Tuesday, 4 November 2025

ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি - পশ্চিম গোলার্ধে হারানো মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা

০৫ই নভেম্বর ২০২৫
ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনাগুলি স্বল্পমেয়াদী হতে পারে; আবার লম্বা সময়ের জন্যে অত্র অঞ্চলে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অপারেশনেও ব্যবহৃত হতে পারে। ১৯৯৪ সালে হাইতিতে সামরিক অপারেশনের পর থেকে ক্যারিবিয়ানে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় সামরিক কর্মকান্ড।


মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি - তিন দশকে সর্বোচ্চ

‘রয়টার্স'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানে দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক অবস্থানের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেপ্টেম্বর নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ পুয়ের্তো রিকো দ্বীপে ২০০৪ সালে বন্ধ করে দেয়া রুজভেল্ট রোডস ঘাঁটিকে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়েছে। এছাড়াও পুয়ের্তো রিকো এবং ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডসের বেসামরিক বিমানবন্দরগুলিতেও নতুন করে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে। গত অগাস্ট মাস থেকে ক্যারিবিয়ানে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, ফাইটার বিমান এবং গোয়েন্দা বিমান মোতায়েন শুরু হয়েছে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'জেরাল্ড ফোর্ড' বর্তমানে ক্যারিবিয়ানের পথে রয়েছে। এছাড়াও ইতোমধ্যেই অত্র এলাকায় মোতায়েন করা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধজাহাজগুলির মাঝে রয়েছে উভচর এসল্ট শিপ 'আইও জিমা', স্পেশাল ফোর্সের মিশনের জাহাজ 'ওশান ট্রেডার', ক্রুজার 'লেক এরি', ডেস্ট্রয়ার 'গ্রেভলি', ‘স্টকডেল', 'জেসন ডানহ্যাম' এবং উভচর ডক ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম 'স্যান এন্টোনিও'। এর বাইরেও পুয়ের্তো রিকোতে বিমান বাহিনীর ১০টা 'এফ-৩৫' স্টেলথ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছে।

অক্টোবরে মার্কিন বিমান বাহিনীর 'বি-১' এবং 'বি-৫২' বোমারু বিমান ভেনিজুয়েলার উপকূল ঘেঁষে উড়ে যায়। 'রয়টার্স'এর ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায় যে, ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডসের সেইন্ট ক্রোয়া-তে 'হেনরি ই রোহলসেন' বিমানবন্দরে দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা রাডার স্থাপন করেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। পুয়ের্তো রিকোর রাফায়েল হেরনানডেজ বেসামরিক বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর 'এমকিউ-৯ রীপার' ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অত্র অঞ্চলে মার্কিন 'সি-১৭' সামরিক পরিবহণ বিমান এবং 'পি-৮' গোয়েন্দা বিমানের ফ্লাইটও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' বা 'সিএসআইএস'এর সিনিয়র ফেলো ক্রিস্টোফার হেরনানডেজ-রয়-এর মতে, এগুলি সবই করা হচ্ছে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং তার সমর্থিত জেনারেলদেরকে ভয় দেখাবার জন্যে। প্রাক্তন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা মার্ক ক্যানসিয়ানের মতে, এই সামরিক স্থাপনাগুলি স্বল্পমেয়াদী হতে পারে; আবার লম্বা সময়ের জন্যে অত্র অঞ্চলে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অপারেশনেও ব্যবহৃত হতে পারে। ১৯৯৪ সালে হাইতিতে সামরিক অপারেশনের পর থেকে ক্যারিবিয়ানে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় সামরিক কর্মকান্ড। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে কমপক্ষে ১৪টা হামলায় যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত মাদক ব্যাবসায়ীদের ৬১ জনকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকান্ডগুলিকে কেন্দ্র করে ভেনিজুয়েলা এবং কলম্বিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়েছে।
 
নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভার পর কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট পেত্রো ফিলিস্তিনের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার পর মার্কিন সরকার প্রেসিডেন্ট পেত্রোর ভিসা বাতিল করে। 'বিবিসি' বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, কলম্বিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।


যুক্তরাষ্ট্র-কলম্বিয়া সম্পর্কের অবনতি

সকলেই শুধু ভেনিজুয়েলা নিয়ে কথা বললেও যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা শুধু ভেনিজুয়েলাই নয়। অত্র অঞ্চলের বেশকিছু নেতৃত্বের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি সংঘর্ষে নেমেছেন। কলম্বিয়ার বামপন্থী লিবারাল প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো 'বিবিসি'র সাথে সাক্ষাতে হামলাগুলিকে জুলুম বলে আখ্যা দেন এবং এই হত্যাকান্ডের জন্যে দায়ী মার্কিন কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেন। এর জবাবে ট্রাম্প কলম্বিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ ঘোষণা করেন এবং হুমকি দেন যে, পেত্রো যদি নিজে কলম্বিয়ার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সেটা করবে এবং সেটা সুখকর ভাবে করা হবে না। কলম্বিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, ট্রাম্পের কথাগুলি মূলতঃ কলম্বিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের বেআইনী হস্তক্ষেপের হুমকি। বহু দশক ধরে কলম্বিয়ায় মার্কিন সহায়তায় বামপন্থীদের গ্রুপগুলি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছে। তবে ২০১৬ সালে বিদ্রোহীদের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে কলম্বিয়াতে মার্কিন সামরিক এবং আর্থিক সহায়তা কমতে থাকে; সেইসাথে কমতে থাকে রাজনৈতিক প্রভাবও। ট্রাম্প ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই শেষ মুহুর্তে কোনক্রমে কলম্বিয়ার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তবে জুন মাসে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটাতে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিগেল উরিবে তুরবে হত্যাকান্ডের শিকার হবার পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও সেই ঘটনার সাথে কলম্বিয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। উভয় দেশের রাষ্ট্রদূতদেরকে নিজ দেশে ডেকে পাঠানো হয়। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভার পর প্রেসিডেন্ট পেত্রো ফিলিস্তিনের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার পর মার্কিন সরকার প্রেসিডেন্ট পেত্রোর ভিসা বাতিল করে। 'বিবিসি' বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, কলম্বিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।

কিউবার সাথে ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়ার বন্ধুত্ব

মার্কিন মিডিয়া এবং প্রাইভেট সেক্টরের অর্থায়নে তৈরি 'প্রজেক্ট সিন্ডিকেট'এর ২০২৪এর অক্টোবরের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ২০০২ সালে ভেনিজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর থেকে কিউবা ভেনিজুয়েলাতে হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স, খেলাধূলা প্রশিক্ষক, নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট পাঠিয়েছে। কিউবার এই সমর্থনই ভেনিজুয়েলার বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারার মূল কারণ। নিকারাগুয়া থেকে পরিচালিত মিডিয়া 'হাভানা টাইমস'এর ২০২৪এর অগাস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত ১৫ বছর ধরে কিউবা ভেনিজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনী এবং ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসকে নতুন করে তৈরি করতে সহায়তা দিয়েছে। 'রয়টার্স'এর ২০১৯ সালের এক তদন্তের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০০৮ সালে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত চুক্তির বলে তৈরি 'জেনারেল ডিরেক্টরেট অব মিলিটারি কাউন্টারইন্টেলিজেন্স' বা 'ডিজিসিআইএম' নামের এক সংস্থার মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উপর ব্যাপক নজরদারি শুরু হয়। একইসাথে কিউবা ভেনিজুয়েলার সামরিক সদস্যদেরকে ট্রেনিং দেয়, বাহিনীর কাঠামোতে পরিবর্তন আনে, হাভানাতে ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্স সদস্যদেরকে ট্রেনিং দেয়, এবং ইন্টেলিজেন্সের মূল কাজকে অন্য দেশের উপর গোয়ান্দাগিরি থেকে সরিয়ে নিজ দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উপর কেন্দ্রীভূত করে। ভেনিজুয়েলা থেকে পালিয়ে আসা প্রাক্তন জেনারেল এন্টোনিও রিভেরো বলেন যে, ২০০৮ সালে দুই দেশের মাঝে ১৫টা গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনীকে কিউবার বাহিনীর ধাঁচে গড়ে তোলা হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে ভেনিজুয়েলার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উঠে এসেছে।

২০০২ সালে ভেনিজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর থেকে কিউবা ভেনিজুয়েলাতে হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স, খেলাধূলা প্রশিক্ষক, নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট পাঠিয়েছে। কিউবার এই সমর্থনই ভেনিজুয়েলার বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারার মূল কারণ।

 
মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও গত ফেব্রুয়ারিতে কোস্টারিকা ভ্রমণে গিয়ে বলেন যে, কিউবা, ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়ার সরকার হলো মানবতার শত্রু। তিনি আরও বলেন যে, এই তিন দেশের কারণে পশ্চিম গোলার্ধে শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে; কারণ এই দেশগুলির ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করছে না। কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ-কানেল রুবিওর এই মন্তব্যকে নির্লজ্জ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন যে, কিউবার উপর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণেই কিউবানরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। মার্কিন রাজনীতিবিদদের নব্য ফ্যাসিস্ট চিন্তার কারণে মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে। অর্ধেক দুনিয়াতে অরাজকতা এবং দৈন্যতার জন্যে মার্কিন যুদ্ধবাজরাই দায়ী। আর ভেনিজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল বলেন যে, রুবিও এই তিন দেশ নিয়ে করুণ এবং অসুস্থ্য চিন্তার মাঝে রয়েছেন।

কিউবা যে সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে, তার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় গত ফেব্রুয়ারিতে; যখন নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারের সেনাপ্রধান জেনারেল জুলিও আভিলেসের অভিষেক অনুষ্ঠানে কিউবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আলভারো লোপেজ মিয়েরা উপস্থিত ছিলেন বলে বলছে 'কিউবান নিউজ এজেন্সি'। ১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়াতে বামপন্থী স্যান্ডানিস্টা সরকারের উত্থানের সময় থেকে কিউবার সাথে নিকারাগুয়ার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। ক্যারিবিয়ানে চলমান উত্তেজনার মাঝেই ৮ই অক্টোবর নিকারাগুয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল আভিলেস কিউবার রাজধানী হাভানা ভ্রমণ করেন।
 

কিউবা ক্যারিবিয়ান সাগরে এমন অবস্থানে রয়েছে, যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে মেক্সিকো উপসাগরের উপকূলে সমুদ্রবন্দরগুলির সমুদ্র বাণিজ্যকে হুমকির মাঝে ফেলে দেয়া সম্ভব। কিউবা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপদ্বীপের মাঝে সমুদ্রপথ মাত্র ১৪৫কিঃমিঃ চওড়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক বাণিজ্য হয় এই বন্দরগুলির মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাতে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। আর পুরো ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ল্যাটিন আমেরিকাতে মাদক ব্যবসায়ীদেরকে এবং বামপন্থী বিদ্রোহী গ্রুপ এবং সরকারগুলিকে সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্স সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারগুলিকে সমস্যায় ফেলার জন্যে। আর এই পুরো অপারেশনের কেন্দ্র ছিল কিউবা। 


রাশিয়ার ভূমিকা এবং কিউবার কৌশলগত গুরুত্ব

তবে ভেনিজুয়েলা এবং কিউবার সামরিক সহযোগিতার খবরগুলি নতুন নয়। কাজেই হঠাত করেই বা কেন যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকবে, তা অন্ততঃ এই দুই দেশের নিরাপত্তা চুক্তির মাঝে পাওয়া যায় না। মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান 'জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স'এর এক লেখায় তার ধারণা প্রকাশ করছেন যে, ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধির পেছনে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের 'টোমাহক' ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের হুমকির সম্পর্ক থাকতে পারে। হয়তো রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সেই হুমকি মোকাবিলায় কিউবার সাথে সামরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে এবং ল্যাটিন আমেরিকার ড্রাগ ব্যাবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক পুনর্নিমাণ করেছে। অক্টোবরের শুরুতেই রুশ পার্লামেন্টে কিউবার সাথে গত মার্চে স্বাক্ষরিত সামরিক চুক্তিকে অনুমোদন দেয়া হয়। এই চুক্তি মোতাবেক দুই দেশের মাঝে যৌথ সামরিক মহড়া, অস্ত্র সরবরাহ সহ কিউবাতে রুশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে এটা মোটেই সুখকর খবর নয়। কিউবা ক্যারিবিয়ান সাগরে এমন অবস্থানে রয়েছে, যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে মেক্সিকো উপসাগরের উপকূলে সমুদ্রবন্দরগুলির সমুদ্র বাণিজ্যকে হুমকির মাঝে ফেলে দেয়া সম্ভব। কিউবা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপদ্বীপের মাঝে সমুদ্রপথ মাত্র ১৪৫কিঃমিঃ চওড়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক বাণিজ্য হয় এই বন্দরগুলির মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাতে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। আর পুরো ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ল্যাটিন আমেরিকাতে মাদক ব্যবসায়ীদেরকে এবং বামপন্থী বিদ্রোহী গ্রুপ এবং সরকারগুলিকে সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্স সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারগুলিকে সমস্যায় ফেলার জন্যে। আর এই পুরো অপারেশনের কেন্দ্র ছিল কিউবা। ফ্রীডম্যানের কথাগুলি সপ্তাখানেক পরেই মস্কোতেও প্রতিফলিত হয়। ২৯শে অক্টোবর রুশ পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির ডেপুটি চেয়ারপার্সন আলেক্সেই ঝুরাভলিয়ভ বলেন যে, রাশিয়া ভেনিজুয়েলা বা কিউবাতে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারে; যা কিনা রাশিয়ার প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগী যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছে অবস্থিত। রাশিয়ার কাছে বহু ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে; যেগুলি প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার করা যেতে পারে। মার্কিন সামরিক থিঙ্কট্যাঙ্ক 'ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার' বা 'আইএসডব্লিউ' বলছে যে, ঝুরাভলিয়ভের এই হুমকি ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের কথা মনে করিয়ে দেয়।

'ডিফেন্স নিউজ'এর খবরে বলা হচ্ছে যে, একটা রুশ 'ইলিউশিন-৭৬' পরিবহণ বিমান ২৬শে অক্টোবর ভেনিজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে অবতরণ করে। এর দু'দিন পর বিমানটা কিউবার রাজধানী হাভানাতে যায়; সেখান থেকে নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়াতে গিয়ে ২৯শে অক্টোবর নাগাদ আবারও কারাকাসে ফেরত আসে। পরদিন বিমানটা রাশিয়ার উদ্দেশ্যে কারাকাস ছেড়ে যায়। বিমানটা রুশ সরকারের না হলেও তা সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখা বিমান সংস্থা 'এভিয়াকন জিটোট্রান্স'এর। যাবার পথে তা আফ্রিকার মৌরিতানিয়ার নুয়াকছোট এবং আলজেরিয়ার আলজিয়ার্সে অবতরণ করে। 'ডিফেন্স নিউজ' বলছে যে, বারবার অবতরণ করার একটা কারণ হতে পারে যে, বিমানটা অতিরিক্ত ভার বহণ করছিলো। অথবা রাশিয়ার উপর অবরোধের কারণে উদ্ভূত সমস্যাকে বাইপাস করার জন্যে বিমানটা কোথা থেকে এসেছে, সেটা ঘোলাটে করার কৌশল হতে পারে। যদিও বিমানটার মিশন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, তথাপি যেহেতু বিমানটার মালিক সংস্থার উপর যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সরঞ্জাম পরিবহণ করার কারণে অবরোধ আরোপ করেছে, তাই এর উদ্দেশ্য ধোঁয়াশার মাঝেই থাকবে।

কিউবাতে রাশিয়ার উপস্থিতি ছাড়াও চীনের উপস্থিতি নিয়েও কথা শুরু হয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সিএসআইএস' ২০২৪এর ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে; যেখানে বলা হয় যে, এতকাল নির্দিষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও এখন প্রায় নিশ্চিত যে, কিউবার কমপক্ষে চার স্থানে চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের উপর নজরদারি করার জন্যে গোয়ান্দা স্থাপনা বসিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক চাপে পড়ার কারণে কিউবা চীনের আরও কাছে গিয়েছে।

কিউবা-মেক্সিকো বন্ধুত্ব

কিউবা যে পুরো ক্যারিবিয়ান এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল, তা নিশ্চিত। ‘মেক্সিকানস এগেইনস্ট করাপশন এন্ড ইমপিউনিটি' নামক থিঙ্কট্যাঙ্কের বরাত দিয়ে 'মায়ামি হেরাল্ড' বলছে যে, মেক্সিকোর বর্তমান বামপন্থী লিবারাল প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শাইনবাউম ক্ষমতায় আসার পর থেকে মেক্সিকো কিউবাতে জ্বালানি তেলের সরবরাহ তিন গুণ করেছে। গত মে মাস থেকে অগাস্টের মাঝে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের তেল ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করেছে মেক্সিকো। আগের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল ওব্রাদরের সরকার দুই বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের তেল সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, প্রেসিডেন্ট শাইনবাউম কিউবাকে রাজনৈতিকভাবেও জোরালো সমর্থন দিচ্ছেন। ১৩ই অক্টোবর তিনি ঘোষণা দেন যে, ডিসেম্বরে ডোমিনিকাতে অনুষ্ঠেয় আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলির শীর্ষ সন্মেলন তিনি বয়কট করেছেন; কারণ সেই সন্মেলন থেকে কিউবা, ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়াকে বাদ দেয়া হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও লস এঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত সন্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দনীয় রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে আমন্ত্রণ জানাননি।

ট্রাম্প প্রশাসনের উপ-পররাষ্ট্র সচিব ক্রিস্টোফার ল্যানডাউ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কিউবাকে সমর্থন দেয়ার জন্যে মেক্সিকোর ব্যাপক সমালোচনা করেন। স্প্যানিশ ভাষার পত্রিকা 'এল পাইস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর জাতিসংঘে ভোটাভুটি হয়ে চলেছে কিউবার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ উঠিয়ে দেয়ার জন্যে। মেক্সিকো এই প্রস্তাবে প্রতি বছর কিউবাকে সমর্থন দিয়ে গেছে। এবছরও মেক্সিকো কিউবাকে সমর্থন করায় ল্যানডাউ বলেন যে, মেক্সিকোর বন্ধু হিসেবে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। কিউবার প্রতি মেক্সিকোর সমর্থন বিভিন্ন সরকারের আমলে অটুট থেকেছে। প্রেসিডেন্ট শাইনবাউমের আগে তার দলেরই প্রেসিডেন্ট ওব্রাদর কিউবাকে তেল সরবরাহের বিনিময়ে কিউবা থেকে ডাক্তার পেয়েছেন। করোনা মহামারির সময় মেক্সিকোকে ডাক্তার দিয়ে সহায়তার করার জন্যে ওব্রাদর ২০২৩ সালে কিউবার নেতা মিগেল দিয়াজ-কানেলকে মেক্সিকোর সর্বোচ্চ পুরষ্কার 'অর্ডার অব দ্যা আজটেক ঈগল'এ ভূষিত করেছিলেন। ওব্রাদরের আগে 'পিআরআই' পার্টির প্রেসিডেন্ট পেনা নিয়েতোর সময় মেক্সিকো কিউবার বড় অংকের ঋণ মওকুফ করে দেয়। 'ইবেরো আমেরিকান ইউনিভার্সিটি'র বিশ্লেষক পিয়া তারাসেনা 'এল পাইস'কে বলছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধকে মোকাবিলার সময় মেক্সিকো কিউবা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে অত্র অঞ্চলে মেক্সিকোর অবস্থানও শক্তিশালী হয়েছে। জাতিসংঘে মেক্সিকোর দূত হেক্টর ভাসকনচেলস যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ঠান্ডা যুদ্ধের চিন্তাধারা পরিত্যাগ করতে পারেনি। কিউবার উপর অবরোধ বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত বেশিরভাগ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আবেলারডো রডরিগেজ 'এল পাইস'কে বলছেন যে, ট্রাম্প প্রশাসন এখন তাদের অপছন্দের কথা বলা কাউকেই সহ্য করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে 'মনরো ডকট্রাইন'কে কাজে লাগিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে হারিয়ে যাওয়া প্রভাবকে পুনরূদ্ধার করতে চাইছে। 'জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স'এর লেখায় জর্জ ফ্রীডম্যানও 'মনরো ডকট্রাইন'কে মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এবং সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হিসেবেই উল্লেখ করেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাকি বিশ্বে জনসমর্থনের কথা বললেও পশ্চিম গোলার্ধ বা আমেরিকা মহাদেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে জনসমর্থনের কোন তোয়াক্কা করেনি কখনও।
 
১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়াতে বামপন্থী স্যান্ডানিস্টা সরকারের উত্থানের সময় থেকে কিউবার সাথে নিকারাগুয়ার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। ক্যারিবিয়ানে চলমান উত্তেজনার মাঝেই ৮ই অক্টোবর নিকারাগুয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল আভিলেস কিউবার রাজধানী হাভানা ভ্রমণ করেন।


কিউবার অর্থনীতিতে মার্কিন অবরোধের প্রভাব

কিউবার অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। ‘হাভানা টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিউবাতে সবচাইতে বেশি পর্যটক আসে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, বিদেশে কিউবান সম্প্রদায় এবং রাশিয়া থেকে। ২০২৪ সালের পর্যটক সিজন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কিউবায় ২ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি কানাডিয় পর্যটক গিয়েছিল; বিদেশে থাকা কিউবানরা গিয়েছিল ৪৫ হাজার, মার্কিনীরা গিয়েছিল ২৮ হাজার এবং রুশরা গিয়েছিল ৪৩ হাজার। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কিউবাতে পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপিয়রাও কিউবাতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। কিউবার সরকার বলছে যে, এর মূল কারণ হলো কিউবার উপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ভিসা নিয়ন্ত্রণ। কারণ ইউরোপিয়রা কিউবাতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে যাবার জন্যে আলাদাভাবে ভিসা নিতে হবে। ২০২৪ সালে কিউবাতে ২৭ লক্ষ পর্যটক গিয়েছিল। ২০২৫ সালে ২৬ লক্ষ টার্গেট থাকলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, এই টার্গেটও পুরণ হবে না।

কিউবা পশ্চিম গোলার্ধে একটা বড় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন পায় কানাডার কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের মাঝে কানাডা কিউবাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে। কানাডার লিবারাল সরকার সর্বদাই কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে এসেছে। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, কানাডার সাথে কিউবা সরকারের রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো এবং কানাডা কিউবার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর পর কানাডিয় পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য হলো কিউবা। আর কিউবার জন্যে কানাডা হলো পর্যটকের সবচাইতে বড় উৎস। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত বছরে প্রায় ১০ লক্ষ কানাডিয় কিউবাতে যেতো। বর্তমানে কিউবাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগ কানাডার; যা মূলতঃ খনিজ, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সেক্টরে। কিউবার নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি, অবকাঠামো এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কানাডা উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে থাকে। এছাড়াও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে কিউবাকে সহায়তা দিচ্ছে কানাডা।

কিউবার অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল ভেনিজুয়েলার তেল-ভিত্তিক অর্থনীতির উপর। তবে 'ট্রেডিং ইকনমিকস'এর হিসেবে ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সালের মাঝে ভেনিজুয়েলার জিডিপি প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হয়ে যায়। এর প্রভাব কিউবার অর্থনীতিতেও পড়েছে। ভেনিজুয়েলার পর রাশিয়া এবং মেক্সিকো কিউবার তেলের উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০২৫ সালে রাশিয়া কিউবাতে প্রায় ১ লক্ষ টন তেল রপ্তানি করেছে। 'মায়ামি হেরাল্ড' বলছে যে, অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে কিউবা ইউক্রেনে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করার জন্যে যোদ্ধা পাঠিয়ে থাকতে পারে। অপরদিকে চীন কিউবার প্রধান রপ্তানি বাজার। ২০২১ সালে কিউবা চীনে প্রায় তিন'শ মিলিয়ন ডলারের নিকেল এবং অন্যান্য খনিজ দ্রব্য রপ্তানি করে। প্রায় ৪ লক্ষ চিনি একসময় চীনে রপ্তানি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিউবার চিনি উৎপাদনে ধ্বস নেমেছে।

ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রশ্নের মুখে পড়েছে বহুদিন ধরেই। কিউবার বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করতে না পেরে অর্থনৈতিক অবরোধের মাঝে রেখে যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃপক্ষে কিউবার সমর্থন বৃদ্ধিই করেছে। বিশেষ করে কিউবায় সরকার পরিবর্তন না করতে পারা, অথবা পশ্চিম গোলার্ধে কিউবাকে পুরোপুরিভাবে একঘরে না করতে পারাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বড় ব্যার্থতা। মধ্য আমেরিকাতে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মেক্সিকো, কলম্বিয়া, নিকারাগুয়া এবং ভেনিজুয়েলাতে বামপন্থী এবং লিবারালরা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কারণে কিউবা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন পেয়েছে। অর্থনৈতিক ধ্বসের আগ পর্যন্ত ভেনিজুয়েলা কিউবার অর্থনীতিকে সবচাইতে বড় সহায়তা দিয়েছে। এখন সেই ভার বহণ করছে মেক্সিকো, কানাডা, রাশিয়া এবং অন্যান্যরা। তবে পশ্চিম গোলার্ধে কিউবার সবচাইতে বড় বন্ধু হলো কানাডা; যার সমর্থন না পেলে মার্কিন অবরোধের মাঝে কিউবার পক্ষে টিকে থাকাটাই দুষ্কর হতো। এই সম্পর্কের মাধ্যমে কানাডাও ক্যারিবিয়ানের মতো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রভাব ধরে রাখছে। কানাডার এই প্রচেষ্টা 'গ্লোবাল ব্রিটেন'এর অংশ। ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে যাবার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি, বিশেষ করে রাশিয়া এবং চীনের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কৌশলগত হুমকি। নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট ভেনিজুয়েলার সরকার উৎখাত নয়; বরং পুরো ক্যারিবিয়ান এবং ল্যাটিন আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা। তবে শুধুমাত্র সামরিক হুমকির মাধ্যমে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

Monday, 21 July 2025

২০২৫এর ২১শে জুলাই দিয়াবাড়ি ট্র্যাজেডি থেকে যা শিক্ষনীয়

২২শে জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর 'এফ-৭বিজিআই' বিমানগুলি ২০১২ সালে বাহিনীতে যুক্ত হয়। তৈরি করার বয়স বিচারে এগুলি বেশ নতুন। আর এই বিমানগুলি এখন চীনা 'এলএস-৬' জিপিএস গাইডেড গ্লাইড বোমা এবং তুরস্কের 'তেবার' লেজার গাইডেড বোমা ছুঁড়ে ভূমিতে নিখুঁতভাবে টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম। কাজেই যদি প্রাযুক্তিক সক্ষমতার কথা বলা হয়, তাহলে এগুলি একেবারে ফেলে দেবার জিনিস নয়। যে সক্ষমতার অভাব রয়েছে তা হলো, এগুলি দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারে না। একারণেই বাংলাদেশের প্রয়োজন 'জে-১০' এবং 'জেএফ-১৭' ফাইটার বিমান। একমাত্র চীন থেকেই দূরপাল্লার এরূপ ক্ষেপণাস্ত্র (‘পিএল-১৫') পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। (Photo: Shahriar Sonet)


২০২৫এর ২১শে জুলাই একটা ট্র্যাজেডির দিবস হিসেবে মনে থাকবে বাংলাদেশের অনেক মানুষের। কমপক্ষে ২০ জন মানুষের প্রাণ ঝরে গেছে বিমান বাহিনীর বিমান দুর্ঘটনায়; যার মাঝে বেশিরভাগই ছিল শিশু; যারা ছিল উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের ছাত্র। তবে এই স্মৃতি কতদিন এদেশের মানুষ মনে রাখবে, সেটা দেখার বিষয়। মাত্র দশ দিন আগে, অর্থাৎ ১১ই জুলাই ছিল আরেকটা ট্র্যাজেডির ১৪তম বার্ষিকী। ২০১১এর ১১ই জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইএ একটা সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হয়েছিল; যারে মাঝে ৪৩ জনই ছিল শিশু শিক্ষার্থী। এর মাঝে ৩৪ জনই ছিল মিরসরাই উপজেলার মায়ানী ইউনিয়নের আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৭১ সালের পর থেকে একসাথে এতজন শিশুর মৃত্যু ঘটেনি। দুর্ঘটনায় এরূপ অপমৃত্যু বাংলাদেশে নতুন নয়। কিছুদিন সেই ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হয়; বিশেষ করে রাজনৈতিক পক্ষগুলি এর থেকে 'পলিটিক্যাল পয়েন্টস' বের করার চেষ্টায় থাকে; এরপর সকলেই ভুলে যায়। এই ব্যবস্থাটাই চলছে বাংলাদেশে যুগের পর যুগ ধরে। মানুষের আবেগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়; কিন্তু সমস্যার সমাধান করার ইচ্ছা কারুরই থাকে না। বরং যতদিন সমস্যা থাকে, ততদিনই সেটা ভোটের রাজনীতির জন্যে ব্যবহারযোগ্য হয়। একারণেই বিমান বাহিনীর বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে একটা 'হোলিস্টিক ভিউ' থাকাটা জরুরি।

১। অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে, 'মান্ধাতার আমলের বিমান ওড়ায় কেন'? খুবই যৌক্তিক কথা। 'এফ-৭' যুদ্ধবিমান তো ১৯৫০এর দশকে সোভিয়েত ডিজাইনের 'মিগ-২১' বিমানের চীনা কপি। একারণেই বাংলাদেশের উচিৎ এই মুহুর্তে কয়েক স্কোয়াড্রন 'জে-১০সি' এবং 'জেএফ-১৭বি' যুদ্ধবিমান যোগাড় করা। একদিকে যেমন এগুলি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে অতি জরুরি; তেমনি পুরোনো বিমানগুলিকে (যেমন – ‘এফ-৭এমবি') প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রেও অতি প্রয়োজনীয়। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই কিছুদিন আগেই বিমান বাহিনীর একটা অনুষ্ঠানে বলেছেন যে, বিভিন্ন দিক থেকে যুদ্ধের হুমকি আসছে। তাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। আর প্রস্তুতি নিতে গেলে অর্ধেক প্রস্তুতি নিলে হবে না; পুরো প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতীয় মিডিয়া (ওয়াশিংটনেরও সমর্থন রয়েছে) চাইছে বিমান নির্মাতা চীনের সাথে বাংলাদেশের একটা দ্বন্দ্ব উস্কে দিতে। কাজেই এদেশের মানুষকে সাবধানে পা ফেলতে হবে।

২। মান্ধাতার আমলের বিমানগুলিকে সরিয়ে ফেললেই তো বিমান দুর্ঘটনা আর হবে না তাই না? মার্কিন বিমান বাহিনী হলো দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী বিমান বাহিনী। তাদের দিকে তাকালে কি দেখা যায়? তাদের রয়েছে 'বি-৫২এইচ' বোমারু বিমান; যা প্রথম উড়েছিল ১৯৬০ সালের ১০ই জুলাই; অর্থাৎ ৬৫ বছর আগে! এটা সার্ভিসে আসে ১৯৬১ সালের ৯ই মে। শেষ 'বি-৫২এইচ' বিমান ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়েছিল ১৯৬২ সালের ২৬শে অক্টোবর। তবে এই বিমানের প্রথম ভার্সনটা প্রথম আকাশে উড়েছিল আরও প্রায় দশ বছর আগে ১৫ই এপ্রিল ১৯৫২ সালে। তাহলে ৬০-৭০ বছর আগে তৈরি এই বিমানগুলি যুক্তরাষ্ট্র কেন এখনও ব্যবহার করছে? তারা 'বি-১বি' এবং 'বি-২' বোমারু বিমানও তৈরি করেছে। এরপরও তারা 'বি-৫২'এর মতো মান্ধাতার আমলের বিমান আকাশে ওড়াচ্ছেই শুধু নয়; সারা দুনিয়ার বহু দেশ ধ্বংস করতে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র তো জানে যে, এই বিমানগুলি যে চালানো বিপজ্জনক; নাকি জানে না?
 
শেষ 'বি-৫২এইচ' বিমান ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়েছিল ১৯৬২ সালের ২৬শে অক্টোবর। তাহলে ৬০-৭০ বছর আগে তৈরি এই বিমানগুলি যুক্তরাষ্ট্র কেন এখনও ব্যবহার করছে? বাস্তবতা হলো, একটা দেশ ধ্বংস করার যোগ্যতা কিন্তু এই বিমানগুলির রয়েছে! অনেক ধরণের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এখন এই বিমানে বহণ করা যায়; যার ফলে বিমানগুলি এখনও অত্যন্ত শক্তিশালী কমব্যাট প্ল্যাটফর্ম। অর্থাৎ বিমান মান্ধাতার আমলের হতে পারে; কিন্তু এর বহণ করা অস্ত্র মোটেই মান্ধাতার আমলের নয়।


৩। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের তো এটাও হিসেবে রয়েছে যে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সালের মাঝে সর্বাধুনিক 'এফ-৩৫' যুদ্ধবিমানের ১৬টা দুর্ঘটনা ঘটেছে। সর্বাধুনিক বিমানের ক্ষেত্রেই যদি এতগুলি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে এটা কি বলা যায় যে, বিমান দুর্ঘটনা শুধুই বিমানের বয়সের উপর নির্ভরশীল? আর বিমানের বয়স বলতে কি বোঝানো হবে? বিমানের টাইপের প্রথম ফ্লাইট? নাকি দুর্ঘটনায় পতিত বিমানটার ফ্যাক্টরি থেকে বের হবার তারিখ? উভয় ক্ষেত্রেই 'বি-৫২' বিমানের আকাশে ওড়ার যোগ্যতা থাকার কথা নয়। তবে বাস্তবতা হলো, একটা দেশ ধ্বংস করার যোগ্যতা কিন্তু এই বিমানগুলির রয়েছে! অনেক ধরণের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এখন এই বিমানে বহণ করা যায়; যার ফলে বিমানগুলি এখনও অত্যন্ত শক্তিশালী কমব্যাট প্ল্যাটফর্ম। অর্থাৎ বিমান মান্ধাতার আমলের হতে পারে; কিন্তু এর বহণ করা অস্ত্র মোটেই মান্ধাতার আমলের নয়।

৪। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর 'এফ-৭বিজিআই' বিমানগুলি ২০১১ সালে তৈরি এবং ২০১২ সালে এগুলি বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়। তৈরি করার বয়স বিচারে এগুলি বেশ নতুন। আর এই বিমানগুলি এখন চীনা 'এলএস-৬' জিপিএস গাইডেড গ্লাইড বোমা এবং তুরস্কের 'তেবার' লেজার গাইডেড বোমা ছুঁড়ে ভূমিতে নিখুঁতভাবে টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম। কাজেই যদি প্রাযুক্তিক সক্ষমতার কথা বলা হয়, তাহলে এগুলি একেবারে ফেলে দেবার জিনিস নয়। যে সক্ষমতার অভাব রয়েছে তা হলো, এগুলি দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারে না। এটা এই মুহুর্তে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মাত্র ৬টা 'মিগ-২৯' বিমান পারে ('আর-২৭' ক্ষেপণাস্ত্র)। একারণেই বাংলাদেশের প্রয়োজন 'জে-১০' এবং 'জেএফ-১৭' ফাইটার বিমান। একমাত্র চীন থেকেই দূরপাল্লার এরূপ ক্ষেপণাস্ত্র (‘পিএল-১৫') পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না। তাই এটা ভুলে যাওয়া যায় যে, ‘ইউরোফাইটার টাইফুন' অথবা ফরাসি 'রাফাল' অথবা মার্কিন 'এফ-১৬'এর সাথে দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পাওয়া সম্ভব।
 
অনেকেই বলছেন যে, এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফাইটার বিমান ওড়ানো হচ্ছে কেন? খুবই যৈক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে অন্যস্থানে (যেমন ভারতে) সরিয়ে ফেললেই কি জনগণকে নিরাপদে রাখা যাবে? একটা 'বোয়িং ৭৮৭' যাত্রীবাহী বিমান সর্বোচ্চ ১২৬টন পর্যন্ত জেট ফুয়েল বহণ করতে পারে! এই পরিমাণ জেট ফুয়েল নিয়ে যদি একটা বিমান কুর্মিটোলার আশেপাশে কোন একটা স্কুলের উপর ধ্বসে পড়ে; অথবা প্রধান উপদেষ্টার অফিসের উপর ধ্বসে পড়ে, তাহলে কি হতে পারে?


৫। অনেকেই বলছেন যে, এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফাইটার বিমান ওড়ানো হচ্ছে কেন? খুবই যৈক্তিক প্রশ্ন। তাহলে কি করা উচিৎ? সিঙ্গাপুর বা ইস্রাইলকে অনুসরণ করা উচিৎ। সিঙ্গাপুর ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার ভূমি এবং আকাশসীমা ব্যবহার করে তাদের পাইলটদের ট্রেনিং দেয়; আর ইস্রাইল তুরস্কের আকাশসীমা ব্যবহার করে। কাজেই সিঙ্গাপুর এবং ইস্রাইলের মানুষ থাকে পুরোপুরিভাবে নিরাপদ। যেহেতু বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে নতুন করে আরেকটা বিমান ঘাঁটি তৈরি করা অসম্ভব, তাই যারা এই যুক্তি দিচ্ছেন, তাদের অবশ্যই সমাধান হিসেবে বিমান মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা উচিৎ যে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে যেন ভারতের বিশাল আকাশসীমায় ট্রেনিং নেবার সুযোগ করে দেয়া হয়। এর আগে মুন্সিগঞ্জে বিমানবন্দর প্রকল্প ভেস্তে যাওয়া, বাগেরহাটে খান জাহান আলী বিমানবন্দর প্রকল্প ভেস্তে যাওয়া এবং লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু করা প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়া থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশের যেকোন সরকারের পক্ষে কোন বিমানবন্দর তৈরি বা পুরোনো বিমানবন্দর চালু করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ ভারত এবং মার্কিন সরকারের আরও কাছাকাছি (পড়ুন অনুগত) হতে পারলে বাংলাদেশের মানুষকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জেট ফুয়েল দ্বারা পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো যাবে! অন্য কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাতে 'আউটসোর্স' (চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিএর মতো) করে দিতে পারলেই এদেশের মানুষকে যুদ্ধবিমানের শব্দ শুনতে হবে না। থাকবে শুধু শান্তি; আর শান্তি!

৬। কিন্তু বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে অন্যস্থানে (যেমন ভারতে) সরিয়ে ফেললেই কি জনগণকে নিরাপদে রাখা যাবে? একটা 'বোয়িং ৭৮৭' যাত্রীবাহী বিমান সর্বোচ্চ ১২৬টন পর্যন্ত জেট ফুয়েল বহণ করতে পারে! এই পরিমাণ জেট ফুয়েল নিয়ে যদি একটা বিমান কুর্মিটোলার আশেপাশে কোন একটা স্কুলের উপর ধ্বসে পড়ে; অথবা প্রধান উপদেষ্টার অফিসের উপর ধ্বসে পড়ে, তাহলে কি হতে পারে? কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে গত ১২ই জুলাই ভারতের আহমেদাবাদে এই রকমই একটা বিমানের দুর্ঘটনা থেকে; যেখানে বিমানের ২৪২ জন আরোহী ছাড়াও ভূমিতে আরও ১৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে আসা এই বিমানটা ৫৪ টনের বেশি জেট ফুয়েল বহণ করছিল! এর তুলনায় ঢাকায় ধ্বংসপ্রাপ্ত 'এফটি-৭বিজিআই' যুদ্ধবিমানটা সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৮ টন জেট ফুয়েল বহণ করতে পারে (যদিও তা নিঃসন্দেহে অনেক কম ফুয়েল বহণ করছিল)। কাজেই এই 'এফ-৭'এর স্থলে যদি একটা 'বোয়িং-৭৮৭' বিমান থাকতো, তাহলে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের কোন নিশানা পাওয়া যেতো কিনা সন্দেহ! সুতরাং যারা প্রশ্ন করছেন যে, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর বিমান ওড়ে কেন, তাদের উচিৎ সরকারের কাছে আবেদন জানানো, যাতে করে ঢাকা বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। থার্ড টার্মিনালের মতো মার্কিন প্রকল্পও বন্ধ করার দাবি জানানো উচিৎ; যেটা বাস্তবায়নের উছিলায় মুন্সিগঞ্জে বিমানবন্দরের প্রকল্প বাতিল করা হয়।
 
২০১১ সালের ১১ই জুলাই মিরসরাইএর দুর্ঘটনায় ৪৩ জন শিশুসহ ৪৫ জন নিহত হয়েছিল। কতজন মনে রেখেছে? দুর্ঘটনায় এরূপ অপমৃত্যু বাংলাদেশে নতুন নয়। কিছুদিন সেই ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হয়; বিশেষ করে রাজনৈতিক পক্ষগুলি এর থেকে 'পলিটিক্যাল পয়েন্টস' বের করার চেষ্টায় থাকে; এরপর সকলেই ভুলে যায়। এই ব্যবস্থাটাই চলছে বাংলাদেশে যুগের পর যুগ ধরে। মানুষের আবেগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়; কিন্তু সমস্যার সমাধান করার ইচ্ছা কারুরই থাকে না। বরং যতদিন সমস্যা থাকে, ততদিনই সেটা ভোটের রাজনীতির জন্যে ব্যবহারযোগ্য হয়।


৭। অনেকেই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে গালাগালি দিচ্ছেন – তাদের পাইলট অনভিজ্ঞ; অনভিজ্ঞ পাইলট দিয়ে ঢাকা শহরের উপর দিয়ে বিমান ওড়ানো হচ্ছে; দুর্নীতির আখড়া হয়ে গেছে বিমান বাহিনী; ইত্যাদি। যারা বলছেন, তারা হয়তো জানেন না যে, একটা 'এফ-৭' ফাইটার পাইলট হতে গেলে কতগুলি ধাপ পার করে আসতে হয়। প্রথমে 'পিটি-৬' এবং 'গ্রোব জি-১২০পি' বিমানে ওড়া শিখতে হয়। যারা বিশেষভাবে ভালো পারদর্শিতা দেখায়, তাদের মাঝ থেকেই সাধারণতঃ ফাইটার পাইলট সিলেক্ট করা হয়। এরা আবার 'কে-৮' জেট প্রশিক্ষণ বিমানে ওড়া শেখে। এরপর 'ইয়াক-১৩০' এডভান্সড ট্রেইনার বিমানে অস্ত্র চালনা শেখে। এরপর সে 'এফ-৭' স্কোয়াড্রনে 'এফটি-৭' বিমানে প্রশিক্ষণ নিয়ে টাইপ ফ্লাইং কোয়ালিফাই করে। এই ফ্লাইং কোয়ালিফিকেশনের শেষ ধাপের 'সোলো ফ্লাইট' ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোঃ তৌকির ইসলামের। প্রায় ১০ মিনিট ভালোভাবে ওড়ার পর বিমানটাতে সমস্যা দেখা দেয়। তার সহকর্মীরা বলেন যে, বিমানটা মধ্য আকাশে হঠাত বন্ধ হয়ে যায়। তৌকির শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করছিলেন বিমানটাকে একটা খোলা স্থানে ল্যান্ডিং করাতে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন যে, দু'টা বিমান একসাথে উড়ছিল। এর মাঝে একটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে সমস্যা পড়েছে। এই বিমানটা মাইলস্টোন কলেজের ১০-১২ তলা উঁচু ভবনের সাথে ধাক্কা খেয়ে এরপর দুই তলা স্কুল ভবনের উপর ধ্বসে পড়ে।

৮। পৃথিবীর অনেক দেশের বিমান বাহিনীতেই এতগুলি ধাপ পার হয়ে ফাইটার পাইলট হতে হয় না। একজন ফাইটার পাইলট হতে গেলে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। আর একজন পাইলট খুব বেশিদিন সুপারসনিক বিমানের পাইলট থাকতে পারেন না। এক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আবার অভিজ্ঞ পাইলটদের মূল গুরুত্ব হলো ট্রেইনার হিসেবে। তাই বিমান বাহিনী সাধারণতঃ তাদেরকে বেশি বয়সে ফাইটার বিমান ওড়াতে দেয় না। টাকা খরচ করলে মোটামুটি দ্রুতই একটা বিমান কেনা সম্ভব। কিন্তু একজন পাইলট তৈরি করতে 'অমূল্য' সময় লাগে; যা অর্থ দিয়েও পাওয়া যায় না। গত ২০২৪এর মে মাসেও একটা 'ইয়াক-১৩০' বিমান ধ্বংস হয়ে স্কোয়াড্রন লীডার আসীম জাওয়াদ মৃত্যুবরণ করেন। জাওয়াদ এবং তৌকিরের পেছনে ব্যয় করা পুরো সময়টা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হারিয়েছে; যা পূরণ করতে কয়েক বছর লাগবে।

