Friday 22 October 2021

‘অকাস’ চুক্তির যে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কথা বলছে না…

২২শে অক্টোবর ২০২১


 
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে স্বাক্ষরিত ‘অকাস’ কৌশলগত চুক্তির মাঝে যে ব্যাপারটা মিডিয়াতে বেশি হাইলাইট হয়েছে, তা হলো অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা। তবে অনেকেই হয়তো খেয়াল করেনি যে, এই চুক্তির আরও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাইবার নিরাপত্তা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’ এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। পারমাণবিক সাবমেরিনের পরিকল্পনার কারণে ফ্রান্সের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ডিজেল সাবমেরিন কেনার বড় রকমের চুক্তিও বাতিল হয়ে যায়। ফ্রান্স এই চুক্তির ব্যাপারে একেবারেই অবগত না থাকার কারণে এবং নিজেদের সাবমেরিন বিক্রির চুক্তি বাতিল হবার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পাঠায়। এমনকি ফরাসিরা এই চুক্তিকে ফ্রান্সের পিছন থেকে ছুরি মারার সাথেও তুলনা করে। ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক এই দ্বন্দ্ব কিছু সময়ের জন্যে আন্তর্জাতিক হেডলাইন কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু কখনোই সাইবার নিরাপত্তা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হাইলাইট হয়নি। কিছু কৌশলগত বিশ্লেষকেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, চুক্তির এই অংশটা চীনের সাথে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের জন্যে অনেক বড় পদক্ষেপ ছিল।

মার্কিন সেনাবাহিনীর সাইবার কমান্ডের প্রাক্তন প্রধান কৌশলী নিকোল কামারিলো এবং ব্রিটিশ সরকারের ‘ডিজিটাল সার্ভিস’এর ডেপুটি ডিরেক্টর অলিভার লুইস সামরিক ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক লেখায় বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার সাথে সাবমেরিনের চুক্তিটা ছিল আরও বড় কর্মকান্ডের জন্যে ‘ডাউনপেমেন্ট’; উন্নততর প্রযুক্তি ডেভেলপ করার পিছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের প্রতিশ্রুতি। এই প্রযুক্তির মাঝে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং আরও কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, যেখানে পশ্চিমারা এখন চীনাদের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতার মাঝে রয়েছে। তারা যুক্তি দিচ্ছেন যে, নতুন যুগের ডিটারেন্স বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, বোমারু বিমান বা সাবমেরিনের উপরে তেমন নির্ভরশীল নয়; বরং সেখানে মূল নির্ভরশীলতা থাকবে সফটওয়্যারের শক্তি, দ্রুতি এবং টিকে থাকার সক্ষমতার উপর। চীনা সরকার এই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার জন্যেই প্রচুর বিনিয়োগ করছে এবং তাদের কাছে ১’শ ৪০ কোটি মানুষের বিশাল ডাটাবেস তো রয়েছেই। চীনারা বেসরকারি খাতকেও সামরিক প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে বলছে।

কামারিলো এবং লুইস বলছেন যে, চীনা কর্মকান্ডকে মোকাবিলা করার জন্যে পশ্চিমাদেরকে ‘এআই’ ডেভেলপ করায় সহযোগিতা বাড়ানো ছাড়াও সম্ভব সবচাইতে বড় ডাটাবেস যোগাড় করতে হবে; যার মাঝে তারা ‘এআই’কে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। তবে পশ্চিমারা যেখানে চীনাদের থেকে এগিয়ে আছে, তা হলো ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোট; যার মাঝে অকাসের যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে রয়েছে কানাডা এবং নিউজিল্যান্ড। লেখকেরা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের ইন্টেলিজেন্স সহযোগিতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিকে পরাজিত করেছিল। এরপর ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ‘ফাইভ আইজ’ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিততে সহায়তা দিয়েছে। আর বর্তমানে ইন্টেলিজেন্স জোগাড় এবং বিশ্লেষণ পুরোটাই যেহেতু ডিজিটাল ডোমেইনে হয়ে থাকে, তাই সেখানে নেটওয়ার্কে যুক্ত সেন্সর, ‘এআই’এর এলগোরিদমের মাধ্যমে ডাটা প্রসেসিং ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ। ‘এআই’ ব্যবহার করা না হলে তা সাইবার আক্রমণের শিকার হবে; আর এটাকে রক্ষা করা না গেলে ‘এআই’এর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে চলে যাবে। কামারিলো এবং লুইস প্রস্তাব দিচ্ছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু দেশগুলিকে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে সকলেই বুঝতে পারে যে, ‘এআই’ প্রকৃতপক্ষে ভালো কাজে ব্যবহার হবে; মানুষকে নিয়ন্ত্রণের কাজে নয়। আর মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ‘এআই’ কাজ করবে না কখনোই।

