Saturday, 8 March 2025

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ২০২৫ – রাইজ অব এইচটি

০৯ই মার্চ ২০২৫

ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে আগমণ যুক্তরাষ্ট্রে শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে; যার প্রমাণ ন্যাটো, ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে দৃশ্যমান। আটলান্টিকের ওপাড়ে এহেন বড় পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে ঢাকায় এইচটি-র উত্থান একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ৭ই মার্চ ২০২৫ সত্যিই ছিল একটা ঐতিহাসিক দিন!


গত ০৭ই মার্চ রমজান মাসের প্রথম জুমআর দিনে ঢাকার বাইতুল মুকাররম মসজিদের উত্তর গেটে হিযবুত তাহরীর বা এইচটি-র মিছিল নিয়ে পুরো দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে। সেকুলার ব্যক্তিত্বদের মাঝে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, নিষিদ্ধ্ব ঘোষণা করা এই দল কিভাবে দিনে দুপুরে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘোষণা দিয়ে একটা মিছিলের আয়োজন করতে পারে? অনেকেই মন্তব্য করছেন যে, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় ব্যাপক দমন-পীড়নের মাঝ দিয়ে যাবার পরেও কি করে তারা ১৬ বছর পর এতবড় মিছিলের আয়োজন করতে পেরেছে? অনেকেই আইনশৃংখলা বাহিনীর সমালোচনা করেছেন যে, কেন পুলিশ আরও কঠোর হলো না। কেউ কেউ বলছেন যে, পুলিশ কেন গুলি চালালো না? অবশ্য যারা বুঝতে পেরেছেন যে, এইচটি-র মিছিলে গুলি চালালে এই পুলিশ আর হাসিনা সরকারের জুলুমবাজ পুলিশের মাঝে কোন পার্থক্য থাকে না, তারা কিন্তু অন্ততঃ রয়েসয়ে কথা বলেছেন। তদুপরি অনেকেই বলেছেন যে, পুলিশের উচিৎ ছিল এইচটি-র সদস্যরা যাতে মিছিল শুরুই করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা। এই কথা বলেও তারা অবশ্য ফেঁসে গেছেন যে, ঠিক এই কাজটাই আওয়ামী সরকার করেছিল বিএনপি-জামাতের বিরুদ্ধে - রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করার আগেই সেটাকে পুলিশ এবং গুন্ডাবাহিনী দ্বারা লন্ডভন্ড করে দেয়া। পুলিশ অবশ্য গত সাত মাসের অক্ষমতার রেকর্ড অক্ষুন্ন রেখেই নিজেদের অবস্থানকে তুলে ধরেছে - এখানে তো অনেক সাধারণ মুসল্লী ছিল। অর্থাৎ পুলিশ অন্ততঃ বুঝেছে যে, যখন বহু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের নির্দেশ মান্য করার জন্যে মামলা ঝুলছে, তখন নতুন করে কোন অমানবিক কাজের ফাঁদে আরেকবার পা দেয়াটা বিচক্ষণের কাজ হবে না। তারা অন্ততঃ এটা বুঝেছেন যে, কোন সরকারই স্থায়ী নয় – এমনকি আওয়ামী সরকার - যারা একসময় যখন মনে করতো যে তারা জার্মানির 'থাউজ্যান্ড ইয়ার রাইখ'এর মতো কিছু একটা বাংলাদেশের মাটিতে কায়েম করবে - তাদেরও পতন হয়েছে। সুতরাং আর কাউকেই পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করে আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মতো বোকামি তারা করতে রাজি ছিল না। তবে সরকারের চাপ ছিল বলেই তারা কাপুরুষের মতো মিছিলের পেছন থেকে কোন উস্কানি ছাড়াই টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং লাঠিচার্চের মাধ্যমে হামলা করেছে। এতে মিছিলকারীদের তেমন কোন ক্ষতি না হলেও পুলিশের কপালে কিন্তু আবারও জুলুমবাজের তকমা জুটে গেলো! বেচারা পুলিশ!
 
নিষেধাজ্ঞা না তোলার পরেও এইচটি তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে পেরেছে; এবং একইসাথে ইউনুস সরকার কেন হাসিনা সরকারের জুলুমবাজ নীতিকে চালিয়ে নিলো, সেটার জন্যে ইউনুস সরকারের গণতন্ত্র রক্ষা করার কৌশলও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কারণ ইউনুস সরকার যদি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে সেটাকে পুলিশী কর্মকান্ডের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে কেন? দুর্বল গণতন্ত্রকে যদি স্ক্যাচে ভর করে চলতে হয়, তাহলে সেটা এইচটি-র বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে লড়বে কিভাবে? প্রকারান্তরে হাসিনার সিদ্ধান্তকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে পুলিশি ব্যবস্থা প্রয়োগ করে সরকার এইচটি-র কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক হারই স্বীকার করে নিয়েছে।


এইচটি কতটা সফল ছিল?