৯। যারা বলছেন যে, অনভিজ্ঞ পাইলট দিয়ে কেন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার উপর দিয়ে বিমান ওড়ানো হচ্ছে, তাদের অবশ্যই জানা উচিৎ যে গত ২৯শে জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে সামরিক 'ব্ল্যাক হক' হেলিকপ্টারের সাথে যাত্রীবাহী বিমানের সংঘর্ষে ৬৭ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। হেলিকপ্টারের পাইলট ক্যাপ্টেন রেবেকা লোবাক ছয় বছর ধরে সেনাবাহিনীর পাইলট ছিলেন। তার সাথের দু'জন এনসিও ছিলেন, যারা ছিলেন যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এরপরেও একটা অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার একটা বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমানের সাথে ধাক্কা লাগা এড়াতে পারেনি। আর পৃথিবীর সবচাইতে বিপজ্জনক আকাশপথ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এই সামরিক ট্রেনিং মিশনকে বাতিল করেনি। কারণ এই ট্রেনিং মিশনটাকে তারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে; তাই বলে জাতীয় নিরাপত্তাকে ছোট করার মতো ক্ষুদ্র চিন্তা তাদেরকে গ্রাস করেনি।
 
যারা বিমান বাহিনীর সমালোচনা করছেন, তাদের উচিৎ 'প্রকৃত' সমালোচনা করা। এই বিমান বাহিনী হলো সাইফুল আজমের উত্তরসুরী; যিনি ১৯৬৭ সালে একদিনে ৩টা ইস্রাইলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন। এই বিমান বাহিনী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে যখন সাইফুল আজমের শত্রুরা ৫৬ হাজারেরও বেশি মুসলিম ভাই-বোনদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাইলটরা নিঃসন্দেহে অতি উচ্চমানের পাইলট। কিন্তু নিজের ভাই-বোনদের মৃত্যুতে যাদের অন্তর কাঁদে না, তারা আর কারুর চোখে না হলেও আল্লাহর চোখে অপরাধী হবে। ইস্রাইলের বিরুদ্ধে না লড়েও তারা যে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবেন না, সেই প্রমাণ তারা পেয়েছেন। মৃত্যু আসবেই; কিন্তু তাদের কাছে অপশন ছিলো - মৃত্যুটা কতটা সন্মানের হবে। হয়তো ২০২৫ সালের ২১শে জুলাইয়ের মর্মান্তিক ঘটনা তাদেরকে সেটাই মনে করিয়ে দেবে।


১০। যারা দুর্নীতির কথা বলছেন, তারা দুর্নীতির আসল আখড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। এই ব্যবস্থায় মানুষকে শেখানো হয় যাতে করে ব্যক্তিগত বেনেফিট ছাড়া কেউ কোন কাজ না করে। দুর্নীতি করলে তো ব্যক্তিগত বেনেফিট হয়; তাহলে কেন সেটা খারাপ হবে? ব্যক্তিগত বেনেফিটের এই একই চিন্তা বাংলাদেশের সকল মানুষকেই শুধু দেয়া হয় না, রাষ্ট্রও চলে বেনেফিটের উপর ভিত্তি করে। যেমন, হাসিনা সরকার বেনেফিটের কথা চিন্তা করেই ভারতের আদানির সাথে রাষ্ট্রবিরোধী চুক্তি করেছিল; যা আবার অন্তর্বর্তী সরকারও বজায় রেখেছে। বেনেফিট চিন্তা করেই সরকার এই চুক্তি বাতিল করেনি অথবা সীমান্ত ও অন্যান্য ইস্যুতে ভারতের সাথে ঝামেলায় জড়ায়নি। বেনেফিট রয়েছে বলেই সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশীদেরকে দিতে চাইছে। বেনেফিট চিন্তা করেই ভারতের সুবিধার্থে তৈরি করা মাতারবাড়ি বন্দরকে সরকার অর্থনৈতিক বিষফোঁড়া মনে করছে না; অথচ পায়রা বন্দরকে ক্ষতিকর মনে করছে। বেনেফিট চিন্তা করেই প্রধান উপদেষ্টা চাডিগাঁও ভাষায় চট্টগ্রামের মানুষকে বুঝিয়েছেন যে মাতারবাড়ি বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশের কি কি বেনেফিট হবে। যখন পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাটাই চলছে বেনেফিটের উপর ভিত্তি করে, তখন এই ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে নির্দিষ্ট কোন একটা গোষ্ঠীকে টার্গেট করার অর্থ হলো, কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলি বলা হচ্ছে।

যারা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি সরিয়ে ফেলার কথা বলছেন, তারা ভারতের ন্যারেটিভ অনুসরণ করছেন। ভারতীয় মিডিয়া এই ঘটনাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি করতে এবং বাংলাদেশের সাথে চীনের (বিমান নির্মাতা) দূরত্ব তৈরি করতে। তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, ‘এফ-৭' বিমানের স্থলে 'বোয়িং-৭৮৭' বিমান থাকলে মাইলস্টোন কলেজ, স্কুল ও আশেপাশের বহু স্থাপনার অস্তিত্বই থাকতো না! যারা বিমান বাহিনীর সমালোচনা করছেন, তাদের উচিৎ 'প্রকৃত' সমালোচনা করা। এই বিমান বাহিনী হলো সাইফুল আজমের উত্তরসুরী; যিনি ১৯৬৭ সালে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের 'হান্টার' যুদ্ধবিমান উড়িয়ে একদিনে ৩টা ইস্রাইলি যুদ্ধবিমান (অপেক্ষাকৃত উচ্চমানের) ভূপাতিত করেছিলেন। এই বিমান বাহিনী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে যখন সাইফুল আজমের শত্রুরা ৫৬ হাজারেরও বেশি মুসলিম ভাই-বোনদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাইলটরা নিঃসন্দেহে অতি উচ্চমানের পাইলট। কিন্তু নিজের ভাই-বোনদের মৃত্যুতে যাদের অন্তর কাঁদে না, তারা আর কারুর চোখে না হলেও আল্লাহর চোখে অপরাধী হবে। ইস্রাইলের বিরুদ্ধে না লড়েও তারা যে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবেন না, সেই প্রমাণ তারা পেয়েছেন। মৃত্যু আসবেই; কিন্তু তাদের কাছে অপশন ছিলো - মৃত্যুটা কতটা সন্মানের হবে। হয়তো ২০২৫ সালের ২১শে জুলাইয়ের মর্মান্তিক ঘটনা তাদেরকে সেটাই মনে করিয়ে দেবে।






সূত্রঃ




‘Stratofortress... The Big One from Boeing’ by Robert F Dorr in Air Enthusiast, Summer 1990

‘Pilot is safe after crash of F-35 fighter jet seen in dramatic video’ in CNN, 29 January 2025

‘What we know so far about Air India crash investigation’ in BBC, 12 July 2025

‘AI-171’s flight to tragedy: A minute-by-minute account of events that led to Ahmedabad plane crash’ Deccan Herald, 12 July 2025

‘মিরসরাই ট্র্যাজেডি: সেদিন যেভাবে প্রাণ হারিয়েছিল ৪৩ শিশুসহ ৪৫ জন' প্রথম আলো, ১১ই জুলাই ২০২৪

‘Pilot tried to avoid disaster by steering crashing jet away from populated area: ISPR’ in The Business Standard, 21 July 2025

‘At least 27 Air Force jet crashes in last 3 decades’ in Dhaka Tribune, 11 July 2025

‘Palestinians mourn death of a Bangladeshi war hero’ in Al-Jazeera, 15 June 2020

‘What we know about the deadly air crash between a passenger jet and a US Army helicopter’ in Associated Press, 28 March 2025

‘Friends say Army captain killed in midair collision was a ‘brilliant and fearless’ patriot’ in Associated Press, 03 February 2025

Tuesday, 24 June 2025

ট্রাম্পের ১২ দিনের যুদ্ধ কিভাবে শেষ হলো?

২৪শে জুন ২০২৫

'বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এটা ছিল সবচাইতে অমায়িক যুদ্ধের একটা উদাহরণ! কারণ ইরান একদিকে যেমন আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বলে দিয়েছিল, তেমনি ট্রাম্প ইরানকে ধন্যবাদ দিয়েছেন কাউকে হতাহত না করার জন্যে। ট্রাম্প যখন বলেছেন যে, তিনি আশা করছেন না যে, ইরান এরপর আর কোন হামলা করবে, তখন এটা চিন্তা করা কঠিন যে, ইরান যুদ্ধ চালিয়ে নেবে। তবে ট্রাম্প ইস্রাইলকেও বলেছেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত না করতে। অন্ততঃ গত দুই সপ্তাহে মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়াতে সত্য-অসত্য মিলে যা প্রচারিত হয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে ঘোরের মাঝে রাখার জন্যে যথেষ্ট ছিল। অনেকে তো মনে করা শুরু করেছিলেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে কিনা? এখানেই ভূরাজনীতির খেলাগুলি; যা খুবই সাধারণ চিন্তার উপর; কিন্তু সাধারণের জন্যে বোঝা খুবই কঠিন। অন্ততঃ পত্রিকা পড়ে কারুর পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয়।



২৪শে জুন যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা দেন যে, ইরানের সাথে ১২ দিনের যুদ্ধের অবসান হয়েছে, তখন এটা অনেকের জন্যেই বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। ট্রাম্প ইরানকে ধন্যবাদ দেন যে, ইরান কাতারের আল-উদাইদ বিমান ঘাঁটিতে হামলার আগে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল। 'বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এটা ছিল সবচাইতে অমায়িক যুদ্ধের একটা উদাহরণ! কারণ ইরান একদিকে যেমন আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বলে দিয়েছিল, তেমনি ট্রাম্প ইরানকে ধন্যবাদ দিয়েছেন কাউকে হতাহত না করার জন্যে। ট্রাম্প যখন বলেছেন যে, তিনি আশা করছেন না যে, ইরান এরপর আর কোন হামলা করবে, তখন এটা চিন্তা করা কঠিন যে, ইরান যুদ্ধ চালিয়ে নেবে। তবে ট্রাম্প ইস্রাইলকেও বলেছেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত না করতে।

অন্ততঃ গত দুই সপ্তাহে মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়াতে সত্য-অসত্য মিলে যা প্রচারিত হয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে ঘোরের মাঝে রাখার জন্যে যথেষ্ট ছিল। অনেকে তো মনে করা শুরু করেছিলেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে কিনা? এখানেই ভূরাজনীতির খেলাগুলি; যা খুবই সাধারণ চিন্তার উপর; কিন্তু সাধারণের জন্যে বোঝা খুবই কঠিন। অন্ততঃ পত্রিকা পড়ে কারুর পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয়।

যুদ্ধ সম্পর্কে পশ্চিমা চিন্তাবিদদের কথাগুলি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেগুলি বলে দেয় যে, পশ্চিমারা কি চাইছে। আর সেটা একইসাথে বলে দেয় যে, ইরান পশ্চিমাদের ইচ্ছাগুলিকে কতটা গুরুত্বের সাথে দেখেছে বা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে কিনা। কেনই বা ইরান চার দিন আগে খালি করে ফেলা কাতারের আল-উদাইদ বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করলো? আর ট্রাম্প কেনই বা এর প্রত্যুত্তর না দিয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন? মোট কথা, পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মন্তব্যগুলি শুনে বোঝা যায় যে উভয় পক্ষ একই সুরে নাচার চেষ্টা করছে কিনা। যদি সেটা হয়েই থাকে, তার অর্থ হলো, যুদ্ধবিরতি খুবই সন্নিকটে।
 

যদি ধরে নেয়া হয় যে, ইরান ফোর্দো থেকে এনরিচড ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে, তথাপি এটা নিশ্চিত নয় যে, কি পরিমাণ এনরিচড ইউরেনিয়াম সেখান থেকে সরানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও সেগুলি দিয়ে একটা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা খুব সহজ কাজ নয়। এনরিচড ইউরেনিয়াম থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে গেলে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি এবং স্থাপনার প্রয়োজন; যেগুলি ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ধ্বংস করেছে; বা সেগুলির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে। এর ফলে ইরান যদি একটা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে যায়, তাহলে তাকে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলিকে আবারও তৈরি করতে হবে; যা বহু সময়ের ব্যাপার। মোটকথা এই আক্রমণের মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গেলো।


ফোর্দো এবং ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার কি হবে?

‘স্কাই নিউজ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন প্রধান মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, যেহেতু খবরে প্রকাশ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে বোমাবর্ষণের আগে ইরানিদেরকে আগেভাগে সতর্ক করেছিল, তার অর্থ হলো ইরান যথেষ্ট সময় পেয়েছে তাদের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা খালি করার। ইরানের খুব ভালো করেই জানার কথা যে, সারা দুনিয়ার স্যাটেলাইটগুলি এখন ফোর্দোর ছবি তুলছে। তাই ইরান যখন ফোর্দোর স্থাপনার পাশের রাস্তায় ২০টার মতো ট্রাক জমা করে রেখেছিল, সেটা হতে পারে যে, ইরান জানান দিচ্ছিলো যে, তারা ফোর্দো থেকে এনরিচড ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিচ্ছে; অথবা তারা হয়তো সারা বিশ্বকে জানাতে চাইছিলো যে, তারা ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিচ্ছে; যদিও তারা সেটা সেই মুহুর্তে করেনি। যদি ধরে নেয়া হয় যে, ইরান ফোর্দো থেকে এনরিচড ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে, তথাপি এটা নিশ্চিত নয় যে, কি পরিমাণ এনরিচড ইউরেনিয়াম সেখান থেকে সরানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও সেগুলি দিয়ে একটা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা খুব সহজ কাজ নয়। এনরিচড ইউরেনিয়াম থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে গেলে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি এবং স্থাপনার প্রয়োজন; যেগুলি ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ধ্বংস করেছে; বা সেগুলির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে। এর ফলে ইরান যদি একটা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে যায়, তাহলে তাকে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলিকে আবারও তৈরি করতে হবে; যা বহু সময়ের ব্যাপার। মোটকথা এই আক্রমণের মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গেলো।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়ান ব্রেমার 'ইউরেশিয়া গ্রুপ'এর 'জি-জিরো মিডিয়া'র এক পডকাস্টে বলছেন যে, আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছিলো যে, ইরান নিজেই তার স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলুক। এটা ইরানের নেতৃত্বের জন্যে অতি অপমানজনক ছিল। তাই ইরানিরা চাইছিলো যে, দরকার হলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মুখে তাদের সামরিক দুর্বলতাকেই তুলে ধরবে; যা হয়তো ইরানের জনগণের কাছে নিজেদের স্থাপনা নিজেরা ধ্বংস করার চাইতে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তাই ইরানের নেতৃত্ব চাইছিলো যে, মার্কিনীরাই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলুক। অপরদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিঃসন্দেহে ইরানের সাথে সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করতে চাননি। তিনি জানেন যে, বেশিরভাগ মার্কিন জনগণ সেটা সমর্থন করবে না; এমনকি তার সমর্থকদের মাঝেও অনেকে যুদ্ধ চাইবে না। ট্রাম্প চেয়েছেন একটা ঝটপট যুদ্ধ; অনেকটা 'টিকটক-স্টাইলে'। তার প্রথম টার্মের সময় ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের আবকাইক তেল শোধনাগারে ইরানের তৈরি ড্রোন দিয়ে হামলা হলেও আরব দেশগুলি এবং ইস্রাইলের যথেষ্ট চাপ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু এর প্রায় তিন মাস পর ২০২০এর জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজ ছাড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ট্রাম্প ইরানের জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দেন। ইরানিরা যথেষ্ট রাগ প্রদর্শন করলেও অকার্যকর লোক দেখানো কিছু হামলার মাঝেই ইরান তাদের প্রত্যুত্তরকে সীমিত করেছিল। ট্রাম্প হয়তো আশা করেছেন যে, এবারও ইরান সেরকমই আচরণ করবে। ব্রেমার বলছেন যে, যদি ইরান এবং তার প্রক্সিগুলির হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মাঝে তেমন একটা হতাহত না হয়, তাহলে ট্রাম্প ধরে নিতে পারেন যে, এই যাত্রায় তিনি জিতে গেছেন। একইসাথে ইস্রাইলও ধরে নেবে যে, তারা জিতেছে; যদিও এতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি।

ইরানে মার্কিন হামলার আন্তর্জাতিক প্রভাব কতটুকু?

