Saturday, 19 April 2025

আসন্ন ভূরাজনৈতিক ঝড়ের জন্যে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?

২০শে এপ্রিল ২০২৫

সবগুলি ঘটনা দেখিয়ে দিছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একারণে বাকি বিশ্বও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামরিক শক্তি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছে। বাংলাদেশ কি এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে অবহিত রয়েছে? অনুধাবন করার এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের সামনে প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে দুই বছর রয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না! অন্য কথা বলতে গেলে, সময় এখন আপাততঃ মাসের হিসেবে এগুচ্ছে!


ইউক্রেনের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে তার সামরিক শক্তি সরিয়ে নেবার প্রসেস শুরু করেছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মিউনিখ বক্তব্য যারা শুনেছেন, তাদের এই ব্যাপারটা বুঝে নিতে এক মুহুর্তও লাগার কথা নয়। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শক্তিকে অর্ধেক করে তুরস্কের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে। এখন তুরস্ক ইস্রাইলের নিরাপত্তা দেবে। একইসাথে ইরানকে, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। উদ্দেশ্য হলো, ইরানকে ভয় দেখিয়ে চুক্তি করতে বাধ্য করা; যাতে করে ইস্রাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এগুলির অর্থ হলো - যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়া থেকে সামরিক শক্তি সরিয়ে নিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতা চীনাদের তুলনায় নস্যি; চীনের একটা শিপইয়ার্ডের সক্ষমতা সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতার চাইতে বেশি! তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন কোরিয়াকে নিয়োজিত করতে চাইছে মার্কিন নৌবহরের জন্যে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর, রেয়ার আর্থ ম্যাটেরিয়াল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ফাইভ-জি প্রযুক্তি, ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এখন যুদ্ধাবস্তা প্রায়। এই সবগুলি ঘটনা দেখিয়ে দিছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একারণে বাকি বিশ্বও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামরিক শক্তি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছে। বাংলাদেশ কি এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে অবহিত রয়েছে? অনুধাবন করার এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের সামনে প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে দুই বছর রয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না! অন্য কথা বলতে গেলে, সময় এখন আপাততঃ মাসের হিসেবে এগুচ্ছে!

প্রথমতঃ বাংলাদেশকে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব বিদেশ-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে; বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে। কারণ দুনিয়াতে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি হবার সাথেসাথেই বৈদেশিক বাণিজ্য-কেন্দ্রিক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন বাতাসে মিলিয়ে যাবে! কোন কোন পণ্য বাংলাদেশের না হলেই নয়, সেগুলির একটা তালিকা করতে হবে এবং সেগুলিকে যথাসম্ভব দেশে উৎপাদনের জন্যে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিছু পণ্য বাইরে থেকে আনতেই হবে। সেগুলির উৎস নিয়ে গভীর চিন্তা ব্যয় করতে হবে - কোথা থেকে কিভাবে সেগুলি আনা সম্ভব হবে; এবং সেগুলির বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা কিভাবে দেয়া যাবে। এক্ষেত্রে কোন কোন দেশ বাংলাদেশের দুর্যোগের সময় সাথে থাকতে পারে, তার একটা তালিকা করতে হবে। যেসকল দেশের উপর নির্ভর করা কঠিন, বা যেগুলি বাংলাদেশকে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, সেগুলিকে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে - এখানে কোন ভালোবাসার সম্পর্ক রাখা যাবে না।

 
ডিজেল ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক মোটর এবং কম্প্রেসারের উৎপাদন করার জন্যে ফ্যাক্টরি দিতে হবে। এগুলি খুব জটিল কোন ইন্ডাস্ট্রি নয়। সদিচ্ছা থাকলে এসব ফ্যাক্টরি করতে এক বছরও লাগার কথা নয়। এই তিনটা জিনিস ছাড়া কোন ইন্ডাস্ট্রিই তৈরি করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বাংলাদেশ এগুলির জন্যে আমদানির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।



দ্বিতীয়তঃ যত দ্রুত সম্ভব কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল সক্ষমতা বাংলাদেশে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে।

১। ফ্ল্যাট স্টিলের উৎপাদন শুরু করতে হবে। বর্তমানে উৎপাদিত স্টিল প্লেটের মান যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে একাধিক ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেগুলিতে ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস বা ইএএফ চুল্লি রয়েছে। এসব চুল্লিতে তৈরি স্টিলের মান ফ্ল্যাট স্টিলের জন্যে সঠিক মানের (বিশুদ্ধতা বিবেচনায়)। ফ্ল্যাট স্টিল ছাড়া কোন কৌশলগত সামগ্রী তৈরি করা যাবে না; বিশেষ করে যানবাহন তৈরি করতে গেলে ফ্ল্যাট স্টিল লাগবেই।

২। ডিজেল ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক মোটর এবং কম্প্রেসারের উৎপাদন করার জন্যে ফ্যাক্টরি দিতে হবে। এগুলি খুব জটিল কোন ইন্ডাস্ট্রি নয়। সদিচ্ছা থাকলে এসব ফ্যাক্টরি করতে এক বছরও লাগার কথা নয়। এই তিনটা জিনিস ছাড়া কোন ইন্ডাস্ট্রিই তৈরি করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বাংলাদেশ এগুলির জন্যে আমদানির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

