Friday, 4 April 2025

ট্রাম্পের গ্রীনল্যান্ড চাই – এটাই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা

০৫ই এপ্রিল ২০২৫

ডেনমার্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের অধীন অঞ্চল দখল করে নিতে চাইছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত বিশ্বব্যবস্থা এখন যে আর নেই, তার আরেকটা প্রমাণ এটা। অপরদিকে এই ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইইউ, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন কানাডার প্রতিদ্বন্দ্বিতা; যা কিনা বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ। 


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে এসেই গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় নেয়ার কথা বলতে থাকেন। এর আগে প্রথম টার্মেও ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করার কথা বলেছিলেন। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বাস্তবতার সাথে যায় কিনা। তবে মার্চ মাস থেকেই গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত হতে শুরু করে। এখন অনেকেই ধরে নিচ্ছেন যে, ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্টই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ট্রাম্প কেন গ্রীনল্যান্ড চাইছেন?

গত ১২ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে 'টেক্সাস মিনারাল রিসোর্সেস'এর এনথনি মারচেজি বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডের পুরো উপকূল নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচাইতে বড় খনিজ সম্পদের ভান্ডারগুলির একটা। এই উপকূলের যেকোন স্থানে কেউ ঢিল ছুঁড়লেই একটা বিশ্বমানের খনির সন্ধান পাবে। 'ডয়েচে ভেলে' বলছে যে, এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডে মাত্র দু'টা খনিতে কাজ চলছে; যেখানে শ'খানেক মানুষ কাজ করে। সেখানে খনিজ আহরণ খুবই কষ্টকর। অন্য অনেক স্থানের চাইতেও এখানে খনিজ আহরণ অনেক ব্যববহুল। এখানে কোন রাস্তা নেই এবং ভূপ্রকৃতি খুবই বন্ধুর। চীনের বাইরে 'রেয়ার আর্থ' খনিজের সবচাইতে বড় উৎসগুলির একটা ২০২১ সালে গ্রীনল্যান্ড সরকার বন্ধ করে দেয়। কারণ ঐ একই সাথে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে এবং তা জনবসতির বেশ কাছাকাছি। আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে কৌশলগত সমুদ্রপথ চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; যার মাঝে একটা গিয়েছে রাশিয়ার উত্তর উপকূল ঘেঁষে; যা 'নর্দার্ন সী রুট' বা 'এনএসআর' নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টা গিয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পাশ দিয়ে কানাডার মাঝ দিয়ে; যা 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নামে পরিচিত। তৃতীয়টা গিয়েছে একেবারে উত্তর মেরুর মাঝ দিয়ে; যা 'ট্রান্স পোলার সী রুট' হিসেবে পরিচিত। এই রুটগুলি এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সমুদ্রপথকে অনেক কমিয়ে ফেলতে পারে। বর্তমানে আর্কটিক অঞ্চল দিয়ে জাহাজ পার করতে হলে আইস ব্রেকার জাহাজ লাগে; যা বেশ ব্যয়বহুল। কাজেই এখনও পর্যন্ত খনিজ আহরণ এবং সমুদ্রপথ ব্যবহার করার ব্যাপারটা ভবিষ্যতের আলোচনা। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ডের জনগণের আয় শুধুমাত্র মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। একারণে ডেনমার্ক সরকার বছরে প্রায় ৫'শ মিলিয়ন ইউরো বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। তবে গ্রীনল্যান্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ডেনমার্ক শক্তিশালী দেশগুলির সাথে বড় রকমের দেনদরবার করতে পারে; যা ডেনমার্কের আকারের তুলনায় বেশি শক্তির প্রতীক।

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক টিম মার্শাল 'বিবিসি'কে বলছেন যে, এর আগেও ১৯৫০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করতে চেয়েছিল। কাজেই একটা অঞ্চল ক্রয় করার ব্যপারটা নতুন নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে ছাড়াও সামরিক দিক থেকে গ্রীনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর মেরুর উপর দিয়ে রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে কম দূরত্ব অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারে। আবার একইসাথে, রুশ সাবমেরিনের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে স্বল্প দূরতের রুট হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে। গ্রীনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলির বেশিরভাগই গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কানাডার কাছাকাছি। গ্রীনল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই সবচাইতে বেশি লাভবান হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং মাইক্রোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইরকমই একটা বোঝাপড়া মার্কিনীরা করতে পারে গ্রীনল্যান্ডের সাথে। নব্যস্বাধীন গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথমে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।
 
আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে কৌশলগত সমুদ্রপথ চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; যার মাঝে একটা গিয়েছে রাশিয়ার উত্তর উপকূল ঘেঁষে; যা 'নর্দার্ন সী রুট' বা 'এনএসআর' নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টা গিয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পাশ দিয়ে কানাডার মাঝ দিয়ে; যা 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নামে পরিচিত। তৃতীয়টা গিয়েছে একেবারে উত্তর মেরুর মাঝ দিয়ে; যা 'ট্রান্স পোলার সী রুট' হিসেবে পরিচিত। এই রুটগুলি এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সমুদ্রপথকে অনেক কমিয়ে ফেলতে পারে।


ডেনমার্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে

মার্চের শেষ সপ্তাহে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী উশা ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হবার পর গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। এই ভিজিট সম্পর্কে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, এই ভ্রমণ গ্রীনল্যান্ডের প্রয়োজন নেই এবং এটা গ্রীনল্যান্ড চাচ্ছেও না। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের উপর যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন যে, এই চাপের মুখে তারা বাধা প্রদান করবেন। হৈচৈ শুরু হবার পর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দেন যে, হৈচৈ শুরু হবার কারণে তিনি নিজেও এখন তার পরিবারের সাথে গ্রীনল্যান্ডে যাবেন। তবে তিনি বলেন যে, তার এই সফর গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন স্পেস ফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ রাডার রয়েছে; যার মাধ্যমে উত্তর মেরুর দিক থেকে ধেয়ে আসা পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা পাবে যুক্তরাষ্ট্র। 'গ্রীনল্যান্ডিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন'এর মারকাস ভ্যালেন্টিন 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর শুধুমাত্র সামরিক ঘাঁটিতে সীমাবদ্ধ করার ফলে সেখানে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এবং বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের জনগণ ভ্যান্স পরিবারের সাথে অসহযোগিতা করার পথে হেঁটেছে। সরকারিভাবে ভ্যান্সের পরিবারকে গ্রহণ না করার কথাও বলা হয়েছে গ্রীনল্যান্ডের পক্ষ থেকে। গ্রীনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে, স্বল্প মেয়াদে হলেও তাদের প্রতিবাদ অনেকটাই সফল হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডের স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী। তবে গ্রীনল্যান্ডের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করতে ইচ্ছুক। 'বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আপাততঃ গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীরা একটা ছোট জয় পেয়েছে বলে মনে হলেও আসন্ন দিনগুলিতে গ্রীনল্যান্ডের উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডে ৭৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এই ঘাঁটিকে যতটা ইচ্ছা বৃদ্ধি করতে পারবে। তাহলে এখানে সমস্যাটা কোথায়, তা স্পষ্ট নয়। গ্রীনল্যান্ডের জনগণও হয়তো ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে চাইবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সবকিছু অতি দ্রুত চাইছে।

তবে ২৯শে মার্চ গ্রীনল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সফরের সময় জেডি ভ্যান্স এক ভাষণে ডেনমার্ক সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, ডেনমার্কের প্রতি তার বার্তা খুবই পরিষ্কার – গ্রীনল্যান্ডের জনগণের জন্যে ডেনমার্ক যথেষ্ট বিনিয়োগ করেনি এবং গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও ডেনমার্ক কিছু করেনি। তিনি বলেন যে, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্ক গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীদের সাথে নয়; বরং তা হলো ডেনমার্কের নেতৃত্বের সাথে; যারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। ভ্যান্স এমন এক সময়ে গ্রীনল্যান্ড সফর করেছেন, যখন গ্রীনল্যান্ডের সরকার পরিবর্তন হচ্ছিলো। ভ্যান্সের সফরের পরপরই নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জেন্স ফ্রেডেরিক নিয়েলসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, সরকার পরিবর্তনের এমন এক সময়ে ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফর করতে আসাটা একটা বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের প্রতি অসন্মান দেখানো। এটা একটা লজ্জাজনক অধ্যায় ছিল।
 
গ্রীনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলির বেশিরভাগই গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কানাডার কাছাকাছি। গ্রীনল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই সবচাইতে বেশি লাভবান হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এবং মাইক্রোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইরকমই একটা বোঝাপড়া মার্কিনীরা করতে পারে গ্রীনল্যান্ডের সাথে। নব্যস্বাধীন গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রথমে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।


ভ্যান্সের গ্রীনল্যান্ড সফরের একই দিন, ২৯শে মার্চ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন যে, গ্রীনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অতি প্রয়োজন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে নয়; সারা দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি চীনা এবং রুশ জাহাজে ভরে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্ক বা অন্য কারুর উপর এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ভার ছেড়ে দিতে পারে না। এক'শ বছর আগেও গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশের সমুদ্রপথগুলি খোলা ছিল না। কিন্তু এখন আইসব্রেকার জাহাজের মাধ্যমে গ্রীনল্যান্ডের আশেপাশে দিয়ে রাশিয়া এবং চীনে যাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, তার আশা ডেনমার্ক এটা বুঝতে পারছে এবং ইইউও এটা বুঝতে পারছে। আর না বুঝতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে বোঝাবে। দু'দিন পর ৩১শে মার্চ এক ভিডিও বার্তায় ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন বলেন যে, ডেনমার্ক সরকার সমালোচনা পছন্দ করে; তবে যে ভাষায় মার্কিনীরা কথা বলছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে কেউ কাছের বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে কথা বলে না। তিনি বলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনও ডেনমার্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কাছের বন্ধু হিসেবেই দেখেন। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডে তার সামরিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারে। ১৯৪৫ সালে গ্রীনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টা সামরিক ঘাঁটি ছিল এবং কয়েক হাজার সেনা সেখানে মোতায়েন ছিল। বর্তমানে একটা ঘাঁটিতে মাত্র ২'শ সেনা রয়েছে। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী একত্রে অনেক কিছুই করা সম্ভব। একসময় শুধু ডেনমার্ক নয়, সকলেই মনে করেছিল যে, আর্কটিকে কোন নিরাপত্তা হুমকি নেই। বর্তমানে পরিস্থতি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। একারণেই কিছুদিন আগেই ডেনমার্ক আর্কটিকের নিরাপত্তায় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ভুলে গেলে চলবে না যে, গ্রীনল্যান্ড ন্যাটোর অংশ এবং ন্যাটোর নিরাপত্তার মাঝে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তাও রয়েছে।

৩রা এপ্রিল ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা নেবে না। গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা হলো গ্রীনল্যান্ডবাসীর। গ্রীনল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব, সীমানা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে সকলকে একত্রিত থাকতে হবে; সেটা ডেনমার্ক এবং গ্রীনল্যান্ডের মাঝে যে আলোচনাই হোক না কেন। তিনি বলেন যে, তার ধারণা এখন পর্যন্ত তারা কাজটা ঠিকমতোই করতে পেরেছেন; তবে এটা পরিষ্কার যে, তাদেরকে খোলা জানালাগুলিকে আরও ভালোভাবে আটকাতে হবে। এটা পরিষ্কার যে, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী গ্রীনল্যান্ডবাসীদের মতামতকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের পক্ষে আনতে পারেননি। আর ৪ঠা এপ্রিল ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লারস লোকি রাসমুসেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিওর সাথে আলোচনার পর সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি রুবিওকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং তা ডেনমার্কের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ।
 
উত্তর মেরুর উপর দিয়ে রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে কম দূরত্ব অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারে। আবার একইসাথে, রুশ সাবমেরিনের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে স্বল্প দূরতের রুট হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রীনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে নয়। এটা গ্রীনল্যান্ডের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি সুবিধা দেয়। 


যুক্তরাষ্ট্র কি গ্রীনল্যান্ডকে আলাদা করতে চায়, নাকি দখল করতে চায়?

