Saturday 17 October 2020

ড্রোন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কি?

১৮ই অক্টোবর ২০২০

ড্রোন একা যুদ্ধ জেতাতে পারবে না। এর সাথে ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে কাজ করবে অন্যান্য সার্ভেইল্যান্স ও কমিউনিকেশন্স ইন্টেলিজেন্স ড্রোন, ইলেকট্রনিক জ্যামার, স্যাটেলাইট, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স, ভূমি ও আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার আর্টিলারি ও ক্ষেপণাস্ত্র। এটা নিশ্চিত যে, এখন থেকে ককেশাসের যুদ্ধের শিক্ষাগুলিকে মাথায় রেখেই সকলকে কাজ করতে হবে।

ককেশাসে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে যুদ্ধের মাঝে সোশাল মিডিয়া বহু ভিডিও দিয়ে ছেয়ে যায়, যেখানে আকাশ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আর্মেনিয়ার ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই ভিডিওগুলি এসেছে আজেরবাইজানের ব্যবহৃত মনুষ্যবিহীন বিমান বা ড্রোন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা মিডলইস্ট সেন্টার ফর রিপোর্টিং এন্ড এনালিসিস’এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সেথ জে ফ্রান্তজম্যান ‘নিউজউইক’এর এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরেই ড্রোনের ব্যবহার করে আসলেও আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে আজেরবাইজানের শতশত নতুন ধরনের ড্রোন ব্যবহার ভবিষ্যৎ যুদ্ধের যবনিকা উন্মোচন করেছে।

আজেরবাইজানের ড্রোনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো ইস্রাইল। ২০১৬ সালে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে চার দিনব্যাপী এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে ইস্রাইলের তৈরি ড্রোনগুলি, বিশেষ করে ‘হারোপ’ সুইসাইড ড্রোন সেই যুদ্ধে তাদের কার্যকারিতার প্রমাণ দেয়। একটা ড্রোনের হামলায় আর্মেনিয়ার একটা বাস ধ্বংস হয়, যার মাধ্যমে কয়েকজন মধ্যম সাড়ির সামরিক অফিসার মারা যায়। এই সুইসাইড ড্রোনগুলি আকাশে উড়তে থাকে; যখন সেগুলি তাদের টার্গেট পেয়ে যায়, তখন নিজেই বোমার মতো সেই টার্গেটের উপর গিয়ে আঘাত করে। আঘাত করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তা ছবি প্রেরণ করতে থাকে। ‘হারোপ’এর ইঞ্জিনের শব্দ ভূমি থেকে শোনা গেলেও পরবর্তীতে তৈরি করা ‘স্কাইস্ট্রাইকার’ এবং ‘অরবিটার ওয়ান-কে’ ড্রোন ইলেকট্রিক মোটর ব্যবহার করে বলে ওড়ার সময় প্রায় শব্দহীন থাকে; শুধু টার্গেটের উপর হামলা করার সময় শব্দ করে। আজেরবাইজানের সরকার একটা ভিডিওতে ৪টা ট্রাকের উপর অনেকগুলি সিলিন্ডার থেকে ইস্রাইলি ড্রোন ছোঁড়ার দৃশ্য দেখায়। ফ্রান্তজম্যান বলছেন যে, ঐ ট্রাকগুলি ৩৬টা সুইসাইড ড্রোন বহণ করতে সক্ষম; যা কিনা একটা বড়সড় সামরিক গ্রুপ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে সক্ষম।

২০২০ সালের যুদ্ধে আজেরবাইজানের ড্রোন ফ্লিটে যুক্ত হয় তুরস্কে তৈরি ‘বায়রাকতার টিবি ২’ এটাক ড্রোন। ছোট আকৃতির এবং অপেক্ষাকৃত সস্তা এই ড্রোন টার্গেটের উপর ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে আবার ঘাঁটিতে ফেরত আসে এবং জ্বালানি নিয়ে আবারও মিশনে যায়। ‘আল জাজিরা’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, আজেরবাইজানের ড্রোনগুলি তাদের টার্গেট ধ্বংসের যে হাই রেজোলিউশন ভিডিও পাঠায়, তা তথ্য যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে আর্মেনিয়া এমন কোন হামলার ভিডিও প্রকাশ করতে না পারায় জনগণের চোখে শুধু আজেরবাইজানের সাফল্যই ধরা পড়েছে এবং সবাই ধরেই নিয়েছে যে, যুদ্ধে আজারবাইজানই জিততে চলেছে।

