Friday 8 October 2021

ফিলিস্তিনের উপর ইস্রাইলের চাপ বৃদ্ধি নতুন করে সংঘাতের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে

০৯ই অক্টোবর ২০২১

আল আকসা মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যে জর্দান ইস্রাইকে আহ্বান করেছে; তুরস্ক এবং মিশর থেকে নিন্দা এসেছে ইস্রাইলি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে। ঠিক এই ব্যাপারটাই চলেছে গত মে মাসে গাজা যুদ্ধের সময়েও। এহেন পরিস্থিতি ফিলিস্তিনে নতুন করে সংঘাতের আশংকাকে যেমন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি ফিলিস্তিনের ব্যাপারে মুসলিম নেতৃত্বের উদাসীনতা পুরো মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের সংকটকে সামনে নিয়ে আসছে; যা কিনা মুসলিমদের মাঝে প্রকৃত পরিবর্তনের হাহাকারকে আরও প্রকট করে তুলছে।

 

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৮তম অধিবেশনে এক যৌথ বিবৃতিতে ‘ইউরো মেডিটেরানিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটর’ এবং ‘গ্লোবাল ইন্সটিটিউট ফর ওয়াটার, এনভায়রনমেন্ট এন্ড হেলথ’ বলে যে, গাজার উপর ইস্রাইলের দীর্ঘ সময়ের অবরোধের কারণে এবং কিছুদিন পরপরই সেখানে ইস্রাইলি সামরিক হামলার কারণে গাজার ৯৭ শতাংশ পানি পানের অযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু গাজার মানুষ অবরোধের কারণে বাধ্য হচ্ছে এই পানি পান করতে; যা কিনা তাদের উপর ধীরে ধীরে বিষপ্রয়োগের কাজ করছে। বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যাহত হবার কারণে গাজার ৮০ শতাংশ ময়লা পানি সরাসরি সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে; আর বাকি ২০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। গত মে মাসে গাজার উপর ইস্রাইলি হামলার সময় গাজার পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উপর ইস্রাইলিরা টার্গেট করে বোমাবর্ষণ করে। এর ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, গাজার মানুষের মোট অসুস্থ্যতার মাঝে চার ভাগের এক ভাগই ছিল পানি দূষণজনিত রোগ। শিশুমৃত্যুর ১২ শতাংশই ছিল পেটের সমস্যার কারণে; যার মূল উৎসই হলো অপরিষ্কার পানি। সেখানকার মানুষ প্রতিদিন তাদের সন্তানদের ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখছে; হয়তো যে মাটিতে তারা ফসল ফলায়, সেখানেও এর প্রভাব পড়বে। বিবৃতির উপসংহারে বলা হয় যে, গাজার জনগণকে বাঁচাতে ইস্রাইলি কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এই বিবৃতির উপসংহারের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা প্রশ্ন করা যায়। গত মে মাসে গাজার উপর ইস্রাইলি হামলায় শতশত মানুষ নিহত হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি ইস্রাইলের পক্ষেই কথা বলে যায়। তারা বলে যে, ইস্রাইল যা কিছু করেছে, তা তার নিজেকে রক্ষা করার জন্যেই করেছে।

ফিলিস্তিনে ইস্রাইলের আগ্রাসী আচরণের একটা ধর্মীয় দিক ছিল সবসময়ই। গত ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক সপ্তাহ ধরে ইস্রাইলিদের ‘সুককত’ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় হাজারো অবৈধ ইহুদী বসতি স্থাপনকারীরা জেরুজালেমে পবিত্র আল আকসা মসজিদে প্রতিদিন সকাল এবং বিকালে দু’বার করে ঢুকে পড়ে এবং সেখানে ইস্রাইলি পতাকা উত্তোলন করে। ইস্রাইলের ‘চ্যানেল ৭’ বলে যে, মোট ৩ হাজার ৫’শ ৯৭ জন ইহুদী বসতি স্থাপনকারী এই মসজিদে ঢুকে। হামলাকারী ইহুদিদের মাঝে অনেক সময়েই পুলিশ প্রহড়ায় মন্ত্রী, এমপি এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। ‘মিডলইস্ট আই’ বলছে যে, ২৮শে সেপ্টেম্বরও ১’শ ৫১ জন ইহুদী আল আকসা মসজিদে ঢুকে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করে। ইহুদিদের মূল টার্গেট হলো মসজিদ কম্পাউন্ডের মাঝে ‘ডোম অব দ্যা রক’ যা ৬৯২ সালে খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান নির্মাণ করেছিলেন। ইহুদিরা সেই স্থানে উপাসনা করে। ‘ওয়াফা’ বলছে যে, ইহুদীরা যখন আল আকসার ভিতর ঢুকে, তখন ইস্রাইলি পুলিশ ফিলিস্তিনিদের মসজিদে ঢুকতে বাধা দেয়। ফিলিস্তিনিরা কয়েকটা বাসে করে ২৮শে সেপ্টেম্বর ফজরের নামাজের আগেই সেখানে পৌঁছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নামাজের পর মসজিদে অবস্থান ধর্মঘট করা, যাতে ইহুদিরা সেখানে ঢুকে পবিত্রতা নষ্ট করতে না পারে। কিন্তু ইস্রাইলিরা সেই বাসগুলিকে আটকে দেয় এবং দু’জন ফিলিস্তিনিকে আটক করে। সেপ্টেম্বর মাসেই ইহুদিরা তাদের তিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যায় আল আকসা মসজিদে হামলা করে।