'জার্মান মার্শাল ফান্ড'এর ফেলো সোফি আর্টস 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্সের বক্তব্য সঠিক নয়। ডেনমার্ক সরকার গ্রীনল্যান্ডের বাজেটের অর্ধেকের বেশি দিয়ে থাকে। এর বাইরেও রয়েছে প্রতিরক্ষা সহায়তা; যা ডেনমার্ক তার বন্ধুপ্রতীম দেশগুলির সাথে একত্রে দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের হুমকির পর গ্রীনল্যান্ড ও আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার জন্যে ২ বিলিয়ন ডলার খরচের ঘোষণা দিয়েছে ডেনমার্ক। এটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যে বর্তমানের ১০ গুণ বেশি খরচ। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রীনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে নয়। এটা গ্রীনল্যান্ডের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি সুবিধা দেয়। তবে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তার সাথে পুরো আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা জড়িত। এখানে ন্যাটো জোটের স্বার্থ জড়িত। জোটকে ছোট করে এখানে গ্রীনল্যান্ডের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে ডেনমার্ক মার্কিনীদের সাথে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং গ্রীনল্যান্ডকে ডেনমার্ক থেকে আলাদা করার কথাও শোনা যাচ্ছে।

‘এএফপি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্ক থেকে পুরোপুরিভাবে আলাদা হবার চেষ্টা করছে। গ্রীনল্যান্ডবাসীদের একটা প্রধান অভিযোগ হলো, ডেনমার্ক সরকার ঐতিহাসিকভাবেই গ্রীনল্যান্ডের ইনুইট আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে দমন করেছে। আদিবাসীদেরকে জোর করে বন্ধাত্ব বরণ করিয়েছে এবং তাদের সন্তানদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে গেছে ডেনমার্ক সরকার। গ্রীনল্যান্ডে অনেকেই মনে করেন যে, ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডবাসীদেরকে নিচু জাতের নাগরিক হিসেবে দেখে। তবে তারা মনে করে না যে, তাদের ভূমি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি হবার জন্যে। গ্রীনল্যান্ডের প্রায় সকল জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও ট্রাম্পের পরিকল্পনার পক্ষে খুব কমই রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, খুব দ্রুত ডেনমার্ক থেকে আলাদা হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। 'ডয়েচে ভেলে' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৭২১ সালে ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এরপর দু'শ বছর ধরে ইনুইট জাতির উপর খ্রিস্টান ধর্ম এবং ড্যানিস ভাষা চাপানো হয়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই গ্রীনল্যান্ডে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করা হতে থাকে। একসময় গ্রীনল্যান্ডকে নিজস্ব পার্লামেন্ট এবং সরকার দেয়া হয়। বর্তমানে গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে একটা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি গ্রীনল্যান্ড নিজে নিয়ন্ত্রণ করলেও নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতি দেখাশোনা করে ডেনমার্ক। গ্রীনল্যান্ডের সরকার বলছে যে, কোন একটা সময় তারা ডেনমার্ক থেকে আলাদা হবার লক্ষ্যেই এগুচ্ছে। ৮৪ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে। এই মুহুর্তে গ্রীনল্যান্ড তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে তাদের অফিস খুলেছে। তারা খনিজ সম্পদ আহরণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউএর সাথেও সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ গ্রীনল্যান্ডের অর্থনীতিতে অনেকেই অংশীদার হতে চাইছে। একারণেই ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডের ইস্যুকে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে রেখেছে।
 
মার্চ ২০২৫। মার্কিন সেনাদের সাথে গ্রীনল্যান্ডের সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে অঞ্চল কেনাবেচা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল ক্রয় করা; যার মাঝে রয়েছে লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আলাস্কা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্রের বিনিময়ে ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ পেয়ে যায়। তাই আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যেতে থাকায় গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় অবাক হবার কিছু নেই। 


প্রাক্তন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা ফিলিপ ইনগ্রাম ব্রিটিশ মিডিয়া 'দ্যা সান'কে বলছেন যে, গ্রীনল্যান্ডের কোন সামরিক বাহিনী নেই। যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যেকোন দিন সেখানে হেঁটে ঢুকে যেতে পারে। তবে এর ভূরাজনৈতিক ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। তার ধারণা, গ্রীনল্যান্ডের ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই কানাডার সাথে যুক্ত। ট্রাম্প সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীনল্যান্ড, কানাডা এবং পানামা নিয়ে যখন কথা বলেছেন, তখন সর্বদাই তিনি সমুদ্রপথের প্রসঙ্গ এনেছেন। অর্থাৎ তিনি এই অঞ্চলগুলিকে সমুদ্রবাণিজ্য এবং লজিস্টিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। ন্যাটোর সদস্য দেশ কানাডা এখনও পর্যন্ত তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষার পিছনে খরচ করছে না। এবং 'ফাইভ আইজ' ইন্টেলিজেন্স সমঝোতার মাঝে কানাডাকে দুর্বল সদস্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। খুব সম্ভবতঃ ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ডকে হুমকির মাঝে রেখে কানাডার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। কানাডার উপর বাণিজ্যিক শুল্ক আরোপের ব্যাপারটাও খুব সম্ভবতঃ একই সূত্রে গাঁথা।

ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া 'বিএফবিএস ফোর্সেস নিউজ'এর এক আলোচনায় ব্রিটিশ সামরিক চিন্তাবিদ ক্যারোলাইন কেনেডি-পাইপ বলছেন যে, মূলতঃ ২০১৭-১৮ সালের দিকে চীনারা যখন গ্রীনল্যান্ডে বিমানবন্দরের রানওয়ে তৈরি করতে ইচ্ছুক হয়, তখনই মার্কিনীরা এবং ড্যানিশরা নড়েচড়ে বসে। দুই দেশের প্রতিরোধের মুখে চীনা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও 'নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ' নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডার একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। এটাও গ্রীনল্যান্ডের হিসেবে মাঝে নিতে হবে। কানাডা এখনও পর্যন্ত আর্কটিকে তাদের সক্ষমতার অনেক নিচে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারাও তড়িঘড়ি করে আর্কটিক নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা উভয়েই আর্কটিককে রাশিয়ার চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেছে। নরওয়ের ডিফেন্স কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের প্রফেসর টরমড হাইয়ার বলছেন যে, আর্কটিকে নরওয়ের অধীনে থাকা সুয়ালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে; যা কিনা গ্রীনল্যান্ডের সমান্তরালে দরকষাকষির অংশ হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী এই দ্বীপপুঞ্জকে বাণিজ্যিকভাবে সকলের জন্যে খোলা রাখা হলেও এর সার্বভৌমত্বকে নরওয়ের অধীনে দেয়া হয়; যা এখন রুশরা প্রশ্ন করছে। এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে ন্যাটো রুশ সাবমেরিনের উপর নজরদারি করে। ইতোমধ্যেই সেখানে রুশ এবং চীনারা গবেষণা কাজ চালাবার জন্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে অঞ্চল কেনাবেচা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল ক্রয় করা; যার মাঝে রয়েছে লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আলাস্কা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ত্রের বিনিময়ে ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ পেয়ে যায়। তাই আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যেতে থাকায় গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় অবাক হবার কিছু নেই। ডেনমার্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্কের অধীন অঞ্চল দখল করে নিতে চাইছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত বিশ্বব্যবস্থা এখন যে আর নেই, তার আরেকটা প্রমাণ এটা। অপরদিকে এই ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইইউ, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন কানাডার প্রতিদ্বন্দ্বিতা; যা কিনা বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ।

Friday, 28 March 2025

যুদ্ধাস্ত্রের ব্যাপারে অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা সার্বভৌমত্বকে হুমকিতে ফেলতে পারে

২৮শে মার্চ ২০২৫

পেরু বিমান বাহিনীর ফরাসি নির্মিত 'মিরাজ-২০০০পি' যুদ্ধবিমান। ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে ১৯৯৫ সালের সেনেপা যুদ্ধে পেরু এই বিমানগুলিকে এয়ারবোর্ন রাডার হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া তেমন কোন কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ ফরাসিরা এই বিমানের সাথে মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে রাজি ছিল না। অস্ত্র নির্মাতা রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বয় না হলে যুদ্ধের দিন সরঞ্জামের রেডিনেসের সমস্যা হতে পারে।


সেনেপা যুদ্ধ – পেরু বনাম ইকুয়েডর

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এবং ইকুয়েডর। পেরুর জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লক্ষ এবং ইকুয়েডরের জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ। আয়তনের দিক থেকেও পেরু অনেক বড় দেশ; ১৩ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ বনাম ৩ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ। বর্তমানে পেরুর জিডিপি (২৭০ বিলিয়ন ডলার) ইকুয়েডরের চাইতে (১২০ বিলিয়ন ডলার) অনেক বড় হলেও ১৯৮০এর দশকে একেবারে সমান ছিল। এই দুই দেশের মাঝে বহু আগে থেকেই সীমানা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সেনেপা নামে গভীর অরণ্যের পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ৭০কিঃমিঃএর মতো অঞ্চলে সীমানা নির্ধারণে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল। ১৯৪০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় এই দ্বন্দ্ব কিছুটা কাটলেও ১৯৫০এর দশকে ইকুয়েডরের পার্লামেন্টে সেই সীমানাকে স্বীকৃতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সমস্যা আবারও জেঁকে বসে ১৯৮১ সালে; যখন ইকুয়েডর সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে গোপনে এই দুর্গম অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তবে সামরিক দিক থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী পেরু খুব সহজেই ইকুয়েডরের সেনাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে সেনেপা অঞ্চলের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মূলতঃ এই অঞ্চলের ইকুয়েডর প্রান্তে স্বর্ণ এবং তামার খনির সন্ধান পাবার কারণে ইকুয়েডর এই অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছিল। ১৯৮১ সালের অপমান ইকুয়েডর ভোলেনি। ১৯৮৮ সাল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলি দেশেই অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। ইকুয়েডর সুযোগ খোঁজে। অর্থনৈতিক চাপে পেরু তার সামরিক বাজেট কমিয়ে ফেলে। তাদের বিমান বাহিনীতে ১২টা ফরাসি নির্মিত অত্যাধুনিক 'মিরাজ-২০০০পি' বিমান ছাড়াও ছিল ১৫টা সুপারসনিক 'মিরাজ-৫পি' ফাইটার (১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনাকে ১০টা দিয়ে দেয়ার পর), ৩৪টা সোভিয়েত 'সুখোই-২২' সুপারসনিক বোমারু বিমান, ১৫টা ব্রিটিশ 'ক্যানবেরা' মধ্যম পাল্লার বোমারু বিমান, ২৪টা মার্কিন নির্মিত 'এ-৩৭বি' হাল্কা এটাক বিমান এবং ১৫টা সোভিয়েত নির্মিত 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। কাগজে কলমে এটা ছিল দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে শক্তিশালী বিমান বাহিনী। কিন্তু সমস্যা হলো, বাজেট না থাকায় স্পেয়ার পার্টসের অভাবে পেরুর বিমান বাহিনীর মাত্র ৩টা 'মিরাজ-২০০০পি', ৭টা 'সুখোই-২২', ৪টা 'ক্যানবেরা', ৮টা 'এ-৩৭বি' বিমান এবং মাত্র ৫টা সোভিয়েত নির্মিত 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার অপারেশনাল ছিল। তাদের ২০টা বিমান প্রতিরক্ষা রাডারের মাঝে মাত্র ৮টা অপারেশনাল ছিল। এছাড়াও মধ্যম পাল্লার সোভিয়েত নির্মিত ৬টা 'এসএ-৩' আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (১১৬টা ক্ষেপণাস্ত্র), ১২৫টা 'এসএ-৭' ও ১১০টা 'এসএ-১৬' স্বল্পপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে মাত্র ২০ শতাংশ অপারেশনাল ছিল। এছাড়াও তাদের বহরে ১২৪টা সোভিয়েত নির্মিত ২৩মিঃমিঃ বিমান প্রতিরক্ষা কামানও ছিল; তবে সেগুলিকে হেলিকপ্টারে করে বহণ করে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাবার মতো সক্ষমতা পেরুর ছিল না। এই অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হলেও তা যুদ্ধের এক মাসের মাঝে পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়নি। একারণে ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সেনেপা যুদ্ধে পেরুর বিমান বাহিনীর অত্যাধুনিক 'মিরাজ-২০০০' এবং 'মিরাজ-৫' বিমানগুলি একবারের জন্যেও ইকুয়েডরের বিমানগুলিকে বাধা দিতে পারেনি। অপরদিকে ইকুয়েডরের 'মিরাজ-এফ১' এবং ইস্রাইলের তৈরি 'কেফির সি২' সুপারসনিক বিমানগুলি পেরুর কয়েকটা বিমান ভূপাতিত করে ফেলে। বাজে অর্থনৈতিক অবস্থা স্বল্প সময়ের জন্যে পেরুর সাথে ইকুয়েডরের সামরিক সক্ষমতার সমতা তৈরি করেছিল। পেরুর প্রায় ১০টার মতো 'মিরাজ-এফ১' এবং ১০টার মতো 'কেফির সি২' বিমান অপারেশনাল ছিল; যা যুদ্ধের ফলাফল তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছিল। তাদের বিমান বাহিনীর সবচাইতে আধুনিক ব্রিটিশ 'জাগুয়ার' বোমারু বিমানকে ব্যবহার করারই দরকার হয়নি। এবারে আবারও যখন যুদ্ধবিরতি হয় এবং সকলে আলোচনার টেবিলে বসে, তখন ইকুয়েডর সেনেপা অঞ্চল থেকে তার সেনা সরিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয় ঠিকই, কিন্তু খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ অঞ্চলটা তাদের নামে নিশ্চিতভাবে লিখিয়ে নেয়। এই অঞ্চলে কানাডার একটা কোম্পানি স্বর্ণের খনি ডেভেলপ করেছে এবং একটা চীনা কোম্পানি তামার খনি ডেভেলপ করেছে। অর্থাৎ ইকুয়েডর যা চেয়েছিল, সেটাই পেয়েছে।