অস্ট্রেলিয়ার নীতিগত ফোরাম ‘ইস্টএশিয়া ফোরাম’এর এক লেখায় ‘স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র গবেষক আরজান তারাপোর বলছেন যে, ‘অকাস’ চুক্তি ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোটকে ছাপিয়ে উন্নততর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং ইন্ডাস্ট্রিকে একত্রে নিয়ে এসেছে। সামরিক প্রযুক্তি শেয়ার করাটা নতুন নয়; তবে কিছু প্রযুক্তি অন্যগুলি থেকে একটু বেশিই দামি। যেমন পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা যুদ্ধের চরম পর্যায়ে শুধুমাত্র ব্রিটেনের সাথে শেয়ার করেছে। এখন বেশ কয়েক দশক পর তারা একই প্রযুক্তি অস্ট্রেলিয়াকে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু কেন? কারণ ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোটের মাধ্যমে এই দেশগুলি ইন্টেলিজেন্স জোগাড় এবং শেয়ার করার জন্যে বহুকাল ধরে যৌথ সিস্টেম, সংস্থা ও প্রসেস ডেভেলপ করেছে। ‘ফাইভ আইজ’এর পার্টনারদেরকেই ওয়াশিংটন বিশ্বাস করছে; কারণ ওয়াশিংটন ‘অকাস’এর মাধ্যমে এমন সকল প্রযুক্তি শেয়ার করতে যাচ্ছে, যা কিনা তারা তাদের সবচাইতে কাছের ইন্টেলিজেন্স পার্টনারদের সাথেই শেয়ার করবে। ‘এআই’, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং সাইবার প্রযুক্তিই সামনের দিনগুলিতে ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতার সর্বসন্মুখে থাকবে। আরজান তারাপোর বলছেন যে, ফ্রান্স এই ‘ফাইভ আইজ’এর অংশ না থাকার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে ‘অকাস’এ রাখতে চায়নি।

তারাপোর প্রস্তাব দিচ্ছেন যে, ‘অকাস’কে যদি আঞ্চলিক পার্টনারদের কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে হয়, তাহলে ফ্রান্স এবং ভারতের মতো বন্ধুদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তি এবং ডাটা শেয়ার করতে হবে। এই দেশগুলি’ ‘অকাস’এর মাঝে না থকলেও এদের গুরুত্ব অনেক। ‘অকাস’ সকল কিছু করতে পারবে না। তাই বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রুপিংএর সাথে ‘অকাস’কে একত্রে কাজ করতে হবে। একেকটা গ্রুপিং একেক উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে। যেমন ‘কোয়াড’ ব্যবহৃত হবে আঞ্চলিক সহযোগিতার ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে। ফ্রান্স এবং ভারতের নিজস্ব সামরিক শক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রভাবের আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা ‘অকাস’ ব্যবহার করতে পারে। একারনেই তারাপোর ‘অকাস’কে ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে মনোনিবেশ করতে বলছেন। তবে তিনি বলছেন যে, ‘অকাস’এর পুরো ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ আলাদা।

সবশেষে ‘অকাস’ চুক্তির ভিত্তি নিয়ে কথা বলেছেন কামারিলো এবং লুইস। তারা বলছেন যে, ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মাঝে স্বাক্ষরিত ‘আটলান্টিক চার্টার’ই হলো এই দুই দেশের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এবছরের জুন মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই একই চার্টারের একটা পরিবর্তিত ভার্সন স্বাক্ষর করেন। মুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজের আদর্শকে দুনিয়াব্যাপী প্রচার করা ছাড়াও তাদের প্রযুক্তিগুলিকে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির মাধ্যমে নিজেদের হাতে ধরে রাখা এবং সাইবার হামলা প্রতিহত করার মতো চিন্তাগুলির ভিত সেই চার্টারের মাঝেই রয়েছে।

বিশ্লেষকদের এই কথাগুলি থেকে পরিষ্কার যে, ‘অকাস’ সাম্প্রতিক সময়ে স্বাক্ষরিত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত চুক্তি। ইংরেজি ভাষাভাষী ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডার মাঝেই গড়ে উঠেছে সেই ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোট, যাকে পুঁজি করেই সামনের দিনগুলিকে ‘অকাস’ প্রযুক্তিগত দিক থেকে দুনিয়াতে এগিয়ে থাকতে চাইছে। এই প্রযুক্তির সর্বসন্মুখে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’; যাকে সমর্থন যোগাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং নিরাপত্তা দেবে সাইবার প্রযুক্তি। ‘আকাস’ চুক্তির মূলেই রয়েছে এই প্রযুক্তিগুলি; যা সামনের দিনগুলিতে প্রতিরক্ষা খাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ হবে; যদিও মিডিয়াতে পারমাণবিক সাবমেরিনের কথাই বেশি প্রচারিত হয়েছে। অতি সংবেদনশীল এই প্রযুক্তিগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র তার সবচাইতে কাছের ‘বিশেষ’ গ্রুপের সাথেই শেয়ার করতে চাইছে। আর নিজেদের এই ‘বিশেষ’ গ্রুপের মাঝে ফান্স এবং ভারতের মতো দেশগুলিকে ঢুকতে না দিলেও ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাকি দেশগুলিকেও তাদের সাথে রেখে তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে।

3 comments:

  1. France ফাইভ আইজ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি কেন বা ফ্রান্সকে ফাইভ আইজ চুক্তিতে রাখা হয়নি কেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. France wasn't invited because they are not English speaking or Anglo-Saxon... The French or the Germans never had the same thought as that of the English.

      Delete
  2. পশ্চিমা সভ্যতার তল্পিবাহক এই সব দেশগুলি, তাদের পরিকল্পনায় কতটা সফল হতে পারবে, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা সামগ্রিকভাবেই ধংসের মুখে দাড়িয়ে আছে?

    ReplyDelete