Wednesday 13 October 2021

সোমালিয়া এবং কেনিয়ার সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

১৪ই অক্টোবর ২০২১

আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা নিয়ে রায়ের পর, সোমালিয়ার উপকূলে তেল গ্যাস আহরণের জন্যেও তুরস্ক সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাই চালাবে। এই প্রচেষ্টাতে কেনিয়া যদি বাধা দেবার চেষ্টা চালায়, তা তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে ভারত মহাসাগরে সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। অর্থাৎ তেল গ্যাস আহরণের নিরাপত্তা দিতেই তুরস্ক সোমালিয়ার উপকূলে সামরিক অবস্থান তৈরি করবে। 

 
গত ১৩ই অক্টোবর জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির আদালত পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া এবং কেনিয়ার মাঝে সমুদ্রসীমা নিয়ে একটা রায় প্রদান করে। প্রায় এক লক্ষ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের সমুদ্রসীমার উপর আদালতের এই রায় মূলতঃ সোমালিয়ার পক্ষেই গিয়েছে। সোমালিয়ার তথ্যমন্ত্রী ওসমান দুবে এক টুইটার বার্তায় আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে সোমালিয়ার জনগণকে অভিনন্দন জানান। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই সমুদ্রসীমার মাঝে তেল গ্যাস পাবার সম্ভাবনা বেশি থাকার কারণেই দুই দেশ এব্যাপারে দ্বন্দ্বের মাঝে ছিল।

২০০৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে একমত হয়। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ২০১৪ সালে দুই দফা আলোচনার পর কেনিয়রা তৃতীয় দফা আলোচনা পরিত্যাগ করলে সোমালিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। কেনিয়া বলছিল যে, দুই দেশের সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে পূর্ব দিকে লাইন টেনে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হোক। আর সোমালিয়া চাইছিল যে, দুই দেশের স্থলসীমানা যে বরাবর গিয়েছে, সেই বরাবর সমুদ্রেও লাইন টেনে সীমানা নির্ধারণ করা হোক। আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকরা দুই প্রস্তাবের মাঝামাঝি একটা লাইন টেনে রায় দিয়েছেন। সোমালিয়া যা চেয়েছিল, তা তারা পায়নি; তবে তারা রায়ে খুশি। কারণ তারা যা চেয়েছিল, তার অনেকটাই পেয়েছে। অপরদিকে কেনিয়া যা চেয়েছিল, তার কোন অংশই ছাড়তে রাজি ছিল না।

কেনিয়া আদালতে বলেছিল যে, ২০০৯ সালে সোমালিয়ার সাথে যে সমঝোতা হয়েছিল, তা দুই দেশের উপর বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছিল। অপরদিকে আদালত বলছে যে, সেই সমঝোতায় সোমালিয়া যে কেনিয়ার প্রস্তাবিত সমুদ্রসীমা মেনে নিয়েছিল, তা কেনিয়া প্রমাণ করতে পারেনি। এবছরের মার্চ মাস থেকেই কেনিয়া আদালতের শুনানিতে অংশ নেয়নি। তারা ১৪ জন বিচারকের প্যানেলে একজন সোমালি থাকার ব্যাপারটাকেও প্রত্যাখ্যান করে। কেনিয়া সরকার এই মামলাকে ‘ত্রুটিযুক্ত আইনী পদ্ধতি’ বলে আখ্যা দেয়। এবং তারা বলে যে, এর মাঝে ‘অন্তর্নিহিত পক্ষপাতদুষ্টতা’ রয়েছে।

সোমালিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রী মোহামেদ গুলেদ ‘বিবিসি’কে বলেছিলেন যে, সোমালিয়া এই আদালতে এসেছে কারণ তারা আন্তর্জাতিকভাবে আইনের শাসনের ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস করে। কিন্ত সমস্যা হলো, সোমালিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলির সাথে আদালতের সক্ষমতার দূরত্ব রয়েছে। কারণ এই আদালত কোন দেশকেই রায় বাস্তবায়নে বাধ্য করতে পারে না। কেনিয়া ইতোমধ্যেই আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই অনেকেই এই রায় বাস্তবায়নের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সন্দিহান। কেনিয়া বলেছে যে, তারা সমুদ্রসীমা রক্ষা করতে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। ‘বিবিসি’ বলছে যে, কেনিয়ার মতো সোমালিয়ার নৌবাহিনী নেই; তবে সোমালিয়ার বন্ধু রয়েছে। এমতাবস্থায় দুই দেশের মাঝে আরও আলোচনার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি কূটনৈতিক চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে যুদ্ধ হয়তো শেষ অপশন।

‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, দুই দেশের মাঝে বিরোধ যথেষ্ট। সোমালিয়ার সীমানার কাছাকাছি এলাকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কেনিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে আসছে সোমালিয়া। ২০১৯ সালে সোমালিয়ার বিরুদ্ধে বিতর্কিত সমুদ্রাঞ্চলের তেল গ্যাসের ব্লক বিক্রি করার অভিযোগে কেনিয়া মোগাদিশু থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায়। একইসাথে কেনিয়া মনে করিয়ে দেয় যে, আল শাবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সোমালিয়াতে কয়েক হাজার কেনিয় সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সোমালিয়া কেনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে; যখন সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের নেতৃত্বকে কেনিয়া নিজ দেশে আপ্যায়ণ করে। তবে ২০২১ সালের অগাস্টে দুই দেশ আবারও সম্পর্ক পুনস্থাপন করে।

 

তবে দুই দেশের সমুদ্রসীমার রায় অন্যরকম অর্থ বহণ করে, যখন সোমালিয়ার সবচাইতে প্রভাবশালী বন্ধু দেশ তুরস্কের নাম চলে আসে। সোমালিয়াতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে তুরস্ক। বিশেষ করে দেশটার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলির অনেকগুলিই এখন তুরস্কের ব্যবস্থাপনায় চলছে। সোমালিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবার জন্যে সেখানে বড় আকারের একটা সামরিক ঘাঁটিও তৈরি করেছে তুরস্ক। সোমালিয়ার হাজার হাজার ছাত্র এখন তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তুর্কি মিডিয়া ‘এনটিভি’ বলে যে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেছেন যে, সোমালিয়া তুরস্ককে সোমালি উপকূলে তেল গ্যাস আহরণে সহায়তা করার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, সেখানে অপারেশন শুরু করার জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ তার সরকার নেবে।

প্রকৃতপক্ষে ২০১৬ সালে তুরস্কের সাথে সোমালিয়ার স্বাক্ষরিত এক সমঝোতার মাঝে ছিল জ্বালানি ও খণিজ সম্পদ আহরণ। তুর্কি জ্বালানি বিশ্লেষক রাহমি কোপার বলছেন যে, ২০১৬ সালে তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কারণে এই প্রচেষ্টা পিছিয়ে গেলেও ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে এই সমঝোতা চুক্তি তুর্কি পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হয়। অপরদিকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোমালি পার্লামেন্টে ‘সোমালি পেট্রোলিয়াম আইন’ পাস করা হয়। এর মাধ্যমে ‘সোমালিয়া পেট্রোলিয়াম অথরিটি’র জন্ম দেয়া হয়। রাহমি কোপার বলছেন যে, এই পদক্ষেপগুলি নিশ্চিত করে যে, তুরস্ক সোমালি উপকূলে তেল গ্যাস আহরণের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ‘ডেইলি সাবাহ’র এক লেখায় হাসান ইউসুফ ওয়াল মত দিচ্ছেন যে, যেহেতু সোমালিয়াতে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তুর্কিরা সেখানে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তাই তেল গ্যাস আহরণের ক্ষেত্রেও তারা অন্যদের চাইতে এগিয়ে থাকবে। তবে তিনি মনে করছেন যে, সোমালিয়ার তেল গ্যাসের সেক্টর এখন আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলিকে আগ্রহী করতে পারে। তিনি আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আফ্রিকার অনেক দেশের উদাহরণই আনা যায় খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে, যেখানে ব্যাপক খনিজ সম্পদ থাকার পরেও দেশের জনগণের কোন উন্নয়ন হয়নি। তুরস্কের জন্যে চ্যালেঞ্জ হবে তেল গ্যাস আহরণ করে তা সোমালিয়ার জনগণের প্রকৃত উন্নয়নে কাজে লাগানো। নতুবা তুরস্কের এই প্রচেষ্টা সমস্যায় পড়বে।

উসমানি খিলাফতের সময় সোমালিয়া তুর্কি প্রভাবে থাকার ইতিহাসকে উপজীব্য করেই তুরস্ক এক দশক আগে সোমালিয়াতে জড়িয়েছে। এরপর থেকে সোমালিয়াতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে তুরস্ক সবকিছুই করেছে। সামনের দিনগুলিতে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা নিয়ে রায়ের পর, সোমালিয়ার উপকূলে তেল গ্যাস আহরণের জন্যেও তুরস্ক সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাই চালাবে। এই প্রচেষ্টাতে কেনিয়া যদি বাধা দেবার চেষ্টা চালায়, তা তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে ভারত মহাসাগরে সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। অর্থাৎ তেল গ্যাস আহরণের নিরাপত্তা দিতেই তুরস্ক সোমালিয়ার উপকূলে সামরিক অবস্থান তৈরি করবে। ভারত মহাসাগরে তুরস্কের অবস্থান এখনও তেমন উল্লেখ করার মতো নয়। তবে সোমালিয়া তুরস্কের জন্যে একটা বড় সুযোগ; যার মাধ্যমে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের উপর তুরস্ক একটা নৌঘাঁটি তৈরি করতে পারবে।

No comments:

Post a Comment