৩। পেট্রোকেমিক্যাল এবং বেসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে। মিথানলের উৎপাদন বাংলাদেশে শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন মিথানলের পরের পণ্যগুলিকে উৎপাদনে নিয়ে আসতে হবে। নাইট্রিক এসিড, ফরমালডিহাইড, এমোনিয়া এবং এগুলির মাধ্যমে তৈরি আরও কিছু যৌগ রয়েছে, যেগুলি উৎপাদন না করতে পারলে এক্সপ্লোসিভ ইন্ডাস্ট্রি করা সম্ভব নয়। আর এক্সপ্লোসিভ উৎপাদন না করতে পারলে সামরিক শক্তি তৈরির কথা ভুলে যেতে হবে। প্লাস্টিকের ধরণগুলির মাঝে শুধুমাত্র পিভিসি উৎপাদনে গিয়েছে বাংলাদেশে। এখানে পিইউ, পিএস, পিইটি, ইত্যাদি রেজিনের উৎপাদন শুরু করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। কারণ এগুলি ছাড়া কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা যাবে না।

৪। সিএনসি মেশিন যত বেশি সম্ভব আনার ব্যবস্থা করতে হবে এবং দেশেই সিএনসি মেশিন তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ সিএনসি মেশিন হলো মিলিং মেশিন, ডব্লিউডিএম; কিছু লেজার কাটিং মেশিনও রয়েছে। একইসাথে সিএনসি লেদ মেশিন প্রয়োজন অনেক। দেশে এই মুহুর্তে লেদ মেশিন (নন সিএনসি) তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। এটাকে আরও বাড়াতে হবে; সাথে মিলিং, সারফেস গ্রাইন্ডিং, শিয়ারিং, ইত্যাদি বেসিক মেশিন তৈরির সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে হবে। বিএমটিএফ, বিওএফ, ইএমই ওয়ার্কশপ, ওয়াল্টন এবং আরও কিছু কারখানায় টুলস তৈরি করা হয়। এই সক্ষমতাগুলিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং দীর্ঘস্থায়ীত্ব দিতে হবে।

৫। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের নিজস্ব কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্ল্যান্ট ডিজাইন, কম্পোনেন্ট উৎপাদন এবং ইন্সটলেশনের সক্ষমতা রয়েছে। এগুলিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে হবে। নলেজ বেইজটাকে আরও বাড়াতে হবে এবং ইন্সটিটিউশনাল জ্ঞানসম্পন্ন নতুন ইঞ্জিনিয়ারদেরকে এসব ক্ষেত্রে জড়িত করতে হবে।

৬। ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। টেলিকমিউনিকেশন, রাডার, জিপিএস এবং স্যাটকমসহ ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম নিয়ে কাজ করা সকল ধরণের যন্ত্র উৎপাদন শুরু করতে হবে। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংএর যন্ত্রের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে; বিশেষ করে মাল্টিলেয়ার পিসিবি তৈরির মেশিন, প্রোটোটাইপিং মেশিন, অটোম্যাটিক টেস্টিং ইকুইপমেন্ট, ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। লিথিয়াম ব্যাটারির উৎপাদন (শুধু সংযোজন নয়) শুরু করতে হবে। ইপিজেডগুলিতে এই মুহুর্তে কিছু অপটিক্যাল সরঞ্জাম তৈরি হয়। এগুলি বাংলাদেশের জন্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। কোন যুদ্ধাস্ত্রই এসকল সরঞ্জাম ছাড়া কার্যকর হবে না।

৭। টায়ার তৈরির সক্ষমতা বাড়াতে হবে; বিশেষ করে রেডিয়্যাল টায়ার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে কিছু বিদেশী শক্তি এদেশের গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি ধ্বংস করে ফেলে। এটা ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ফ্যাক্টরি, যেখানে ট্রাকে ব্যবহার করা কমার্শিয়াল ভেহিকল টায়ার তৈরি করা হতো। এটা ধ্বংস করে ফেলার কারণে ট্রাক টায়ার ভারত থেকে আনা ছাড়া কোন পদ্ধতিই থাকেনি। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। চীনের প্রযুক্তিতে আরও একটা টায়ার ফ্যাক্টরি (রেডিয়্যাল টায়ারসহ) তৈরি হবার প্রসেস শুরু হলেও সেটার ভবিষ্যৎ অনেক আগেই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। টায়ার তৈরির ফ্যাক্টরি এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ – সকল প্রকারের টায়ার তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন।

৮। গ্লাস তৈরির সক্ষমতাকে নতুন ধাপে নিয়ে যেতে হবে। বুলেটপ্রুফ গ্লাস এবং ফাইটার বিমানের ককপিটের ক্যানোপি তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন।

৯। আর্মার প্লেট এবং সিরামিক আর্মার তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সিরামিক এবং গার্মেন্টস শিল্পে কিছু বিশেষ দক্ষতা রয়েছে; যেগুলিকে সমন্বয় করতে হবে।
 
বর্তমানে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সংখ্যা বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। ইউক্রেনে ৫০টার মতো বিমানবন্দর থাকার কারণে তারা রুশ হামলা থেকে তাদের বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পেরেছে। ইউক্রেনের তুলনায় আকৃতিতে বাংলাদেশ অনেক ছোট। কাজেই বাংলাদেশের পুরাতন সকল বিমানবন্দরের রানওয়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে। এছাড়াও নতুন করে বহু স্থানে রানওয়ে তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে যতগুলি হাইওয়ে রয়েছে, তার সকল স্থানে খুঁজে দেখতে হবে যে, কোথায় কোথায় ফাইটার বিমান ওঠানামা করার মতো দীর্ঘ রানওয়ে তৈরি করা যায়।