স্বল্প সময়ের সেনেপা যুদ্ধ যে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেয় তা হলো, একটা রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই তার প্রতিরক্ষাকে হাল্কাভাবে নিতে পারে না। এটা স্বার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। যুদ্ধ শেষ হবার সাথেসাথেই পেরু রাশিয়া থেকে 'মিগ-২৯' এবং 'সুখোই-২৫' যুদ্ধবিমান কেনে। ২০০১ সালেই পেরু 'মিগ-২৯' যুদ্ধবিমানগুলিকে আপগ্রেড করে মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য 'আর-৭৭' রাডার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র বহণের উপযোগী করে নেয়। তাদের অতি দামী 'মিরাজ-২০০০পি' ফাইটারগুলি এয়ারবোর্ন রাডার ছাড়া খুব বেশি একটা কাজে আসেনি। এই বিমানগুলি একবারের জন্যেও ইকুয়েডরের বিমানগুলিকে বাধা দিতে পারেনি। সেগুলিতে বহণ করার জন্যে মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও ফরাসিরা পেরুকে দিতে রাজি হয়নি।
 
ইকুয়েডর বিমান বাহিনীর 'মিরাজ-এফ১' যুদ্ধবিমান। পেরুর প্রায় ১০টার মতো 'মিরাজ-এফ১' এবং ১০টার মতো 'কেফির সি২' বিমান অপারেশনাল ছিল; যা যুদ্ধের ফলাফল তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছিল। বাজে অর্থনৈতিক অবস্থা স্বল্প সময়ের জন্যে পেরুর সাথে ইকুয়েডরের সামরিক সক্ষমতার সমতা তৈরি করেছিল। কোন একটা সময় একটা রাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের উপরে কোন নিয়ন্ত্রণ চলে আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স সেটার উপর নজরদারি করবে এবং প্রয়োজন হলে সেই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে পারে।


সেনেপা যুদ্ধ থেকে শিক্ষা

প্রথমতঃ বিশাল শক্তিশালী সামরিক সরঞ্জামের বহর কোন কাজেই আসবে না যদি সেগুলি সর্বদা ব্যবহারের উপযোগী না থাকে। যুদ্ধের দিনে যুদ্ধক্ষেত্রে কে কতটা সামরিক শক্তি মোতায়েন করতে পারে, সেটার উপরেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। কোন একটা সময় সেই সরঞ্জামগুলি ব্যবহারের উপরে কোন নিয়ন্ত্রণ চলে আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স সেটার উপর নজরদারি করবে এবং প্রয়োজন হলে সেই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে পারে। সামরিক সরঞ্জামের রেডিনেস বা ব্যবহারের উপযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই রেডিনেস একদিকে যেমন নির্ভর করবে সরঞ্জামের কর্মক্ষমতার উপর, তেমনি নির্ভর করবে মানবসম্পদের ট্রেনিংএর উপর। এটা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।

দ্বিতীয়তঃ সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি; বিশেষ করে যেদিন প্রয়োজন হবে। যদি সরঞ্জাম অন্য কারুর তৈরি হয়, তাহলে সেখানে নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। বাইরে থেকে সরঞ্জাম কিনে আনার সাথে আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রশ্ন ছাড়াও ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত। অস্ত্র নির্মাতা রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বয় না হলে যুদ্ধের দিন সরঞ্জামের রেডিনেসের সমস্যা হতে পারে। স্পেয়ার পার্টস ছাড়া এখানে সফটওয়্যার আপগ্রেডের ব্যাপার রয়েছে। আবার যুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও চলে আসতে পারে। অস্ত্র নির্মাতা দেশগুলি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বহণের সক্ষমতা রেখে তাদের বিমানগুলি রপ্তানি করে না। বরং শর্ত সাপেক্ষে কিছু কিছু করে প্রযুক্তির ছাড় দেয়া হয়। পেরু 'মিরাজ-২০০০' বিমান ঠিকই পেয়েছিল; কিন্তু সেগুলি মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং 'এক্সোসেট' জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারতো না। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনার 'সুপার এটেনডার্ড' যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। ব্রিটেনের চাপে ফরাসিরা আর্জেন্টিনার বেশিরভাগ 'সুপার এটেনডার্ড' যুদ্ধবিমানকে 'এক্সোসেট' ক্ষেপণাস্ত্র বহণের উপযোগী করেনি; কালক্ষেপণ করেও আর্জেন্টিনার ক্ষতি করে তারা। পেরুকে ফ্রান্স 'এক্সোসেট' ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি এই সন্দেহে যে, পেরু সেগুলি আর্জেন্টিনাকে দিয়ে দিতে পারে। মিশরেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে মার্কিন 'এফ-১৬' (১৯২টা) এবং ফরাসি 'রাফাল' (৫৪টার মাঝে ২৪টা ডেলিভারি পেয়েছে) যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন তাদের মধ্যম পাল্লার 'এআইএম-১২০ এমর‍্যাম' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র মিশরকে দেয়নি; তেমনি ফরাসিরাও তাদের 'রাফাল' বিমানের সাথে 'মাইকা' এবং 'মিটিয়র' ক্ষেপণাস্ত্র দিতে রাজি হয়নি। কারণ উভয় দেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হলো ইস্রাইলকে রক্ষা করা; তাই তারা মিশরের হাতে এই অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলি দেয়নি। সুতরাং অতি দামী মার্কিন ও ফরাসি যুদ্ধবিমান কেনার পরেও মিশর সেগুলি নিয়ে কিছুই করতে পারেনি। একারণে তারা শেষ পর্যন্ত চীনের দ্বারস্থ হয়েছে 'জে-১০সি' যুদ্ধবিমানের জন্যে। তারা আশা করছে যে, অবশেষে তারা এই বিমানের সাথে মধ্যম পাল্লার 'পিএল-১৫' আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পাবে। মার্কিন 'এফ-১৬'এর সাথে তুরস্কের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। তুরস্কের 'এফ-১৬' বিমানগুলির সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার আপগ্রেড করার জন্যে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে পেছনে ঘুরছে। আর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে নাকে দড়ি দিয়ে তার কাজগুলি করিয়ে নিচ্ছে। মার্কিন 'এফ-৩৫' স্টেলথ বিমানের প্রকল্পে যুক্ত হয়েও তুরস্ক ফেঁসে গেছে। রাশিয়া থেকে 'এস-৪০০' বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার 'অপরাধে' যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং তুরস্কের পাইলটরা 'এফ-৩৫' বিমানে ট্রেনিং সম্পন্ন করার পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে বিমানগুলি ডেলিভারি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি আগাম দেয়া অর্থও যুক্তরাষ্ট্র ফেরত দেয়নি তুরস্ককে! দেরিতে হলেও তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাকমেইল বুঝতে পেরেছে (যদিও কিছু লোক এখনও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়তে পারছে না); এবং একারণে তারা নিজেদের যুদ্ধ সরঞ্জাম ডেভেলপ করছে।
 
মিশরের বিমান বাহিনীর মার্কিন নির্মিত 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান। যুক্তরাষ্ট্র মিশরকে বিমান দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর সাথে 'এআইএম-১২০ এমর‍্যাম' মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি। ফ্রান্সও 'রাফাল' বিমানের সাথে মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স নিশ্চিত করেছে যে, ইস্রাইলের বিরুদ্ধে কেউ মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে না। 


তৃতীয়তঃ যেকোন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সরঞ্জাম ডেলিভারির ক্ষেত্রে একটা লীডটাইম থাকে। অর্থাৎ প্রস্তুতকারীকে কিছুটা সময় দিতে হয় সরঞ্জাম তৈরি করে ডেলিভারি দেয়ার; বিশেষ করে সরঞ্জাম যদি এমন হয়, যা কিনা আগে থেকে তৈরি করে রেখে দেয়া হয় না। সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে লীডটাইম খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা বেশ দীর্ঘ। হাতে গোণা কয়েকজন এসকল সরঞ্জাম প্রস্তুত করে। একারণে অনেক সময়েই দেখা যায় যে, সমরাস্ত্রের স্পেয়ার পার্টস পেতে সময়ক্ষেপণ হয়। পেরুর ক্ষেত্রেও সম্ভবতঃ সেটা হয়েছিল। কোন কোন সময় অতি প্রয়োজন হলে প্রস্তুতকারী দেশ নিজেদের বাহিনী থেকে সমরাস্ত্র সেকেন্ড-হ্যান্ড ডেলিভারি দিয়ে থাকে। তবে সেটা শুধুমাত্র প্রস্তুতকারী রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বিত হলেই হয়ে থাকে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনাম ছেড়ে গিয়েছিল, তখন তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিমান বাহিনীকে প্রায় ১১'শ যুদ্ধবিমান দিয়েছিল। অপরদিকে ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে পাকিস্তান কানাডা থেকে 'এফ-৮৬এফ স্যাবর' ফাইটার বিমান যোগাড় করে।

চতুর্থতঃ যে ব্যাপারটা পেরু হয়তো মোকাবিলা করেনি, তবে অন্য অনেক দেশকেই মোকাবিলা করতে হতে পারে। যেমন অস্ত্র ডেলিভারি করা বিমানকে আকাশসীমানা ব্যবহার করতে না দেয়া। অস্ত্র যদি আমদানি করতে হয়, তখন শক্তিশালী কোন দেশ ইচ্ছা করলে বহণকারী বিমানের চলাচলকে বিঘ্নিত করতে পারে। এখানে যুদ্ধে জড়ানো রাষ্ট্রের আকাশসীমানা কোন কোন দেশের সাথে বা তাদের সমুদ্রসীমানা রয়েছে কিনা, সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। ১৯৮০এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ চীন থেকে ২০টা 'এফ-৭এমবি' এবং ১২টা 'এ-৫' বিমান ক্রয় করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ চীন থেকে আরও যুদ্ধবিমান ক্রয় করে। এই বিমানগুলি অনেক ক্ষেত্রেই আকাশপথে উড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। অন্ততঃ 'কে-৮ডব্লিউ' বিমানগুলি যে আকাশপথে মিয়ানমার হয়ে এসেছিল, তা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তার কারণে এই আকাশপথের বর্ণনা এখানে না দেয়া গেলেও যে ব্যাপারটা বোঝানো সম্ভব তা হলো, যুদ্ধের সময় সমরাস্ত্র আমদানি করতে গেলে কোন একটা পথে আকাশসীমানা খোলা রাখতেই হবে। এটা সার্বভৌমত্ব রক্ষার সাথে সম্পর্কিত।

পঞ্চমতঃ সকল সমরাস্ত্র নিজেরা ডেভেলপ ও তৈরি করতে পারলে উপরের বেশিরভাগ সমস্যাই এড়ানো সম্ভব। সকল সরঞ্জাম না হলেও অন্ততঃ ক্রিটিক্যাল কম্পোনেন্টগুলি যদি নিজেরা তৈরি করা যায়, তাহলে পেরুর মতো পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। তবে এর সাথে একটা এয়ার করিডোর খোলা রাখতেই হবে; যাতে করে বাইরে থেকে এমন কিছু সরঞ্জাম নিয়ে আসা যায়, যা কিনা নিজেদের কাছে নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের 'ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক' হেলিকপ্টার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা বলাই যেতে পারে যে, বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা যদি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত রাখা না হয়, তাহলে এই রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী রাখার কোন প্রয়োজনই নেই। আর এই সামরিক বাহিনীর জন্যে বাইরে থেকে কেনা কোন অস্ত্রের উপর যদি শর্ত থাকে যে, তা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, অথবা যুদ্ধের সময়ে অস্ত্র অবরোধের মাঝে পড়তে হবে, বা স্পেয়ার পার্টস বা সফটওয়্যার আপডেট পাওয়া যাবে না, তাহলে সেই অস্ত্রের ব্যাপারে বাংলাদেশের অনীহা থাকাটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ।

 
সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে যদি একটা রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে। সেই রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে অন্য রাষ্ট্রের পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধে নামতে বাধ্য হবে; ঠিক যেমনটা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে হয়েছে। নিজের অর্থ খরচ করে অন্যের কাছ থেকে কেনা অস্ত্রের উপর নির্ভর করে কেউ কখনও বড় হতে পারেনি। সে সর্বদাই আরেকজনের কথায় উঠেছে বসেছে। অন্য কথায় অন্যের দাস হিসেবে কাজ করেছে। অনেকে এই দাস মনোভাবের মাঝেই গর্ব দেখে - সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্রের দাসত্ব করাও গর্বের ব্যাপার! তবে বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে, যুদ্ধের সময়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি নিয়মিতই নিজেদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে জ্বলাঞ্জলি দেয়। তাই সেসকল রাষ্ট্রের উপর সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপারে নির্ভরশীলতা তৈরি করাটা বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা বলাই যেতে পারে যে, বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা যদি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত রাখা না হয়, তাহলে এই রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী রাখার কোন প্রয়োজনই নেই। আর এই সামরিক বাহিনীর জন্যে বাইরে থেকে কেনা কোন অস্ত্রের উপর যদি শর্ত থাকে যে, তা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, অথবা যুদ্ধের সময়ে অস্ত্র অবরোধের মাঝে পড়তে হবে, বা স্পেয়ার পার্টস বা সফটওয়্যার আপডেট পাওয়া যাবে না, তাহলে সেই অস্ত্রের ব্যাপারে বাংলাদেশের অনীহা থাকাটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ। অন্ততঃ এটা নিশ্চিত যে, বিশাল অংক খরচ করে পশ্চিমা দেশ থেকে কেনা অত্যাধুনিক সামরিক বিমান যদি মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, বা এন্টি রাডার ক্ষেপণাস্ত্র, বা জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম না হয়, তাহলে সেগুলি শো-কেসে সাজিয়ে রাখা চকচকে খেলনা থেকে আলাদা কিছু হবে না।






সূত্রঃ




‘The Time Ecuador and Peru Fought a 34-Day War Over a Patch of Amazonian Jungle’ in Historynet, 16 June 2023 (https://www.historynet.com/cenepa-war-peru-ecuador/)

‘The Cenepa Conflict at 25: Lessons Learned' by Lt Col Oswal Sigüeñas Alvarado in Journal of the Americas, Third Edition 2021

‘Mirage vs. Sukhoi; February 10, 1995 – The Cenepa War’ in Ed Nash’s Military Matters, 20 March 2020 (https://www.youtube.com/watch?v=fKJcm7E59oU)

‘Exocet missile: how the sinking of HMS Sheffield made it famous’ in The Guardian, 15 October 2017

‘Turkey scales down $23 bln F-16 jet deal with US, minister says’ in Reuters, 27 November 2024

‘Egypt to Replace US F-16s With China’s J-10C Fighter Jets: Report’ in The Defense Post, 10 September 2024

‘Egypt has spent big on diversifying its air force, but to what end?’ in Middle East Eye, 09 September 2022

‘Egypt barred from receiving BVR missiles for F-16 and Rafale’ in Bulgarian Military, 12 September 2024 (https://bulgarianmilitary.com/2024/09/12/egypt-barred-from-receiving-bvr-missiles-for-f-16-and-rafale/)

‘Turkey’s readmission to the F-35 program must come with a cost’ by Jonathan Schanzer and Sinan Ciddi in The Hill, 26 March 2025

‘US formally removes Turkey from F-35 programme’ in TRT World (https://www.trtworld.com/turkey/us-formally-removes-turkey-from-f-35-programme-46112)

‘Canadair Sabre’ in Joe Baugher (http://joebaugher.com/usaf_fighters/p86_22.html)

Monday, 24 March 2025

মোজাম্বিকে রাজনৈতিক কলহ পশ্চিমা দেশগুলির ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতারই ফলাফল

২৪শে মার্চ ২০২৫

 আফ্রিকার দক্ষিণে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটেন-ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিযোগিতা আরও বেগবান হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় ইস্রাইলি হামলার প্রতিবাদ হিসেবে লোহিত সাগর ও বাব-এল-মান্ডেব প্রণালিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজের উপর ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়াদের হামলা শুরু হবার পর থেকে। এই হামলার কারণে আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলি তাদের বেশিরভাগ জাহাজকে লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল ব্যবহার না করে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল ঘুরে যাতায়ত করার নির্দেশনা দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে আফ্রিকার দক্ষিণের এই সমুদ্রপথের উপর দেশগুলি, বিশেষ করে মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার এবং সাউথ আফ্রিকায় শক্তিশালী দেশগুলির প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।


মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র একমাস আগে ২০২৪এর ৯ই অক্টোবর আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্বের রাষ্ট্র মোজাম্বিকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ১৯৭৫ সাল থেকে ক্ষমতাসীন বামপন্থী 'ফ্রেলিমো' দলের ড্যানিয়েল চাপো দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। চাপো পেয়েছেন ৬৫ শতাংশ ভোট এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী 'পোডেমোস' দলের ভেনানসিও মন্ডলানে পান ২৪ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে 'ফ্রেলিমো' দল ৭১ শতাংশ ভোট পায় এবং বিরোধী 'পোডেমোস' দল পায় মাত্র ১৩ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। 'পোডেমোস' দলের দাবি, তাদের দল ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। 'পোডেমোস' নির্বাচনের ফলাফলকে বাতিলের দাবি জানিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেয়। সহিংসতায় বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়া জানাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা 'এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল' বলছে যে, নির্বাচনের পর মোজাম্বিকে ৩'শর বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। তবে ২৩শে মার্চ মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্টের ওয়েবসাইটে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল চাপো বিরোধী নেতা ভেনানসিও মন্ডলানের সাথে প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসেছেন।

ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা গভীর হচ্ছে

বামপন্থী 'ফ্রেলিমো' দল পাঁচ দশক ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখলেও পশ্চিমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। দেশের উত্তরে কাবো দেলগাদো অঞ্চলে মুসলিম বিদ্রোহীদের দমনে পশ্চিমারা, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মোজাম্বিককে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। মোজাম্বিকের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি পর্তুগাল, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও মোজাম্বিকের নিরাপত্তায় জড়িত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশ রুয়ান্ডা মোজাম্বিকে সৈন্য পাঠিয়েছে। কাবো দেলগাদো অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে হাইড্রোকার্বনের ব্যাপক খনি অবিষ্কৃত হওয়ায় এই অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলি এই অঞ্চলে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। পশ্চিমা বিনিয়োগের উপর মুসলিম বিদ্রোহীদের হামলার পরপরই পশ্চিমা দেশগুলি মোজাম্বিকের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দৈন্যতা ভুলে গিয়ে সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সোচ্চার হয়েছে। তবে এর সাথে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও শুরু হয়। বিশেষ করে ব্রিটেন-ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিযোগিতা আরও বেগবান হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় ইস্রাইলি হামলার প্রতিবাদ হিসেবে লোহিত সাগর ও বাব-এল-মান্ডেব প্রণালিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজের উপর ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়াদের হামলা শুরু হবার পর থেকে। এই হামলার কারণে আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলি তাদের বেশিরভাগ জাহাজকে লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল ব্যবহার না করে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল ঘুরে যাতায়ত করার নির্দেশনা দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে আফ্রিকার দক্ষিণের এই সমুদ্রপথের উপর দেশগুলি, বিশেষ করে মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার এবং সাউথ আফ্রিকায় শক্তিশালী দেশগুলির প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

মোজাম্বিকের উত্তরের মুসলিম-অধ্যুষিত কাবো দেলগাদো অঞ্চলে এলএনজি প্রকল্পে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও তার বন্ধু দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু দেশগুলির মতের অমিল দেখা যাচ্ছে। অন্ততঃ যতদিন হোয়াইট হাউজে বাইডেন প্রশাসন ছিল, ততদিন মোজাম্বিকের ব্যাপারে ব্রিটেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমত ছিল না। তবে ট্রাম্প প্রশাসন হোয়াইট হাউজে আসার সাথেসাথেই প্রকল্পের ব্যাপারে দুই শক্তিধর দেশের দ্বিমত শুরু হয়ে গেছে। 'ফিনানশিয়াল টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ফরাসি তেলের কোম্পানি 'টোটাল এনার্জি'কে প্রতিশ্রুত মার্কিন 'এক্সিম ব্যাংক'এর ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের স্থগিত ঋণ হোয়াইট হাউজে পরিবর্তনের সাথেসাথে ছাড় দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে প্রথম ট্রাম্প প্রশাসন এই ঋণের অনুমতি দিয়েছিল। ২০২১ সালে কাবো দেলগাদোর এলএনজি প্রকল্পে মুসলিম বিদ্রোহীদের হামলা শুরুর পর বাইডেন প্রশাসন এই ঋণ স্থগিত করেছিল। গত ১৩ই মার্চ মোজাম্বিকের জ্বালানি মন্ত্রী এব্যাপারে বলেন যে, এই ঋণ ছাড়ের মাধ্যমে মোজাম্বিকের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বশীল অবস্থান নিশ্চিত হলো। তিনি একইসাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে 'টোটাল এনার্জি' বলছিলো যে, কাবো দেলগাদোতে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এই প্রকল্পের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কাজ মার্কিন সাবকন্ট্রাক্টররা করবে; যার মাধ্যমে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নিশ্চিত হবে। ক্ষমতাসীন 'ফ্রেলিমো' দলের পুনর্নিবাচিত প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল চাপোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রধানতম ছিল কাবো দেলগাদোর এলএনজি প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ স্থগিত করার সাথেসাথে ব্রিটেন এবং নেদারল্যান্ডসের সরকারও সেখানে বিনিয়োগ স্থগিত করেছিলো। এই প্রকল্পে ব্রিটেনের ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়ার কথা ছিল। 'ফিনানশিয়াল টাইমস' বলছে যে, ব্রিটিশ সরকার এই প্রকল্প থেকে তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নেবার চিন্তা করছে। ব্রিটেন সরে গেলে নেদারল্যান্ডসও সরে যাবে। ব্রিটিশ সরকারের সূত্রগুলি বলছে যে, তারা মোজাম্বিকের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী নয়। অপরদিকে এই প্রকল্পের এশিয়ান দাতারা যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের ব্যাপারে ছাড় দিয়েছে। প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ফরাসি কোম্পানি 'টোটাল এনার্জি'র (সাড়ে ২৬ শতাংশ) সাথে পার্টনার হিসেবে কাজ করছে মোজাম্বিক সরকার (১৫ শতাংশ), জাপান (২০ শতাংশ), ভারত (৩০ শতাংশ) এবং থাইল্যান্ড (সাড়ে ৮ শতাংশ)।

৯ই জানুয়ারি ২০২৫। ভেনানসিও মন্ডলানের বীরের বেশ মোজাম্বিকের মাটিতে অবতরণ। ২০১৩ সালে তিনি পর্তুগীজ ভাষাভাষী দেশগুলির মাঝে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকল্প 'ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লীডারশিপ প্রোগ্রাম' বা 'আইভিএলপি'তে অংশ নেন। মার্কিন দূতাবাস কেন ভেনানসিও মন্ডলানেকে এই প্রকল্পে যুক্ত করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার পরবর্তী কর্মকান্ডে। রাজনীতিবিদ হিসেবে মোজাম্বিকের জনগণ মন্ডলানেকে ডানপন্থী না ভাবলেও দেশের বাইরে অনেকেই তাকে সেরকমই মনে করে। 


ভেনানসিও মন্ডলানে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের ব্যক্তি

নির্বাচনে হেরে যাবার পরপরই ভেনানসিও মন্ডলানে দেশ ছেড়ে চলে যান এবং দেশের বাইরে থেকে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে মোজাম্বিকের জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে বলেন। গত কয়েক মাসের সহিংসতায় মোজাম্বিকের অর্থনীতি একেবারেই ধ্বসে গেছে। এরপর ৯ই জানুয়ারি তিনি বাইবেল হাতে দেশের মাটিতে পা রাখেন, এবং বলেন যে তিনি সরকারের সাথে আলোচনার জন্যে প্রস্তুত। ভেনানসিও মন্ডলানে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতেন। ২০১৩ সালে তিনি পর্তুগীজ ভাষাভাষী দেশগুলির মাঝে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকল্প 'ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লীডারশিপ প্রোগ্রাম' বা 'আইভিএলপি'তে অংশ নেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে নেতৃত্ব নেবার মতো প্রায় ৫ হাজার ব্যক্তিকে একত্রে নিয়ে এসে তিন সপ্তাহের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া হয়; যাতে করে তারা তাদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে সেটার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এই প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির একটা অংশ। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তররের 'আইভিএলপি' বিষয়ক তথ্যবহুল বর্ণনায় বলা হয় যে, বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাস এই ব্যক্তিদেরকে নির্বাচন করে থাকে। মার্কিন দূতাবাস কেন ভেনানসিও মন্ডলানেকে এই প্রকল্পে যুক্ত করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার পরবর্তী কর্মকান্ডে। সেই বছরই মন্ডলানে মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুটো শহরের মেয়র হিসেবে নির্বাচনে লড়েন। হেরে গেলেও পরের বছর তিনি শহরের মিউনিসিপ্যাল এসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালে তিনি আবারও মাপুটোর মেয়র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন এবং আবারও হেরে যান। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি 'রেনামো' দলের হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে তার পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রথমে 'সিএডি' এবং পরবর্তীতে 'পোডেমোস' দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাজনীতিবিদ হিসেবে মোজাম্বিকের জনগণ মন্ডলানেকে ডানপন্থী না ভাবলেও দেশের বাইরে অনেকেই তাকে সেরকমই মনে করে। তিনি ক্ষমতাসীন বামপন্থী 'ফ্রেলিমো' দলের ঘোর বিরোধী এবং কমিউনিস্ট-বিরোধী গ্রুপেরও সদস্য। ব্রাজিলের ক্ষমত্যাচ্যুত এবং মামলায় জর্জরিত প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেয়ার বউসুনারুকে তিনি বিভিন্ন সময়ে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারনার মাঝেই মন্ডলানে পর্তুগালের উগ্র ডানপন্থী দল 'চেগা'র প্রধান আন্দ্রে ভেনচুরার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ঐতিহ্যগতভাবে পারিবারিক আদর্শগুলিকে ধরে রাখার পক্ষপাতি এবং ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি, অপরাধ এবং আইন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সমস্যা নিরসনে প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল চাপোও বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় বসার ব্যাপারে তারা ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছেন। জনগণকে ঠান্ডা করার জন্যে গত ২৪শে জানুয়ারি চাপো মোজাম্বিকের পুলিশ প্রধান বারনারডিনো রাফায়েলকে বরখাস্ত করেন। অন্ততঃ নিজের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না বুঝেই ভেনানসিও মন্ডলানে যে দেশে ফিরে এসেছিলেন, এটা নিশ্চিত। প্রেসিডেন্ট চাপো আর যা-ই হোক, ট্রাম্প প্রশাসনকে ক্ষেপাতে চাইছেন না।
 
ডিসেম্বর ২০২৪। সাউথ আফ্রিকার সাথে মোজাম্বিকের লেবোম্বো সীমান্ত রাস্তা। সাউথ আফ্রিকার উত্তর-পুর্বাঞ্চলের খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে দৈনিক প্রায় ১ হাজার ট্রাকে করে কয়লা এবং ক্রোমিয়াম যায় মোজাম্বিকে। স্থলবন্দর বন্ধ হবার কারণে সাউথ আফ্রিকা প্রতিদিন সাড়ে ৫ লক্ষ ডলার বা মাসে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে। 'ডিসাইড' নামের মোজাম্বিকের একটা বেসামরিক সংগঠন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'এক্স'এ একটা খোলা চিঠি প্রকাশ করে যেখানে মোজাম্বিকের রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে সরকার এবং বিরোধী দলকে আলোচনায় বসাতে সাউথ আফ্রিকার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।  


মোজাম্বিকে প্রতিবেশী দেশ সাউথ আফ্রিকার প্রভাব

‘ব্লুমবার্গ'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মোজাম্বিকে রাজনৈতিক অসন্তোষের কারণে সাউথ আফ্রিকার অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে। সাউথ আফ্রিকার উত্তর-পুর্বাঞ্চলের খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে দৈনিক প্রায় ১ হাজার ট্রাকে করে কয়লা এবং ক্রোমিয়াম যায় মোজাম্বিকে। সেই খনিজ পণ্য লেবোম্বো স্থলবন্দর দিয়ে মোজাম্বিকে ঢুকে মাপুটো সমুদ্রবন্দর হয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়। মোজাম্বিকে রাজনৈতিক কলহ শুরুর পর থেকে এই রুটে খনিজ রপ্তানি কমে যেতে থাকে। এরপর ২০২৪এর ৯ই ডিসেম্বর সাউথ আফ্রিকা এই স্থলবন্দর দিয়ে খনিজ রপ্তানি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয়। সাউথ আফ্রিকার 'রোড ফ্রেইট এসোসিয়েশন'এর হিসেবে স্থলবন্দর বন্ধ হবার কারণে সাউথ আফ্রিকা প্রতিদিন সাড়ে ৫ লক্ষ ডলার বা মাসে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে। একসময় সাউথ আফ্রিকার খনিজ শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি থাকলেও বর্তমানে ৪ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষ এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। এবং সরকার এখনও এই শিল্প থেকে করের মাধ্যেমে ব্যাপক আয় করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সাউথ আফ্রিকার খনিজ শিল্প দুর্দিনের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। খনিজের মূল্যে স্থবিরতা, খরচ বৃদ্ধি পাওয়া এবং লজিস্টিক্যাল সমস্যা থাকার কারণে এই শিল্পে লাভ কমে গেছে। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে এবং বাকিরাও খরচ কমানোর চেষ্টায় রয়েছে।

গত ৭ই জানুয়ারি 'ডিসাইড' নামের মোজাম্বিকের একটা বেসামরিক সংগঠন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'এক্স'এ একটা খোলা চিঠি প্রকাশ করে সাউথ আফ্রিকার সরকারকে উদ্দেশ্য করে। সাউথ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসা এবং দেশটার পার্লামেন্টকে উদ্দেশ্য করে লেখা এই চিঠিতে মোজাম্বিকের রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে সরকার এবং বিরোধী দলকে আলোচনায় বসাতে সাউথ আফ্রিকার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন সংস্থার প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচয় দেয়া এডসন রবার্টো ডে অলিভেইরা কর্তেজ। সংস্থার ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বেশ সরব। এর ডিরেক্টর উইকলার দিয়াজ মাত্র কয়েকদিন আগেই 'ডয়েচে ভেলে'তে স্বাক্ষাত দিয়ে মোজাম্বিকের পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। তারা সাউথ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টকে আফ্রিকান কোর্ট অব জাস্টিস, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের পীস এন্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলের সহায়তা নিতে অনুরোধ জানান। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, তারা মোজাম্বিকের সমস্যা নিরসনে 'সাউদার্ন আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি' বা 'এসএডিসি'র সহায়তা চাননি। যদিও ২০২১ সালে মোজাম্বিকের উত্তরাঞ্চলের মুসলিম বিদ্রোহীদের দমন করতে 'এসএডিসি'র অধীনেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে সৈন্য পাঠানো হয়েছিল। এরপর ২০২৪এর নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে 'এসএডিসি'র প্রতিনিধিরা নির্বাচনকে বৈধতা দেয়। 'এসএডিসি'র ওয়েবসাইটে নির্বাচন সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, নির্বাচন যথেষ্ট কর্মদক্ষতার সাথে সম্পাদন করা হয়েছে। এবং এর পরিবেশ ছিল নিয়মমাফিক এবং স্বাধীন। 'এসএডিসি'র এই অবস্থান মোজাম্বিকের বিরোধী দলীয় বিক্ষোভকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি মোটেই। প্রকৃতপক্ষে মোজাম্বিকের নির্বাচনের আগেই আফ্রিকার দক্ষিণের দেশগুলিতে সকল নির্বাচন এবং সরকারি দমনপীড়নের ব্যাপারেই 'এসএডিসি' নীরব ভূমিকা নিয়েছিল। মোজাম্বিকের ২০১৯ সালের নির্বাচনের অনিয়ম নিয়েও 'এসএডিসি' কোন কথা বলেনি। 'এসএডিসি'র অনেক দেশেই যখন একনায়কের শাসন চলছে, তখন সংস্থার এহেন চরিত্র অবশ্য অবাক করা কিছু নয়।
  

২৩শে মার্চ ২০২৫। ওয়াশিংটনে সাউথ আফ্রিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এব্রাহিম রাসূল দেশে ফিরে বীরোচিত সন্মান পান। তিনি একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' প্রকল্পকে শ্বেতাঙ্গ 'সুপ্রিম্যাসিস্ট প্রবৃত্তি' হিসেবে আখ্যা দেয়ার কারণে মার্কিন সরকার তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বড় রকমের পরিবর্তনের পর থেকে সেটার প্রতিফলন ঘটছে দুনিয়ার সকল অঞ্চলে। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে ব্রিটিশ ঘরানার প্রভাবের সাথে মার্কিন প্রভাবের দ্বন্দ্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামনে আসেনি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এই দ্বন্দ্বগুলিকে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে খুব একটা সচেষ্ট নয়। ভেঙ্গে পড়ার কারণে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার কদর্যটা এখন মোটামুটিভাবে সকলের কাছেই দৃশ্যমান হচ্ছে।


যুক্তরাষ্ট্র-সাউথ আফ্রিকার সম্পর্কে টানাপোড়েন

মোজাম্বিকের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে কেউ কেউ যখন সাউথ আফ্রিকার হস্তক্ষেপ কামনা করছে, তখন সাউথ আফ্রিকার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পরিস্থিতি চিন্তা করা প্রয়োজন। কারণ হোয়াইট হাউজে নতুন প্রশাসন আসার পর থেকে মোজাম্বিকের প্রতিবেশী ব্রিটিশদের বন্ধু দেশ সাউথ আফ্রিকার সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ অনেকদিন থেকেই ভালো যাচ্ছে না। অপরদিকে মোজাম্বিকের বিরোধী নেতা মন্ডলানে ট্রাম্প প্রশাসনের পছন্দের লোক। মার্কিন সরকার ওয়াশিংটনে সাউথ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত এব্রাহিম রাসূলকে বের করে দেয়ার পর ২৩শে মার্চ তিনি সাউথ আফ্রিকাতে হিরোর বেশে অবতরণ করেন। বিমানবন্দরে শতশত মানুষের মাঝে তিনি ঘোষণা দেন যে, যদিও কোন একটা রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে বের করে দেয়াটা অপমানজনক, তথাপি তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে বের করে দেয়ার এই আদেশকে গর্বভরে বলে বেড়াবেন। এক সপ্তাহ আগে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিও বলেন যে, এব্রাহিম রাসূলকে বের করে দেয়ার কারণ হলো, তিনি একটা সাউথ আফ্রিকান থিংকট্যাঙ্কের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' প্রকল্পকে শ্বেতাঙ্গ 'সুপ্রিম্যাসিস্ট প্রবৃত্তি' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। রাসূল একইসাথে ট্রাম্পের সমকামিতা-বিরোধী প্রকল্প এবং অভিবাসী নীতির সমালোচনা করেন। 'ডয়েচে ভেলে' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ফেব্রুয়ারি মাসেই ট্রাম্প প্রশাসন সাউথ আফ্রিকাতে মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেয়। এর পিছনে অভিযোগ ছিল যে, সাউথ আফ্রিকা সরকার ফিলিস্তিনের হামাস এবং ইরানকে সমর্থন দিচ্ছে। রাসূল বলেছেন যে, সাউথ আফ্রিকা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মাথা নত করে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা সরিয়ে নেবে না। এছাড়াও ট্রাম্প সমালোচনা করেন যে, সাউথ আফ্রিকা সরকার সেই দেশের শ্বেতাঙ্গদের জমি দখল করে নিচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' বা 'সিএসআইএস'এর সিনিয়র ফেলো মুয়েম্বা ফেজো এক লেখায় বলছেন যে, সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের পতনের পর নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসা দল 'এএনসি' তাদের দেশের বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দলনের সময় বিভিন্ন দেশের ভূমিকাকে ভিন্নরূপে দেখে। তারা মনে করে যে, সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে বেশি ভূমিকা রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট ব্লকের রাষ্ট্রগুলি। তারা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জোট-নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকেছে এবং ওয়াশিংটনের হুমকি অগ্রাহ্য করেই রাশিয়া এবং কিউবার সাথে সম্পর্ক করেছে; যারা সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদী সময়ে 'এএনসি'রকে সমর্থন দিয়েছিল। তথাপি সাউথ আফ্রিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্কে রেখে চলেছে। তবে বাইডেন প্রশাসনের সময় থেকেই সাউথ আফ্রিকার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ভাটা পড়তে থাকে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর সাউথ আফ্রিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। সেই বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়ার একটা জাহাজ সাউথ আফ্রিকার সায়মন্সটাউন বন্দর থেকে অস্ত্রের ডেলিভারি নেয়; যা যুক্তরাষ্ট্রের চোখে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের শামিল। সাউথ আফ্রিকা রাশিয়া ও চীনের সাথে যৌথ নৌ-মহড়াও করেছে। এরপর গাজায় ইস্রাইলের বোমাবর্ষণ শুরুর পর আন্তর্জাতিক আদালতে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা ঠুকে দেয় সাউথ আফ্রিকা। এটা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজনীতিবিদের জন্যেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ চাইছিলেন।

মুয়েম্বা ফেজো বলছেন যে, ওয়াশিংটনের সাথে সাউথ আফ্রিকার বর্তমান কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো সাউথ আফ্রিকার মাধ্যমে 'ব্রিকস'এর অন্যান্য সদস্যদেশকে (বিশেষ করে রাশিয়া, চীন ও ব্রাজিলকে) শেখাচ্ছে যে, ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক এজেন্ডার বিরুদ্ধে গেলে কি হতে পারে। এর ফলাফল হিসেবে সাউথ আফ্রিকার অর্থনীতিতে ধ্বস নামতে পারে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলির মাঝে বিভেদ তৈরি হয়ে বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের পতনও ঘটে যেতে পারে। আপাততঃ ওয়াশিংটন সাউথ আফ্রিকার উপর চাপ সৃষ্টি করছে কারণ 'ব্রিকস' জোটের পক্ষ থেকে সাউথ আফ্রিকার পক্ষে বড় ধরণের কোন অর্থনৈতিক সমর্থন না-ও আসতে পারে। অন্ততঃ ওয়াশিংটনকে দূরে ঠেলে রাখার মতো শক্তি 'ব্রিকস' জোটের এখনও হয়নি। একারণে অনেকেই হয়তো ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে যেতে দুইবার চিন্তা করবে। তবে অনেক দেশই হয়তো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সন্মুখীন হয়ে নতুন করে ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্কের হিসেব করবে।

মোজাম্বিকে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে ('ফ্রেলিমো' সরকার বনাম 'রেনামো’ বিদ্রোহী দল) দেশটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এরপর ২০১৭ সাল থেকে উত্তরের কাবো দেলগাদো অঞ্চলে মুসলিম বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়। এই সংঘাতে ৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হয়েছে। বিপুল সম্পদ থাকার পরেও দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বিশেষ করে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় বৈষম্য সবচাইতে বেশি।

আফ্রিকার দক্ষিণের দেশ মোজাম্বিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা মূলতঃ ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতারই ফলাফল। এই প্রতিযোগিতার একদিকে রয়েছে ব্রিটিশ ঘরানার সাউথ আফ্রিকা এবং ইউরোপিয় ইউনিয়ন। অন্যপক্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়ারা লোহিত সাগর এবং বাব-এল-মান্ডেব প্রণালিতে বাণিজ্য জাহাজের উপর হামলা শুরু করার পর থেকে বেশিরভাগ বাণিজ্য জাহাজকে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল ঘুরে যেতে হচ্ছে। একারণে এই অঞ্চলের দেশগুলি, বিশেষ করে মোজাম্বিক, মাদাগাসকার এবং সাউথ আফ্রিকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বড় রকমের পরিবর্তনের পর থেকে সেটার প্রতিফলন ঘটছে দুনিয়ার সকল অঞ্চলে। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে ব্রিটিশ ঘরানার প্রভাবের সাথে মার্কিন প্রভাবের দ্বন্দ্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামনে আসেনি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এই দ্বন্দ্বগুলিকে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে খুব একটা সচেষ্ট নয়। ভেঙ্গে পড়ার কারণে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার কদর্যটা এখন মোটামুটিভাবে সকলের কাছেই দৃশ্যমান হচ্ছে।

Tuesday, 18 March 2025

পাকিস্তানের ট্রেনে হামলা - ভারত কেন সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নয়?

১৯শে মার্চ ২০২৫

পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার এই ঘটনা যে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যায় না তা হলো, পাকিস্তান রাষ্ট্র তার জনগণের মৌলিক চাহিদা পুরণে যথেষ্ট যত্নবান হয়নি কখনোই। এছাড়াও পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতিগত বৈষম্যকেই প্রাধান্য দিয়েছে সর্বদা। একারণেই যুগ যুগ ধরে পুরো পাকিস্তান জুড়ে অস্থিরতা তৈরির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ভারতীয়রা এই অস্থিরতায় ইন্ধন যুগিয়েছে মাত্র।


গত ১১ই মার্চ পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী 'বালুচ লিবারেশন আর্মি' বা 'বিএলএ'এর একটা সশস্ত্র গ্রুপ দুর্গম অঞ্চলে 'জাফর এক্সপ্রেস' নামের একটা ট্রেন হাইজ্যাক করে ৪'শ মানুষকে জিম্মি করে। প্রায় ৩৬ ঘন্টা পর পাকিস্তানের স্পেশাল ফোর্স 'এসএসজি'র 'আল জারার কোম্পানি' ট্রেনটার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। এর ফলাফল হিসেবে ১৮ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, ৩ জন রেলওয়ে কর্মী, ৫ জন সাধারণ যাত্রী এবং ৩৩ জন বিচ্ছিন্নতাবাদীর মৃত্যু হয় এবং ৩'শ ৫৪ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয় বলে সরকারি সূত্র বলছে। আক্রমণকারীরা ট্রেন লাইনে বোমা ফাটিয়ে ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা করেছিল। 'এসোসিয়েটেড প্রেস'এর এক খবরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, আক্রমণকারীরা ট্রেনের যাত্রীদের সকলের পরিচয়পত্র চেক করতে থাকে এবং যারা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলতে থাকে। হত্যা করা ব্যক্তিদের মাঝে সেনাসদস্য ছাড়াও সংখ্যালঘু শিয়া এবং পাঞ্জাবিরা ছিল। বালুচ অধিবাসীদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন যে, হামলাকারীরা কিছু যাত্রীর হাত বেঁধে তাদেরকে কয়েকবার গুলি করে হত্যা করে। একজন মহিলার চোখের সামনে সামরিক বাহিনীতে কাজ করা তার তিন ছেলেকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানী সেনাদের সাথে আক্রমণকারীদের গুলি বিনিময়ের সময় বেশ কিছু যাত্রী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

একইদিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেঃ জেনারেল আহমাদ শরীফ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সন্ত্রাসী হামলা এবং এর আগের আক্রমণগুলির পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে ভারত। তিনি অবশ্য ভারতের জড়িত থাকার ব্যাপারে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। তিনি উল্লেখ করেন যে, ২০১৬ সালে কুলভূষণ যাদব নামে ভারতের নৌবাহিনীর একজন অফিসার পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন। ভারতের পক্ষে গোয়ান্দাবৃত্তির কাজ করা এবং বালুচিস্তান ও অন্যান্য অঞ্চলের গেরিলা গ্রুপগুলিকে ইন্ধন দেয়ার অপরাধে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল। জেনারেল চৌধুরী বলেন যে, কিছু আক্রমণকারী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে; যাদেরকে পাকরাও করার চেষ্টা চলছে। হতাহতের মাঝে বেশিরভাগই ছিল ট্রেনের যাত্রীদেরকে রক্ষা করতে যাওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং নিজেদের গ্রামের বাড়িতে ফেরত যাওয়া সেনা সদস্য। তিনি আরও বলেন যে, ভারতীয় মিডিয়াতে 'বিএলএ'এর প্রকাশ করা ভিডিও প্রচার করা হয়; যেগুলি হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআইএর মাধ্যমে তৈরি, নতুবা পুরোনো ছবি। জেনারেল চৌধুরী বলেন যে, হামলাকারীরা মহিলা এবং শিশুদেরকে আলাদা করে ৮ ঘন্টা পরে ছেড়ে দেয়। তারা পুরুষ যাত্রীদেরকে বাইরে নিয়ে আসে এবং যাত্রীদের জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে আলাদা করে। 'আল জাজিরা' বলছে যে, তারাও যাত্রীদের সাথে কথা বলে সেটাই জানতে পেরেছে। জেনারেল চৌধুরী বলেন যে, আক্রমণকারীদের বড় অংশ পাহাড়ি অঞ্চলে লুকিয়ে পড়ে। আর ছোট একটা গ্রুপ জিম্মিদের সাথে থাকে। থেকে যাওয়া হামলাকারীদের প্রায় সকলেই ছিল সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স বুঝতে পেরেছে যে, হামলাকারীরা ওয়াকিটকির মাধ্যমে আফগানিস্তানে তাদের ইন্ধনদাতাদের সাথে কথা বলছিল। দ্বিতীয় দিনে সামরিক স্নাইপারদের গুলিতে জিম্মিদের কাছে দাঁড়ানো কয়েকজন সুইসাইড স্কোয়াড হামলাকারীর মৃত্যু হলে কয়েকজন জিম্মি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরপরই জিম্মি উদ্ধারের মূল অপারেশন চালানো হয়। উদ্ধার অভিযানের সময় কোন জিম্মির মৃত্যু হয়নি বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়। 'আল জাজিরা'র সাথে কথা বলতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসার বলেন যে, গেরিলাদের জীবন্ত ধরার জন্যে সর্বোচ্চ লক্ষ্য থাকলেও এধরণের অপারেশনে জিম্মি উদ্ধারে গেরিলাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন।
 
২০১৬ সালে কুলভূষণ যাদব নামে ভারতের নৌবাহিনীর একজন অফিসার পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন। ভারতের পক্ষে গোয়ান্দাবৃত্তির কাজ করা এবং বালুচিস্তান ও অন্যান্য অঞ্চলের গেরিলা গ্রুপগুলিকে ইন্ধন দেয়ার অপরাধে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া যখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলায় ভারতের সংশ্লিষ্টতা দেখতে পাচ্ছে না, তখন এটা বলাই বাহুল্য যে, পশ্চিমারা ভারত-ঘেঁষা নীতিতেই অটল থাকবে। কারণ বালুচিস্তানের গেরিলাদেরকে পশ্চিমারা সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়েছে। এখন এই সংগঠনগুলির সাথে ভারতের সংশ্লিষ্টতা মেনে নেয়ার অর্থ হলো ভারত সন্ত্রাসবাদের ইন্ধনদাতা। 


হামলার আন্তর্জাতিক চেহারা

দিল্লীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রানধির জাইসওয়াল সাংবাদিকদের বলেন যে, পাকিস্তানের ট্রেন হামলায় ভারতের যোগসাজসের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের নিজস্ব ভূখন্ডই সন্ত্রাসের আখড়া। পাকিস্তানের উচিৎ নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও ব্যর্থতাকে ঢাকতে অন্যের উপর দোষ না চাপিয়ে নিজের দিকে তাকানো। এর আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাফকাত আলী খান বলেন যে, এই হামলার পরিকল্পনা আফগানিস্তানে বসে করা হয়েছে। এবং সেখানে হামলাকারীদের সাথে ইন্ধনদাতাদের যোগাযোগ হয়েছে। পাকিস্তান বরাবরই আফগানিস্তান সরকারকে বলেছে যে, তারা যেন 'বিএলএ'কে তাদের ভূখন্ড ব্যবহার করতে না দেয়। কাবুলের তালিবান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্দুল ক্বাহার বালখি এক বিবৃতিতে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন যে, আফগানিস্তানে 'বিএলএ'র কোন উপস্থিতি নেই। তিনি আরও বলেন যে, পাকিস্তানের উচিৎ দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা না বলে নিজস্ব নিরাপত্তা জোড়দার করা এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করা।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বালুচিস্তান প্রদেশের অনেকেই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ করে আসছিল; যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তা সর্বদাই অস্বীকার করেছে। এই প্রদেশে প্রচুর খনিজ সম্পদও রয়েছে। 'বিএলএ' পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চাইছে এবং সেই লক্ষ্যে তারা এর আগেও ট্রেনে হামলা করেছে। তবে ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনা এটাই প্রথম। এই আক্রমণ সারা দুনিয়া থেকে নিন্দা কুড়িয়েছে; যার মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, তুরস্ক, ইরান এবং ব্রিটেন রয়েছে। ১৪ই মার্চ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও এই আক্রমনের নিন্দা জানানো হয় এবং এই আক্রমণকে সন্ত্রাসী আক্রমণ আখ্যা দিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি করা হয়।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০২১ সালের অগাস্ট থেকে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার পাকিস্তানের 'তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান' বা 'টিটিপি'কে সহায়তা দিয়ে আসছে; যারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনেক হামলার সাথে জড়িত ছিল। এছাড়াও সেই প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ‘বিএলএ'র সাথে 'টিটিপি' এবং আইসিসের খোরাসান শাখার যোগাযোগ রয়েছে। যদিও এই গ্রুপগুলির লক্ষ্য ভিন্ন, তথাপি নিজেদের স্বার্থে তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।
 