ফিলিস্তিনিদের উপর ইস্রাইলের চাপ সৃষ্টির পদ্ধতি অনেক রকম। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের উপর ইস্রাইলী অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের হামলা আগের দুই বছরের চাইতে দ্বিগুণ হয়েছে বলে বলছে ইস্রাইলি পত্রিকা ‘হারেতস’। পত্রিকাটা বলছে যে, গত ডিসেম্বর মাসে সহিংসতায় দু’জন ইস্রাইলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারী নিহত হবার পর থেকে ইস্রাইলি কর্তৃপক্ষ নতুন এক কৌশল নিয়েছে, যার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদেরকে ফিলিস্তিনিদের উপর নিজেদের ‘ক্রোধ প্রকাশ করার’ জন্যে পরিস্থিতি সহজ করে দিচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে যেখানে ২০১৯ সালে ফিলিস্তিনিদের উপর ইহুদী বসতি স্থাপনকারীদের হামলার সংখ্যা ছিল ৩’শ ৬৩; এবং ২০২০ সালে যা ছিল ৫’শ ৭; তা এখন ২০২১ সালে মাত্র ছয় মাসেই গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪’শ ১৬তে। এর মাঝে ১’শ ৩৯টা ঘটনা ছিল ‘প্রাইস ট্যাগ’ ঘটনা; ইস্রাইলিদের কাছে যার সংজ্ঞা হলো, ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়িতে আক্রমণ, পাথর ছুঁড়ে মারা, বর্ণবাদী গ্রাফিতি এঁকে যাওয়া, গাড়ির টায়ার নষ্ট করা এবং গাছ উপড়ে ফেলা। এই হামলাগুলির বেশিরভাগই করেছে ‘প্রাইস ট্যাগ’ এবং ‘হিলটপ ইয়ুথ’ নামের ইহুদী বসতি স্থাপনকারী গ্রুপ। ২০২১ সালের এই হামলাগুলিতে কমপক্ষে ২৩ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে; যা আগের বছরগুলির তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বেশিরভাগ হামলাই হয়েছে হেবরন, রামাল্লাহ ও নাবলুস শহর এবং এর আশেপাশে। এছাড়াও পূর্ব জেরুজালেমে বাস করা ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়িতেও বিগত বছরগুলিতে বহু হামলা হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ইহুদীরা পূর্ব জেরুজালেমের শুয়াফাত এলাকায় ফিলিস্তিনিদের অনেক বাড়িঘর এবং গাড়ির উপর হামলা করে। এর পরের মাসে শারাফাত এলাকায় একটা মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয়। ২০২০এর ফেব্রুয়ারিতে জিশ শহরের এক মসজিদে বর্ণবাদী কথা লিখে দেয়া হয়। এই ঘটনাগুলিতে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন ফিলিস্তিনির মৃত্যুও হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের উপর ইস্রাইলের চাপ সৃষ্টি এবং তাদের জানমাল ধ্বংস করার ইস্রাইলি কর্মকান্ড নতুন নয়; তবে পদ্ধতিগুলি বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। ধর্মীয়ভাবে ইস্রাইলিরা সর্বদাই ফিলিস্তিনিদের চাপের মাঝে রেখেছে। যেমন কিছুদিন আগেই ইস্রাইলি এক আদালত আল আকসা মসজিদে ইহুদিদের ‘চুপচাপ’ উপাসনা বৈধ করে দেয়। ব্যাপারটা এমন যে, নিয়মিত আল আকসায় হাজারো ইহুদির হামলা কোন ঘটনাই ছিল না। এই কর্মকান্ডগুলির বিপরীতে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্ব থেকে আসছে বিভিন্ন বিবৃতি এবং নিন্দা। আল আকসা মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যে জর্দান ইস্রাইকে আহ্বান করেছে; তুরস্ক এবং মিশর থেকে নিন্দা এসেছে ইস্রাইলি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে। ঠিক এই ব্যাপারটাই চলেছে গত মে মাসে গাজা যুদ্ধের সময়েও। ইস্রাইলের সাথে সৌদি গ্রুপ এবং তুর্কিদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ইস্রাইলকে আরও বেপরোয়া করেছে। এহেন পরিস্থিতি ফিলিস্তিনে নতুন করে সংঘাতের আশংকাকে যেমন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি ফিলিস্তিনের ব্যাপারে মুসলিম নেতৃত্বের উদাসীনতা পুরো মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের সংকটকে সামনে নিয়ে আসছে; যা কিনা মুসলিমদের মাঝে প্রকৃত পরিবর্তনের হাহাকারকে আরও প্রকট করে তুলছে।

No comments:

Post a Comment