগাড় করতে হবে। একইসাথে অফ-দ্যা-শেলফ কিছু ফ্রিগেট (চীনা এবং আর যেখানে পাওয়া যায়) যোগাড় করতে হবে; যেগুলি আনার পর সেগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন জাহাজ তৈরি করতে কয়েক বছর লেগে যাবে; এখন সেই সময়টুকু আছে কিনা, তা সন্দেহ। পুরোনো জাহাজগুলির সাথে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং এয়ার, সারফেস ও সাব-সারফেস ড্রোনের সমন্বয় ঘটিয়ে সেগুলিকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের উপযোগী করে প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই মুহুর্তে সংখ্যা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার; যা কোনভাবেই প্রতিস্থাপনীয় নয়। মধ্যম পাল্লার এয়ার ডিফেন্স ক্ষেপণাস্ত্র (চীনা এবং তুর্কি) অবশ্যই প্রয়োজন। এগুলি না থাকলে দেশের কোন স্থাপনাই রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
ঝড় আসছে! কিন্তু বাংলাদেশ এই মুহুর্তে মোটেই প্রস্তুত নয়! বিপদে ভয় পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভয় না পেলে অনেক সময়েই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা যায় না। ভয় পেলেই শরীরের ডিফেন্সিভ মেকানিজম কাজ করা শুরু করে; আবার কোন কোন ক্ষেত্রে প্যারালাইসিসেও আক্রান্ত হতে পারে। দ্বিতীয়টা বাংলাদেশের জনগণ তাদের নেতৃত্বের কাছ থেকে কখনোই আশা করবে না। কিন্তু আশা না করলেই যে তা বাস্তবে হবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ কেউ কেউ এখনও দিবাস্বপ্নে বিভোর রয়েছেন। তাদেরকে বলতে হবে - ঘুম থেকে জেগে উঠুন! বাস্তবতা বুঝুন! উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার ভিত্তিগুলি বাস্তবে রূপ দিতে পারলেও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সহজ হবে না। কারণ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ কোন আদর্শিক রাষ্ট্র নয়। তারা 'প্রোএকটিভ' নয়; বরং তারা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে প্রতিক্রিয়া (রিয়্যাকটিভ) হিসেবে কিছু পরিকল্পনা করে থাকে। যেকারণে বেশিরভাগ সময়ই তারা বাইরের শক্তির প্রভাব বলয়ে আবর্তিত হয়।