Tuesday 19 October 2021

ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়াতে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চাইছে

১৯শে অক্টবর ২০২১

বঙ্গোপসাগরকে মার্কিন প্রভাব বলয়ের অধীনে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সকল প্রচেষ্টাই চালাবে। তথাপি পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় কোনকিছুই এখন আগের মত যে নেই, তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ভারতীয় মিডিয়ার অবাক হবার মাঝ দিয়ে প্রমাণ হয়। এতদিন দিল্লীর নীতিনির্ধারকরা যদি মনে করে থাকেন যে, তাদের উগ্রবাদী নীতি তারা ইচ্ছেমতো বাস্তবায়ন করবেন, তবে তারা বেশ বড়সড় ধাক্কাই খেয়েছেন।

 
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগণের উপর হামলার ব্যাপারে নিন্দা জ্ঞাপন করেন বলে জানাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়া। ১৯শে অক্টোবর ভারতীয় সরকারি বার্তা সংস্থা ‘পিটিআই’ এবং বেসরকারি মিডিয়া ‘এনডিটিভি’ নাম না জানা দপ্তরের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বলে যে, ধর্ম বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা মানুষের অধিকার। বিশ্বের সকল ধর্মের মানুষেরই নিরাপদ থাকার অধিকার রয়েছে এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান পালনে সমর্থন পাবার অধিকার রাখে। এদিকে ‘এনডিটিভি’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশী হিন্দুরা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে আবেদন জানায় যেন বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আর কোন ধরনের হামলা না হয়। তারা মার্কিন মানবাধিকার গ্রুপগুলি এবং মিডিয়া হাউজগুলিকে বাংলাদেশে সহিংসতার খবর হাইলাইট করার আবেদন জানায়।

বাংলাদেশ বলছে ‘তৃতীয় শক্তি’ জড়িত

অপরদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এক অনুষ্ঠানে বলেন যে, যিনি কুমিল্লার ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাকে তারা এখনও ধরতে পারেননি; কারণ তিনি বারবার স্থান পরিবর্তন করছেন। তবে আইন শৃংখলা বাহিনী শিগগিরই তাকে ধরে ফেলবে বলে তিনি বলেন। এর আগের দিন সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে কুমিল্লার ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে তারা মনে করছেন। এর আগে রামু, ভোলা এবং নাসিরনগরের ঘটনাগুলিও এ ধরনের ঘটনা ছিল বলে বলেন তিনি; যা মূলতঃ সোশাল মিডিয়াতে অপপ্রচারের মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, বিশৃংখলা, অরাজক পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রের মাঝে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্যে এটা একটা কৌশল ছিল। কিন্তু অনেকেই এখানে না বুঝে অনেক কিছু করে ফেলেছেন। নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং হাজিগঞ্জে যা ঘটেছে, তা একই সূত্রে গাঁথা বলে বলেন মন্ত্রী। এগুলির পিছনে মুষ্টিমেয় কিছু লোক রয়েছে এবং এরইমাঝে সন্দেহজনক লোকদের চিহ্নিত এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বলেন তিনি। ১৭ই অক্টোবরও তিনি প্রায় একই ধরনের কথা বলেন। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পিছনে ‘তৃতীয় পক্ষের’ ইন্ধন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেন যে, কারা এই ঘটনার পিছনে জড়িত, তখন মন্ত্রী বলেন যে, সাংবাদিকরাই এব্যাপারে অনুমান করে নিতে পারেন।

এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিন্দুদের দূর্গাপুজা অনুষ্ঠানে বলেন যে, ভারতকে সাবধান থাকতে হবে যে, সেখানেও যাতে এমন কোনকিছু যেন না করা হয়, যা বাংলাদেশের উপরেও প্রভাব ফেলে এবং বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আঘাত আসে। তিনি আরও বলেন যে, ধর্মান্ধরা সবসময়ই ধর্মীয় সংঘাত দেখতে চায়। এরা শুধু মুসলিমদের মাঝ থেকেই আসে না; অন্যান্য ধর্ম থেকেও আসে। শেখ হাসিনা ভারতের কোন ঘটনাকে নির্দিষ্ট করে না বললেও ভারতীয় মিডিয়া এই যোগসূত্র ধরতে ভুলেনি। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ বলছে যে, শেখ হাসিনা এমন সময়ে কথাগুলি বললেন, যখন ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে আসামে অগুণিত বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমকে বেআইনী বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে এবং ‘আর্টিকেল ৩৭০’ পরিবর্তনের মাধ্যমে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিশেষ স্ট্যাটাস বাতিল করে সেখানে অন্য অঞ্চলের হিন্দুদের বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

গত ২৩শে সেপ্টেম্বর আসামের দারাং জেলায় তথাকথিত ‘বেআইনী বসতি স্থাপনকারী’দের বাস্তুচ্যুত করার পুলিশী মিশনে পুলিশের গুলিতে দু’জন বাঙ্গালী মুসলিম নৃশংসভাবে নিহত হয়। এর মাঝে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে তার শরীরের উপর লাফানোর ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। আসামের মূখ্যমন্ত্রী এই ঘটনার পর এই বাস্তুচ্যুত করার মিশনকে চালিয়ে নেবার ঘোষণা দেন। তবে এই ঘটনা বা এর আগে আসামের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ব্যাপক সহিংসতার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন অবস্থানই চোখে পড়েনি।

দিল্লী যখন ওয়াশিংটনের ক্রীড়নক…

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছ থেকে যখন ভারত সরকারের উগ্রবাদী অভ্যন্তরীণ নীতিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সাথে যুক্ত করে বিবৃতি আসছে, তখন ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের ঘটনার নিন্দা ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ সরকারও নির্দিষ্ট করে না বলেই ‘তৃতীয় পক্ষের’ জড়িত থাকার কথা বলছে; যা মূলতঃ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, মে মাসে ঢাকার পল্লবীতে সংঘটিত এক হত্যাকান্ডের ভিডিওকে নোয়াখালীতে একজন হিন্দু হত্যার ভিডিও বলে সোশাল মিডিয়াতে ছড়ানো হয়। অর্থাৎ তিনি বলছেন যে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ এই সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে।

মুসলিমদের নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোন অবস্থান আশা করাটা কঠিন; যখন দুই দশক ধরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ মার্কিন সামরিক হামলায় ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ বহু দেশে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নিহত হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে গত দুই দশক থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তার বলয়ে নিতে চাইছিল। এই সুযোগটা খুলে যায় ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির উগ্রবাদী বিজেপি সরকারের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হবার পর। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার নতুন কৌশল বাস্তবায়নে ভারতকে উন্নত অস্ত্র দিতে থাকে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল হিমালয়ে পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় চীনের সাথে উত্তেজনা সৃষ্টি করে সেখানে চীনা সামরিক বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা। একইসাথে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘কোয়াড’ সামরিক জোটের অংশ হওয়ায় ভারতীয় নৌবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে দিল্লী এখন ওয়াশিংটনের ক্রীড়নক। কাজেই ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের কড়া সমালোচনা করে তাদেরকে দূরে ঠেলে দেবার কোন চিন্তা জো বাইডেনের মার্কিন সরকারের রয়েছে বলে মনে করাটা ভুল হবে। উল্টো মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক নীতি বাস্তবায়নে পথের কাঁটা হয়ে কেউ যেন না দাঁড়ায়, সেব্যাপারেই বরং ওয়াশিংটনের দৃষ্টি থাকবে। এবং সে অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরকে মার্কিন প্রভাব বলয়ের অধীনে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সকল প্রচেষ্টাই চালাবে। তথাপি পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় কোনকিছুই এখন আগের মত যে নেই, তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ভারতীয় মিডিয়ার অবাক হবার মাঝ দিয়ে প্রমাণ হয়। এতদিন দিল্লীর নীতিনির্ধারকরা যদি মনে করে থাকেন যে, তাদের উগ্রবাদী নীতি তারা ইচ্ছেমতো বাস্তবায়ন করবেন, তবে তারা বেশ বড়সড় ধাক্কাই খেয়েছেন। জাতিরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওয়েস্টফালিয়ান ব্যবস্থা এখন যে নামমাত্র টিকে আছে, তা সীমানার দুই পাড়ের ঘটনাই বলে দিচ্ছে। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার সূর্যাস্ত আসন্ন।

7 comments:

  1. জাতিরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওয়েস্টফালিয়ান ব্যবস্থা এখন যে নামমাত্র টিকে আছে, তা সীমানার দুই পাড়ের ঘটনাই বলে দিচ্ছে। - ওয়েস্ট ফালিয়ান ব্যবস্থায় দুই পাড়ের সীমানা র সম্পর্ক বলতে আসলে কি বলা হয়েছে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. বর্তমান বিশ্বে যে জাতিরাষ্ট্রগুলি রয়েছে, সেগুলি ১৬৪৮ সালের ইউরোপের ওয়েস্টফালিয়ান চুক্তির কনসেপ্টের উপর স্থাপিত। এই চুক্তি মোতাবেক মেনে নেয়া সীমানাকে সকল দেশ মেনে চলবে; একে অপরের সীমানার ভেতরে কোন অবস্থাতেই হস্তক্ষেপ করবে না।

      ইউরোপে ক্যাথোলিক এবং প্রোটেস্টান্টদের প্রায় শত বছরের দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ এই চুক্তি হয়েছিল। এর মাধ্যমে এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের বাউন্ডারির ভিতরে নিজেদের জাতিগোষ্ঠির মানুষ থাকলেও তাদের পক্ষে কোন কথা বলবে না; কারণ সেটা সেই দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। উদাহরণস্বরূপ, একটা ক্যাথোলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ পাশের প্রোটেস্ট্যান্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভ্যন্তরে বসবাস করা ক্যাথোলিক সংখ্যালঘুদের পক্ষ নিয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না; সীমানা মেনে চলবে।

      এই ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেম প্রথম দেড়'শ বছর শুধু ইউরোপে বাস্তবায়িত থাকলেও পরবর্তীতে উপনিবেশের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাস্তবায়ন করা হয়। জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তিই হলো এই ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেম।

      Delete
  2. তার মানে এই দাঁড়ায় যে বর্তমান ওয়েস্ট ফ্যালিয়ান ব্যবস্থা অনুসারে ভারত তার প্রতিবেশী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তথা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে কোন মন্তব্য বা হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা। হস্তক্ষেপ না করলেও ভারত তাদের মিডিয়ায় এই নিয়ে অনেক কথা বলছে। এটা কি ওয়েস্ট ফ্যালিয়ান সিস্টেম নড়বড়ে হওয়ার লক্ষন নয় কি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. Yes. You are right.

      State potentially has a lot of influence over the media; which makes media part of state apparatus and media activity outside the border as part of state influence.

      Delete
  3. এই মুহুর্তে ওয়াশিংটনে জুইশ/ইসরালি লবিস্টের পরে সবচেয়ে শক্তিশালী লবিস্ট গ্রুপ হচ্ছে ইন্ডিয়ান লবিস্ট গ্রুপ, আর ভারতও যে পুরোপুরিভাবে আমেরিকাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে তা কিন্তু নয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. জ্বি। ঠিক এই কারণেই ভারতীয়দের উচিৎ ভারতকে মার্কিন-ব্রিটিশ প্রভাব থেকে মুক্ত করে দক্ষিণ এশিয়াকে নিরাপদ করা।

      Delete