যুদ্ধবিরতির আগে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি' বা 'সিআইএ'র প্রাক্তন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গ্লেন কর্ন নিরাপত্তা বিষয়ক ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'এর সাথে সাক্ষাতে বলেছেন যে, কেউ কেউ বলছেন যে, রাশিয়া ইরানকে সামরিক সহায়তা দেবে। কিন্তু তিনি মনে করছেন না যে, রাশিয়ার আদৌ সেই বাস্তবতা রয়েছে। কারণ তারা নিজেরাই ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে বের হতে পারেনি। আর কিছুদিন আগেই যখন সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারের পতন ঘটেছিল, তখনও রাশিয়া কিছুই করতে পারেনি। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের কারণে যদি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো খুশি হতে পারেন; কিন্তু তার বন্ধু শি জিনপিং মোটেই খুশি হবে না। তবে পুতিন হয়তো দুশ্চিন্তায় থাকবেন যে, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে তার আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হারাতে পারেন। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা থেকেও পুতিন শিক্ষা নিতে পারেন। সত্য বা মিথ্যা সেটা নিশ্চিত নয়, তবে বাজারে ছড়িয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলকে সহায়তা দেয়ার জন্যেই ইরানের সাথে আলোচনা চালিয়ে নিয়েছে; যাতে করে ইরানিদের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে থাকে। এর মাধ্যমে পুতিনের জন্যে শিক্ষা হলো, ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন নীতি কি হবে, তা আগে থেকে বলা কঠিন।
 
ইরানের সক্ষমতা রয়েছে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়ার। তবে সেটা তারা খুব সম্ভবতঃ বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না। কারণ ১৯৮০এর দশকে ইরান যখন প্রথমবারের মতো এই কাজটা করেছিল, সেই সময় থেকে প্রযুক্তি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আরব দেশগুলির কাছে যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে এগুলিকে মোকাবিলা করার। তবে ইরান যদি কয়েক সপ্তাহের জন্যে হরমুজ বন্ধ করে রাখতে সক্ষম হয়, তাহলে তা তেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্যে যথেষ্ট।



ইরান কি হরমুজ আটকে দিতে পারতো?

যুদ্ধবিরতির আগে গ্লেন কর্ন বলছিলেন যে, বর্তমান অবস্থা থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে যদি ইরান যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক বন্ধুদের উপর, বিশেষ করে তাদের তেলের স্থাপনাগুলির উপর হামলা করে, অথবা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে অথবা মধ্যপ্রাচ্য বা এর বাইরে মার্কিন স্বার্থের উপর সামরিক বা বড় আকারের সাইবার হামলা করে। রালফ গফ বলছেন যে, এই মুহুর্তে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, ইরানের কিছু না কিছু প্রত্যুত্তর দিতেই হবে। কাশেম সুলাইমানিকে হত্যার পর ইরান প্রতিশোধ নেবে বলেছিল; কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হলেছিল। কিন্তু তার মানে এ-ই নয় যে, তারা সকল ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হবে। ইরানের 'আইআরজিসি' ইরানের বাইরে সরকার বিরোধীদেরকে টার্গেট করতে পারে। এছাড়াও ইরানের সাইবার হামলার সক্ষমতাও রয়েছে।

যুদ্ধবিরতির আগে ‘সিআইএ'তে ইরানের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাক্তন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ম্যানেজার নরমান রুল 'সাইফার ব্রীফ'কে দেয়া সাক্ষাতে বলেছেন যে, হরমুজ প্রণালির কথা উঠলেই সকলে তেলের কথা চিন্তা করে। কিন্তু তেল ছাড়াও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে। যেমন, কাতার বর্তমানে চীন, ভারত, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশগুলির জন্যে প্রধান এলএনজি সরবরাহকারী। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারে পেট্রোকেমিক্যাল সরবরাহের একটা বড় অংশ যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মিথানল এবং রাসায়নিক সারের বড় সরবরাহকারী এখন মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্য থেকে গ্যাস এবং এলএনজি সরবরাহের সমস্যা তৈরি হলে রাসায়নিক সারের সরবরাহেও সমস্যা তৈরি হবে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাথর, চুনাপাথর ও ক্লিংকার ভারত এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে রপ্তানি হয়। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও খাবার, চিনি, সয়াবিন ইত্যাদির জন্যে আমদানির উপর নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালি আটকে গেলে এই সকল পণ্যের সরবরাহেই সমস্যা তৈরি হবে এবং এগুলির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারলে ইরান সাময়িকভাবে এর সুবিধা নিতে পারবে। কারণ ইরানের রয়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টা তেলের ট্যাঙ্কার জাহাজ; যেগুলি প্রায় ৪০ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল নিয়ে পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রে অবস্থান করছে। তেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হলেই এই জাহাজগুলি চীনের তেল শোধনাগারগুলিতে তেল সরবরাহ করবে। নরমান রুল বলছেন যে, ইরানের সক্ষমতা রয়েছে হরমুজ প্রণালি দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের জন্যে ব্যাপক সমস্যা তৈরি করার। জিপিএস জ্যামিং-এর কারণে কোন একটা জাহাজ তার অবস্থান হারিয়ে ভুলবশতঃ ইরানের জলসীমানায় ঢুকে যেতে পারে। তখন ইরানিরা সেই জাহাজটাকে দখলে নিয়ে নিতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন রকম অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে পারে।
 
ইরানিদের দিক থেকে অনেক হুমকি শোনা গেছে; কিন্তু বাস্তবে সেটা করাটা ভিন্ন বিষয়। এরূপ হামলা মুহুর্তের মাঝেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যকে ১'শ ডলারের উপর নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইস্রাইলিরা যখন একসাথে ইরানের সকল শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বকে হত্যা করেছে, তখন কতটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ইরানিরা সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই নেবে? এমনও হতে পারে যে, যারা নতুন নেতৃত্ব নেবে, তারা তাদের আবেগকে প্রাধান্য দেবে। আর যখন ইরানের সক্ষমতা দিন দিন নিচের দিকে যাচ্ছে, তখন নেতৃত্বে আসা নতুন লোকেরা আগের মতোই সিদ্ধান্ত নেবে - এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।


ইরানের অস্ত্রগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছেন ব্রিটিশ সামরিক বিশ্লেষক এবং রয়াল নেভির প্রাক্তন কর্মকর্তা এইচ আই সাটন। তিনি তার 'কোভার্ট শোরস' চ্যানেলে এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, ইরানের নৌবাহিনী এবং আইআরজিসি-র জাহাজগুলি যত সুন্দর দেখতেই হোক না কেন, সেগুলি পশ্চিমাদের জন্যে কোনরূপ হুমকি হিসেবে দেখা দেবে না। ইরানের সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে সামুদ্রিক মাইন। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের মাইন অপসারণের জন্যে জাহাজ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এগুলির কাজ সঠিকভাবে করতে হলে জাহাজগুলিকে ইরানের আক্রমণ থেকে পুরোপুরি সুরক্ষা প্রদান করতে হবে; যা মোটেই সহজ হবে না। ইরানের ছোট ছোট সাবমেরিনগুলি, বিশেষ করে 'ঘাদির-ক্লাস'এর সাবমেরিনগুলি টর্পেডো এবং মাইনের মাধ্যমে হরমুজ প্রণালির পণ্যবাহী জাহাজগুলি ধ্বংস করতে পারে। ইরানের জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলির কিছু ইয়েমেনের হুথিরা ব্যবহার করেছে। এগুলির সফলতা নির্ভর করছে কোন জাহাজে হামলা করা হচ্ছে এবং জাহাজে কি পণ্য বহণ করা হচ্ছিলো সেটার উপর। এগুলি চীনা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অতটা শক্তিশালী না হলেও জাহাজের যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে। ইরানের জাহাজ-ধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মাঝে রয়েছে 'নূর' (চীনা 'সি-৮০২'এর কপি) এবং 'নাসর-১' (চীনা 'সি-৭০৪'এর কপি)। এগুলি জাহাজ ডুবাতে সক্ষম না হলেও যেকোন জাহাজের যথেষ্ট ক্ষতি করতে সক্ষম। তবে একবার ব্যবহার করার পরেই এগুলির লঞ্চারগুলি খুব সম্ভবতঃ পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স খুঁজে পাবে এবং ধ্বংস করে ফেলবে। ইরানের ছোট ছোট স্পীডবোটগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব বহণ করবে; বিশেষ করে মনুষ্যবিহীন সুইসাইড বোটগুলি, যেগুলি ওয়ারহেড বহণ করে পণ্যবাহী জাহাজের গায়ে হামলা করতে পারে। ইয়েমেনের হুথিরা এগুলির কার্যকারিতা দেখিয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে ইরান নিঃসন্দেহে এরকম অনেক বোট একসাথে পানিতে নামাতে পারবে। এছাড়াও ইরানের রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের সুইসাইড ড্রোন বিমান; যেগুলি হয়তো কোন জাহাজ ডোবাতে পারবে না, তবে একসাথে অনেকগুলি ছুঁড়লে একটা শক্ত ডিটারেন্স তৈরি করতে পারে। যদিও এগুলিকে গুলি করে ধ্বংস করাটা খুব কঠিন নয়, তথাপি একটা বেসামরিক জাহাজের জন্যে এটা যথেষ্টই হুমকি। আর এগুলির শক্তিশালী দিক হলো পাল্লা। ভারত মহাসাগরের গভীরে গিয়েও এগুলি একটা জাহাজে হামলা করতে পারবে। ইরানের যেসকল স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলি হরমুজে বেশ কাজ করবে; বিশেষ করে পশ্চিমা মাইন অপসারণ হেলিকপ্টার এবং সার্ভেইল্যান্স ড্রোনের বিরুদ্ধে এগুলি যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে। ইয়েমেনের হুথিরা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটা মার্কিন 'রীপার' ড্রোন ধ্বংস করে যথেষ্ট নাম কামিয়েছে।

নরমান রুল বলছেন যে, ইরানের সক্ষমতা রয়েছে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়ার। তবে সেটা তারা খুব সম্ভবতঃ বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না। কারণ ১৯৮০এর দশকে ইরান যখন প্রথমবারের মতো এই কাজটা করেছিল, সেই সময় থেকে প্রযুক্তি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আরব দেশগুলির কাছে যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে এগুলিকে মোকাবিলা করার। তবে ইরান যদি কয়েক সপ্তাহের জন্যে হরমুজ বন্ধ করে রাখতে সক্ষম হয়, তাহলে তা তেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্যে যথেষ্ট।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার বলেছেন যে, যেহেতু ইরানের তেলের স্থাপনাগুলি এখনও হামলার শিকার হয়নি, তাই ইরানও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা বা আরব দেশগুলির তেলের স্থাপনাগুলির উপর হামলার মতো সিদ্ধান্ত না-ও নিতে পারে। ইরানিদের দিক থেকে অনেক হুমকি শোনা গেছে; কিন্তু বাস্তবে সেটা করাটা ভিন্ন বিষয়। এরূপ হামলা মুহুর্তের মাঝেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যকে ১'শ ডলারের উপর নিয়ে যেতে পারে। অপরদিকে মার্কিনীরা হরমুজে ইরানের যেকোন আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্যে যথেষ্টই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ব্রেমার বলছেন যে, এখনও পর্যন্ত ইরানি নেতৃত্ব সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কিন্তু ইস্রাইলিরা যখন একসাথে ইরানের সকল শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বকে হত্যা করেছে, তখন কতটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ইরানিরা সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই নেবে? এমনও হতে পারে যে, যারা নতুন নেতৃত্ব নেবে, তারা তাদের আবেগকে প্রাধান্য দেবে। আর যখন ইরানের সক্ষমতা দিন দিন নিচের দিকে যাচ্ছে, তখন নেতৃত্বে আসা নতুন লোকেরা আগের মতোই সিদ্ধান্ত নেবে - এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

ইয়ান ব্রেমার পরবর্তীতে 'সিএনএন'এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, ইরানের সরকার ইস্রাইল এবং মার্কিন সামরিক স্থাপনার উপর হামলাগুলিকে বেশ বড় করে দেখিয়েছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দাবি করেছে। এবং একইসাথে তারা বলেছে যে, ফোর্দোতে তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই কথাগুলি তারা বলেছে ইরানের জনগণকে ঠান্ডা করার জন্যে। অথচ সত্যটা হলো, মার্কিন ঘাঁটিগুলিতে হামলার আগে ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে, যাতে করে মার্কিনীদের মাঝে কেউ হতাহত না হয়। ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিচ্ছিলো যে, যুক্তরাষ্ট্র যেন নতুন করে আর কোন হামলা না করে। ইরান ইচ্ছা করলে এমন সকল টার্গেটে হামলা করতে পারতো, যেখানে মার্কিনীদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ততটা শক্তিশালী নয়। অথবা তারা যদি আগাম বলে না দিতো, সেক্ষেত্রেও মার্কিনীদের জন্যে কিছুটা সমস্যা হতো। তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার দিকেও আগায়নি। ইরানের নেতৃত্ব বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এগিয়েছে। অপরদিকে ট্রাম্প ইস্রাইলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেছেন ঠিকই কিন্তু ইস্রাইল সেটা কতটুকু মানবে, সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। আর ইস্রাইল যদি ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলে ইরানেও যে আবেগপ্রবণ হয়ে কেউ কিছু করবে না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
 
লেবাননের শিয়াদের মাঝে অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, যখন লেবাননের উপর ইস্রাইলি হামলা চলছিলো, তখন কেন ইরান তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ব্যবহার করেনি? ইরান কেন লেবাননে তাদের বন্ধুদের রক্ষায় এগিয়ে এলো না? আর হিযবুল্লাহর সদস্যরা এখন ইরানের সাথে ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতে সরাসরি যুক্ত হতে চাইছে না। অন্ততঃ সাম্প্রতিক সময়ে ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স হিযবুল্লাহর নেতৃত্বকে যেভাবে টার্গেট করেছে, সেটার পুনরাবৃত্তি তারা দেখতে চাইছে না। তবে হিযবুল্লাহর মাঝে হতাশ হয়ে যাওয়া কিছু গ্রুপ ইস্রাইল ও মার্কিন টার্গেটে হামলা করার চেষ্টা করলে অবাক হবার কিছু নেই।


ইরানের প্রক্সিগুলির ভবিষ্যৎ কি?

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি' বা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা রালফ গফ নিরাপত্তা বিষয়ক ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'এর সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্স একদিকে যেমন ৭ই অক্টোবরের হামলায় নিজেদের ব্যার্থতা দেখিয়েছে; ঠিক তেমনি পরবর্তীতে আশ্চর্য্য রকম নিখুঁতভাবে হামাস এবং হিযবুল্লাহর নেতৃত্বকে ধ্বংস করে তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। এর মাধ্যমে ইস্রাইল ইরানের আঞ্চলিক প্রক্সিগুলিকে একেবারেই দুর্বল করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরানে হয়তো অনেকেই প্রশ্ন করা শুরু করবে যে, আঞ্চলিক প্রক্সি এবং পারমাণবিক প্রকল্পের পিছনে ইরান যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছিল, তার কোনটাই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। আর পর্দার আড়ালে নিশ্চয়ই অনেক বার্তা দেয়া হবে ইরানের প্রক্সিগুলিকে, যাতে করে তারা ভবিষ্যতে ইরানের লেজুড়বৃত্তি করা থেকে দূরে থাকে।

গ্লেন কর্ন বলছেন যে, ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র এখন চাইছে হিযবুল্লাহকে পুরোপুরিভাবে নিরস্ত্র করতে। কিন্তু লেবাননের সেনাবাহিনীর সেই সক্ষমতা নেই; এবং একইসাথে লেবাননের সরকারের আর্থিক সক্ষমতা নেই ইস্রাইলি হামলায় লেবাননের ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাগুলিকে পুনর্গঠন করার। অথচ এটা সকলেই জানে যে, লেবাননে হিযবুল্লাহর জনপ্রিয়তার একটা বড় কারণ হলো লেবাননের অর্থনীতিতে ইরানের আর্থিক বিনিয়োগ। তবে গ্লেন কর্ন বলছেন যে, লেবাননে তার পরিচিতদের থেকে তিনি জানতে পারছেন যে, লেবাননের শিয়াদের মাঝে অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, যখন লেবাননের উপর ইস্রাইলি হামলা চলছিলো, তখন কেন ইরান তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ব্যবহার করেনি? ইরান কেন লেবাননে তাদের বন্ধুদের রক্ষায় এগিয়ে এলো না? আর হিযবুল্লাহর সদস্যরা এখন ইরানের সাথে ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতে সরাসরি যুক্ত হতে চাইছে না। অন্ততঃ সাম্প্রতিক সময়ে ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স হিযবুল্লাহর নেতৃত্বকে যেভাবে টার্গেট করেছে, সেটার পুনরাবৃত্তি তারা দেখতে চাইছে না। তবে হিযবুল্লাহর মাঝে হতাশ হয়ে যাওয়া কিছু গ্রুপ ইস্রাইল ও মার্কিন টার্গেটে হামলা করার চেষ্টা করলে অবাক হবার কিছু নেই।
 
আল-উদাইদ বিমান ঘাঁটি আমেরিকানরা খালি করেছিল চার দিন আগেই। এরপরেও ইরানিরা এই ঘাঁটিতেই হামলা করে এবং হামলার আগে আমেরিকানদেরকে আগাম সতর্কবাণীও দেয়। পশ্চিমারা যখন একটা মুসলিম দেশকে ধ্বংস করেছে, তখন বাকিরা সাইডলাইনে বসে ছিল। তারা কি জানতো না যে, তাদের পালা আসছে? হয়তো তারা জানতো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির সামনে ইরানের আত্মসমর্পণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আগে থেকে জানলেও তারা তাদের তথাকথিত বাস্তবতাকে মেনেই নিয়েছে। এবং সেই অনুযায়ীই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে - একই সুরে নেচেছে। বিনিময়ে তারা আপাততঃ ক্ষমতা ধরে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি, হয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত। 


ইরানের সরকার পতনের সম্ভাবনা কতটুকু?

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে 'সিআইএ'র রালফ গফ বলেছেন যে, গত কয়েক দশকে ইরানের সরকারের সমর্থনে লেবানন এবং ইরাকের মিলিশিয়ারা বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সামরিক সদস্যাদের উপর হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একটা দুর্বল ইরানের সুযোগ নিয়ে সেই হামলাগুলির শোধ নিয়েছে দেখে তিনি খুশি হয়েছেন। তবে যেহেতু ইরানের সরকার পরিবর্তনকে মার্কিন সরকার তাদের প্রকাশ্য লক্ষ্যের মাঝে রাখেনি, তাই ইরানের সরকারকে তার যতটাই অপছন্দ হোক না কেন, তাদেরকে মেনে নিতেই হচ্ছে। ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, ইস্রাইলিদের সক্ষমতা নেই ইরানের সরকার পরিবর্তন করার। এই কাজটা শুধুমাত্র বোমা ফেলে বা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে করা যাবে না; প্রয়োজন হবে বড় আকারের সেনাবাহিনীর; যেটার ব্যাপারে এই মুহুর্তে পশ্চিমাদের কেউই আগ্রহী নয়। আর আরও বড় কথা হলো, ইরানের ৯ কোটি মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে; যার কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। বলাই বাহুল্য যে, ইরান সিরিয়া নয়। বরং যেটা হবার সম্ভাবনা বেশি তা হলো, ইরানের দুর্বল হয়ে যাওয়া নেতৃত্ব আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন গ্রুপকে সহায়তা দেবে। এই কাজটা করার জন্যে তাদের হারাবার কিছু থাকবে না; কারণ তাদের ডিটারেন্সগুলি সবগুলিই নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইরানিরা জানবে যে, ইস্রাইলিরা যেকোন মুহুর্তে হামলা করে তাদের নেতৃত্বকে হত্যা করতে পারে। এরূপ পরিস্থিতিতে ইরানের নেতৃত্বে যারা থাকবে, তারা অনেক ক্ষেত্রেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবেগকে প্রাধান্য দিতে পারে।

ট্রাম্পের সমালোচক হয়েও ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, একদিন আগেও যেটা পরিষ্কার ছিল না তা হলো, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ট্রাম্পের জন্যে একটা বিরাট সফলতা। কারণ কয়েক দশক ধরে কয়েকটা মার্কিন প্রশাসন যেটা করতে পারেনি (ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করা), সেটা ট্রাম্প করে দেখিয়েছেন কয়েক দিনের মাঝে। ইরান সেভাবেই কাজ করেছে, যা ট্রাম্প চেয়েছেন; একারণেই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন। ব্রেমারের কথাগুলি পশ্চিমা চিন্তারই প্রতিফলন – পশ্চিমারা চাইছে মুসলিম বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন জাতিরাষ্ট্রগুলি একে একে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সামনে নিজেদেরকে সঁপে দেয়। ২০০১ সালে আফগানিস্তান, ২০০৩ সালে ইরাক, ২০১১ সালে লিবিয়া এবং সিরিয়া, ২০২৩ সালে গাজা, ২০২৪-২৫ সালে লেবাননের পর ২০২৫ সালে ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা হামলার ইতিহাস যেন আগেই লিখা হয়ে গিয়েছিল। এখন শুধু হিসেব করতে হবে যে, পরবর্তী টার্গেট কে? পাকিস্তান? তুরস্ক? মিশর? বাংলাদেশ? ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে এবং লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করেছে। তারা যখন একটা দেশকে ধ্বংস করেছে, তখন বাকিরা সাইডলাইনে বসে ছিল। তারা কি জানতো না যে, তাদের পালা আসছে? হয়তো তারা জানতো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির সামনে ইরানের আত্মসমর্পণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আগে থেকে জানলেও তারা তাদের তথাকথিত বাস্তবতাকে মেনেই নিয়েছে। এবং সেই অনুযায়ীই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে - একই সুরে নেচেছে। বিনিময়ে তারা আপাততঃ ক্ষমতা ধরে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি, হয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত। এ যেন স্যামুয়েল হান্টিংটনের 'ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস'এর কার্বন কপি। ১৯৯৬ সালে হান্টিংটন কিন্তু ধরেই নিয়েছিলেন যে, মুসলিমরা একসময় একত্রিত হবেই; যা হবে পশ্চিমা সভ্যতার জন্যে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। একারণেই তিনি লিখেছিলেন যে, চীন (যারা খুব সম্ভবতঃ মুসলিমদের সহায়তা করবে) এবং মুসলিম বিশ্বের প্রচলিত ও অপ্রচলিত সামরিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করতে হবে। যারা তখন বোঝেনি, আজকেও কি তারা এটা বুঝতে পারছেন না?

Sunday, 11 May 2025

ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধ – বাকি বিশ্বের জন্যে শিক্ষা

১১ই মে ২০২৫

ফরাসি 'রাফাল' বিমানগুলি অকার্যকর কিনা; অথবা চীনা ‘জে-১০’ বিশ্বসেরা বিমান কিনা - এগুলি নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। প্রকৃতপক্ষে একটা টাইপের হার্ডওয়্যার দিয়ে কোন যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 'কাম্ফগ্রুপ' নামের যে কনসেপ্ট জন্ম দিয়েছিল, তা আজকে 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকস নামে পরিচিত। আজকের দিনে এই 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকসকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার' হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে; যার মাঝে যুক্ত রয়েছে স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমনকি অপ্রচলিত যুদ্ধের উপাদানও।


১০ই মে প্রায় হঠাৎ করেই ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের পক্ষ থেকেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে! গত ২২শে এপ্রিল ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মিরের পেহেলগামে এক হামলায় ২৬ জন নিহত হবার পর ভারত পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ৭ই মে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ভারতীয় বিমান বাহিনী বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখানে বড় ভূমিকা নিয়েছেন বলে তিনি সোশাল মিডিয়াতে ঘোষণা দেন। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ছয় ঘন্টার মাঝেই ভারত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্যে পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে। তবে দুই দেশের মাঝে শান্তিচুক্তি এখনও হয়নি। বিশেষ করে সিন্ধু নদের পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি, যা ভারত বাতিল করেছিল, সেটা নিয়ে কোন আলোচনা শুরু হয়নি এখনও। কাজেই কূটনৈতিক আলোচনা সবে শুরু হলো বলে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগর যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা এখন পরিষ্কার।

ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাত কি যুদ্ধ ছিল? ‘আল জাজিরার'র সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'উইলসন সেন্টার'এর ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন যে, ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত যেভাবেই সংজ্ঞায়িত হোক না কেন, সেটা প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের মাঝে যুদ্ধই ছিল। উভয় পক্ষই একে অপরের সামরিক স্থাপনায় হামলা করেছে; যা নিঃসন্দেহেই সহিংসতাকে আরও বেশি উস্কে দিয়েছে। কুগেলম্যান এটাকে যুদ্ধ বলছেন। তবে এই যুদ্ধের মাঝে সবচাইতে বেশি আলোচিত হয়েছে দুই দেশের মাঝের আকাশ যুদ্ধ। কারণ এই প্রথম একটা বড় আকারের আকাশ যুদ্ধে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে চোখে না দেখার পরেও প্রায় এক ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলেছে। এটা ইতিহাসে প্রথম। এখনও বেশিরভাগ তথ্যই অজানা। তবে এই যুদ্ধ থেকে কিছু শিক্ষা এখনই নেয়া সম্ভব। ৭ই মে বিমান হামলা দিয়ে শুরু হলেও পরদিন থেকেই যুদ্ধ সঞ্চালিত হয় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার দিকে। আর যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই সীমান্তে স্বল্প পাল্লার আর্টিলারি ও রকেট ছুঁড়েছে। হতাহতের সংখ্যার ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত নয়।
 
কুগেলম্যান মনে করছেন যে, ভারতের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সংজ্ঞায়িত তথাকথিত সন্ত্রাসীদের অস্তানা ধ্বংস করাই নয়; বরং ভারত চাইছে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে; যাতে করে দাতা সংস্থাগুলি যেন পাকিস্তানকে অর্থিক সহায়তা না দেয়। ভারত চাইছে পাকিস্তানের জন্যে ভারত-বিরোধী কর্মকান্ডের মূল্য অত্যধিক করে ফেলা। তবে বর্তমান এই সংঘাতের পেছনে উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মোদী সরকারের উপর ভারতে যথেষ্ট চাপ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্ত কিছু করার। কারণ ভারত সরকারের পক্ষে থেকে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী হামলার জন্যে দায়ী করা হয়েছিল। অপরদিকে পাকিস্তানের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে জনমত তেমন একটা নেই। এমতাবস্থায় ভারতকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরে তারা জনমতকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে।



ডিটারেন্স বনাম উস্কানি

যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত এবং পাকিস্তান একে অপরকে দোষারোপ করেছে উস্কানিদাতা হিসেবে। কিন্তু এখানে কোনটা উস্কানি, আর কোনটা ডিটারেন্স, সেটা বিবেচ্য বিষয়। কে কোনটাকে কিভাবে দেখছে, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। কুগেলম্যান মনে করছেন যে, ভারতের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সংজ্ঞায়িত তথাকথিত সন্ত্রাসীদের অস্তানা ধ্বংস করাই নয়; বরং ভারত চাইছে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে; যাতে করে দাতা সংস্থাগুলি যেন পাকিস্তানকে অর্থিক সহায়তা না দেয়। ভারত চাইছে পাকিস্তানের জন্যে ভারত-বিরোধী কর্মকান্ডের মূল্য অত্যধিক করে ফেলা। তবে বর্তমান এই সংঘাতের পেছনে উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মোদী সরকারের উপর ভারতে যথেষ্ট চাপ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্ত কিছু করার। কারণ ভারত সরকারের পক্ষে থেকে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী হামলার জন্যে দায়ী করা হয়েছিল। অপরদিকে পাকিস্তানের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে জনমত তেমন একটা নেই। এমতাবস্থায় ভারতকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরে তারা জনমতকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে।

