Saturday 30 October 2021

সুদানে অভ্যুত্থান মূলতঃ পশ্চিমা হস্তক্ষেপেরই ফলাফল

৩০শে অক্টবর ২০২১

ওয়াশিংটন আপাততঃ সুদানের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধাচরণ করলেও সুদানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দেখিয়ে দেয় যে, মার্কিনীরা সুদানের সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক কখনোই কর্তন করেনি। ওমর আল বশির ক্ষমতায় থাকার সময়েই যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী দেশের তালিকা থেকে সুদানের নাম সরিয়ে নেয়। বিনিময়ে সুদান মানবাধিকার বিষয়ে সুদানের কিছু আইন পরিবর্তন করে। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেই সৌদি আরব সুদানকে তেল সরবরাহসহ আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে।

 
গত ২৫শে অক্টোবর আফ্রিকার দেশ সুদানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটার চরমভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্থহীন হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদানের মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্জয় ২০১৯ সালে একনায়ক ওমর আল বশিরের সরকারের পতনের পিছনে নেতৃত্ব দেয়া জোট ‘ফোর্সেস অব ফ্রিডম এন্ড চেইঞ্জ’ বা ‘এফএফসি’কে মানুষের কাছে হেয় করেছে। ২০১৯ সালের অগাস্টে দেশ পরিচালনার জন্যে ‘এফএফসি’এর মনোনীত পাঁচজন এবং সেনাবাহিনীর মনোনীত পাঁচজন সদস্য মিলে ‘সভেরেইন কাউন্সিল’ গঠন করেছিল। তবে দুই বছরের মাঝে ‘এফএফসি’র নেতৃবৃন্দ দেশটাকে কোনরূপ দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনার কথা বেশ কিছুদিন আগ থেকেই শোনা যাচ্ছিল। ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রতিশ্রুত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আগেই এই অভ্যুত্থানকে শুধু সুদানের অভ্যন্তরীণ আঙ্গিক থেকে নয়, বরং দেশটা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে।

সুদানের দুই রাজনৈতিক দল গত ২রা অক্টোবর একটা নতুন জোট গঠন করে। মিনি মিনাউইএর নেতৃত্বে ‘সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট’ এবং জিবরিল ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ‘জাস্টিস এন্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট’ এই জোট গঠন করে। এই দলগুলি ২০২০এর অক্টোবরে সুদান সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এরপর থেকে উভয় নেতাই এতদিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। মিনাউই বলেন যে, তারা চান যে, ‘এফএফসি’র নেতারা তাদের কথা শুনবেন। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, এর ফলে ‘এফএফসি’এর বিভাজন আরও গভীর হয়। এই দুই রাজনৈতিক দল মূলতঃ দারফুর অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন; যারা বশির সরকারের সময় আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জন্যে যুদ্ধ করেছে। ‘এফএফসি’র মাঝে আরও রয়েছে দক্ষিণ সুদানের সীমানায় অবস্থিত কুরদুফান অঞ্চলের বিদ্রোহী দল ‘সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট নর্থ’। এছাড়াও রয়েছে দারফুরের ওয়াহিদ আল নূরএর নেতৃত্বে ‘সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট’এর আরেক অংশ। অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করা এই দলগুলি একত্রে ‘সুদান রেভোলিউশনারি ফ্রন্ট’ নামে ‘এফএফসি’র মাঝে ছিল। এই আঞ্চলিক বিদ্রোহী গ্রুপগুলি সুদানের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই গ্রুপগুলিকে আঞ্চলিক এবং পশ্চিমা শক্তিরা সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছে। সবচাইতে বড় উদাহরণ ছিল দক্ষিণ সুদান, যা সুদান থেকে আলাদা হয়ে যায় পশ্চিমা মদদে।

‘এফএফসি’র আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ‘ন্যাশনাল কনসেনসাস ফোর্সেস’; যাদের মূল নেতৃত্ব ছিল জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলির হাতে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সাদিক আল মাহদির প্রতিষ্ঠা করা ‘ন্যাশনাল উম্মা পার্টি’র সাথে কোয়ালিশনে ছিল বামপন্থী ‘সুদানিজ বাথ পার্টি’, ‘সুদানিজ কমিউনিস্ট পার্টি’ এবং হাসান আল তুরাবির প্রতিষ্ঠা করা ‘পপুলার কংগ্রেস পার্টি’। এই দলগুলি বরাবরই পশ্চিমা, বিশেষ করে ইউরোপের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছে। ১৯৮৯ সালে সাদিক আল মাহদির সরকারকে উৎখাত করেই ওমর আল বশির ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর থেকে মাহদি বশির সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। ‘এফএফসি’তে আরও অংশীদার ছিল বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সমন্বয়ে গঠিত ‘সুদানিজ প্রফেশনালস এসোসিয়েশন’ এবং আরও কিছু নারীবাদী সংগঠন; যেগুলি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মাপকাঠিতে ইউরোপ থেকে সরাসরি সমর্থন পেয়েছে।

সুদানের অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে পশ্চিমা নীতি থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না। এবছরের ২৯শে জুন ‘ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড বা ‘আইএমএফ’এর প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান ডেভিড ম্যালপাসের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, সংস্থাগুলির শর্ত হিসেবে সুদান তার নিজস্ব মুদ্রার মূল্যমান পুনর্নিধারণ করার পর বিশ্বব্যংকের ঋণ শোধ করে। এতে তিন দশক পর বিশ্বব্যংকের সাথে সুদানের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিশ্বব্যংকের শর্ত মানার পুরষ্কার হিসেবে ‘আইএমএফ’ দেশটার ২৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মওকুফ করে। এই মওকুফ সামনের দিনগুলিতে ৫০ বিলিয়ন ডলার বা দেশটার মোট বৈদেশিক ঋণের ৯০ শতাংশ ছাপিয়ে যাবে। তবে ঋণ মাফের শর্ত হিসেবে মুদ্রামান কমিয়ে ফেলায় সুদানে মুদ্রাস্ফীতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধগতির সাথে যুক্ত হয় চরম বেকারত্ব; যা কিনা জনগণকে দেশটার রাস্তায় নামায়। সুদানের বিরোধী রাজনীতিবিদেরা এই অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে বশিরের সরকারকে উৎখাতে সফলতা পেলেও সেই একই অসন্তোষ বেসামরিক ও সামরিক যৌথ নেতৃত্বকে অর্থহীন করেছে।

ওমর আল বশির ক্ষমতায় থাকার সময়েই যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী দেশের তালিকা থেকে সুদানের নাম সরিয়ে নেয়। বিনিময়ে সুদান মানবাধিকার বিষয়ে সুদানের কিছু আইন পরিবর্তন করে। দক্ষিণ সুদানের তেলখনিগুলি সুদান থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর থেকেই সুদানের অর্থনীতি বিপদে পড়ে। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেই সৌদি আরব সুদানকে তেল সরবরাহসহ আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে। ইয়েমেনের যুদ্ধে সুদান সৌদিদের পক্ষে সৈন্যও প্রেরণ করে। গত এপ্রিলে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা দেয় যে, কৃষিখাতে তারা এবছর সুদানকে ৪’শ মিলিয়ন ডলার দেবে। এই সহায়তা মূলতঃ ৩ বিলিয়ন ডলারের মূল সহায়তার অংশ। সুদান সরকারের বরাত দিয়ে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ বলে যে, এর মাঝে সাড়ে ৭’শ মিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যেই সুদান পেয়ে গেছে; যার মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্যে ৫’শ মিলিয়ন ডলারের পুঁজি। দুই বছর আগের আরও দেড় বিলিয়ন ডলারের অনুদানও নিশ্চিত করা হয়। ‘আরব নিউজ’ বলছে যে, অভ্যুত্থানে সৌদিরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তারা সকল পক্ষকে আলোচনার টেবিলে দেখতে চায়।

ওয়াশিংটন আপাততঃ সুদানের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধাচরণ করলেও সুদানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দেখিয়ে দেয় যে, মার্কিনীরা সুদানের সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক কখনোই কর্তন করেনি। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো ক্যামেরন হাডসন এক লেখায় সুদানের সমস্যার জন্যে সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি দায়ী করেন। তার কথায়, সুদানের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বোকা বানিয়েছে’; যা বারংবার হতে দেয়া যায় না। তিনি অবশ্য সুদানের অর্থনীতিতে ‘আইএমএফ’ এবং বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেয়া শর্তের ফলাফলগুলি ঠিকই এড়িয়ে যান। তবে আরবের মার্কিন বন্ধু দেশগুলির সুদানের সাথে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সুদানের অভ্যুত্থানে মিশর, সৌদি বা আমিরাত যেন সরাসরি সমর্থন না দেয়, সেজন্য ওয়াশিংটন যথেষ্ট কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। সুদানের রাজনীতিতে ইউরোপের প্রভাবের কথাও তিনি আলোচনায় আনেননি; যা বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে পরিপূর্ণতা দেয় না।



No comments:

Post a Comment