Sunday 31 October 2021

বেলারুশ কি ইইউএর বিরুদ্ধে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ চালাচ্ছে?

৩১শে অক্টোবর ২০২১

পশ্চিমা চিন্তার স্তম্ভ মানবাধিকার ইইউএর সদস্য রাষ্ট্রগুলির শরণার্থী বিরোধী জাতীয়তাবাদী চিন্তার কাছে হার মেনেছে। পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে গণতান্ত্রিকভাবেই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রাশিয়ার সমর্থনে বেলারুশ ইউরোপের দুর্বলতাকেই উস্কে দিচ্ছে; যাকে ইইউ বলছে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ। ইউরোপের লিবারাল গণতান্ত্রিক আদর্শ দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে; আর এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে উগ্রবাদী জাতীয়তাবাদী চিন্তা। লিবারাল চিন্তার উৎসস্থলে এই দুর্যোগ ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থারই প্রমাণ মাত্র।

 পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশের সাথে ইইউএর যখন উত্তপ্ত সম্পর্ক চলছে, তখন ইইউএর অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো ইইউএর সাথে শরণার্থী ব্যবহার করে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। আর এই যুদ্ধে লুকাশেঙ্কোর প্রধান সমর্থনকারী হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অপরদিকে ইইউএর পূর্ব সীমানার দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং পোল্যান্ড শরণার্থীদের আটকাতে তাদের সীমানায় দেয়াল তৈরিতে উদ্যত হয়েছে; এবং এব্যাপারে তারা ইইউএর সহায়তা চাইছে।

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর সাথে সাক্ষাতে ইইউএর স্বরাষ্ট্র কমিশনার ইয়ালভা জোহানসন বলেন যে, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো মানুষকে আগ্রাসনের জন্যে ব্যবহার করছেন। তিনি দাবি করেন যে, বেলারুশের উপর ইইউএর অবরোধগুলি তাকে আঘাত করছে বলেই তিনি এখন মরিয়া হয়ে দ্বন্দ্বের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। ‘ইউরোনিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২০ সালে বেলারুশের নির্বাচনে জেতার পর থেকেই ইইউএর সাথে লুকাশেঙ্কো সরকারের সম্পর্ক খারাপের দিকে যেতে থাকে। ইইউ থেকে নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং এরপর থেকে বেলারুশের রাস্তায় প্রতিবাদ শুরু হয়। ইইউ লুকাশেঙ্কো সরকারের উপর অবরোধ আরোপ করে এবং দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। বেলারুশ সরকার ‘রায়ান এয়ার’এর একটা বিমানকে মিনস্ক বিমানবন্দরে নামতে বাধ্য করে এবং বিমানের অভ্যন্তর থেকে এক সাংবাদিককে বের করে এনে গ্রেপ্তার করে। গত অগাস্টে টোকিও অলিম্পিক থেকে পালানো বেলারুশ এথলেট ক্রিস্টসিনা সিমানুস্কায়াকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় ইইউএর সদস্য দেশ পোল্যান্ড; যা বেলারুশের সাথে দেশটার সম্পর্ক খারাপ করে। তবে এক সংবাদ সন্মেলনে লুকাশেঙ্কো অস্বীকার করেন যে, তিনি শরণার্থীদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন যে, বেলারুশ কাউকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে না; তবে তারা যদি বেলারুশকে শর্তের মাঝে ফেলে, তাহলে বেলারুশ প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, তার দেশের রাশিয়া, চীন বা ইইউএর মতো সম্পদ নেই।

 

তবে বেলারুশ থেকে আসা শরণার্থীর চাপে প্রতিবেশী দেশ লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। পোল্যান্ডও তার সীমান্ত অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং প্রায় ৬ হাজার সেনা সীমানায় মোতায়েন করে। লাটভিয়া এবং পোল্যান্ড উভয় দেশই তাদের সীমান্তরক্ষী এবং সামরিক বাহিনীকে শক্তি ব্যবহার করে শরণার্থীদের বেলারুশে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছে। পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে বিল পাশ করে সাড়ে তিন’শ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে বেলারুশের সাথে ৪’শ কিঃমিঃ সীমানা বরাবর দেয়াল তোলার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পোলিশ সরকার বলছে যে, এবছরেই তারা বেলারুশ থেকে শরণার্থী ঢোকার চেষ্টার ২৩ হাজার প্রচেষ্টাকে তালিকাভুক্ত করেছে। লিথুয়ানিয়াও বেলারুশের সীমানায় কাঁটাতাদের বেড়া দেয়া শুরু করেছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের এক বিবৃতিতে এই বেড়া দেয়াকে ‘ভালো চিন্তা’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। তবে ইইউ এই প্রকল্পে কোন অর্থায়ন করবে না বলে বলা হয়। লিথুয়ানিয়া সরকার ইইউএর কাছ থেকে এব্যাপারে সহায়তা চেয়েছে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, শরণার্থীদের মূল স্রোত আসছে ইরাকের উত্তরের কুর্দী অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে। ইরাক, সিরিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে শরণার্থীরা ১৪ থেকে ১৭ হাজার ডলার খরচ করে মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে সেখানে পৌঁছাচ্ছে। প্রথমে এবছরের অগাস্টে বাগদাদ থেকে সরাসরি শরণার্থীরা বেলারুশে আসতে থাকে। এরপর ইইউএর চাপের মুখে ইরাক সরকার সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ইরাক থেকে শরণার্থীরা দুবাই, লেবানন, সিরিয়া, জর্দান, তুরস্ক, ইত্যাদি দেশ হয়ে বেলারুশে আসতে থাকে। অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, বেলারুশ সরকার মিনস্ক বিমানবন্দর থেকেই শরণার্থীদের সরাসরি পোল্যান্ডের সীমানায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইইউএর সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হবার পর থেকে বেলারুশ সরকার ভিসা ইস্যু করার দায়িত্ব বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির হাতে দিয়ে দেয়। এই এজেন্সিগুলি বিভিন্ন উপায়ে শরণার্থীদের বেলারুশে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে থাকে।

 

বেলারুশের সীমানার সমস্যার এক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর এসোসিয়েট ফেলো সামানথা ডে বেনডার্ন। বেলারুশের বিতর্কিত নির্বাচনের এক বছরের মাথায় ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা বেলারুশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য পটাশ, অপরিশোধিত তেল, এবং আরও কিছু পণ্যের উপর অবরোধ দেয়। একইসাথে বেলারুশের উপর ব্রিটেনের অর্থবাজার থেকে অর্থ যোগানের উপরও অবরোধ দেয়া হয়। এর পাল্টা হিসেবে লুকাশেঙ্কো মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরণার্থী ঢোকার পথ খুলে দেন। বেনডার্ন বলছেন যে, এটা হলো একধরনের ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ, যা শরণার্থীদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ইইউ এবং ন্যাটোর পূর্ব সীমানায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা ছাড়াও মিত্র দেশগুলির মাঝে বিরোধের জন্ম দিতে চাইছে। নতুন শরণার্থী সমস্যার কারণে পূর্ব ইউরোপে শরণার্থী বিরোধী মনোভাবকে আরও বেশি উস্কে দিতে পারে এবং অভিবাসন বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলিকে শক্তিশালী করতে পারে। এই ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই জার্মানি এবং সুইডেনে দেখা গেছে; যেখানে সমাজের সমস্যার জন্যে উগ্র ডানপন্থীরা শরণার্থীদের দায়ী করছে। একইসাথে তা উগ্র জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ইইউ বিরোধী চিন্তার জন্ম দিয়েছে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই চাইছে ইউরোপে ডানপন্থীদের উত্থান হোক; যা ইইউ এবং ন্যাটোকে দুর্বল করবে। বেনডার্ন মনে করেন না যে, এই ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ বেলারুশের পক্ষে মস্কোর অনুমতি ছাড়া করা সম্ভব।

মানবাধিকার সংস্থাগুলি পোল্যান্ড এবং বেলারুশ উভয় দেশের বিরুদ্ধেই আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগে মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ করেছে। ইতোমধ্যেই প্রচন্ড শীত এবং অন্যান্য সমস্যায় পড়ে কমপক্ষে আটজন শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। পশ্চিমা চিন্তার স্তম্ভ মানবাধিকার ইইউএর সদস্য রাষ্ট্রগুলির শরণার্থী বিরোধী জাতীয়তাবাদী চিন্তার কাছে হার মেনেছে। পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে গণতান্ত্রিকভাবেই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রাশিয়ার সমর্থনে বেলারুশ ইউরোপের দুর্বলতাকেই উস্কে দিচ্ছে; যাকে ইইউ বলছে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ। লিবারাল গণতান্ত্রিক দেশগুলি যখন শরণার্থীর ঢল ঠেকাতে দেয়াল তুলছে এবং সামরিক বাহিনী ব্যবহার করছে, তখন বেলারুশে লিবারাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার দাবি তুলে লুকাশেঙ্কো সরকারের উপর অবরোধ আরোপ পরস্পরবিরোধীই বটে। ইউরোপের লিবারাল গণতান্ত্রিক আদর্শ দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে; আর এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে উগ্রবাদী জাতীয়তাবাদী চিন্তা। লিবারাল চিন্তার উৎসস্থলে এই দুর্যোগ ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থারই প্রমাণ মাত্র।

No comments:

Post a Comment