Sunday, 11 May 2025

ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধ – বাকি বিশ্বের জন্যে শিক্ষা

১১ই মে ২০২৫

ফরাসি 'রাফাল' বিমানগুলি অকার্যকর কিনা; অথবা চীনা ‘জে-১০’ বিশ্বসেরা বিমান কিনা - এগুলি নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। প্রকৃতপক্ষে একটা টাইপের হার্ডওয়্যার দিয়ে কোন যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 'কাম্ফগ্রুপ' নামের যে কনসেপ্ট জন্ম দিয়েছিল, তা আজকে 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকস নামে পরিচিত। আজকের দিনে এই 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকসকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার' হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে; যার মাঝে যুক্ত রয়েছে স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমনকি অপ্রচলিত যুদ্ধের উপাদানও।


১০ই মে প্রায় হঠাৎ করেই ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের পক্ষ থেকেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে! গত ২২শে এপ্রিল ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মিরের পেহেলগামে এক হামলায় ২৬ জন নিহত হবার পর ভারত পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ৭ই মে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ভারতীয় বিমান বাহিনী বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখানে বড় ভূমিকা নিয়েছেন বলে তিনি সোশাল মিডিয়াতে ঘোষণা দেন। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ছয় ঘন্টার মাঝেই ভারত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্যে পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে। তবে দুই দেশের মাঝে শান্তিচুক্তি এখনও হয়নি। বিশেষ করে সিন্ধু নদের পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি, যা ভারত বাতিল করেছিল, সেটা নিয়ে কোন আলোচনা শুরু হয়নি এখনও। কাজেই কূটনৈতিক আলোচনা সবে শুরু হলো বলে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগর যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা এখন পরিষ্কার।

ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাত কি যুদ্ধ ছিল? ‘আল জাজিরার'র সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'উইলসন সেন্টার'এর ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন যে, ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত যেভাবেই সংজ্ঞায়িত হোক না কেন, সেটা প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের মাঝে যুদ্ধই ছিল। উভয় পক্ষই একে অপরের সামরিক স্থাপনায় হামলা করেছে; যা নিঃসন্দেহেই সহিংসতাকে আরও বেশি উস্কে দিয়েছে। কুগেলম্যান এটাকে যুদ্ধ বলছেন। তবে এই যুদ্ধের মাঝে সবচাইতে বেশি আলোচিত হয়েছে দুই দেশের মাঝের আকাশ যুদ্ধ। কারণ এই প্রথম একটা বড় আকারের আকাশ যুদ্ধে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে চোখে না দেখার পরেও প্রায় এক ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলেছে। এটা ইতিহাসে প্রথম। এখনও বেশিরভাগ তথ্যই অজানা। তবে এই যুদ্ধ থেকে কিছু শিক্ষা এখনই নেয়া সম্ভব। ৭ই মে বিমান হামলা দিয়ে শুরু হলেও পরদিন থেকেই যুদ্ধ সঞ্চালিত হয় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার দিকে। আর যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই সীমান্তে স্বল্প পাল্লার আর্টিলারি ও রকেট ছুঁড়েছে। হতাহতের সংখ্যার ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত নয়।
 
কুগেলম্যান মনে করছেন যে, ভারতের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সংজ্ঞায়িত তথাকথিত সন্ত্রাসীদের অস্তানা ধ্বংস করাই নয়; বরং ভারত চাইছে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে; যাতে করে দাতা সংস্থাগুলি যেন পাকিস্তানকে অর্থিক সহায়তা না দেয়। ভারত চাইছে পাকিস্তানের জন্যে ভারত-বিরোধী কর্মকান্ডের মূল্য অত্যধিক করে ফেলা। তবে বর্তমান এই সংঘাতের পেছনে উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মোদী সরকারের উপর ভারতে যথেষ্ট চাপ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্ত কিছু করার। কারণ ভারত সরকারের পক্ষে থেকে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী হামলার জন্যে দায়ী করা হয়েছিল। অপরদিকে পাকিস্তানের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে জনমত তেমন একটা নেই। এমতাবস্থায় ভারতকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরে তারা জনমতকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে।



ডিটারেন্স বনাম উস্কানি

যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত এবং পাকিস্তান একে অপরকে দোষারোপ করেছে উস্কানিদাতা হিসেবে। কিন্তু এখানে কোনটা উস্কানি, আর কোনটা ডিটারেন্স, সেটা বিবেচ্য বিষয়। কে কোনটাকে কিভাবে দেখছে, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। কুগেলম্যান মনে করছেন যে, ভারতের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সংজ্ঞায়িত তথাকথিত সন্ত্রাসীদের অস্তানা ধ্বংস করাই নয়; বরং ভারত চাইছে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে; যাতে করে দাতা সংস্থাগুলি যেন পাকিস্তানকে অর্থিক সহায়তা না দেয়। ভারত চাইছে পাকিস্তানের জন্যে ভারত-বিরোধী কর্মকান্ডের মূল্য অত্যধিক করে ফেলা। তবে বর্তমান এই সংঘাতের পেছনে উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মোদী সরকারের উপর ভারতে যথেষ্ট চাপ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্ত কিছু করার। কারণ ভারত সরকারের পক্ষে থেকে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী হামলার জন্যে দায়ী করা হয়েছিল। অপরদিকে পাকিস্তানের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে জনমত তেমন একটা নেই। এমতাবস্থায় ভারতকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরে তারা জনমতকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে।

‘স্কাই নিউজ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, উভয় পক্ষই খুব সাবধানে তাদের পরবর্তী টার্গেট নির্বাচন করেছে। ভারত প্রথম দিকে শুধু কাশ্মির এবং বাহওয়ালপুরের মাঝে আক্রমণকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। পাকিস্তানও প্রথমদিকে তাদের টার্গেট নির্বাচন করেছে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অভ্যন্তরে এবং পাঞ্জাবের অমৃতসরে। এরপর থেকে তারা ধীরে ধীরে উভয় পক্ষে সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে। ভারত তাদের পশ্চিম নৌবহরের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে পাকিস্তানের উপকূলের দিকে যেতে বলেছিল; যার অর্থ হলো, তারা পাকিস্তানের প্রধান সমুদ্রবন্দর করাচিকে (যা কিনা কাশ্মির থেকে বহু দূরে) হুমকির মাঝে ফেলতে চেয়েছিল।

ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল শন বেল 'আল জাজিরা'কে বলছেন যে, একটা খবরে যখন বলা হচ্ছিলো যে, পাকিস্তানি সেনারা 'লাইন অব কন্ট্রোল'এর দিকে আগ্রসর হচ্ছে। এই ব্যাপারটাকে ভারত নিয়েছে উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করার একটা কর্মকান্ড হিসেবে। অথচ একজন সামরিক কর্মকর্তার কাছে এই একই ব্যাপারটা মনে হতে পারে আক্রমণাত্মক অথবা প্রতিরক্ষামূলক। তার কাছে হয়তো মনে হতে পারে যে, সীমান্তের কাছাকাছি সামরিক শক্তি মোতায়েনের অর্থ হলো অপর পক্ষকে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা। কাজেই একই কর্মকান্ডকে কে কিভাবে দেখছে, সেই ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।
 
মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, যখন পাকিস্তানীরা প্রথমে বলেছিল যে, তারা ভারতের পাঁচটা বিমান ভূপাতিত করেছে, তখন তিনি নিজেই সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ পাকিস্তানে হামলা করার জন্যে ভারতের বিমানের পাকিস্তানের আকাশ সীমানায় ঢোকারই প্রয়োজন নেই। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের আকাশ সীমানায় থাকার সময়েই তাদের 'রাফাল' ফাইটারগুলিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। আর যেহেতু বিমানগুলি ভারতে ভূপাতিত হয়েছে, তাই পাকিস্তানের পক্ষে বিমানগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখানো সম্ভব নয়; আর ভারতীয়রাও এব্যাপারে কোন তথ্য দেবে না। এর মাঝে এটাও ধারণা করা যেতে পারে যে, চীনের তৈরি 'এইচকিউ-৯' বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও 'রাফাল' বিমান ভূপাতিত করে থাকতে পারে। তবে এই প্রথমবারের মতো চীনের উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম পশ্চিমাদের তৈরি উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামের মুখোমুখি হয়েছে; যার গুরুত্ব অনেক।



চীনা অস্ত্র বনাম পশ্চিমা অস্ত্র

আকাশ যুদ্ধের মাঝে সবচাইতে গুরুত্ব পেয়েছে পাকিস্তানের হাতে থাকা চীনা অস্ত্রের সক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝে ভারতের হাতে থাকা পশ্চিমা অস্ত্রের বিরুদ্ধে চীনা অস্ত্রের সক্ষমতা কতটুকু, সেব্যাপারে এখন সকলেই আগ্রহী। কুগেলম্যান বলছেন যে, পাকিস্তান খুব সম্ভবতঃ চীনে নির্মিত 'জে-১০' ফাইটার বিমানের মাধ্যমে ফ্রান্সে তৈরি ভারতের 'রাফাল' ফাইটার বিমান ধ্বংস করেছে। উভয় পক্ষই অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র যোগাড় করতে পেরেছে; যা কিনা তাদেরকে সামরিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছে।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, ২০১০এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রের উপর পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা কমতে থাকে; এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্থান নিতে থাকে চীন। অনেক আগে থেকেই চীন পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামের বড় সরবরাহকারী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীন পাকিস্তানের উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামের প্রধান সরবরাহকারীরূপে আবির্ভূত হয়েছে। মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, যখন পাকিস্তানীরা প্রথমে বলেছিল যে, তারা ভারতের পাঁচটা বিমান ভূপাতিত করেছে, তখন তিনি নিজেই সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ পাকিস্তানে হামলা করার জন্যে ভারতের বিমানের পাকিস্তানের আকাশ সীমানায় ঢোকারই প্রয়োজন নেই। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের আকাশ সীমানায় থাকার সময়েই তাদের 'রাফাল' ফাইটারগুলিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। আর যেহেতু বিমানগুলি ভারতে ভূপাতিত হয়েছে, তাই পাকিস্তানের পক্ষে বিমানগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখানো সম্ভব নয়; আর ভারতীয়রাও এব্যাপারে কোন তথ্য দেবে না। এর মাঝে এটাও ধারণা করা যেতে পারে যে, চীনের তৈরি 'এইচকিউ-৯' বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও 'রাফাল' বিমান ভূপাতিত করে থাকতে পারে। তবে এই প্রথমবারের মতো চীনের উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম পশ্চিমাদের তৈরি উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামের মুখোমুখি হয়েছে; যার গুরুত্ব অনেক।

এয়ার ভাইস মার্শাল শন বেল 'আল জাজিরা'কে বলছেন যে, আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, পাকিস্তানিরা চীনাদের সরবরাহকৃত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারতের ফরাসি নির্মিত 'রাফাল' ফাইটার ভূপাতিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও জানা গেছে যে, ভারতের কমপক্ষে ৩টা বিমান ভূপাতিত হয়েছে। অথচ পাকিস্তানকে চীনারা হয়তো তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতার ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি; দিয়েছে শুধু 'এক্সপোর্ট ভার্সন'। আর তা দিয়েই পাকিস্তানিরা পশ্চিমাদের উচ্চ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। অর্থাৎ চীনারা তাদের 'এক্সপোর্ট ভার্সন' ক্ষেপণাস্ত্রকে পশ্চিমা সরঞ্জামের বিরুদ্ধে মোতায়েন করে পরীক্ষা করছে। যুদ্ধের প্রথম দিনেই এই ব্যাপারটা পরিষ্কার না হলেও এখন সেটা সত্যিই মনে হচ্ছে।
 
ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েরই বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রাইলের মতো উন্নততর বিমান বাহিনীগুলিই শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হামলা চালাতে সক্ষমতা রাখে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াও ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত খুব বেশিদিন চলা সম্ভব ছিল না। কারণ একসময় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমে গেলে শত্রুর এলাকার ভেতরে গিয়ে গাইডেড বোমা দিয়ে হামলা চালাতে হবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যেতে পারতো। 


আকাশ সক্ষমতা কতটা থাকা যথেষ্ট?

ভারত-পাকিস্তানের আকাশ যুদ্ধ প্রযুক্তির দ্বন্দ্ব হিসেবে যেমন বিশ্বের সকল দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে থেকে একটা রাষ্ট্র সামরিক দিক থেকে কতটুকু সক্ষমতা থাকলে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে, সেব্যাপারেও অনেক দেশকে আগ্রহী করবে। ক্রোয়েশিয়ার অনলাইন সামরিক ওয়েবসাইট 'বিনকভস ব্যাটসফিল্ডস'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ভারতের বিমান বাহিনীর সবচাইতে বেশি ফাইটার বিমান হলো 'সুখোই-৩০এমকেআই' (২৬০টা); যেগুলি অনেক বড় আকারের হলেও রাডারের সক্ষমতার দিক থেকে পাকিস্তানের 'জেএফ-১৭'এর 'ব্লক-৩' ভার্সনের (৪০টার মতো) চাইতে শক্তিশালী নয়। ভারতের কাছে মধ্যম পাল্লার 'আর-৭৭' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বশেষ ভার্সনটা রয়েছে। তবে বিমানের সংখ্যার তুলনায় সর্বশেষ ভার্সনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা অনেক কম। একারণে ভারতীয়রা এই বিমানে মূলতঃ পুরোনো ভার্সনের 'আর-৭৭' ক্ষেপণাস্ত্র এবং ভারতের নিজস্ব তৈরি 'অস্ত্র' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে বলে জানা যায়। ভারতীয়রা তাদের 'মিগ-২৯' বিমানগুলিকেও (৯১টার মতো) উন্নত করেছে। কিন্তু সেগুলি হয়তো এখনও পুরোনো ভার্সনের 'আর-৭৭' ক্ষেপণাস্ত্রই বহণ করছে। অপরদিকে পাকিস্তানের 'জে-১০' বিমানে (৩০টার মতো) বহণ করা মধ্যম পাল্লার 'পিএল-১৫' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমা 'মিটিঅর' ক্ষেপণাস্ত্রের সমকক্ষ বা আরও উন্নততর। এছাড়াও 'জেএফ-১৭'এর 'ব্লক-৩' ভার্সনের বিমানগুলিও 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম। মোটামুটিভাবে পাকিস্তানের ২৬০-২৭০টা বিমানে মধ্যমে পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহণ সম্ভব। ভারতের এরকম বিমান রয়েছে ৫'শ বেশি। তবে পাকিস্তানের কাছে 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্রের স্টক খুব বেশি একটা নেই বলেই জানা যায়। 'স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইন্সটিটিউট' বা 'সিপরি'র হিসেবে ১৯৮০এর দশক থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাকিস্তান প্রায় ১৩'শ মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র যোগাড় করেছে; ভারত যোগাড় করেছে ৪১'শ। স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তান পেয়েছে ৩৫'শ; ভারত পেয়েছে ৫২'শ। তবে ভারত নিজেও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে; যেগুলির সংখ্যা জানা দুষ্কর। ভারতের নিজস্ব তৈরি 'তেজাস' ফাইটার (৩৭টার মতো) পাকিস্তানের 'জেএফ-১৭'এর 'ব্লক-১, ২'এর (১৩০টার মতো) কাছাকাছি সক্ষমতার। এছাড়াও পাকিস্তানের রয়েছে ৭৫টা 'এফ-১৬', ৪৫টা 'এফ-৭' এবং ৩৫টা 'মিরাজ-৩'। আর ভারতের রয়েছে ৪৪টা 'মিরাজ-২০০০', ৪০টা 'মিগ-২১' আর ১১০টা 'জাগুয়ার'। উভয় পক্ষের কারুরই রাডার এড়ানো স্টেলথ বিমান নেই। তাই শত্রুর অভ্যন্তরে হামলায় তাদের মূল শক্তি হলো দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া অথবা অনেক নিচু দিয়ে উড়ে রাডার এড়ানো। পাকিস্তান আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য গাইডেড বম্ব পেয়েছে ৪৭'শ; ভারত পেয়েছে ৩৭'শ। পাকিস্তান আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে ৮৭০টা; ভারত পেয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। এই সংখ্যাগুলি লম্বা যুদ্ধের জন্যে যথেষ্ট নয়। তবে উভয় পক্ষই নিজেরা অস্ত্র তৈরি করে; যার সক্ষমতা যাচাই করা কঠিন। নিচু দিয়ে ওড়া বিমান খুঁজে পাবার ক্ষেত্রে এয়ারবোর্ন রাডার গুরুত্বপূর্ণ। এয়ারবোর্ন রাডারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সক্ষমতা খুব বেশি না হলেও তা ভারতের চাইতে বেশি। এই বিমানগুলি শত্রুর বিরুদ্ধে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের জন্যেও ব্যবহৃত হয়; যেগুলির মাধ্যমে শত্রুর রাডার এবং যোগাযোগের উপর গোয়েন্দাগিরি সম্ভব। আর উভয় দেশের কাছেই আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিং করার মতো বিমানের সংখ্যা ৪ থেকে ৬টার বেশি নয়। একারণে তাদের উভয়ের পক্ষেই বিপক্ষের আকাশ সীমানার অনেক ভেতরে গিয়ে আঘাত করা কঠিন।