তৃতীয়তঃ কৌশলগত অবকাঠামো নির্মাণে মনোনিবেশ করতে হবে।

১। বিমানবন্দরের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সংখ্যা বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। ইউক্রেনে ৫০টার মতো বিমানবন্দর থাকার কারণে তারা রুশ হামলা থেকে তাদের বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পেরেছে। ইউক্রেনের তুলনায় আকৃতিতে বাংলাদেশ অনেক ছোট। কাজেই বাংলাদেশের পুরাতন সকল বিমানবন্দরের রানওয়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে; যাতে করে মোটামুটিভাবে পরিবহণ বিমান হলেও যেন ওঠানামা করতে পারে। এছাড়াও নতুন করে বহু স্থানে রানওয়ে তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে যতগুলি হাইওয়ে রয়েছে, তার সকল স্থানে খুঁজে দেখতে হবে যে, কোথায় কোথায় ফাইটার বিমান ওঠানামা করার মতো দীর্ঘ রানওয়ে তৈরি করা যায়। সেই স্থানগুলির সারফেসকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভারত ইতোমধ্যেই হাইওয়েতে ফাইটার বিমান নামানোর পরীক্ষা চালিয়ে ফেলেছে।

২। নদীবন্দরের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বেশকিছু নদীবন্দর রয়েছে বর্তমানে; সেগুলিকে নতুন অবকাঠামো যোগ করে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর মাঝে প্রথমেই থাকবে ড্রেজিং। নদীপথে নাব্যতা না থাকলে নদীবন্দর দিয়ে কি হবে? নাব্যতা নিশ্চিত করতে ড্রেজার এবং আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়াতে হবে। ড্রেজারের ভেসেলগুলি বাংলাদেশে তৈরি হলেও ড্রেজারের কাটিং মেশিন এবং ডিজেল ইঞ্জিন আমদানির উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

৩। শিপবিল্ডিংএর ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে; বিশেষ করে খুলনা শিপইয়ার্ড ও নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে আরও অনেক স্থানে উচ্চমানের জাহাজ তৈরির ফ্যাসিলিটি গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ জাহাজ তৈরির জন্যে বরিশাল ও পটুয়াখালি এলাকা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, গজারিয়া, ভৈরব, আশুগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা ভালো এলাকা হতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং খুলনা অঞ্চলকে সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরির জন্যে আলাদাভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে।


জানুয়ারি ২০২৫। মিয়ানমার নৌবাহিনীর ফ্রিগেট পানিতে ভেসেছে। তাদের প্রথম ফ্রিগেটটা পানিতে ভেসেছে ১৩ বছর আগে। বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত ফ্রিগেট তৈরির উপযোগী একটা ডকইয়ার্ডও তৈরি করতে পারেনি! এই লজ্জা নিয়েই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।


চতুর্থতঃ সামরিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

১। বিমান সংযোজন ও নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ 'পিটি-৬', ‘বেল-২১২', ‘বেল-২০৬', ‘এমআই-১৭১' এবং 'এফ-৭' বিমান ওভারহোলিং করে থাকে। এছাড়াও 'গ্রোব জি-১২০টিপি' বিমানের কম্পোজিট স্ট্রাকচার তৈরির সক্ষমতাও রয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অতি সম্প্রতি নিজস্ব দু'টা প্রোটোটাইপ বিমান তৈরি করে উড্ডয়ন করেছে। এই সক্ষমতাগুলিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে হবে। বিমান সংযোজনের সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হবে এবং ফাইটার বিমান নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

২। নৌবাহিনীর ফ্রিগেট তৈরির সক্ষমতা অর্জন করার কথা ছিলো কয়েক বছর আগেই। মিয়ানমার তাদের নৌবাহিনীর জন্যে প্রথম ফ্রিগেট পানিতে ভাসিয়েছে ১৩ বছর আগে। বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত ফ্রিগেট তৈরির উপযোগী একটা ডকইয়ার্ডও তৈরি করতে পারেনি! এই লজ্জা নিয়েই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।

৩। ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সকল প্রকারের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন। এন্টি-ট্যাঙ্ক, ম্যানপ্যাডস, শোরাড, মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স, এন্টি-শিপ, এয়ার-টু-সারফেস, এয়ার-টু-এয়ার, সারফেস-টু-সারফেস ব্যালিস্টিক, সারফেস-টু-সারফেস ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা প্রয়োজন। এই মুহুর্তে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ওভারহোলিং (এবং প্রয়োজনে এসেম্বলি) করার সক্ষমতা রয়েছে; যেগুলিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে হবে।

৪। ড্রোন তৈরির কারখানা তৈরি করতে হবে। ড্রোন বহু প্রকারের; তবে এর মাঝে কিছু প্রকারের ড্রোনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। গোয়েন্দা কাজের জন্যে ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর (উপরে আলোচিত) সমৃদ্ধ ড্রোন প্রয়োজন। আর আক্রমণকারী ড্রোন হিসেবে 'ফার্স্ট পারসন ভিউ' বা 'এফপিভি' ড্রোন তৈরি করতে হবে। এই ড্রোনগুলি কোয়াডকপ্টার, হেক্সাকপ্টার, অক্টাকপ্টার, ফিক্সড-উইং হতে পারে। এই ড্রোনের প্রপালশন হিসেবে বিভিন্ন আকৃতির ইলেকট্রিক মোটর (উপরে মোটরের কারখানার কথা আলোচিত হয়েছে) এবং ছোট পেট্রোল ইঞ্জিন (মূলতঃ মোটরসাইকেল ইঞ্জিন) তৈরির কারখানা বসাতে হবে। এগুলিতে ব্যবহার করা জিপিএস, রিমোট-কন্ট্রোল কমিউনিকেশন ডিভাইস, লিথিয়াম ব্যাটারির (উপরে আলোচিত) আলাদা কারখানা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলির বডি (বিশেষ করে এফপিভি ড্রোনের) কার্বন-ফাইবার ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করতে হয়। কার্বন-ফাইবার কিভাবে যোগাড় করা যায়, অথবা কিভাবে এগুলি নিজেদের দেশে উৎপাদন করার প্রযুক্তি আনা যায়, সেটা খুঁজতে হবে।