এখন প্রশ্ন হলো, এইচটি-র জন্যে এটা কি সফলতা ছিল কিনা? এটা বুঝতে হলে দেখতে হবে যে, তারা এর মাধ্যমে কি করতে চেয়েছে। 'মার্চ ফর খিলাফত' নামের প্রকল্প এবং এর ন্যারেটিভগুলি মোটামুটিভাবে ৩রা মার্চ থেকে পোস্টার আকারে সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে যেতে থাকে। এতে একদিকে যেমন এইচটি তাদের দলীয় সক্ষমতার প্রমাণ দেয়, তেমনি সমাজের মাঝে তাদের সরাসরি ও চাপা সমর্থনের প্রমাণও সামনে চলে আসে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই তারা দিনের বেলায় পোস্টার লাগিয়েছে; এবং অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ তাদেরকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। পুলিশ এক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নীরব ভূমিকা পালন করাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছে। অন্ততঃ আওয়ামী সময়ে এইচটি-র সদস্যদের ধরে ধরে আয়নাঘরে ছুঁড়ে ফেলার মতো বাজে কাজের দুর্গন্ধ তাদের ইউনিফর্মে যখন লেগে আছে, তখন পুলিশ বক্সের উপর এইচটি-র পোস্টার লাগানোতে বাধা দিয়ে সেই জঘন্য স্মৃতি তারা আর সামনে আনতে চায়নি। তাই পোস্টার লাগানো চলেছে; যে যা কিছুই মনে করুক; এটাই বাস্তবতা। যারা অভিযোগ করছেন, তাদেরকে বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে।

মোটকথা এইচটি বাস্তবতাকে তাদের পক্ষে পরিবর্তন করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে; যা অবশ্য ২০২৪এর ০৫ই অগাস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হলেও ১৫ বছরের শক্তিশালী রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ফলাফল হিসেবেই এসেছে। কেননা, আওয়ামী সময়ের ১৫ বছর তারা যদি কোন কাজ করতে না-ই পারতো, তাহলে কেউই বলতে পারতো না যে, এইচটি ০৫ই অগাস্টের অভ্যুত্থানের অংশীদার। আর কেউ যদি এইচটি-র নাম না-ই জানতো, তাহলে তারা আওয়ামী লীগের পতনের পরপরই বাইতুল মুকাররমের উত্তর গেটে দু'টা বড় বড় মিছিল করতে সক্ষম হতো না। এছাড়াও তারা গত ২৯শে নভেম্বর একটা আন্তর্জাতিক অনলাইন কনফারেন্সও করেছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এইচটি-র উপর থেকে হাসিনা সরকারের দেয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিলেও এই কর্মকান্ডগুলিকে আটকানো সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা না তোলার পরেও এইচটি তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে পেরেছে; এবং একইসাথে ইউনুস সরকার কেন হাসিনা সরকারের জুলুমবাজ নীতিকে চালিয়ে নিলো, সেটার জন্যে ইউনুস সরকারের গণতন্ত্র রক্ষা করার কৌশলও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কারণ ইউনুস সরকার যদি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে সেটাকে পুলিশী কর্মকান্ডের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে কেন? দুর্বল গণতন্ত্রকে যদি স্ক্যাচে ভর করে চলতে হয়, তাহলে সেটা এইচটি-র বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে লড়বে কিভাবে? প্রকারান্তরে হাসিনার সিদ্ধান্তকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে পুলিশি ব্যবস্থা প্রয়োগ করে সরকার এইচটি-র কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক হারই স্বীকার করে নিয়েছে।
 
তারা যে ব্যাপারটা ধরতেই পারেনি তা হলো, এইচটি-র পক্ষে বা বিপক্ষে যেকোন কিছু লিখলেই সেটা এইচটি-কে সহায়তা করবে। কারণ এইচটি হলো একটা আদর্শিক দল; যারা সকল মুসলিমকে নিজেদের দাওয়ার আওতায় ধরে। অর্থাৎ তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, সামরিক অফিসার, শিক্ষক, চিন্তাবিদ, যে কাউকে দাওয়া করে; বিশেষ করে যারা সমাজের এলিট শ্রেণি। বর্তমানে কেউ কেউ বলছে যে, এইচটি-র বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে সখ্যতা রয়েছে। আবার আরেক দল বলছে যে, এইচটি-র পেছনে আওয়ামী লীগের পান্ডারা লুকিয়ে আছে। 


এইচটি-র ব্যাপারে হাসিনা সরকারের নীতি

গত ১৫ বছর হাসিনা সরকার মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের গাইডলাইন অনুযায়ী চলেছে। এইচটি হলো একটা আদর্শিক সংগঠন। তাদেরকে হয় আদর্শিক কাউন্টার-ন্যারেটিভের মাধ্যমে আটকাতে হবে; নতুবা তাদের কথা জনগণের কাছে যাতে একেবারেই পৌঁছাতে না পারে, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমটা বেশ কঠিন। কারণ এইচটি কোন জিহাদী গ্রুপ নয়; যার বিরুদ্ধে সহজেই কোন ন্যারেটিভ তৈরি করে সাধারণ মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা থেকে দূরে রাখা সম্ভব। একারণে হাসিনা সরকার দ্বিতীয় পদ্ধতিটা অনুসরণ করেছে; যদিও তাদের সামনে আর কোন পদ্ধতিও খোলা ছিল না। কারণ ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে ভারত এবং আওয়ামী লীগের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার ব্যাপারে লিফলেট ইস্যু করার পর এইচটি আওয়ামীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়। একইসাথে এইচটি হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্যে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের দিকে আহ্বান করতে থাকে। নিষেধাজ্ঞা আসাটা ছিল প্রায় অবধারিত। এটা জানা সত্ত্বেও তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি এবং পরবর্তীতে অনেক বছর ধরে ব্যাপক জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছে। বাংলাদেশের আইনে কোন অপরাধ প্রমাণিত না হলেও কোন কারণ ছাড়াই তাদের সদস্যদেরকে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছিল। আয়নাঘরে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে মারত্মক নির্যাতন করা হয়েছিল।

তবে এই ১৫ বছরের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল টোটাল মিডিয়া ব্ল্যাকআউট। সকল মিডিয়াকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিলো, যাতে করে কোন মিডিয়াতে এইচটি-র কোন কর্মকান্ড না আসে। এই সুযোগে হাসিনা সরকার এইচটি-র বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য ছড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। কারণ জগগণ শুধু সরকার-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াই দেখতে পেতো। এরপরেও এইচটি এই সময়ে তাদের কর্মকান্ডকে চালিয়ে নিতে পেরেছে; যা কিনা যে কোন সাধারণ রাজনৈতিক দলের জন্যে প্রায় অসম্ভব কাজ। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশে এইচটি-র অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে। কারণ এইচটি বিভিন্ন দেশে ভয়াবহতম একনায়ককে মোকাবিলা করেছে; যাদের মাঝে ছিল ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মিশরের হোসনি মুবারক এবং উজবেকিস্তানের ইসলাম কারিমভ। গ্লোবাল আদর্শিক দল হবার কারণে তারা বাংলাদেশে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের মাঝে শুধু টিকেই যায়নি; নিজেদের দলকে আরও বড় ও মজবুত করেছে। ঢাকার স্বনামধন্য স্কুল-কলেজের ছাত্ররা কালেমা খচিত পতাকা নিয়ে মিছিল করার পর দিল্লীতে অনেকেরই ঘাম ঝড়ে গিয়েছে। কারণ ভারত মনে করেছে যে, এটা এইচটি-ই করেছে। ঢাকায় জেনারেশন-জেড (জেন-জি)এর পতাকা মিছিল দিল্লীর জন্যে ছিল অশনি সংকেত।

০৫ই অগাস্টের পরিবর্তনের পর এইচটি-র জন্যে সবচাইতে বড় ব্যাপার ছিল প্রকাশ্যে দাওয়ার কাজ করতে পারা। এটা অবশ্য পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে। তথাপি মিডিয়া ব্ল্যাকআউট কিন্তু ঠিকই চলেছে। এই ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে, যখন 'মার্চ ফর খিলাফত' অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পুলিশের বিবৃতি আসে এবং সকল মিডিয়া এটাকে ফলাও করে প্রচার করে। এটা ঠিক যে, পুলিশের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে এইচটি-র অনেক সমর্থকই হয়তো মিছিলে যোগ দেয়নি। তথাপি যে পরিমাণ প্রচার পুলিশ এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তারা পেয়েছে, তাতে অনুষ্ঠানের আগেই তাদের অর্ধেক বিজয় হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এইচটি-র বড় একটা বিজয় হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠানের আগেই। আর অনুষ্ঠানের দিন জুমআর নামাজ শেষ হবার সাথেসাথেই যখন দেখা গেলো যে, হাজারো মুসল্লির বিশাল জনস্রোত এইচটি-র সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে, তখন বাকি অর্ধেক বিজয়ও তারা পেয়ে গেছে। কারণ নিষেধাজ্ঞার পরেও এত মানুষ এই মিছিলে যোগ দেবে, এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি!

বাকিটা ছিল ইতিহাস। যে এইচটি ১৫ বছরে মিডিয়াতে আসতে পারেনি, তারা ৭ই মার্চ ছিল সকল মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম। প্রকৃতপক্ষে সেদিন এইচটি ছিল বাংলাদেশের একমাত্র শিরোনাম! এটা এই দলকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গেছে, তা যারা ভূরাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন তাদের বোঝার কথা। এইচটি-র টার্গেট অডিয়েন্স ছিল মূলতঃ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা; যারা এইচটি-র সক্ষমতার একটা চাক্ষুশ প্রমাণ পেলো। অন্ততঃ তাদের টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে এইচটি-র সন্মান যে বহুগুণে বেড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের দমন পীড়নের পরেও এইচটি যখন এতবড় জনসমাগম করতে সক্ষম হয়েছে, তখন এদেশের সেকুলার সমাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত পুলিশকে দোষারোপ করেছে; যেখানে সকলেই জানে যে, সারা দেশের কোথাও নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতা পুলিশের নেই। কোন বুদ্ধিবৃত্তিক কাউন্টার-ন্যারেটিভ বের করতে না পেরে হাসিনা সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুলুমবাজ নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারটা সেকুলার চিন্তাবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিউয়াত্বকেই তুলে ধরে। অথচ এইচটি-র কন্ঠরোধ করার এই নীতিতে তাদের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রধান একটা স্তম্ভ বাক-স্বাধীনতা যে ভূলুন্ঠিত হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের খেয়ালই নেই।


এইচটি-র বিরুদ্ধে প্রচারণা - লাভ কার?

বাংলাদেশের পুরো সেকুলার সমাজের ব্যাপক প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গেলো কিভাবে এইচটি-কে জনগণের সামনে খারাপভাবে তুলে ধরা যায়। সত্যাসত্য অনেক কিছুই সোশাল মিডিয়াতে ভরিয়ে দিতে থাকে অনেকে। অথচ তারা যে ব্যাপারটা ধরতেই পারেনি তা হলো, এইচটি-র পক্ষে বা বিপক্ষে যেকোন কিছু লিখলেই সেটা এইচটি-কে সহায়তা করবে। কারণ এইচটি হলো একটা আদর্শিক দল; যারা সকল মুসলিমকে নিজেদের দাওয়ার আওতায় ধরে। অর্থাৎ তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, সামরিক অফিসার, শিক্ষক, চিন্তাবিদ, যে কাউকে দাওয়া করে; বিশেষ করে যারা সমাজের এলিট শ্রেণি। বর্তমানে কেউ কেউ বলছে যে, এইচটি-র বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে সখ্যতা রয়েছে। আবার আরেক দল বলছে যে, এইচটি-র পেছনে আওয়ামী লীগের পান্ডারা লুকিয়ে আছে। যেটা এরা কেউই চিন্তা করতে পারছে না তা হলো, এইচটি-র এব্যাপারে কোন মাথাব্যাথা থাকবে না। কারণ এত বছরে এইচটি-র কোন ন্যারেটিভে দেখা যাবে না যে, তারা অন্য কারুর কর্মকান্ডকে অনুসরণ করে নিজেদের কর্মকান্ডকে সাজিয়েছে। তারা সর্বদাই নিজেদের অদর্শকে সমুন্নত রেখে তাদের লক্ষ্য ঠিক করেছে এবং সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিভিন্ন কর্মকান্ড করেছে। অর্থাৎ তারা সর্বদাই 'প্রোএকটিভ' থেকেছে; কখনোই 'রিএকটিভ' হয়নি। কাজেই এটা আশা করা যায় না যে, তারা কারুর মিথ্যা তথ্য ছড়ানোতে 'রিএকশন' দেখাবে। বরং এতে এইচটি-র ব্যাপারে সমাজে আরও বেশি কৌতুহল তৈরি হবে এবং আরও বেশি আলোচনা হবে; যেখানে এইচটি-কে কেউই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে হারাতে সক্ষম হবে না। কারণ তাদের বিরুদ্ধে কাউন্টার-ন্যারেটিভ তৈরি করাটা যথেষ্টই কঠিন। মোটকথা, এর মাধ্যমে এইচটি আবারও বাস্তবতাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। একসময় তাদের ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলতো না; আর এখন তাদের কথা সকলের মুখে মুখে। এটা এইচটি-র জন্যে অনেক বড় একটা বিজয়।

পুরো বাংলাদেশের মানুষ অবাক হয়ে দেখেছে কিভাবে এইচটি ঘোষণা দিয়ে বাইতুল মুকাররমে মিছিল করেছে; সেটাও আবার পুলিশের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও। হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের দমন পীড়নের পরেও এইচটি যখন এতবড় জনসমাগম করতে সক্ষম হয়েছে, তখন এদেশের সেকুলার সমাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত পুলিশকে দোষারোপ করেছে; যেখানে সকলেই জানে যে, সারা দেশের কোথাও নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতা পুলিশের নেই। কোন বুদ্ধিবৃত্তিক কাউন্টার-ন্যারেটিভ বের করতে না পেরে হাসিনা সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুলুমবাজ নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারটা সেকুলার চিন্তাবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিউয়াত্বকেই তুলে ধরে। অথচ এইচটি-র কন্ঠরোধ করার এই নীতিতে তাদের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রধান একটা স্তম্ভ বাক-স্বাধীনতা যে ভূলুন্ঠিত হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের খেয়ালই নেই। অপরদিকে সেকুলার রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরা হতবিহ্বল হয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছে - বলছে যে, এইচটি উমুক বা তুমুক দলের সাথে রয়েছে। এইচটি কিছুই বলবে না। তারা তো আদর্শিক দল হবার কারণে সকলকেই দাওয়া করে। তাই তারা সকলকেই তাদের নিজেদের লোক মনে করে। কাজেই কেউ যদি বলে যে, এইচটি ওদের লোক, তারা কখনোই এতে ব্যাথিত হবে না। কারণ এতে তাদের সংখ্যা শুধু বৃদ্ধিই পায়। শুধুমাত্র এই বাস্তবতাটুকু অনুধাবন করার সক্ষমতাও যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবিদের নেই, সেটা আজ প্রমাণিত সত্য। বাংলাদেশের পুরো সেকুলার সমাজ আজকে এইচটি-র কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত! এটা ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও দিনটাকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। কারণ প্রথমতঃ এইদিনের মিছিল ছিল ৩রা মার্চের খিলাফত পতন দিবসের ১০১তম (ইংরেজি ক্যালেন্ডারে) বর্ষপুর্তি উপলক্ষে; যা সারা বিশ্বে রমজানের প্রথম জুমআর দিনে একযোগে পালিত হয়েছে। আর দ্বিতীয়তঃ ঢাকায় এইচটি-র এতবড় উত্থান ওয়াশিংটন ও দিল্লীর জন্যে বড় একটা চিন্তার বিষয়। ওয়াশিংটনে যখন বড় রকমের পরিবর্তন চলছে, দিল্লীর নেতৃত্ব তখন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বিপদ গুণছে। ০৫ই অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিভিন্ন সাবভার্সনের কাজ করে বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় দিতে বাধ্য করেছে। তথাপি এক্ষেত্রে হোয়াইট হাউজে বাইডেন সরকার থাকার সময় ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের উপর রাজনৈতিক চাপ বড় ভূমিকা রেখেছিল। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে আগমণ যুক্তরাষ্ট্রে শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে; যার প্রমাণ ন্যাটো, ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে দৃশ্যমান। আটলান্টিকের ওপাড়ে এহেন বড় পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে ঢাকায় এইচটি-র উত্থান একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ৭ই মার্চ ২০২৫ সত্যিই ছিল একটা ঐতিহাসিক দিন!

Sunday, 2 March 2025

পশ্চিমা লিবারাল বিশ্বব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক!

০২রা মার্চ ২০২৫

যে ব্যাপারটা নিয়ে পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা পুরোপুরিভাবে একমত তা হলো, পশ্চিমা লিবারাল বিশ্বব্যবস্থার মৃত্যু হয়েছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছর ধরে চলা এই বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল পশ্চিমা দেশগুলির জোট এবং তাদের তৈরি করা বিভিন্ন সংস্থা; যেগুলি গত কয়েক বছর ধরে দুর্বল হতে থাকলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে আসার সাথে সাথে এগুলি অকার্যকর হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা জোটের কেন্দ্রে থাকা ন্যাটো নিরাপত্তা জোট আজ নামমাত্র দাঁড়িয়ে আছে।


পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়া গত কিছুদিনের সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছে। জার্মানির মিউনিখে নিরাপত্তা সন্মেলনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো; সৌদি আরবে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেন ও ইউরোপকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে আলোচনা; এবং হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে মিডিয়ার সন্মুখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে মারাত্মক ঝগড়ার পর হোয়াইট হাউজ থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকিকে বের করে দেয়া - এই ঘটনাগুলি পুরো বিশ্বব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা বলছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গত ৩৫ বছরে এতবড় পরিবর্তন আসেনি। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছর ধরে চলা পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত লিবারাল বিশ্বব্যবস্থা আজকে মৃত বলেই ধরে নেয়া যায়।


ইউক্রেনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা এখানেই শেষ!

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি' বা 'সিআইএ'র প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর জন ম্যাকলাঘলিন নিরাপত্তা ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, ট্রাম্পের ইউক্রেন নীতিতে ইউরোপিয়দের মাঝে একতাবদ্ধ হবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ঠিকই; তবে সেটার অর্থ আসলে কি হবে, সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার চ্যালেঞ্জগুলি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি ছাড়া ইউরোপের আর কোন নেতৃত্বের বুঝতে পারার কথা নয়। কারণ জেলেন্সকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে তিন বছর ধরে যুদ্ধ করছেন। একমাত্র তিনিই জানেন রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে। ইউরোপ রাশিয়ার হুমকি বোঝে না তা-ও কিন্তু নয়। ইউরোপের কিছু অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইউরোপের সকল দেশের অস্ত্রই ন্যাটোর স্ট্যান্ডার্ড মেনে তৈরি করা। কিন্তু সমস্যা হলো, সেখানে সকলেই আলাদা আলাদা অস্ত্র তৈরি করেছে; এবং সেগুলি একটা আরেকটার সাথে যায় না। শুধুমাত্র ন্যাটোর অধীনেই তারা একত্রে যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। ন্যাটোকে বাদ দিয়ে তারা যুদ্ধ করার মতো একত্রিত ইউরোপিয় সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে পারবে কিনা, তাতে সন্দেহ রয়েছে। আবার ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে ইউরোপের নিজস্ব সামরিক বাহিনী তৈরি করাটাও অদ্ভুত ঠেকছে। কারণ এই মুহুর্তে ইউরোপের সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে ইউক্রেনের। ইউক্রেন চাইলে পুরো ইউরোপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একেবারে ফ্রান্সের আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত যাবার সক্ষমতা রাখে। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার জন্যে একটা ইউরোপিয় বাহিনীর কথা বলা হচ্ছে। এই মুহুর্তে এই বাহিনী বলতে যা বোঝা যায় তা হলো কয়েকটা ব্রিগেডের একটা বাহিনী যা রাশিয়ার সাথে সীমানায় টহল দেয়ার কাজ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, কোন মার্কিন সেনা এই বাহিনীতে থাকবে না। তথাপি যুক্তরাষ্ট্রকে এই বাহিনীর পিছনে গ্যারান্টি দিতে হবে। কারণ এই বাহিনী যদি রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা ট্রাম্পের জন্যে একটা মারাত্মক রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে আবির্ভূত হবে। কাজেই পুতিন রাজি হোক আর না হোক, যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তভাবে বলতেই হবে যে, ইউরোপিয়দের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত সমর্থন রয়েছে এবং রাশিয়া চুক্তি ভঙ্গ করলে যুক্তরাষ্ট্র শক্ত অবস্থান নেবে। তবে খুব সম্ভবতঃ এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত হবে।
 
ট্রাম্পের কথাগুলি জেলেন্সকি মেনে নিতে পারেননি এবং ট্রাম্পকে প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এটা ট্রাম্পের অতি উঁচু দম্ভের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে এবং এরপর ট্রাম্প মূলতঃ জেলেন্সকিকে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দিয়েছেন। অন্য কথায় বলতে গেলে, ইউক্রেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনকে ছেড়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে না যে, ইউরোপ ইউক্রেনকে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে। অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া ইউরোপ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হবার ক্ষমতা রাখে না।


হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে জেলেন্সকির সাথে ট্রাম্পের ঝগড়ার পর লিবারাল ঘরানার মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং 'ইউরেশিয়া গ্রুপ'এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার 'জি-জিরো মিডিয়া'তে বলছেন যে, ট্রাম্পের কথাগুলি জেলেন্সকি মেনে নিতে পারেননি এবং ট্রাম্পকে প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এটা ট্রাম্পের অতি উঁচু দম্ভের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে এবং এরপর ট্রাম্প মূলতঃ জেলেন্সকিকে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দিয়েছেন। অন্য কথায় বলতে গেলে, ইউক্রেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এখন অনেকেই হয়তো বলবেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউক্রেনের সম্পর্ককে জোড়া লাগাতে হলে জেলেন্সকিকে পদত্যাগ করতে হতে পারে। আর গত কয়েক বছরে ইউরোপের কর্মকান্ডে যা বোঝা গেছে তা হলো, ইউরোপিয়রা যতটা বলে, ততটা করে না। অনেক কথার পরেও ইউরোপের সকল দেশ তাদের প্রতিরক্ষা বাজেটকে জিডিপির ২ শতাংশেই নিয়ে যেতে পারেনি। তাদের একেক দেশের একেক এজেন্ডা এবং একেক বাজেট। তাদের পক্ষে একটা একত্রিত সামরিক শক্তি গঠন করে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপিত করা খুবই কঠিন। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনকে ছেড়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে না যে, ইউরোপ ইউক্রেনকে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে। অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া ইউরোপ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হবার ক্ষমতা রাখে না।

ট্রাম্প ইউরোপ, বিশেষ করে ব্রিটিশদেরকে বাদ দিয়ে পুতিনের সাথে আলোচনায় বসেছেন – এই ব্যাপারটা ব্রিটিশরা মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল মাইকেল ক্লার্ক ব্রিটিশ মিডিয়া 'স্কাই নিউজ'কে বলছেন যে, ইউক্রেনে যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো ঐতিহাসিক মাত্রার ঐতিহাসিক এক বিশ্বাসঘাতকতা। ইউক্রেন তার ২০ শতাংশ ভূমি হারাবে ঠিকই; কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তাদের শতভাগ রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। একত্রিতভাবে পশ্চিমা বিশ্ব বলতে যা এতদিন বোঝাতো, সেটা এখন মৃত; আন্তর্জাতিক আইন এখন মৃত। এগুলি গত তিন-চার বছর ধরেই নিম্নগামী ছিল। তবে গত দুই সপ্তাহে এর কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে। তিনি বলছেন যে, এখন বিশ্ব রয়েছে নব্য সাম্রাজ্যবাদের মাঝে; ট্রাম্প, পুতিন এবং শি জিনপিং দুনিয়াটাকে নতুন একটা ব্যবস্থার মাঝে নিয়ে আসতে চাইছে আগামী দেড়-দুই বছরের মাঝে। ট্রাম্প মূলতঃ বোঝেন বাণিজ্য এবং তিনি মার্কিন অর্থনীতিকে দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে দেখতে চান। এবং একইসাথে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক আকৃতিও বড় করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এরা তিনজনই তাদের রাষ্ট্রের ভৌগোলিক আকৃতিকে বড় করার ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প এই তিন দেশের পারমাণবিক অবস্থানকে কমিয়ে ফেলার দিকে এগুতে চাইছেন। ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরষ্কার চান এবং মাউন্ট রাশমোরএর মাঝে তার একটা প্রতিকৃতি থাকুক, সেটাও চান। তিনি ইউক্রেন, গাজা, তাইওয়ান এবং ন্যাটো নিয়ে চিন্তা করেন না। সুতরাং সামনের চার বছরে এরূপ অন্ধকারের মাঝে পতিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব।
 
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে; যাতে করে নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়। যদিও সবচাইতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রদর্শন করতেই পারে, তথাপি পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদেরা বেশিরভাগই একমত যে, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এখন নিম্নগামী; তাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব না-ও হতে পারে। মোটকথা, পুরো বিশ্ব আজ চরম উৎকণ্ঠার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বড় ধরণের একটা পরিবর্তনের দাঁড়প্রান্তে।


যুক্তরাষ্ট্র এখন নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ার চেষ্টায় রয়েছে

ট্রাম্পের কর্মকান্ডকে স্বাভাবিক আখ্যা দিয়ে পুরো বিষয়টাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অংশ বলে আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক 'জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স'এর এক পডকাস্টে তিনি বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হওয়া বিশ্বব্যবস্থাকে এখন আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সারা বিশ্বকে লিবারাল চিন্তার অধীনে আনার পশ্চিমা প্রকল্প ছিল কল্পনার জগতের একটা চিন্তা। একারণেই যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলছে। ট্রাম্পের কর্মপদ্ধতি খুবই উদ্ভট; কিন্তু তিনি যা করছেন, তার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। ইউক্রেনের প্রতি আমেরিকার কোন ভালোবাসা নেই। কঠোর বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন ছিল একটা ভূরাজনৈতিক খেলার মাঠ। ইউরোপিয়দের মাঝে অনেকেরই, বিশেষ করে ব্রিটিশদের মাঝে অনেকেরই ইউক্রেনের জন্যে ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু কেউই প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনকে রক্ষা করতে জীবন দিতে প্রস্তুত নয়। রাশিয়া ইউক্রেনের মতো প্রায় তৃতীয় বিশ্বের একটা সামরিক শক্তিকে তিন বছরে হারাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এতে তাদের সামরিক সক্ষমতা কতটুকু তা এখন প্রমাণিত। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে গেছে; তাই রাশিয়াকে শত্রু ভেবে অনেক কিছু করার সময় এখন নয়। ন্যাটোর সৃষ্টি হয়েছিল রাশিয়াকে আটকে রাখার জন্যে; যখন রাশিয়া ইউরোপের জন্যে একটা বড় হুমকি ছিল। এখন রাশিয়া ইউরোপের জন্যে কোন হুমকি নয়; তাই ন্যাটোরও এখন কোন প্রয়োজন নেই। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, ইউক্রেনের চাইতে মধ্যপ্রাচ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা হয়েছে সৌদি আরবে। এই আলোচনা শুধু ইউক্রেন নিয়ে নয়; এখানে মধ্যপ্রাচ্যও রয়েছে। এই আলোচনা নতুন বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। এই পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে বাদ দিয়েছে বলেই ইউরোপে এতটা হৈচৈ শুরু হয়েছে। তিনি বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্য হলো সারা দুনিয়ার জ্বালানি সরবরাহের সবচাইতে বড় উৎস। মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সৌদি আরবকে প্রয়োজন। আর গাজা দখলের মতো আশ্চর্য্য পরিকল্পনা না নিয়ে আসলে হয়তো সৌদিদেরকে দিয়ে ট্রাম্প কাজ করাতে পারতেন না। তবে ফ্রীডম্যানের কথাগুলির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল নতুন বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। তিনি বলছেন যে, চীনের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কোন্নয়ন। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এর মাধ্যমে চীনের উপর চাপ সৃষ্টি করে চীনের কর্মকান্ডে পরিবর্তন নিয়ে আসা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণভাবে চীনকে পরিবর্তন করা; বিশেষ করে চীনা সরকারের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে বেসরকারি সেক্টরকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করা; যাতে করে চীন পশ্চিমা পুঁজিবাদী চিন্তাকে আরও শক্তভাবে ধারণ করে।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ রবার্ট ক্যাপলান ব্রিটিশ কনজারভেটিভ ঘরানার মিডিয়া 'স্পেকট্যাটর'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, ট্রাম্প যে স্বর্ণযুগের কথা বলছেন, তা প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামীতারই একটা অংশ। অপরদিকে চীনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, চীনের অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা রয়েছে। বিশ্বের সকল গ্রেট পাওয়ার রাষ্ট্রই ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার কবর। এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়া মধ্য এশিয়া, ককেশাস, সাইবেরিয়া এবং পূর্ব এশিয়াতে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা হারিয়েছে। তিনি বলছেন যে, কেউই চায় না কোন গ্রেট পাওয়ার রাষ্ট্র তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করুক। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গ্রেট পাওয়ার বিশ্বকে একটা ব্যবস্থার মাঝে রাখে। গ্রেট পাওয়ার ব্যতীত বিশ্ব হলো অব্যবস্থার মাঝে থাকা একটা বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত হওয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রায় ৮০ বছর টিকেছে; যা আসলে অনেক বেশি। তবে খুব সম্ভবতঃ সেই বিশ্বব্যবস্থা এখন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্যাপলান বলছেন যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতে পারে। ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং প্রাক্তন কনজারভেটিভ রাজনীতিবিদ মাইকেল গোভ 'স্পেকট্যাটর'কে বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি বিশ্বব্যবস্থায় অনেকগুলি বহুপাক্ষিক সংস্থা তৈরি করা হয়েছিল; যেগুলি ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, অথবা তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে এই হুমকিগুলি নেই এবং এই সংস্থাগুলি নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্যে যুক্তি হারাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে যে, এই সংস্থাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

যে ব্যাপারটা নিয়ে পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা পুরোপুরিভাবে একমত তা হলো, পশ্চিমা লিবারাল বিশ্বব্যবস্থার মৃত্যু হয়েছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছর ধরে চলা এই বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল পশ্চিমা দেশগুলির জোট এবং তাদের তৈরি করা বিভিন্ন সংস্থা; যেগুলি গত কয়েক বছর ধরে দুর্বল হতে থাকলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে আসার সাথে সাথে এগুলি অকার্যকর হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা জোটের কেন্দ্রে থাকা ন্যাটো নিরাপত্তা জোট আজ নামমাত্র দাঁড়িয়ে আছে। কারণ যেই রাশিয়াকে আটকানোর জন্যে ন্যাটো তৈরি করা হয়েছিল, সেই রাশিয়া আজকে দুর্বল। আর যেই জার্মানিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে ন্যাটো তৈরি করা হয়েছিল, সেই জার্মানি আজকে এতটাই দুর্বল যে, জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, জার্মান নির্বাচন নিয়ে কেউ চিন্তিতই নয়। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউরোপ থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নেয়, তাহলে ন্যাটো অর্থহীন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে; যাতে করে নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়। যদিও সবচাইতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রদর্শন করতেই পারে, তথাপি পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদেরা বেশিরভাগই একমত যে, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এখন নিম্নগামী; তাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব না-ও হতে পারে। মোটকথা, পুরো বিশ্ব আজ চরম উৎকণ্ঠার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বড় ধরণের একটা পরিবর্তনের দাঁড়প্রান্তে।