Wednesday 27 October 2021

ব্রিটেন কেন সামরিক প্রযুক্তি যোগাড়ে উঠেপড়ে লেগেছে?

২৭শে অক্টোবর ২০২১

ছবিঃ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর 'ব্ল্যাক হরনেট ন্যানো' ড্রোন। নিজের দুর্বলতাগুলিকে ব্রিটেন জয় করতে চাইছে ‘এআই’ প্রযুক্তির মাধ্যমে। ড্রোনের ঝাঁক, ফাইটার ড্রোন, গোয়েন্দা স্যাটেলাইট, লেজার অস্ত্র, কথা বলা ক্ষেপণাস্ত্র, মনুষ্যবিহীন বোট বা সাবমেরিন, ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ব্রিটেন ‘এআই’এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু ‘এআই’ ডেভেলপ করতে গিয়ে ব্রিটেনের যে জিনিসটা প্রথমেই দরকার তা হলো মেধা। সারা বিশ্ব থেকে মেধা আকর্ষণ করে ব্রিটেন ‘এআই মাস্টার্স’এর প্রফেশনাল তৈরি করতে চাইছে।

 
ব্রেক্সিটের পর ব্রিটিশ সরকার তাদের বৈশ্বিক কৌশল নির্ধারণ করার পর থেকে পুরো ব্রিটেন জুড়ে শুরু হয়েছে কর্মযজ্ঞ। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পুরো ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী বর্তমানে গবেষণা প্রকল্পের মাঝে ডুবে গেছে। ছোট আকৃতির মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান, মনুষ্যবিহীন গাড়ি বা পানির নিচের যান, ইত্যাদি এই গবেষণার মাঝে রয়েছে; যার কিছু রয়েছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্যে; কিছু থাকবে অস্ত্রসজ্জিত। ২০২০এর নভেম্বরে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার জেনারেল নিক কার্টার ‘স্কাই নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ২০৩০ সালের মাঝে তারা যে সামরিক বাহিনী তৈরি করতে চাইছেন, যেখানে বড় সংখ্যক স্বয়ংচালিত অথবা দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, ১ লক্ষ ২০ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনীর মাঝে ৩০ হাজারই হয়তো রোবোট হতে পারে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেন তার সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে করতে হিমসিম খাচ্ছে। ৮২ হাজার সেনার টার্গেটের তুলনায় বর্তমানে সেনা রয়েছে ৭৪ হাজারেরও কম। এখন টার্গেটকে ৭৫ হাজারের নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শূণ্যস্থানগুলির কিছু হয়তো পূরণ করা হতে পারে। তবে সেখানেও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ অনেকেই এখনও মনে করছেন যে, রোবোট হয়তো মানুষ খুন করার সিদ্ধান্ত দিতে এবং নিজে খুন করতে পারে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, রোবোটের হাতে গুলি করার সিদ্ধান্ত দেয়া হবে না। তথাপি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী এখন উন্নততর প্রযুক্তির মালিক হতে দিনরাত কাজ করতে শুরু করেছে; যেন তাদের হাতে সময় খুব বেশি একটা নেই। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ সরকার লক্ষ্য স্থির করেছে যে, ২০৩০ সালের মাঝে তারা ব্রিটেনকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বৈশ্বিক ‘সুপারপাওয়ার’ দেখতে চায়।

হাইপারসনিক এবং লেজার অস্ত্র ডেভেলপ করছে ব্রিটেন

গত মার্চে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার তাদের নতুন নীতিপত্রে নতুন ধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করতে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার বাজেট রেখেছে; যার মাঝে থাকবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং লেজার অস্ত্র। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন যখন হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপে বেশ এগিয়ে গেছে, তখন ব্রিটেনই এখানে সর্বশেষ খেলোয়াড় হিসেবে যোগ হতে চলেছে। হাইপারসনিক অস্ত্র হলো শব্দের পাঁচ গুণ বা তার চাইতেও বেশি দ্রুত চলা অস্ত্র। সাধারণ ব্যালিস্টক ক্ষেপণাস্ত্র অনেক উঁচু দিয়ে আক্রমণ করে বিধায় তা আগে থেকে দেখা যায় এবং দূরে থাকা অবস্থাতেই আটকানো যায়। কিন্তু হাইপারসনিক অস্ত্র বায়ুমন্ডলের মাঝ দিয়েই বেশিরভাগ সময় চলে বলে এটাকে আটকানো খুবই কঠিন। এধরনের অস্ত্র বা এর ইঞ্জিন ডেভেলপ করা কঠিন হলেও আরও বড় সমস্যা হলো, এত দ্রুত চালিত হলে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ক্ষেপণাস্ত্রের রাসায়নিক উপাদানগুলি পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। বাকিদের থেকে পিছিয়ে থাকলেও ব্রিটিশরা বলছে যে, তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’ ব্যবহার করে এর ডেভেলপমেন্ট দ্রুত এগিয়ে নিতে পারবে।

গত ১৪ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সরকার ১’শ মিলিয়ন ডলার বাজেটে তিনটা প্রকল্পের কাজে হাত দেয়। ‘ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন’ নামে আখ্যা দেয়া এই প্রকল্পগুলিকে সাধারণ মানুষ লেজার অস্ত্র বলেই চেনে। প্রকল্পগুলির দু’টা ব্যবহার করবে লেজার রশ্মি; বাকিটা ব্যবহার করবে ‘রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি’। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, ‘থালেস’ কোম্পানির নেতৃত্বে একটা কনসোর্টিয়াম একটা লেজার অস্ত্র তৈরি করে সেটা ব্রিটিশ রয়াল নেভির ‘টাইপ ২৩’ ফ্রিগেটের উপর পরীক্ষা করবে। ‘থালেস’এর নেতৃত্বে আরেকটা কনসোর্টিয়াম উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ব্যবহার করে একটা অস্ত্র তৈরি করবে, যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটা ট্রাকের উপর বসানো হবে। তৃতীয় প্রকল্পটা ‘রেথিয়ন’ কোম্পানির নেতৃত্বে একটা কনসোর্টিয়ামকে দেয়া হয়েছে; যারা আরেকটা লেজার অস্ত্র ডেভেলপ করে একটা সাঁজোয়া যানের উপর বসাবে। এই অস্ত্রগুলির মূল লক্ষ্য হবে শত্রুর ড্রোন বিমানগুলিকে টার্গেট করে ধ্বংস করা। প্রকল্পের কাজ ২০২৩ থেকে ২০২৫এর মাঝে শেষ হবে।

 
ছবিঃ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধরনের মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান এবং গাড়ি পরীক্ষা করছে। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার জেনারেল নিক কার্টার বলছেন যে, ২০৩০ সালের মাঝে তারা যে সামরিক বাহিনী তৈরি করতে চাইছেন, যেখানে বড় সংখ্যক স্বয়ংচালিত অথবা দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, ১ লক্ষ ২০ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনীর মাঝে ৩০ হাজারই হয়তো রোবোট হতে পারে।

ড্রোন, ড্রোন এবং আরও ড্রোন

তবে শত্রুর ড্রোন ভূপাতিত করাই নয়, নিজেদের ড্রোন ডেভেলপ করার পিছনেও মনোযোগ দিয়েছে ব্রিটেন। সামরিক ম্যাগাজিন ‘আর্মি টেকনলজি’ বলছে যে, ২০১৯এর মার্চ মাসে ব্রিটিশ ড্রোন ডেভেলপার কোম্পানি ‘ব্লু বেয়ার’ ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের নতুন এক প্রকল্পের কাজ পায়; যার মাধ্যমে তারা ছোট ও মাঝারি আকৃতির ড্রোনের ঝাঁক ডেভেলপ করা শুরু করে। এর উদ্দেশ্য হলো এই ড্রোনগুলিকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে কাজে লাগানো; এবং একইসাথে শত্রুপক্ষের আকাশ ছেয়ে ফেলে সিদ্ধান্তহীনতার জন্ম দেয়া, যাতে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাকে ছেড়ে কাকে টার্গেট করবে, সেটা ঠিক করতে না পারে। ছোট ড্রোনগুলি একদিকে যেমন স্বপক্ষের মানুষের জীবনের প্রতি হুমকি কমাবে, তেমনি হেলিকপ্টার বা এরকম কোন বিমানের স্থলাভিষিক্ত হয়ে অনেক কম খরচে মিশন সম্পাদন করবে। ড্রোনগুলি যেহেতু অনেক কম শব্দ উৎপন্ন করে, তাই সেগুলি খালি চোখে আকাশে খুঁজে পাওয়াও অপেক্ষাকৃত কঠিন হবে। ২০১৮ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘আর্মি ওয়ারফাইটিং এক্সপিরিয়েন্স ২০১৮’ মহড়ায় এটা প্রমাণিত হয় যে, সেনারা ছোট আকারের ড্রোন ব্যবহার করে বনভূমি এলাকায় শত্রুর লুকিয়ে থাকা অসম্ভব করে ফেলতে পারে।

শুধু ছোট ড্রোনের ঝাঁকই নয়, ব্রিটিশ সরকার ২০২১এর জানুয়ারিতে ‘প্রজেক্ট মসকিটো’ নামে একটা ড্রোন প্রকল্প শুরু করে। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, ৪১ মিলিয়ন ডলারের বাজেটের এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দেবে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘স্পিরিট এরোসিস্টেম’ এবং সাথে থাকবে ‘নর্থরোপ গ্রুমান’। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ২০২৩ সালের মাঝে একটা ড্রোন ফাইটার বিমান ডেভেলপ করা, যা কিনা ‘লয়াল উইংম্যান’ কনসেপ্টকে এগিয়ে নেবে। এই কনসেপ্টের মাধ্যমে একটা মনুষ্যবিহীন ড্রোন ফাইটার একটা মনুষ্যচালিত ফাইটার বিমানের সাথে একত্রে কাজ করবে এবং একে অপরের কাজকে সহায়তা করবে। ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাইক উইগস্টন বলছেন যে, ব্রিটিশরা এক যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা নিয়ে এগুচ্ছে, যার মাধ্যমে ড্রোনের ঝাঁক, ‘মসকিটো’র মতো মনুষ্যবিহীন ড্রোন ফাইটার, ভবিষ্যতের মনুষ্যচালিত ফাইটার ‘টেমপেস্ট’ মিলে যুদ্ধক্ষেত্রের হিসেবকেই পরিবর্তিত করে ফেলবে।

 
ছবিঃ ব্রিটিশ ব্যবসায়ী রিচার্ড ব্র্যানসনের 'বোয়িং ৭৪৭' বিমান থেকে রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো হচ্ছে। স্বল্প খরচে স্যাটেলাইট পাঠানোর এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করছে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেই মহাকাশে গোয়েন্দা স্যাটেলাইট প্রেরণ করতে চাইছে।

গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের জগতে পা রাখছে ব্রিটেন


শুধু ড্রোন থেকেই নয়; ব্রিটিশরা চাইছে মহাকাশ থেকেও নিজেদের গোয়েন্দাগিরি বৃদ্ধি করতে। এতকাল মহাকাশের ইন্টেলিজেন্সের জন্যে ব্রিটিশরা প্রায় পুরোপুরিভাবে মার্কিনীদের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। একটা স্যাটেলাইট ডেভেলপ করে সেটাকে মহাকাশে প্রেরণ করার বাজেট ব্রিটিশ অর্থনীতির জন্যে কঠিন ব্যাপার ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির অগ্রগামিতার কারণে ব্রিটিশদের সামনে এক নতুন দুয়ার খুলে গেছে। ব্রিটিশ বিলিয়নায়ার ব্যবসায়ী রিচার্ড ব্র্যানসন ২০২১এর জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একটা ‘বোয়িং ৭৪৭’ বিমান ব্যবহার করে স্যাটেলাইটসহ একটা রকেট মহাকাশে প্রেরণ করেন। তার কোম্পানি ‘ভার্জিন অরবিট’ বিমানটাকে পরিবর্তিত করে একটা হাল্কা রকেট বহনের উপযোগী করে। ভূমি থেকে উৎক্ষেপিত না হবার কারণে রকেটটা অনেক ছোট। প্রযুক্তিগত কারণে এখন অনেক ছোট স্যাটেলাইট তৈরি সম্ভব হচ্ছে বিধায় এই ছোট রকেট দিয়েই স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করা যাচ্ছে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২০ সালের মে মাসে আরও একবার চেষ্টা করে বিফল হয়েছিল ‘ভার্জিন’। বিমানের নিচে বহণযোগ্য এই রকেটগুলি ব্যবহার করে ব্রিটিশরা সামরিক ইন্টেলিজেন্স স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করতে চাইছে। এই স্যাটেলাইটগুলি ছোট আকারের এবং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থেকে ভূমির হাই রেজোলিউশন ছবি তুলতে পারবে। ব্রিটেন এধরনের স্যাটেলাইট ডেভেলপ করে বন্ধু দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। গত মে মাসে ‘ভার্জিন অরবিট’ ঘোষণা দেয় যে, তারা ব্রিটেনের কর্নওয়াল থেকে তাদের মহাকাশ অপারেশন শুরু করার জন্যে কাজ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইউরোপের মাটি থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হবে। এভাবে রিচার্ড ব্র্যানসনের বাণিজ্যিক প্রকল্পকে ব্রিটিশরা সামরিক ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি এগিয়ে নিতে ব্যবহার করবে। ব্রিটিশ সরকার স্কটল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে আরেকটা ‘স্পেসপোর্ট’ ডেভেলপ করার পরিকল্পনাতেও হাত দিয়েছে, যেখানে ভূমি থেকে রকেট উতক্ষেপণ করা যাবে।

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘সিফোরআইএসআরনেট’এর সাথে এক সাক্ষাতে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাইক উইগস্টন বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকার চাইছে ‘লো আর্থ অরবিট’এ স্থাপনের যোগ্য ছোট স্যাটেলাইট; যেগুলি কি বহণ করবে বা মহাকাশে কোথায় স্থাপিত হবে বা কি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে, তা ব্রিটিশরা নিজেরাই ঠিক করতে পারবে। একইসাথে তারা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মাঝেই এই স্যাটেলাইটগুলি মহাকাশে প্রেরণ করতে পারবে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন স্থানে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকার নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব স্পেস কমান্ড তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ করা জনগণকে একত্রে আনার ব্যবস্থা করেছে। এরা মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই কাজ করছিল এবং এদের স্যাটেলাইটের ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। মহাকাশে ব্রিটেনের বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই বেসরকারি খাতে হবে; সরকার এক্ষেত্রে সহায়তা দেবে মাত্র। সামরিক বাহিনী মহাকাশে ব্রিটেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলির নিরাপত্তা দেবে।

এবছরের জুলাই মাসে ব্রিটিশ সরকার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিতে নতুন এক প্রকল্প শুরু করে। ব্রিটেনের সামরিক গবেষণা সংস্থা ‘ডিফেন্স সায়েন্স টেকনলজি ল্যাবরেটরি’ বা ‘ডিএসটিএল’ প্রায় ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর মাধ্যমে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় একটা ক্ষেপণাস্ত্র আরেকটা ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। ব্রিটিশ সরকার বলছে যে, এতে ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তাদের টার্গেটের গুরুত্ব অনুসারে কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শুধুমাত্র যেখান থেকে ছোঁড়া হয়েছে, যেমন বহণকারী যুদ্ধবিমানের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম। ‘কোঅপারেটিভ স্ট্রাইক ওয়েপন্স টেকনলজি ডেমোনস্ট্রেটর’ নামে আগামী দুই বছর ধরে এই প্রকল্প চলবে।

সমুদ্রে প্রযুক্তি ডেভেলপ করছে রয়াল নেভি

ব্রিটিশ রয়াল নেভি গত মার্চ মাসে মনুষ্যবিহীন প্যাট্রোল বোট ‘ম্যাডফক্স’এর ডেলিভারি পেয়েছে। রয়াল নেভির প্রযুক্তিগত গবেষণা সংস্থা ‘নেভিএক্স’এর অধীনে পরিচালিত হওয়া এই প্রকল্পে ‘এল থ্রি হ্যারিস’ কোম্পানির ‘মাস্ট ১৩’ বোটকে ব্যবহার করে ১৮ মাস ধরে পরীক্ষা করা হয়। এবছরের শেষে ব্রিটিশ নৌবাহিনী আরেকটা মনুষ্যবিহীন বোটের ডেলিভারি পাবে। ‘নেভাল টেকনলজি’ ম্যাগাজিন বলছে যে, এই বোটগুলি নৌবাহিনী ছাড়াও রয়াল ম্যারিনের সদস্যরা ব্যবহার করবে। ‘নেভিএক্স’এর প্রধান কমান্ডার এন্টনি ক্র্যাব বলছেন যে, পরীক্ষামূলক এই কর্মকান্ডগুলি বলে দেবে যে, সামনের দিনগুলিতে রয়াল নেভির ‘টাইপ ২৬’ এবং ‘টাইপ ৩১’ ফ্রিগেটের উপর এধরণের প্রযুক্তিগুলি কিভাবে মোতায়েন হবে।

এছাড়াও রয়াল নেভি ২০১৯ সালে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক সেক্টরের সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে প্রযুক্তি ডেভেলপ করার কাজে হাত দিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘ইউকে ডিফেন্স সলিউশন্স সেন্টার’ বা ‘ইউকেডিএসসি’ এই প্রকল্পে বেসামরিক সংস্থা ‘সাবসী ইউকে’ এবং ‘ন্যাশনাল সাবসী রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর সাথে এই কাজ বাস্তবায়ন করছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর মাধ্যমে বেসামরিক এবং সামরিক গবেষকেরা সমুদ্রের নিচে কাজ করার প্রযুক্তিগত উতকর্ষতা নিয়ে কাজ করবে। এই প্রযুক্তির মাঝে থাকবে রোবোটিক্স, মনুষ্যবিহীণ যন্ত্রপাতি এবং ডিজিটাল যোগাযোগ। এতে বেসামরিক এবং সামরিক গবেষকেরা একে অপরের কাছ থেকে শিখবে। ‘ইউকেডিএসসি’এর ওয়েবসাইট বলছে যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে পানির নিচে বিভিন্ন সেন্সর ব্যবহার এবং সেগুলি থেকে ডাটা সংগ্রহ ও স্টোর করা ছাড়াও সেই ডাটা যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য করা হবে। তাছাড়া পানির নিচে অপারেশন চালনা করার অভিজ্ঞতাও এই প্রকল্পের মাধ্যমে শেয়ার করা সম্ভব হবে। ‘সাবসী ইউকে’ হলো ব্রিটেনের সমুদ্রের নিচে প্রযুক্তি ডেভেলপ করার সর্বোন্নত সংস্থা। এরা মূলতঃ তেল গ্যাস আহরণের কাজে সহায়তা দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রের মাঝে বায়ু বিদ্যুৎ উতপাদন এবং সেগুলির ব্যবস্থাপনা তাদের একটা বড় কাজ হয়ে গেছে।

 
ছবিঃ ব্রিটিশ রয়াল নেভি এবং রয়াল ম্যারিনের জন্যে ডেভেলপ করা মনুষ্যবিহীন বোট 'ম্যাডফক্স'। সামরিক প্রযুক্তিতে আগামী এক দশকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার যে টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে ব্রিটিশ সরকার, তার ভিত্তি মূলতঃ ব্রিটেনের শিক্ষা সেক্টরে। শিক্ষা সেক্টরে ব্রিটেনের প্রধান ফোকাস হলো ‘এআই’, যা ডেভেলপ করতে গেলে ব্রিটিনের নিজস্ব মেধা যথেষ্ট নয়; বরং সারা বিশ্বের সেরা মেধাগুলিকে ব্রিটিশ পতাকাতলে আনতে হবে। কিন্তু যেখানে পশ্চিমা আদর্শই মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে, সেখানে সেই আদর্শিক সমস্যার বেড়াজাল পেরিয়ে অন্যের সম্পদ ব্যবহার করে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার বৈশ্বিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে কতটা সফলতা পাবে, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে।