৫। আর্টিলারি কামান তৈরির কারখানা প্রয়োজন। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে, ন্যাটোর মতো এয়ার সুপেরিয়রিটি না থাকলে (যেটার ব্যাপারে এখন অনেকেই সন্দিহান) যেকোন দেশকে আর্টিলারির উপরেই নির্ভর করতে হবে। ১০৫মিঃমিঃ এবং ১৫৫মিঃমিঃ আর্টিলারি ব্যারেল অবশ্যই তৈরি করতে হবে। ১০৫মিঃমিঃ, ১৫৫মিঃমিঃ আর্টিলারি এমুনিশন তৈরির ব্যাপক সক্ষমতা প্রয়োজন। এছাড়াও আরও দূরের পাল্লার টার্গেটে আঘাত করার লক্ষ্যে ১২২মিঃমিঃ, ২৩০মিঃমিঃ, ৩০০মিঃমিঃ আর্টিলারি রকেটের কারখানা করতে হবে। এছাড়াও বিমান বিধ্বংসী কামান তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন। ২০মিঃমিঃ অথবা ১৪ দশমিক ৫মিঃমিঃ (যেকোন একটা), ৩৫ অথবা ৩৭মিঃমিঃ (যেকোন একটা), ৫৭মিঃমিঃ কামান নিজস্ব কারখানায় তৈরি করতে হবে। এগুলির সাথে ব্যবহার করার জন্যে নিজস্ব তৈরি ইলেকট্রো-অপটিক ডিভাইস এবং রাডারের সমন্বয় করতে হবে।

৬। সামরিক অফরোড গাড়ির কারখানা তৈরি করতে হবে। এগুলি সকল প্রকারের পরিবহণ ছাড়াও আর্টিলারি ট্রাকটর হিসেবে কাজ করবে। এগুলির মাঝে 'বাগি' প্রকারের হাল্কা যানও প্রয়োজন, যেগুলি মোটরসাইকেলের সাথে চলার উপযোগী। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে এধরণের যানবাহন উপযোগী হবে। বেশকিছু গাড়ি প্রয়োজন, যেগুলি উভচর হবে; অর্থাৎ নদী-খাল-বিল পার হতে পারবে। গাড়িগুলিকে পরিবর্তিত করেই এধরণের উভচর যান তৈরি করা সম্ভব। এসকল গাড়িতে ব্যবহারের জন্যে ডিজেল ইঞ্জিন, স্টিল প্লেট, আর্মার, বুলেটপ্রুফ গ্লাসের কারখানার কথা উপরে উল্লিখিত হয়েছে।

৭। বন্দুকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের এসল্ট রাইফেল তৈরির সক্ষমতা মোটেই যথেষ্ট নয়। অতি দ্রুত এই উৎপাদন সক্ষমতাকে কয়েক গুণ করতে হবে। একইসাথে ৭ দশমিক ৬২মিঃমিঃ জিপি মেশিন গান এবং ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ হেভি মেশিন গান (এয়ার ডিফেন্সের জন্যে) তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এসকল বন্দুকের জন্যে ৭ দশমিক ৬২মিঃমিঃ (রাইফেল ও মেশিন গান) এবং ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ এমুনিশন উৎপাদন কয়েক গুণ করতে হবে।

৮। এয়ারড্রপ এমুনিশন এবং নেভাল মাইন তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

এছাড়াও আরও বেশকিছু সামরিক সক্ষমতা রয়েছে, যেগুলি উল্লেখ করতে থাকলে তালিকা বড় হতেই থাকবে। কিন্তু উপরে উল্লেখ করা সক্ষমতাগুলি অর্জিত না হলে এর সাথে আরও কয়েক'শ সক্ষমতা যুক্ত করাটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে।
 
কেউ কেউ এখনও দিবাস্বপ্নে বিভোর রয়েছেন। তাদেরকে বলতে হবে - ঘুম থেকে জেগে উঠুন! বাস্তবতা বুঝুন! উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার ভিত্তিগুলি বাস্তবে রূপ দিতে পারলেও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সহজ হবে না। কারণ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ কোন আদর্শিক রাষ্ট্র নয়। তারা 'প্রোএকটিভ' নয়; বরং তারা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে প্রতিক্রিয়া (রিয়্যাকটিভ) হিসেবে কিছু পরিকল্পনা করে থাকে। যেকারণে বেশিরভাগ সময়ই তারা বাইরের শক্তির প্রভাব বলয়ে আবর্তিত হয়।


উপরে দেয়া তালিকার বাইরে বাংলাদেশকে আরও অনেক কিছুই করতে হবে। যেমন, অতি দ্রুত কয়েক স্কোয়াড্রন চীনা 'জে-১০' এবং পাকিস্তানি 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান যোগাড় করতে হবে। একইসাথে অফ-দ্যা-শেলফ কিছু ফ্রিগেট (চীনা এবং আর যেখানে পাওয়া যায়) যোগাড় করতে হবে; যেগুলি আনার পর সেগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন জাহাজ তৈরি করতে কয়েক বছর লেগে যাবে; এখন সেই সময়টুকু আছে কিনা, তা সন্দেহ। পুরোনো জাহাজগুলির সাথে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং এয়ার, সারফেস ও সাব-সারফেস ড্রোনের সমন্বয় ঘটিয়ে সেগুলিকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের উপযোগী করে প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই মুহুর্তে সংখ্যা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার; যা কোনভাবেই প্রতিস্থাপনীয় নয়। মধ্যম পাল্লার এয়ার ডিফেন্স ক্ষেপণাস্ত্র (চীনা এবং তুর্কি) অবশ্যই প্রয়োজন। এগুলি না থাকলে দেশের কোন স্থাপনাই রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

ঝড় আসছে! কিন্তু বাংলাদেশ এই মুহুর্তে মোটেই প্রস্তুত নয়! বিপদে ভয় পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভয় না পেলে অনেক সময়েই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা যায় না। ভয় পেলেই শরীরের ডিফেন্সিভ মেকানিজম কাজ করা শুরু করে; আবার কোন কোন ক্ষেত্রে প্যারালাইসিসেও আক্রান্ত হতে পারে। দ্বিতীয়টা বাংলাদেশের জনগণ তাদের নেতৃত্বের কাছ থেকে কখনোই আশা করবে না। কিন্তু আশা না করলেই যে তা বাস্তবে হবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ কেউ কেউ এখনও দিবাস্বপ্নে বিভোর রয়েছেন। তাদেরকে বলতে হবে - ঘুম থেকে জেগে উঠুন! বাস্তবতা বুঝুন! উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার ভিত্তিগুলি বাস্তবে রূপ দিতে পারলেও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সহজ হবে না। কারণ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ কোন আদর্শিক রাষ্ট্র নয়। তারা 'প্রোএকটিভ' নয়; বরং তারা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে প্রতিক্রিয়া (রিয়্যাকটিভ) হিসেবে কিছু পরিকল্পনা করে থাকে। যেকারণে বেশিরভাগ সময়ই তারা বাইরের শক্তির প্রভাব বলয়ে আবর্তিত হয়।

Friday, 4 April 2025

ট্রাম্পের গ্রীনল্যান্ড চাই – এটাই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা

০৫ই এপ্রিল ২০২৫

ডেনমার্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের অধীন অঞ্চল দখল করে নিতে চাইছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত বিশ্বব্যবস্থা এখন যে আর নেই, তার আরেকটা প্রমাণ এটা। অপরদিকে এই ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইইউ, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন কানাডার প্রতিদ্বন্দ্বিতা; যা কিনা বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ। 


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে এসেই গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় নেয়ার কথা বলতে থাকেন। এর আগে প্রথম টার্মেও ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করার কথা বলেছিলেন। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বাস্তবতার সাথে যায় কিনা। তবে মার্চ মাস থেকেই গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত হতে শুরু করে। এখন অনেকেই ধরে নিচ্ছেন যে, ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্টই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ট্রাম্প কেন গ্রীনল্যান্ড চাইছেন?

গত ১২ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে 'টেক্সাস মিনারাল রিসোর্সেস'এর এনথনি মারচেজি বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডের পুরো উপকূল নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচাইতে বড় খনিজ সম্পদের ভান্ডারগুলির একটা। এই উপকূলের যেকোন স্থানে কেউ ঢিল ছুঁড়লেই একটা বিশ্বমানের খনির সন্ধান পাবে। 'ডয়েচে ভেলে' বলছে যে, এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডে মাত্র দু'টা খনিতে কাজ চলছে; যেখানে শ'খানেক মানুষ কাজ করে। সেখানে খনিজ আহরণ খুবই কষ্টকর। অন্য অনেক স্থানের চাইতেও এখানে খনিজ আহরণ অনেক ব্যববহুল। এখানে কোন রাস্তা নেই এবং ভূপ্রকৃতি খুবই বন্ধুর। চীনের বাইরে 'রেয়ার আর্থ' খনিজের সবচাইতে বড় উৎসগুলির একটা ২০২১ সালে গ্রীনল্যান্ড সরকার বন্ধ করে দেয়। কারণ ঐ একই সাথে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে এবং তা জনবসতির বেশ কাছাকাছি। আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে কৌশলগত সমুদ্রপথ চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; যার মাঝে একটা গিয়েছে রাশিয়ার উত্তর উপকূল ঘেঁষে; যা 'নর্দার্ন সী রুট' বা 'এনএসআর' নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টা গিয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পাশ দিয়ে কানাডার মাঝ দিয়ে; যা 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নামে পরিচিত। তৃতীয়টা গিয়েছে একেবারে উত্তর মেরুর মাঝ দিয়ে; যা 'ট্রান্স পোলার সী রুট' হিসেবে পরিচিত। এই রুটগুলি এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সমুদ্রপথকে অনেক কমিয়ে ফেলতে পারে। বর্তমানে আর্কটিক অঞ্চল দিয়ে জাহাজ পার করতে হলে আইস ব্রেকার জাহাজ লাগে; যা বেশ ব্যয়বহুল। কাজেই এখনও পর্যন্ত খনিজ আহরণ এবং সমুদ্রপথ ব্যবহার করার ব্যাপারটা ভবিষ্যতের আলোচনা। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডের জনগণের আয় শুধুমাত্র মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। একারণে ডেনমার্ক সরকার বছরে প্রায় ৫'শ মিলিয়ন ইউরো বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। তবে গ্রীনল্যান্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ডেনমার্ক শক্তিশালী দেশগুলির সাথে বড় রকমের দেনদরবার করতে পারে; যা ডেনমার্কের আকারের তুলনায় বেশি শক্তির প্রতীক।

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক টিম মার্শাল 'বিবিসি'কে বলছেন যে, এর আগেও ১৯৫০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করতে চেয়েছিল। কাজেই একটা অঞ্চল ক্রয় করার ব্যপারটা নতুন নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে ছাড়াও সামরিক দিক থেকে গ্রীনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর মেরুর উপর দিয়ে রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে কম দূরত্ব অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারে। আবার একইসাথে, রুশ সাবমেরিনের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে স্বল্প দূরতের রুট হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে। গ্রীনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলির বেশিরভাগই গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কানাডার কাছাকাছি। গ্রীনল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই সবচাইতে বেশি লাভবান হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং মাইক্রোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইরকমই একটা বোঝাপড়া মার্কিনীরা করতে পারে গ্রীনল্যান্ডের সাথে। নব্যস্বাধীন গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথমে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।
 
আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে কৌশলগত সমুদ্রপথ চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; যার মাঝে একটা গিয়েছে রাশিয়ার উত্তর উপকূল ঘেঁষে; যা 'নর্দার্ন সী রুট' বা 'এনএসআর' নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টা গিয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পাশ দিয়ে কানাডার মাঝ দিয়ে; যা 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নামে পরিচিত। তৃতীয়টা গিয়েছে একেবারে উত্তর মেরুর মাঝ দিয়ে; যা 'ট্রান্স পোলার সী রুট' হিসেবে পরিচিত। এই রুটগুলি এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সমুদ্রপথকে অনেক কমিয়ে ফেলতে পারে।


ডেনমার্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে

মার্চের শেষ সপ্তাহে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী উশা ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হবার পর গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। এই ভিজিট সম্পর্কে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, এই ভ্রমণ গ্রীনল্যান্ডের প্রয়োজন নেই এবং এটা গ্রীনল্যান্ড চাচ্ছেও না। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের উপর যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন যে, এই চাপের মুখে তারা বাধা প্রদান করবেন। হৈচৈ শুরু হবার পর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দেন যে, হৈচৈ শুরু হবার কারণে তিনি নিজেও এখন তার পরিবারের সাথে গ্রীনল্যান্ডে যাবেন। তবে তিনি বলেন যে, তার এই সফর গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন স্পেস ফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ রাডার রয়েছে; যার মাধ্যমে উত্তর মেরুর দিক থেকে ধেয়ে আসা পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা পাবে যুক্তরাষ্ট্র। 'গ্রীনল্যান্ডিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন'এর মারকাস ভ্যালেন্টিন 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর শুধুমাত্র সামরিক ঘাঁটিতে সীমাবদ্ধ করার ফলে সেখানে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এবং বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের জনগণ ভ্যান্স পরিবারের সাথে অসহযোগিতা করার পথে হেঁটেছে। সরকারিভাবে ভ্যান্সের পরিবারকে গ্রহণ না করার কথাও বলা হয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পক্ষ থেকে। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে, স্বল্প মেয়াদে হলেও তাদের প্রতিবাদ অনেকটাই সফল হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী। তবে গ্রীনল্যান্ডের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করতে ইচ্ছুক। 'বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আপাততঃ গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীরা একটা ছোট জয় পেয়েছে বলে মনে হলেও আসন্ন দিনগুলিতে গ্রীনল্যান্ডের উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডে ৭৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এই ঘাঁটিকে যতটা ইচ্ছা বৃদ্ধি করতে পারবে। তাহলে এখানে সমস্যাটা কোথায়, তা স্পষ্ট নয়। গ্রীনল্যান্ডের জনগণও হয়তো ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে চাইবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সবকিছু অতি দ্রুত চাইছে।

তবে ২৯শে মার্চ গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সফরের সময় জেডি ভ্যান্স এক ভাষণে ডেনমার্ক সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, ডেনমার্কের প্রতি তার বার্তা খুবই পরিষ্কার – গ্রীনল্যান্ডের জনগণের জন্যে ডেনমার্ক যথেষ্ট বিনিয়োগ করেনি এবং গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও ডেনমার্ক কিছু করেনি। তিনি বলেন যে, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্ক গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীদের সাথে নয়; বরং তা হলো ডেনমার্কের নেতৃত্বের সাথে; যারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। ভ্যান্স এমন এক সময়ে গ্রীনল্যান্ড সফর করেছেন, যখন গ্রীনল্যান্ডের সরকার পরিবর্তন হচ্ছিলো। ভ্যান্সের সফরের পরপরই নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জেন্স ফ্রেডেরিক নিয়েলসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, সরকার পরিবর্তনের এমন এক সময়ে ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর করতে আসাটা একটা বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের প্রতি অসন্মান দেখানো। এটা একটা লজ্জাজনক অধ্যায় ছিল।
 
গ্রীনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলির বেশিরভাগই গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কানাডার কাছাকাছি। গ্রীনল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই সবচাইতে বেশি লাভবান হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং মাইক্রোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইরকমই একটা বোঝাপড়া মার্কিনীরা করতে পারে গ্রীনল্যান্ডের সাথে। নব্যস্বাধীন গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথমে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।


ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফরের একই দিন, ২৯শে মার্চ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অতি প্রয়োজন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে নয়; সারা দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি চীনা এবং রুশ জাহাজে ভরে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্ক বা অন্য কারুর উপর এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ভার ছেড়ে দিতে পারে না। এক'শ বছর আগেও গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি খোলা ছিল না। কিন্তু এখন আইসব্রেকার জাহাজের মাধ্যমে গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশে দিয়ে রাশিয়া এবং চীনে যাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, তার আশা ডেনমার্ক এটা বুঝতে পারছে এবং ইইউও এটা বুঝতে পারছে। আর না বুঝতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে বোঝাবে। দু'দিন পর ৩১শে মার্চ এক ভিডিও বার্তায় ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন বলেন যে, ডেনমার্ক সরকার সমালোচনা পছন্দ করে; তবে যে ভাষায় মার্কিনীরা কথা বলছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে কেউ কাছের বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে কথা বলে না। তিনি বলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনও ডেনমার্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কাছের বন্ধু হিসেবেই দেখেন। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডে তার সামরিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারে। ১৯৪৫ সালে গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টা সামরিক ঘাঁটি ছিল এবং কয়েক হাজার সেনা সেখানে মোতায়েন ছিল। বর্তমানে একটা ঘাঁটিতে মাত্র ২'শ সেনা রয়েছে। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী একত্রে অনেক কিছুই করা সম্ভব। একসময় শুধু ডেনমার্ক নয়, সকলেই মনে করেছিল যে, আর্কটিকে কোন নিরাপত্তা হুমকি নেই। বর্তমানে পরিস্থতি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। একারণেই কিছুদিন আগেই ডেনমার্ক আর্কটিকের নিরাপত্তায় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ভুলে গেলে চলবে না যে, গ্রীনল্যান্ড ন্যাটোর অংশ এবং ন্যাটোর নিরাপত্তার মাঝে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তাও রয়েছে।

৩রা এপ্রিল ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা নেবে না। গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা হলো গ্রীনল্যান্ডবাসীর। গ্রীনল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব, সীমানা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে সকলকে একত্রিত থাকতে হবে; সেটা ডেনমার্ক এবং গ্রীনল্যান্ডের মাঝে যে আলোচনাই হোক না কেন। তিনি বলেন যে, তার ধারণা এখন পর্যন্ত তারা কাজটা ঠিকমতোই করতে পেরেছেন; তবে এটা পরিষ্কার যে, তাদেরকে খোলা জানালাগুলিকে আরও ভালোভাবে আটকাতে হবে। এটা পরিষ্কার যে, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী গ্রীনল্যান্ডবাসীদের মতামতকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের পক্ষে আনতে পারেননি। আর ৪ঠা এপ্রিল ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিওর সাথে আলোচনার পর সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি রুবিওকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং তা ডেনমার্কের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ।
 
উত্তর মেরুর উপর দিয়ে রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে কম দূরত্ব অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারে। আবার একইসাথে, রুশ সাবমেরিনের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে স্বল্প দূরতের রুট হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রীনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে নয়। এটা গ্রীনল্যান্ডের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি সুবিধা দেয়। 


যুক্তরাষ্ট্র কি গ্রীনল্যান্ডকে আলাদা করতে চায়, নাকি দখল করতে চায়?

'জার্মান মার্শাল ফান্ড'এর ফেলো সোফি আর্টস 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের বক্তব্য সঠিক নয়। ডেনমার্ক সরকার গ্রীনল্যান্ডের বাজেটের অর্ধেকের বেশি দিয়ে থাকে। এর বাইরেও রয়েছে প্রতিরক্ষা সহায়তা; যা ডেনমার্ক তার বন্ধুপ্রতীম দেশগুলির সাথে একত্রে দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের হুমকির পর গ্রীনল্যান্ড ও আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার জন্যে ২ বিলিয়ন ডলার খরচের ঘোষণা দিয়েছে ডেনমার্ক। এটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যে বর্তমানের ১০ গুণ বেশি খরচ। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রীনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে নয়। এটা গ্রীনল্যান্ডের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি সুবিধা দেয়। তবে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার সাথে পুরো আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা জড়িত। এখানে ন্যাটো জোটের স্বার্থ জড়িত। জোটকে ছোট করে এখানে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে ডেনমার্ক মার্কিনীদের সাথে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং গ্রীনল্যান্ডকে ডেনমার্ক থেকে আলাদা করার কথাও শোনা যাচ্ছে।

‘এএফপি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্ক থেকে পুরোপুরিভাবে আলাদা হবার চেষ্টা করছে। গ্রীনল্যান্ডবাসীদের একটা প্রধান অভিযোগ হলো, ডেনমার্ক সরকার ঐতিহাসিকভাবেই গ্রীনল্যান্ডের ইনুইট আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে দমন করেছে। আদিবাসীদেরকে জোর করে বন্ধাত্ব বরণ করিয়েছে এবং তাদের সন্তানদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে গেছে ডেনমার্ক সরকার। গ্রীনল্যান্ডে অনেকেই মনে করেন যে, ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডবাসীদেরকে নিচু জাতের নাগরিক হিসেবে দেখে। তবে তারা মনে করে না যে, তাদের ভূমি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি হবার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের প্রায় সকল জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও ট্রাম্পের পরিকল্পনার পক্ষে খুব কমই রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, খুব দ্রুত ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। 'ডয়েচে ভেলে' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৭২১ সালে ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এরপর দু'শ বছর ধরে ইনুইট জাতির উপর খ্রিস্টান ধর্ম এবং ড্যানিস ভাষা চাপানো হয়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই গ্রীনল্যান্ডে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করা হতে থাকে। একসময় গ্রীনল্যান্ডকে নিজস্ব পার্লামেন্ট এবং সরকার দেয়া হয়। বর্তমানে গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে একটা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি গ্রীনল্যান্ড নিজে নিয়ন্ত্রণ করলেও নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতি দেখাশোনা করে ডেনমার্ক। গ্রীনল্যান্ডের সরকার বলছে যে, কোন একটা সময় তারা ডেনমার্ক থেকে আলাদা হবার লক্ষ্যেই এগুচ্ছে। ৮৪ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ড তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে তাদের অফিস খুলেছে। তারা খনিজ সম্পদ আহরণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউএর সাথেও সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ গ্রীনল্যান্ডের অর্থনীতিতে অনেকেই অংশীদার হতে চাইছে। একারণেই ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডের ইস্যুকে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে রেখেছে।
 
মার্চ ২০২৫। মার্কিন সেনাদের সাথে গ্রীনল্যান্ডের সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে অঞ্চল কেনাবেচা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল ক্রয় করা; যার মাঝে রয়েছে লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আলাস্কা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্রের বিনিময়ে ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ পেয়ে যায়। তাই আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যেতে থাকায় গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় অবাক হবার কিছু নেই। 


প্রাক্তন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা ফিলিপ ইনগ্রাম ব্রিটিশ মিডিয়া 'দ্যা সান'কে বলছেন যে, গ্রীনল্যান্ডের কোন সামরিক বাহিনী নেই। যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যেকোন দিন সেখানে হেঁটে ঢুকে যেতে পারে। তবে এর ভূরাজনৈতিক ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। তার ধারণা, গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই কানাডার সাথে যুক্ত। ট্রাম্প সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীনল্যান্ড, কানাডা এবং পানামা নিয়ে যখন কথা বলেছেন, তখন সর্বদাই তিনি সমুদ্রপথের প্রসঙ্গ এনেছেন। অর্থাৎ তিনি এই অঞ্চলগুলিকে সমুদ্রবাণিজ্য এবং লজিস্টিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। ন্যাটোর সদস্য দেশ কানাডা এখনও পর্যন্ত তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষার পিছনে খরচ করছে না। এবং 'ফাইভ আইজ' ইন্টেলিজেন্স সমঝোতার মাঝে কানাডাকে দুর্বল সদস্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। খুব সম্ভবতঃ ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডকে হুমকির মাঝে রেখে কানাডার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। কানাডার উপর বাণিজ্যিক শুল্ক আরোপের ব্যাপারটাও খুব সম্ভবতঃ একই সূত্রে গাঁথা।

ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া 'বিএফবিএস ফোর্সেস নিউজ'এর এক আলোচনায় ব্রিটিশ সামরিক চিন্তাবিদ ক্যারোলাইন কেনেডি-পাইপ বলছেন যে, মূলতঃ ২০১৭-১৮ সালের দিকে চীনারা যখন গ্রীনল্যান্ডে বিমানবন্দরের রানওয়ে তৈরি করতে ইচ্ছুক হয়, তখনই মার্কিনীরা এবং ড্যানিশরা নড়েচড়ে বসে। দুই দেশের প্রতিরোধের মুখে চীনা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডার একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। এটাও গ্রীনল্যান্ডের হিসেবে মাঝে নিতে হবে। কানাডা এখনও পর্যন্ত আর্কটিকে তাদের সক্ষমতার অনেক নিচে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারাও তড়িঘড়ি করে আর্কটিক নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা উভয়েই আর্কটিককে রাশিয়ার চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেছে। নরওয়ের ডিফেন্স কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের প্রফেসর টরমড হাইয়ার বলছেন যে, আর্কটিকে নরওয়ের অধীনে থাকা সুয়ালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে; যা কিনা গ্রীনল্যান্ডের সমান্তরালে দরকষাকষির অংশ হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী এই দ্বীপপুঞ্জকে বাণিজ্যিকভাবে সকলের জন্যে খোলা রাখা হলেও এর সার্বভৌমত্বকে নরওয়ের অধীনে দেয়া হয়; যা এখন রুশরা প্রশ্ন করছে। এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে ন্যাটো রুশ সাবমেরিনের উপর নজরদারি করে। ইতোমধ্যেই সেখানে রুশ এবং চীনারা গবেষণা কাজ চালাবার জন্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে অঞ্চল কেনাবেচা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল ক্রয় করা; যার মাঝে রয়েছে লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আলাস্কা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্রের বিনিময়ে ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ পেয়ে যায়। তাই আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যেতে থাকায় গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় অবাক হবার কিছু নেই। ডেনমার্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের অধীন অঞ্চল দখল করে নিতে চাইছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত বিশ্বব্যবস্থা এখন যে আর নেই, তার আরেকটা প্রমাণ এটা। অপরদিকে এই ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইইউ, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন কানাডার প্রতিদ্বন্দ্বিতা; যা কিনা বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ।