Sunday 10 October 2021

কানাডার সাথে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা চুক্তি কি আসন্ন?

১০ই অক্টোবর ২০২১

ছবিঃ ২০১৮ সালের মার্চ। ব্রিটিশ রয়াল নেভির পারমাণবিক সাবমেরিন ‘ট্রেনচ্যান্ট’ আর্কটিকের বরফ ফুঁড়ে উঠে এসেছে। ব্রিটেন তার পারমাণবিক সাবমেরিন সক্ষমতাকে কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যে ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু এত কাছের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও কানাডার সাথে আর্কটিকের ‘নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ’এর সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব রয়েছে। একারণেই কানাডা ব্রিটেনের প্রস্তাবের ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

 
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কানাডার মিডিয়া ‘সিবিসি’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কানাডার সর্বউত্তরের উত্তর মেরুর কাছাকাছি অতিশীতল অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্রিটেন তার সামরিক সক্ষমতাকে কানাডার সহায়তায় মোতায়েন করতে চাইছে; বিশেষ করে ব্রিটেন তার পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনগুলিকে উত্তরাঞ্চলে নজরদারি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে কানাডার সহায়তায় ব্যবহার করতে চাইছে। ‘সিবিসি’র সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল নিক কার্টার বলেন যে, ব্রিটেন কানাডার উত্তরাঞ্চলে বেঁচে থাকা এবং যুদ্ধ করার ব্যাপারে শিখতে ইচ্ছুক; এবং তারা সেই হিসেবে কানাডার সাথে সহযোগিতার জন্যে যথেষ্ট আগ্রহী। আর্কটিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কানাডাকে যা যা করতে হবে, ব্রিটেন সেই ব্যাপারগুলিতে সহযোগিতা করতে চায়। নিক কার্টারের এই প্রস্তাবখানা প্রকৃতপক্ষে কয়েক মাস আগেই কানাডার সরকারি বিভিন্ন মহলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, কানাডার কোন সরকারই আর্কটিক অঞ্চলে কোন রাষ্ট্রকেই অবস্থান নিতে দেয়নি; এমনকি সবচাইতে কাছের বন্ধু রাষ্ট্রগুলিকেও। এর মূল কারণ হলো কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব নিয়ে অনেকগুলি দেশের মাঝে প্রতিযোগিতা রয়েছে। তবে ‘সিবিসি’ বলছে যে, কানাডার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ড্যানিয়েল মিনডেন এক ইমেইলে ব্রিটেনের এই প্রস্তাবের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাননি।

তবে ‘সিবিসি’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে সাম্প্রতিক ‘অকাস’ প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে কানাডার বাদ পড়ার ব্যাপারটা হয়তো ব্রিটেনের প্রস্তাবের ব্যাপারে কানাডাকে নতুন করে ভাবাবে। ন্যাটোর সদস্য হিসেবে ব্রিটেন এবং কানাডা নিয়মিত নরওয়েতে শীতকালীন মহড়ায় অংশ নেয়। আর কানাডার এলবার্টা রাজ্যের সাফিল্ডের বিশাল ভূখন্ডে ব্রিটেন বহু বছর ধরে তার সেনাবাহিনীর আর্মার্ড এবং কম্বাইন্ড অপারেশনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডার বন্ধু রাষ্ট্রগুলি আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার নতুন করে সামরিক অবস্থান শক্তিশালীকরণ এবং সেই অঞ্চলে চীনের মতো প্রতিযোগী রাষ্ট্রের কর্মকান্ড বৃদ্ধির ব্যাপারে কথা বলছে।

কানাডার আর্কটিকের নিরাপত্তা

২০০৬ সালে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিভেন হারপারএর কনজারভেটিভ সরকার আর্কটকের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। এই হিসেবে আর্কটিক অফশোর প্যাট্রল শিপ প্রকল্পের সূচনা করে কানাডা সরকার। ২০১১ সালে ছয় থেকে আটটা জাহাজ তৈরির এই প্রকল্প শুরু করা হয়, যেগুলি বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে চলাচল করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এই প্রকল্পের বাজেট যোগাড় করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে জাহাজ নির্মাণ শুরু হয়। ‘হ্যারি ডে উলফ ক্লাস’এর সাড়ে ৬ হাজার টনের এই জাহাজগুলি গত ৫০ বছরে কানাডায় তৈরি সবচাইতে বড় সামরিক জাহাজ। ২০২১ সাল পর্যন্ত দু’টা জাহাজ তৈরি শেষ হয়েছে। এই জাহাজগুলির সহায়তায় কানাডার উত্তরের বাফিন দ্বীপের নুনাভুত এলাকায় ‘নানিসিভিক নেভাল ফ্যাসিলিটি’ তৈরি করা শুরু হয়। এখান থেকে জাহাজগুলি জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এই জাহাজগুলি এবং নতুন সামরিক স্থাপনা কানাডার উত্তরের পানির নিচের নজরদারি এবং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নজরদারির চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান দেয় না। এখানেই কানাডার সহায়তায় আসতে চাইছে ব্রিটেন।

‘সিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ব্রিটেনের সেটাই রয়েছে যা কানাডার নেই; আর তা হলো পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন; যা কিনা বরফের নিচে লম্বা সময় থাকতে পারে। কানাডা ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৮০এর দশকে তৈরি চারটা ডিজেল সাবমেরিন কেনে ১৯৯০এর দশকের শেষের দিকে। তারা চেয়েছিল এই সাবমেরিনগুলিকে আরও উন্নত করে সেগুলির বরফের নিচে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে। কিন্তু সেই পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আর্কটিক অঞ্চলে রুশ সাবমেরিনের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্চ মাসে রাশিয়ার তিনটা সাবমেরিন একই সময়ে আর্কটিকের বরফ ফুঁড়ে উপরে উঠে আসে। কানাডার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগারি’র প্রফেসর রব হিউবার্ট প্রশ্ন করছেন যে, কানাডার কি সক্ষমতা রয়েছে রুশ এবং চীনা সাবমেরিন মোকাবিলা করার? তিনি বলছেন যে, ব্রিটিশরা সর্বপ্রথমে এই সক্ষমতাটাই আর্কটিকে নিয়ে আসছে। হিউবার্ট বলছেন যে, কানাডা আর্কটিকে তার সবচাইতে কাছের বন্ধুদেরও অবস্থান দিতে নারাজ। কারণ ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই কানাডার উত্তরাঞ্চলের আর্কটিক দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যাওয়া ‘নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ’এর সার্বভৌমত্ব কানাডার বলে স্বীকার করে না। এই প্যাসেজের মাধ্যমে আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে যাতায়াত করা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আর্কটিকে ব্যাপকভাবে বরফ গলতে থাকায় এই রুটে জাহাজ চলাচল নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালে কানাডার কোস্ট গার্ড এই প্যাসেজের মাঝ দিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক জাহাজ ‘ক্যামিলিয়া দেসগাগনেস’এর চলাচল নিশ্চিত করে। ২০১৩ সালে ‘নরডিক ওরাইয়ন’ নামের একটা কয়লাবাহী জাহাজ কানাডার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের ভ্যাঙ্কুভার থেকে সাড়ে ৭৩ হাজার টন কয়লা নিয়ে ‘নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ’ ব্যবহার করে ৩৩ দিনের মাঝে ইউরোপের ফিনল্যান্ডে পৌঁছে। বেশি গভীরতার হবার কারণে এই ওজন নিয়ে জাহাজটার পানামা খাল অতিক্রম করতে পারার কথা ছিল না। ২০১৬ সালে ‘ক্রিস্টাল সেরেনিটি’ নামের একটা যাত্রীবাহী ক্রুজ শিপ ১৭’শ যাত্রী নিয়ে এই প্যাসেজ অতিক্রম করে।

‘কানাডিয়ান গ্লোবাল এফেয়ার্স ইন্সটিটিউট’এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেইভ পেরি বলছেন যে, ব্রিটিশদের প্রস্তাব বলে দিচ্ছে যে, আর্কটিক অঞ্চলে কানাডার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে হবে; যা জাস্টিন ট্রুডোর অধীন বর্তমান লিবারাল সরকারের জন্যে একটা ঘুম থেকে জেগে ওঠার ডাক। তিনি আরও বলছেন যে, ‘অকাস’ চুক্তি দেখিয়ে দিচ্ছে যা কানাডার সবচাইতে কাছের বন্ধু রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মাঝে আরও কাছাকাছি এবং আরও ছোট ক্লাব তৈরি করছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এমন বন্ধু চাইছে যারা অন্ততঃ নিজেদের ওজন বহন করতে সক্ষম।

 
ছবিঃ কানাডিয়ান বিমান বাহিনীর ‘সিএফ ১৮’ যুদ্ধবিমান। ১৯৮৩ সাল থেকে এই বিমানগুলি উড়ছে। বিশ্বব্যাপী বহু মিশনে এই বিমানগুলি ব্যবহৃত হলেও এগুলিকে প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে কানাডার কোন সরকারই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। হয়তো তা কানাডার প্রতিরক্ষা চিন্তারই ফসল। কানাডা হলো একটা অগ্নিনিরোধক বাড়ি; যা দাহ্য বস্তু থেকে বহু দূরে।


কানাডা হলো অগ্নিরিরোধক বাড়ি

‘দ্যা কনভারসেশন’এর এক লেখায় ‘কানাডিয়ান ফোর্সেস কলেজ’এর প্রফেসর পল টি মিচেল ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, কানাডিয়রা তাদের নিরাপত্তাকে কিভাবে দেখে। ১৯২৪ সালে কানাডার রাজনীতিবিদ রাউল ডানডুরান্ড বলেন যে, কানাডা হলো একটা অগ্নিনিরোধক বাড়ি; যা দাহ্য বস্তু থেকে বহু দূরে। তিনি প্রকৃতপক্ষে ১৮৬৭ সাল থেকে কানাডার প্রতিরক্ষা চিন্তাকেই তুলে ধরেন। সহজ কথা বলতে গেলে, তিনটা মহাসাগরের মাঝে অবস্থান এবং একটা সুপারপাওয়ারের পাশে থাকার কারণে কানাডিয়দের নিজেদের প্রতিরক্ষা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। ১৯৫০এর দশক থেকেই কানাডার সকল সরকারের প্রতিরক্ষানীতির মূল কর্মকান্ড ছিল তিনটা; কানাডাকে রক্ষা করা; উত্তর আমেরিকাকে রক্ষা করা; এবং আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তায় সহায়তা করা। এই ব্যাপারগুলি এতটাই অপরিবর্তনীয় রয়েছে যে, সাম্প্রতিক নির্বাচনেও প্রতিরক্ষার ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কোন কথাই বলেনি। অনেকেই মনে করেন যে, কানাডার প্রকৃতপক্ষে কনস্টাবুলারি বাহিনী ছাড়া আর কিছুর দরকার নেই; যাদের কাজ হবে বনের দাবানল থামানো এবং মানুষকে বিপদে উদ্ধার করা। কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই সক্ষমতা আছে কানাডাকে আক্রমণ করার। এটা হয়তো বাস্তবে হবে না; তবে যদি এটা হয়েই যায়, তাহলে মিচেলের ব্যাখ্যা হলো, কানাডা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহায়তার আবেদন জানাবে।

১৯৫০এর দশক থেকেই কানাডা তার সামরিক সক্ষমতা কমাচ্ছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে কানাডার বিমান বাহিনীর ‘সিএফ ১৮’ যুদ্ধবিমানগুলিকে প্রতিস্থাপনের গুরুত্ব বোঝা গেলেও সকল সরকারই এই বিমানগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছে। এমনকি প্রতিরক্ষা নিয়ে বেশি চিন্তিত কনজারভেটিভ সরকারও এব্যাপারে কিছু করতে পারেনি। অথচ যুগে যুগে কানাডা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং এই বিমানগুলিই সার্ভিস দিয়ে গেছে। ১৯৮৩ সালে কানাডার বিমান বাহিনী ১’শ ৩৮টা ‘সিএফ ১৮’ বিমান সংগ্রহ শুরু করে। বিমানগুলি ১৯৯১ সালে ইরাক যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এরপর ১৯৯০এর দশকে কসভোতে; ২০১১ সালে লিবিয়াতে; এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আইসিসের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে ব্যবহারের পরে এখন মাত্র ৮৫টার মতো বিমান সার্ভিসে রয়েছে। এই বিমানগুলিকে আরও সময় সার্ভিসে রাখার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার বিমান বাহিনী থেকে রিটায়ার করা একই ধরনের ১৮টা বিমান এর সাথে যুক্ত করা হয়।

কানাডা তার সামরিক সক্ষমতা কমাতে থাকলেও তার বৈশ্বিক দায়িত্ব থেকে সে সড়ে আসেনি। কাজেই বিভিন্ন সময়ে কানাডা যুদ্ধে জড়িয়েছে; এবং প্রতিবারই কানাডার সামরিক বাহিনী সেই দায়িত্ব পালনের জন্যে তৈরি ছিল না। কারণ কানাডিয়রা মনে করেছে যে, তাদের সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে চিন্তার দরকার নেই। পল মিচেল বলছেন যে, কানাডিয়দের এহেন চিন্তার ফলে বর্তমান আইনের শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে রক্ষার ব্যাপারে কানাডিয়দের কতটা সদিচ্ছা রয়েছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অর্থাৎ সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষার পিছনে কানাডার চেষ্টার ঘাটতি রয়েছে।

সেপ্টেম্বর ২০২১; নির্বাচনে জয়লাভ করেছে জাস্টিন ট্রুডোর লিবারাল পার্টি। ১৯৫০এর দশক থেকে কানাডার কোন নির্বাচনেই প্রতিরক্ষা কোন আলোচ্য বিষয়বস্তুই ছিল না। বিশেষ করে ২০২০ সালে লিবারাল সরকার কানাডার জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিয়মিত বিরোধের মাঝে রয়েছে।



কানাডার লিবারাল সরকার এবং প্রতিরক্ষা বাজেট

জ্যেষ্ঠ কানাডিয় সাংবাদিক এবং মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো ডাইএন ফ্রান্সিস ‘ফিনানশিয়াল পোস্ট’এর লেখায় কানাডার প্রতিরক্ষানীতির ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি বলছেন যে, কানাডার আর্কটিকে রুশ এবং চীনা হুমকি মোকাবিলায় কানাডা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র কিছু দায়িত্ব নিয়েছে; আর ব্রিটিশরাও এখন এখানে জড়িত হতে চাইছে। প্রশান্ত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়া চীনের হুমকি বুঝতে পেরেছে বলেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সাথে চুক্তি করেছে এবং আটটা পারমাণবিক সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু কানাডা এখনও চীনের হুমকি মোকাবিলায় চিন্তা করছে না। একইসাথে আর্কটিকে কানাডার সক্ষমতা একেবারেই যথেষ্ট নয়। আর লিবারাল সরকার প্রতিরক্ষা বাজেট যেমন একেবারেই কমিয়ে রেখেছে, তেমনি আর্কটিক অঞ্চলও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রতিরক্ষার ব্যাপারে কানাডার সিদ্ধান্তহীনতা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। শুধু তাই নয়, ন্যাটোর মাঝে কানাডার অবস্থান সন্মানজনক নয়। ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের সদস্যরা মনে করে যে, কানাডার ইন্টেলিজেন্সের উপর নির্ভর করা যায় না; কারণ তারা তথ্য গোপন রাখতে অক্ষম। ফ্রান্সিস বলছেন যে, কানাডার সবচাইতে কাছের বন্ধুরা কানাডার নিরাপত্তা নিজেদের হাতে নিতে চাইছে; কারণ কানাডার লিবারাল সরকার সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতো কাজ করতে চাইছে না।

কানাডার প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রকল্প ‘নেটওয়ার্ক ফর স্ট্র্যাটেজিক এনালিসিস’এর এক লেখায় মাক্সান্ড্রে ফোর্টিয়ের ব্রিটেন এবং আস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ টেনে নিয়ে আসছেন। তিনি বলছেন যে, কানাডার উচিৎ এই দুই দেশের মতো নিজেদের উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে চিন্তা করা। ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়া তাদের আকাংক্ষা বাস্তবায়নে যা দরকার সেগুলি যোগাড় করায় মনোনিবেশ করেছে। করোনাভাইরাসের মাঝে অর্থনৈতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও এবং অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে মারাত্মক ক্ষতির পরেও এই দেশগুলি ন্যাটোর ঠিক করে দেয়া জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করেছে। প্রতিরক্ষার পিছনে কম খরচ করাটা কানাডার সাথে তার বন্ধু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার কারণ। তিনি ২০২০ সালের একটা জনমত জরিপের বরাত দিয়ে বলছেন যে, কানাডার জনগণ এখন সামরিক বাহিনীতে বিনিয়োগ করার পক্ষে। কাজেই এখন কানাডার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় না করাটা অর্থহীন। উল্লেখ্য যে, কানাডার লিবারাল সরকার ২০২০ সালে কানাডার জিডিপির ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করেছে।

‘রয়াল মিলিটারি কলেজ অব কানাডা’র প্রফেসর প্রাক্তন সামরিক অফিসার রস ফেটারলি কানাডার রাজনীতিতে সামরিক বাজেটের বিষয়টাকে নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলছেন যে, প্রতিরক্ষার বিষয়গুলি সবসময়ই দীর্ঘমেয়াদি এবং কানাডিয়দের কাছে এর সুবিধাগুলি সরাসরি নয়। অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলি এমন ইস্যুগুলি নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে, যেগুলি মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। নির্বাচনে জেতার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলি সর্বদাই অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে। অথচ কানাডার বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিই কিন্তু কানাডাকে দূরে কোথাও সৈন্য প্রেরণে বাধ্য করেছে। চার বছরের জন্যে যে সরকার নিয়োগ পেয়েছে, সেই সরকারের রেখে যাওয়া সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তী দুই দশকের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হবে। কাজেই কানাডার সরকারের উচিৎ হবে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি বিচার করেই বর্তমান প্রতিরক্ষানীতিকে নতুন করে দেখা এবং এতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করা। 

কানাডা আর্কটিকে তার সবচাইতে কাছের বন্ধুদেরও অবস্থান দিতে নারাজ। কারণ ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই কানাডার উত্তরাঞ্চলের আর্কটিক দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যাওয়া ‘নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ’এর সার্বভৌমত্ব কানাডার বলে স্বীকার করে না।


‘অকাস’ চুক্তির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এখনও সবে সামনে আসছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর মাঝে অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার চিন্তাগত পার্থক্যগুলি এখনও পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান। অস্ট্রেলিয়া চীনকে যতটা হুমকি হিসেবে দেখছে, কানাডা ততটা হুমকি হিসেবে দেখছে না। নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুগুলিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে কানাডার সরকার পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষা করার আন্তর্জাতিক দায়িত্বকে দ্বিতীয় সাড়ির দায়িত্ব হিসেবে দেখেছে। একারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডা সরকারের টানাপোড়েন চলছেই। এখন এখানে ব্রিটেনও যোগ হয়েছে। কানাডার রাষ্ট্রীয় চিন্তাবিদদের মাঝে প্রতিরক্ষা বিষয়ে খরচ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে যথেষ্ট একাত্মতা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলি এখনও ভোট পাবার জন্যে অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলির উপরেই নির্ভরশীল। সুরক্ষিত ‘অগ্নি নিরোধক বাড়ি’র সাথে নিজেদের অবস্থানকে তুলনা করে কানাডিয়রা প্রতিরক্ষা খাতে নিজেদের ব্যয় বৃদ্ধি করতে চাইছে না। আবার আর্কটিক অঞ্চলে নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতা খুব কম থাকলেও সেখানে ‘নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ’এর সার্বভৌমত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সাথে দ্বন্দ্বের মাঝে রয়েছে কানাডা। একারণেই আর্কটিকের বরফের নিচে ব্রিটিশ পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েনের প্রস্তাবটা এখনও কানাডার সরকারের কাছে আলোচ্য বিষয়। ইংরেজি ভাষাভাষী ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের সদস্য হবার পরেও দেশগুলির মাঝে বিরোধ লক্ষ্যণীয়।

No comments:

Post a Comment