Thursday 21 October 2021

‘আসিয়ান’এর অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করছে ‘অকাস’ চুক্তি

২১শে অক্টোবর ২০২১


 

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং আস্ট্রেলিয়ার মাঝে কৌশলগত চুক্তি ‘অকাস’ স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট ‘এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস’ বা ‘আসিয়ান’এর সদস্য দেশগুলির মাঝে সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দিয়েছে। জোটের সদস্য মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া যখন বলছে যে, এই চুক্তির ফলে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছের রাষ্ট্র ফিলিপাইন এই চুক্তিকে সমর্থন দিয়েছে।

গত ১২ই অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসামুদ্দিন হুসেইন পার্লামেন্টকে বলেন যে, মালয়েশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে শক্তির ব্যালান্স যাই থাকুক না কেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে রক্ষা করা। ‘আসিয়ান’এর সদস্য রাষ্ট্রদের চিন্তার মাঝে একটা সমঝোতাই কেবল এই দুই শক্তিশালী দেশকে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। জাপানের মিডিয়া ‘এনএইচকে’ বলছে যে, গত ১৭ই সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাঈল সাবরি ইয়াকব অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে বলেন যে, ‘অকাস’ চুক্তি দক্ষিণ চীন সাগরে অন্যান্য শক্তিকে আরও আগ্রাসী ভূমিকা নিতে উস্কে দিতে পারে। একই দিনে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, অত্র অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে ইন্দোনেশিয়া ভীষণভাবে চিন্তিত। মার্কিন সামরিক পত্রিকা ‘স্ট্রারস এন্ড স্ট্রাইপস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ১৬ই সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সিয়েন লুং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেন যে, এই চুক্তি আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সহায়তা করবে এবং আঞ্চলিক কাঠামোকে সমর্থন দেবে। পরদিন ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডেলফিন লরেনজানা অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডাটনকে ফোন করে বলেন যে, অস্ট্রেলিয়ার অধিকার রয়েছে তার সাবমেরিন প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার; ফিলিপাইনও তার নিজস্ব অঞ্চলকে রক্ষা করতে সক্ষমতা তৈরি করছে। ২৩শে সেপ্টেম্বর ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লে থি থু হাং নির্দিষ্ট না করেই বলেন যে, সকল রাষ্ট্রই শান্তি, স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা এবং উন্নয়ন চায়। অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক প্রযুক্তি কেনা নিয়ে তিনি বলেন যে, পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার হতে হবে শান্তিপূর্ণ এবং তা আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগতে হবে।

থাইল্যান্ডের ‘চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর থিতিনান পংসুধিরাক ‘ব্যাংকক পোস্ট’এর এক লেখায় মত দিচ্ছেন যে, ‘অকাস’ চুক্তি চীনকে যেমন উস্কে দেবে, তেমনি ‘আসিয়ান’কে আরও বিভক্ত করবে। একইসাথে এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন সরবরাহ করলে ইইউ এবং জাপানসহ অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলিও চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে যাবে। পংসুধিরাকের সাথে একমত নন থাইল্যান্ডের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কাভি চংকিত্তাভর্ন। একই পত্রিকার এক লেখায় তিনি বলছেন যে, একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্র অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে; এখন করছে চীন। তিনি বলেন যে, ‘আসিয়ান’ যদি সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তবে সংস্থার আকাত্মতায় সমস্যা হবে। গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা বলছে যে, ‘আসিয়ান’এর সক্ষমতা রয়েছে টিকে থাকার। এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে এর সদস্য দেশগুলির কেউ কেউ ভিন্ন পথে হাঁটার চেষ্টা করেছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সংস্থায় ভাঙ্গন ধরাতে পারেনি।

নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কাজ করা মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক পল বিউকানান ‘স্টারস এন্ড স্ট্রাইপস’কে বলছেন যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চিন্তিত যে, দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালি, মালয় দ্বীপপুঞ্জ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় পারমাণবিক শক্তির আনাগোনা আরও দেশকে পারমাণবিক শক্তির দিকে আকর্ষণ করতে পারে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলি, যেগুলি এই মুহুর্তে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে না, তারাও এব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। এই পুরো ব্যাপারটা সংঘাতের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ চীন তার আঞ্চলিক অবস্থানকে ধরে রাখতে চেষ্টা করবে এবং চাপের মুখে তার শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে।

সিঙ্গাপুরের সরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ইসেয়াস ইউসোফ ইসহাক ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম চুং এবং শ্যারন সেয়া ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, যখন ‘আসিয়ান’এর বাইরের দেশগুলি অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছে, তখন বোঝা যায় যে, চীনা আগ্রাসী তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণে ‘আসিয়ান’ ব্যর্থ হয়েছে। ‘আসিয়ান’ মনে করছে যে, ‘কোয়াড’এর মতো জোট তৈরি হওয়া মানেই চীনকে আরও খেপিয়ে তোলা। তারা ‘আসিয়ান’এর শক্ত নেতৃত্ব দাবি করেন এবং বর্তমান নেতৃত্বের সমালোচনা করেন। ‘আসিয়ান’এর বর্তমান চেয়ারম্যান ব্রুনাইএর কার্যকলাপকেও তারা বিবৃতিসর্বস্ব বলে আখ্যা দেন। একইসাথে সংস্থার মাঝে এখন অনেক বিষয়েই বিরোধ; যার ফলশ্রুতিতে শুধু ছাড় দিয়েই চলতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে শীর্ষ বৈঠকে আমন্ত্রণ না জানানো হলেও তার একজন প্রতিনিধিকে সন্মেলনে আসার অনুমতি দেয়া হয়। একারণেই বাইডেন প্রশাসন ‘আসিয়ান’এর সমঝোতার জন্যে অপেক্ষা না করে সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনামের মতো সদস্যদেশগুলির সাথে আলাদাভাবে সম্পর্ক তৈরি করছে। লেখকেরা বলছেন যে, দিন শেষে ‘আসিয়ান’ হয়তো কোনমতে চালিয়ে নেবে; কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, ‘আসিয়ান’এর বয়স হয়েছে।

‘অকাস’ চুক্তি ‘আসিয়ান’এর মতো একটা সংস্থার অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার চীনকে নিয়ন্ত্রণের নীতিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে বাধ্য করছে এক পক্ষ নিতে। কিন্তু এই দেশগুলি অর্থনৈতিকভাবে অনেকাংশেই চীনের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও আরেক বাস্তবতার মাঝে রয়েছে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। পূর্ব এশিয়ার প্রায় সবগুলি কৌশলগত সমুদ্রপথই এই দেশগুলির মাঝ দিয়ে গিয়েছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে যে কোন সম্ভাব্য সংঘাতে এই দেশগুলির উঠানই হয়ে উঠবে যুদ্ধক্ষেত্র। চীনের বেশি কাছে অবস্থিত হওয়ায় ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামের কাছে যখন চীনের হাত থেকে সমুদ্রসীমা উদ্ধার মূল লক্ষ্য, তখন মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া তাদের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমাকে সংঘাতমুক্ত দেখতেই বেশি আগ্রহী। অর্থাৎ সংস্থার সদস্যদেশগুলির জাতীয় লক্ষ্য এখন সংস্থার সাথে একাত্মতা প্রকাশকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। একারণেই যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং সিঙ্গাপুরের সাথে আলাদা সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহী হয়েছে। এমতাবস্থায় মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া নিজস্ব কৌশলগত দিকনির্দেশনা খুঁজবে। একইসাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবার সাথেসাথে অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে নতুন খেলোয়াড় যোগ হবে এবং নতুন নতুন কৌশলগত জোট তৈরি হবে।

No comments:

Post a Comment