মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে এসেই গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় নেয়ার কথা বলতে থাকেন। এর আগে প্রথম টার্মেও ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করার কথা বলেছিলেন। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বাস্তবতার সাথে যায় কিনা। তবে মার্চ মাস থেকেই গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত হতে শুরু করে। এখন অনেকেই ধরে নিচ্ছেন যে, ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্টই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ট্রাম্প কেন গ্রীনল্যান্ড চাইছেন?
গত ১২ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে 'টেক্সাস মিনারাল রিসোর্সেস'এর এনথনি মারচেজি বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডের পুরো উপকূল নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচাইতে বড় খনিজ সম্পদের ভান্ডারগুলির একটা। এই উপকূলের যেকোন স্থানে কেউ ঢিল ছুঁড়লেই একটা বিশ্বমানের খনির সন্ধান পাবে। 'ডয়েচে ভেলে' বলছে যে, এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডে মাত্র দু'টা খনিতে কাজ চলছে; যেখানে শ'খানেক মানুষ কাজ করে। সেখানে খনিজ আহরণ খুবই কষ্টকর। অন্য অনেক স্থানের চাইতেও এখানে খনিজ আহরণ অনেক ব্যববহুল। এখানে কোন রাস্তা নেই এবং ভূপ্রকৃতি খুবই বন্ধুর। চীনের বাইরে 'রেয়ার আর্থ' খনিজের সবচাইতে বড় উৎসগুলির একটা ২০২১ সালে গ্রীনল্যান্ড সরকার বন্ধ করে দেয়। কারণ ঐ একই সাথে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে এবং তা জনবসতির বেশ কাছাকাছি। আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে কৌশলগত সমুদ্রপথ চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; যার মাঝে একটা গিয়েছে রাশিয়ার উত্তর উপকূল ঘেঁষে; যা 'নর্দার্ন সী রুট' বা 'এনএসআর' নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টা গিয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পাশ দিয়ে কানাডার মাঝ দিয়ে; যা 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নামে পরিচিত। তৃতীয়টা গিয়েছে একেবারে উত্তর মেরুর মাঝ দিয়ে; যা 'ট্রান্স পোলার সী রুট' হিসেবে পরিচিত। এই রুটগুলি এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সমুদ্রপথকে অনেক কমিয়ে ফেলতে পারে। বর্তমানে আর্কটিক অঞ্চল দিয়ে জাহাজ পার করতে হলে আইস ব্রেকার জাহাজ লাগে; যা বেশ ব্যয়বহুল। কাজেই এখনও পর্যন্ত খনিজ আহরণ এবং সমুদ্রপথ ব্যবহার করার ব্যাপারটা ভবিষ্যতের আলোচনা। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডের জনগণের আয় শুধুমাত্র মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। একারণে ডেনমার্ক সরকার বছরে প্রায় ৫'শ মিলিয়ন ইউরো বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। তবে গ্রীনল্যান্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ডেনমার্ক শক্তিশালী দেশগুলির সাথে বড় রকমের দেনদরবার করতে পারে; যা ডেনমার্কের আকারের তুলনায় বেশি শক্তির প্রতীক।
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক টিম মার্শাল 'বিবিসি'কে বলছেন যে, এর আগেও ১৯৫০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করতে চেয়েছিল। কাজেই একটা অঞ্চল ক্রয় করার ব্যপারটা নতুন নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে ছাড়াও সামরিক দিক থেকে গ্রীনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর মেরুর উপর দিয়ে রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে কম দূরত্ব অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারে। আবার একইসাথে, রুশ সাবমেরিনের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে স্বল্প দূরতের রুট হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে। গ্রীনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলির বেশিরভাগই গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কানাডার কাছাকাছি। গ্রীনল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই সবচাইতে বেশি লাভবান হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং মাইক্রোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইরকমই একটা বোঝাপড়া মার্কিনীরা করতে পারে গ্রীনল্যান্ডের সাথে। নব্যস্বাধীন গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথমে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।
ডেনমার্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে
মার্চের শেষ সপ্তাহে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী উশা ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হবার পর গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। এই ভিজিট সম্পর্কে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, এই ভ্রমণ গ্রীনল্যান্ডের প্রয়োজন নেই এবং এটা গ্রীনল্যান্ড চাচ্ছেও না। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের উপর যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন যে, এই চাপের মুখে তারা বাধা প্রদান করবেন। হৈচৈ শুরু হবার পর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দেন যে, হৈচৈ শুরু হবার কারণে তিনি নিজেও এখন তার পরিবারের সাথে গ্রীনল্যান্ডে যাবেন। তবে তিনি বলেন যে, তার এই সফর গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন স্পেস ফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ রাডার রয়েছে; যার মাধ্যমে উত্তর মেরুর দিক থেকে ধেয়ে আসা পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা পাবে যুক্তরাষ্ট্র। 'গ্রীনল্যান্ডিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন'এর মারকাস ভ্যালেন্টিন 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর শুধুমাত্র সামরিক ঘাঁটিতে সীমাবদ্ধ করার ফলে সেখানে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এবং বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের জনগণ ভ্যান্স পরিবারের সাথে অসহযোগিতা করার পথে হেঁটেছে। সরকারিভাবে ভ্যান্সের পরিবারকে গ্রহণ না করার কথাও বলা হয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পক্ষ থেকে। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে, স্বল্প মেয়াদে হলেও তাদের প্রতিবাদ অনেকটাই সফল হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী। তবে গ্রীনল্যান্ডের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করতে ইচ্ছুক। 'বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আপাততঃ গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীরা একটা ছোট জয় পেয়েছে বলে মনে হলেও আসন্ন দিনগুলিতে গ্রীনল্যান্ডের উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডে ৭৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এই ঘাঁটিকে যতটা ইচ্ছা বৃদ্ধি করতে পারবে। তাহলে এখানে সমস্যাটা কোথায়, তা স্পষ্ট নয়। গ্রীনল্যান্ডের জনগণও হয়তো ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে চাইবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সবকিছু অতি দ্রুত চাইছে।
তবে ২৯শে মার্চ গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সফরের সময় জেডি ভ্যান্স এক ভাষণে ডেনমার্ক সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, ডেনমার্কের প্রতি তার বার্তা খুবই পরিষ্কার – গ্রীনল্যান্ডের জনগণের জন্যে ডেনমার্ক যথেষ্ট বিনিয়োগ করেনি এবং গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও ডেনমার্ক কিছু করেনি। তিনি বলেন যে, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্ক গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীদের সাথে নয়; বরং তা হলো ডেনমার্কের নেতৃত্বের সাথে; যারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। ভ্যান্স এমন এক সময়ে গ্রীনল্যান্ড সফর করেছেন, যখন গ্রীনল্যান্ডের সরকার পরিবর্তন হচ্ছিলো। ভ্যান্সের সফরের পরপরই নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জেন্স ফ্রেডেরিক নিয়েলসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, সরকার পরিবর্তনের এমন এক সময়ে ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর করতে আসাটা একটা বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের প্রতি অসন্মান দেখানো। এটা একটা লজ্জাজনক অধ্যায় ছিল।
ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফরের একই দিন, ২৯শে মার্চ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অতি প্রয়োজন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে নয়; সারা দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি চীনা এবং রুশ জাহাজে ভরে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্ক বা অন্য কারুর উপর এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ভার ছেড়ে দিতে পারে না। এক'শ বছর আগেও গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি খোলা ছিল না। কিন্তু এখন আইসব্রেকার জাহাজের মাধ্যমে গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশে দিয়ে রাশিয়া এবং চীনে যাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, তার আশা ডেনমার্ক এটা বুঝতে পারছে এবং ইইউও এটা বুঝতে পারছে। আর না বুঝতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে বোঝাবে। দু'দিন পর ৩১শে মার্চ এক ভিডিও বার্তায় ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন বলেন যে, ডেনমার্ক সরকার সমালোচনা পছন্দ করে; তবে যে ভাষায় মার্কিনীরা কথা বলছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে কেউ কাছের বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে কথা বলে না। তিনি বলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনও ডেনমার্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কাছের বন্ধু হিসেবেই দেখেন। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডে তার সামরিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারে। ১৯৪৫ সালে গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টা সামরিক ঘাঁটি ছিল এবং কয়েক হাজার সেনা সেখানে মোতায়েন ছিল। বর্তমানে একটা ঘাঁটিতে মাত্র ২'শ সেনা রয়েছে। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী একত্রে অনেক কিছুই করা সম্ভব। একসময় শুধু ডেনমার্ক নয়, সকলেই মনে করেছিল যে, আর্কটিকে কোন নিরাপত্তা হুমকি নেই। বর্তমানে পরিস্থতি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। একারণেই কিছুদিন আগেই ডেনমার্ক আর্কটিকের নিরাপত্তায় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ভুলে গেলে চলবে না যে, গ্রীনল্যান্ড ন্যাটোর অংশ এবং ন্যাটোর নিরাপত্তার মাঝে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তাও রয়েছে।
৩রা এপ্রিল ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা নেবে না। গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা হলো গ্রীনল্যান্ডবাসীর। গ্রীনল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব, সীমানা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে সকলকে একত্রিত থাকতে হবে; সেটা ডেনমার্ক এবং গ্রীনল্যান্ডের মাঝে যে আলোচনাই হোক না কেন। তিনি বলেন যে, তার ধারণা এখন পর্যন্ত তারা কাজটা ঠিকমতোই করতে পেরেছেন; তবে এটা পরিষ্কার যে, তাদেরকে খোলা জানালাগুলিকে আরও ভালোভাবে আটকাতে হবে। এটা পরিষ্কার যে, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী গ্রীনল্যান্ডবাসীদের মতামতকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের পক্ষে আনতে পারেননি। আর ৪ঠা এপ্রিল ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিওর সাথে আলোচনার পর সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি রুবিওকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং তা ডেনমার্কের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ।
যুক্তরাষ্ট্র কি গ্রীনল্যান্ডকে আলাদা করতে চায়, নাকি দখল করতে চায়?
'জার্মান মার্শাল ফান্ড'এর ফেলো সোফি আর্টস 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের বক্তব্য সঠিক নয়। ডেনমার্ক সরকার গ্রীনল্যান্ডের বাজেটের অর্ধেকের বেশি দিয়ে থাকে। এর বাইরেও রয়েছে প্রতিরক্ষা সহায়তা; যা ডেনমার্ক তার বন্ধুপ্রতীম দেশগুলির সাথে একত্রে দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের হুমকির পর গ্রীনল্যান্ড ও আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার জন্যে ২ বিলিয়ন ডলার খরচের ঘোষণা দিয়েছে ডেনমার্ক। এটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যে বর্তমানের ১০ গুণ বেশি খরচ। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রীনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে নয়। এটা গ্রীনল্যান্ডের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি সুবিধা দেয়। তবে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার সাথে পুরো আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা জড়িত। এখানে ন্যাটো জোটের স্বার্থ জড়িত। জোটকে ছোট করে এখানে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে ডেনমার্ক মার্কিনীদের সাথে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং গ্রীনল্যান্ডকে ডেনমার্ক থেকে আলাদা করার কথাও শোনা যাচ্ছে।
‘এএফপি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্ক থেকে পুরোপুরিভাবে আলাদা হবার চেষ্টা করছে। গ্রীনল্যান্ডবাসীদের একটা প্রধান অভিযোগ হলো, ডেনমার্ক সরকার ঐতিহাসিকভাবেই গ্রীনল্যান্ডের ইনুইট আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে দমন করেছে। আদিবাসীদেরকে জোর করে বন্ধাত্ব বরণ করিয়েছে এবং তাদের সন্তানদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে গেছে ডেনমার্ক সরকার। গ্রীনল্যান্ডে অনেকেই মনে করেন যে, ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডবাসীদেরকে নিচু জাতের নাগরিক হিসেবে দেখে। তবে তারা মনে করে না যে, তাদের ভূমি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি হবার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের প্রায় সকল জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও ট্রাম্পের পরিকল্পনার পক্ষে খুব কমই রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, খুব দ্রুত ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। 'ডয়েচে ভেলে' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৭২১ সালে ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এরপর দু'শ বছর ধরে ইনুইট জাতির উপর খ্রিস্টান ধর্ম এবং ড্যানিস ভাষা চাপানো হয়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই গ্রীনল্যান্ডে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করা হতে থাকে। একসময় গ্রীনল্যান্ডকে নিজস্ব পার্লামেন্ট এবং সরকার দেয়া হয়। বর্তমানে গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে একটা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি গ্রীনল্যান্ড নিজে নিয়ন্ত্রণ করলেও নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতি দেখাশোনা করে ডেনমার্ক। গ্রীনল্যান্ডের সরকার বলছে যে, কোন একটা সময় তারা ডেনমার্ক থেকে আলাদা হবার লক্ষ্যেই এগুচ্ছে। ৮৪ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ড তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে তাদের অফিস খুলেছে। তারা খনিজ সম্পদ আহরণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউএর সাথেও সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ গ্রীনল্যান্ডের অর্থনীতিতে অনেকেই অংশীদার হতে চাইছে। একারণেই ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডের ইস্যুকে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে রেখেছে।
প্রাক্তন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা ফিলিপ ইনগ্রাম ব্রিটিশ মিডিয়া 'দ্যা সান'কে বলছেন যে, গ্রীনল্যান্ডের কোন সামরিক বাহিনী নেই। যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যেকোন দিন সেখানে হেঁটে ঢুকে যেতে পারে। তবে এর ভূরাজনৈতিক ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। তার ধারণা, গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই কানাডার সাথে যুক্ত। ট্রাম্প সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীনল্যান্ড, কানাডা এবং পানামা নিয়ে যখন কথা বলেছেন, তখন সর্বদাই তিনি সমুদ্রপথের প্রসঙ্গ এনেছেন। অর্থাৎ তিনি এই অঞ্চলগুলিকে সমুদ্রবাণিজ্য এবং লজিস্টিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। ন্যাটোর সদস্য দেশ কানাডা এখনও পর্যন্ত তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষার পিছনে খরচ করছে না। এবং 'ফাইভ আইজ' ইন্টেলিজেন্স সমঝোতার মাঝে কানাডাকে দুর্বল সদস্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। খুব সম্ভবতঃ ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডকে হুমকির মাঝে রেখে কানাডার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। কানাডার উপর বাণিজ্যিক শুল্ক আরোপের ব্যাপারটাও খুব সম্ভবতঃ একই সূত্রে গাঁথা।
ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া 'বিএফবিএস ফোর্সেস নিউজ'এর এক আলোচনায় ব্রিটিশ সামরিক চিন্তাবিদ ক্যারোলাইন কেনেডি-পাইপ বলছেন যে, মূলতঃ ২০১৭-১৮ সালের দিকে চীনারা যখন গ্রীনল্যান্ডে বিমানবন্দরের রানওয়ে তৈরি করতে ইচ্ছুক হয়, তখনই মার্কিনীরা এবং ড্যানিশরা নড়েচড়ে বসে। দুই দেশের প্রতিরোধের মুখে চীনা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডার একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। এটাও গ্রীনল্যান্ডের হিসেবে মাঝে নিতে হবে। কানাডা এখনও পর্যন্ত আর্কটিকে তাদের সক্ষমতার অনেক নিচে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারাও তড়িঘড়ি করে আর্কটিক নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা উভয়েই আর্কটিককে রাশিয়ার চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেছে। নরওয়ের ডিফেন্স কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের প্রফেসর টরমড হাইয়ার বলছেন যে, আর্কটিকে নরওয়ের অধীনে থাকা সুয়ালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে; যা কিনা গ্রীনল্যান্ডের সমান্তরালে দরকষাকষির অংশ হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী এই দ্বীপপুঞ্জকে বাণিজ্যিকভাবে সকলের জন্যে খোলা রাখা হলেও এর সার্বভৌমত্বকে নরওয়ের অধীনে দেয়া হয়; যা এখন রুশরা প্রশ্ন করছে। এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে ন্যাটো রুশ সাবমেরিনের উপর নজরদারি করে। ইতোমধ্যেই সেখানে রুশ এবং চীনারা গবেষণা কাজ চালাবার জন্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে অঞ্চল কেনাবেচা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল ক্রয় করা; যার মাঝে রয়েছে লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আলাস্কা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্রের বিনিময়ে ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ পেয়ে যায়। তাই আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যেতে থাকায় গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় অবাক হবার কিছু নেই। ডেনমার্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের অধীন অঞ্চল দখল করে নিতে চাইছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত বিশ্বব্যবস্থা এখন যে আর নেই, তার আরেকটা প্রমাণ এটা। অপরদিকে এই ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইইউ, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন কানাডার প্রতিদ্বন্দ্বিতা; যা কিনা বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ।