Wednesday 28 October 2020

‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসিফিকে প্রভাব বাড়াচ্ছে

২৯শে অক্টোবর ২০২০
জুলাই ২০২০। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ৩০তম ‘অস্ট্রেলিয়া ইউনাইটেড স্টেটস মিনিস্টেরিয়াল কনসালটেশন্স’ বা ‘অসমিন’ বৈঠক। অত্র অঞ্চলের সবচাইতে বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকেও অস্ট্রেলিয়া সাথে রাখতে চাইছে শক্তিধর চীনকে ব্যালান্স করতে। তথাপি অস্ট্রেলিয়া তার এই কৌশলগত চিন্তায় যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না।



করোনা মহামারির মাঝেই অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসিফিকে তার কৌশলগত অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে সচেষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে অস্ট্রেলিয়া পুরো ইন্দো-প্যাসিফিকে তার প্রভাব বৃদ্ধির পিছনে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে। মাত্র আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশ অস্ট্রেলিয়া অত্র অঞ্চলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও ১’শ ৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হয়েছে, যখন সকলের দৃষ্টি মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের দ্বন্দ্বের দিকে। অস্ট্রেলিয়ার এই প্রচেষ্টাকে যতটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনে হোক না কেন, অস্ট্রেলিয়াকে যদি ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার একটা অংশ হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকই মনে হবে। আদর্শিক শক্তি ব্রিটেনের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা চিন্তার ঝান্ডাবাহক হবার কারণেই অস্ট্রেলিয়া এই প্রভাব বিস্তারের খেলায় বিচলিত খেলোয়াড় নয়।

অস্ট্রেলিয়ার ইন্দো-প্যাসিফিক কূটনীতি

গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ৩০তম ‘অস্ট্রেলিয়া ইউনাইটেড স্টেটস মিনিস্টেরিয়াল কনসালটেশন্স’ বা ‘অসমিন’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ‘টু প্লাস টু’ এই বৈঠকে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা অংশ নেন। আলোচনায় মূল বিষয়বস্তুই ছিল চীনকে নিয়ন্ত্রণ। আলোচনা শেষে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিজ পেইন বলেন যে, তারা ইন্দো-প্যাসিফিকের বিভিন্ন বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগাবেন; যার মাঝে রয়েছে ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ; ‘এসোসিয়েশন অব সাইথ ইস্ট এশিয়ান নেশন্স’ বা ‘আসিয়ান’ অর্থনৈতিক ফোরাম; যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে তৈরি করা নিরাপত্তা সংগঠন ‘কোয়াড্রিল্যাটেরাল স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’ বা ‘কোয়াড’; ইন্দো-প্যাসিফিকের ১৮টা দেশ নিয়ে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া ‘ইস্ট এশিয়া সামিট’; অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্থলগ্নী উন্নয়ন সংস্থা মিলে তৈরি করা অবকাঠামো উন্নয়ন সংস্থা ‘ট্রাইল্যাটেরাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পার্টনারশিপ’। তবে তিনি ইন্দো-প্যাসিফিকে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে আরও নতুন কিছু গ্রুপ তৈরি করার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্পের ক্ষেত্রে দুই দেশ সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছে; বিশেষ করে হাইপারসনিক অস্ত্র, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ও মহাকাশ সক্ষমতার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। ‘নিকেই এশিয়া’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, এই সমঝোতাগুলি চীনের ‘এন্টি একসেস / এরিয়া ডিনাইয়াল’ বা ‘এটু/এডি’ কৌশলকে মোকাবিলার টার্গেট করেই করা হয়েছে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেইন এটাও বলেন যে, চিনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, তা অস্ট্রেলিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অস্ট্রেলিয়া সেই সম্পর্ককে আঘাত করতে চায় না।
 

অক্টোবর ২০২০। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিশি নোবুওএর সাথে। দুই দেশের মাঝে সমঝোতা হয়েছে যে, যুদ্ধবস্থা না থাকলে জাপান অস্ট্রেলিয়ার সামরিক শক্তিকে রক্ষা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের পর অস্ট্রেলিয়া মাত্র দ্বিতীয় দেশ হিসেবে জাপানের কাছ থেকে এই সহায়তার নিশ্চয়তা পেলো। ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলিকে অস্ট্রেলিয়া নিজের প্রভাব বলয়ে আনার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং তাতে তারা বেশ সাফল্যও পাচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা কূটনীতি চলছে জোর গতিতে

অক্টোবরে ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলিতে ভ্রমণ শুরু করার আগে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, তিনি দেশগুলির সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে যাচ্ছেন। প্রতিরক্ষা কূটনীতি ও সহযোগিতা এবং সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি এই সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলেন। তিনি বলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইন্দো-প্যাসিফিকে সবচাইতে বড় কৌশলগত পরিবর্তন হতে চলেছে। ২৬শে অক্টোবর রেইনল্ডস তার এশিয়া-প্যাসিফিক ভ্রমণের শেষ দেশ হিসেবে ফিলিপাইন গিয়ে ফিলিপাইনের সামরিক বাহিনীর করোনা মোকাবিলায় সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যে ২ মিলিয়ন ডলারের মেডিক্যাল সরঞ্জাম দেবার ঘোষণা দেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স কানেক্ট’ বলছে যে, এই বছরের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়া আরও ১ মিলিয়ন ডলারের মেডিক্যাল সহায়তা দেয় ফিলিপাইনের সামরিক বাহিনীকে। ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষা সচিব ডেলফিন লরেনজানার সাথে বৈঠকে তারা দক্ষিণ চীন সাগরে অবাধ চলাচল নিশ্চিত করার ব্যাপারে কথা বলেন; যা মূলতঃ অত্র অঞ্চলে চীনের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করাকেই বোঝায়। অস্ট্রেলিয়া ফিলিপাইনকে আরও আগে থেকেই প্রতিরক্ষা সহায়তা দিয়ে আসছে। ২০১৭ থেকে ২০১৯এর মাঝে অস্ট্রেলিয়া ‘অপারেশন অগারি ফিলিপিন্স’এর অধীনে ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিপিনো সামরিক সদস্যকে সন্ত্রাস দমনের ট্রেনিং দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দুই দেশের মাঝে ‘এনহান্সড ডিফেন্স কোঅপারেশন প্রোগ্রাম’ নামের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার অধীনে অস্ট্রেলিয়া ফিলিপাইনকে আরও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। ফিলিপাইন আসার তিন দিন আগে লিন্ডা রেইনল্ডস ব্রুনাই সফরের সময় বলেন যে, সেদেশের সরকার একজন অস্ট্রেলিয় সামরিক অফিসারকে স্থায়িভাবে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছে। এছাড়াও আলোচনার সময় বলা হয় যে, ব্রুনাইএর সাথে সামরিক সম্পর্কের অগ্রগতির অংশ হিসেবে গত মার্চে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর একটা সামবমেরিন ব্রুনাই সফর করে। অগাস্ট মাসে দুই দেশের নৌবাহিনী পাসেক্স মহড়া দেয়।

এশিয়া-প্যাসিফিক ভ্রমণের অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ২২শে অক্টোবর সিঙ্গাপুর সফর করেন। সফরকালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিঙ্গাপুরের সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং নেবার ৩০ বছর উদযাপন করা হয়। সিঙ্গাপুরে স্থানের অভাবে সামরিক ট্রেনিং নেয়া সম্ভব হয়না বলেই অন্য দেশের মাটিতে ট্রেনিং নিতে হয়; অস্ট্রেলিয়া এক্ষেত্রে অর্থিকভাবে লাভবান হওয়া ছাড়াও সিঙ্গাপুরের সাথে সামরিক সম্পর্ক গভীর করে। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের সময় সিঙ্গাপুরের ‘শিনুক’ হেলিকপ্টারগুলি জরুরি কাজে ব্যবহৃত হতে দেয়ায় রেইনল্ডস সিঙ্গাপুর সরকারকে ধন্যবাদ দেন। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেন্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সিঙ্গাপুরের ‘শিনুক’ হেলিকপ্টারগুলি এখন অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে অপারেট করার লাইসেন্স পেয়েছে ক’দিন আগেই। এর মাধ্যমে দুই দেশের সামরিক সহযোগিতা অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছাতে যাচ্ছে।

এর আগে ১৯শে অক্টোবর রেইনল্ডস তার ভ্রমণের প্রথম দেশ হিসেবে জাপান সফর করেন। জাপানের নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিশি নোবুওএর সাথে সাক্ষাতে তারা পূর্ব চীন সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন এবং একত্রে চীনের আগ্রাসী মনোভাবকে প্রতিরোধ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তারা উত্তর কোরিয়া বিষয়েও আলাপ করেন এবং দেশটার পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করার প্রয়োজনের ব্যাপারে একাত্মতা প্রকাশ করেন। একইসাথে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে সমন্বয় বৃদ্ধির ব্যাপারে তারা একমত হন। জাপানের সেনাবাহিনীর সাথে একজন অস্ট্রেলিয় লিয়াঁজো অফিসার রাখার ব্যাপারে এবং দুই দেশের যৌথ সামরিক মহড়াকে আরও এগিয়ে নেবার ব্যাপারেও একমত হন তারা। দুই দেশের মহাকাশ ও সাইবার নিরাপত্তা, সামরিক প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা শিল্পের মাঝে সহযোগিতার ব্যাপারেও ঔকমত্য হয়।

‘জাপান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রেইনল্ডসএর জাপান সফরের সময় জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও ঘোষণা দেন যে, যুদ্ধবস্থা না থাকলে জাপান অস্ট্রেলিয়ার সামরিক শক্তিকে রক্ষা করবে। এই সিদ্ধান্ত সম্ভব হয়েছে ২০১৫ সালে পাস করা এক আইনের কারণে; যেখানে বলা হয়েছে যে, কোন দেশ যদি জাপানের নিরাপত্তায় সহায়তা দেয়, তবে জাপানি সামরিক বাহিনী সেই দেশের সেনা ও সরঞ্জামকে সুরক্ষা দেবে। অর্থাৎ ইন্দো-প্যাসিফিকের কোথাও অস্ট্রেলিয়ার সামরিক শক্তির উপর কোন হুমকি আসলে জাপান সেখানে অস্ট্রেলিয়াকে সামরিক সহায়তা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের পর অস্ট্রেলিয়া মাত্র দ্বিতীয় দেশ হিসেবে জাপানের কাছ থেকে এই সহায়তার নিশ্চয়তা পেলো।

‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের কর্মকান্ড সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডসএর ব্যস্ত ইন্দো-প্যাসিফিক ভ্রমণের আগেই তিনি ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের এক অনলাইন ভিডিওকনফারেন্সে যোগ দেন। কানাডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হারজিত সাজ্জান এই কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ‘ফাইভ আইজ’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ডের এক ইন্টেলিজেন্স চুক্তি। এর মাধ্যমে এই দেশগুলি সারা বিশ্বে গোয়েন্দা তৎপরতা চালায় এবং অতি গোপনীয় তথ্যসহ সকল ইন্টেলিজেন্স নিজেদের মাঝে চালাচালি করে। এই নেটওয়ার্কের কর্মকান্ড তেমন একটা ফলাও করে প্রচার না পেলেও এবারের কনফারেন্সের খবর মিডিয়াতে প্রচার করা হয়। লিন্ডা রেইনল্ডস ‘ডিফেন্স কানেক্ট’কে বলেন যে, কনফারেন্সে আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় সদস্য দেশগুলি নিজেদের মাঝে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তবে কনফারেন্সে আলোচিত কোন বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে কোনকিছু বলতে তিনি ছিলেন নারাজ। গত জুন মাসে অস্ট্রেলিয়ার অনুরোধে ‘ফাইভ আইজ’এর আরেকটা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেই কনফারেন্সেই প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা নিয়মিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিয়মিত আলোচনায় বসার ব্যাপারে একমত হন।

এছাড়াও ১১ই অক্টোবর ‘ফাইভ আইজ’এর আরেক আলোচনায় জাপান এবং ভারতকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই আলোচনায় সদস্যরা একটা ‘ব্যাকডোর’ রেখে মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপ করার জন্যে কোম্পানিগুলির প্রতি আহ্বান জানান, যাতে ইন্টেলিজেন্সের সদস্যরা সেগুলি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যবহারকারীর মোবাইল ফোনে ঢুকতে পারে। 

অক্টোবর ২০২০। জাপানের রাজধানী টোকিওতে ‘কোয়াড’এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক। ‘কোয়াড’এর কর্মকান্ড আটকে থাকার মূল কারণ ছিল ভারত; যারা ঐতিহাসিকভাবেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশ ছিল। আর এখন এই জোটের সামনে চলে আসাটাও হয়েছে ভারতের জন্যেই, যারা এখন চীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। ভারতকে রাজি করিয়ে ‘কোয়াড’এর মতো জোটকে সামরিক জোটে রূপান্তর করাটা অস্ট্রেলিয়ার আদর্শিক চিন্তার প্রভাবেরই ফলাফল।


‘কোয়াড’ এবং ‘এক্সারসাইজ মালাবার’

গত জুলাই মাসে ফিলিপাইন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের সাথে নৌমহড়ায় অংশ নেয় অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ক্যানবেরা’সহ পাঁচটা যুদ্ধজাহাজ এতে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রনাল্ড রেগ্যান’সহ তিনটা যুদ্ধজাহাজ ও জাপানের একটা যুদ্ধজাহাজ এই মহড়ায় যোগ দেয়। তবে এই তিন দেশের সাথে ভারতের নামও যুক্ত করা হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে ব্যালান্স করতে। ‘নিকেই এশিয়া’ বলছে যে, সামনের দিনগুলিতে ইন্দো-প্যাসিফিকে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে ‘কোয়াড’। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে এই গ্রুপটা এতদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের গ্রুপ হিসেবে থাকলেও নভেম্বরের শেষে নৌমহড়া ‘এক্সারসাইজ মালাবার’এ অস্ট্রেলিয়ার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ‘কোয়াড’ একটা প্রতিরক্ষা গ্রুপে রূপ নিতে যাচ্ছে। ১৯শে অক্টোবর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে অস্ট্রেলিয়ার অন্তর্ভুক্তির কথা জানানো হয়। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া ‘এক্সারসাইজ মালাবার’ মূলতঃ বঙ্গোপসাগরে অনুষ্ঠিত হয়; শুধুমাত্র এক বছর এটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ফিলিপাইন সাগরে। তিন বছর আগে অস্ট্রেলিয়া এই মহড়ায় অংশ নেবার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও ভারতের অনিচ্ছায় অস্ট্রেলিয়রা অংশ নিতে পারেনি। তবে অস্ট্রেলিয়া তাদের চেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত মহড়ার অংশ হতে পেরেছে। ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলছে যে, গত অগাস্টে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে নীতিগতভাবে অস্ট্রেলিয়াকে এই মহড়ায় আমন্ত্রণ জানাবার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই মহড়ার মূল লক্ষ্যই হলো চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর হিমালয়ের পাদদেশে লাদাখে চীনের সাথে ভারতের সংঘাত এই সিদ্ধান্তের পিছনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন।

অক্টোবরের শুরুতে জাপানের রাজধানী টোকিওতে ‘কোয়াড’এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মাধ্যমে এই গ্রুপের শুরু হলেও চীনের কাছ থেকে প্রতিবাদ আসার পর এই গ্রুপটার চীন বিরোধী চিন্তাটাকে সদস্য রাষ্ট্রগুলি আড়াল করে রাখার ক্ষীণ একটা প্রয়াস চালিয়ে যায়। তবে গত কয়েক বছরের মাঝে গ্রুপের সবগুলি দেশের সাথেই চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটার পর ‘কোয়াড’এর কৌশলগত জোটের চিন্তাটা সামনে আসতে থাকে। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর সিঙ্গাপুর অফিসের সিনিয়র ফেলো আলেক্সান্ডার নেইল বলছেন যে, ‘কোয়াড’এর কর্মকান্ড আটকে থাকার মূল কারণ ছিল ভারত; যারা ঐতিহাসিকভাবেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশ ছিল। আর এখন এই জোটের সামনে চলে আসাটাও হয়েছে ভারতের জন্যেই, যারা এখন চীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। 

জুলাই ২০২০। ফিলিপাইন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ও জাপানের সাথে অস্ট্রেলিয়ার নৌমহড়া। অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ক্যানবেরা’সহ পাঁচটা যুদ্ধজাহাজ এতে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রনাল্ড রেগ্যান’সহ তিনটা যুদ্ধজাহাজ ও জাপানের একটা যুদ্ধজাহাজ এই মহড়ায় যোগ দেয়। চীনকে নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলিকে নিয়ে কয়েকটা কৌশলগত জোট গঠন করার প্রচেষ্টায় রয়েছে।


করোনা মহামারির মাঝে ইন্দো-প্যাসিফিকের শক্তির মাপকাঠিতে এগিয়েছে অস্ট্রেলিয়া

১৮ই অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’ ‘এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স কি ফাইন্ডিংস ২০২০’ নামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর মাঝে মূল বিষয় ছিল ‘এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স ২০২০’ নামে একটা সূচক; যেখানে ভূরাজনৈতিক শক্তির হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিকে প্রভাব বিস্তার করা ২৬টা দেশের মাঝে একটা তুলনামূলক চিত্র দেখানো হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে প্রকাশ করে আসা এই ইনডেক্সে এশিয়ার রাষ্ট্রগুলির সম্পদ এবং প্রভাবের একটা সমন্বয় করা হয়। পশ্চিমে পাকিস্তান থেকে পূর্বে নিউজিল্যান্ড এবং উত্তরে রাশিয়া পর্যন্ত এই অঞ্চলকে সংজ্ঞায়িত করে এর মাঝের দেশগুলির আশেপাশের অঞ্চলকে প্রভাবিত করার সক্ষমতাকে মাপা হয়। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয় যে, করোনাভাইরের কারণে কোন দেশের কার চাইতে বেশি অধোগতি হয়েছে, সেটাই হয়ে গিয়েছে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব অনেকটা হারালেও ৮২ পয়েন্ট নিয়ে এখনও সে শীর্ষে অবস্থান করছে; তার ঠিক পিছনে রয়েছে চীন; যার পয়েন্ট ৭৬। প্রায় ৪০ পয়েন্টের কাছাকাছি রয়েছে জাপান ও ভারত। ৩২ থেকে ৩৩ পয়েন্টের মাঝে রয়েছে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া; ২৭ পয়েন্ট নিয়ে ৭ম স্থানে রয়েছে ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুর। ১৯ থেকে ২১ পয়েন্টের মাঝে রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং নিউজিল্যান্ড। ১৫ থেকে ১৭ পয়েন্টের মাঝে রয়েছে তাইওয়ান ও পাকিস্তান। ১২ থেকে ১৩ পয়েন্টের মাঝে রয়েছে ফিলিপাইন এবং উত্তর কোরিয়া; ৯ পয়েন্ট নিয়ে ১৮ এবং ১৯তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ এবং ব্রুনাই। ৭০ পয়েন্টের উপর দেশগুলিকে ‘সুপারপাওয়ার’, ৪০ পয়েন্টের দেশগুলিকে ‘মেজর পাওয়ার’ এবং ১০ পয়েন্টের বেশির পাওয়া দেশগুলিকে ‘মিডল পাওয়ার বলে’ আখ্যা দেয়া হয়।

২০২০ সালের এই ইনডেক্সের গুরুত্ব আগেরগুলির চাইতে বেশি, কেননা এখানে করোনাভাইরাসের কারণে এই দেশগুলির ভূরাজনৈতিক সক্ষমতার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, তার তুলনা করা হয়। আটটা ক্ষেত্রের মাঝে মোট ১’শ ২৮টা বিষয়ের উপর দেশগুলির সক্ষমতা পরিমাপ করা হয়; যার মাঝে রয়েছে সামরিক সক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক; অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও নেটওয়ার্ক; কূটনৈতিক ও সাংকৃতিক প্রভাব; এবং দৃঢ়তা ও ভবিষ্যৎ সম্পদ। এবছরের হিসেবে তিনটা নতুন বিষয় যোগ করা হয়; যেগুলি হলো, প্রধান জলবায়ুগত হুমকি; দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রতিরক্ষা আলোচনা; এবং দেশে ও দেশের বাইরে করোনা মহামারি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে মানুষের ধারণা। এবছরে ২৬তম দেশ হিসেবে পপুয়া নিউ গিনিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন তার অবস্থানকে বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে ভারতকে একসময় চীনের ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যারা চিন্তা করছিলেন, তাদেরকে সেটা ভুলে যেতে বলা হয়। তিনটা দেশের কথা বলা হয়, যারা ২০২০ সালে নিজেদের অবস্থানকে বেশ খানিকটা এগিয়ে নিয়েছে; যারা হলো ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া এবং তাইওয়ান। আরেক হিসেবে দেখানো হয় যে, শক্তির সূচকে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় থাকা সত্ত্বেও কোন দেশ করোনা পরিস্থিতিকে কাটিয়ে উঠতে কত সময় নিতে পারে। এক্ষেত্রে জাপানের কথা বলা হয় যে, ২০২৭ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে তাদের পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে; যুক্তরাষ্ট্রের লাগবে ২০২৪ সাল; রাশিয়া ও নিউজিল্যান্ডের লাগবে ২০২৩ সাল। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের লেগে যাবে ২০২২ সাল। অপরদিকে ২০২০ সালের মাঝেই পুষিয়ে উঠতে পারবে যে দেশগুলি, তার মাঝে রয়েছে চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার এবং আরও কয়েকটা দেশ। \

অক্টোবর ২০২০। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস ব্রুনাইএর সুলতান হাসানাল বলকিয়াহএর সাথে। এই সফরের সময় ব্রুনাই সরকার একজন অস্ট্রেলিয় সামরিক অফিসারকে স্থায়িভাবে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলির মাঝে শক্তির বিচারে যথেষ্ট অগ্রগামী; যা মাত্র আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশটার জন্যে অস্বাভাবিক। এটা মূলতঃ অস্ট্রেলিয়ার আদর্শিক চিন্তার প্রভাবেরই ফলাফল। এই চিন্তাই অস্ট্রেলিয়াকে ইন্দো-প্যাসিফিকে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর প্রতিনিধিত্ব করাচ্ছে।


অস্ট্রেলিয়ার বাস্তবতা এবং ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর আদর্শিক লক্ষ্য

তবে অস্ট্রেলিয়া কতটা স্বাধীনভাবে তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে চীনকে নিয়ন্ত্রণের যে নীতি নিয়ে তারা এগুতে চাইছে, তা সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়নযোগ্য নাও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর জেষ্ঠ্য বিশ্লেষক ডেরেক গ্রসম্যান বলছেন যে, চীন অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী। এমতাবস্থায় অস্ট্রেলিয়া অত সহজে বেইজিং থেকে আলাদা হতে চাইবে না। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অস্ট্রেলিয়া চীনের ব্যাপারে কঠোর রাজনৈতিক অবস্থানে যাবার কারণে চীন অস্ট্রেলিয়ার পণ্য এবং সেবার উপর বাধা সৃষ্টি করছে। অস্ট্রেলিয়ার পর্যটন, শিক্ষা, কয়লা, গোমাংস, মদ, তুলা এবং বার্লি চীনারা টার্গেট করেছে। বেইজিং অস্ট্রেলিয়ার গোমাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে; চীনা শিক্ষার্থীরা অস্ট্রেলিয়ায় জাতিগত হামলার হুমকিতে থাকতে পারে বলে সতর্কতা জারি করা হয়েছে; অস্ট্রেলিয়ার কয়লা আমদানিও আপাততঃ স্থগিত রাখা হয়েছে; বার্লির উপর দেয়া হয়েছে ৮০ শতাংশ শুল্ক। তবে একদিকে অস্ট্রেলিয়া যেমন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি চীনের পক্ষেও অস্ট্রেলিয়ার বিকল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার কয়লার বিকল্প চীনারা অত সহজে পাবে না। কাজেই আঞ্চলিকভাবে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা থাকলেও দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য অত সহজে স্থবির হচ্ছে না।

‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া নিজেকে একা হিসেবে দেখে না। বিশাল ইন্দো-প্যাসিফিকে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান এমনকি জাপান এবং ভারতকে নিয়েও জোট বাধার চেষ্টায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এই ‘মিডল পাওয়ার’ রাষ্ট্রগুলির সক্ষমতাকে বাড়িয়ে তা নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে চাইছে অস্ট্রেলিয়া। করোনা মহামারিতে বেশিরভাগ দেশের সক্ষমতাই কমেছে; তথাপি ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতামূলক কর্মকান্ড আরও জোরালো হয়েছে। তবে অত্র অঞ্চলের সবচাইতে বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকেও অস্ট্রেলিয়া সাথে রাখতে চাইছে শক্তিধর চীনকে ব্যালান্স করতে। তথাপি অস্ট্রেলিয়া তার এই কৌশলগত চিন্তায় যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। জাপানের সাথে আলাদা করে কৌশলগত সমঝোতা এবং ব্যাপক চেষ্টার পর ভারতকে রাজি করিয়ে ‘কোয়াড’এর মতো জোটকে সামরিক জোটে রূপান্তর করার মতো কাজগুলি অস্ট্রেলিয়ার আদর্শিক চিন্তার প্রভাবেরই ফলাফল। এই চিন্তাই অস্ট্রেলিয়াকে ইন্দো-প্যাসিফিকে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর প্রতিনিধিত্ব করাচ্ছে।

Saturday 24 October 2020

ফ্রান্সে ইসলাম ... কে কার বাস্তবতা?

২৫শে অক্টোবর ২০২০
ফ্রান্স এখন দ্বিধাবিভক্ত; মুসলিমরা কি ফ্রান্সের সেকুলার বাস্তবতার শিকার? নাকি ফরাসিরা ইসলামিক বাস্তবতার শিকার? তারা কি ইসলামোফোবিয়া কাটাতে ইসলামকে পরিবর্তন করতে উদ্যত হবে? নাকি সেকুলার আইনের চাপে সহিংসতাকে আরও বৃদ্ধি করবে? যেদিকেই তারা পা বাড়াক না কেন, ফরাসি রিপাবলিক যে আরও দুর্বল হচ্ছে, তা এখন নিশ্চিত। 


ফ্রান্সে এক শিক্ষককে হত্যার পর ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ তথাকথিত ‘উগ্রবাদী ইসলাম’এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন বলে ঘোষণা দেন। অভিযানের শুরুতেই এক মসজিদের ইমামের তথাকথিত ‘উগ্রবাদী’ চিন্তা ধারণ করার জন্যে মসজিদটাকেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়; এবং আরও কঠোর পদক্ষেপ আসছে বলে বলা হয়। কিছুদিন আগেই প্যারিস থেকে ৩০ কিঃমিঃ দূরে এক শহরে ৪৭ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ফরাসী কারিকুলাম অনুযায়ী বাকস্বাধীনতা বিষয়ে পড়াতে গিয়ে ২০১৫ সালে ‘শার্লি ইব্দো’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত রাসূল (সাঃ)এর ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেন। এরপর এক মুসলিম ছাত্রীর বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রদের সামনে অশ্লীল ছবি প্রদর্শনের অভিযোগ করেন। অনলাইন ভিডিওতে প্যাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা ছাড়াও তিনি প্যাটির পদচ্যুতি দাবি করেন। এরপর গত ১৬ই অক্টোবর ১৮ বছর বয়সী চেচেন বংশোদ্ভূত উদ্বাস্তু আব্দুল্লাখ আবুইয়েদোভিচ আনজোরভ প্যাটিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে। আনজোরভ এক অডিও বার্তায় বলে যে, সে রাসূল (সঃ)এর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে। এরপর পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে এক ছাত্র বলেন যে, প্যাটি প্রতিবছরই বাকস্বাধীনতা পড়াতে গিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ)এর ব্যাঙ্গচিত্র ছাত্রদের দেখাতেন। এই হত্যাকান্ডের দু’দিন পর আইফেল টাওয়ারের কাছে দু’জন মহিলা হিজাব পরিহিত দু’জন মুসলিম মহিলাকে ছুরিকাঘাত করে। আক্রমণের সময় তারা মুসলিম মহিলাদেরকে ‘নোংড়া আরব’ বলে গালি দেয়। এই ঘটনাগুলি ফরাসী সমাজে ইসলামোফোবিয়াকেই শুধু সামনে টেনে আনছে না, ফ্রান্সের সেকুলার সংস্কৃতির ভিতের মাঝে পরস্পরবিরোধী চিন্তাগুলিকেও আলোচনায় নিয়ে আসছে।

ফরাসীরা প্যাটির হত্যাকান্ডকে ফরাসী রিপাবলিকের উপর হামলা হিসেবে দেখছে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেছেন যে, প্যাটি হলো ফরাসি রিপাবলিকের প্রতিচ্ছবি। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে জাতীয় সঙ্গীতের পরপরই এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় প্যাটির জন্যে। পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ফেরান্ড বলেন যে, প্যাটির হত্যাকান্ডে ফ্রান্স ঐক্যবদ্ধ; কারণ প্যাটির পিছনেই রয়েছে ‘হিউম্যানিস্ট’ ফরাসি রিপাবলিক। ফরাসী স্বরাষ্ট্র দপ্তর বলছে যে, বন্ধ করে দেয়া মসজিদ থেকে প্যাটিকে ভীতি প্রদর্শন করার জন্যে আহ্বান করা হয়েছিল। তারা দাবি করছেন যে, মসজিদ থেকেই প্যাটির হত্যার ‘ফতওয়া’ আসে। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন আরও একধাপ এগিয়ে টেলিভিশনে এসে বলেন যে, ফ্রান্সের সুপারমার্কেটে বিভিন্ন জাতির জন্যে আলাদা খাবার পাওয়া যায়; এর ফলে ফ্রান্সের ঐক্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং বিচ্ছিন্নতা দানা বাঁধছে।

‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ফরাসি মানবাধিকারকর্মী ইয়াসির লুয়াতি বলেন যে, ফ্রান্সে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে সর্বত্র ক্যামেরা বসানো হয়েছে, অনেকগুলি আইন পাস হয়েছে এবং ইন্টারনেটে গোয়ান্দাগিরি করা হচ্ছে; কিন্তু তারপরেও এরূপ ঘটনা ঘটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতারই প্রকাশ। নির্বাচনের ১৮ মাস আগে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ মহামারি এবং অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে ঢাকতে এক ব্যাক্তির কর্মকান্ডকে ব্যবহার করে পুরো মুসলিম সমাজকে টার্গেট করছেন। ম্যাক্রঁ বলছেন যে, ফ্রান্স ঐক্যবদ্ধ; কিন্তু সেই ঐক্যের মাঝে মুসলিমরা নেই। একইসাথে তিনি ডানপন্থীদের মাঝেও তার সমর্থন বৃদ্ধি করতে চাইছেন। ইসলামোফোবিয়া কমাতে কাজ করা মুসলিম এনজিওগুলিকেও টার্গেট করা হচ্ছে। তবে ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবিরা ফ্রান্সে ইসলামোফোবিয়া রয়েছে, সেটা স্বীকার করতে নারাজ। ‘দ্যা গ্লোবাল পলিসি রিসার্চ’এর সিনিয়র ফেলো জাক রোঁলা বলছেন যে, ফ্রান্স নিজেকে সেকুলার ধারণার ঝান্ডাবাহী মনে করে; যেখানে মানুষের আইনকে স্রষ্টার আইন থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। আর ফরাসীরা এই চিন্তাকে রক্ষা করতে সবকিছু করবে। তিনি বলেন যে, ‘উগ্রবাদী ইসলাম’এর বিরুদ্ধে যথেষ্ট শক্ত ভূমিকা না নেয়ার সমালোচনা রয়েছে ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধে। ফ্রান্সের সমস্যা ইসলামোফোবিয়া নয়, বরং ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তাটাই আসল সমস্যা। ফরাসি পত্রিকা ‘লে ফিগারো’র প্রবীণ সাংবাদিক রনোঁ জিরাঁদ আরও কঠোর ধারণা পোষণ করেন। তিনি বলেন যে, মুসলিমরা ফ্রান্সে এসে বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সুবিধা পাবার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে বরং ফরাসি সেকুলার স্কুল, যা তাদের সমাজের একটা স্তম্ভ, সেটাকে আক্রমণ করেছে। তিনি বলেন যে, ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে মুসলিমরা রয়েছে; অনেক মসজিদও রয়েছে ফ্রান্সে। তবে ফ্রান্সের সেকুলার চিন্তা বলছে যে, ধর্ম এবং রাজনীতি থাকবে আলাদা। নিজের বাড়িতে ধর্মকর্ম করায় কোন বাধা থাকবে না; তবে প্রকাশ্যে ধর্মের কোন ভূমিকাই থাকবে না। যারা ফ্রান্সের এই চিন্তাধারাকে ভালোবাসতে পারে না, তাদের ফ্রান্স ছেড়ে চলে যাওয়া উচিৎ।

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৯০৫ সালে ফ্রান্সে যে সেকুলার আইন তৈরি হয়েছিল, তা ছিল মূলতঃ ক্যাথোলিক চার্চের প্রভাবকে কমাবার জন্যে। সেসময় ফ্রান্সের বেশিরভাগ জনগণই ছিল ক্যাথোলিক। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স তার উপনিবেশগুলিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে বহু মুসলিম ফ্রান্সে এসে হাজির হয়; এভাবেই ফ্রান্সে ইসলামের আবির্ভাব হয়। বর্তমানে ফ্রান্সে মুসলিম জনসংখ্যা একেবারে কম নয়; যা ফ্রান্সের বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সের লজ্জাজনক বিদায়ের পর ফরাসিদের কাছে ইসলামের একবিন্দু উপস্থিতিও অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ফ্রান্সে ক্যাথোলিক অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে এখনও রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে, তথাপি ইসলামের যেকোন দৃশ্যমান ব্যাপারকে ফরাসিরা তাদের সেকুলার চিন্তার বিরোধী হিসেবে দেখতে থাকে। যেমন হিজাব বর্তমানে ফ্রান্সে সবচাইতে আলোচ্য বিষয়গুলির একটা।

ফ্রান্স তার সেকুলার আদর্শের মাঝেই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। বাকস্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সেকুলার চিন্তার ভিত্তি হিসেবে ধরলেও ধর্মীয় আবেগকে আঘাত করেই তারা বাকস্বাধীনতাকে উপরে স্থান দিয়েছে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথোলিকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের অনুভূতি তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি; উল্টা মুসলিমদের ধর্মকর্ম পালনকে ফরাসীরা দেখেছে ফ্রান্সের সেকুলার ব্যবস্থার প্রতি হুমকি হিসেবে। ফ্রান্স এখন দ্বিধাবিভক্ত; মুসলিমরা কি ফ্রান্সের সেকুলার বাস্তবতার শিকার? নাকি ফরাসিরা ইসলামিক বাস্তবতার শিকার? তারা কি ইসলামোফোবিয়া কাটাতে ইসলামকে পরিবর্তন করতে উদ্যত হবে? নাকি সেকুলার আইনের চাপে সহিংসতাকে আরও বৃদ্ধি করবে? যেদিকেই তারা পা বাড়াক না কেন, ফরাসি রিপাবলিক যে আরও দুর্বল হচ্ছে, তা এখন নিশ্চিত। 

Saturday 17 October 2020

ড্রোন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কি?

১৮ই অক্টোবর ২০২০

ড্রোন একা যুদ্ধ জেতাতে পারবে না। এর সাথে ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে কাজ করবে অন্যান্য সার্ভেইল্যান্স ও কমিউনিকেশন্স ইন্টেলিজেন্স ড্রোন, ইলেকট্রনিক জ্যামার, স্যাটেলাইট, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স, ভূমি ও আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার আর্টিলারি ও ক্ষেপণাস্ত্র। এটা নিশ্চিত যে, এখন থেকে ককেশাসের যুদ্ধের শিক্ষাগুলিকে মাথায় রেখেই সকলকে কাজ করতে হবে।

ককেশাসে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে যুদ্ধের মাঝে সোশাল মিডিয়া বহু ভিডিও দিয়ে ছেয়ে যায়, যেখানে আকাশ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আর্মেনিয়ার ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই ভিডিওগুলি এসেছে আজেরবাইজানের ব্যবহৃত মনুষ্যবিহীন বিমান বা ড্রোন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা মিডলইস্ট সেন্টার ফর রিপোর্টিং এন্ড এনালিসিস’এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সেথ জে ফ্রান্তজম্যান ‘নিউজউইক’এর এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরেই ড্রোনের ব্যবহার করে আসলেও আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে আজেরবাইজানের শতশত নতুন ধরনের ড্রোন ব্যবহার ভবিষ্যৎ যুদ্ধের যবনিকা উন্মোচন করেছে।

আজেরবাইজানের ড্রোনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো ইস্রাইল। ২০১৬ সালে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে চার দিনব্যাপী এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে ইস্রাইলের তৈরি ড্রোনগুলি, বিশেষ করে ‘হারোপ’ সুইসাইড ড্রোন সেই যুদ্ধে তাদের কার্যকারিতার প্রমাণ দেয়। একটা ড্রোনের হামলায় আর্মেনিয়ার একটা বাস ধ্বংস হয়, যার মাধ্যমে কয়েকজন মধ্যম সাড়ির সামরিক অফিসার মারা যায়। এই সুইসাইড ড্রোনগুলি আকাশে উড়তে থাকে; যখন সেগুলি তাদের টার্গেট পেয়ে যায়, তখন নিজেই বোমার মতো সেই টার্গেটের উপর গিয়ে আঘাত করে। আঘাত করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তা ছবি প্রেরণ করতে থাকে। ‘হারোপ’এর ইঞ্জিনের শব্দ ভূমি থেকে শোনা গেলেও পরবর্তীতে তৈরি করা ‘স্কাইস্ট্রাইকার’ এবং ‘অরবিটার ওয়ান-কে’ ড্রোন ইলেকট্রিক মোটর ব্যবহার করে বলে ওড়ার সময় প্রায় শব্দহীন থাকে; শুধু টার্গেটের উপর হামলা করার সময় শব্দ করে। আজেরবাইজানের সরকার একটা ভিডিওতে ৪টা ট্রাকের উপর অনেকগুলি সিলিন্ডার থেকে ইস্রাইলি ড্রোন ছোঁড়ার দৃশ্য দেখায়। ফ্রান্তজম্যান বলছেন যে, ঐ ট্রাকগুলি ৩৬টা সুইসাইড ড্রোন বহণ করতে সক্ষম; যা কিনা একটা বড়সড় সামরিক গ্রুপ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে সক্ষম।

২০২০ সালের যুদ্ধে আজেরবাইজানের ড্রোন ফ্লিটে যুক্ত হয় তুরস্কে তৈরি ‘বায়রাকতার টিবি ২’ এটাক ড্রোন। ছোট আকৃতির এবং অপেক্ষাকৃত সস্তা এই ড্রোন টার্গেটের উপর ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে আবার ঘাঁটিতে ফেরত আসে এবং জ্বালানি নিয়ে আবারও মিশনে যায়। ‘আল জাজিরা’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, আজেরবাইজানের ড্রোনগুলি তাদের টার্গেট ধ্বংসের যে হাই রেজোলিউশন ভিডিও পাঠায়, তা তথ্য যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে আর্মেনিয়া এমন কোন হামলার ভিডিও প্রকাশ করতে না পারায় জনগণের চোখে শুধু আজেরবাইজানের সাফল্যই ধরা পড়েছে এবং সবাই ধরেই নিয়েছে যে, যুদ্ধে আজারবাইজানই জিততে চলেছে।

আকাশ থেকে হামলা করা ছাড়াও ড্রোনগুলি যে ছবি পাঠায়, তার উপর ভিত্তি করে শত্রুর টার্গেটে দূরপাল্লার আর্টিলারি এবং বিমান দিয়ে নির্ভুলভাবে হামলা করা যায়। তুরস্ক সিরিয়া এবং লিবিয়াতে এই কৌশল অবলম্বন করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন যে, সেই শিক্ষাগুলিই তুরস্কের সাথে যৌথ মহড়ার সময় আজেরিদের কাছে পৌঁছে গেছে। অনেকেই এর মাঝে আশংকা করতে শুরু করেছেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ‘ওয়াশিংটন টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ট্যাঙ্কের দিন প্রায় শেষের পথে। ‘দ্যা ট্রিবিউন’ বলছে যে, ট্যাঙ্ককে যুদ্ধক্ষেত্রে বাঁচতে হলে কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। সমর বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, জ্যামার ব্যবহার করে ড্রোনের সাথে এর কন্ট্রোলারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায়; আর ট্যাঙ্কের সাথে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করে ড্রোন ভূপাতিত করা যায়। তবে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিন কোর এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের ট্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে ইনফর্মেশন নেটওয়ার্ক ভিত্তিক সমন্বিত সক্ষমতার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে, যেখানে ইলেকট্রনিক সেন্সর, ড্রোন এবং দূরপাল্লার অস্ত্রের ব্যবহার হবে গুরুত্বপূর্ণ। ‘আল জাজিরা’ আজেরবাইজানের উদাহরণ দিয়ে বলছে যে, বর্তমানে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সেন্সর এবং ড্রোন ব্যবহারের কারণে আর্মেনিয়ার কোন অস্ত্রই লুকিয়ে থাকতে পারছে না; আর এর সাথে ড্রোন এবং দূরপাল্লার অস্ত্রের ব্যবহারে নির্ভুলভাবে টার্গেট ধ্বংস করে ফেলা যাচ্ছে।

তবে আজেরবাইজানের এই যুদ্ধ দেখিয়ে দেয় যে, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ড্রোন থেকে নিরাপদ নয়। ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত আজেরবাইজান সরকার দাবি করে যে, তারা ১৫টা বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট ধ্বংস করেছে; যার মাঝে একটা অত্যাধুনিক ‘এস ৩০০’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা রয়েছে; ৬টা রাডারও রয়েছে। এছাড়াও তারা ৪৯টা ট্যাঙ্ক ও আর্মার্ড ভেহিকল এবং ৫১টা আর্টিলারি ইউনিট ধ্বংস করেছে। অপরপক্ষে ১৭ই অক্টোবর আর্মেনিয়া বলে যে, তারা কমপক্ষে ১’শ ৮৬টা ড্রোন ভূপাতিত করেছে। একইসাথে তারা ৫’শ ৫৪টা ট্যাঙ্ক ও আর্মার্ড ভেহিকল ২২টা বিমান এবং ১৬টা হেলিকপ্টার ধ্বংস করার দাবি করে। দাবির সত্যাসত্য যাচাই করার আগে এটা অন্ততঃ বলা যায় যে, এর আগে কোন যুদ্ধে কেউ এতগুলি ড্রোন ভূপাতিত করার যেমন দাবি করেনি, তেমনি ড্রোন ব্যবহার করে এতগুলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দাবিও করেনি। সেথ ফ্রান্তজম্যান বলছেন যে, একটা ড্রোন ভিডিওতে আরেকটা ইস্রাইলি ‘অরবিটার’ ড্রোন দেখা যায়; যা বলে দিচ্ছে যে, আকাশে এতগুলি ড্রোন একত্রে উড়ছে যে, একটা আরেকটার ছবি তুলছে!

ড্রোন নির্মাতা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন অবশ্যই আজেরবাইজানের যুদ্ধের দিকে লক্ষ্য রাখছে। ১৩ই অক্টোবর ‘ইন্সটিটিউট অব ইলেকট্রনিক সায়েন্স এন্ড টেকনলজি চায়না’ একটা ভিডিও প্রকাশ করে; যেখানে দেখানো হয় যে একটা ট্রাক থেকে ৪৮টা সুইসাইড ড্রোন ছোঁড়া হচ্ছে। অনেকগুলি ড্রোনকে একত্রে ঝাঁক বেঁধে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সমস্যায় ফেলে দেয়া সম্ভব, তা ককেশাসের যুদ্ধে প্রমাণিত। ‘কদিন আগেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল মার্ক কার্লেটন স্মিথ সাংবাদিকদের বলেন যে, ভবিষ্যতের বাহিনীতে আর্মার্ড ভেহিকল ব্যবহৃত হবে রোবোটের মাদারশিপ হিসেবে; এর সাথে থাকবে দূরপাল্লার আর্টিলারি, যেগুলির জন্যে টার্গেট খুঁজে দেবে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন। তবে এসব ড্রোন একা যুদ্ধ জেতাতে পারবে না। এর সাথে ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে কাজ করবে অন্যান্য সার্ভেইল্যান্স ও কমিউনিকেশন্স ইন্টেলিজেন্স ড্রোন, ইলেকট্রনিক জ্যামার, স্যাটেলাইট, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স, ভূমি ও আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার আর্টিলারি ও ক্ষেপণাস্ত্র। ফ্রান্তজম্যান বলছেন যে, এটা নিশ্চিত যে, এখন থেকে ককেশাসের যুদ্ধের শিক্ষাগুলিকে মাথায় রেখেই সকলকে কাজ করতে হবে।

Friday 16 October 2020

কিরগিজস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ... ভূরাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে মধ্য এশিয়া

১৭ই অক্টোবর ২০২০ 

কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের রাস্তায় বিক্ষোভ। মধ্য এশিয়ার একমাত্র কিরগিজস্তানেই কিছুদিন পরপরই বিক্ষোভের মুখে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। আশেপাশের দেশগুলির সবগুলিতেই একনায়ক ক্ষমতাসীন। মধ্য এশিয়ায় ‘সিল্ক রোড’এর উপর অবস্থিত দেশটাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ চীনের ‘বিআরআই’ চিন্তাই হলো ‘নতুন সিল্ক রোড’, যা পূর্ব এবং পশ্চিমের মাঝে সুপার হাইওয়ে; চীনারা শুরু করলেও সকলেই চাইছে এর নিয়ন্ত্রণ নিতে।

১৫ই অক্টোবর মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার ফলাফল হিসেবে প্রেসিডেন্ট সুরনবাই জিনবেকভ পদত্যাগ করেন এবং নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন হন। সাদির জাপারভ মাত্র ক’দিন আগেও কারাগারে ছিলেন; এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। ২০১৩ সালে ‘কুমতর’ স্বর্ণ খনির আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে তার ১১ বছরের জেল হয়। ২০১০ সালে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট কুরমানবেক বাকিয়েভের সমর্থক ছিলেন তিনি। ‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বেশিরভাগ বিশ্লেষকই মনে করছেন যে, প্রায় অচেনা একজন রাজনীতিবিদ এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামীর প্রধানমন্ত্রী হবার অর্থই হলো পিছনে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। ৪ঠা অক্টোবরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আলমাজবেক আতামবায়েভকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসলেও পরে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন আক্রমণ করার পর প্রধানমন্ত্রী এবং স্পিকার পদত্যাগ করেন। কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা অত্র এলাকার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বুঝতে হলে কিরগিজস্তানসহ মধ্য এশিয়ার ভৌকৌশলগত বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করতে হবে।

ভূরাজনৈতিকভাবে আকারের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিরগিজস্তান

মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানের উত্তরে রয়েছে কাজাখস্তান, পশ্চিমে রয়েছে উজবেকিস্তান, দক্ষিণে তাজিকিস্তান এবং পূর্বে রয়েছে চীনের উইঘুর বা শিনজিয়াং। প্রায় ২ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ এই দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৬৩ লক্ষ। জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলিম; প্রায় ১৬ শতাংশ রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার মাধ্যমে দেশটার জন্ম। প্রায় ১৩’শ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে মধ্য এশিয়ার সবচাইতে গরীব দেশ কিরগিজস্তান। দেশটার প্রধান রপ্তানি পণ্যের মাঝে রয়েছে স্বর্ণ, কৃষিজ দ্রব্য, বিদ্যুৎ, তৈরি পোষাক, ইত্যাদি। মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশে মোটামুটিভাবে একনায়কতন্ত্র চললেও কিরগিজস্তানে পার্লামেন্টারি ব্যাবস্থা প্রচলিত হয়েছে। দেশটাতে বেশ কয়েকবার নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন হয়েছে এবং বেশ কয়েকবার ক্ষমতাসীন নেতৃত্বকে চাপের মুখে পদক্ষেপ করতে হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে কিরগিজস্তানের সম্পর্ক পশ্চিমাদের সাথে মোটামুটি ভালো; যদিও নিরাপত্তার দিক থেকে দেশটা রাশিয়ার উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। তদুপরি মধ্য এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাবের পর এবং একইসাথে চীনা বিনিয়োগ বাড়তে থাকায় এখানকার ভূরাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। অত্র এলাকায় পশ্চিমা দেশগুলির কূটনৈতিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে কাজাখস্তানের সবচাইতে বড় শহর আলমাতিতে পশ্চিমা দেশগুলির রাজনৈতিক অবস্থান। 


১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র কাজাখস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।পরের মাসে, অর্থাৎ ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্র আলমাতিতে তার দূতাবাস খোলে। কাজাখস্তানের রাজধানী ১৯৯৮ সালে আস্তানাতে চলে গেলে মার্কিন দূতাবাসও সেখানে চলে যায় ২০০৬ সালে। তবে আলমাতির গুরুত্ব বিচারে সেখানে দূতাবাসের একটা শাখা থেকে যায়। ২০০৯ সালে সেখানে একটা কনসুলেট জেনারেল খোলা হয়; যার কর্মকান্ডের মাঝে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাও রয়েছে। মার্কিন দূতাবাসের কথায় দেশটার রাজধানী সরে গেলেও আলমাতি দেশটার ‘দক্ষিণের রাজধানী’ রয়ে গেছে; যা বর্তমানে দেশটার সবচাইতে বড় শহর এবং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক রাজধানী। অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি করার পিছনে এই কূটনৈতিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটেনও আলমাতিতে একই বছরের অক্টোবরে তাদের দূতাবাস খোলে। ব্রিটিশরা অবশ্য পরবর্তীতে তাদের দূতাবাস নতুন রাজধানীতে সরিয়ে নেয়। রাজধানী নূর সুলতান, যার আগের নাম ছিল আস্তানা, বর্তমানে ৬৯টা দেশের দূতাবাসের ঠিকানা। তবে আলমাতিতে অবস্থান ধরে রেখেছে ১৯টা দেশ; যার মাঝে মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি ছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক এবং প্রতিবেশী চীন। অথচ প্রতিবেশী দেশ কিরগিজস্তানের রাজধানীতে রয়েছে মাত্র ১৩টা দেশের দূতাবাস। অনেক দেশই কিরগিজস্তানে তাদের কূটনৈতিক কর্মকান্ড কাজাখস্তান থেকেই চালিয়ে থাকে। একারণেই কিরগিজস্তানের রাজধানীতে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে আলমাতির একটা যোগসূত্র থেকে যায়।

কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মধ্য এশিয়া। আর মধ্য এশিয়া ভৌগোলিক আয়তনে যত বিশালই হোক না কেন, চীন থেকে মধ্য এশিয়ায় ঢোকার পথ কিন্তু খুবই সীমিত। পথগুলি চীনের শিনজিয়াং প্রদেশ বা উইঘুরের মাঝ দিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে প্রবেশ করে। এই পথগুলিই হাজার বছরের পুরোনো ‘সিল্ক রোড’। এর মূল পথগুলি ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে দক্ষিণে হিমালয় পর্বত এবং উত্তরে অতি শীতল সাইবেরিয়া এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। একটা পথ উইঘুরের কাশগর হয়ে হিমালয়ের উত্তরে তিয়েন শান পর্বতমালার মাঝ দিয়ে ফারগানা ভ্যালিতে পৌঁছে। আরেকটা পথ উইঘুরের উরুমচি থেকে তিয়েন শান পর্বতমালার উত্তর দিয়ে ইশিক কুল হ্রদ এবং বলখাশ হ্রদের মাঝ দিয়ে ফারগানা ভ্যালিতে পৌঁছায়। বর্তমানে বলখাশ হ্রদের উত্তরে সাইবেরিয়ার অতি শীতল অঞ্চলের মাঝ দিয়ে আরও কিছু পথ তৈরি করা হলেও তা বেশ ঘুরপথ হওয়ায় প্রাচীন ‘সিল্ক রোড’এর পথগুলিই এখনও প্রধান পথ হয়ে রয়েছে। এই পথগুলি বর্তমানের কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তানের মাঝ দিয়ে যায়। অর্থাৎ উইঘুর, কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তান হলো ‘বিআরআই’এর মধ্য এশিয়া রুটের প্রধান পথ। আর এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি হলো উইঘুরের কাশগর থেকে কিরগিজস্তানের ওশ; এবং উইঘুরের উরুমচি থেকে খরগোস হয়ে কাজাখস্তানের আলমাতি। আলমাতি বর্তমান কাজাখস্তানের সবচাইতে বড় শহর। আর কিরগিজস্তানের ওশ শহর কিরগিজস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহর হলেও এর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কিরগিজ রাজধানী বিশকেকএ। বিশকেক আবার অনেক ক্ষেত্রেই আলমাতির সাথে যুক্ত। অর্থাৎ আলমাতি এবং বিশকেক ‘বিআরআই’এর রুটগুলির নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে। 

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি। মার্কিন বিমান বাহিনীর শেষ ‘কেসি ১৩৫’ এয়ার রিফুয়েলিং বিমান ছেড়ে যাচ্ছে কিরগিজস্তানের মানাস বিমান ঘাঁটি। রুশ বাধার মুখে আফগানিস্তানের যুদ্ধের উপর ভর করে প্রায় ১৩ বছর কিরগিজস্তানে সামরিক লজিস্টিকস ঘাঁটি ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক উপস্থিতি অত্র অঞ্চলে মার্কিন প্রভাবকে যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকেও বাড়িয়েছে।

আফগান যুদ্ধ কিরগিজস্তানের গুরুত্বকে বাড়িয়েছে

২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধে জড়াবার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্য এশিয়াতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আফগান যুদ্ধের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র কিরগিজস্তানের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার লক্ষ্যে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকএর মানাস বিমান বন্দরকে লজিস্টিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া এতে তার নিজের উঠানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার হিসেবে দেখতে থাকে; যদিও রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের মালামালকে কাজাখস্তান পর্যন্ত রেল ট্রানজিট দিয়েছিল; যেখান থেকে তা কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান পৌঁছাতো। এভাবে মূলতঃ খাবারদাবারসহ কিছু সাধারণ পণ্য আফগানিস্তানে যেতো। জ্বালানি, সামরিক গাড়ি এবং ভারি রসদপাতিসহ বেশকিছু পণ্য আফগানিস্তানে পৌঁছাতো পাকিস্তানের মাঝ দিয়ে। আর সৈন্য এবং তাদের ব্যবহৃত অতি সংবেদনশীল জিনিসগুলি যেতো আকাশপথে কিরগিজস্তান হয়ে। দেশটার রুশ লবি সর্বদাই এই সামরিক রুটখানা বন্ধ করে দেবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপের অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে রুশ নেতৃত্বের ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ‘সিএসটিও’এর সদস্যপদের শর্ত হিসেবে রাশিয়া কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকএর অদূরে কান্টএ একটা সামরিক বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করার চুক্তি করে। মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তান এবং তাজিকিস্তান ছাড়াও আর্মেনিয়া এবং বেলারুশ ‘সিএসটিও’এর সদস্য। চুক্তি মোতাবেক এই দেশগুলি বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে রাশিয়া সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করার কথা রয়েছে। রুশ বিমান ঘাঁটি ব্যবহারের চুক্তিটা সর্বশেষ এবছরের জুন মাসে নবায়ন করা হয়েছে। বাৎসরিক সাড়ে ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এই ঘাঁটি ব্যবহার করছে রাশিয়া। এছাড়াও কিরগিজস্তানে রাশিয়ার আরও কয়েকটা ঘাঁটি রয়েছে; যার মাঝে রয়েছে ইসিক কুল হ্রদে রুশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ধ্বংসী টর্পেডো টেস্টিংএর ঘাঁটি।

২০০৫ সালের জুলাই মাসে ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’এর আলোচনায় কিরগিজস্তান এবং উজবেকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরিয়ে নেবার জন্যে সমসীমা বেঁধে দেবার দাবি জানানো হয়। ‘এসসিও’এর সদস্য হিসেবে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের সাথে রয়েছে রাশিয়া এবং চীন। প্রায় ১৩ বছর ব্যবহার করার পর কিরগিজ সরকারের চাপের মুখে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র মানাসে তার লজিস্টিকস ঘাঁটিখানা বন্ধ করে দেয়। মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩৭৬তম এক্সপিডিশনারি উইংএর কমান্ডার কর্নেল জন মিলার্ড বলেন যে, এই সময়ের মাঝে মানাসের এই ঘাঁটি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ৫৩ লক্ষ সৈন্য আনা নেয়া করেছে; আর ১ লক্ষ ৩৬ হাজার বিমানকে আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিং করা হয়েছে; এবং ৪২ হাজার কার্গো পরিবহণ মিশন সম্পাদন করেছে। প্রায় ২ হাজার মার্কিন সেনা এই ঘাঁটিতে অবস্থান করতো। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০১১ সালে রুশ সমর্থিত আলমাজবেক আতামবায়েভ কিরগিজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর মানাসের ঘাঁটি বন্ধ করার জন্যে চাপ সৃষ্টি শুরু হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তিনি মস্কোর সাথে চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে কান্ট সামরিক ঘাঁটিকে রাশিয়ার কাছে আরও ১৫ বছরের জন্যে লিজ দেবার ব্যবস্থা করেন। বিনিময়ে মস্কো কিরগিজস্তানের ৫’শ মিলিয়ন ডলারের ঋণ মওকুফ করে। 

বলখাশ হ্রদের দক্ষিণের ‘জেতিসু’ বা ‘সাত নদী’ অঞ্চলের বড় শহর আলমাতি, যা কাজাখস্থানের প্রাক্তন রাজধানী। একই অঞ্চলের মাঝে পড়েছে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেক এবং চীনের উইঘুরের ইয়িনিং শহর। মূলতঃ মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলকে ঊনিশ শতকে রাশিয়া এবং চীন নিজেদের মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই বাউন্ডারিগুলি উভয় পাশের মানুষের বিশ্বাসগত এবং জাতিগত একাত্মতাকে মুছে ফেলতে পারেনি।


কিরগিজস্তান এবং মধ্য এশিয়ার ভৌগোলিক অসঙ্গতি


মধ্য এশিয়ার একেবারে পূর্বে অবস্থিত কিরগিজস্তান। তিয়েন শান পর্বতমালা দেশটাকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। রাজধানী বিশকেকএর অবস্থান দেশের একেবারে উত্তরে কাজাখস্তানের সীমানার কাছাকাছি। বিশকেকের জনসংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ; যা পুরো দেশের জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগ। সেখান থেকে কাজাখস্তানের সবচাইতে বড় শহর আলমাতি মাত্র ২’শ ৩৬ কিঃমিঃ দূরে; যেতে লাগে মাত্র ৪ ঘন্টা। নিকটবর্তী কাজাখস্তানের প্রায় ১৯ লক্ষ জনসংখ্যার আলমাতি শহরই বিশকেকের মানুষের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশকেক এবং আলমাতি তিয়েন শান পর্বতের উত্তরে ইশিক কুল হ্রদ এবং বলখাশ হ্রদের মাঝে অবস্থিত এলাকার অংশ; যা ঐতিহাসিকভাবে ‘জেতিসু’ বা ‘সাত নদী’ নামে পরিচিত। বলখাশ হ্রদে পরা সাতটা নদীর উপর ভিত্তি করেই এই নাম; যদিও বর্তমানে মূল নদী ইলি সহ পাঁচটা নদী অবশিষ্ট রয়েছে। এই অঞ্চলটা রাজনৈতিকভাবে ভাগাভাগি হয়ে বেশিরভাগটা পড়েছে কাজাখস্তানে; বাকিটা চীন এবং কিরগিজস্তানে। বিশকেক থেকে পাহাড়ি পথে কিরগিজস্তানের অপর গুরুত্বপূর্ণ শহর ওশ যেতে লাগে ১১ থেকে ১২ ঘন্টার উপরে। ওশ হলো তিয়েন শানের পশ্চিমে ফারগানা ভ্যালিতে অবস্থিত এক শহর। সেখান থেকে ফারগানা ভ্যালির অন্য শহরগুলি বেশি কাছে; যদিও সেই শহরগুলি উজবেকিস্তান বা তাজিকিস্তানের অংশ। মোটকথা, ফারগানা ভ্যালি এবং ‘জেতিসু’ দু’টা ভৌগোলিকভাবে আলাদা অঞ্চল; এবং এই অঞ্চলগুলিকে কৃত্রিমভাবে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং চীনের মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করা হয়েছে। জারের রাশিয়া এবং সোভিয়েত আমলে করা এই বিভাজনের বর্তমান ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। ১৮৫৪ সালে রুশরা আলমাতি শহরের গোড়াপত্তন করে; বিশকেক শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৮৬৮ সালে। এই শহরগুলি তিয়েন শান পর্বতমালার দক্ষিণে কাশগর থেকে ফারগানা ভ্যালিতে যাওয়া সিল্ক রোডের একটা বিকল্প তৈরি করে, যা মূলতঃ রাশিয়ার সাথে চীনের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা দেয়। একুশ শতকে এসে সেই একই কারণে এই শহরগুলি গুরুত্বপূর্ণ।

মধ্য এশিয়ায় কয়েকটা বিশেষ অঞ্চলে প্রাকৃতিক কারণে পানির সহজলভ্যতার উপর ভিত্তি করে মানুষের বসতি স্থাপিত হয়েছে। বৃষ্টি না থাকার কারণে প্রায় মরু এই অঞ্চলে কিছু বরফগলা নদীর উপর নির্ভর করে মানুষ বেঁচে থাকে। এই অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যাওয়া সবচাইতে বড় বাউন্ডারি হলো তিয়েন শান পর্বতমালা। এই পর্বতমালার উত্তরে আলতাই পর্বতমালার দক্ষিণ পর্যন্ত রয়েছে ‘জুংগার বেসিন’; যার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শহর উইঘুরের উরুমচি। এখানে উরুমচি নদী ছাড়াও অনেকগুলি নদী নেমে এসেছে তিয়েন শান পর্বতমালা থেকে। উরুমচি থেকে তিয়েন শান পর্বত পেরিয়ে দক্ষিণে আসলে ‘তারিম বেসিন’; যেখানে তাকলা মাকান মরুভূমির মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তারিম, হোতান, ইয়ারকান্দ নদী এবং এগুলির শাখা প্রশাখাগুলি। তারিমের পশ্চিম প্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ শহর কাশগর; মধ্যযুগের সিল্ক রোড এই অঞ্চলের উপর দিয়েই গিয়েছে। তিয়েন শানের উত্তর পশ্চিমে রয়েছে ‘জেতিসু’ বা ‘সাত নদী’র অঞ্চল; যেখানে মূল নদী ইলি। আর তিয়েন শানের দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে উর্ভর ফারগানা ভ্যালি, যার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে শির দরিয়া নদী। ‘জুংগার’ এবং ‘তারিম’ মূলতঃ বর্তমানে চীনের উইঘুরের মাঝে পড়েছে। ‘জেতিসু’ ভাগাভাগি হয়েছে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং চীনের মাঝে। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক ভৌগোলিক অঞ্চলগুলিকে কৃত্রিম রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে ভাগাভাগি করা হয়েছে; সৃষ্টি হয়েছে বহু ধরনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। এই ভাগাভাগির পিছনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ‘সিল্ক রোড’এর নিয়ন্ত্রণ নেয়া। মূলতঃ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও রুশ এবং চীনা সাম্রাজ্যগুলি এই অঞ্চলকে ভাগবাটোয়ারা করে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে নেয়। এই অঞ্চলে রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং চীনা হান জাতির লোকদের ব্যাপক হারে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। এই কর্মকান্ডগুলি আজও এখানকার ভূরাজনীতিকে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। কৃত্রিম বাউন্ডারির মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষকে আলাদা করা হলেও বিশ্বাসগত এবং জাতিগত একাত্মতার প্রভাব খুব সহজেই সীমানা পার হয়ে যাচ্ছে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

ফারগানা ভ্যালি ... মরুর মাঝে ওয়েসিস


তিয়েন শান পর্বতমালা এবং গিসার আলাই পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত প্রায় ২২ হাজার বর্গকিঃমিঃএর ফারগানা ভ্যালির সমতলভূমি কতটা শুষ্ক, তার প্রমাণ হলো এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। ‘ক্লাইমেট ডাটা’র হিসেব মতে ফারগানাতে বছরে মাত্র ২’শ ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। মাসের হিসেবে তা বৃষ্টিপাতের আট মাসে গড়ে মাসে ২০ থেকে ৩০ মিঃমিঃ। আর গ্রীষ্মকালের শুষ্ক চার মাসে প্রায় নেই বললেই চলে। তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশে বৃষ্টির মৌসুমে মাসে গড়ে ৩’শ থেকে ৯’শ মিঃমিঃ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। তদুপরি এখানে চাষাবাদের কমতি নেই। ফারগানা ভ্যালি পুরো মধ্য এশিয়ার খাদ্যের জোগানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এখানে তুলা, গম, ধান, সব্জি, ফল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়। চাষাবাদের কারণেই ফারগানা হলো মধ্য এশিয়ার মাঝে সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। পুরো মধ্য এশিয়ার সাড়ে ৬ কোটি মানুষের মাঝে প্রায় দেড় কোটিই বাস করে ফারগানাতে, যা কিনা মধ্য এশিয়ার ভূমির মাত্র ৫ শতাংশ।

সোভিয়েতদের তৈরি করা রাজনৈতিক সীমানা

ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়েই পুরো ফারগানা ভ্যালির নিয়ন্ত্রণ ছিল যেকোন একটা রাজনৈতিক শক্তির হাতে। একসময় এর নিয়ন্ত্রণ ছিল পারস্যের হাতে; এরপর তা চলে যায় ইসলামিক সভত্যার অধীনে। ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গল আক্রমণের পর তা আবারো মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। মধ্যপ্রাচ্য এবং চীনের মাঝে স্থলবাণিজ্যপথ ‘সিল্ক রোড’এর উপর অবস্থিত হবার কারণে এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। ঊনিশ শতকে এই অঞ্চলে রুশদের আগ্রাসন শুরু হয়। ১৮৭৬ সাল নাগাদ তৎকালীন কোকান্দ খানাতের পুরো এলাকা রুশদের উপনিবেশ হয়ে যায় এবং দলে দলে রুশরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। বিংশ শতকে বলশেভিক বিপ্লবের পর এই অঞ্চল রুশদের হাত থেকে সোভিয়েতদের হাতে যায়। সোভিয়েতরা প্রথমবারের মতো মধ্য এশিয়াকে জাতি ভিত্তিতে, অর্থাৎ উজবেক, তাজিক, কাজাখ, তুর্কমেন এবং কিরগিজ পরিচয়ে ভাগ করা শুরু করে। উজবেক এবং তাজিকরা সমতলভূমিতে চাষাবাদের কাজ করলেও কাজাখ, তুর্কমেন এবং করগিজরা বেশিরভাগই ছিল যাযাবর। সোভিয়েতরা নতুন তৈরি করা সীমানা অনুযায়ী এই যাযাবরদেরকে এক জায়গায় থাকতে বাধ্য করে। ‘স্ট্রাটফর’ বলছে যে, সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের এই নীতির পিছনে মূল চিন্তাটা ছিল মধ্য এশিয়ায় পুনরায় একক কোন শক্তির উত্থান প্রতিহত করা, যা কিনা অত্র অঞ্চলে মস্কোর শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হতে পারে। তবে নতুন তৈরি করা সীমানাগুলি জাতিগত সীমানা পুরোপুরিভাবে মেনে চলেনি। এক রিপাবলিকে আরেক রিপাবলিকের বড়সড় একটা সংখ্যালঘু জনসংখ্যা থেকেই যায়। সোভিয়েত সময়ে মধ্য এশিয়া মস্কোর একচ্ছত্র অধিকারে থাকার ফলে এই সীমানাগুলির ফলাফল খুব বড় ছিল না। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তার দিক থেকে পুরো অঞ্চল একক সত্ত্বা হিসেবেই কাজ করেছে। তবে এই পুরো হিসেব পরিবর্তিত হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথেসাথে। 

বৃষ্টিহীন মধ্য এশিয়ায় কিরিগিজস্তানের তক্তোগুল রিজার্ভার। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যে ১৯৭০এর দশকে নারিন নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই রিজার্ভার। নারিন নদীর পানির উপর উজবেকিস্তানের ফারগানা ভ্যালি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল; আবার কিরগিজস্তানের অর্থনীতিতে পানিবিদ্যুৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। কৃত্রিম রাজনৈতিক সীমানারা কারণে ফারগানা ভ্যালির বিরাট জনসংখ্যার পানির নিয়ন্ত্রণ ছোট্ট কিরগিজস্তানের হাতে।


কিরগিজস্তানের বিদ্যুৎ ব্যবসা, পশ্চিমা বিনিয়োগ এবং আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক

অর্থনৈতিকভাবে কিরগিজস্তান তার প্রতিবেশী দেশগুলির উপরে যথেষ্টই নির্ভরশীল; বিশেষ করে তেল গ্যাসের জন্যে। দেশটায় খনিজ তেল এবং গ্যাস তেমন একটা না থাকলেও এর পানিবিদ্যুৎ শক্তি উল্লেখযোগ্য। দেশটার জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ বিদ্যুৎ খাত থেকে আসে। আর উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯০ শতাংশই হলো পানিবিদ্যুৎ। তবে শীতকালে পানিবিদ্যুতের উৎপাদন কমে গেলে আমদানিকৃত হাইড্রোকার্বনের উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়; তাজিকিস্তান এবং কাজাখস্তান থেকে বিদ্যুৎ আমদানিও করতে হয়। ২০১০ সালের পর থেকে দেশে কয়লার উৎপাদন যেখানে ছিল সাড়ে ৪ লক্ষ টন, সেখানে ২০১৮ সাল নাগাদ তা বেড়ে হয় প্রায় ২৪ লক্ষ টন। মাত্র ৬৩ লক্ষ মানুষের দেশের জন্যে সংখ্যাটা বেশ বড়। সরকারের কয়লা উৎপাদন বৃদ্ধির পিছনে কারণ হলো বিদ্যুৎ এবং আমদানিকৃত তেল গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমানো। তদুপরি তেল গ্যাস আমদানির নেটওয়ার্ক কিরগিজস্তানের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালে রক্ষণাবেক্ষণের অর্থের অভাবে কিরগিজস্তানের গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্ক রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রমের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। দেশটা বেশিরভাগ তেল আমদানি করে রাশিয়া এবং কাজাখস্থান থেকে।

কিরগিজস্তানের পানিবিদ্যুতের উৎস হলো দেশটার পাহাড়ি নদীগুলি। মধ্য এশিয়ার পাহাড়গুলির মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পেয়েছে কিরগিজস্তান; বিশেষ করে তিয়েন শান পর্বতমালা। তিয়েন শানের পশ্চিমে অবস্থিত ফারগানা ভ্যালির উর্বরতার মূলে রয়েছে শির দরিয়া নদী এবং এর শাখা প্রশাখা। শির দরিয়া নদীর পানির সবচাইতে বড় উৎস হলো নারিন এবং কারা দরিয়া নদী। উভয় নদীর উৎপত্তিই কিরগিজস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে। অর্থাৎ কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ফারগানা ভ্যালির পানির উৎসের প্রায় পুরোটাই ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের হাতে। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পানির উৎসগুলির উপর বাঁধ দিয়েই কিরগিজরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। ফারগানা ভ্যালির নামানগান শহরের কাছে এই নদী দু’টা মিলিত হয়ে শির দরিয়া নদী তৈরি করেছে। নারিন নদীর উপর ১৯৭০এর দশকে সোভিয়েতরা শুরু করে বাঁধ নির্মাণ; উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন। সবচাইতে বড় পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প হলো ১২’শ মেগাওয়াট সক্ষমতার তক্তোগুল বাঁধ। এই বাঁধের ভাটিতে কুরপসাই, তাশ কুমির, শামালদাইসাই এবং উচ কুরগানস্ক নামে আরও চারটা বাঁধ নির্মাণ করা হয়, যেগুলির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যথাক্রমে ৮’শ, সাড়ে ৪’শ, ২’শ ৪০ এবং ১’শ ৮০ মেগাওয়াট। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও নারিন নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ অব্যাহত থাকে। তক্তোগুল রিজার্ভারের উজানে ২০১০ সালে রুশ অর্থায়নে তৈরি করা হয় ৩’শ ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কামবারাতা-২ বিদ্যুৎ প্রকল্প। কিরগিজস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক হলেও শীতকালে তাপমাত্রা শূণ্যের নিচে নেমে গেলে তা যথেষ্ট থাকে না। যেকারণে উজানে আরও দু’টা প্রকল্প নিয়েছে কিরগিজ সরকার, যেগুলির জন্যে অর্থায়ন নিয়ে সমস্যা ছাড়াও ভাটির দেশ উজবেকিস্তানকে রাজি করাবার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কামবারাতা-১ প্রকল্প হলো সর্ববৃহত, যার সক্ষমতা হবে ১৮’শ ৬০ মেগাওয়াট। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিরগিজস্তান খারাপ মৌসুমে বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাবে আর ভালো মৌসুমে বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে।

এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন তৈরির প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১২ সালে শুরু হওয়া ‘সেন্ট্রাল এশিয়া সাউথ এশিয়া ১০০০’ বা ‘সিএএসএ ১০০০’ নামের এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এর মূল অর্থ যোগানদাতা হলো বিশ্বব্যাংক; যাদের নেতৃত্ব অনুসরণ করে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকসহ আরও বেশকিছু সংস্থা এতে অর্থায়ন করছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো কিরগিস্তানকে গ্রিড লাইনের মাধ্যমে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা; মাঝে তাজিকিস্তানও যুক্ত থাকবে। এই লাইনের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালে যখন কিরগিজস্তানে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে, তখন তা আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে রপ্তানি করা হবে। তবে বর্তমানে যেহেতু চীনা বিনিয়োগে পাকিস্তানে অনেকগুলি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, তাই পাকিস্তান বলছে যে, গ্রিড লাইনটাকে এমনভাবে তৈরি করা হোক, যাতে দরকার হলে একই লাইন ব্যবহার করে পাকিস্তান থেকে যেন কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা যায়।

কিরগিজস্তানের পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামোর সুযোগ নিয়ে দেশটার বিদ্যুৎ শিল্পে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ১৯৭০এর দশকে তৈরি তক্তোগুল হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্পের সক্ষমতা কমে গিয়েছিল; যা কিনা কিরগিজস্তানের বিদ্যুৎ রপ্তানি করার সক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয়। ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ বা ‘এডিবি’র ২’শ ৭৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে ২০১২ সালে এই প্রকল্পের উন্নয়ন কাজে হাত দেয়া হয়। এতে ২০২৩ সালের মাঝে এর স্থাপিত সক্ষমতা ১২’শ মেগাওয়াট থেকে ১৪’শ ৪০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পে বেঁচে যাওয়া অর্থের মাধ্যমে ভাটির ১’শ ৮০ মেগাওয়াট সক্ষমতার উচ কুরগানস্ক বাঁধেরও উন্নয়ন করার কথা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে এডিবির সদস্যপদ পাবার পর থেকে কিরগিজস্তানকে এডিবি প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ এবং অনুদান দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক দেশটার কৃষি, পানিবিদ্যুৎ এবং পর্যটন খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। ১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংকের সদস্য হবার পর থেকে কিরগিজস্তান সংস্থাটা থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। একইসাথে সকল পশ্চিমা উন্নয়ন সংস্থাগুলির সহায়তাকে সমন্বয় করার দায়িত্বও নিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

রেমিট্যান্সের ভূরাজনীতি এবং রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা

কিরগিজস্তানের অর্থনীতি রেমিট্যান্সের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে ২০০০ সালে কিরগিজস্তানের রেমিট্যান্স আয় ছিল ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার; যা ছিল জিডিপির দশমিক ২ শতাংশেরও কম। ২০০৫ সালে রেমিট্যান্স এক লাফে ৩’শ মিলিয়ন ডলার পার হয়ে যায়; যা ছিল জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। ২০০৮ সাল নাগাদ তা পৌঁছে যায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে; যা জিডিপির প্রায় ২৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে; যা কিনা জিডিপির প্রায় ৩১ শতাংশ। আর ২০১৮ সালে তা পৌঁছে যায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে; যা কিনা জিডিপির ৩২ শতাংশ। বুঝতে বাকি থাকে না যে, কিরগিজস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব কতটা বেশি। বিশ্বব্যাংক বলছে যে, দেশটার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এর অর্থনীতির একটা খাতের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের কথাগুলিকে খতিয়ে দেখতে কিরগিজস্তানের রেমিট্যান্সের উৎসের দিকে তাকাতে হবে। কিরগিজস্তানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলি তাদের রেমিট্যান্সের জন্যে রাশিয়ার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রাশিয়া থেকে যে কয়টা দেশে রেমিট্যান্স যায়, তার মাঝে সর্বোচ্চ যায় উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানে। ২০১৮ সালে রাশিয়া থেকে যাওয়া মোট রেমিট্যান্সের ৬৮ শতাংশই গেছে এই তিন দেশে। বিশেষ করে কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানে কর্মসংস্থানের ব্যাপক স্বল্পতার কারণে দেশের একতা বড় সংখ্যক মানুষ রাশিয়াতে যায় কাজ করতে। তাজিকিস্তানের জিডিপির কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। যা এই দেশগুলিকে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি রেমিট্যান্স নির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। রাশিয়া এই মানুষগুলিকে মূলত কন্সট্রাকশন সেক্টরে কাজে লাগায়; যা মূলতঃ একটা মৌসুমী কর্মকান্ড। কিরগিজস্তানের রেমিট্যান্সের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ২০১২ সালের পর থেকে দেশটার রেমিট্যান্স তেমন একটা বাড়েনি। কারণ হিসেবে ২০১৪ সালে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধ্বসের কথা বলতেই হয়। সেবছর তেলের বাজারে মূল্য ধ্বস এবং ইউক্রেন যুদ্ধে জড়াবার কারণে রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ রাশিয়ার অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অর্থনীতি ছিল নিম্নগামী। এরপর সেখানে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। যেকারণে মধ্য এশিয়ার দেশগুলিও রাশিয়া থেকে বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 

কিরগিজস্তানের ‘কুমতর’ স্বর্ণ খনি। কানাডিয়ান একটা কোম্পানি ১৯৯২ সালে কোন টেন্ডার ছাড়াই এই খনির শতভাগ মালিকানা পেয়ে যায়। এরপর মারাত্মক পরিবেশগত দুর্ঘটনার পরেও এই কোম্পানি খনির মালিকানা ধরে রেখেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, খনিটা কিরগিজস্তানের অর্থনীতির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে দেশটাতে চীনা বিনিয়োগ নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

স্বর্ণ খনি এবং চীনা বিনিয়োগ

বিশ্ব ব্যাংকএর হিসেবে কিরগিজস্তানের জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ ‘কুমতর’ নামের স্বর্ণ খনি থেকে আসে। এই খনির শতভাগ মালিকানা কানাডিয় কোম্পানি ‘সেনটেরা গোল্ড’এর হাতে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে কোন টেন্ডার ডাকা ছাড়াই এই খনি কানাডিয়দের হাতে দিয়ে দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালে খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন শুরু হলে পরের বছরেই সেখানে মারাত্মক এক দুর্ঘটনা পর পুরো এলাকার ৫ হাজারের বেশি মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়। ব্যাপক পরিবেশগত সমস্যা থাকলেও কানাডিয়ান কোম্পানির কর্মকান্ড বন্ধ হয়নি। ২০০৪ সাল থেকে খনির মালিকানা নিয়ে কিরগিজ সরকারের সাথে কানাডিয়দের দ্বন্দ্ব শুরু হলেও আন্তর্জাতিক আদালত পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে কিরগিজ সরকার কোম্পানির সাথে চুক্তি করে মালিকানা কানাডিয়দের হাতেই রেখে দেয়। বলা হয় যে, ‘কুমতর’ কিরগিজস্তানের অর্থনীতির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কানাডিয়দের পিছন পিছন চীনারাও কিরগিজস্তানে স্বর্ণ খনিতে বিনিয়োগ করে। কিন্তু তারা তাদের সমস্যাগুলিকে সমাধান করতে হিমসিম খেয়েছে।

চীনারা কিরগিজস্তানে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থগুলিকে এগিয়ে নিতে চায় ‘বিআরআই’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে। কিন্তু কিরগিজস্তানে চীনারাদের রাজনৈতিক অবস্থান যে, কতটা দুর্বল, তা কয়েকটা প্রকল্পের সমস্যার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। ২০১৯এর অগাস্টে দেশের দক্ষিণে নারিন এলাকায় চীনা বিনিয়োগে চলা সলটন সারি স্বর্ণ খনিতে কর্মীদের সাথে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে ২০ জন আহত হবার পর খনির কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয় দেশের সরকার। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গ্রামবাসীরা অভিযোগ করে যে, খনি থেকে বের হওয়া বিষাক্ততা থেকে তাদের গবাদিপশু মারা যাচ্ছিল; যদিও সেখানকার পশু বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, পশু মৃত্যুর কারণ ছিল জীবাণুর সংক্রমণ। এরপর এবছরের ফেব্রুয়ারিতে চীনারা কিরগিজস্তানে একটা বড় প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ‘নারিন ফ্রি ইকনমিক জোন’ নামে একটা লজিস্টিক্যাল সেন্টার তৈরি করার প্রকল্প ছিল দেশটার দক্ষিণে আতবাশি অঞ্চলে। এই লজিস্টিক্যাল সেন্টারের মাধ্যমে চীনের কাশগর এর সাথে ফারগানা ভ্যালির ব্যবসা সহজ হতো। কিন্তু প্রকল্প অঞ্চলে শতশত মানুষের প্রতিবাদের মুখে চীনা কোম্পানি তাদের ২’শ ৮০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের কর্মকান্ড বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য ছিল যে, চীনারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিরগিজস্তানের জমি দখল করে নিচ্ছে। 

মধ্যযুগের ‘সিল্ক রোড’। মধ্য এশিয়া বিশাল এলাকা হলেও ভৌগোলিক কারণেই এই পথ মাত্র অল্প কিছু অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেই পথের উপরে হবার কারণেই কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তান ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। একুশ শতকের ‘নিউ সিল্ক রোড’ও এই দেশগুলি হয়েই যাচ্ছে।


নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

চীনের জন্যে কিরগিজস্তানে থেকে থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেখানে চীনের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে না পারাটা একটা আঞ্চলিক হুমকি। প্রাকৃতিক ভৌগোলিক অঞ্চলগুলিকে কৃত্রিমভাবে বিভাজনের মাধ্যমে রাশিয়া এবং চীন যে সীমানাগুলি তৈরি করেছে, তা আজ বহু ধরনের ভূরাজনৈতিক জটিলতার জন্ম দিচ্ছে। যেমন উজবেকিস্তানের পানির নিয়ন্ত্রণ কিরগিজস্তানের হাতে। কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেক আবার কাজাখস্তানের বড় শহর আলমাতির প্রভাবমুক্ত নয়। চীনের ‘বিআরআই’ চিন্তাটা কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তানের উপর পুরোপুরি নির্ভর থাকার কারণেই এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ চীনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই অঞ্চলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত প্রভাব এখনও সর্বোচ্চ। ১৯৯০এর দশক থেকেই এখানে পশ্চিমা দেশগুলির, বিশেষতঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়ছে। ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হতে থাকে। আর এই ভূরাজনৈতিক খেলার মাঠ হয়ে দাঁড়ায় কিরগিজস্তান; যেখানে কিছুদিন পরপরই গণবিক্ষোভে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। কিরগিজস্তানের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে পানিবিদ্যুৎ এবং স্বর্ণ খনিতে পশ্চিমারা অনেক বিনিয়োগ করলেও দেশটা এখনও রাশিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্সের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন অবরোধে এবং তেলের বাজারে ধ্বসের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি যখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে, তখন মধ্য এশিয়ার ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের আয়ও কমতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং বেকারত্ব একটা গণবিক্ষোভ উস্কে দেবার জন্যে যথেষ্ট।

এহেন পরিস্থিতিতে চীন তার অর্থনৈতিক স্বার্থগুলিকে সমুন্নত রাখতেও হিমসিম খাচ্ছে। তদুপরি উইঘুর বা শিনজিয়াং প্রদেশে চীনা সরকারের দমনপীড়নের সাথে বিশ্বাসগত এবং জাতিগতভাবে একাত্মতা প্রকাশ করা সীমানার ওপাড়ের কিরগিজ এবং কাজাখদেরকে চীনারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ঊনিশ শতক থেকে শুরু করে রাশিয়া এবং চীনের প্রচেষ্টায় মধ্য এশিয়ায় তৈরি করা কৃত্রিম বাউন্ডারিগুলির ব্যবস্থাপনাই আজ চীনের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া এবং চীনের তৈরি করা এই কৃত্রিম সীমানাগুলিই এখন পশ্চিমারা ব্যবহার করছে অত্র অঞ্চলে তাদের প্রভাব বৃদ্ধিতে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলির উপর রাজনৈতিক প্রভাব রাখা রাশিয়ার উপর চীনকে নির্ভর করতে হচ্ছে; যদিও মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া এবং চীনের স্বার্থ আলাদা। পূর্ব এবং পশ্চিমের মাঝে স্থলযোগাযোগের এক সুপারহাইওয়ে মধ্য এশিয়া; যা নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে চীনের ‘বিআরআই’ চিন্তার কারণে। চীনাদের হাত দিয়েই এর শুরু হলেও ‘বিআরআই’ নামের এই ‘নতুন সিল্ক রোড’এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে, তা নিয়েই এখন শুরু হয়েছে নতুন প্রতিযোগিতা। কিরিগিজস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতারই ফলাফল।



সূত্রঃ 


‘Who is Kyrgyzstan’s new prime minister, Sadyr Japarov?’, Al Jazeera, 15 October 2020
‘Rayimbek Matraimov: Do protests threaten Kyrgyzstan’s kingmaker?’, Al Jazeera, 13 October 2020
‘Seizure of Kyrgyzstan nears completion as president steps down’, Eurasianet, 15 October 2020
‘Fergana Climate (Uzbekistan)’ in Climate Data (https://en.climate-data.org/asia/uzbekistan/fergana-province/fergana-2780/)
‘Bangladesh Average Precipitation’ in Trading Economics (https://tradingeconomics.com/bangladesh/precipitation)
‘Kyrgyz Republic President, ADB Country Director Inspect Toktogul Hydropower Plant’, ADB News Release, 18 October 2019
‘Kyrgyzstan to hold talks on Kambarata HPP in Tashkent’ in Azer News, 21 February 2019
‘Kyrgyzstan Energy Profile: Country Report April 2020’, International Energy Agency
‘Central Asia: The Complexities Of The Fergana Valley’ by Stratfor in Forbes, 10 October 2013
‘Afghan Leader Inaugurates Construction of Key Regional Energy Project’, VOA News, 06 February 2020
‘Kyrgyz Lawmakers OK Bill On Amendments To Russian Military Base Agreement’, Radio Free Europe Radio Liberty, 12 June 2020
‘"Mission accomplished" for U.S. air base in pro-Moscow Kyrgyzstan’, Reuters, 06 March 2014
‘U.S. vacates base in Central Asia as Russia's clout rises’, Reuters, 03 June 2014
‘Kyrgyzstan Reveals More Russian Military Facilities’ by John C.K. Daly in Jamestown Foundation, Eurasia Daily Monitor Volume: 5 Issue 59, 28 March 2008
‘Personal remittances, received (% of GDP) - Kyrgyz Republic’, The World Bank (https://data.worldbank.org/indicator/BX.TRF.PWKR.DT.GD.ZS?locations=KG)
‘The World Bank in the Kyrgyz Republic’, The World Bank (https://www.worldbank.org/en/country/kyrgyzrepublic/overview)
‘Personal remittances, received (current US$) - Kyrgyz Republic’, The World Bank (https://data.worldbank.org/indicator/BX.TRF.PWKR.CD.DT?locations=KG)
U.S. Embassy & Consulate in Kazakhstan – History (https://kz.usembassy.gov/embassy-consulates/almaty/history/)
‘Kumtor Hostory’ (https://www.kumtor.kg/en/deposit/history/)
‘Mountain of gold’, Reuters, 03 October 2013
‘Conflict continues at Kyrgyzstan’s massive gold mine’, Al Jazeera, 19 February 2016
‘Kyrgyzstan halts work at Chinese gold mine after clashes’, Reuters, 07 August 2019
‘China-led $280 million Kyrgyzstan project abandoned after protests’, Reuters, 18 February 2020

Saturday 10 October 2020

ককেশাসে যুদ্ধ ... শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউই

১০ই অক্টোবর ২০২০
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এই রাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আর তাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘৮২২’, ‘৮৫৩’, ‘৮৭৪’ এবং ‘৮৮৪’ নম্বর রেজোলিউশন অর্থহীনই রয়ে গিয়েছে। দন্তহীন জাতিসংঘের রেজোলিউশনের ব্যাপারে ভীত হবার কোন কারণ কারুর কাছেই ছিল না; বরং সকলেই হিসেব করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিরা কি চায়। গায়ের জোরই যেখানে সমস্যা সমাধানের একমাত্র কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে রাশিয়া ছাড়াও তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে; বেড়েছে লাশের মিছিল। বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থার কদর্য ফুটিয়ে তোলার জন্যে আর কি প্রয়োজন?

৯ই অক্টোবর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, পরদিন দুপুর থেকে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে সীমিতি আকারে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে চলেছে। এতে বলা হয় যে, এই যুদ্ধবিরতি বলবত হবে মূলতঃ মানবিক কারণে, যুদ্ধবন্দী আদানপ্রদান করতে, আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদে নিতে এবং লাশ হস্তান্তর করতে। রুশ বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, যুদ্ধবিরতির শর্তসমূহের উপর আলাদাভাবে আলোচনা এবং সমঝোতা হবে। ২৭শে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে কত হতাহত হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত করে কেউ বলতে না পারলেও উভয় পক্ষই অপর পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দাবি করেছে। কিন্তু এই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি বলবত করতেই প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেলো কেনো, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র হিসেবে দুই দেশের উপর ব্যাপক প্রভাব রাখে রাশিয়া; উভয় দেশের বেশিরভাগ অস্ত্রই সরবরাহ করেছে রাশিয়া। এছাড়াও আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা চুক্তিও রয়েছে, যার শর্ত অনুযায়ী আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলে রুশরা সামরিক সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ১০ দিন আর্মেনিয়ার সাথে চুক্তির ব্যাপারে চুপ থাকার পর ৭ই অক্টোবর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন যে, আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার চুক্তির মাঝে বিতর্কিত নাগোর্নো কারাবাখ নেই, যেখানে আজেরবাইজানের সাথে আর্মেনিয়দের যুদ্ধ চলছে। তিনি সহিংসতার কারণে অনেক মানুষের প্রাণহানিতে শোক প্রকাশ করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন যে, যুদ্ধটা যেহেতু আর্মেনিয়ার ভূখন্ডে হচ্ছে না, তাই এব্যাপারে রাশিয়ার তেমন কিছু করার নেই। ২৮ বছর আগে ১৯৯২ সালে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে ‘অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি এন্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ’ বা ‘ওএসসিই’এর অধীনে ‘মিনস্ক গ্রুপ’ নামে একটা সংস্থা গঠন করা হয়। এই সংস্থার কোচেয়ারম্যান রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় তিন দশকে এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অপরদিকে তুরস্ক বর্তমান যুদ্ধের শুরু থেকেই আজেরবাইজানকে সমর্থন করে আসছে; সামরিক সহায়তাও দিচ্ছে। আর গ্রুপের কোচেয়ারম্যান ফ্রান্স ইতোমধ্যেই আর্মেনিয়ার পক্ষে কথা বলেছে এবং এই বিবাদে তুরস্কের জড়ানোটা পছন্দ করেনি। নাগোর্নো কারাবাখের আজেরিদের নেতা তুরাল গাঞ্জালিয়েভ তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর কোচেয়ার থেকে ফ্রান্সের অপসারণ দাবি করেন। তিনি ফ্রান্সের স্থানে তুরস্ককে কোচেয়ারের পদে দেখতে চান বলে বলেন। গ্রুপের অপর সদস্য যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কথাসর্বস্বই থেকেছে। এমতাবস্থায় এরকম ধ্বংসাত্মক একটা যুদ্ধ থামাবার পিছনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অভাবটাই সামনে আসছে বারংবার।

‘আল জাজিরা’র সাথে এক সাক্ষাতে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ অভিযোগ করেন যে, ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর মধ্যস্ততাকারীরা জাতিসংঘের রেজোলিউশন বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোন চাপ প্রয়োগ করে না। তিনি বলেন যে, আজেরবাইজান এই দ্বন্দ্ব নিরসনে আরও ৩০ বছর অপেক্ষা করতে পারবে না। ১৯৯০এর দশকে আর্মেনিয়রা আজেরবাইজানের ভূখন্ড হিসেবে স্বীকৃত নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চল সামরিকভাবে দখল করে নেয়। সেই যুদ্ধে পশ্চিমা এবং রুশ হিসেবে প্রায় ৩০ হাজার আজেরি মৃত্যুবরণ করে; প্রায় ৬ হাজার আর্মেনিয়ও মারা যায়। সোভিয়েত আমলে ১৯৮৮ সাল থেকে এই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়া নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় দুই দেশের মাঝে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। তবে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলের আগে এই যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের কোন রেজোলিউশন আসেনি। সেই একই বছরে নিরাপত্তা পরিষদের মোট ৪টা রেজোলিউশন আসলেও তা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ১২ই মে যখন রুশ মধ্যস্ততায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তখন নাগোর্নো কারাবাখের পুরোটাই আর্মেনিয়দের দখলে। শুধু তা-ই নয়, এর বাইরেও আজেরবাইজানের ৯ শতাংশ এলাকা আর্মেনিয়রা অধিকার করে নেয়।

আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার অফিশিয়াল সীমানা সোভিয়েত আমলে তৈরি; যা নিয়ে কেউই খুশি হতে পারেনি। জাতিসংঘ সেই সোভিয়েত সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েই ১৯৯২ সালের ২রা মার্চ দুই দেশকে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু গত তিন দশকে জাতিসংঘের এই সদস্যপদ এই দুই দেশের জন্যে দিতে পারেনি শান্তি। এখানে রুশ ইচ্ছাটার বাস্তবায়নকেই মেনে নিয়েছে জাতিসংঘ। একইসাথে ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর মতো একটা অন্তসারশূণ্য সংস্থাকেও তাদের মেনে নিতে হয়েছে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে। রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থ থেকে বের হতে না পারার কারণে এই সমস্যার সমাধানও সোনার হরিণ থেকে গিয়েছে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ করলে ইউরোপের সাথে আফগানিস্তানের সামরিক এয়ার করিডোর তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ গুটি হয়ে দাঁড়ায় আজেরবাইজান এবং জর্জিয়া। ২০০৩ সালে গণভ্যুত্থানের মাধ্যমে জর্জিয়া রুশ প্রভাব থেকে দূরে সরে যায়। আজেরবাইজানের বাকুর তেলখনিগুলি থেকে উত্তোলিত তেল ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে রাশিয়া এবং আর্মেনিয়াকে বাইপাস করে ২০০৬ সালে জর্জিয়ার মাঝ দিয়ে পাইপলাইন চালু করা হয়। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে বসলে এই পাইপলাইনের ভবিষ্যৎ হুমকির মাঝে পড়ে যায়। ফলস্বরূপ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আজেরবাইজান তুরস্কের সাথে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ককেশাসে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারকে রাশিয়া সন্দেহের চোখেই দেখেছে। তবে এর ফলশ্রুতিতে অত্র অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ককেশাসে প্রভাব বিস্তার করার জন্যে অনেক দেশই এগিয়ে এসেছে; কিন্তু সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেই প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এই রাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আর তাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘৮২২’, ‘৮৫৩’, ‘৮৭৪’ এবং ‘৮৮৪’ নম্বর রেজোলিউশন অর্থহীনই রয়ে গিয়েছে। থেকে থেকে সংঘাতে জড়িয়েছে দুই দেশ; শক্তিশালী দেশগুলি তাতে দিয়েছে তাদের ইন্ধন। দন্তহীন জাতিসংঘের রেজোলিউশনের ব্যাপারে ভীত হবার কোন কারণ কারুর কাছেই ছিল না; বরং সকলেই হিসেব করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিরা কি চায়। গায়ের জোরই যেখানে সমস্যা সমাধানের একমাত্র কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে রাশিয়া ছাড়াও তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে; বেড়েছে লাশের মিছিল। বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থার কদর্য ফুটিয়ে তোলার জন্যে আর কি প্রয়োজন?

Monday 5 October 2020

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ধ্বস কি আসন্ন?

০৫ই অক্টোবর ২০২০

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পশ্চিমা চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ মুক্ত বাজারের সাইনবোর্ড। সারা বিশ্বকে একটা মুক্ত বাজারের অধীনে আনার যে লক্ষ্য নিয়ে ‘ডব্লিউটিও’র যাত্রা শুরু, ২৫ বছর পর সেই লক্ষ্য অবাস্তব ঠেকছে। জাতিরাষ্ট্রগুলির নিজস্ব স্বার্থকে পেরিয়ে সংস্থার আইনগুলিকে প্রাধান্য দেবার জন্যে কেউই প্রস্তুত নয়; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রও। আর করোনাভাইরাসের মহামারি এবং মহামন্দার মাঝে জাতিরাষ্ট্রগুলিও ক্রমেই আরও রক্ষণশীল হচ্ছে; দূরে চলে যাচ্ছে সংস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য মুক্ত বাজার।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন’ বা ‘ডব্লিউটিও’এর নতুন ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচন চলছে। বিদায়ী ডিরেক্টর জেনারেল ব্রাজিলের নাগরিক রবার্তো আজেভেদো তার মেয়াদ শেষের এক বছর আগেই পদত্যাগ করার কারণে নির্বাচনী কর্মকান্ড আগেভাগেই শুরু করতে হয়েছে। ১৮ই সেপ্টেম্বর পাঁচজন প্রার্থী প্রাথমিক নির্বাচনে সামনে এসেছেন; এরা হলেন কেনিয়ার মন্ত্রী আমিনা মোহামেদ, নাইজেরিয়ার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী নগোজি ওকোঞ্জো ইওয়েআলা, দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ইয়ু মিউংহি, সৌদি আরবের মোহাম্মদ আল তুওয়াইজরি এবং ব্রিটেনের প্রাক্তন মন্ত্রী লায়াম ফক্স। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, সৌদি আরব আর ব্রিটেনের প্রার্থীরা প্রথম রাউন্ডের পরেও টিকে যাবেন, এটা অনেকেই ভাবেনি। তিনজন প্রার্থী বাদ পড়েছেন; যারা হলেন মেক্সিকোর জিসাস সীদ, মিশরের হামাদ মামদুহ এবং মলদোভার তুদর উলিয়ানভশি। ২৪শে সেপ্টেম্বর থেকে ৬ই অক্টোবর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে সংস্থার ১’শ ৬৪টা সদস্য দেশ ভোট দিয়ে প্রার্থীর সংখ্যা দুইয়ে নামিয়ে নিয়ে আসবে। সংস্থা বলছে যে, নভেম্বরের শুরুতেই তারা নতুন ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচিত করে ফেলতে চাইছেন। সংস্থাটা ভূরাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার জন্যে এটাই যথেষ্ট যে, কেউ কেউ মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ৩রা নভেম্বরের নির্বাচনের কারণে সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল নিয়োগের সময়সীমা বৃদ্ধি পেতে পারে। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, যে-ই ডিরেক্টর জেনারেল হোন না কেন, তার জন্যে বেশ কঠিন সময় অপেক্ষা করছে; বিশেষ করে করনাভাইরাসের মহামারি এবং বিশ্বব্যাপী মহামন্দার মাঝে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সকলেই রক্ষণশীল আচরণ করছে। আর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চরম আকার নিয়েছে, যেখানে বাণিজ্য যুদ্ধ একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংস্কারের দাবি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে জেঁকে ধরেছে। অনেকেই ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচন নিয়ে কথা বললেও এটা সংস্থার মূল চ্যালেঞ্জ নয়। বরং চ্যালেঞ্জগুলি এতটাই জটিল যে, তা সংস্থার ভবিষ্যৎকেই হুমকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। এই হুমকিকে বুঝতে সংস্থার ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাজার তৈরি করতে ১৯৪৭ সালে ‘জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস এন্ড ট্রেড’ বা ‘জিএটিটি’ বা ‘গ্যাট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩টা দেশ এর সদস্য ছিল। আর এই সংস্থা কার্যক্রম চালিয়ে যায় ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত; ১৯৯৫ সালে ‘উরুগুয়ে রাউন্ড’ আলোচনা শেষে ১’শ ২৩টা দেশের সমন্বয়ে ‘ডব্লিউটিও’ গঠন করা হয়। ‘গ্যাট’এর সদস্যরাষ্ট্রগুলি যে আইনের মাঝে ছিল, সেই আইন ‘ডব্লিউটিও’র মাঝেও চালিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যরাষ্ট্রগুলির মাঝে বাণিজ্যের দ্বন্দ্ব থামানো যায়নি। ১৯৯৫ সালের পর থেকে দ্বন্দ্বের কারণে সংস্থার আইনে কোন পরিবর্তনই আনা সম্ভব হয়নি। যেকারণে সদস্যদের মাঝে দ্বন্দ্ব নিরসনে আপিল বডি অনেক বেশি হারে আইনের ‘ব্যাখ্যা’র আশ্রয় নিয়েছে। বড় অর্থনীতির দেশগুলি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই সংস্থাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে; যেকারণে সংস্থার ২৫ বছরের ইতিহাস শুধুই সংঘাতে পরিপূর্ণ। বিশেষ করে ২০০১ সালে চীনকে সংস্থার সদস্য করে নেবার পর থেকে এই দ্বন্দ্ব নতুন গতি পেয়েছে। সংস্থার সদস্য হবার জন্যে চীনকে অন্যদের তৈরি আইন মেনে নিতে হয়েছে; মেনে নিতে হয়েছিল বেশকিছু শর্তও, যেগুলি পশ্চিমা আদর্শের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার বিষয়ে ছাড়া দেবার বিষয়ে বলা হয়। তবে আইনের ফাঁকফোঁকড়ে আটকে যায় সেসব বিষয়; ‘যুক্তিসঙ্গত সময়’এর সংজ্ঞার ব্যাপারে কেউই একমত হতে পারেনি। এই শর্তগুলি চীন কতদিনে এবং কিভাবে পূরণ করবে, তা এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বিভেদের কারণ।

 

নিজের স্বার্থের বিপক্ষে গেলেই যুক্তরাষ্ট্র সংস্থার আপিল বডির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর সংস্থার আইনগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা যুক্তির অভাব হয়নি। চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ‘ডব্লিউটিও’ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন হয়ে পড়েছে।


যুক্তরাষ্ট্র বনাম ‘ডব্লিউটিও’

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডগুলির মাঝে একটা হলো সদস্যরাষ্ট্রগুলির মাঝে বাণিজ্যিক বিরোধের নিষ্পত্তি করা। দ্বন্দ্ব নিরসণের পদ্ধতির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘এপেলেইট বডি’ বা আপিল বডি। এতে সাতজন সদস্য থাকার কথা রয়েছে, যারা মূলতঃ বিচারক। চার বছর মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া এই সদস্যারা সর্বোচ্চ দুইবার সদস্যপদ পেতে পারেন। সংস্থার নিয়মানুসারে সদস্যদের ‘স্বাধীনভাবে’ সিদ্ধান্ত দিতে পারার শর্ত রয়েছে। তাদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই সংস্থার দ্বন্দ্বগুলি নিরসন হয়ে আসছে। তবে আপিল বডির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রয়েছে। ২০১১ সালে বারাক ওবামা হোয়াইট হাউজে থাকার সময় আপিল বডির সদস্য জেনিফার হিলম্যানের পুনরায় নিয়োগ পাওয়া বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নিয়মানুসারে সদস্য যদি তার পদে বহাল থাকতে ইচ্ছুক থাকেন, তবে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরায় নিযুক্ত হয়ে যাবেন। তবে হিলম্যানের ক্ষেত্রে কোন কারণ উল্লেখ না করেই ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মজার ব্যাপার হলো, হিলম্যান একজন মার্কিন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অনাস্থা এসেছিল। আর একইসাথে কোন কারণ না দেখাবার ফলে ‘ডব্লিউটিও’র ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে অনেকেই স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে দেখতে শুরু করে। আবার আপিল বডির ‘স্বাধীনতা’র ব্যাপারেও সন্দেহ দেখা দেয়। হিলম্যানের এই ঘটনার পর একই রকম ব্যাপার ঘটে কোরিয়ার নাগরিক সিউং হোয়া চ্যাংএর ক্ষেত্রেও। ২০১৬ সালে তার দ্বিতীয় দফা নিয়োগের ক্ষেত্রে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে এবার জানা যায় যে, তিনটা রুলিং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েছে, যেখানে চ্যাং ছিলেন তিন সদস্যের আপিল কমিটির চেয়ারম্যান। মার্কিন প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাইকেল পাঙ্কএর কথায়, এই রুলিংগুলির প্রথমটা ছিল চীনের ১৭টা পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধমূলক শুল্কারোপ; চীন এক্ষেত্রে আপিল জিতেছিল। দ্বিতীয়টা ছিল চীনা পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের এন্টি ডাম্পিং শুল্কারোপ। আর তৃতীয়টা ছিল আর্জেন্টিনা এবং পানামার মাঝে পণ্য এবং সার্ভিসের উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ছিল তৃতীয় পক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র বলে যে, আর্জেন্টিনা যেভাবে পানামার বিপক্ষে মামলা জিতেছে, তা সংস্থার আইনের সাথে যায় না। মাইকেল পাঙ্ক আরও বলেন যে, সংস্থার আইনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘আইন তৈরি’ করার এখতিয়ার নেই আপিল বডির। তিনি আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, প্যানেল জুরি যদি আইনী জটিলতার কারণে কোন ইস্যুর সমাধান দিতে না পারে, তাহলে আপিল বডির উচিৎ নয় সেটার সমাধান করতে যাওয়া। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যখন কোন বাণিজ্য দ্বন্দ্ব নিয়ে দুই পক্ষের লড়াই শুরু হয়, তখন প্রথমেই প্যানেল জুরির সামনে শুনানি হয়। এই প্যানেল হলো এড হক প্রকৃতির; একেকটা বিশেষ সমস্যার জন্যে একেকটা বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয় এবং রিপোর্ট দেয়া শেষে প্যানেল ভেঙ্গে দেয়া হয়। এই রিপোর্ট পাঠানো হয় আপিল বডির কাছে। লিখিত বক্তব্যে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি টিম রাইফ বলেন যে, ওবামা প্রশাসন সংস্থার আইনকে সমুন্নত রাখা ছাড়াও মার্কিন কর্মী, কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে তুলে ধরবে। আরও বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে যে আইনগুলি তৈরি করা হয়েছে, সেগুলি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীন আপিল বডি নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করে নিতে পারে না।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় পশ্চিমা এক দেশের প্রতিনিধি অভিযোগ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্তের ফলে আপিল বডির সদস্যদের কাছে এই বার্তা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রুলিং না গেলে চাকুরি খোয়াতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দ্বন্দ্ব নিরসনে কি সিদ্ধান্ত দেবে, তা নির্ধারণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনের পদক্ষেপ ট্রাম্প প্রশাসন আরও একধাপ এগিয়ে নেয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র মরিশাসের নাগরিক শ্রী বাবু চেকিতান সেরভাসিংএর পুনরায় নিয়োগে ভেটো দিলে মাত্র তিনজন সদস্য অবশিষ্ট থাকে। আপিল বডিতে যেকোন শুনানি হতে হলে কমপক্ষে তিনজন সদস্য থাকতে হবে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, সংস্থার ৬৭টা সদস্য রাষ্ট্র ওয়াশিংটনের কাছে পিটিশন দেয়, যাতে যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো তুলে নেয়। আপিল বডির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিযোগগুলি রয়েছে, তার মাঝে প্রধান হলো বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দেয়া রিপোর্ট আপিল বডি অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন করে অথবা পুরোপুরি উল্টিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, এই কাজ করার ক্ষমতা আপিল বডির নেই। মার্কিনীরা আরও বলছে যে, সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ৯০ দিনের মাঝে আপিল বডির কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও সকল ক্ষেত্রেই আপিল বডির হস্তক্ষেপে রুলিংএ দেরি হয়। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, সংস্থার আইনে ফাঁকফোঁকড় থাকার কারণে আপিল বডির সদস্যরা নিজেদের মতো করে রুলিং দিচ্ছেন, যা কিনা নতুন আইন হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। তারা সদস্য রাষ্ট্রগুলির নিজস্ব আইনের ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন নিজেদের মতো করে। আপিল বডির সদস্যরা সংস্থার আইন নতুন করে তৈরি করে দিতে পারেন না। আইনের যে জায়গাটাতে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তা হলো ‘যুক্তিসংগত সময়’। রুলিংএর সময় কোন সদস্য রাষ্ট্রকে সংস্থার আইন মানার জন্যে ‘যুক্তিসংগত সময়’ বেধে দেয়ার কথা থাকলেও এই ‘যুক্তিসংগত সময়’ আসলে কত, তা নিয়ে একেকজনের ভাবনা একেক রকম। এই বেধে দেয়া সময়ের মাঝে কেউ যদি আইন বাস্তবায়ন না করে, তাহলেও তার বিরুদ্ধে তেমন কোন কিছুই করার নেই সংস্থার। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, সংস্থার আইন যদি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই সেই আইন বাস্তবায়ন করবে না। আগের প্রশাসনগুলির মতো চাপা না থেকে ট্রাম্প প্রশাসন এক্ষেত্রে একেবারে রাখঢাক না রেখেই বলছে যে, আপিল বডির সদস্যরা অন্য দেশের হবার কারণে তারা অন্য দেশের স্বার্থ দেখে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নয়। সংস্থায় একটা অলিখিত নিয়ম ছিল যে, আপিল বডির সাতজন সদস্যের মাঝে একজন করে আসবেন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাপান থেকে। বাকি সকল রাষ্ট্রের জন্যে থাকবে বাকি চারটা আসন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন আমেরিকান নাগরিককেই সদস্য পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

সংস্থার আপিল বিভাগের কর্মকান্ড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ২০১৯এর ডিসেম্বরে; যখন শেষ তিনজন সদস্যের মাঝে দুইজনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুনরায় নিয়োগের ব্যাপারে ভেটো দেয়। খুব সম্ভবতঃ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মৃত্যুর শুরু এখানেই। আম্পায়ার ছাড়া খেলা চলতেই পারে; কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে যে, আম্পায়ার ছাড়া খেলায় সমস্যা হবেই।


বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উপসংহার?

আসলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনের তোয়াক্কা করেনি কোনদিনই। জেনেভার ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক’এর চক্রবর্তী রাঘাবন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দ্বন্দ্ব নিরসনের বেশিরভাগ রুলিং বাস্তবায়ন না করার বিশেষ রেকর্ড রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এর মাঝে বেশিরভাগই হলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক এবং পাল্টা শুল্ক আরোপের ব্যাপারে রুলিং। অনেক আমদানির ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানিকারকের খরচকে কম হিসেব করে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, আপিল বডির রুলিং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই তারা এগুলির বাস্তবায়ন করেনি।

সংস্থার আপিল বিভাগের কর্মকান্ড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ২০১৯এর ডিসেম্বরে; যখন শেষ তিনজন সদস্যের মাঝে দুইজনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুনরায় নিয়োগের ব্যাপারে ভেটো দেয়। ‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে কথা বলতে গিয়ে লন্ডনের ‘বেরেনবার্গ ব্যাঙ্ক’এর প্রধান অর্থনীতিবিদ হোলগার শ্মাইডিং বলেন যে, খুব সম্ভবতঃ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মৃত্যুর শুরু এখানেই। আম্পায়ার ছাড়া খেলা চলতেই পারে; কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে যে, আম্পায়ার ছাড়া খেলায় সমস্যা হবেই। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’ বলছে যে, সংস্থার রেফারি চলে যাবার সাথে সাথে এর আলোও নিভে যাচ্ছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র সংস্থাকে দুর্বল করতে চাইলেও আরেক পক্ষ চাইছে এটাকে টিকিয়ে রাখতে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সংস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে একটা আলোচনার আয়োজন করে কানাডা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। গত বছরের নভেম্বরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ডেভিড ওয়াকার আপিল বডিকে নিয়ে কিছু প্রস্তাব দেন। তার লক্ষ্য ছিল আপিল বডির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং যুক্তরাষ্ট্র যা যা চেয়েছে, সেগুলি মেনে নেয়া। তার প্রস্তাবগুলির মাঝে ছিল, আপিল বডির সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের মাঝে দেবার ব্যাপারটা নিশ্চিত করা; আপিল বডির সদস্যরা যেন নিজেদের উপর অর্পিত ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কোন ধরনের উপদেশ দিতে না যান; পূর্বের দেয়া আপিল বডির রুলিংকে যেন তারা আইনের উদাহরণ হিসেবে না নেন; আর তারা যেন খেয়াল রাখেন যে সদস্য দেশগুলির উপর তারা যেন সংস্থার ১৯৯৫ সালের আইনের বাইরে নতুন কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ না করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও ওয়াকারের প্রস্তাবের সমর্থন রয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক ‘কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ ওয়াকারের চিন্তাগুলিকেই পুঁজি করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপিল বডিকে টিকিয়ে রাখা; নাহলে তা শুধু আপিল বডিকেই না, পুরো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ব্যবস্থাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। শিকাগোভিত্তিক আইন বিষয়ক কোম্পানি ‘বেকার ম্যাকেঞ্জি’ বলছে যে, ইতোমধ্যেই ইউরোপ এবং কানাডা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপিল বডির বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দ্বিপাক্ষিক দিকটাকে প্রাধান্য দিয়ে কানাডা এবং নরওয়ের সাথে আলোচনায় আপিল বডির মতোই একটা ব্যবস্থা নিজেরা তৈরি করে নিতে চাইছে। ওয়াকারের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তাগুলি সমাধানের চেষ্টা করা হলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ছোটখাটো কোন পরিবর্তন চাইছে না; বরং পুরো সংস্থাটার আমূল পরিবর্তন করতে চাইছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পশ্চিমা চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ মুক্ত বাজারের সাইনবোর্ড। সারা বিশ্বকে একটা মুক্ত বাজারের অধীনে আনার যে লক্ষ্য নিয়ে ‘ডব্লিউটিও’র যাত্রা শুরু, ২৫ বছর পরেও সেই লক্ষ্য অবাস্তব ঠেকছে। জাতিরাষ্ট্রগুলির নিজস্ব স্বার্থকে পেরিয়ে সংস্থার আইনগুলিকে প্রাধান্য দেবার জন্যে কেউই প্রস্তুত নয়; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রও। নিজের স্বার্থের বিপক্ষে গেলেই যুক্তরাষ্ট্র সংস্থার আপিল বডির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর সংস্থার আইনগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা যুক্তির অভাব হয়নি। চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ‘ডব্লিউটিও’ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আর করোনাভাইরাসের মহামারি এবং মহামন্দার মাঝে জাতিরাষ্ট্রগুলিও ক্রমেই আরও রক্ষণশীল হচ্ছে; দূরে চলে যাচ্ছে সংস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য মুক্ত বাজার। শুধু তা-ই নয়, এর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এহেন করুণ অবস্থা পুঁজিবাদী আদর্শের উপর একটা কঠিন আঘাত হিসেবেই এসেছে।