‘স্কাই নিউজ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, উভয় পক্ষই খুব সাবধানে তাদের পরবর্তী টার্গেট নির্বাচন করেছে। ভারত প্রথম দিকে শুধু কাশ্মির এবং বাহওয়ালপুরের মাঝে আক্রমণকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। পাকিস্তানও প্রথমদিকে তাদের টার্গেট নির্বাচন করেছে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অভ্যন্তরে এবং পাঞ্জাবের অমৃতসরে। এরপর থেকে তারা ধীরে ধীরে উভয় পক্ষে সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে। ভারত তাদের পশ্চিম নৌবহরের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে পাকিস্তানের উপকূলের দিকে যেতে বলেছিল; যার অর্থ হলো, তারা পাকিস্তানের প্রধান সমুদ্রবন্দর করাচিকে (যা কিনা কাশ্মির থেকে বহু দূরে) হুমকির মাঝে ফেলতে চেয়েছিল।

ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল শন বেল 'আল জাজিরা'কে বলছেন যে, একটা খবরে যখন বলা হচ্ছিলো যে, পাকিস্তানি সেনারা 'লাইন অব কন্ট্রোল'এর দিকে আগ্রসর হচ্ছে। এই ব্যাপারটাকে ভারত নিয়েছে উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করার একটা কর্মকান্ড হিসেবে। অথচ একজন সামরিক কর্মকর্তার কাছে এই একই ব্যাপারটা মনে হতে পারে আক্রমণাত্মক অথবা প্রতিরক্ষামূলক। তার কাছে হয়তো মনে হতে পারে যে, সীমান্তের কাছাকাছি সামরিক শক্তি মোতায়েনের অর্থ হলো অপর পক্ষকে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা। কাজেই একই কর্মকান্ডকে কে কিভাবে দেখছে, সেই ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।
 
মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, যখন পাকিস্তানীরা প্রথমে বলেছিল যে, তারা ভারতের পাঁচটা বিমান ভূপাতিত করেছে, তখন তিনি নিজেই সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ পাকিস্তানে হামলা করার জন্যে ভারতের বিমানের পাকিস্তানের আকাশ সীমানায় ঢোকারই প্রয়োজন নেই। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের আকাশ সীমানায় থাকার সময়েই তাদের 'রাফাল' ফাইটারগুলিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। আর যেহেতু বিমানগুলি ভারতে ভূপাতিত হয়েছে, তাই পাকিস্তানের পক্ষে বিমানগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখানো সম্ভব নয়; আর ভারতীয়রাও এব্যাপারে কোন তথ্য দেবে না। এর মাঝে এটাও ধারণা করা যেতে পারে যে, চীনের তৈরি 'এইচকিউ-৯' বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও 'রাফাল' বিমান ভূপাতিত করে থাকতে পারে। তবে এই প্রথমবারের মতো চীনের উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম পশ্চিমাদের তৈরি উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামের মুখোমুখি হয়েছে; যার গুরুত্ব অনেক।



চীনা অস্ত্র বনাম পশ্চিমা অস্ত্র

আকাশ যুদ্ধের মাঝে সবচাইতে গুরুত্ব পেয়েছে পাকিস্তানের হাতে থাকা চীনা অস্ত্রের সক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝে ভারতের হাতে থাকা পশ্চিমা অস্ত্রের বিরুদ্ধে চীনা অস্ত্রের সক্ষমতা কতটুকু, সেব্যাপারে এখন সকলেই আগ্রহী। কুগেলম্যান বলছেন যে, পাকিস্তান খুব সম্ভবতঃ চীনে নির্মিত 'জে-১০' ফাইটার বিমানের মাধ্যমে ফ্রান্সে তৈরি ভারতের 'রাফাল' ফাইটার বিমান ধ্বংস করেছে। উভয় পক্ষই অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র যোগাড় করতে পেরেছে; যা কিনা তাদেরকে সামরিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছে।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, ২০১০এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রের উপর পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা কমতে থাকে; এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্থান নিতে থাকে চীন। অনেক আগে থেকেই চীন পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামের বড় সরবরাহকারী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীন পাকিস্তানের উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামের প্রধান সরবরাহকারীরূপে আবির্ভূত হয়েছে। মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, যখন পাকিস্তানীরা প্রথমে বলেছিল যে, তারা ভারতের পাঁচটা বিমান ভূপাতিত করেছে, তখন তিনি নিজেই সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ পাকিস্তানে হামলা করার জন্যে ভারতের বিমানের পাকিস্তানের আকাশ সীমানায় ঢোকারই প্রয়োজন নেই। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের আকাশ সীমানায় থাকার সময়েই তাদের 'রাফাল' ফাইটারগুলিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। আর যেহেতু বিমানগুলি ভারতে ভূপাতিত হয়েছে, তাই পাকিস্তানের পক্ষে বিমানগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখানো সম্ভব নয়; আর ভারতীয়রাও এব্যাপারে কোন তথ্য দেবে না। এর মাঝে এটাও ধারণা করা যেতে পারে যে, চীনের তৈরি 'এইচকিউ-৯' বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও 'রাফাল' বিমান ভূপাতিত করে থাকতে পারে। তবে এই প্রথমবারের মতো চীনের উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম পশ্চিমাদের তৈরি উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামের মুখোমুখি হয়েছে; যার গুরুত্ব অনেক।

এয়ার ভাইস মার্শাল শন বেল 'আল জাজিরা'কে বলছেন যে, আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, পাকিস্তানিরা চীনাদের সরবরাহকৃত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারতের ফরাসি নির্মিত 'রাফাল' ফাইটার ভূপাতিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও জানা গেছে যে, ভারতের কমপক্ষে ৩টা বিমান ভূপাতিত হয়েছে। অথচ পাকিস্তানকে চীনারা হয়তো তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতার ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি; দিয়েছে শুধু 'এক্সপোর্ট ভার্সন'। আর তা দিয়েই পাকিস্তানিরা পশ্চিমাদের উচ্চ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। অর্থাৎ চীনারা তাদের 'এক্সপোর্ট ভার্সন' ক্ষেপণাস্ত্রকে পশ্চিমা সরঞ্জামের বিরুদ্ধে মোতায়েন করে পরীক্ষা করছে। যুদ্ধের প্রথম দিনেই এই ব্যাপারটা পরিষ্কার না হলেও এখন সেটা সত্যিই মনে হচ্ছে।
 
ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েরই বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রাইলের মতো উন্নততর বিমান বাহিনীগুলিই শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হামলা চালাতে সক্ষমতা রাখে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াও ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত খুব বেশিদিন চলা সম্ভব ছিল না। কারণ একসময় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমে গেলে শত্রুর এলাকার ভেতরে গিয়ে গাইডেড বোমা দিয়ে হামলা চালাতে হবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যেতে পারতো। 


আকাশ সক্ষমতা কতটা থাকা যথেষ্ট?

ভারত-পাকিস্তানের আকাশ যুদ্ধ প্রযুক্তির দ্বন্দ্ব হিসেবে যেমন বিশ্বের সকল দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে থেকে একটা রাষ্ট্র সামরিক দিক থেকে কতটুকু সক্ষমতা থাকলে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে, সেব্যাপারেও অনেক দেশকে আগ্রহী করবে। ক্রোয়েশিয়ার অনলাইন সামরিক ওয়েবসাইট 'বিনকভস ব্যাটসফিল্ডস'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ভারতের বিমান বাহিনীর সবচাইতে বেশি ফাইটার বিমান হলো 'সুখোই-৩০এমকেআই' (২৬০টা); যেগুলি অনেক বড় আকারের হলেও রাডারের সক্ষমতার দিক থেকে পাকিস্তানের 'জেএফ-১৭'এর 'ব্লক-৩' ভার্সনের (৪০টার মতো) চাইতে শক্তিশালী নয়। ভারতের কাছে মধ্যম পাল্লার 'আর-৭৭' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বশেষ ভার্সনটা রয়েছে। তবে বিমানের সংখ্যার তুলনায় সর্বশেষ ভার্সনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা অনেক কম। একারণে ভারতীয়রা এই বিমানে মূলতঃ পুরোনো ভার্সনের 'আর-৭৭' ক্ষেপণাস্ত্র এবং ভারতের নিজস্ব তৈরি 'অস্ত্র' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে বলে জানা যায়। ভারতীয়রা তাদের 'মিগ-২৯' বিমানগুলিকেও (৯১টার মতো) উন্নত করেছে। কিন্তু সেগুলি হয়তো এখনও পুরোনো ভার্সনের 'আর-৭৭' ক্ষেপণাস্ত্রই বহণ করছে। অপরদিকে পাকিস্তানের 'জে-১০' বিমানে (৩০টার মতো) বহণ করা মধ্যম পাল্লার 'পিএল-১৫' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমা 'মিটিঅর' ক্ষেপণাস্ত্রের সমকক্ষ বা আরও উন্নততর। এছাড়াও 'জেএফ-১৭'এর 'ব্লক-৩' ভার্সনের বিমানগুলিও 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম। মোটামুটিভাবে পাকিস্তানের ২৬০-২৭০টা বিমানে মধ্যমে পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহণ সম্ভব। ভারতের এরকম বিমান রয়েছে ৫'শ বেশি। তবে পাকিস্তানের কাছে 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্রের স্টক খুব বেশি একটা নেই বলেই জানা যায়। 'স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইন্সটিটিউট' বা 'সিপরি'র হিসেবে ১৯৮০এর দশক থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাকিস্তান প্রায় ১৩'শ মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র যোগাড় করেছে; ভারত যোগাড় করেছে ৪১'শ। স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তান পেয়েছে ৩৫'শ; ভারত পেয়েছে ৫২'শ। তবে ভারত নিজেও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে; যেগুলির সংখ্যা জানা দুষ্কর। ভারতের নিজস্ব তৈরি 'তেজাস' ফাইটার (৩৭টার মতো) পাকিস্তানের 'জেএফ-১৭'এর 'ব্লক-১, ২'এর (১৩০টার মতো) কাছাকাছি সক্ষমতার। এছাড়াও পাকিস্তানের রয়েছে ৭৫টা 'এফ-১৬', ৪৫টা 'এফ-৭' এবং ৩৫টা 'মিরাজ-৩'। আর ভারতের রয়েছে ৪৪টা 'মিরাজ-২০০০', ৪০টা 'মিগ-২১' আর ১১০টা 'জাগুয়ার'। উভয় পক্ষের কারুরই রাডার এড়ানো স্টেলথ বিমান নেই। তাই শত্রুর অভ্যন্তরে হামলায় তাদের মূল শক্তি হলো দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া অথবা অনেক নিচু দিয়ে উড়ে রাডার এড়ানো। পাকিস্তান আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য গাইডেড বম্ব পেয়েছে ৪৭'শ; ভারত পেয়েছে ৩৭'শ। পাকিস্তান আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে ৮৭০টা; ভারত পেয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। এই সংখ্যাগুলি লম্বা যুদ্ধের জন্যে যথেষ্ট নয়। তবে উভয় পক্ষই নিজেরা অস্ত্র তৈরি করে; যার সক্ষমতা যাচাই করা কঠিন। নিচু দিয়ে ওড়া বিমান খুঁজে পাবার ক্ষেত্রে এয়ারবোর্ন রাডার গুরুত্বপূর্ণ। এয়ারবোর্ন রাডারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সক্ষমতা খুব বেশি না হলেও তা ভারতের চাইতে বেশি। এই বিমানগুলি শত্রুর বিরুদ্ধে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের জন্যেও ব্যবহৃত হয়; যেগুলির মাধ্যমে শত্রুর রাডার এবং যোগাযোগের উপর গোয়েন্দাগিরি সম্ভব। আর উভয় দেশের কাছেই আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিং করার মতো বিমানের সংখ্যা ৪ থেকে ৬টার বেশি নয়। একারণে তাদের উভয়ের পক্ষেই বিপক্ষের আকাশ সীমানার অনেক ভেতরে গিয়ে আঘাত করা কঠিন।

‘বিনকভস ব্যাটলফিল্ডস'এর বিশ্লেষণে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ভূমিতে থাকা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ভূমিতে থাকা রাডারগুলি শত্রুর বিমানের অবস্থান অনেক আগে থেকে খুঁজে পেয়ে নিজেদের ফাইটার বিমানকে দিয়ে দেয়। এর ফলে নিজেদের ফাইটার বিমানগুলি নিজস্ব রাডার বন্ধ রেখেই শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এর ফলে অনেক ছোট একটা ফাইটার ফোর্সও অনেক বড় ফোর্সের মতো কর্মক্ষম হয়। আর ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে, পুরোনো ভার্সনের বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েও শত্রুর বিমান ভূপাতিত করা সম্ভব; যদি সেগুলি সংখ্যায় যথেষ্ট থাকে। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েরই বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রাইলের মতো উন্নততর বিমান বাহিনীগুলিই শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হামলা চালাতে সক্ষমতা রাখে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াও ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত খুব বেশিদিন চলা সম্ভব ছিল না। কারণ একসময় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমে গেলে শত্রুর এলাকার ভেতরে গিয়ে গাইডেড বোমা দিয়ে হামলা চালাতে হবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যেতে পারতো। সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণেই পাকিস্তান দূর থেকে ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে হামলা করতে সচ্ছন্দ বোধ করেছে। অপরদিকে ভারতীয়রা জানে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে বিমান হামলা করতে গেলে ভারতের সংখ্যাধিক্যের ব্যাপারটা অকার্যকর হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ভারতের বিমান বাহিনীর একটা বড় অংশ চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন রাখা হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পুরো বিমান শক্তিই ভারতের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা।
 
কিছু অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরা হয়। মেহমুনা জয়ার ভিডিও ফুটেজটা খুব সম্ভবতঃ সুইসাইড ড্রোনের ছিল। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার জন্যে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রথম দিনের বিমান হামলার ক্ষয়ক্ষতি ভারতের পক্ষে কয়েকদিন ধরে বহণ করা অসম্ভব ছিল। আর যেহেতু প্রথম দিনের ক্ষয়ক্ষতি ভারতকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল, তাই জনগণের সামনে নিজেদের বিজয় দেখাতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনেও হামলা অব্যাহত রাখতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। শুধু তা-ই নয়, এই হামলাগুলি ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির উপর। পাকিস্তানের ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা ৭৭টা ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে; যেগুলি ছিল মূলতঃ ইস্রাইলের তৈরি 'হারপি' এবং 'হারোপ' ড্রোন।  


ট্যাকটিকস এবং স্ট্র্যাটেজি

গত ৭ই মে ভারতের সামরিক বাহিনীর ব্রিফিংএ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির এবং পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডে ভারতীয় বিমান হামলার চিত্র তুলে ধরা হয়। কিছু অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরা হয়; যার মাঝে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মেহমুনা জয়া এবং লাহোরের কাছাকাছি মুরিদকে (ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৩১কিঃমিঃ দূরে) এলাকায় হামলার চিত্র দেখানো হয়। মেহমুনা জয়ার ভিডিও ফুটেজটা খুব সম্ভবতঃ সুইসাইড ড্রোনের ছিল। অপরদিকে মুরিদকে এবং কাশ্মিরের কোটলি আব্বাস (ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মির থেকে প্রায় ২৫কিঃমিঃ দূরে) হামলায় অনেক দূরে আকাশ থেকে তোলা ফুটেজ দেখানো হয়। পুরো ব্রিফিংএ কোথায় কোথায় হামলা করা হয়েছে, সেগুলি বলা ছাড়া আকাশ যুদ্ধ নিয়ে তেমন কোন তথ্য প্রদান করা হয়নি। তবে পাকিস্তানের ব্রিফিং ছিল পুরোটাই আকাশ যুদ্ধ নিয়ে।

