Friday 1 October 2021

মধ্য এশিয়াতে ইরান এবং তুরস্কের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা জটিল আকার নিচ্ছে

০২রা অক্টোবর ২০২১

আজেরবাইজানের সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে ইরানের সামরিক মহড়া সেই হিসেবে ইরানের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে তুরস্ক থেকে আজেরবাইজান হয়ে পূর্ব পশ্চিম পরিবহণ করিডোর সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে ইরানের সাথে রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পরিবহণ করিডোরকে। পরস্পরবিরোধী এই কৌশলগত করিডোরের মাঝে প্রতিযোগিতা সবে শুরু হয়েছে মাত্র; যার ভূরাজনৈতিক তাপমাত্রা লক্ষ্যণীয় হচ্ছে বিভিন্ন রকমের সামরিক মহড়া এবং কূটনৈতিক শব্দের ব্যবহারের মাঝ দিয়ে।



পহেলা অক্টোবর ইরানের সামরিক বাহিনী মধ্য এশিয়ার ককেশাসের দেশ আজেরবাইজানের সীমানায় বড় আকারের মহড়া শুরু করেছে। ‘আল জাজিরা’ ইরানের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলছে যে, ইরানের এই মহড়া আজেরবাইজান এবং জায়নিস্ট ইস্রাইলের কাছাকাছি সম্পর্কের ফলাফলের জের। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখানো হয় যে, ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার, আর্টিলারি এবং বহু সেনাসদস্যদের মহড়া শুরু হয়েছে। ইরানি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, তারা প্রথমবারের মতো নিজস্ব ডেভেলপ করা দূরপাল্লার মনুষ্যবিহীন ড্রোন পরীক্ষা করছে। ইরানের সেনাবাহিনীর কমান্ডার কিউমারস হাইদারি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেন যে, গত বছর নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধে আজেরবাইজান আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধ করার জন্যে আইসিস সন্ত্রাসীদেরকে ককেশাসে নিয়ে এসেছিল। তিনি বলেন যে, এই সন্ত্রাসীরা এখনও এই এলাকা ছেড়ে গেছে বলে তারা নিশ্চিত নন; তবে তাদেরকে এই এলাকা ছেড়ে যেতে হবে।

‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সেপ্টেম্বর মাসে আজেরবাইজানের বাকুতে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের যৌথ সামরিক মহড়ার পরপরই ইরানের ‘ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর’ বা ‘আইআরজিসি’ আজেরবাইজানের সীমানায় সৈন্য এবং সামরিক যন্ত্রপাতি মোতায়েন করে। ইরান বারংবার ইস্রাইলের সাথে আজেরবাইজানের সম্পর্কের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা দেখিয়েছে। ২০২০ সালের শেষের দিকে আর্মেনিয়ার সাথে ৪৪ দিনের যুদ্ধে জয়লাভের পিছনে আজেরিদের একটা বড় সহায়তা এসেছিল ইস্রাইলের কাছ থেকে। ৩০শে সেপ্টেম্বর তেহরানে আজেরবাইজানের নতুন রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাব্দোল্লাহিয়ান। তিনি আজেরি প্রতিনিধিকে সরাসরিই বলেন যে, ইরান তার জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে জায়নিস্ট ইস্রাইলের অবস্থান এবং কর্মকান্ডকে সহ্য করবে না এবং দরকার বিশেষে যা করা দরকার, সেটাই করবে।

তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে দেয়া এক সাক্ষাতে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ বলেন যে, যেকোন দেশই নিজ অঞ্চলে সামরিক মহড়া করতে পারে; এটা তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার মাঝে পড়ে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না যে, ইরান কেন আজেরবাইজানের সীমানায় মহড়া শুরু করেছে এবং সেটা এখনই বা কেন? তিনি মনে করিয়ে দেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে প্রথমবারের মতো ইরান আজেরিদের সীমানায় শক্তি প্রদর্শন করছে। আজেরিরা তিন দশক পর কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে; আর এখনই ইরান আজেরবাইজানের সীমানায় মহড়া শুরু করেছে।

আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানে ইরানের ট্রাক

দুই দেশের মাঝে উত্তেজনার কিছুটা পাওয়া যাবে গত মাসে ইরানের পণ্যবাহী ট্রাকের উপর আজেরিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা শুরুর পর থেকে। ২০২০ সালের নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধের পর থেকে তিন দশকে প্রথমবারের মতো কারাবাখ অঞ্চলে আজেরিদের কর্তৃত্ব বহাল হয়। আজেরিরা সেটা নিশ্চিত করতে ইরানের ট্রাকের উপর থেকে ‘রোড ট্যাক্স’ আদায় করা শুরু করে। আলিইয়েভ বলেন যে, এই করারোপ শুরু করার পর থেকে ইরান থেকে আর্মেনিয়াতে যাওয়া ট্রাকের সংখ্যা প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তিনি আরও বলেন যে, ১১ই অগাস্ট থেকে ১১ই সেপ্টেম্বরের সময়ের মাঝে আজেরিরা মোট ৬০টা ইরানিয়ান ট্রাকের আজেরি রাস্তা ব্যবহারের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। কিছু ট্রাক নিজেদের পরিচয় গোপন করে আর্মেনিয়ার লাইলেন্স প্লেট ব্যবহার করছে। আজেরিরা বারংবার ইরানের কর্মকর্তাদের এব্যাপারে তথ্য দিচ্ছে বলে বলেন আলিইয়েভ। 


আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ বলেন যে, যেকোন দেশই নিজ অঞ্চলে সামরিক মহড়া করতে পারে; এটা তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার মাঝে পড়ে। কিন্তু সেটা এখনই বা কেন? তিনি মনে করিয়ে দেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে প্রথমবারের মতো ইরান আজেরিদের সীমানায় শক্তি প্রদর্শন করছে। আজেরিরা তিন দশক পর কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে; আর এখনই ইরান আজেরবাইজানের সীমানায় মহড়া শুরু করেছে।


 ‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রথমদিকে আজেরি পুলিশ এবং কাস্টমস কর্মকর্তারা ইরানের ট্রাক আটক করা শুরু করলে ইরান চুপই ছিল। আর্মেনিয়ার মিডিয়া বলছে যে, ট্রাকগুলির বেশকিছু আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান এবং নাগোর্নো কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ট যাচ্ছিলো সিমেন্ট নিয়ে। ইরানের ব্যবহার করা অঞ্চলটা আন্তর্জাতিকভাবে আজেরি অঞ্চল বলে স্বীকৃত; যদিও তিন দশক ধরে তা আর্মেনিয়ানদের হাতে অধিকৃত ছিল। কারাবাখের এই অঞ্চলের মাঝ দিয়ে এতকাল ইরান থেকে আর্মেনিয়ার দক্ষিণের গোরিস এবং কাপান অঞ্চলে পণ্য পরিবহণ হচ্ছিলো। এই হাইওয়ে হলো ইরান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে একমাত্র হাইওয়ে।

আজেরবাইজানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এহসান জাহাদভ বলেন যে, ট্রাকগুলি বেআইনীভাবে আর্মেনিয়া থেকে আজেরবাইজানের কারাবাখ অঞ্চলে ঢোকার কারণেই ড্রাইভারদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর থেকে ইরানের কর্মকর্তারা আজেরিদের সাথে এই সমস্যা সমাধানে বৈঠক করছেন বলে জানা যায়। আজেরবাইজানে ইরানের রাষ্ট্রদূত আব্বাস মুসাভি এক সপ্তাহে দু’বার আজেরি প্রেসিডেন্ট আলিইয়েভের জেষ্ঠ্য পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিকমেত হাযিইয়েভের সাথে দেখা করেন। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের সাইডলাইনে আজেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেইহুন বায়রামভ এবং ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরআব্দোল্লাহিয়ান বৈঠক করেন। ‘তেহরান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দেশের মাঝে তৃতীয় কোন পক্ষের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে উদ্রেক জ্ঞাপন করেন। এই তৃতীয় পক্ষ বলতে ইরান মূলতঃ ইস্রাইলকেই বোঝাতে চাইছে। ইরানের রাজনীতিবিদেরা কেউ কেউ আজেরিদের সাথে সম্পর্ককে আরও কঠিন পরীক্ষার মাঝেই ফেলতে চাইছেন। ইরানের পার্লামেন্ট সদস্য আহমেদ নাদেরি এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, আজেরিরা নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারছে না এবং নিজেদের আকৃতি এবং সক্ষমতার বাইরে কথা বলছে। আরেকজন পার্লামেন্ট সদস্য মোহাম্মদ রেজা আহমাদি সাঙ্গারি বলছেন যে, আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধ জয়ের পর আজেরিরা অহংকারি হয়ে গেছে এবং তাদেরকে ইন্ধন যোগাচ্ছে তুরস্ক। তিনি কঠোর ভাষায় বলেন যে, আজেরবাইজানের মতো ছোট্ট দেশের বয়স ইরানের সর্বকনিষ্ঠ রাজনীতিবিদের বয়সের চাইতেও কম!

আজেরিদের সাথে ইরানের সম্পর্কের অবনতি কেন?

দুই দেশের মাঝে সন্দেহের সম্পর্ককে তুলে ধরছেন লাটভিয়ার কূটনীতি বিশ্লেষক এলদার মামিদভ। তিনি ‘ইউরেশিয়ানেট’কে বলছেন যে, আজেরিদের মাঝে একটা ধারণা রয়েছে যে, ইরান আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে আজেরিদের বিপক্ষে থেকেছে। এর মাঝে ইস্রাইলের সাথে আজেরবাইজানের কথাকাছি সম্পর্ক ইরানের জন্যে হুমকিস্বরূপ। এছাড়াও আজেরিরা কেউ কেউ মনে করে যে, ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের আজেরি অধ্যুষিত দক্ষিণ আজেরবাইজানকে ইরানের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের এই আজেরিরা অনেক ক্ষেত্রেই আজেরবাইজানের সাথে সহমর্মিতা প্রদর্শন করে। বিশেষ করে আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধের সময় ইরানের আজেরিরা চাইছিলো ইরান সরকার যেনো আজেরবাইজানের পক্ষাবলম্বন করে। এমতাবস্থায় মামিদভ বলছেন যে, ইরানের উত্তরাঞ্চলের ককেসাস সীমানায় নতুন করে আজেরিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করার সুযোগ নেই। পারস্য উপসাগর, ইরাক এবং আফগানিস্তানে ইরান ইতোমধ্যেই অনেক চ্যালেঞ্জের মাঝে রয়েছে।

তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি’ বলছে যে, সাম্প্রতিক কারাবাখ যুদ্ধের আগ পর্যন্ত তিন দশক ধরে এই অঞ্চল আর্মেনিয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তেহরানের সাংবাদিক ফাতিমা কারিমখান বলছেন যে, এই সময়ে ইরানের ট্রাকগুলি কোন কর প্রদান ছাড়াই কারাবাখের অঞ্চল ব্যবহার করে আর্মেনিয়া, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্য চালিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের পর কারাবাখের বেশিরভাগটাই আজেরিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ইরানের এই পরিবহণ করিডোরের উপর আজেরিরা কাস্টমস নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি আরও বলছেন যে, ইরানের ট্রাকের ব্যাপারে আজেরি প্রেসিডেন্টের কথাগুলি ইরানের জনমতের বিরুদ্ধে যায়। ইরানের ট্রাক আটকে দেয়ার ব্যাপারটা ইরানিরা ভালো চোখে দেখেনি। এই ট্রাক আটকানের মাধ্যমে আজেরিরা মধ্য এশিয়াতে ইরানের বাণিজ্য নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সামরিক মহড়ার মাধ্যমে ইরান দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এই বাণিজ্য পরিবহণ করিডোর ইরানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ।

তবে আজেরিদের মাঝে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন যে, ইরানের ট্রাকগুলিতে করে হয়তো ইরান থেকে আর্মেনিয়ার কাছে সামরিক সহায়তা যেতে পারে; যা পরবর্তীতে আজেরিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো মাথিউ ব্রাইজা বলছেন যে, ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন হিসেবে প্রায় দুই কোটি আজেরি বসবাস করে। আজেরিদের মাঝে অনেক জাতিয়তাবাদী এবং শিক্ষাবিদেরা মনে করেন যে, আজেরবাইজান এবং ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিরা সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে একইরকম। সেই হিসেবে তাদের একই রাজনৈতিক একাত্মতা প্রকাশ করা উচিৎ। এই ব্যাপারগুলি তেহরানের নেতৃত্বকে বিচলিত করছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আজেরবাইজানে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের যৌথ সামরিক মহড়া হয়তো ইরানের আজেরি জনগণের জন্যে তেহরানের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কোন বার্তা বহণ করতে পারে। আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজেরবাইজানের ৪৪ দিনের যুদ্ধ ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদের মাঝে যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। ইরানের আজেরিরা চাইছিল ইরান সরকার যেন আর্মেনিয়ার পক্ষ না নেয়। সেই হিসেবে ইরানের উত্তর পশ্চিমের তাবরিজ শহরের আজেরি জনগণ আজেরবাইজানের পক্ষে রাস্তায় বিক্ষোভও করেছে। ইরান সরকার তার আজেরি জনগণের জন্যে হয়তো বার্তা দিচ্ছে যে, তুর্কি এবং পাকিস্তানি যৌথ মহড়ার উপর ভিত্তি করে ইরানের আজেরিরা যেন কোন অস্থিরতার সৃষ্টি না করে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর মাইকেল ডোরান বলছেন যে, আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধের সময় জর্জিয়া তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়ার কারণে রাশিয়া কাস্পিয়ান সাগর হয়ে ইরানের অঞ্চল ব্যবহার করে আর্মেনিয়াতে পণ্য পরিবহণ করছিলো। বর্তমানে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিইয়েভ প্রকৃতপক্ষে তুরস্কের জনগণের কাছ থেকে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। এরউপরে এখানে যোগ হয়েছে ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’এর ইস্যু। এই করিডোর হলো আজেরবাইজানের মূল ভূখন্ড এবং দেশটার নাখচিভান ছিটমহলের মাঝে যোগাযোগের করিডোর। একইসাথে এই করিডোর নাখচিভান হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত যাবে। ইরান এই করিডোরকে মূলতঃ তুর্কি করিডোর হিসেবে দেখছে। এই করিডোর ইরানের উত্তরের অঞ্চলকে একেবারেই ঘিরে ফেলবে বলে ইরানিয়ানরা মনে করছে। অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে ইরানের উত্তরাঞ্চল তখন তুরস্ক থেকে আজেরবাইজান পর্যন্ত একটা পরিবহণ করিডোর দ্বারা ঘিরে যাবে। আর ইরানের অভ্যন্তরে বড় আজেরি জাতি থাকার কারণে এই করিডোর তখন ইরানের জন্যে হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। তদুপরি অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন যে, আজেরবাইজানের সাথে সম্পর্ককে ব্যবহার করে এবং ইরানের অভ্যন্তরে অসন্তুষ্ট আজেরিদের সম্পর্ককে পুঁজি করে ইস্রাইল সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় বহু হামলা চালিয়েছে। তেহরানের নেতৃত্ব খুব স্বাভাবিকভাবেই বাকুর সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ককে ভালোভাবে দেখবে না।

 


গত এপ্রিলে ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ নিয়ে আজেরি প্রেসিডেন্ট আলিইয়েভের কথাগুলি যথেষ্ট আলোচিত হয়েছে। আজেরবাইজানের সরকারি টেলিভিশনে আলিইয়েভ বলেন যে, ৯ই নভেম্বর ২০২০এর চুক্তি অনুযায়ী আর্মেনিয়া আজেরবাইজানকে দেশটার কারাবাখ অঞ্চল থেকে নাখচিভান ছিটমহল পর্যন্ত পরিবহণ করিডোর দেবে। আজেরবাইজান এই ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ বাস্তবায়ন করবে; সেটা আর্মেনিয়া ইচ্ছা করুক বা না করুক। যদি আর্মেনিয়া এটা করতে চায়, তাহলে সমস্যা সমাধান সহজ হবে। কিন্তু তারা না চাইলে শক্তি দিয়ে এটা বাস্তবায়ন করা হবে। এর জবাবে আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আনা নাখতালিয়ান বলেন যে, আলিইয়েভের এধরনের মন্তব্য আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিলিশীলতাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে। একইসাথে তিনি আজেরবাইজানের শান্তি এবং দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সমাধানের প্রতি অঙ্গীকারকে প্রশ্ন করেন। আর্মেনিয়ান প্রধানমন্ত্রী নিকল পাশিনিয়ান আর্মেনিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে গেলে সেখানে জনগণের আক্রোশের মুখে পড়েন। কারণ সেই অঞ্চল দিয়েই ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ বাস্তবায়নের কথা বলছে আজেরবাইজান। আলিইয়েভ বলেন যে, আজেরবাইজানের জনগণ ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’এ ফেরত আসবে; যা ১’শ ১ বছর আগে আজেরিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এই করিডোর চালু করাটা আজেরবাইজানের জাতীয় স্বার্থের প্রকল্প। তিনি বলেন যে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ এখন সময়। কারণ রেলওয়ে এবং রাস্তা তৈরি করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

আর্মেনিয়ার সাথে নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধে জয়ী হওয়াটা আজেরিদেরকে সাহস যুগিয়েছে। বিশেষ করে তুরস্ক এবং ইস্রাইলের সমর্থন আজেরিদের সামরিক সক্ষমতাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তারা নিজেদের দাবি আদায়ে আর্মেনিয়ার সাথে নতুন করে শক্ত ভাষায় কথা বলতেও পিছপা হচ্ছে না। আজেরিদের এই চিন্তাগুলি আঞ্চলিকভাবে ইরানকে বিচলিত করেছে। ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’এর মতো প্রকল্পগুলি মধ্য এশিয়াতে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক করিডোরকে হুমকির মাঝে ফেলেছে। কারাবাখে ইরানের ট্রাক আটকে দেয়ার ব্যাপারটা তাই মধ্য এশিয়াতে ইরানের কৌশলগত অবস্থানের প্রতি হুমকি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের যৌথ সামরিক মহড়া, যার একটা প্রভাব হয়তো পড়তে পারে ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদের উপর। আজেরবাইজানের সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে ইরানের সামরিক মহড়া সেই হিসেবে ইরানের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে তুরস্ক থেকে আজেরবাইজান হয়ে পূর্ব পশ্চিম পরিবহণ করিডোর সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে ইরানের সাথে রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পরিবহণ করিডোরকে। পরস্পরবিরোধী এই কৌশলগত করিডোরের মাঝে প্রতিযোগিতা সবে শুরু হয়েছে মাত্র; যার ভূরাজনৈতিক তাপমাত্রা লক্ষ্যণীয় হচ্ছে বিভিন্ন রকমের সামরিক মহড়া এবং কূটনৈতিক শব্দের ব্যবহারের মাঝ দিয়ে। আপাততঃ এই প্রতিযোগিতাতে রাশিয়া সরাসরি অংশ নেয়া থেকে বিরত রয়েছে। তুরস্কও চাইছে রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলতে। কিন্তু মধ্য এশিয়ার ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের মাঝে তুরস্ক এবং রাশিয়ার সংঘাত এড়িয়ে চলার সমীকরণ দিনে দিনে আরও জটিল হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment