Tuesday 12 October 2021

আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্ব নিয়ে কেলেঙ্কারি কি দেখিয়ে দিচ্ছে?

১২ই অক্টোবর ২০২১

পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় সংস্থাদু’টার উদ্দেশ্য নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন সংস্থার কর্মকান্ডের মাঝে স্বচ্ছতার অভাব বিশ্বব্যাপী এর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, জর্জিয়েভা মূলতঃ সংস্থার অর্থায়ন বৃদ্ধি করতে চীনের কাছ থেকে আরও বেশি বিনিয়োগ যোগাড় করতেই ইনডেক্সে চীনের অবস্থানকে পরিবর্তন করিয়েছেন। তবে এতেও যে ব্যাপারটা এড়ানো যায়না তা হলো, সংস্থাদু’টা এতকাল মূলতঃ তাদের যেসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে পশ্চিমা উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়ন করেছে সেগুলির ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

 
গত ৪ঠা অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড’ বা আইএমএফএর এক্সিকিউটিভ বোর্ডের সাথে ‘উইলমার হেইল’ নামের এক আইনব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। ‘উইলমার হেইল’এর ১৭ই সেপ্টেম্বরের এক তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে যে, আইএমএফএর প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা যখন বিশ্বব্যাংকের প্রধান ছিলেন, তখন সংস্থার ‘ডুইং বিজনেস ইনডেক্স’এর র‍্যাংকিংএ চীনের অবস্থানকে পরিবর্তন করা হয়। এই ইনডেক্সের অর্থ হলো একটা রাষ্ট্র প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগকে কতটা সহায়তা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এক বছরে চীনের অবস্থান ৭৮ নম্বরে ছিল; যার পরের বছর ৮৫ নম্বরে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে চীনারা ক্ষুব্ধ ছিল। জর্জিয়েভা এবং সংস্থার অন্যান্য কর্মকর্তারা সেসময় ইনডেক্সের হিসেবকে পরিবর্তন করে চীনের অবস্থানকে আগের বছরের, অর্থাৎ ৭৮ নম্বরে নামিয়ে আনেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, জর্জিয়েভা ইনডেক্স হিসেবের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এনেছিলেন চীনের অবস্থানকে পরিবর্তন করার জন্যে। এই প্রতিবেদনের ফলশ্রুতিতে জর্জিয়েভাকে আইএমএফএর প্রধান হিসেবে বহাল রাখা হবে কিনা, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই বলে যে, এই অভিযোগ খুবই গুরুতর এবং এসময় তারা জর্জিয়েভাকে সমর্থন করা বন্ধ করে দেয়। তবে এক সপ্তাহ পর যুক্তরাষ্ট্র জানায় যে, তারা জর্জিয়েভাকে তার পদ থেকে সরাবার চেষ্টা করবে না। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ফরাসিরা ইতোমধ্যেই জর্জিয়েভার পক্ষে কথা বলেছিল এবং ব্রিটিশরাও একই পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ জর্জিয়েভা এবং তার সমর্থকদের বরাত দিয়ে বলছে যে, সংস্থার ভেতর জর্জিয়েভার বিরোধীরা অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিল; যারা জর্জিয়েভার ‘প্রগ্রেসিভ’ লক্ষ্যগুলির সাথে একমত নয়। তবে কেউ কেউ এধরণের বক্তব্যের পুরোপুরি বিরোধী। ‘নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর এবং অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী পল রোমার কিছুদিন আগেও বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং রিসার্চ ডিভিশনের প্রধান ছিলেন। সেই হিসেবে তিনি সংস্থার ‘ডুইং বিজনেস ইনডেক্স’এর উপর যে কাজ হতো, তার মূল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ‘ব্লুমবার্গ’এর সাথে এক সাক্ষাতে ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, এই ইনডেক্সে ভালো অবস্থানে থাকার জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশের মাঝে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে অনেক দেশই ইনডেক্সে তাদের স্কোরকে কিছুটা ভালো অবস্থানে দেখার জন্যে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে। রোমার বলছেন যে, বিশ্বব্যাংকের মাঝে একটা সংস্কৃতি রয়েছে যে, ইনডেক্সের সংখ্যাগুলিকে রিভিউ করা এবং কিছু দেশকে অধিক সুবিধা দিয়ে তাদের স্কোরকে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রাখা। তিনি বলছেন যে, সংস্থার নেতৃত্ব চীনকে ভালো স্কোর দিয়ে হয়তো চীনের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করতে চাইছিলেন, তবে সেব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। তবে রোমারের অভিযোগ হলো যেসব দেশ ইনডেক্সে তাদের অবস্থানকে পরিবর্তন করতে চাপ সৃষ্টি করে, তারা স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য দেশের সাথে নিজেদের একটা পার্থক্য করে ফেলছে। এবং শেষ পর্যন্ত কিছু দেশকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে ইনডেক্স প্রকাশ করা হচ্ছে। এভাবে বিশ্বব্যাংক একদিকে একটা বৈজ্ঞানিক তথ্যের উৎস, আবার এটা একইসাথে একটা কূটনৈতিক সংস্থা। কারণ তারা বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক দেনদরবার চালায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশে যে বিশ্বাসযোগ্যতা দরকার, তা কূটনৈতিক আলোচনায় ছাড় দেবার মাধ্যমে তথ্যের উৎসের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কঠোর নিয়মে ঘাটতি পড়ে যায়। এটা পুরো সংস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

