Sunday 3 October 2021

পশ্চিম আফ্রিকার মালিতে ফ্রান্সকে প্রতিস্থাপন করছে রাশিয়া?

০৪ঠা অক্টোবর ২০২১

ফরাসিরা যখন রুশ ভাড়াটে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মালি ছেড়ে যেতে চাইছে, তখন ফ্রান্সের কাছে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নয়, বরং নিজ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রকাশ পেয়ে যায়।

 

পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের দেশ মালিতে গত ২০২০এর অগাস্টের পর থেকে এক বছরের মাঝে দু’বার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। প্রাক্তন এই ফরাসি উপনিবেশে ‘অপারেশন বারখেইন’ নামে ফ্রান্স সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল ২০১৩ সালে। সেই সময় থেকে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থান ছাড়াও জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং উগ্রবাদী সংঘাতে দিশেহারা রয়েছে ফ্রান্স। মালির সমস্যা দূরীভূত করা নয়, বরং মালির আশেপাশের বুরকিনা ফাসো এবং নিজেরএ সংঘাত ছড়িয়ে পড়াটাকেই থামাতে পারেনি ফ্রান্স। বর্তমানে মালির বিশাল মরু অঞ্চলে জাতিসংঘের ১৩ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। তবে এখানকার যুদ্ধের মূল নেতৃত্ব এখনও ফ্রান্সের হাতেই রয়েছে। পুরো সাহেল অঞ্চলের এই সংঘাতকে নেতৃত্ব দিতে অত্র অঞ্চলে ৫ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন রেখেছে ফ্রান্স। সাহেলের দেশগুলির সেনাদের নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে ফরাসিরা এই যুদ্ধ চালিয়ে নেবার চেষ্টা করলেও এই যুদ্ধের শেষ কোথায়, তা কেউ বলতে পারছে না। মালিতে অভ্যুত্থানের পর থেকে কর্নেল আসিমি গোইতার নিয়ন্ত্রণে থাকা সামরিক সরকারের সদস্যরা ফ্রান্সের নেতৃত্ব মানছে না। ফ্রান্স মালির সরকারের উপর অনেক ধরনের চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেও এর দৃশ্যমান প্রভাব কম। এমনই একটা পরিস্থিতিতে মালিতে ফ্রান্সের অবস্থান নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে। এখানে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে রাশিয়া। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ রুশ ভাড়াটে সেনাদের নাম উল্লেখ না করে বলেন যে, মালির সরকার রাশিয়ার প্রাইভেট সামরিক কোম্পানির কাছ থেকে নিরাপত্তা সহায়তা চেয়েছে। তবে তিনি এতে রুশ সরকারের সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।

মালির সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে সাম্প্রতিক সময়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ ঘোষণা দেন যে, ফ্রান্স সাহেলে তার সৈন্যের সংখ্যা অর্ধেক করবে। ম্যাক্রঁর এই কথার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে মালির প্রধানমন্ত্রী শোগুয়েল মাইগা বলেন যে, ফ্রান্স মালিকে পরিত্যাগ করছে। এই কথার প্রত্যুত্তরে ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি বলেন যে, মালি সরকার ফরাসি সেনাদের রক্ত দিয়ে নিজেদের পা মুছে নিচ্ছে। ম্যাক্রঁ এক বছরে দু’বার অভ্যুত্থানের পর মালির সরকারের গণতান্ত্রিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে সাহেলের দেশগুলিতে ফ্রান্স বহুকাল থেকেই সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করা ছাড়াও দুর্নীতিগ্রস্ত এবং মানবাধিকার বিরোধী কর্মকান্ডকে সমর্থন করে এসেছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মালির জনমত নিঃসন্দেহেই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে চলে গেছে। মালির সংঘাত আশেপাশের দেশগুলিতে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান নিম্নগামিতার কারণে মালিয়ানরা নিয়মিতভাবে ফ্রান্সের সামরিক অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে এবং ফ্রান্সের ‘দখলদারিত্ব’র শেষ চাইছে।

 
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথে মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুলাই দিওপ। ফরাসি ভাষাভাষী আফ্রিকায় রাশিয়ার স্বার্থ কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাশিয়া হয়তো ফ্রান্সকে বার্তা দিতে চাইছে যে, রাশিয়া তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইউরোপের হস্তক্ষেপ পছন্দ করছে না। আর এই লক্ষ্যে রুশরা এমন কিছু ভাড়াটে সেনাকে ব্যবহার করছে, যাদের সাথে ক্রেমলিনের সরাসরি সম্পর্ক দেখানোটা কঠিন।

মালিতে অনেকেই চাইছেন রুশ ভাড়াটে সেনারা দেশটার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক। এই চিন্তার পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন গ্রুপ থাকলেও অনেকেই মনে করছেন যে, মালির বর্তমান অবস্থার মূল কারণ ফ্রান্স। ফ্রান্সই মালির বিভিন্ন গ্রুপের সাথে আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করে। মালিতে ফরাসি সেনাদের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিবাদ হয়েছে, সেভাবে রুশ ভাড়াটে সেনাদের ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়নি। তবে এব্যাপারে জনমত একমুখী নয়। উত্তরাঞ্চলের তুয়ারেগদের একটা গ্রুপ ‘সিএমএ’ মনে করে যে, রুশদের সাথে কাজ করলে তা ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে যাবে।

রুশ ভাড়াটে সেনারা ২০১৭ সাল থেকে সেন্ট্রান আফ্রিকান রিপাবলিকের সরকারের নিরাপত্তা দিচ্ছে। সেখানেও কয়েক হাজার জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন রয়েছে ১৪টা বিদ্রোহী গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ফ্রান্স যখন দেশটাকে নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে গেছে, তখনই রুশরা সরকারি সমর্থনে সেখানকার সরকারের নিরাপত্তা দেয়ায় মনোনিবেশ করে। সেখানে সরকারি বাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে ১’শ ৭০ জনের মতো রুশ ভাড়াটে সেনা। একইসাথে সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহও আসছে রাশিয়া থেকে।

ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইইউএর সেনারা রয়েছে মালিতে। ফ্রান্স যখন বলছে যে, মালিতে রুশ ভাড়াটে সেনা মোতায়েন হলে ফ্রান্স মালি ছেড়ে যাবে, তখন ফ্রান্সের বন্ধু জার্মানিও সেরকমই বার্তা দিচ্ছে। ইইউএর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন যে, মালি সরকার সেদেশে রুশ ভাড়াটে সেনাদের মোতায়েন করলে ইইউএর সাথে মালির সম্পর্কের অবনতি হবে। অপরদিকে রুশরা মালিতে তাদের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। রুশ পরিবহণ বিমানে করে মালির জন্যে ৪টা হেলিকপ্টার, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ডেলিভারি দিয়েছে রাশিয়া। মালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাদিও কামারা বলছেন যে, গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার সাথে এই হেলিকপ্টার ডেলিভারির চুক্তি হয়েছিল। তবে তিনি বলেন যে, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ছিল রাশিয়ার পক্ষ থেকে উপহার।

মালিতে কার প্রভাব বেশি হবে, তা নিয়ে ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মাঝে শুরু হয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার সোচিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ৪৩ জন আফ্রিকান সরকার প্রধানকে ‘রাশিয়া আফ্রিকা সামিট’এ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যদিও মূলতঃ মালিতে ২০১৩ সালে ফরাসি হস্তক্ষেপের পর থেকেই সেখানে রুশ সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ শুরু হয়। প্রথমে তিন হাজার কালাশনিকভ রাইফেল ডেলিভারি দেবার পর ২০১৬ সালে মালিকে দু’টা হেলিকপ্টার দেয় রাশিয়া। ২০১৯ সালে দুই দেশের মাঝে একটা প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিয়াগালে বাগাইয়োকো বলছেন যে, ফরাসিরা যখন রুশ ভাড়াটে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মালি ছেড়ে যেতে চাইছে, তখন ফ্রান্সের কাছে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নয়, বরং নিজ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রকাশ পেয়ে যায়। মালি সরকার খুব চতুরতার সাথে জনমতকে ব্যবহার করে ফ্রান্সকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে; যা কিনা তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা দিতে পারে। তবে প্যারিসের ‘সায়ন্সেস পো ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর আনাস্তাসিয়া সাপোশকিনা বলছেন যে, ফরাসি ভাষাভাষী আফ্রিকায় রাশিয়ার স্বার্থ কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাশিয়া হয়তো ফ্রান্সকে বার্তা দিতে চাইছে যে, রাশিয়া তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইউরোপের হস্তক্ষেপ পছন্দ করছে না। আর এই লক্ষ্যে রুশরা এমন কিছু ভাড়াটে সেনাকে ব্যবহার করছে, যাদের সাথে ক্রেমলিনের সরাসরি সম্পর্ক দেখানোটা কঠিন।

No comments:

Post a Comment