আকাশ থেকে হামলা করা ছাড়াও ড্রোনগুলি যে ছবি পাঠায়, তার উপর ভিত্তি করে শত্রুর টার্গেটে দূরপাল্লার আর্টিলারি এবং বিমান দিয়ে নির্ভুলভাবে হামলা করা যায়। তুরস্ক সিরিয়া এবং লিবিয়াতে এই কৌশল অবলম্বন করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন যে, সেই শিক্ষাগুলিই তুরস্কের সাথে যৌথ মহড়ার সময় আজেরিদের কাছে পৌঁছে গেছে। অনেকেই এর মাঝে আশংকা করতে শুরু করেছেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ‘ওয়াশিংটন টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ট্যাঙ্কের দিন প্রায় শেষের পথে। ‘দ্যা ট্রিবিউন’ বলছে যে, ট্যাঙ্ককে যুদ্ধক্ষেত্রে বাঁচতে হলে কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। সমর বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, জ্যামার ব্যবহার করে ড্রোনের সাথে এর কন্ট্রোলারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায়; আর ট্যাঙ্কের সাথে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করে ড্রোন ভূপাতিত করা যায়। তবে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিন কোর এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের ট্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে ইনফর্মেশন নেটওয়ার্ক ভিত্তিক সমন্বিত সক্ষমতার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে, যেখানে ইলেকট্রনিক সেন্সর, ড্রোন এবং দূরপাল্লার অস্ত্রের ব্যবহার হবে গুরুত্বপূর্ণ। ‘আল জাজিরা’ আজেরবাইজানের উদাহরণ দিয়ে বলছে যে, বর্তমানে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সেন্সর এবং ড্রোন ব্যবহারের কারণে আর্মেনিয়ার কোন অস্ত্রই লুকিয়ে থাকতে পারছে না; আর এর সাথে ড্রোন এবং দূরপাল্লার অস্ত্রের ব্যবহারে নির্ভুলভাবে টার্গেট ধ্বংস করে ফেলা যাচ্ছে।

তবে আজেরবাইজানের এই যুদ্ধ দেখিয়ে দেয় যে, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ড্রোন থেকে নিরাপদ নয়। ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত আজেরবাইজান সরকার দাবি করে যে, তারা ১৫টা বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট ধ্বংস করেছে; যার মাঝে একটা অত্যাধুনিক ‘এস ৩০০’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা রয়েছে; ৬টা রাডারও রয়েছে। এছাড়াও তারা ৪৯টা ট্যাঙ্ক ও আর্মার্ড ভেহিকল এবং ৫১টা আর্টিলারি ইউনিট ধ্বংস করেছে। অপরপক্ষে ১৭ই অক্টোবর আর্মেনিয়া বলে যে, তারা কমপক্ষে ১’শ ৮৬টা ড্রোন ভূপাতিত করেছে। একইসাথে তারা ৫’শ ৫৪টা ট্যাঙ্ক ও আর্মার্ড ভেহিকল ২২টা বিমান এবং ১৬টা হেলিকপ্টার ধ্বংস করার দাবি করে। দাবির সত্যাসত্য যাচাই করার আগে এটা অন্ততঃ বলা যায় যে, এর আগে কোন যুদ্ধে কেউ এতগুলি ড্রোন ভূপাতিত করার যেমন দাবি করেনি, তেমনি ড্রোন ব্যবহার করে এতগুলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দাবিও করেনি। সেথ ফ্রান্তজম্যান বলছেন যে, একটা ড্রোন ভিডিওতে আরেকটা ইস্রাইলি ‘অরবিটার’ ড্রোন দেখা যায়; যা বলে দিচ্ছে যে, আকাশে এতগুলি ড্রোন একত্রে উড়ছে যে, একটা আরেকটার ছবি তুলছে!