‘সিএনবিসি’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, ১৯৪৪ সালে ‘ব্রেটন উডস কনফারেন্স’এর মাধ্যমে তৈরি করা আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। আইএমএফ সাধারণতঃ এর সদস্য দেশগুলিকে স্বল্প মেয়াদে ঋণ দেয়, যাতে সেসব দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করা যায়। সদস্য দেশগুলির অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও আইএমএফএর বহুবিধ লক্ষ্য রয়েছে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের কাজ হলো বিভিন্ন দেশে উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অর্থায়ন করা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করা। বিশ্বব্যাংকের বেশিরভাগ কাজ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। উভয় সংস্থারই ১’শ ৮৯টা সদস্য। আইএমএফএর মূল অর্থায়ন হয় কোটা ব্যবস্থায়। এর মাধ্যমে সংস্থার মোট অর্থায়ন প্রায় ৬’শ ৭৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। কোটা পদ্ধতিতে সংস্থার প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট চারটা দেশের হাতে; যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন এবং জার্মানি। ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং ইতালির হাতে রয়েছে আরও প্রায় ১২ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ মাত্র সাতটা দেশের হাতেই সংস্থার প্রায় অর্ধেক ভোট। সংস্থার সবচাইতে বড় ঋণগ্রহীতা দেশ হলো গ্রিস, ইউক্রেন, পর্তুগাল এবং পাকিস্তান। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আসে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মাঝে বন্ড ইস্যু করে ঋণ নেবার মাধ্যমে।

পল রোমার বলছেন যে, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক একসময় বিশ্বের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ সেসময় একটা দেশের পক্ষে খুব বেশি উৎস থেকে ঋণ পাওয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই দুই সংস্থাই সেসময় আন্তর্জাতিক পুঁজির জোগানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু বর্তমানে এই সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক পুঁজির বাজারের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় উভয় সংস্থাই তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে নতুন কিছু করতে চাইছে। রোমার বলছেন যে, ১৯৫০এর দশকে এই সংস্থাগুলির উদ্দেশ্য যা ছিল, বর্তমান দুনিয়ার সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; কাজেই এখন সময় এসেছে এই সংস্থাগুলির উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার। তিনি মনে করছেন যে, এই সংস্থার এখন সবচাইতে বড় কাজ হলো বিভিন্ন দেশের মাঝে কূটনৈতিক আলোচনা সচল রাখা।

আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় সংস্থাদু’টার উদ্দেশ্য নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন সংস্থার কর্মকান্ডের মাঝে স্বচ্ছতার অভাব বিশ্বব্যাপী এর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। শক্তিশালী দেশগুলি যদি সংস্থার ‘ডুইং বিজনেস ইনডেক্স’এর হিসাবের প্রতিবাদ করে র‍্যাঙ্কিংএ পরিবর্তন আনতে পারে, তাহলে বাকি দেশগুলির সদস্যপদের গুরুত্ব যতটুকুইবা ছিল, তা অর্থহীন হয়ে যায়। তদুপরি অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, জর্জিয়েভা মূলতঃ সংস্থার অর্থায়ন বৃদ্ধি করতে চীনের কাছ থেকে আরও বেশি বিনিয়োগ যোগাড় করতেই ইনডেক্সে চীনের অবস্থানকে পরিবর্তন করিয়েছেন। তবে এতেও যে ব্যাপারটা এড়ানো যায়না তা হলো, সংস্থাদু’টা এতকাল মূলতঃ তাদের যেসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে পশ্চিমা উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়ন করেছে সেগুলির ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নবিদ্ধ।



5 comments:

  1. বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ যে দেশ গুলো কে টাকা জোগায়, তো এরা অর্থ কিভাবে পায় মানে এরা কোথা থেকে পায়? আর বন্ড ব্যাপারটা যদি বুঝিয়ে বলেন। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আইএমএফ যাদেরকে অর্থায়ন করে, তারা সাধারণতঃ অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্তঃ খারাপ অবস্থায় বা দেউলিয়া অবস্থায় থাকে। তারা বাধ্য হয় আইএমএফএর সকল শর্ত মেনে চলতে। তারা গায়ের রক্ত পানি করে এই অর্থ ফেরত দেয়। সাধারণতঃ শর্তগুলি জনগণের জন্যে অত্যন্ত কষ্টকর হয়। সরকারের আয় বাড়াবার এবং খরচ কমাবার আইএমএফএর বেধে দেয়া শর্তগুলিই তারা পূরণ করতে বাধ্য থাকে।

      অপরদিকে বিশ্বব্যাংক সাধারণতঃ উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র্য দেশগুলিতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে। তারাও অনেক শর্ত দেয় ঋণ পাবার জন্যে।

      বন্ড হলো একটা ঋণপত্র। এতে একটা অর্থের সংখ্যা লেখা থাকে। সেই অর্থের বিনিময়ে কোন ব্যক্তি বা সংস্থা বা রাষ্ট্র সেই ঋণপত্র কিনতে পারবে। এর মেয়াদ শেষ হলে মূল অর্থের সাথে সুদ ফেরত দেয়া হয়। যারা বন্ড ইস্যু করবে, তারা হলো ঋণগ্রহীতা; যে বন্ড কেনে, সে ঋণদাতা।

      Delete
  2. ধন্যবাদ। ভাল ভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।

    মার্কিন হেগেমনি যদি শেষ হয় তবে কি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক জাতীয় সুদি কারবারি প্রতিষ্ঠানগুলিও ধসে পড়বে?
    তাহলে কি সুদ নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি এই লেখার মাঝেই আপনার উত্তর মোটামুটি পেয়ে যাবেন। পরিবর্তিন দুনিয়ার সাথেসাথে এই সংস্থাগুলি কিন্তু এখন তাদের প্রভাব হারিয়েছে এবং নিজেদের উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিৎ, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলা শুরু করেছে। এই ব্যাপারটা কখনোই হয়নি যখন যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র ক্ষমতাধর সুপারপাওয়ার ছিল।

      যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী প্রভাব কমার সাথেসাথে তার তৈরি করা সংস্থাগুলির প্রভাবও কমতে শুরু করেছে। চীনের আবির্ভাব এক্ষেত্রে একটা বড় কারণ। একইসাথে বিশ্বের অনেক দেশই এখন এই সংস্থাগুলির ঋণের জালে জড়াতে চায় না; কারণ এরা পশ্চিমা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঋণগ্রহীতা দেশের উপর এতটাই মারাত্মক শর্ত নিয়ে আসে, যা বেশিরভাগ দেশই অন্য কোন বিকল্প থাকলে ঘাড়ের উপর নিতে চাইবে না। বিকল্প এখন অনেক দিক থেকে তৈরি হয়েছে; তাই সংস্থাগুলির প্রভাবও এখন অনেকটাই কমে গেছে; ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের মতই।

      সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি ধ্বসে যেতে হলে এক্ষেত্রে নতুন কোন বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ দরকার। এই মুহুর্তে বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ হলো পশ্চিমারা; যাদের নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা যতদিন অন্য কোন শক্তির উত্থান দ্বারা চ্যালেঞ্জের মাঝে না পড়বে, ততদিন এই সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি চলবে।

      Delete
  3. ধন্যবাদ।

    ReplyDelete