‘বিনকভস ব্যাটলফিল্ডস'এর বিশ্লেষণে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ভূমিতে থাকা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ভূমিতে থাকা রাডারগুলি শত্রুর বিমানের অবস্থান অনেক আগে থেকে খুঁজে পেয়ে নিজেদের ফাইটার বিমানকে দিয়ে দেয়। এর ফলে নিজেদের ফাইটার বিমানগুলি নিজস্ব রাডার বন্ধ রেখেই শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এর ফলে অনেক ছোট একটা ফাইটার ফোর্সও অনেক বড় ফোর্সের মতো কর্মক্ষম হয়। আর ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে, পুরোনো ভার্সনের বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েও শত্রুর বিমান ভূপাতিত করা সম্ভব; যদি সেগুলি সংখ্যায় যথেষ্ট থাকে। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েরই বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রাইলের মতো উন্নততর বিমান বাহিনীগুলিই শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হামলা চালাতে সক্ষমতা রাখে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াও ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত খুব বেশিদিন চলা সম্ভব ছিল না। কারণ একসময় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমে গেলে শত্রুর এলাকার ভেতরে গিয়ে গাইডেড বোমা দিয়ে হামলা চালাতে হবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যেতে পারতো। সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণেই পাকিস্তান দূর থেকে ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে হামলা করতে সচ্ছন্দ বোধ করেছে। অপরদিকে ভারতীয়রা জানে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে বিমান হামলা করতে গেলে ভারতের সংখ্যাধিক্যের ব্যাপারটা অকার্যকর হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ভারতের বিমান বাহিনীর একটা বড় অংশ চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন রাখা হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পুরো বিমান শক্তিই ভারতের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা।
 
কিছু অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরা হয়। মেহমুনা জয়ার ভিডিও ফুটেজটা খুব সম্ভবতঃ সুইসাইড ড্রোনের ছিল। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার জন্যে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রথম দিনের বিমান হামলার ক্ষয়ক্ষতি ভারতের পক্ষে কয়েকদিন ধরে বহণ করা অসম্ভব ছিল। আর যেহেতু প্রথম দিনের ক্ষয়ক্ষতি ভারতকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল, তাই জনগণের সামনে নিজেদের বিজয় দেখাতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনেও হামলা অব্যাহত রাখতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। শুধু তা-ই নয়, এই হামলাগুলি ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির উপর। পাকিস্তানের ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা ৭৭টা ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে; যেগুলি ছিল মূলতঃ ইস্রাইলের তৈরি 'হারপি' এবং 'হারোপ' ড্রোন।  


ট্যাকটিকস এবং স্ট্র্যাটেজি

গত ৭ই মে ভারতের সামরিক বাহিনীর ব্রিফিংএ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির এবং পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডে ভারতীয় বিমান হামলার চিত্র তুলে ধরা হয়। কিছু অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরা হয়; যার মাঝে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মেহমুনা জয়া এবং লাহোরের কাছাকাছি মুরিদকে (ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৩১কিঃমিঃ দূরে) এলাকায় হামলার চিত্র দেখানো হয়। মেহমুনা জয়ার ভিডিও ফুটেজটা খুব সম্ভবতঃ সুইসাইড ড্রোনের ছিল। অপরদিকে মুরিদকে এবং কাশ্মিরের কোটলি আব্বাস (ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মির থেকে প্রায় ২৫কিঃমিঃ দূরে) হামলায় অনেক দূরে আকাশ থেকে তোলা ফুটেজ দেখানো হয়। পুরো ব্রিফিংএ কোথায় কোথায় হামলা করা হয়েছে, সেগুলি বলা ছাড়া আকাশ যুদ্ধ নিয়ে তেমন কোন তথ্য প্রদান করা হয়নি। তবে পাকিস্তানের ব্রিফিং ছিল পুরোটাই আকাশ যুদ্ধ নিয়ে।

গত ৯ই মে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ব্রিফিংএ প্রথমে তুলে ধরা হয় যে, ভারতের দিক থেকে পেহেলগাম হামলার যেসকল উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে, তার মাঝে রয়েছে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা; যে প্রকাশ করে দেয় যে, ভারতীয়রা নিজেরাই পেহেলগামের নাটক সাজিয়েছে। এরপর বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে যথেষ্ট উপাত্ত সহ প্রথম দিনের আকাশ যুদ্ধের বর্ণনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয় যে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রায় ৪২টার মতো উচ্চমানের যুদ্ধবিমান ভারতের ৬০টার মতো যুদ্ধবিমানের মোকাবিলা করেছে। আর ভারতীয়দের বিমানের সংখ্যা ৬০টা থেকে সময়ে সময়ে প্রায় ৭২টার মতো উঠেছিল। ভারতীয় বিমানগুলি তাদের রাডার অন করার সাথেসাথেই পাকিস্তানিরা প্রতিটা বিমানের অবস্থান জেনে যায়। একইসাথে বিমানগুলির ইলেকট্রনিক সিগনালের মাধ্যমে প্রতিটা বিমানের টাইপ তারা নিশ্চিত হয়ে যায়। ব্রিফিংএর এই তথ্য জানিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানের ভূমির রাডার এবং এয়ারবোর্ন রাডারগুলি কতটা কার্যকর ছিল। ব্রিফিংএ বলা হয়ে যে, পাকিস্তানিরা ইচ্ছে করেই ভারতের ১৪টা 'রাফাল' বিমানকে আলাদাভাবে টার্গেট করেছে। এর কারণ হলো, পাকিস্তানিরা নিশ্চিত ছিল যে, এই বিমানগুলিই ভারতের পুরো আক্রমণকারী বাহিনীর মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছিল। একারণে ভারতের ৫টা ভূপাতিত বিমানের মাঝে ৩টাই ছিল 'রাফাল'। বাকিগুলির একটা ছিল 'সুখোই-৩০' এবং একটা ছিল 'মিগ-২৯'। এর বাইরেও ইস্রাইলের তৈরি একটা 'হেরন' ড্রোন ভূপাতিত করার কথা বলা হয়। পাকিস্তানিরা বলে যে, এখানে হার্ডওয়্যারের সক্ষমতার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাহিনীর সকল সদস্যদের সমন্বিত দক্ষতা। পাকিস্তান তাদের সকল শক্তিকে সমন্বয়ের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সংখ্যার চাইতে বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। ব্রিফিংএ ভারতীয় বিমান বাহিনীর 'রাফাল' পাইলটদের মাঝে যোগাযোগের অডিও প্রকাশ করা হয়; যেখানে ভারতীয় 'রাফাল' বিমানগুলি নিজেদের রেডিও যোগাযোগের মাঝে 'গডজিলা' নামে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলো। এর মাধ্যমে পাকিস্তানিরা তাদের কমিউনিকেন্স ইন্টেলিজেন্সের সক্ষমতার পরিচয় দেয়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানিরা 'এইচকিউ-৯' এবং 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে কিনা, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়।

ভারতের ৯ই মের ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা দুই দেশের পুরো সীমান্ত জুড়ে ৩৬টা স্থানে প্রায় ৩'শ থেকে ৪'শ ড্রোন ব্যবহার করে ভারতের সীমানায় প্রবেশ করেছে। এই ড্রোনের কিছু ভারতীয়রা ভূপাতিত করেছে বলে দাবি করা হয়। এর মাঝে কমপক্ষে একটা ড্রোন ছিল তুর্কিদের তৈরি 'আসিসগার্ড সোঙ্গার'; যা মাঝারি আকৃতির একটা কোয়াডকপ্টার ড্রোন। ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা এই ড্রোনগুলির মাধ্যমে খুব সম্ভবতঃ ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পরীক্ষা করছিলো। ১০ই মে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আরেক ব্রিফিংএ পাকিস্তানের বিভিন্ন দাবিকে মিথ্যা বলে আখ্যা দেয়া হয়। এর আগে পাকিস্তান বলেছিল যে, তারা ভারতীয় 'এস-৪০০' বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, 'ব্রাহমোস' ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং কিছু গোলাবারুদের ডিপো ধ্বংস করেছে।
 
মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস এবং 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স' বা 'এআই'। চীনারা পাকিস্তানকে এই ক্ষেত্রগুলিতে কতটুকু সহায়তা দিয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে, চীনারা তাদের যুদ্ধের কনসেপ্টগুলিকে কিছুটা হলেও পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছে। আসন্ন সম্ভাব্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের জন্যে পাক-ভারত আকাশ যুদ্ধে ব্যবহৃত কনসেপ্টগুলি গুরুত্বপূর্ণ।


আকাশ যুদ্ধের শিক্ষা

আপাতদৃষ্টে এটা নিশ্চিত যে, পাকিস্তান ৭ই মেএর আকাশ যুদ্ধে কমপক্ষে ৩টা ভারতীয় ফাইটার বিমান ভূপাতিত করেছে। ভারতের পক্ষে এটা ফলাও করে বলাটা কঠিন; কারণ তারা পাকিস্তানের কাছে তাদের হার দেখাতে চাইবে না। অপরদিকে পাকিস্তান যা দাবি করেছে, সেগুলির স্বপক্ষে তারা যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেছে; যেগুলি ভারতের পক্ষে বাতিল করে দেয়া অসম্ভব। অন্ততঃ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার জন্যে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রথম দিনের বিমান হামলার ক্ষয়ক্ষতি ভারতের পক্ষে কয়েকদিন ধরে বহণ করা অসম্ভব ছিল। আর যেহেতু প্রথম দিনের ক্ষয়ক্ষতি ভারতকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল, তাই জনগণের সামনে নিজেদের বিজয় দেখাতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনেও হামলা অব্যাহত রাখতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। শুধু তা-ই নয়, এই হামলাগুলি ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির উপর। পাকিস্তানের ব্রিফিংএ বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা ৭৭টা ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে; যেগুলি ছিল মূলতঃ ইস্রাইলের তৈরি 'হারপি' এবং 'হারোপ' ড্রোন।

১। ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধ ছিল সারা দুনিয়ার জন্যে একটা শিক্ষা। প্রথমবারের মতো এতবড় একটা যুদ্ধ হয়েছে উভয় পক্ষ একে অপরকে চোখে দেখা ছাড়াই। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দূরপাল্লার বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পেয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু ছোঁড়া হয়েছে ফাইটার বিমান থেকে; আর কিছু ছোঁড়া হয়েছে ভূমি থেকে। দূরপাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সামনের দিনগুলিতে আরও বেশি গুরুত্ব বহণ করবে। ভারতীয়রা দূর থেকে পাকিস্তানি টার্গেটে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে এই মনে করে যে, এতে পাকিস্তানি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতীয়দের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এখানে পাল্লার হিসেবে একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে ভারতীয়রা। হয় তারা পাকিস্তানের হাতে থাকা 'পিএল-১৫' এবং 'এইচকিউ-৯'এর পাল্লাকে পাত্তা দেয়নি, অথবা তারা নিশ্চিত ছিল যে, তারা 'পিএল-১৫' এবং 'এইচকিউ-৯'কে মোকাবিলা করতে পারবে।

২। এই যুদ্ধে কে কাকে কতটুকু দেখতে পেয়েছিল, সেটা পরিষ্কার না হলেও কিছু ব্যাপার ধারণা করা যায়। যেমন, ভারতীয় বিমানগুলি নিশ্চিতভাবেই তাদের রাডারগুলিকে অন করেছিল। অবশ্য আক্রমণকারী হবার ফলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এছাড়া আর কোন পথও ছিল না। এর ফলে সেগুলি পাকিস্তানের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সরঞ্জামে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। পাকিস্তানিরা ভারতীয় বিমানগুলির অবস্থানই শুধু জানতে পারেনি; কোন বিমানগুলি কোন টাইপের, সেটাই বুঝতে পেরেছে। সেই হিসেবেই তারা 'রাফাল' বিমানগুলিকে আলাদাভাবে টার্গেট করতে পেরেছে। কাজেই আবারও প্রমাণ হলো যে, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে একটা 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার'।

৩। পাকিস্তান তাদের ভূমিতে অবস্থিত এবং আকাশে এয়ারবোর্ন রাডারগুলির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। এই রাডারগুলিই তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলির জন্যে টার্গেট নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের বিমানগুলি খুব সম্ভবতঃ রাডার অন করেইনি। এটা ক্ল্যাসিক 'গ্রাইন্ড কন্ট্রোলড ইন্টারসেপশন' বা 'জিসিআই'। আট দশকের বেশি সময় ধরে রাডারের মাধ্যমে শত্রুর বিমানের বিরুদ্ধে নিজস্ব ফাইটার বিমান গাইড করার পদ্ধতি চলে আসছে। ব্রিটিশ এবং জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই কৌশল বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিল। ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধে প্রমাণ হলো যে, আজও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে 'জিসিআই' কার্যকর একটা পদ্ধতি।

৪। ফরাসি 'রাফাল' বিমানগুলি অকার্যকর কিনা; অথবা চীনা ‘জে-১০’ বিশ্বসেরা বিমান কিনা - এগুলি নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। প্রকৃতপক্ষে একটা টাইপের হার্ডওয়্যার দিয়ে কোন যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 'কাম্ফগ্রুপ' নামের যে কনসেপ্ট জন্ম দিয়েছিল, তা আজকে 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকস নামে পরিচিত। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের পক্ষের বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র একত্রে সমন্বিতভাবে কাজ করে। এর ফলে একেকটা হার্ডওয়্যারের দুর্বলতা যেমন ঢেকে যায়; তেমনি প্রতিটা হার্ডওয়্যারের শক্তিশালী অংশগুলি কাজে লাগানো যায়। পাকিস্তানিরা এই ট্যাকটিকসটাকেই সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছে। অপরদিকে এটা কাজে লাগাতে না পারার কারণেই রুশরা ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে অত্যন্ত খারাপ পার্ফরম্যান্স দেখিয়েছে। আজকের দিনে এই 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকসকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার' হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে; যার মাঝে যুক্ত রয়েছে স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমনকি অপ্রচলিত যুদ্ধের উপাদানও।

৫। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত নয় তা হলো, ‘পিএল-১৫' তার ফ্লাইটের শেষ পর্যায়ে কি আসলেই নিজস্ব রাডারের মাধ্যমে টার্গেট খুঁজেছে কিনা। যদি সেটা করে থাকে, তাহলে 'রাফাল' কেন, যেকোন বিমানের রাডার ওয়ার্নিং রিসিভার (আরডব্লিউআর)এর মাধ্যমে জেনে যাবার কথা যে, বিমানটা কোন একটা ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় 'সুখোই-৩০', ‘মিগ-২৯' এবং 'রাফাল' বিমানে রয়েছে 'ইনফ্রারেড সার্চ এন্ড ট্র্যাক' বা 'আইআরএসটি'। এর মাধ্যমে বিমানগুলি অনেক দূর থেকে যেকোন বস্তুর ইনফ্রারেড সিগনাল ধরে ফেলতে পারে। যেকোন ক্ষেপণাস্ত্রই এর মাধ্যমে ধরা পড়ার কথা। পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলি নিঃসন্দেহে 'আরডব্লিউআর' এবং 'আইআরএসটি' উভয়কেই হার মানাতে সক্ষম হয়েছে। 'আইআরএসটি' ৩৬০ডিগ্রিতে একরকম কার্যকর নয়। কাজেই ক্ষেপণাস্ত্রের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ডিভাইসকে অকার্যকর করা যেতে পারে। যেহেতু এই মুহুর্তে জানা যাচ্ছে না যে, পাকিস্তানিরা কতগুলি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল, তাই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, কি হয়েছিল। কারণ ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা অনেক বেশি হলে যেকোন বিমানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে যাবে। আবার, ক্ষেপণাস্ত্রের রাডার যদি অনেক বেশি দেরিতে অন করা হয়, তাহলেও বিমানগুলির পক্ষে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করার সময় ভীষণভাবে কমে যেতে পারে। এটা সম্ভব হতে পারে যদি আগে থেকে জেনে যাওয়া যায় যে, ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট শত্রু বিমান কিছুক্ষণ পর আকাশের কোথায় অবস্থান করবে। অর্থাৎ আগে থেকেই আকাশে একটা অবস্থান তাক করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে দেয়া; এবং পথিমধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রের রাডার অন করে শেষ পর্যায়ে টার্গেট বিমানকে খুঁজে নেয়া। এই কাজটা বাস্তবায়ন করতে হলে নিশ্চিত হতে হবে যে, শত্রুর বিমান যেপথে এগুচ্ছে, সেই পথেই এগুবে এবং আগে থেকে নির্দিষ্ট করা সেই অবস্থান পার হয়ে যাবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে বা 'এআই’-এর মাধ্যমে এটা করা সম্ভব হতে পারে। চীনারা 'এআই' প্রযুক্তিতে বেশ এগিয়েছে। তারা পাকিস্তানকে এক্ষেত্রে কতটুকু সহায়তা দিয়েছে, সেটা আলোচ্য বিষয় হতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে বলা যাবে যে, পাকিস্তানিরা 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার'এর কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে।

পাকিস্তান নিঃসন্দেহে যুদ্ধক্ষেত্রে জিতেছে। কিন্তু পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দৈন্যতার সময়ে এমন একটা যুদ্ধ দেশটাকে আরও বেশি অর্থনৈতিক সমস্যার মাঝে ফেলবে; যা পাকিস্তানকে বিদেশী ঋণের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে ফেলবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলার ভারতীয় উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। এটা ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের জন্যেও সতর্কবার্তা। ভারত-পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে - ১। দূরপাল্লার আকাশ যুদ্ধ আজকের বাস্তবতা; ২। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে একটা 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার'; ৩। আজও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে 'জিসিআই' কার্যকর একটা পদ্ধতি; ৪। 'কম্বাইন্ড আর্মস' ট্যাকটিকসএর নতুন ভার্সন হলো 'মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ার'। শেষোক্ত মাল্টিডোমেইন ওয়ারফেয়ারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্যাটেলাইট, সাইবারস্পেস এবং 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স' বা 'এআই'। চীনারা পাকিস্তানকে এই ক্ষেত্রগুলিতে কতটুকু সহায়তা দিয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে, চীনারা তাদের যুদ্ধের কনসেপ্টগুলিকে কিছুটা হলেও পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছে। আসন্ন সম্ভাব্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের জন্যে পাক-ভারত আকাশ যুদ্ধে ব্যবহৃত কনসেপ্টগুলি গুরুত্বপূর্ণ।

Saturday, 3 May 2025

'নেভাল ড্রোন' হতে পারে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার'

৩রা মে ২০২৫

২৬শে মে ২০২৫। ফরাসি নেভাল সুইসাইড এটাক ড্রোন ছুটে চলেছে তার টার্গেটের দিকে। সর্বশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে ফরাসি নৌবাহিনী মনুষ্যবিহীন নেভাল ড্রোনের ব্যবহার, বিশেষ করে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার, গাইড্যান্স এবং ধ্বংসাত্মক সক্ষমতার ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী অবস্থানে যেতে চাইছে। ফরাসি নৌবাহিনীর বিবৃতি থেকে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় তা হলো, ফরাসি নৌবাহিনী ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। 



ফরাসি নৌবাহিনীর চার প্রকারের নেভাল ড্রোন

গত ২৬শে এপ্রিল ফরাসি নৌবাহিনী ফ্রান্সের উপকূলে 'আনম্যান্ড সারফেস ভেসেল' (ইউএসভি) বা মনুষ্যবিহীন ম্যারিটাইম বা নেভাল ড্রোন নিয়ে একটা পরীক্ষা চালায়। পরীক্ষায় নৌবাহিনীর একটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল বা ওপিভি থেকে একটা সুইসাইড বা কামিকাজি ড্রোন ছাড়া হয়; যা কিনা পুরোনো একটা ল্যান্ডিং ক্রাফটকে আঘাত করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ২০২১ সাল থেকে শুরু করা 'পোলারিস' কৌশলের অন্তর্ভুক্ত এই পরীক্ষায় সত্যিকারের যুদ্ধাবস্থার সবচাইতে কাছাকাছি অবস্থা তৈরি করে পরীক্ষাটার আয়োজন করা হয়। ফরাসি নৌবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, এর আগে গত ডিসেম্বরে ফরাসি সাবমেরিন থেকে টর্পেডো ছোঁড়ার মাধ্যমে একটা জাহাজ ধ্বংস করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ফরাসি নৌবাহিনীর একটা 'লাফায়েত-ক্লাস' ফ্রিগেটের খুব কাছে একটা বিস্ফোরণ ঘটানোর মাধ্যমে জাহাজের চাপ নেবার সক্ষমতা যাচাই করা হয়। আর গত মার্চ মাসে 'ড্রাগুন ফিউরি' উভচর মহড়ার মাধ্যমে আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহার যাচাই করা হয়। সর্বশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে ফরাসি নৌবাহিনী মনুষ্যবিহীন নেভাল ড্রোনের ব্যবহার, বিশেষ করে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার, গাইড্যান্স এবং ধ্বংসাত্মক সক্ষমতার ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী অবস্থানে যেতে চাইছে। ফরাসি নৌবাহিনীর বিবৃতি থেকে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় তা হলো, ফরাসি নৌবাহিনী ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। গত জানুয়ারিতে ফরাসি নৌবাহিনীর রিয়ার এডমিরাল ডেভিড ডেসফুজেরেস 'নেভাল নিউজ'কে বলেন যে, ফরাসি নৌবাহিনী চার ধরণের নেভাল ড্রোন পেতে চাইছে। এর প্রথমটা হলো সামুদ্রিক মাইন ধ্বংস করার জন্যে; দ্বিতীয়টা হলো হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে কাজের জন্যে; তৃতীয়টা হলো উভচর অপারেশনে ব্যবহার করার জন্যে; আর চতুর্থটা হলো শত্রুর সাথে সরাসরি যুদ্ধ করার জন্যে কমব্যাট বা এটাক ড্রোন।

গত মার্চের উভচর মহড়ায় ফরাসি নৌবাহিনী 'এক্সেইল' কোম্পানির তৈরি 'ড্রিএক্স এইচ-৮' নেভাল ড্রোন ব্যবহার করে। এর আগে এই একই ড্রোন ২০২০ সাল থেকে পরীক্ষা করা হচ্ছিলো হাইড্রোগ্রাফির কাজের জন্যে। অর্থাৎ সমুদ্রাঞ্চলকে জাহাজ চলাচলে নিরাপদ রাখতে এর ব্যবহার খোঁজা হচ্ছিলো। এর মাধ্যমে পানির নিচের ভূমির গঠনপ্রকৃতির একটা ছবি পাওয়া যাচ্ছিলো। আর এই ড্রোন অটোনমাস, বা কোন মনুষ্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই একটা প্রোগ্রামের মাধ্যমে চালানো সম্ভব। এর ফলে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের পানির নিচের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরির জন্যে এই ড্রোনগুলিকে একটা নির্দেশনা দিয়ে দিলেই হলো; সর্বদা কোন ব্যক্তিকে এগুলির কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে না। 'ড্রাগুন ফিউরি' মহড়ার মাধ্যমে ফরাসি নৌবাহিনী এই কাজটাকেই উভচর অপারেশনে ব্যবহার করতে চাইছে। এরূপ অপারেশনে 'ড্রিএক্স এইচ-৮' ড্রোন শত্রুর নিয়ন্ত্রণে থাকা উপকূলের কাছাকাছি অঞ্চলে পানির নিচের ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে। ড্রোন ব্যবহারের কারণে ফরাসি সামরিক কোন সদস্যের জীবন হুমকির মাঝে পড়বে না। মহড়ার মাঝে ফরাসিরা আরও দেখতে চাইছিলো যে, কিভাবে এই ড্রোন নিরাপদে ফরাসি 'মিসট্রাল-ক্লাস'এর হেলিকপ্টার ডক ল্যান্ডিং শিপের ডক থেকে পানিতে ওঠা-নামা করানো যায়।
 
ফরাসি নৌবাহিনীর 'ফ্রেম' ফ্রিগেট থেকে নেভাল ড্রোন পানিতে নামানো হচ্ছে। ফরাসি সরকারের মালিকানায় থাকার কারণে নৌবাহিনীর চাহিদার গুরুত্ব অনুধাবন করে 'নেভাল গ্রুপ' মাত্র এক বছরের মাঝে এই ড্রোন ডেভেলপ করে অপারেশনাল অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এই কোম্পানির কর্মকান্ড অনেক ক্ষেত্রেই ফরাসি সরকারের কৌশলগত চিন্তাভাবনার ফলাফল। আর এর মাঝে এ-ও বোঝা যায় যে, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা বেসামাল হবার কারণে ফরাসিরা এতটা দ্রুত এগুচ্ছে।


এর আগে ২০২৪এর ডিসেম্বরে ফরাসি নৌবাহিনী 'থালেস' কোম্পানির কাছ থেকে ১২মিটার লম্বা নেভাল ড্রোনের ডেলিভারি পায়। এটাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সার্ভিসে আসা অটোনমাস নেভাল ড্রোন। এই ড্রোনগুলি ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের নৌবাহিনীর মাইন ধ্বংস করা জাহাজে বহণ করা যাবে। এগুলি একটা সোনার টেনে নেবে এবং পানির নিচে মাইন খুঁজবে। অটোনমাস হবার কারণে এই ড্রোনগুলি মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই একনাগারে ৪০ ঘন্টা মাইন খুঁজতে পারবে। এই ড্রোন ডেলিভারি পাবার আগেই ফরাসিরা ন্যাটোর অধীনে 'রেপমাস' মহড়ায় অংশ নেয়; যেখানে তারা তাদের নিজস্ব নৌবাহিনী থেকে ৩৮ বছরের পুরোনো ৪২মিটার লম্বা ৪০০টন ওজনের ডাইভিং টেন্ডার জাহাজ 'এশিরন'কে পাঠায়। এই জাহাজ মূলতঃ ব্যবহৃত হয় পানির নিচের বস্তু খোঁজায় ডাইভারদের বহণ করার জন্যে। এই জাহাজ থেকে সুইডেনে নির্মিত 'পিরায়া' নেভাল ড্রোন অপারেট করা হয়েছিলো। একটা ডাইভিং টেন্ডার জাহাজ থেকে মনুষ্যবিহীন নেভাল ড্রোন অপারেট করার অর্থ হলো এসকল ড্রোন অনেক প্রকারের জাহাজ থেকেই অপারেট করা সম্ভব।

২০২৪এর নভেম্বরে ফরাসি সরকারি মালিকানার শিপবিল্ডিং কোম্পানি 'নেভাল গ্রুপ' এবং 'কুয়াচ শিপইয়ার্ড' তাদের প্রথম নেভাল ড্রোন সামনে আনে। 'সীকুয়েস্ট এস' নামের প্রায় ৯মিটার লম্বা এই ড্রোনগুলিকে যেকোন জাহাজে বহণ করা যাবে; যার মাঝে থাকবে ফ্রিগেট, হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ডক ল্যান্ডিং শিপ, সাপ্লাই জাহাজ, ইত্যাদি। এই ড্রোনগুলিকে জাহাজের নিজস্ব বোট পানিতে নামানোর জন্য ব্যবহার করা ক্রেন বা ড্যাভিটের মাধ্যমে অপারেট করা যাবে। ফরাসি নৌবাহিনীর 'ফ্রেম' ফ্রিগেট থেকে এই ড্রোন ইতোমধ্যেই অপারেট করা হয়েছে। এই ড্রোনগুলি সোনারের মাধ্যমে পানির নিচের সাবমেরিন, টর্পেডো এবং ড্রোন খুঁজে পেতে সহায়তা করবে। বিশেষ করে অগভীর পানিতে, যেখানে মাদারশিপের জন্যে অপারেট করা কঠিন, সেখানে এই ড্রোনগুলি চলতে পারবে। ফরাসি সরকারের মালিকানায় থাকার কারণে নৌবাহিনীর চাহিদার গুরুত্ব অনুধাবন করে 'নেভাল গ্রুপ' মাত্র এক বছরের মাঝে এই ড্রোন ডেভেলপ করে অপারেশনাল অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এই কোম্পানির কর্মকান্ড অনেক ক্ষেত্রেই ফরাসি সরকারের কৌশলগত চিন্তাভাবনার ফলাফল। আর এর মাঝে এ-ও বোঝা যায় যে, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা বেসামাল হবার কারণে ফরাসিরা এতটা দ্রুত এগুচ্ছে।
 
অগাস্ট ২০২১। তুর্কি 'এলবাট্রস এস' নেভাল এটাক ড্রোনের ঝাঁক সমন্বিত আক্রমণে। ইউক্রেন যুদ্ধে এবং লোহিত সাগরে পশ্চিমা বাণিজ্যিক জাহাজের উপর ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়াদের আক্রমণে সুইসাইড নেভাল ড্রোনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছে। হুথি মিলিশয়ারা নেভাল ড্রোনের সাথে সমন্বয় করে ড্রোন বিমান, জাহাজ-ধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, এমনকি জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে। এর ফলে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজগুলি মারাত্মক সমস্যায় পড়েছিল।  


ইউক্রেন যুদ্ধ এবং লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথিদের থেকে শিক্ষা

তবে যেকোন জাহাজ থেকে নেভাল ড্রোন অপারেট করার সবচাইতে শক্তিশালী পরীক্ষাটা ছিল সুইসাইড এটাক ড্রোনের ক্ষেত্রে। ইউক্রেন যুদ্ধে এবং লোহিত সাগরে পশ্চিমা বাণিজ্যিক জাহাজের উপর ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়াদের আক্রমণে সুইসাইড নেভাল ড্রোনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছে। ইউক্রেনিয়রা কিছু সুইসাইড এটাক ড্রোনের সাথে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা কমব্যাট ড্রোনও ব্যবহার করেছে। এই কমব্যাট ড্রোনগুলি রুশ প্রতিরক্ষা লাইনে টহল হেলিকপ্টারের উপর গুলি করে। কিছু কমব্যাট ড্রোনকে আবার মাদারশিপ হিসেবে ব্যবহার করে তারা; যার মাধ্যমে একটা কমব্যাট ড্রোনের ভেতর কয়েকটা সুইসাইড ড্রোন বিমান বহণ করা হয়। হুথি মিলিশয়ারা নেভাল ড্রোনের সাথে সমন্বয় করে ড্রোন বিমান, জাহাজ-ধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, এমনকি জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে। এর ফলে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজগুলি মারাত্মক সমস্যায় পড়েছিল। ফরাসিরা এই ঘটনাগুলি থেকে শিক্ষা নিয়েই নিজেদের ড্রোন ডেভেলপ করছে।

ফরাসিরা ছাড়াও অন্যান্য নৌবাহিনীও মনুষ্যবিহীন নেভাল ড্রোন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে অথবা নিজেদের নৌবাহিনীতে সেগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। মার্কিন নৌবাহিনী 'ঘোস্ট ফ্লীট' নামের প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন ধরণের নেভাল ড্রোন তৈরি করছে; যেগুলি ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ, এটাক, লজিস্টিক্যাল মিশন ছাড়াও অন্যান্য মিশন সম্পাদনে সক্ষম হবে। এছাড়াও চীন, তুরস্ক, ইস্রাইল, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানও নেভাল ড্রোন ডেভেলপ করছে। ২০২১এর মে মাসে তুরস্ক প্রথমবারের মতো তাদের 'উলাক' নেভাল ড্রোন থেকে 'সিরিট' রকেট ছোঁড়ার মাধ্যমে একটা টার্গেট ধ্বংস করেছে। এই ড্রোন দু'টা 'এল-উমটাস' দূরপাল্লার ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও বহণ করতে সক্ষম। উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজের নিরাপত্তা ও নৌস্থাপনার নিরাপত্তা দিতে এই ড্রোনগুলিতে রাডার, নাইট ভিশন ক্যামেরা এবং ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ মেশিন গান বসানো হয়। ২০২২এর জুনে তুর্কিরা দু'টা 'আলবাট্রস এস' এটাক ড্রোনের সাথে একটা 'মির' কমান্ড ড্রোনের সমন্বয়ে আক্রমণকারী ড্রোনের ঝাঁক নিয়ে পরীক্ষা করে। ২০২৩এর এপ্রিলে তুর্কিরা একটা পরীক্ষা চালায়, যেখানে 'মারলিন' নেভাল ড্রোন সাবমেরিন খুঁজে বের করে এবং তার সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করা 'মির' নেভাল ড্রোন থেকে টর্পেডো ছুঁড়ে টার্গেট ধ্বংস করা হয়। ২০২৩এর অক্টোবরে তুরস্ক তাদের 'আলবাট্রস এস' সুইসাইড নেভাল ড্রোন পরীক্ষা করে। প্রায় ৭মিটার লম্বা এবং ২টন ওজনের এই ড্রোনগুলি ৪০নটিক্যাল মাইল গতিতে এবং প্রায় ১০ ঘন্টা ধরে চলতে সক্ষম। ইনবোর্ড ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করে এই ড্রোন ২৫০কেজি ওয়ারহেড বহণে সক্ষম। অটোনমাস এরকম ৮টা ড্রোন একত্রে টার্গেটে সমন্বিতভাবে হামলা করে এবং শেষ পর্যন্ত ওয়ারহেড বহণ করা একটা ড্রোনের আঘাতে ২২মিটার লম্বা টার্গেট জাহাজটা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়। নেভাল ড্রোনগুলিকে আকাশ থেকে সহায়তা দিচ্ছিল 'বায়রাক্তার টিবি-২' ড্রোন বিমান। ২০২৪এর অক্টোবরে কাতার তুরস্ক থেকে 'উলাক ১১' নেভাল ড্রোন ক্রয় করার ঘোষণা দেয়।
 
ফরাসি নৌবাহিনীর ডাইভিং টেন্ডার ভেসেল 'এশিরন'। ৪২মিটার লম্বা এবং ৪০০টনের ৩৮ বছরের পুরোনো এই জাহাজ থেকে নেভাল ড্রোন অপারেট করা হয়েছিল। যুদ্ধজাহাজ হতে হলে এখন আর কোন জাহাজকে জটিল ডিজাইনের হতে হয় না। প্রতিটা জাহাজেই নিজস্ব বোট পানিতে নামাবার জন্যে ক্রেন বা ড্যাভিট থাকে। এই একই ব্যবস্থার মাধ্যমে একটা নেভাল ড্রোনকে জাহাজে বহণ করে পানিতে নামানো সম্ভব; যা কিনা ফরাসি নৌবাহিনী প্রমাণ করেছে। ইউক্রেনিয়রা যা উপকূলের কাছাকাছি করেছে, ফরাসিরা সেটাকে গভীর সাগরে নিয়ে গিয়েছে।   


‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার' হিসেবে নেভাল ড্রোন

ইউক্রেন যুদ্ধের বাইরে অন্যান্য দেশের সুইসাইড নেভাল ড্রোনগুলি এখন পরীক্ষামূলক থেকে অপারেশনাল সক্ষমতা পর্যায়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে একটা ঝাঁকে অনেকগুলি ড্রোন ব্যবহার করে শত্রুর প্রতিরক্ষাকে ব্যাতিব্যস্ত করে ফেলাটাকেই সবচাইতে কার্যকর মনে করছেন অনেকে। দূরবর্তী টার্গেটের ক্ষেত্রে ফ্রিগেট বা অন্য কোন স্পেশালাইজড জাহাজ থেকে পানিতে নামিয়ে এগুলিকে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়। এরূপ নেভাল ড্রোনগুলিকে পানির নিচ দিয়ে চলা সাবমেরিন ড্রোন এবং ড্রোন বিমানের সাথে সমন্বয় করে ব্যবহার করলে শত্রুর সমস্যাকে আরও জটিল করে ফেলা সম্ভব। বিশেষ করে বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন ড্রোনের মাধ্যমে আক্রমণ করে শত্রু জাহাজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকেজো করে ফেলা সম্ভব। তবে অনেক দূরবর্তী টার্গেটে ম্যারিটাইম সুইসাইড এটাক ড্রোন দিয়ে হামলা করার ব্যাপারটা এখনও পরীক্ষিত নয়। এধরণের হামলায় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সমস্যার কারণে ড্রোনের সাথে নিজ বাহিনীর যোগাযোগ ব্যাহত হতে পারে। এই সমস্যা দূর করতে হলে এগুলিকে অটোনমাস করা প্রয়োজন। তবে অটোনমাস করতে হলে এগুলিতে যথেষ্ট ভালো সেন্সর যুক্ত করতে হবে; যাতে করে অন্য কোন বস্তুর সাথে সংঘর্ষ এড়াতে পারে এবং টার্গেটে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারে। এছাড়াও শত্রুর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় জ্যামিং এবং সাইবার হামলা এড়াতে গেলে এই ড্রোনগুলিতে অত্যন্ত শক্তিশালী গাইড্যান্স সিস্টেম থাকা প্রয়োজন। তবে এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ নৌবাহিনীতেই নেভাল ড্রোন খোঁজা এবং সেগুলিকে ঠেকাবার জন্যে তেমন কোন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। পানির ঢেউএর মাঝ দিয়ে চলা নিচু এবং ছোট্ট এসকল নৌযানকে খুঁজে পাওয়া বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। স্বল্প খরচের এসকল ড্রোনের মাধ্যমে অনেক বড় এবং দামী যুদ্ধজাহাজ ঘায়েল করে ফেলা সম্ভব।

ইউক্রেনিয়রা প্রমাণ করেছে যে, নেভাল ড্রোনের মাধ্যমে শত্রুর নৌবাহিনীকে বন্দরের কাছাকাছি স্থানে পঙ্গু করে ফেলা সম্ভব। ইয়েমেনের হুথিরা প্রমাণ করেছে যে, নেভাল ড্রোন, ড্রোন বিমান, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সমন্বিত আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুর জাহাজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাতিব্যস্ত করে ফেলা সম্ভব। যুদ্ধজাহাজ হতে হলে এখন আর কোন জাহাজকে জটিল ডিজাইনের হতে হয় না। প্রতিটা জাহাজেই নিজস্ব বোট পানিতে নামাবার জন্যে ক্রেন বা ড্যাভিট থাকে। এই একই ব্যবস্থার মাধ্যমে একটা নেভাল ড্রোনকে জাহাজে বহণ করে পানিতে নামানো সম্ভব; যা কিনা ফরাসি নৌবাহিনী প্রমাণ করেছে। ইউক্রেনিয়রা যা উপকূলের কাছাকাছি করেছে, ফরাসিরা সেটাকে গভীর সাগরে নিয়ে গিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ফরাসিদেরকে চিন্তার মাঝে ফেলেছে এবং একইসাথে নিজেদের প্রতিরক্ষাকে দ্রুত উন্নত করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। নেভাল ড্রোনগুলি একপ্রকার 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার' হিসেবে কাজ করছে; যার মাধ্যমে একটা নৌবাহিনী তাদের স্বাভাবিক শক্তিমত্তার চাইতে বেশি শক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে। ইউক্রেন এক্ষেত্রে প্রমাণ করেছে যে, বহুগুণে শক্তিশালী একটা নৌবাহিনীকেও নেভাল ড্রোনের বিচক্ষণ ব্যবহারের মাধ্যমে পঙ্গু করে ফেলা সম্ভব। তুরস্কও এক্ষেত্রে শিক্ষা নিয়ে অনেক ধরণের নেভাল ড্রোন ডেভেলপ করেছে; যার মাঝে কয়েক প্রকারের কমব্যাট বা এটাক ড্রোনও রয়েছে।
 
২১শে নভেম্বর ২০২৪। মংলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর 'আইল্যান্ড-ক্লাস' ওপিভি 'কপোতাক্ষ' এবং একই ক্লাসের আরেকটা জাহাজ। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পুরোনো 'আইল্যান্ড-ক্লাস' ওপিভি, ‘ক্যাসল-ক্লাস' কর্ভেট, ‘রিভার-ক্লাস' মাইন সুইপার, কোস্ট গার্ডের 'লীডার-ক্লাস' কর্ভেটগুলি খুব সহজেই বেশকিছু প্রকারের নেভাল ড্রোন বহণ করতে পারে। এখানেই ১৫টা জাহাজ। এগুলির সাথে আরও কিছু সেকেন্ড-হ্যান্ড জাহাজ যুক্ত করলে খুব সহজেই এই সংখ্যাকে ৩০ থেকে ৫০-এ নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এরূপ একটা ফ্লীটের পক্ষে ১০০ থেকে ৪০০টা নেভাল ড্রোন, একই সংখ্যক ড্রোন বিমান ছাড়াও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করা তেমন কঠিন হবে না। 


বাংলাদেশের জন্যে 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার'

বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সম্পদের মারাত্মক স্বল্পতা রয়েছে। এই স্বল্প সম্পদ দিয়ে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রকে (যেমন ভারত) মোকাবিলা করা খুবই কঠিন কাজ। তবে বাংলাদেশের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে তাদের নিজেদের শক্তিকে এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া, যা দিয়ে শত্রুর নৌবাহিনীকে বঙ্গোপসাগর অবরোধ দেয়ার প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত করতে পারবে। হঠাৎ করে নৌবাহিনীর জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে গেলে সেকেন্ড-হ্যান্ড জাহাজ যোগাড় করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে শধু সামরিক নয়, বেসামরিক জাহাজও ক্রয় করা যেতে পারে; যেগুলি কিনা সামরিক কাজের জন্যে প্রস্তুত করে নেয়া যেতে পারে। এই জাহাজগুলিকে বিভিন্ন প্রকারের সামরিক সরঞ্জাম বহণের জন্যে উপযোগী করে নেয়া সম্ভব। এর মাঝে ছোট ড্রোন বিমান যুক্ত করতে তেমন কোন পরিবর্তনই প্রয়োজন নেই। জাহাজের আকার অনুযায়ী সেখান থেকে ৪০মিনিট থেকে ১৮ঘন্টা ওড়ার সক্ষমতার ড্রোন অপারেশন পরিচালনা করা যেতে পারে। একইসাথে কনটেইনারের ভেতর বিভিন্ন প্রকারের সক্ষমতার প্যাকেজ বহণ করা যেতে পারে; যেমন, জাহাজ-ধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র; ড্রোন অপারেশনস কমান্ড সেন্টার। এছাড়াও জাহাজের ডেকের উপরেই বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র জুড়ে দেয়া যেতে পারে; যেমন, কাঁধে বহণযোগ্য বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র (ম্যানপ্যাডস); ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ, ২০মিঃমিঃ বা ৩০মিঃমিঃ বিমান-বিধ্বংসী কামান।

নেভাল ড্রোন বা 'আনম্যান্ড সারফেস ভেসেল' (ইউএসভি) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার' হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রায় সকল জাহাজেই নিজস্ব বোট থাকে এবং বোট পানিতে নামাবার জন্যে ক্রেন বা ড্যাভিটও থাকে। এই মাধ্যমটা ব্যবহার করেই জাহাজে নেভাল ড্রোন বহণ করা যেতে পারে। যত বড় জাহাজ, তত বড় বা তত বেশি সংখ্যক বা প্রকারের নেভাল ড্রোন বহণ করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পুরোনো 'আইল্যান্ড-ক্লাস' ওপিভি, ‘ক্যাসল-ক্লাস' কর্ভেট, ‘রিভার-ক্লাস' মাইন সুইপার, কোস্ট গার্ডের 'লীডার-ক্লাস' কর্ভেটগুলি খুব সহজেই বেশকিছু প্রকারের নেভাল ড্রোন বহণ করতে পারে। এখানেই ১৫টা জাহাজ। এগুলির সাথে আরও কিছু সেকেন্ড-হ্যান্ড জাহাজ যুক্ত করলে খুব সহজেই এই সংখ্যাকে ৩০ থেকে ৫০-এ নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এরূপ একটা ফ্লীটের পক্ষে ১০০ থেকে ৪০০টা নেভাল ড্রোন, একই সংখ্যক ড্রোন বিমান ছাড়াও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করা তেমন কঠিন হবে না। এই জাহাজগুলিকে উচ্চতর সক্ষমতার ফ্রিগেট-কর্ভেটের সাথে গ্রুপ হিসেবে অপারেশনে যুক্ত করতে পারলে একে অপরের সক্ষমতাগুলিকে ব্যবহার করতে পারবে। এগুলির একত্রিত সক্ষমতা তখন প্রতিটা জাহাজের আলাদা সক্ষমতার সাথে যুক্ত হবে এবং নিজেদের একক দুর্বলতা দৃশ্যমান হবে না।

নেভাল ড্রোন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে 'ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার' হিসেবে কাজ করে বঙ্গোপসাগরকে শত্রুর নৌ-অবরোধের চেষ্টা থেকে মুক্ত রাখতে পারবে। তবে সেটা তখনই সম্ভব, যখন বাংলাদেশ নিশ্চিত করে বুঝতে পারবে যে, তারা নিজেদেরকে কোথায় দেখতে চায়। সাত দশকের লিবারাল বিশ্বব্যবস্থা, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা করেছিলো, তা আজ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ভেঙ্গে ফেলেছে। এরূপ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্যে সবথেকে বেশি প্রয়োজন নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তাকে পাঁচ দশকের নতজানু অবস্থান থেকে সরিয়ে আদর্শিক চিন্তার দিকে ধাবিত করা। এছাড়াও প্রয়োজন রয়েছে নিজেদের ভূকৌশলগত অবস্থানকে 'হোলিস্টিক'ভাবে মূল্যায়ন করা; যাতে করে সামগ্রিকভাবে একটা প্রতিরক্ষা কৌশলের দিকে অগ্রগামী হওয়া সম্ভব হয়। এরূপ একটা কৌশলে উপনীত হবার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সেক্টরকে শক্তিশালী করার জন্যে শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে। যুদ্ধ আসছে জেনে শুধু কথায় প্রস্তুতি নিলেই হবে না; গুরুত্বের ক্রম অনুধাবন করে কাজে দেখাতে হবে। সার্বভৌমত্ব এই ক্রমের মাঝে কোথায় স্থান পাবে, তা আজ কেউ প্রশ্ন না করলেও পরাধীনতার স্বাদ নেয়ার পর প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে। আজকে কাজ না করার স্বপক্ষে কোন যুক্তিই আগামীকালকের ব্যর্থতার পর কারুর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আজকের অদূরদর্শীতা আগামীকালকে জনগণের কাছে দেশদ্রোহীতার সমতুল্য হবে। কারণ ব্যর্থতার দায় কেউই নিতে চাইবে না।







সূত্রঃ
‘French Navy tests one-way attack USV against target at sea’ in Naval News, 29 April 2025

‘French Navy conducts trials with Exail DriX USV’ in Naval News, 18 March 2025

‘French Navy experiments new unmanned systems to support amphibious operations’ in Naval News, 18 March 2025

‘French Navy Tests iXblue’s DriX Unmanned Surface Vessel’ in Naval News, 02 November 2020

‘‘World’s first’ autonomous surface drone system delivered’ in Naval Today, 10 February 2025

‘French Navy steps up USV development and delivery ’ in Naval News, 27 January 2025

‘French Navy Experiments Weaponized Drone Jet Ski for Remote Naval Attacks Without Risking Crews’ in Army Recognition, 29 April 2025

‘France’s Naval Group unveils Seaquest, its first unmanned surface vessel’ in Breaking Defense, 05 November 2024

‘Seaquest S System Successfully Deployed on French Navy FREMM Frigate’ in Army Recognition, 08 November 2024

‘Turkey’s ‘ULAQ’ USV Completes Firing Tests with New Weapon System’ in Naval News, 24 January 2022

‘Türkiye's Okhan USV successfully completes tests’ in Turkiye Today, 20 January 2025

‘Qatar orders Turkish Ulaq USV’ in Janes’, 01 November 2024

‘Turkish Navy successfully tests Albatros S kamikaze naval drone’ in Army Recognition, 09 October 2023

‘For the First Time in the World, a Swarm Attack Concept was Carried Out in a Joint USV-UAV Operation!’ in Defence Turkey, 09 October 2023

‘Turkish “MIR” USV test-fires torpedo for the first time’ in Newsatsea, 19 April 2023

‘Turkey’s Aselsan demonstrates new swarm USV capabilities’ in Naval News, 20 June 2022

Saturday, 19 April 2025

আসন্ন ভূরাজনৈতিক ঝড়ের জন্যে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?

২০শে এপ্রিল ২০২৫

সবগুলি ঘটনা দেখিয়ে দিছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একারণে বাকি বিশ্বও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামরিক শক্তি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছে। বাংলাদেশ কি এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে অবহিত রয়েছে? অনুধাবন করার এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের সামনে প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে দুই বছর রয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না! অন্য কথা বলতে গেলে, সময় এখন আপাততঃ মাসের হিসেবে এগুচ্ছে!


ইউক্রেনের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে তার সামরিক শক্তি সরিয়ে নেবার প্রসেস শুরু করেছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মিউনিখ বক্তব্য যারা শুনেছেন, তাদের এই ব্যাপারটা বুঝে নিতে এক মুহুর্তও লাগার কথা নয়। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শক্তিকে অর্ধেক করে তুরস্কের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে। এখন তুরস্ক ইস্রাইলের নিরাপত্তা দেবে। একইসাথে ইরানকে, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। উদ্দেশ্য হলো, ইরানকে ভয় দেখিয়ে চুক্তি করতে বাধ্য করা; যাতে করে ইস্রাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এগুলির অর্থ হলো - যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়া থেকে সামরিক শক্তি সরিয়ে নিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতা চীনাদের তুলনায় নস্যি; চীনের একটা শিপইয়ার্ডের সক্ষমতা সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতার চাইতে বেশি! তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন কোরিয়াকে নিয়োজিত করতে চাইছে মার্কিন নৌবহরের জন্যে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর, রেয়ার আর্থ ম্যাটেরিয়াল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ফাইভ-জি প্রযুক্তি, ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এখন যুদ্ধাবস্তা প্রায়। এই সবগুলি ঘটনা দেখিয়ে দিছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একারণে বাকি বিশ্বও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামরিক শক্তি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছে। বাংলাদেশ কি এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে অবহিত রয়েছে? অনুধাবন করার এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের সামনে প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে দুই বছর রয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না! অন্য কথা বলতে গেলে, সময় এখন আপাততঃ মাসের হিসেবে এগুচ্ছে!

প্রথমতঃ বাংলাদেশকে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব বিদেশ-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে; বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে। কারণ দুনিয়াতে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি হবার সাথেসাথেই বৈদেশিক বাণিজ্য-কেন্দ্রিক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন বাতাসে মিলিয়ে যাবে! কোন কোন পণ্য বাংলাদেশের না হলেই নয়, সেগুলির একটা তালিকা করতে হবে এবং সেগুলিকে যথাসম্ভব দেশে উৎপাদনের জন্যে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিছু পণ্য বাইরে থেকে আনতেই হবে। সেগুলির উৎস নিয়ে গভীর চিন্তা ব্যয় করতে হবে - কোথা থেকে কিভাবে সেগুলি আনা সম্ভব হবে; এবং সেগুলির বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা কিভাবে দেয়া যাবে। এক্ষেত্রে কোন কোন দেশ বাংলাদেশের দুর্যোগের সময় সাথে থাকতে পারে, তার একটা তালিকা করতে হবে। যেসকল দেশের উপর নির্ভর করা কঠিন, বা যেগুলি বাংলাদেশকে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, সেগুলিকে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে - এখানে কোন ভালোবাসার সম্পর্ক রাখা যাবে না।

 
ডিজেল ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক মোটর এবং কম্প্রেসারের উৎপাদন করার জন্যে ফ্যাক্টরি দিতে হবে। এগুলি খুব জটিল কোন ইন্ডাস্ট্রি নয়। সদিচ্ছা থাকলে এসব ফ্যাক্টরি করতে এক বছরও লাগার কথা নয়। এই তিনটা জিনিস ছাড়া কোন ইন্ডাস্ট্রিই তৈরি করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বাংলাদেশ এগুলির জন্যে আমদানির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।



দ্বিতীয়তঃ যত দ্রুত সম্ভব কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল সক্ষমতা বাংলাদেশে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে।

১। ফ্ল্যাট স্টিলের উৎপাদন শুরু করতে হবে। বর্তমানে উৎপাদিত স্টিল প্লেটের মান যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে একাধিক ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেগুলিতে ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস বা ইএএফ চুল্লি রয়েছে। এসব চুল্লিতে তৈরি স্টিলের মান ফ্ল্যাট স্টিলের জন্যে সঠিক মানের (বিশুদ্ধতা বিবেচনায়)। ফ্ল্যাট স্টিল ছাড়া কোন কৌশলগত সামগ্রী তৈরি করা যাবে না; বিশেষ করে যানবাহন তৈরি করতে গেলে ফ্ল্যাট স্টিল লাগবেই।

২। ডিজেল ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক মোটর এবং কম্প্রেসারের উৎপাদন করার জন্যে ফ্যাক্টরি দিতে হবে। এগুলি খুব জটিল কোন ইন্ডাস্ট্রি নয়। সদিচ্ছা থাকলে এসব ফ্যাক্টরি করতে এক বছরও লাগার কথা নয়। এই তিনটা জিনিস ছাড়া কোন ইন্ডাস্ট্রিই তৈরি করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বাংলাদেশ এগুলির জন্যে আমদানির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

৩। পেট্রোকেমিক্যাল এবং বেসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে। মিথানলের উৎপাদন বাংলাদেশে শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন মিথানলের পরের পণ্যগুলিকে উৎপাদনে নিয়ে আসতে হবে। নাইট্রিক এসিড, ফরমালডিহাইড, এমোনিয়া এবং এগুলির মাধ্যমে তৈরি আরও কিছু যৌগ রয়েছে, যেগুলি উৎপাদন না করতে পারলে এক্সপ্লোসিভ ইন্ডাস্ট্রি করা সম্ভব নয়। আর এক্সপ্লোসিভ উৎপাদন না করতে পারলে সামরিক শক্তি তৈরির কথা ভুলে যেতে হবে। প্লাস্টিকের ধরণগুলির মাঝে শুধুমাত্র পিভিসি উৎপাদনে গিয়েছে বাংলাদেশে। এখানে পিইউ, পিএস, পিইটি, ইত্যাদি রেজিনের উৎপাদন শুরু করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। কারণ এগুলি ছাড়া কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা যাবে না।

৪। সিএনসি মেশিন যত বেশি সম্ভব আনার ব্যবস্থা করতে হবে এবং দেশেই সিএনসি মেশিন তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ সিএনসি মেশিন হলো মিলিং মেশিন, ডব্লিউডিএম; কিছু লেজার কাটিং মেশিনও রয়েছে। একইসাথে সিএনসি লেদ মেশিন প্রয়োজন অনেক। দেশে এই মুহুর্তে লেদ মেশিন (নন সিএনসি) তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। এটাকে আরও বাড়াতে হবে; সাথে মিলিং, সারফেস গ্রাইন্ডিং, শিয়ারিং, ইত্যাদি বেসিক মেশিন তৈরির সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে হবে। বিএমটিএফ, বিওএফ, ইএমই ওয়ার্কশপ, ওয়াল্টন এবং আরও কিছু কারখানায় টুলস তৈরি করা হয়। এই সক্ষমতাগুলিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং দীর্ঘস্থায়ীত্ব দিতে হবে।

৫। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের নিজস্ব কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্ল্যান্ট ডিজাইন, কম্পোনেন্ট উৎপাদন এবং ইন্সটলেশনের সক্ষমতা রয়েছে। এগুলিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে হবে। নলেজ বেইজটাকে আরও বাড়াতে হবে এবং ইন্সটিটিউশনাল জ্ঞানসম্পন্ন নতুন ইঞ্জিনিয়ারদেরকে এসব ক্ষেত্রে জড়িত করতে হবে।

৬। ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। টেলিকমিউনিকেশন, রাডার, জিপিএস এবং স্যাটকমসহ ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম নিয়ে কাজ করা সকল ধরণের যন্ত্র উৎপাদন শুরু করতে হবে। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংএর যন্ত্রের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে; বিশেষ করে মাল্টিলেয়ার পিসিবি তৈরির মেশিন, প্রোটোটাইপিং মেশিন, অটোম্যাটিক টেস্টিং ইকুইপমেন্ট, ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। লিথিয়াম ব্যাটারির উৎপাদন (শুধু সংযোজন নয়) শুরু করতে হবে। ইপিজেডগুলিতে এই মুহুর্তে কিছু অপটিক্যাল সরঞ্জাম তৈরি হয়। এগুলি বাংলাদেশের জন্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। কোন যুদ্ধাস্ত্রই এসকল সরঞ্জাম ছাড়া কার্যকর হবে না।

৭। টায়ার তৈরির সক্ষমতা বাড়াতে হবে; বিশেষ করে রেডিয়্যাল টায়ার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে কিছু বিদেশী শক্তি এদেশের গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি ধ্বংস করে ফেলে। এটা ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ফ্যাক্টরি, যেখানে ট্রাকে ব্যবহার করা কমার্শিয়াল ভেহিকল টায়ার তৈরি করা হতো। এটা ধ্বংস করে ফেলার কারণে ট্রাক টায়ার ভারত থেকে আনা ছাড়া কোন পদ্ধতিই থাকেনি। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। চীনের প্রযুক্তিতে আরও একটা টায়ার ফ্যাক্টরি (রেডিয়্যাল টায়ারসহ) তৈরি হবার প্রসেস শুরু হলেও সেটার ভবিষ্যৎ অনেক আগেই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। টায়ার তৈরির ফ্যাক্টরি এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ – সকল প্রকারের টায়ার তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন।

৮। গ্লাস তৈরির সক্ষমতাকে নতুন ধাপে নিয়ে যেতে হবে। বুলেটপ্রুফ গ্লাস এবং ফাইটার বিমানের ককপিটের ক্যানোপি তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন।

৯। আর্মার প্লেট এবং সিরামিক আর্মার তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সিরামিক এবং গার্মেন্টস শিল্পে কিছু বিশেষ দক্ষতা রয়েছে; যেগুলিকে সমন্বয় করতে হবে।
 
বর্তমানে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সংখ্যা বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। ইউক্রেনে ৫০টার মতো বিমানবন্দর থাকার কারণে তারা রুশ হামলা থেকে তাদের বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পেরেছে। ইউক্রেনের তুলনায় আকৃতিতে বাংলাদেশ অনেক ছোট। কাজেই বাংলাদেশের পুরাতন সকল বিমানবন্দরের রানওয়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে। এছাড়াও নতুন করে বহু স্থানে রানওয়ে তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে যতগুলি হাইওয়ে রয়েছে, তার সকল স্থানে খুঁজে দেখতে হবে যে, কোথায় কোথায় ফাইটার বিমান ওঠানামা করার মতো দীর্ঘ রানওয়ে তৈরি করা যায়।



তৃতীয়তঃ কৌশলগত অবকাঠামো নির্মাণে মনোনিবেশ করতে হবে।

১। বিমানবন্দরের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সংখ্যা বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। ইউক্রেনে ৫০টার মতো বিমানবন্দর থাকার কারণে তারা রুশ হামলা থেকে তাদের বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পেরেছে। ইউক্রেনের তুলনায় আকৃতিতে বাংলাদেশ অনেক ছোট। কাজেই বাংলাদেশের পুরাতন সকল বিমানবন্দরের রানওয়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে; যাতে করে মোটামুটিভাবে পরিবহণ বিমান হলেও যেন ওঠানামা করতে পারে। এছাড়াও নতুন করে বহু স্থানে রানওয়ে তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে যতগুলি হাইওয়ে রয়েছে, তার সকল স্থানে খুঁজে দেখতে হবে যে, কোথায় কোথায় ফাইটার বিমান ওঠানামা করার মতো দীর্ঘ রানওয়ে তৈরি করা যায়। সেই স্থানগুলির সারফেসকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভারত ইতোমধ্যেই হাইওয়েতে ফাইটার বিমান নামানোর পরীক্ষা চালিয়ে ফেলেছে।

২। নদীবন্দরের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বেশকিছু নদীবন্দর রয়েছে বর্তমানে; সেগুলিকে নতুন অবকাঠামো যোগ করে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর মাঝে প্রথমেই থাকবে ড্রেজিং। নদীপথে নাব্যতা না থাকলে নদীবন্দর দিয়ে কি হবে? নাব্যতা নিশ্চিত করতে ড্রেজার এবং আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়াতে হবে। ড্রেজারের ভেসেলগুলি বাংলাদেশে তৈরি হলেও ড্রেজারের কাটিং মেশিন এবং ডিজেল ইঞ্জিন আমদানির উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

৩। শিপবিল্ডিংএর ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে; বিশেষ করে খুলনা শিপইয়ার্ড ও নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে আরও অনেক স্থানে উচ্চমানের জাহাজ তৈরির ফ্যাসিলিটি গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ জাহাজ তৈরির জন্যে বরিশাল ও পটুয়াখালি এলাকা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, গজারিয়া, ভৈরব, আশুগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা ভালো এলাকা হতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং খুলনা অঞ্চলকে সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরির জন্যে আলাদাভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে।


জানুয়ারি ২০২৫। মিয়ানমার নৌবাহিনীর ফ্রিগেট পানিতে ভেসেছে। তাদের প্রথম ফ্রিগেটটা পানিতে ভেসেছে ১৩ বছর আগে। বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত ফ্রিগেট তৈরির উপযোগী একটা ডকইয়ার্ডও তৈরি করতে পারেনি! এই লজ্জা নিয়েই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।


চতুর্থতঃ সামরিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

১। বিমান সংযোজন ও নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ 'পিটি-৬', ‘বেল-২১২', ‘বেল-২০৬', ‘এমআই-১৭১' এবং 'এফ-৭' বিমান ওভারহোলিং করে থাকে। এছাড়াও 'গ্রোব জি-১২০টিপি' বিমানের কম্পোজিট স্ট্রাকচার তৈরির সক্ষমতাও রয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অতি সম্প্রতি নিজস্ব দু'টা প্রোটোটাইপ বিমান তৈরি করে উড্ডয়ন করেছে। এই সক্ষমতাগুলিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে হবে। বিমান সংযোজনের সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হবে এবং ফাইটার বিমান নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

২। নৌবাহিনীর ফ্রিগেট তৈরির সক্ষমতা অর্জন করার কথা ছিলো কয়েক বছর আগেই। মিয়ানমার তাদের নৌবাহিনীর জন্যে প্রথম ফ্রিগেট পানিতে ভাসিয়েছে ১৩ বছর আগে। বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত ফ্রিগেট তৈরির উপযোগী একটা ডকইয়ার্ডও তৈরি করতে পারেনি! এই লজ্জা নিয়েই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।

৩। ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সকল প্রকারের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন। এন্টি-ট্যাঙ্ক, ম্যানপ্যাডস, শোরাড, মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স, এন্টি-শিপ, এয়ার-টু-সারফেস, এয়ার-টু-এয়ার, সারফেস-টু-সারফেস ব্যালিস্টিক, সারফেস-টু-সারফেস ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা প্রয়োজন। এই মুহুর্তে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ওভারহোলিং (এবং প্রয়োজনে এসেম্বলি) করার সক্ষমতা রয়েছে; যেগুলিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে হবে।

৪। ড্রোন তৈরির কারখানা তৈরি করতে হবে। ড্রোন বহু প্রকারের; তবে এর মাঝে কিছু প্রকারের ড্রোনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। গোয়েন্দা কাজের জন্যে ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর (উপরে আলোচিত) সমৃদ্ধ ড্রোন প্রয়োজন। আর আক্রমণকারী ড্রোন হিসেবে 'ফার্স্ট পারসন ভিউ' বা 'এফপিভি' ড্রোন তৈরি করতে হবে। এই ড্রোনগুলি কোয়াডকপ্টার, হেক্সাকপ্টার, অক্টাকপ্টার, ফিক্সড-উইং হতে পারে। এই ড্রোনের প্রপালশন হিসেবে বিভিন্ন আকৃতির ইলেকট্রিক মোটর (উপরে মোটরের কারখানার কথা আলোচিত হয়েছে) এবং ছোট পেট্রোল ইঞ্জিন (মূলতঃ মোটরসাইকেল ইঞ্জিন) তৈরির কারখানা বসাতে হবে। এগুলিতে ব্যবহার করা জিপিএস, রিমোট-কন্ট্রোল কমিউনিকেশন ডিভাইস, লিথিয়াম ব্যাটারির (উপরে আলোচিত) আলাদা কারখানা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলির বডি (বিশেষ করে এফপিভি ড্রোনের) কার্বন-ফাইবার ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করতে হয়। কার্বন-ফাইবার কিভাবে যোগাড় করা যায়, অথবা কিভাবে এগুলি নিজেদের দেশে উৎপাদন করার প্রযুক্তি আনা যায়, সেটা খুঁজতে হবে।

৫। আর্টিলারি কামান তৈরির কারখানা প্রয়োজন। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে, ন্যাটোর মতো এয়ার সুপেরিয়রিটি না থাকলে (যেটার ব্যাপারে এখন অনেকেই সন্দিহান) যেকোন দেশকে আর্টিলারির উপরেই নির্ভর করতে হবে। ১০৫মিঃমিঃ এবং ১৫৫মিঃমিঃ আর্টিলারি ব্যারেল অবশ্যই তৈরি করতে হবে। ১০৫মিঃমিঃ, ১৫৫মিঃমিঃ আর্টিলারি এমুনিশন তৈরির ব্যাপক সক্ষমতা প্রয়োজন। এছাড়াও আরও দূরের পাল্লার টার্গেটে আঘাত করার লক্ষ্যে ১২২মিঃমিঃ, ২৩০মিঃমিঃ, ৩০০মিঃমিঃ আর্টিলারি রকেটের কারখানা করতে হবে। এছাড়াও বিমান বিধ্বংসী কামান তৈরির সক্ষমতা প্রয়োজন। ২০মিঃমিঃ অথবা ১৪ দশমিক ৫মিঃমিঃ (যেকোন একটা), ৩৫ অথবা ৩৭মিঃমিঃ (যেকোন একটা), ৫৭মিঃমিঃ কামান নিজস্ব কারখানায় তৈরি করতে হবে। এগুলির সাথে ব্যবহার করার জন্যে নিজস্ব তৈরি ইলেকট্রো-অপটিক ডিভাইস এবং রাডারের সমন্বয় করতে হবে।

৬। সামরিক অফরোড গাড়ির কারখানা তৈরি করতে হবে। এগুলি সকল প্রকারের পরিবহণ ছাড়াও আর্টিলারি ট্রাকটর হিসেবে কাজ করবে। এগুলির মাঝে 'বাগি' প্রকারের হাল্কা যানও প্রয়োজন, যেগুলি মোটরসাইকেলের সাথে চলার উপযোগী। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে এধরণের যানবাহন উপযোগী হবে। বেশকিছু গাড়ি প্রয়োজন, যেগুলি উভচর হবে; অর্থাৎ নদী-খাল-বিল পার হতে পারবে। গাড়িগুলিকে পরিবর্তিত করেই এধরণের উভচর যান তৈরি করা সম্ভব। এসকল গাড়িতে ব্যবহারের জন্যে ডিজেল ইঞ্জিন, স্টিল প্লেট, আর্মার, বুলেটপ্রুফ গ্লাসের কারখানার কথা উপরে উল্লিখিত হয়েছে।

৭। বন্দুকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের এসল্ট রাইফেল তৈরির সক্ষমতা মোটেই যথেষ্ট নয়। অতি দ্রুত এই উৎপাদন সক্ষমতাকে কয়েক গুণ করতে হবে। একইসাথে ৭ দশমিক ৬২মিঃমিঃ জিপি মেশিন গান এবং ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ হেভি মেশিন গান (এয়ার ডিফেন্সের জন্যে) তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এসকল বন্দুকের জন্যে ৭ দশমিক ৬২মিঃমিঃ (রাইফেল ও মেশিন গান) এবং ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ এমুনিশন উৎপাদন কয়েক গুণ করতে হবে।

৮। এয়ারড্রপ এমুনিশন এবং নেভাল মাইন তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

এছাড়াও আরও বেশকিছু সামরিক সক্ষমতা রয়েছে, যেগুলি উল্লেখ করতে থাকলে তালিকা বড় হতেই থাকবে। কিন্তু উপরে উল্লেখ করা সক্ষমতাগুলি অর্জিত না হলে এর সাথে আরও কয়েক'শ সক্ষমতা যুক্ত করাটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে।
 
কেউ কেউ এখনও দিবাস্বপ্নে বিভোর রয়েছেন। তাদেরকে বলতে হবে - ঘুম থেকে জেগে উঠুন! বাস্তবতা বুঝুন! উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার ভিত্তিগুলি বাস্তবে রূপ দিতে পারলেও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সহজ হবে না। কারণ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ কোন আদর্শিক রাষ্ট্র নয়। তারা 'প্রোএকটিভ' নয়; বরং তারা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে প্রতিক্রিয়া (রিয়্যাকটিভ) হিসেবে কিছু পরিকল্পনা করে থাকে। যেকারণে বেশিরভাগ সময়ই তারা বাইরের শক্তির প্রভাব বলয়ে আবর্তিত হয়।


উপরে দেয়া তালিকার বাইরে বাংলাদেশকে আরও অনেক কিছুই করতে হবে। যেমন, অতি দ্রুত কয়েক স্কোয়াড্রন চীনা 'জে-১০' এবং পাকিস্তানি 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান যোগাড় করতে হবে। একইসাথে অফ-দ্যা-শেলফ কিছু ফ্রিগেট (চীনা এবং আর যেখানে পাওয়া যায়) যোগাড় করতে হবে; যেগুলি আনার পর সেগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন জাহাজ তৈরি করতে কয়েক বছর লেগে যাবে; এখন সেই সময়টুকু আছে কিনা, তা সন্দেহ। পুরোনো জাহাজগুলির সাথে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং এয়ার, সারফেস ও সাব-সারফেস ড্রোনের সমন্বয় ঘটিয়ে সেগুলিকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের উপযোগী করে প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই মুহুর্তে সংখ্যা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার; যা কোনভাবেই প্রতিস্থাপনীয় নয়। মধ্যম পাল্লার এয়ার ডিফেন্স ক্ষেপণাস্ত্র (চীনা এবং তুর্কি) অবশ্যই প্রয়োজন। এগুলি না থাকলে দেশের কোন স্থাপনাই রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

ঝড় আসছে! কিন্তু বাংলাদেশ এই মুহুর্তে মোটেই প্রস্তুত নয়! বিপদে ভয় পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভয় না পেলে অনেক সময়েই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা যায় না। ভয় পেলেই শরীরের ডিফেন্সিভ মেকানিজম কাজ করা শুরু করে; আবার কোন কোন ক্ষেত্রে প্যারালাইসিসেও আক্রান্ত হতে পারে। দ্বিতীয়টা বাংলাদেশের জনগণ তাদের নেতৃত্বের কাছ থেকে কখনোই আশা করবে না। কিন্তু আশা না করলেই যে তা বাস্তবে হবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ কেউ কেউ এখনও দিবাস্বপ্নে বিভোর রয়েছেন। তাদেরকে বলতে হবে - ঘুম থেকে জেগে উঠুন! বাস্তবতা বুঝুন! উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার ভিত্তিগুলি বাস্তবে রূপ দিতে পারলেও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সহজ হবে না। কারণ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ কোন আদর্শিক রাষ্ট্র নয়। তারা 'প্রোএকটিভ' নয়; বরং তারা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে প্রতিক্রিয়া (রিয়্যাকটিভ) হিসেবে কিছু পরিকল্পনা করে থাকে। যেকারণে বেশিরভাগ সময়ই তারা বাইরের শক্তির প্রভাব বলয়ে আবর্তিত হয়।

Friday, 4 April 2025

ট্রাম্পের গ্রীনল্যান্ড চাই – এটাই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা

০৫ই এপ্রিল ২০২৫

ডেনমার্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের অধীন অঞ্চল দখল করে নিতে চাইছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত বিশ্বব্যবস্থা এখন যে আর নেই, তার আরেকটা প্রমাণ এটা। অপরদিকে এই ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইইউ, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন কানাডার প্রতিদ্বন্দ্বিতা; যা কিনা বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ। 


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে এসেই গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় নেয়ার কথা বলতে থাকেন। এর আগে প্রথম টার্মেও ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করার কথা বলেছিলেন। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বাস্তবতার সাথে যায় কিনা। তবে মার্চ মাস থেকেই গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত হতে শুরু করে। এখন অনেকেই ধরে নিচ্ছেন যে, ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্টই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ট্রাম্প কেন গ্রীনল্যান্ড চাইছেন?

গত ১২ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে 'টেক্সাস মিনারাল রিসোর্সেস'এর এনথনি মারচেজি বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডের পুরো উপকূল নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচাইতে বড় খনিজ সম্পদের ভান্ডারগুলির একটা। এই উপকূলের যেকোন স্থানে কেউ ঢিল ছুঁড়লেই একটা বিশ্বমানের খনির সন্ধান পাবে। 'ডয়েচে ভেলে' বলছে যে, এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডে মাত্র দু'টা খনিতে কাজ চলছে; যেখানে শ'খানেক মানুষ কাজ করে। সেখানে খনিজ আহরণ খুবই কষ্টকর। অন্য অনেক স্থানের চাইতেও এখানে খনিজ আহরণ অনেক ব্যববহুল। এখানে কোন রাস্তা নেই এবং ভূপ্রকৃতি খুবই বন্ধুর। চীনের বাইরে 'রেয়ার আর্থ' খনিজের সবচাইতে বড় উৎসগুলির একটা ২০২১ সালে গ্রীনল্যান্ড সরকার বন্ধ করে দেয়। কারণ ঐ একই সাথে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে এবং তা জনবসতির বেশ কাছাকাছি। আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে কৌশলগত সমুদ্রপথ চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; যার মাঝে একটা গিয়েছে রাশিয়ার উত্তর উপকূল ঘেঁষে; যা 'নর্দার্ন সী রুট' বা 'এনএসআর' নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টা গিয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পাশ দিয়ে কানাডার মাঝ দিয়ে; যা 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নামে পরিচিত। তৃতীয়টা গিয়েছে একেবারে উত্তর মেরুর মাঝ দিয়ে; যা 'ট্রান্স পোলার সী রুট' হিসেবে পরিচিত। এই রুটগুলি এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সমুদ্রপথকে অনেক কমিয়ে ফেলতে পারে। বর্তমানে আর্কটিক অঞ্চল দিয়ে জাহাজ পার করতে হলে আইস ব্রেকার জাহাজ লাগে; যা বেশ ব্যয়বহুল। কাজেই এখনও পর্যন্ত খনিজ আহরণ এবং সমুদ্রপথ ব্যবহার করার ব্যাপারটা ভবিষ্যতের আলোচনা। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডের জনগণের আয় শুধুমাত্র মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। একারণে ডেনমার্ক সরকার বছরে প্রায় ৫'শ মিলিয়ন ইউরো বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। তবে গ্রীনল্যান্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ডেনমার্ক শক্তিশালী দেশগুলির সাথে বড় রকমের দেনদরবার করতে পারে; যা ডেনমার্কের আকারের তুলনায় বেশি শক্তির প্রতীক।

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক টিম মার্শাল 'বিবিসি'কে বলছেন যে, এর আগেও ১৯৫০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করতে চেয়েছিল। কাজেই একটা অঞ্চল ক্রয় করার ব্যপারটা নতুন নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে ছাড়াও সামরিক দিক থেকে গ্রীনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর মেরুর উপর দিয়ে রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে কম দূরত্ব অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারে। আবার একইসাথে, রুশ সাবমেরিনের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে স্বল্প দূরতের রুট হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে। গ্রীনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলির বেশিরভাগই গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কানাডার কাছাকাছি। গ্রীনল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই সবচাইতে বেশি লাভবান হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং মাইক্রোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইরকমই একটা বোঝাপড়া মার্কিনীরা করতে পারে গ্রীনল্যান্ডের সাথে। নব্যস্বাধীন গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথমে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।
 
আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে কৌশলগত সমুদ্রপথ চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; যার মাঝে একটা গিয়েছে রাশিয়ার উত্তর উপকূল ঘেঁষে; যা 'নর্দার্ন সী রুট' বা 'এনএসআর' নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টা গিয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পাশ দিয়ে কানাডার মাঝ দিয়ে; যা 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নামে পরিচিত। তৃতীয়টা গিয়েছে একেবারে উত্তর মেরুর মাঝ দিয়ে; যা 'ট্রান্স পোলার সী রুট' হিসেবে পরিচিত। এই রুটগুলি এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সমুদ্রপথকে অনেক কমিয়ে ফেলতে পারে।


ডেনমার্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে

মার্চের শেষ সপ্তাহে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী উশা ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হবার পর গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। এই ভিজিট সম্পর্কে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, এই ভ্রমণ গ্রীনল্যান্ডের প্রয়োজন নেই এবং এটা গ্রীনল্যান্ড চাচ্ছেও না। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের উপর যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন যে, এই চাপের মুখে তারা বাধা প্রদান করবেন। হৈচৈ শুরু হবার পর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দেন যে, হৈচৈ শুরু হবার কারণে তিনি নিজেও এখন তার পরিবারের সাথে গ্রীনল্যান্ডে যাবেন। তবে তিনি বলেন যে, তার এই সফর গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন স্পেস ফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ রাডার রয়েছে; যার মাধ্যমে উত্তর মেরুর দিক থেকে ধেয়ে আসা পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা পাবে যুক্তরাষ্ট্র। 'গ্রীনল্যান্ডিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন'এর মারকাস ভ্যালেন্টিন 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর শুধুমাত্র সামরিক ঘাঁটিতে সীমাবদ্ধ করার ফলে সেখানে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এবং বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের জনগণ ভ্যান্স পরিবারের সাথে অসহযোগিতা করার পথে হেঁটেছে। সরকারিভাবে ভ্যান্সের পরিবারকে গ্রহণ না করার কথাও বলা হয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পক্ষ থেকে। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে, স্বল্প মেয়াদে হলেও তাদের প্রতিবাদ অনেকটাই সফল হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী। তবে গ্রীনল্যান্ডের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করতে ইচ্ছুক। 'বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আপাততঃ গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীরা একটা ছোট জয় পেয়েছে বলে মনে হলেও আসন্ন দিনগুলিতে গ্রীনল্যান্ডের উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডে ৭৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এই ঘাঁটিকে যতটা ইচ্ছা বৃদ্ধি করতে পারবে। তাহলে এখানে সমস্যাটা কোথায়, তা স্পষ্ট নয়। গ্রীনল্যান্ডের জনগণও হয়তো ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে চাইবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সবকিছু অতি দ্রুত চাইছে।

তবে ২৯শে মার্চ গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সফরের সময় জেডি ভ্যান্স এক ভাষণে ডেনমার্ক সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, ডেনমার্কের প্রতি তার বার্তা খুবই পরিষ্কার – গ্রীনল্যান্ডের জনগণের জন্যে ডেনমার্ক যথেষ্ট বিনিয়োগ করেনি এবং গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও ডেনমার্ক কিছু করেনি। তিনি বলেন যে, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্ক গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীদের সাথে নয়; বরং তা হলো ডেনমার্কের নেতৃত্বের সাথে; যারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। ভ্যান্স এমন এক সময়ে গ্রীনল্যান্ড সফর করেছেন, যখন গ্রীনল্যান্ডের সরকার পরিবর্তন হচ্ছিলো। ভ্যান্সের সফরের পরপরই নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জেন্স ফ্রেডেরিক নিয়েলসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, সরকার পরিবর্তনের এমন এক সময়ে ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর করতে আসাটা একটা বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের প্রতি অসন্মান দেখানো। এটা একটা লজ্জাজনক অধ্যায় ছিল।
 
গ্রীনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলির বেশিরভাগই গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কানাডার কাছাকাছি। গ্রীনল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই সবচাইতে বেশি লাভবান হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং মাইক্রোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইরকমই একটা বোঝাপড়া মার্কিনীরা করতে পারে গ্রীনল্যান্ডের সাথে। নব্যস্বাধীন গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথমে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।


ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফরের একই দিন, ২৯শে মার্চ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অতি প্রয়োজন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে নয়; সারা দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি চীনা এবং রুশ জাহাজে ভরে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্ক বা অন্য কারুর উপর এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ভার ছেড়ে দিতে পারে না। এক'শ বছর আগেও গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি খোলা ছিল না। কিন্তু এখন আইসব্রেকার জাহাজের মাধ্যমে গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশে দিয়ে রাশিয়া এবং চীনে যাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, তার আশা ডেনমার্ক এটা বুঝতে পারছে এবং ইইউও এটা বুঝতে পারছে। আর না বুঝতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে বোঝাবে। দু'দিন পর ৩১শে মার্চ এক ভিডিও বার্তায় ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন বলেন যে, ডেনমার্ক সরকার সমালোচনা পছন্দ করে; তবে যে ভাষায় মার্কিনীরা কথা বলছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে কেউ কাছের বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে কথা বলে না। তিনি বলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনও ডেনমার্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কাছের বন্ধু হিসেবেই দেখেন। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডে তার সামরিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারে। ১৯৪৫ সালে গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টা সামরিক ঘাঁটি ছিল এবং কয়েক হাজার সেনা সেখানে মোতায়েন ছিল। বর্তমানে একটা ঘাঁটিতে মাত্র ২'শ সেনা রয়েছে। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী একত্রে অনেক কিছুই করা সম্ভব। একসময় শুধু ডেনমার্ক নয়, সকলেই মনে করেছিল যে, আর্কটিকে কোন নিরাপত্তা হুমকি নেই। বর্তমানে পরিস্থতি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। একারণেই কিছুদিন আগেই ডেনমার্ক আর্কটিকের নিরাপত্তায় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ভুলে গেলে চলবে না যে, গ্রীনল্যান্ড ন্যাটোর অংশ এবং ন্যাটোর নিরাপত্তার মাঝে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তাও রয়েছে।

৩রা এপ্রিল ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা নেবে না। গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা হলো গ্রীনল্যান্ডবাসীর। গ্রীনল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব, সীমানা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে সকলকে একত্রিত থাকতে হবে; সেটা ডেনমার্ক এবং গ্রীনল্যান্ডের মাঝে যে আলোচনাই হোক না কেন। তিনি বলেন যে, তার ধারণা এখন পর্যন্ত তারা কাজটা ঠিকমতোই করতে পেরেছেন; তবে এটা পরিষ্কার যে, তাদেরকে খোলা জানালাগুলিকে আরও ভালোভাবে আটকাতে হবে। এটা পরিষ্কার যে, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী গ্রীনল্যান্ডবাসীদের মতামতকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের পক্ষে আনতে পারেননি। আর ৪ঠা এপ্রিল ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিওর সাথে আলোচনার পর সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি রুবিওকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং তা ডেনমার্কের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ।
 
উত্তর মেরুর উপর দিয়ে রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে কম দূরত্ব অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারে। আবার একইসাথে, রুশ সাবমেরিনের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে স্বল্প দূরতের রুট হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রীনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে নয়। এটা গ্রীনল্যান্ডের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি সুবিধা দেয়। 


যুক্তরাষ্ট্র কি গ্রীনল্যান্ডকে আলাদা করতে চায়, নাকি দখল করতে চায়?

'জার্মান মার্শাল ফান্ড'এর ফেলো সোফি আর্টস 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের বক্তব্য সঠিক নয়। ডেনমার্ক সরকার গ্রীনল্যান্ডের বাজেটের অর্ধেকের বেশি দিয়ে থাকে। এর বাইরেও রয়েছে প্রতিরক্ষা সহায়তা; যা ডেনমার্ক তার বন্ধুপ্রতীম দেশগুলির সাথে একত্রে দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের হুমকির পর গ্রীনল্যান্ড ও আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার জন্যে ২ বিলিয়ন ডলার খরচের ঘোষণা দিয়েছে ডেনমার্ক। এটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যে বর্তমানের ১০ গুণ বেশি খরচ। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রীনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে নয়। এটা গ্রীনল্যান্ডের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি সুবিধা দেয়। তবে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার সাথে পুরো আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা জড়িত। এখানে ন্যাটো জোটের স্বার্থ জড়িত। জোটকে ছোট করে এখানে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে ডেনমার্ক মার্কিনীদের সাথে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং গ্রীনল্যান্ডকে ডেনমার্ক থেকে আলাদা করার কথাও শোনা যাচ্ছে।

‘এএফপি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্ক থেকে পুরোপুরিভাবে আলাদা হবার চেষ্টা করছে। গ্রীনল্যান্ডবাসীদের একটা প্রধান অভিযোগ হলো, ডেনমার্ক সরকার ঐতিহাসিকভাবেই গ্রীনল্যান্ডের ইনুইট আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে দমন করেছে। আদিবাসীদেরকে জোর করে বন্ধাত্ব বরণ করিয়েছে এবং তাদের সন্তানদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে গেছে ডেনমার্ক সরকার। গ্রীনল্যান্ডে অনেকেই মনে করেন যে, ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডবাসীদেরকে নিচু জাতের নাগরিক হিসেবে দেখে। তবে তারা মনে করে না যে, তাদের ভূমি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি হবার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের প্রায় সকল জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও ট্রাম্পের পরিকল্পনার পক্ষে খুব কমই রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, খুব দ্রুত ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। 'ডয়েচে ভেলে' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৭২১ সালে ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এরপর দু'শ বছর ধরে ইনুইট জাতির উপর খ্রিস্টান ধর্ম এবং ড্যানিস ভাষা চাপানো হয়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই গ্রীনল্যান্ডে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করা হতে থাকে। একসময় গ্রীনল্যান্ডকে নিজস্ব পার্লামেন্ট এবং সরকার দেয়া হয়। বর্তমানে গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে একটা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি গ্রীনল্যান্ড নিজে নিয়ন্ত্রণ করলেও নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতি দেখাশোনা করে ডেনমার্ক। গ্রীনল্যান্ডের সরকার বলছে যে, কোন একটা সময় তারা ডেনমার্ক থেকে আলাদা হবার লক্ষ্যেই এগুচ্ছে। ৮৪ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ড তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে তাদের অফিস খুলেছে। তারা খনিজ সম্পদ আহরণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউএর সাথেও সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ গ্রীনল্যান্ডের অর্থনীতিতে অনেকেই অংশীদার হতে চাইছে। একারণেই ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডের ইস্যুকে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে রেখেছে।
 
মার্চ ২০২৫। মার্কিন সেনাদের সাথে গ্রীনল্যান্ডের সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে অঞ্চল কেনাবেচা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল ক্রয় করা; যার মাঝে রয়েছে লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আলাস্কা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্রের বিনিময়ে ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ পেয়ে যায়। তাই আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যেতে থাকায় গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় অবাক হবার কিছু নেই। 


প্রাক্তন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা ফিলিপ ইনগ্রাম ব্রিটিশ মিডিয়া 'দ্যা সান'কে বলছেন যে, গ্রীনল্যান্ডের কোন সামরিক বাহিনী নেই। যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যেকোন দিন সেখানে হেঁটে ঢুকে যেতে পারে। তবে এর ভূরাজনৈতিক ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। তার ধারণা, গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই কানাডার সাথে যুক্ত। ট্রাম্প সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীনল্যান্ড, কানাডা এবং পানামা নিয়ে যখন কথা বলেছেন, তখন সর্বদাই তিনি সমুদ্রপথের প্রসঙ্গ এনেছেন। অর্থাৎ তিনি এই অঞ্চলগুলিকে সমুদ্রবাণিজ্য এবং লজিস্টিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। ন্যাটোর সদস্য দেশ কানাডা এখনও পর্যন্ত তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষার পিছনে খরচ করছে না। এবং 'ফাইভ আইজ' ইন্টেলিজেন্স সমঝোতার মাঝে কানাডাকে দুর্বল সদস্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। খুব সম্ভবতঃ ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডকে হুমকির মাঝে রেখে কানাডার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। কানাডার উপর বাণিজ্যিক শুল্ক আরোপের ব্যাপারটাও খুব সম্ভবতঃ একই সূত্রে গাঁথা।

ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া 'বিএফবিএস ফোর্সেস নিউজ'এর এক আলোচনায় ব্রিটিশ সামরিক চিন্তাবিদ ক্যারোলাইন কেনেডি-পাইপ বলছেন যে, মূলতঃ ২০১৭-১৮ সালের দিকে চীনারা যখন গ্রীনল্যান্ডে বিমানবন্দরের রানওয়ে তৈরি করতে ইচ্ছুক হয়, তখনই মার্কিনীরা এবং ড্যানিশরা নড়েচড়ে বসে। দুই দেশের প্রতিরোধের মুখে চীনা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডার একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। এটাও গ্রীনল্যান্ডের হিসেবে মাঝে নিতে হবে। কানাডা এখনও পর্যন্ত আর্কটিকে তাদের সক্ষমতার অনেক নিচে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারাও তড়িঘড়ি করে আর্কটিক নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা উভয়েই আর্কটিককে রাশিয়ার চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেছে। নরওয়ের ডিফেন্স কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের প্রফেসর টরমড হাইয়ার বলছেন যে, আর্কটিকে নরওয়ের অধীনে থাকা সুয়ালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে; যা কিনা গ্রীনল্যান্ডের সমান্তরালে দরকষাকষির অংশ হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী এই দ্বীপপুঞ্জকে বাণিজ্যিকভাবে সকলের জন্যে খোলা রাখা হলেও এর সার্বভৌমত্বকে নরওয়ের অধীনে দেয়া হয়; যা এখন রুশরা প্রশ্ন করছে। এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে ন্যাটো রুশ সাবমেরিনের উপর নজরদারি করে। ইতোমধ্যেই সেখানে রুশ এবং চীনারা গবেষণা কাজ চালাবার জন্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে অঞ্চল কেনাবেচা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল ক্রয় করা; যার মাঝে রয়েছে লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আলাস্কা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্রের বিনিময়ে ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ পেয়ে যায়। তাই আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যেতে থাকায় গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় অবাক হবার কিছু নেই। ডেনমার্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের অধীন অঞ্চল দখল করে নিতে চাইছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত বিশ্বব্যবস্থা এখন যে আর নেই, তার আরেকটা প্রমাণ এটা। অপরদিকে এই ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইইউ, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন কানাডার প্রতিদ্বন্দ্বিতা; যা কিনা বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ।

Friday, 28 March 2025

যুদ্ধাস্ত্রের ব্যাপারে অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা সার্বভৌমত্বকে হুমকিতে ফেলতে পারে

২৮শে মার্চ ২০২৫

পেরু বিমান বাহিনীর ফরাসি নির্মিত 'মিরাজ-২০০০পি' যুদ্ধবিমান। ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে ১৯৯৫ সালের সেনেপা যুদ্ধে পেরু এই বিমানগুলিকে এয়ারবোর্ন রাডার হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া তেমন কোন কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ ফরাসিরা এই বিমানের সাথে মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে রাজি ছিল না। অস্ত্র নির্মাতা রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বয় না হলে যুদ্ধের দিন সরঞ্জামের রেডিনেসের সমস্যা হতে পারে।


সেনেপা যুদ্ধ – পেরু বনাম ইকুয়েডর

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এবং ইকুয়েডর। পেরুর জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লক্ষ এবং ইকুয়েডরের জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ। আয়তনের দিক থেকেও পেরু অনেক বড় দেশ; ১৩ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ বনাম ৩ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ। বর্তমানে পেরুর জিডিপি (২৭০ বিলিয়ন ডলার) ইকুয়েডরের চাইতে (১২০ বিলিয়ন ডলার) অনেক বড় হলেও ১৯৮০এর দশকে একেবারে সমান ছিল। এই দুই দেশের মাঝে বহু আগে থেকেই সীমানা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সেনেপা নামে গভীর অরণ্যের পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ৭০কিঃমিঃএর মতো অঞ্চলে সীমানা নির্ধারণে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল। ১৯৪০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় এই দ্বন্দ্ব কিছুটা কাটলেও ১৯৫০এর দশকে ইকুয়েডরের পার্লামেন্টে সেই সীমানাকে স্বীকৃতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সমস্যা আবারও জেঁকে বসে ১৯৮১ সালে; যখন ইকুয়েডর সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে গোপনে এই দুর্গম অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তবে সামরিক দিক থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী পেরু খুব সহজেই ইকুয়েডরের সেনাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে সেনেপা অঞ্চলের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মূলতঃ এই অঞ্চলের ইকুয়েডর প্রান্তে স্বর্ণ এবং তামার খনির সন্ধান পাবার কারণে ইকুয়েডর এই অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছিল। ১৯৮১ সালের অপমান ইকুয়েডর ভোলেনি। ১৯৮৮ সাল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলি দেশেই অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। ইকুয়েডর সুযোগ খোঁজে। অর্থনৈতিক চাপে পেরু তার সামরিক বাজেট কমিয়ে ফেলে। তাদের বিমান বাহিনীতে ১২টা ফরাসি নির্মিত অত্যাধুনিক 'মিরাজ-২০০০পি' বিমান ছাড়াও ছিল ১৫টা সুপারসনিক 'মিরাজ-৫পি' ফাইটার (১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনাকে ১০টা দিয়ে দেয়ার পর), ৩৪টা সোভিয়েত 'সুখোই-২২' সুপারসনিক বোমারু বিমান, ১৫টা ব্রিটিশ 'ক্যানবেরা' মধ্যম পাল্লার বোমারু বিমান, ২৪টা মার্কিন নির্মিত 'এ-৩৭বি' হাল্কা এটাক বিমান এবং ১৫টা সোভিয়েত নির্মিত 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। কাগজে কলমে এটা ছিল দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে শক্তিশালী বিমান বাহিনী। কিন্তু সমস্যা হলো, বাজেট না থাকায় স্পেয়ার পার্টসের অভাবে পেরুর বিমান বাহিনীর মাত্র ৩টা 'মিরাজ-২০০০পি', ৭টা 'সুখোই-২২', ৪টা 'ক্যানবেরা', ৮টা 'এ-৩৭বি' বিমান এবং মাত্র ৫টা সোভিয়েত নির্মিত 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার অপারেশনাল ছিল। তাদের ২০টা বিমান প্রতিরক্ষা রাডারের মাঝে মাত্র ৮টা অপারেশনাল ছিল। এছাড়াও মধ্যম পাল্লার সোভিয়েত নির্মিত ৬টা 'এসএ-৩' আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (১১৬টা ক্ষেপণাস্ত্র), ১২৫টা 'এসএ-৭' ও ১১০টা 'এসএ-১৬' স্বল্পপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে মাত্র ২০ শতাংশ অপারেশনাল ছিল। এছাড়াও তাদের বহরে ১২৪টা সোভিয়েত নির্মিত ২৩মিঃমিঃ বিমান প্রতিরক্ষা কামানও ছিল; তবে সেগুলিকে হেলিকপ্টারে করে বহণ করে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাবার মতো সক্ষমতা পেরুর ছিল না। এই অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হলেও তা যুদ্ধের এক মাসের মাঝে পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়নি। একারণে ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সেনেপা যুদ্ধে পেরুর বিমান বাহিনীর অত্যাধুনিক 'মিরাজ-২০০০' এবং 'মিরাজ-৫' বিমানগুলি একবারের জন্যেও ইকুয়েডরের বিমানগুলিকে বাধা দিতে পারেনি। অপরদিকে ইকুয়েডরের 'মিরাজ-এফ১' এবং ইস্রাইলের তৈরি 'কেফির সি২' সুপারসনিক বিমানগুলি পেরুর কয়েকটা বিমান ভূপাতিত করে ফেলে। বাজে অর্থনৈতিক অবস্থা স্বল্প সময়ের জন্যে পেরুর সাথে ইকুয়েডরের সামরিক সক্ষমতার সমতা তৈরি করেছিল। পেরুর প্রায় ১০টার মতো 'মিরাজ-এফ১' এবং ১০টার মতো 'কেফির সি২' বিমান অপারেশনাল ছিল; যা যুদ্ধের ফলাফল তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছিল। তাদের বিমান বাহিনীর সবচাইতে আধুনিক ব্রিটিশ 'জাগুয়ার' বোমারু বিমানকে ব্যবহার করারই দরকার হয়নি। এবারে আবারও যখন যুদ্ধবিরতি হয় এবং সকলে আলোচনার টেবিলে বসে, তখন ইকুয়েডর সেনেপা অঞ্চল থেকে তার সেনা সরিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয় ঠিকই, কিন্তু খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ অঞ্চলটা তাদের নামে নিশ্চিতভাবে লিখিয়ে নেয়। এই অঞ্চলে কানাডার একটা কোম্পানি স্বর্ণের খনি ডেভেলপ করেছে এবং একটা চীনা কোম্পানি তামার খনি ডেভেলপ করেছে। অর্থাৎ ইকুয়েডর যা চেয়েছিল, সেটাই পেয়েছে।