বালুচিস্তানে চীনের কৌশলগত প্রকল্পে কাজ করা চীনা নাগরিকদের উপর হামলার ব্যাপারটা ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানের গোয়াদরে চীনের কৌশলত সমুদ্রবন্দর তৈরিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত কেউই ভালো চোখে দেখেনি। চীনাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা যেন একপ্রকার গ্রীন লাইটই পাচ্ছে পশ্চিমাদের কাছ থেকে। হাজার হলেও চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বড় বন্ধু। 


বালুচিস্তানের ভূরাজনীতি

‘বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বালুচিস্তান হলো পাকিস্তানের পুরো ভূখন্ডের ৪৪ শতাংশ। তবে জনসংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের ২৪ কোটি মানুষের মাত্র ৬ শতাংশ হলো বালুচ। তবে খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে এই প্রদেশ পাকিস্তানের সবচাইতে ধনী। কানাডার 'বারিক গোল্ড' কোম্পানি এখানে 'রেকো ডিক' খনি ডেভেলপ করছে; যা কিনা বর্তমানে ডেভেলপের মাঝে থাকা সর্ববৃহত তামা এবং স্বর্ণ খনিগুলির অন্যতম। এই প্রদেশে চীনারা 'চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর' বা 'সিপেক' নামের কৌশলগত প্রকল্পে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। এই প্রকল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো গোয়াদর গভীর সমুদ্রবন্দর; যা কিনা চীনের 'বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই প্রদেশে চীনারা খনিজ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে এবং গোয়াদরে একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করছে। 'বিএলএ' এই প্রকল্পগুলির ঘোর বিরোধী। ইরান এবং আফগানিস্তানের সাথে বিশাল সীমানা ছাড়াও আরব সাগরে এর রয়েছে বেশ লম্বা সমুদ্রতট। বালুচ জাতির মাঝে বেশ অনেকেই আফগানিস্তান এবং ইরানের বাসিন্দা। ২০২৪এর জানুয়ারিতে ইরান এবং পাকিস্তান একে অপরের ভূমিতে বিমান হামলা করে। তাদের উভয়েরই যুক্তি ছিল যে, অপর দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের ক্যাম্প রয়েছে। বালুচিস্তানের বাসিন্দারা অভিযোগ করে যে, পাকিস্তান সরকার বালুচিস্তানের খনিজগুলিকে তুলছে ঠিকই, কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের অবস্থার উন্নয়ন করছে না। ১৯৪৮ সালে শুরু হয়ে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ১৯৭০এর দশক পর্যন্ত তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গিয়েছিল। এরপর বেশকিছু সময় পর ২০০৩ সাল থেকে তারা আবারও সক্রিয় হয়। 'বালুচ লিবারেশন আর্মি' বা 'বিএলএ' এবং 'বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট' বা 'বিএলএফ' প্রধান বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। এর মাঝে 'বিএলএ'র সক্ষমতা সবচাইতে বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন 'বিএলএ'কে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এক অপারেশনে বালুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতিকে হত্যা করে। অভিযোগ রয়েছে যে, পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বহু বালুচ জনগণ গুম হয়েছে। পাকিস্তান সরকার অবশ্য এগুলি অস্বীকার করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে 'বিএলএ' পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়াও বড় প্রকল্পগুলিতে কাজ করা চীনা নাগরিকদের উপর হামলা করছে। 'বিএলএফ'ও বিদেশী নাগরিকদের উপর হামলা করছে। পাকিস্তান সরকার দাবি করছে যে, ইরান এবং আফগানিস্তানে এই গ্রুপগুলির ঘাঁটি রয়েছে। এবং এদের অনেককেই ভারত অর্থায়ন করছে।

পাকিস্তানের ট্রেনে হামলার ঘটনা পশ্চিমা মিডিয়াতে ততটা গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়নি; যতটা দেখা গিয়েছে ভারতের উপর বিভিন্ন হামলার সময়। একইসাথে ভারতের উপর হামলার সময় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতাকে যতটা হাইলাইট করা হয়েছে, ততটা কখনোই দেখা যায়নি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলায় ভারতের জড়িত থাকার ব্যাপারে। এমনকি যখন ভারতের সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পরেও পশ্চিমা মিডিয়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলায় ভারতের সংশ্লিষ্টতা দেখতে পাচ্ছে না, তখন এটা বলাই বাহুল্য যে, পশ্চিমারা ভারত-ঘেঁষা নীতিতেই অটল থাকবে। কারণ বালুচিস্তানের গেরিলাদেরকে পশ্চিমারা সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়েছে। এখন এই সংগঠনগুলির সাথে ভারতের সংশ্লিষ্টতা মেনে নেয়ার অর্থ হলো ভারত সন্ত্রাসবাদের ইন্ধনদাতা। আর বালুচিস্তানে চীনের কৌশলগত প্রকল্পে কাজ করা চীনা নাগরিকদের উপর হামলার ব্যাপারটা ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানের গোয়াদরে চীনের কৌশলত সমুদ্রবন্দর তৈরিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত কেউই ভালো চোখে দেখেনি। চীনাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা যেন একপ্রকার গ্রীন লাইটই পাচ্ছে পশ্চিমাদের কাছ থেকে। হাজার হলেও চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বড় বন্ধু। তবে সন্ত্রাসী হামলার এই ঘটনাগুলি যে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যায় না তা হলো, পাকিস্তান রাষ্ট্র তার জনগণের মৌলিক চাহিদা পুরণে যথেষ্ট যত্নবান হয়নি কখনোই। এছাড়াও পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতিগত বৈষম্যকেই প্রাধান্য দিয়েছে সর্বদা। একারণেই যুগ যুগ ধরে পুরো পাকিস্তান জুড়ে অস্থিরতা তৈরির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ভারতীয়রা এই অস্থিরতায় ইন্ধন যুগিয়েছে মাত্র।

Monday, 17 March 2025

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন – ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বব্যবস্থার আরও প্রমাণ

১৭ই মার্চ ২০২৫

মার্চ ২০২৫। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন উন একটা শিপইয়ার্ডে সে সাবমেরিন তৈরি প্রত্যক্ষ করতে যান। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন প্রকল্পের সাথেসাথে প্রশান্ত মহাসাগরে দু'টা দেশের নৌবাহিনীতে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন যুক্ত হতে যাচ্ছে। অপরটা হলো অস্ট্রেলিয়া। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে 'অকাস' চুক্তির মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের যুগ শুরু হয়েছিল। তখন যারা 'অকাস' চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, তারা সকলেই এখন পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন যোগাড় করতে ছুটবে। প্রশান্ত মহাসাগরের পারমাণবিকীকরণ ধ্বংসপ্রপ্ত বিশ্বব্যবস্থায় আসন্ন সংঘাতের জানান দিচ্ছে মাত্র!


গত ৮ই মার্চ উত্তর কোরিয়ার সরকারি মিডিয়া 'কোরিয়া সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি' খবর প্রকাশ করে যে, উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরি করছে; যা কিনা কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন উন একটা শিপইয়ার্ডে সে সাবমেরিন তৈরি প্রত্যক্ষ করতে যান। দক্ষিণ কোরিয়ার 'হানইয়াং ইউনিভার্সিটি'র প্রফেসর এবং সেদেশের নৌবাহিনীর সাবেক সাবমেরিন কর্মকর্তা মুন কিউন-সিক 'সিএনএন'কে বলছেন যে, তার ধারণা এই সাবমেরিনটা ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টনের হতে পারে। কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র বলতে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বোঝানো হয়েছে। ১০টা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হয়তো এরকম একটা সাবমেরিন বহণ করতে সক্ষম হতে পারে। ২০২১এর শুরুতে অস্টম ওয়ার্কার্স পার্টি কংগ্রেসে কিম জন উন বলেছিলেন যে, তার দেশ পারমাণবিক সাবমেরিন, ‘সলিড ফুয়েল' আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, গোয়েন্দা স্যাটেলাইট এবং 'মাল্টি ওয়ারহেড' ক্ষেপণাস্ত্র পাবার জন্যে কাজ করছে। সেই সময় থেকে উত্তর কোরিয়া এই প্রযুক্তির বিভিন্ন রকম পরীক্ষা চালিয়েছে। এসকল প্রযুক্তি উত্তর কোরিয়া কিভাবে পেলো, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। মুন কিউন-সিক মনে করছেন যে, ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে সেনা ও রসদ সরবরাহের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে এসকল প্রযুক্তি পেয়েছে। উত্তর কোরিয়া হয়তো আগামী এক থেকে দুই বছরের মাঝেই এই সাবমেরিন পানিতে ছাড়বে। ২০১৬ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া পানির নিচ থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরীক্ষা চালিয়ে আসছে। এই পরীক্ষাগুলি করা হচ্ছিলো ২ হাজার টনের একটা পরীক্ষামূলক সাবমেরিন থেকে।

মার্কিন নৌবাহিনীর 'অফিস অব নেভাল ইন্টেলিজেন্স' বা 'ওএনআই'এর প্রাক্তন প্রধান অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার এডমিরাল মাইক স্টুডেম্যান নিরাপত্তা বিষয়ক ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'কে বলছেন যে, এটা জানাই ছিল যে, উত্তর কোরিয়া পাঁচ বছরের মাঝে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন পেতে চাইছে, যেটা কৌশলগত অস্ত্র বহণ করতে সক্ষম হবে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়া পানির নিচ থেকে উৎক্ষেপিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এর মাঝে কিছু ছিল স্বল্প পাল্লার; যেগুলি সর্বোচ্চ ৫'শ থেকে ৬'শ কিঃমিঃএর বেশি যেতে পারবে না। তবে পরবর্তীতে তারা একটা ভার্সন তৈরি করেছে যেটার পাল্লা ২ থেকে আড়াই হাজার কিঃমিঃ হতে পারে। 'পুকগুকসং-৫' নামের সর্বশেষ প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩ হাজার কিঃমিঃ পর্যন্ত হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার পশ্চিমে পীত সাগরের গভীরতা দেড়'শ ফুটের বেশি নয়; তবে পূর্বের জাপান সাগরের গভীরতা ৫ হাজার ফুটের বেশি। জাপান সাগর থেকে এরকম একটা সাবমেরিন ৩ হাজার কিঃমিঃ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানতে পারবে।
 
২৪শে এপ্রিল ২০১৬। ২০১৬ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া পানির নিচ থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরীক্ষা চালিয়ে আসছে। উত্তর কোরিয়ার জন্যে আপাততঃ সীমিত পরিসরে 'সেকেন্ড স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি' (নিজ ভূমিতে শত্রুর হামলায় নিজের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ধ্বংস হয়ে গেলেও শত্রুকে প্রত্যুত্তর দিতে পারা) ডেভেলপ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। পিয়ং ইয়ং যদি সাগরকে ব্যবহার করে ভিন্ন একটা দিক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার সক্ষমতা পেয়ে যায়, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কিছুটা হলেও কঠিন হবে।


মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি' বা 'সিআইএ'র প্রাক্তন ইস্ট-এশিয়া অপারেশন্সএর ডিরেক্টর জোসেফ ডেট্রানি 'সাইফার ব্রীফ'কে বলছেন যে, ২০২১ সাল থেকেই জানা ছিল যে, উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক সাবমেরিন পেতে চাইছে। এরপর ২০২৪ সালে কিম জং উন রাশিয়ার ভ্লাডিভস্টকে রুশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্লিট ভিজিট করেন। তাই তাদের হাতে পারমাণবিক সাবমেরিন দেখে অবাক হবার কিছু নেই। উত্তর কোরিয়া নিয়ে যেকোন খবর এলেই সকলে হাই তোলেন এবং ভিন্ন দিকে মুখ ফিরিয়ে নেন। কিন্তু এখানে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তিত হবার কারণ রয়েছে শুধুমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের কারণেই নয়, রাশিয়ার সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কের কারণেও।

'ওএনআই'এর এডমিরাল স্টুডেম্যান বলছেন যে, উত্তর কোরিয়া নিশ্চিত করতে চাইছে যে, কোন শক্তিশালী রাষ্ট্র যাতে উত্তর কোরিয়ার উপর হামলা করে না বসতে পারে। এটা নিশ্চিত করতেই তারা হয়তো রাশিয়ার কাছে পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রযুক্তি চেয়েছে। বিনিময়ে তারা হয়তো ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সৈন্য ও রসদ দিয়ে সহায়তা করেছে। ‘সিআইএ'এর জোসেফ ডেট্রানি বলছেন যে, উত্তর কোরিয়া 'হোয়াসং-১৯' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র যা পারতো না, তা এখন পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের মাধ্যমে তারা অর্জন করতে যাচ্ছে। এছাড়াও উত্তর কোরিয়া স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। এগুলির প্রযুক্তি তারা নিঃসন্দেহে রাশিয়া থেকে পেয়েছে। 'হোয়াসং-১৯' ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু প্রযুক্তিও উত্তর কোরিয়া হয়তো রাশিয়া থেকেই পেয়েছে।
 
১৯শে অক্টোবর ২০২১। সাবমেরিন থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির খবর মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বিচলিত করেছে। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া যে রাশিয়ার কাছ থেকে কৌশলগত প্রযুক্তি পেয়েছে, সেব্যাপারে যেমন সকলেই একমত, তেমনি গত এক দশকের মাঝে উত্তর কোরিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্র যে তার সকল প্রভাব হারিয়েছে, এই ঘটনা তার প্রমাণ। আর এটাও এখন নিশ্চিত যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যে প্রশান্ত মহাসাগরের ভূরাজনীতিকেও প্রভাবিত করতে পারে, সেটাও যুক্তরাষ্ট্র আগে বুঝতে পারেনি। 


মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন এডমিরাল জেমস স্টাভরাইডিস নিরাপত্তা ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'কে বলছেন যে, ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে ১২ হাজার সেনা এবং রসদ সরবরাহ করার পুরষ্কার হিসেবে রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে ইন্টেলিজেন্স এবং প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। এর মাঝে হয়তো পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের প্রযুক্তি সহ পারমাণবিক অস্ত্রের প্রযুক্তিও থাকতে পারে। এই সাবমেরিনগুলিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকবে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত নয়; তবে এগুলি নিঃসন্দেহে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করবে। আর পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন হলো সমুদ্রের সবচাইতে মারাত্মক শিকারী। এরকম একটা সাবমেরিন যদি কিম জং উনের হাতে পড়ে, তা সকলকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবে। তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের সাথে কোন সংঘাত হলে উত্তর কোরিয়ার এই সাবমেরিনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা করতে হবে। কারণ এই সাবমেরিন হয়তো তখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে বিভাজিত করে ফেলতে পারবে। এর চাইতেও বড় সমস্যা হলো, যদি এরকম একটা সাবমেরিন প্রশান্ত মহাসাগরে বের হয়ে পার্ল হারবার, বা লস এঞ্জেলেস বা ওয়াশিংটন স্টেটের উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান নেয়, আর এতে যদি পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থাকে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভয়াবহ হুমকি তৈরি করবে। কারণ একটা পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন প্রায় অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পানির নিচে অবস্থান করতে সক্ষম।

তবে 'ওএনআই'এর এডমিরাল মাইক স্টুডেম্যান বলছেন যে, এরকম একটা সাবমেরিনের প্রশান্ত মহাসাগরে বেরিয়ে আসা এতটা সহজ নয়। কারণ তাকে তখন জাপান এবং রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা দ্বীপগুলির মাঝ দিয়ে মহাসাগরে প্রবেশ করতে হবে। আপাততঃ মনে হচ্ছে যে, উত্তর কোরিয়ার জন্যে মহাসাগরে যাওয়াটা অনেক বড় পদক্ষেপ হবে। উত্তর কোরিয়ার জন্যে আপাততঃ সীমিত পরিসরে 'সেকেন্ড স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি' (নিজ ভূমিতে শত্রুর হামলায় নিজের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ধ্বংস হয়ে গেলেও শত্রুকে প্রত্যুত্তর দিতে পারা) ডেভেলপ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। পিয়ং ইয়ং যদি সাগরকে ব্যবহার করে ভিন্ন একটা দিক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার সক্ষমতা পেয়ে যায়, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কিছুটা হলেও কঠিন হবে। তিনি বলছেন যে, এরকম একটা প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো হাতে পাবার পর উত্তর কোরিয়া হয়তো দুই-তিন বছর সেটা নিয়ে পরীক্ষা করবে। তারা সেটাকে কতদূর পর্যন্ত নিতে পারবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যদি উত্তর কোরিয়া সার্বক্ষনিকভাবে 'সেকেন্ড স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি' রাখতে চায়, তাহলে তাদের ৩ থেকে ৫টা সাবমেরিন প্রয়োজন হবে। কারণ একটাকে সমুদ্রে রাখতে হলে বাকিগুলিকে মেইনটেন্যান্সের কোন না কোন পর্যায়ে থাকতে হবে। এটা সম্ভব করতে হলে হয়তো ১০ বছর লেগে যেতে পারে।
 
মার্চ ২০২৫। উত্তর কোরিয়ার সাবমেরিনটা ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টনের হতে পারে।  ডোনাল্ড ট্রাম্প কিম জন উনএর সাথে আলোচনা করেছিলেন ২০১৮ সালে। গত চার বছরে উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র কোন কথা বলেনি। একারণেই কিম জন উন যুক্তরাষ্ট্রের উপর সকল আশা ছেড়ে দিয়ে তার দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রধান শত্রু হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছেন।


এডমিরাল স্টাভরাইডিস মনে করেন যে, চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক আস্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মতো। কাজেই উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন যাওয়াতে চীনের চিন্তার কোন কারণ থাকার কথা নয়। তিনি বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন দেয়ার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন যে 'অকাস' চুক্তি করেছে, সেই চুক্তিতে জাপানকে ঢোকানো যেতে পারে। যদিও জাপান পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে অনিচ্ছুক, তথাপি উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমাণবিক সাবমেরিন জাপানকে তাদের চিন্তা পরিবর্তনে প্রভাবিত করতে পারে। তবে 'ওএনআই'এর এডমিরাল স্টুডেম্যান বলছেন যে, উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমাণবিক সাবমেরিন চীনের জন্যে সুখকর বিষয় নয়। এতে পিয়ং ইয়ংএর উপর চীনের প্রভাব নিঃসন্দেহে কমে যাচ্ছে; এবং উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার বলয়ে প্রবেশ করছে। উত্তর কোরিয়া এখন চীনের বদলে রাশিয়া থেকেও প্রায় সকল দ্রব্যের সরবরাহ পাচ্ছে। চীনারা হয়তো নিজেদেরকে প্রশ্ন করবে যে, কোন ঘাটতির কারণে তারা উত্তর কোরিয়াকে নিজেদের বলয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি মনে করছেন যে, উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনরূপ শান্তিচুক্তির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ওয়াশিংটন ও পিয়ং ইয়ংএর মাঝে সম্পর্কে এখন কোন বিশ্বাস নেই। উত্তর কোরিয়া চেয়েছিল আলোচনার মাধ্যমে তাদের উপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ সরিয়ে নিতে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে এমন কিছু দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ফলশ্রুতিতে এখন উত্তর কোরিয়া রাশিয়া থেকেই অনেক কিছু পাচ্ছে এবং তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার গুরুত্ব এখন একেবারেই নেই।

‘সিএইএ'র জোসেফ ডেট্রানি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সবচাইতে বড় ভুল ছিল বুঝতে না পারা যে, কিম জং উন পুতিনের দিকে ঘুরে যাচ্ছেন। একইসাথে ডেট্রানি বলছেন যে, তিনি নিজে ইউক্রেন যুদ্ধে ১২ হাজার উত্তর কোরিয় সেনা দেখে মনে করেছিলেন যে, সেটা ছিল প্রতিকী। কিন্তু সেটা তার ভুল বিশ্লেষণ ছিল; বরং সেটা ছিল পুরোপুরিভাবে কৌশলগত ব্যাপার। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিম জন উনএর সাথে আলোচনা করেছিলেন ২০১৮ সালে। গত চার বছরে উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র কোন কথা বলেনি। একারণেই কিম জন উন যুক্তরাষ্ট্রের উপর সকল আশা ছেড়ে দিয়ে তার দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রধান শত্রু হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছেন। জোসেফ ডেট্রানি মনে করছেন যে, এখনও উত্তর কোরিয়ার সাথে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক অসম্ভব নয়। উত্তর কোরিয়ার উপরে অবরোধ কমানোর ব্যাপারে কথা বলা যাবে। যদিও এটা দাবি করাটা বোকামি হবে যে, উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাথে কথা বলতে রাজি হবে। তবে এখন উত্তর কোরিয়াকে আলোচনায় বসানো অপেক্ষাকৃত কঠিন হলেও পুতিনের সাথে ট্রাম্পের সম্পর্ক এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পুতিন হয়তো কিম জং উনকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় বসতে প্রভাবিত করতে পারেন। এতদিন চীন এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেনি। কারণ চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বদাই অবনতির দিকে গিয়েছে। তিনি বলছেন যে, তার বিশ্বাস কিম জন উনের কাছে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে আলোচনার দিকে যেতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা হলেও ছাড় দিতে হবে। চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার ৯০ শতাংশ বাণিজ্য থাকলেও এখন উত্তর কোরিয়া তার অনেক কিছুই রাশিয়া থেকে পাচ্ছে; এমনকি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও স্যাটেলাইট তৈরির সহায়তাও আসছে সেখান থেকে। এগুলি চীনের জন্যে যথেষ্টই বিচলিত হবার কারণ। হয়তো চীনারা এখন ভাববে যে, গত চার বছরে তারা উত্তর কোরিয়াকে বাইডেন প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বসার জন্যে উপদেশ দিলে সেটা ভালো হতো। হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক কেমন হবে, সেসম্পর্কেও চীন এখন নিশ্চিত হতে পারবে না। চীনারা হয়তো এখন চিন্তা করবে যে, ভূকৌশলগত দিক থেকে উত্তর কোরিয়ার উপর চীনের প্রভাব কমে যাবার ব্যাপারটাকে তারা কিভাবে পুনরুদ্ধার করবে।
 
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব কতটা হারিয়েছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। উত্তর কোরিয়াকে বিরত করার একমাত্র কার্ড এখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই ঘটনায় চীনের বিচলিত হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণে এতে উত্তর কোরিয়ার উপর চীনের প্রভাব কমে গিয়ে রাশিয়া সেই জায়গা নিয়েছে। অপরদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির আলোচনার মাঝে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সম্ভাবনা এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য সম্পর্কের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা চীনাদেরকে ধোঁয়াশার মাঝে রাখবে। 


উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির খবর মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বিচলিত করেছে। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া যে রাশিয়ার কাছ থেকে কৌশলগত প্রযুক্তি পেয়েছে, সেব্যাপারে যেমন সকলেই একমত, তেমনি গত এক দশকের মাঝে উত্তর কোরিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্র যে তার সকল প্রভাব হারিয়েছে, এই ঘটনা তার প্রমাণ। আর এটাও এখন নিশ্চিত যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যে প্রশান্ত মহাসাগরের ভূরাজনীতিকেও প্রভাবিত করতে পারে, সেটাও যুক্তরাষ্ট্র আগে বুঝতে পারেনি। এই সময়ের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব কতটা হারিয়েছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। উত্তর কোরিয়াকে বিরত করার একমাত্র কার্ড এখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই ঘটনায় চীনের বিচলিত হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণে এতে উত্তর কোরিয়ার উপর চীনের প্রভাব কমে গিয়ে রাশিয়া সেই জায়গা নিয়েছে। অপরদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির আলোচনার মাঝে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সম্ভাবনা এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য সম্পর্কের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা চীনাদেরকে ধোঁয়াশার মাঝে রাখবে। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, তা হলো, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন প্রকল্পের সাথেসাথে প্রশান্ত মহাসাগরে দু'টা দেশের নৌবাহিনীতে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন যুক্ত হতে যাচ্ছে। অপরটা হলো অস্ট্রেলিয়া। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে 'অকাস' চুক্তির মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের যুগ শুরু হয়েছিল। তখন যারা 'অকাস' চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, তারা সকলেই এখন পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন যোগাড় করতে ছুটবে। প্রশান্ত মহাসাগরের পারমাণবিকীকরণ ধ্বংসপ্রপ্ত বিশ্বব্যবস্থায় আসন্ন সংঘাতের জানান দিচ্ছে মাত্র!