গত ৯ই মে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ব্রিফিংএ প্রথমে তুলে ধরা হয় যে, ভারতের দিক থেকে পেহেলগাম হামলার যেসকল উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে, তার মাঝে রয়েছে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা; যে প্রকাশ করে দেয় যে, ভারতীয়রা নিজেরাই পেহেলগামের নাটক সাজিয়েছে। এরপর বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে যথেষ্ট উপাত্ত সহ প্রথম দিনের আকাশ যুদ্ধের বর্ণনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয় যে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রায় ৪২টার মতো উচ্চমানের যুদ্ধবিমান ভারতের ৬০টার মতো যুদ্ধবিমানের মোকাবিলা করেছে। আর ভারতীয়দের বিমানের সংখ্যা ৬০টা থেকে সময়ে সময়ে প্রায় ৭২টার মতো উঠেছিল। ভারতীয় বিমানগুলি তাদের রাডার অন করার সাথেসাথেই পাকিস্তানিরা প্রতিটা বিমানের অবস্থান জেনে যায়। একইসাথে বিমানগুলির ইলেকট্রনিক সিগনালের মাধ্যমে প্রতিটা বিমানের টাইপ তারা নিশ্চিত হয়ে যায়। ব্রিফিংএর এই তথ্য জানিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানের ভূমির রাডার এবং এয়ারবোর্ন রাডারগুলি কতটা কার্যকর ছিল। ব্রিফিংএ বলা হয়ে যে, পাকিস্তানিরা ইচ্ছে করেই ভারতের ১৪টা 'রাফাল' বিমানকে আলাদাভাবে টার্গেট করেছে। এর কারণ হলো, পাকিস্তানিরা নিশ্চিত ছিল যে, এই বিমানগুলিই ভারতের পুরো আক্রমণকারী বাহিনীর মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছিল। একারণে ভারতের ৫টা ভূপাতিত বিমানের মাঝে ৩টাই ছিল 'রাফাল'। বাকিগুলির একটা ছিল 'সুখোই-৩০' এবং একটা ছিল 'মিগ-২৯'। এর বাইরেও ইস্রাইলের তৈরি একটা 'হেরন' ড্রোন ভূপাতিত করার কথা বলা হয়। পাকিস্তানিরা বলে যে, এখানে হার্ডওয়্যারের সক্ষমতার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাহিনীর সকল সদস্যদের সমন্বিত দক্ষতা। পাকিস্তান তাদের সকল শক্তিকে সমন্বয়ের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সংখ্যার চাইতে বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। ব্রিফিংএ ভারতীয় বিমান বাহিনীর 'রাফাল' পাইলটদের মাঝে যোগাযোগের অডিও প্রকাশ করা হয়; যেখানে ভারতীয় 'রাফাল' বিমানগুলি নিজেদের রেডিও যোগাযোগের মাঝে 'গডজিলা' নামে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলো। এর মাধ্যমে পাকিস্তানিরা তাদের কমিউনিকেন্স ইন্টেলিজেন্সের সক্ষমতার পরিচয় দেয়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানিরা 'এইচকিউ-৯' এবং 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে কিনা, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়।

ভারতের ৯ই মের ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা দুই দেশের পুরো সীমান্ত জুড়ে ৩৬টা স্থানে প্রায় ৩'শ থেকে ৪'শ ড্রোন ব্যবহার করে ভারতের সীমানায় প্রবেশ করেছে। এই ড্রোনের কিছু ভারতীয়রা ভূপাতিত করেছে বলে দাবি করা হয়। এর মাঝে কমপক্ষে একটা ড্রোন ছিল তুর্কিদের তৈরি 'আসিসগার্ড সোঙ্গার'; যা মাঝারি আকৃতির একটা কোয়াডকপ্টার ড্রোন। ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা এই ড্রোনগুলির মাধ্যমে খুব সম্ভবতঃ ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পরীক্ষা করছিলো। ১০ই মে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আরেক ব্রিফিংএ পাকিস্তানের বিভিন্ন দাবিকে মিথ্যা বলে আখ্যা দেয়া হয়। এর আগে পাকিস্তান বলেছিল যে, তারা ভারতীয় 'এস-৪০০' বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, 'ব্রাহমোস' ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং কিছু গোলাবারুদের ডিপো ধ্বংস করেছে।
 
মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস এবং 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স' বা 'এআই'। চীনারা পাকিস্তানকে এই ক্ষেত্রগুলিতে কতটুকু সহায়তা দিয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে, চীনারা তাদের যুদ্ধের কনসেপ্টগুলিকে কিছুটা হলেও পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছে। আসন্ন সম্ভাব্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের জন্যে পাক-ভারত আকাশ যুদ্ধে ব্যবহৃত কনসেপ্টগুলি গুরুত্বপূর্ণ।


আকাশ যুদ্ধের শিক্ষা

আপাতদৃষ্টে এটা নিশ্চিত যে, পাকিস্তান ৭ই মেএর আকাশ যুদ্ধে কমপক্ষে ৩টা ভারতীয় ফাইটার বিমান ভূপাতিত করেছে। ভারতের পক্ষে এটা ফলাও করে বলাটা কঠিন; কারণ তারা পাকিস্তানের কাছে তাদের হার দেখাতে চাইবে না। অপরদিকে পাকিস্তান যা দাবি করেছে, সেগুলির স্বপক্ষে তারা যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেছে; যেগুলি ভারতের পক্ষে বাতিল করে দেয়া অসম্ভব। অন্ততঃ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার জন্যে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রথম দিনের বিমান হামলার ক্ষয়ক্ষতি ভারতের পক্ষে কয়েকদিন ধরে বহণ করা অসম্ভব ছিল। আর যেহেতু প্রথম দিনের ক্ষয়ক্ষতি ভারতকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল, তাই জনগণের সামনে নিজেদের বিজয় দেখাতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনেও হামলা অব্যাহত রাখতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। শুধু তা-ই নয়, এই হামলাগুলি ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির উপর। পাকিস্তানের ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা ৭৭টা ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে; যেগুলি ছিল মূলতঃ ইস্রাইলের তৈরি 'হারপি' এবং 'হারোপ' ড্রোন।

১। ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধ ছিল সারা দুনিয়ার জন্যে একটা শিক্ষা। প্রথমবারের মতো এতবড় একটা যুদ্ধ হয়েছে উভয় পক্ষ একে অপরকে চোখে দেখা ছাড়াই। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দূরপাল্লার বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পেয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু ছোঁড়া হয়েছে ফাইটার বিমান থেকে; আর কিছু ছোঁড়া হয়েছে ভূমি থেকে। দূরপাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সামনের দিনগুলিতে আরও বেশি গুরুত্ব বহণ করবে। ভারতীয়রা দূর থেকে পাকিস্তানি টার্গেটে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে এই মনে করে যে, এতে পাকিস্তানি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতীয়দের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এখানে পাল্লার হিসেবে একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে ভারতীয়রা। হয় তারা পাকিস্তানের হাতে থাকা 'পিএল-১৫' এবং 'এইচকিউ-৯'এর পাল্লাকে পাত্তা দেয়নি, অথবা তারা নিশ্চিত ছিল যে, তারা 'পিএল-১৫' এবং 'এইচকিউ-৯'কে মোকাবিলা করতে পারবে।

২। এই যুদ্ধে কে কাকে কতটুকু দেখতে পেয়েছিল, সেটা পরিষ্কার না হলেও কিছু ব্যাপার ধারণা করা যায়। যেমন, ভারতীয় বিমানগুলি নিশ্চিতভাবেই তাদের রাডারগুলিকে অন করেছিল। অবশ্য আক্রমণকারী হবার ফলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এছাড়া আর কোন পথও ছিল না। এর ফলে সেগুলি পাকিস্তানের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সরঞ্জামে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। পাকিস্তানিরা ভারতীয় বিমানগুলির অবস্থানই শুধু জানতে পারেনি; কোন বিমানগুলি কোন টাইপের, সেটাই বুঝতে পেরেছে। সেই হিসেবেই তারা 'রাফাল' বিমানগুলিকে আলাদাভাবে টার্গেট করতে পেরেছে। কাজেই আবারও প্রমাণ হলো যে, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে একটা 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার'।

৩। পাকিস্তান তাদের ভূমিতে অবস্থিত এবং আকাশে এয়ারবোর্ন রাডারগুলির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। এই রাডারগুলিই তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলির জন্যে টার্গেট নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের বিমানগুলি খুব সম্ভবতঃ রাডার অন করেইনি। এটা ক্ল্যাসিক 'গ্রাইন্ড কন্ট্রোলড ইন্টারসেপশন' বা 'জিসিআই'। আট দশকের বেশি সময় ধরে রাডারের মাধ্যমে শত্রুর বিমানের বিরুদ্ধে নিজস্ব ফাইটার বিমান গাইড করার পদ্ধতি চলে আসছে। ব্রিটিশ এবং জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই কৌশল বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিল। ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধে প্রমাণ হলো যে, আজও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে 'জিসিআই' কার্যকর একটা পদ্ধতি।

৪। ফরাসি 'রাফাল' বিমানগুলি অকার্যকর কিনা; অথবা চীনা ‘জে-১০’ বিশ্বসেরা বিমান কিনা - এগুলি নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। প্রকৃতপক্ষে একটা টাইপের হার্ডওয়্যার দিয়ে কোন যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 'কাম্ফগ্রুপ' নামের যে কনসেপ্ট জন্ম দিয়েছিল, তা আজকে 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকস নামে পরিচিত। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের পক্ষের বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র একত্রে সমন্বিতভাবে কাজ করে। এর ফলে একেকটা হার্ডওয়্যারের দুর্বলতা যেমন ঢেকে যায়; তেমনি প্রতিটা হার্ডওয়্যারের শক্তিশালী অংশগুলি কাজে লাগানো যায়। পাকিস্তানিরা এই ট্যাকটিকসটাকেই সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছে। অপরদিকে এটা কাজে লাগাতে না পারার কারণেই রুশরা ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে অত্যন্ত খারাপ পার্ফরম্যান্স দেখিয়েছে। আজকের দিনে এই 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকসকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার' হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে; যার মাঝে যুক্ত রয়েছে স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমনকি অপ্রচলিত যুদ্ধের উপাদানও।

৫। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত নয় তা হলো, ‘পিএল-১৫' তার ফ্লাইটের শেষ পর্যায়ে কি আসলেই নিজস্ব রাডারের মাধ্যমে টার্গেট খুঁজেছে কিনা। যদি সেটা করে থাকে, তাহলে 'রাফাল' কেন, যেকোন বিমানের রাডার ওয়ার্নিং রিসিভার (আরডব্লিউআর)এর মাধ্যমে জেনে যাবার কথা যে, বিমানটা কোন একটা ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় 'সুখোই-৩০', ‘মিগ-২৯' এবং 'রাফাল' বিমানে রয়েছে 'ইনফ্রারেড সার্চ এন্ড ট্র্যাক' বা 'আইআরএসটি'। এর মাধ্যমে বিমানগুলি অনেক দূর থেকে যেকোন বস্তুর ইনফ্রারেড সিগনাল ধরে ফেলতে পারে। যেকোন ক্ষেপণাস্ত্রই এর মাধ্যমে ধরা পড়ার কথা। পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলি নিঃসন্দেহে 'আরডব্লিউআর' এবং 'আইআরএসটি' উভয়কেই হার মানাতে সক্ষম হয়েছে। 'আইআরএসটি' ৩৬০ডিগ্রিতে একরকম কার্যকর নয়। কাজেই ক্ষেপণাস্ত্রের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ডিভাইসকে অকার্যকর করা যেতে পারে। যেহেতু এই মুহুর্তে জানা যাচ্ছে না যে, পাকিস্তানিরা কতগুলি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল, তাই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, কি হয়েছিল। কারণ ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা অনেক বেশি হলে যেকোন বিমানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে যাবে। আবার, ক্ষেপণাস্ত্রের রাডার যদি অনেক বেশি দেরিতে অন করা হয়, তাহলেও বিমানগুলির পক্ষে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করার সময় ভীষণভাবে কমে যেতে পারে। এটা সম্ভব হতে পারে যদি আগে থেকে জেনে যাওয়া যায় যে, ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট শত্রু বিমান কিছুক্ষণ পর আকাশের কোথায় অবস্থান করবে। অর্থাৎ আগে থেকেই আকাশে একটা অবস্থান তাক করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে দেয়া; এবং পথিমধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রের রাডার অন করে শেষ পর্যায়ে টার্গেট বিমানকে খুঁজে নেয়া। এই কাজটা বাস্তবায়ন করতে হলে নিশ্চিত হতে হবে যে, শত্রুর বিমান যেপথে এগুচ্ছে, সেই পথেই এগুবে এবং আগে থেকে নির্দিষ্ট করা সেই অবস্থান পার হয়ে যাবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে বা 'এআই’-এর মাধ্যমে এটা করা সম্ভব হতে পারে। চীনারা 'এআই' প্রযুক্তিতে বেশ এগিয়েছে। তারা পাকিস্তানকে এক্ষেত্রে কতটুকু সহায়তা দিয়েছে, সেটা আলোচ্য বিষয় হতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে বলা যাবে যে, পাকিস্তানিরা 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার'এর কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে।

পাকিস্তান নিঃসন্দেহে যুদ্ধক্ষেত্রে জিতেছে। কিন্তু পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দৈন্যতার সময়ে এমন একটা যুদ্ধ দেশটাকে আরও বেশি অর্থনৈতিক সমস্যার মাঝে ফেলবে; যা পাকিস্তানকে বিদেশী ঋণের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে ফেলবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলার ভারতীয় উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। এটা ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের জন্যেও সতর্কবার্তা। ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে - ১। দূরপাল্লার আকাশ যুদ্ধ আজকের বাস্তবতা; ২। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে একটা 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার'; ৩। আজও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে 'জিসিআই' কার্যকর একটা পদ্ধতি; ৪। 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকসএর নতুন ভার্সন হলো 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার'। শেষোক্ত মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস এবং 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স' বা 'এআই'। চীনারা পাকিস্তানকে এই ক্ষেত্রগুলিতে কতটুকু সহায়তা দিয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে, চীনারা তাদের যুদ্ধের কনসেপ্টগুলিকে কিছুটা হলেও পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছে। আসন্ন সম্ভাব্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের জন্যে পাক-ভারত আকাশ যুদ্ধে ব্যবহৃত কনসেপ্টগুলি গুরুত্বপূর্ণ।