স্বল্প সময়ের সেনেপা যুদ্ধ যে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেয় তা হলো, একটা রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই তার প্রতিরক্ষাকে হাল্কাভাবে নিতে পারে না। এটা স্বার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। যুদ্ধ শেষ হবার সাথেসাথেই পেরু রাশিয়া থেকে 'মিগ-২৯' এবং 'সুখোই-২৫' যুদ্ধবিমান কেনে। ২০০১ সালেই পেরু 'মিগ-২৯' যুদ্ধবিমানগুলিকে আপগ্রেড করে মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য 'আর-৭৭' রাডার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র বহণের উপযোগী করে নেয়। তাদের অতি দামী 'মিরাজ-২০০০পি' ফাইটারগুলি এয়ারবোর্ন রাডার ছাড়া খুব বেশি একটা কাজে আসেনি। এই বিমানগুলি একবারের জন্যেও ইকুয়েডরের বিমানগুলিকে বাধা দিতে পারেনি। সেগুলিতে বহণ করার জন্যে মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও ফরাসিরা পেরুকে দিতে রাজি হয়নি।
 
ইকুয়েডর বিমান বাহিনীর 'মিরাজ-এফ১' যুদ্ধবিমান। পেরুর প্রায় ১০টার মতো 'মিরাজ-এফ১' এবং ১০টার মতো 'কেফির সি২' বিমান অপারেশনাল ছিল; যা যুদ্ধের ফলাফল তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছিল। বাজে অর্থনৈতিক অবস্থা স্বল্প সময়ের জন্যে পেরুর সাথে ইকুয়েডরের সামরিক সক্ষমতার সমতা তৈরি করেছিল। কোন একটা সময় একটা রাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের উপরে কোন নিয়ন্ত্রণ চলে আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স সেটার উপর নজরদারি করবে এবং প্রয়োজন হলে সেই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে পারে।


সেনেপা যুদ্ধ থেকে শিক্ষা

প্রথমতঃ বিশাল শক্তিশালী সামরিক সরঞ্জামের বহর কোন কাজেই আসবে না যদি সেগুলি সর্বদা ব্যবহারের উপযোগী না থাকে। যুদ্ধের দিনে যুদ্ধক্ষেত্রে কে কতটা সামরিক শক্তি মোতায়েন করতে পারে, সেটার উপরেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। কোন একটা সময় সেই সরঞ্জামগুলি ব্যবহারের উপরে কোন নিয়ন্ত্রণ চলে আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স সেটার উপর নজরদারি করবে এবং প্রয়োজন হলে সেই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে পারে। সামরিক সরঞ্জামের রেডিনেস বা ব্যবহারের উপযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই রেডিনেস একদিকে যেমন নির্ভর করবে সরঞ্জামের কর্মক্ষমতার উপর, তেমনি নির্ভর করবে মানবসম্পদের ট্রেনিংএর উপর। এটা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।

দ্বিতীয়তঃ সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি; বিশেষ করে যেদিন প্রয়োজন হবে। যদি সরঞ্জাম অন্য কারুর তৈরি হয়, তাহলে সেখানে নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। বাইরে থেকে সরঞ্জাম কিনে আনার সাথে আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রশ্ন ছাড়াও ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত। অস্ত্র নির্মাতা রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বয় না হলে যুদ্ধের দিন সরঞ্জামের রেডিনেসের সমস্যা হতে পারে। স্পেয়ার পার্টস ছাড়া এখানে সফটওয়্যার আপগ্রেডের ব্যাপার রয়েছে। আবার যুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও চলে আসতে পারে। অস্ত্র নির্মাতা দেশগুলি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বহণের সক্ষমতা রেখে তাদের বিমানগুলি রপ্তানি করে না। বরং শর্ত সাপেক্ষে কিছু কিছু করে প্রযুক্তির ছাড় দেয়া হয়। পেরু 'মিরাজ-২০০০' বিমান ঠিকই পেয়েছিল; কিন্তু সেগুলি মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং 'এক্সোসেট' জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারতো না। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনার 'সুপার এটেনডার্ড' যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। ব্রিটেনের চাপে ফরাসিরা আর্জেন্টিনার বেশিরভাগ 'সুপার এটেনডার্ড' যুদ্ধবিমানকে 'এক্সোসেট' ক্ষেপণাস্ত্র বহণের উপযোগী করেনি; কালক্ষেপণ করেও আর্জেন্টিনার ক্ষতি করে তারা। পেরুকে ফ্রান্স 'এক্সোসেট' ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি এই সন্দেহে যে, পেরু সেগুলি আর্জেন্টিনাকে দিয়ে দিতে পারে। মিশরেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে মার্কিন 'এফ-১৬' (১৯২টা) এবং ফরাসি 'রাফাল' (৫৪টার মাঝে ২৪টা ডেলিভারি পেয়েছে) যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন তাদের মধ্যম পাল্লার 'এআইএম-১২০ এমর‍্যাম' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র মিশরকে দেয়নি; তেমনি ফরাসিরাও তাদের 'রাফাল' বিমানের সাথে 'মাইকা' এবং 'মিটিয়র' ক্ষেপণাস্ত্র দিতে রাজি হয়নি। কারণ উভয় দেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হলো ইস্রাইলকে রক্ষা করা; তাই তারা মিশরের হাতে এই অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলি দেয়নি। সুতরাং অতি দামী মার্কিন ও ফরাসি যুদ্ধবিমান কেনার পরেও মিশর সেগুলি নিয়ে কিছুই করতে পারেনি। একারণে তারা শেষ পর্যন্ত চীনের দ্বারস্থ হয়েছে 'জে-১০সি' যুদ্ধবিমানের জন্যে। তারা আশা করছে যে, অবশেষে তারা এই বিমানের সাথে মধ্যম পাল্লার 'পিএল-১৫' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পাবে। মার্কিন 'এফ-১৬'এর সাথে তুরস্কের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। তুরস্কের 'এফ-১৬' বিমানগুলির সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার আপগ্রেড করার জন্যে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে পেছনে ঘুরছে। আর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে নাকে দড়ি দিয়ে তার কাজগুলি করিয়ে নিচ্ছে। মার্কিন 'এফ-৩৫' স্টেলথ বিমানের প্রকল্পে যুক্ত হয়েও তুরস্ক ফেঁসে গেছে। রাশিয়া থেকে 'এস-৪০০' বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার 'অপরাধে' যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং তুরস্কের পাইলটরা 'এফ-৩৫' বিমানে ট্রেনিং সম্পন্ন করার পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে বিমানগুলি ডেলিভারি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি আগাম দেয়া অর্থও যুক্তরাষ্ট্র ফেরত দেয়নি তুরস্ককে! দেরিতে হলেও তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাকমেইল বুঝতে পেরেছে (যদিও কিছু লোক এখনও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়তে পারছে না); এবং একারণে তারা নিজেদের যুদ্ধ সরঞ্জাম ডেভেলপ করছে।
 
মিশরের বিমান বাহিনীর মার্কিন নির্মিত 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান। যুক্তরাষ্ট্র মিশরকে বিমান দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর সাথে 'এআইএম-১২০ এমর‍্যাম' মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি। ফ্রান্সও 'রাফাল' বিমানের সাথে মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স নিশ্চিত করেছে যে, ইস্রাইলের বিরুদ্ধে কেউ মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে না। 


তৃতীয়তঃ যেকোন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সরঞ্জাম ডেলিভারির ক্ষেত্রে একটা লীডটাইম থাকে। অর্থাৎ প্রস্তুতকারীকে কিছুটা সময় দিতে হয় সরঞ্জাম তৈরি করে ডেলিভারি দেয়ার; বিশেষ করে সরঞ্জাম যদি এমন হয়, যা কিনা আগে থেকে তৈরি করে রেখে দেয়া হয় না। সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে লীডটাইম খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা বেশ দীর্ঘ। হাতে গোণা কয়েকজন এসকল সরঞ্জাম প্রস্তুত করে। একারণে অনেক সময়েই দেখা যায় যে, সমরাস্ত্রের স্পেয়ার পার্টস পেতে সময়ক্ষেপণ হয়। পেরুর ক্ষেত্রেও সম্ভবতঃ সেটা হয়েছিল। কোন কোন সময় অতি প্রয়োজন হলে প্রস্তুতকারী দেশ নিজেদের বাহিনী থেকে সমরাস্ত্র সেকেন্ড-হ্যান্ড ডেলিভারি দিয়ে থাকে। তবে সেটা শুধুমাত্র প্রস্তুতকারী রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বিত হলেই হয়ে থাকে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনাম ছেড়ে গিয়েছিল, তখন তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিমান বাহিনীকে প্রায় ১১'শ যুদ্ধবিমান দিয়েছিল। অপরদিকে ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে পাকিস্তান কানাডা থেকে 'এফ-৮৬এফ স্যাবর' ফাইটার বিমান যোগাড় করে।

চতুর্থতঃ যে ব্যাপারটা পেরু হয়তো মোকাবিলা করেনি, তবে অন্য অনেক দেশকেই মোকাবিলা করতে হতে পারে। যেমন অস্ত্র ডেলিভারি করা বিমানকে আকাশসীমানা ব্যবহার করতে না দেয়া। অস্ত্র যদি আমদানি করতে হয়, তখন শক্তিশালী কোন দেশ ইচ্ছা করলে বহণকারী বিমানের চলাচলকে বিঘ্নিত করতে পারে। এখানে যুদ্ধে জড়ানো রাষ্ট্রের আকাশসীমানা কোন কোন দেশের সাথে বা তাদের সমুদ্রসীমানা রয়েছে কিনা, সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। ১৯৮০এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ চীন থেকে ২০টা 'এফ-৭এমবি' এবং ১২টা 'এ-৫' বিমান ক্রয় করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ চীন থেকে আরও যুদ্ধবিমান ক্রয় করে। এই বিমানগুলি অনেক ক্ষেত্রেই আকাশপথে উড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। অন্ততঃ 'কে-৮ডব্লিউ' বিমানগুলি যে আকাশপথে মিয়ানমার হয়ে এসেছিল, তা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তার কারণে এই আকাশপথের বর্ণনা এখানে না দেয়া গেলেও যে ব্যাপারটা বোঝানো সম্ভব তা হলো, যুদ্ধের সময় সমরাস্ত্র আমদানি করতে গেলে কোন একটা পথে আকাশসীমানা খোলা রাখতেই হবে। এটা সার্বভৌমত্ব রক্ষার সাথে সম্পর্কিত।

পঞ্চমতঃ সকল সমরাস্ত্র নিজেরা ডেভেলপ ও তৈরি করতে পারলে উপরের বেশিরভাগ সমস্যাই এড়ানো সম্ভব। সকল সরঞ্জাম না হলেও অন্ততঃ ক্রিটিক্যাল কম্পোনেন্টগুলি যদি নিজেরা তৈরি করা যায়, তাহলে পেরুর মতো পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। তবে এর সাথে একটা এয়ার করিডোর খোলা রাখতেই হবে; যাতে করে বাইরে থেকে এমন কিছু সরঞ্জাম নিয়ে আসা যায়, যা কিনা নিজেদের কাছে নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের 'ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক' হেলিকপ্টার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা বলাই যেতে পারে যে, বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা যদি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত রাখা না হয়, তাহলে এই রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী রাখার কোন প্রয়োজনই নেই। আর এই সামরিক বাহিনীর জন্যে বাইরে থেকে কেনা কোন অস্ত্রের উপর যদি শর্ত থাকে যে, তা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, অথবা যুদ্ধের সময়ে অস্ত্র অবরোধের মাঝে পড়তে হবে, বা স্পেয়ার পার্টস বা সফটওয়্যার আপডেট পাওয়া যাবে না, তাহলে সেই অস্ত্রের ব্যাপারে বাংলাদেশের অনীহা থাকাটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ।

 
সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে যদি একটা রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে। সেই রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে অন্য রাষ্ট্রের পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধে নামতে বাধ্য হবে; ঠিক যেমনটা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে হয়েছে। নিজের অর্থ খরচ করে অন্যের কাছ থেকে কেনা অস্ত্রের উপর নির্ভর করে কেউ কখনও বড় হতে পারেনি। সে সর্বদাই আরেকজনের কথায় উঠেছে বসেছে। অন্য কথায় অন্যের দাস হিসেবে কাজ করেছে। অনেকে এই দাস মনোভাবের মাঝেই গর্ব দেখে - সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্রের দাসত্ব করাও গর্বের ব্যাপার! তবে বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে, যুদ্ধের সময়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি নিয়মিতই নিজেদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে জ্বলাঞ্জলি দেয়। তাই সেসকল রাষ্ট্রের উপর সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপারে নির্ভরশীলতা তৈরি করাটা বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা বলাই যেতে পারে যে, বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা যদি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত রাখা না হয়, তাহলে এই রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী রাখার কোন প্রয়োজনই নেই। আর এই সামরিক বাহিনীর জন্যে বাইরে থেকে কেনা কোন অস্ত্রের উপর যদি শর্ত থাকে যে, তা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, অথবা যুদ্ধের সময়ে অস্ত্র অবরোধের মাঝে পড়তে হবে, বা স্পেয়ার পার্টস বা সফটওয়্যার আপডেট পাওয়া যাবে না, তাহলে সেই অস্ত্রের ব্যাপারে বাংলাদেশের অনীহা থাকাটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ। অন্ততঃ এটা নিশ্চিত যে, বিশাল অংক খরচ করে পশ্চিমা দেশ থেকে কেনা অত্যাধুনিক সামরিক বিমান যদি মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, বা এন্টি রাডার ক্ষেপণাস্ত্র, বা জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম না হয়, তাহলে সেগুলি শো-কেসে সাজিয়ে রাখা চকচকে খেলনা থেকে আলাদা কিছু হবে না।






সূত্রঃ




‘The Time Ecuador and Peru Fought a 34-Day War Over a Patch of Amazonian Jungle’ in Historynet, 16 June 2023 (https://www.historynet.com/cenepa-war-peru-ecuador/)

‘The Cenepa Conflict at 25: Lessons Learned' by Lt Col Oswal Sigüeñas Alvarado in Journal of the Americas, Third Edition 2021

‘Mirage vs. Sukhoi; February 10, 1995 – The Cenepa War’ in Ed Nash’s Military Matters, 20 March 2020 (https://www.youtube.com/watch?v=fKJcm7E59oU)

‘Exocet missile: how the sinking of HMS Sheffield made it famous’ in The Guardian, 15 October 2017

‘Turkey scales down $23 bln F-16 jet deal with US, minister says’ in Reuters, 27 November 2024

‘Egypt to Replace US F-16s With China’s J-10C Fighter Jets: Report’ in The Defense Post, 10 September 2024

‘Egypt has spent big on diversifying its air force, but to what end?’ in Middle East Eye, 09 September 2022

‘Egypt barred from receiving BVR missiles for F-16 and Rafale’ in Bulgarian Military, 12 September 2024 (https://bulgarianmilitary.com/2024/09/12/egypt-barred-from-receiving-bvr-missiles-for-f-16-and-rafale/)

‘Turkey’s readmission to the F-35 program must come with a cost’ by Jonathan Schanzer and Sinan Ciddi in The Hill, 26 March 2025

‘US formally removes Turkey from F-35 programme’ in TRT World (https://www.trtworld.com/turkey/us-formally-removes-turkey-from-f-35-programme-46112)

‘Canadair Sabre’ in Joe Baugher (http://joebaugher.com/usaf_fighters/p86_22.html)