সারা বিশ্বের সেরা মেধা ব্যবহার করে নেতৃত্ব দিতে চাইছে ব্রিটেন

ব্রিটেনের প্রযুক্তি ডেভেলপ করার একেবারে মূলে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’। ব্রিটেন ‘এআই’এর উপর নির্ভর করেই প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছাতে চাইছে। মার্কিন বা চীনা বাজেটের তুলনায় ব্রিটেনের প্রযুক্তি বাজেট কিছুই নয়। ব্রিটেন তার বর্তমান সামরিক বাহিনীকে আকারে ছোট করে অর্থ বাঁচাচ্ছে; আর সেই অর্থ বিনিয়োগ করছে নতুন প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন হাইপারসনিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্রিটেন পিছিয়ে আছে। এই দুর্বলতাগুলিকে ব্রিটেন জয় করতে চাইছে ‘এআই’ প্রযুক্তির মাধ্যমে। ড্রোনের ঝাঁক, ফাইটার ড্রোন, গোয়েন্দা স্যাটেলাইট, লেজার অস্ত্র, কথা বলা ক্ষেপণাস্ত্র, মনুষ্যবিহীন বোট বা সাবমেরিন, ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ব্রিটেন ‘এআই’এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু ‘এআই’ ডেভেলপ করতে গিয়ে ব্রিটেনের যে জিনিসটা প্রথমেই দরকার তা হলো মেধা।

ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইট বলছে যে, সারা বিশ্ব থেকে মেধা আকর্ষণ করে ব্রিটেন ‘এআই মাস্টার্স’এর প্রফেশনাল তৈরি করতে চাইছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশেষ ‘সেন্টার’ তৈরি করে তারা পরবর্তী জেনারেশনের ‘এআই পিএইচডি’ তৈরি করবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয় ‘এলান টুরিং ইন্সটিটিউট’এর ‘এআই’ রিসার্স ফেলোশিপ; যা এখন এখন সকলের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কমপক্ষে ২’শ ‘এআই’ মাস্টার্স ছাত্রকে নিজস্ব অর্থে পড়াচ্ছে ‘ডিপ মাইন্ড’, ‘কোয়ান্টাম ব্ল্যাক’, ‘সিসকো’ এবং ‘ব্রিটিশ এরোস্পেস সিস্টেমস’এর মতো কোম্পানিগুলি। ১৬টা ‘ইউকে রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন এআই সেন্টার্স ফর ডকটরাল ট্রেনিং’এ ১ হাজার ছাত্রকে পড়ার সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারের এই প্রকল্পগুলি বলে দিচ্ছে যে, সামরিক প্রযুক্তিতে আগামী এক দশকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার যে টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে ব্রিটিশ সরকার, তার ভিত্তি মূলতঃ ব্রিটেনের শিক্ষা সেক্টরে। শিক্ষা সেক্টরে ব্রিটেনের প্রধান ফোকাস হলো ‘এআই’, যা ডেভেলপ করতে গেলে ব্রিটিনের নিজস্ব মেধা যথেষ্ট নয়; বরং সারা বিশ্বের সেরা মেধাগুলিকে ব্রিটিশ পতাকাতলে আনতে হবে। ব্রেক্সিট পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সর্বদাই ব্রিটেনের নিজস্ব সম্পদকে ছাপিয়ে গেছে। তবে অন্যান্য রাষ্ট্র এবং অঞ্চলের সম্পদ ও মেধা ব্রিটেন নিজস্ব জাতীয় স্বার্থে কতটা ব্যবহার করতে পারবে, তা নির্ভর করছে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় ব্রিটেনের আদর্শিক নেতৃত্ব নিতে পারার সক্ষমতার উপর। কিন্তু যেখানে পশ্চিমা আদর্শই মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে, সেখানে সেই আদর্শিক সমস্যার বেড়াজাল পেরিয়ে অন্যের সম্পদ ব্যবহার করে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার বৈশ্বিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে কতটা সফলতা পাবে, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

No comments:

Post a Comment