ড্রোন নির্মাতা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন অবশ্যই আজেরবাইজানের যুদ্ধের দিকে লক্ষ্য রাখছে। ১৩ই অক্টোবর ‘ইন্সটিটিউট অব ইলেকট্রনিক সায়েন্স এন্ড টেকনলজি চায়না’ একটা ভিডিও প্রকাশ করে; যেখানে দেখানো হয় যে একটা ট্রাক থেকে ৪৮টা সুইসাইড ড্রোন ছোঁড়া হচ্ছে। অনেকগুলি ড্রোনকে একত্রে ঝাঁক বেঁধে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সমস্যায় ফেলে দেয়া সম্ভব, তা ককেশাসের যুদ্ধে প্রমাণিত। ‘কদিন আগেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল মার্ক কার্লেটন স্মিথ সাংবাদিকদের বলেন যে, ভবিষ্যতের বাহিনীতে আর্মার্ড ভেহিকল ব্যবহৃত হবে রোবোটের মাদারশিপ হিসেবে; এর সাথে থাকবে দূরপাল্লার আর্টিলারি, যেগুলির জন্যে টার্গেট খুঁজে দেবে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন। তবে এসব ড্রোন একা যুদ্ধ জেতাতে পারবে না। এর সাথে ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে কাজ করবে অন্যান্য সার্ভেইল্যান্স ও কমিউনিকেশন্স ইন্টেলিজেন্স ড্রোন, ইলেকট্রনিক জ্যামার, স্যাটেলাইট, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স, ভূমি ও আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার আর্টিলারি ও ক্ষেপণাস্ত্র। ফ্রান্তজম্যান বলছেন যে, এটা নিশ্চিত যে, এখন থেকে ককেশাসের যুদ্ধের শিক্ষাগুলিকে মাথায় রেখেই সকলকে কাজ করতে হবে।

3 comments:

  1. UAV or UCAV সহ artificial intelligence, আগামীর যুদ্ধক্ষেত্র গুলিতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা গ্রহন করতে চলেছে। তবে ফাইটার জেট কে replace করতে পারবে বলে মনে হয় না। আপনি কি মনে করেন?
    আর, ড্রোন প্রযুক্তিতে তুরষ্ক কতটা এগিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন, বিশেষ করে ক্যানাডার sanctions এর কথা মাথায় রেখে।?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আকাশে সামরিক উপস্থিতির সবচাইতে বড় সুবিধা হলো উপর থেকে দেখতে পাওয়া। প্রথম বেলুন এবং বিমানও এজন্যেই ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেগুলিতে অস্ত্র সংযোজিত করে ভূমিতে হামলার ব্যবস্থা করা হয়। এবং আরও পরে আকাশ থেকে হামলা ঠেকাতে অন্য বিমান দিয়ে হামলাকারী বিমান ভূপাতিত করার (ইন্টারসেপশন) পদ্ধতি বের করা হয়। অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে; কিন্তু পৃথিবীর বাস্তবতার কারণে আকাশ থেকে অবলোকন করতে পারার সুবিধাখানা এখনও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আর একারণেই সার্ভেইল্যান্স বিমান এবং স্যাটেলাইটের ব্যবহার হচ্ছে।

      আসলে আকাশ থেকে ভূমিতে টার্গেট খুঁজে পাওয়া গেলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। কিন্তু টার্গেট খুঁজে পাওয়া না গেলে এর কোন ব্যবহার নেই; তা যতো উন্নত প্রযুক্তিরই হোক না কেন। সেই হিসেবে টার্গেট খোঁজার পিছনেই সবচাইতে বড় প্রচেষ্টাটা থেকে যাবে। বর্তমান ড্রোনগুলির সুবিধা এখনও সেই আকাশ থেকে অবলোকন। এর সাথে যোগ হয়েছে উড়ন্ত ড্রোন খুঁজে বের করা এবং সেগুলিকে ভূপাতিত করার অসুবিধা। ড্রোন খোঁজা এবং ভূপাতিত করার প্রযুক্তি এগিয়ে গেলে ভবিষ্যতের ড্রোনগুলিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে; ফলে সেগুলি আরও দামি হয়ে যাবে। ড্রোনের একটা বড় সুবিধা হলো পাইলটের জীবনের ঝুঁকি না থাকা; অর্থাৎ সস্তা। ড্রোন দামি হয়ে গেলে সেটার গুরুত্ব এখনকার মতো থাকবে না।

      তুরস্কের ব্যাপারটা ড্রোনের জন্যে নয়; তুরস্কের জন্যে। ড্রোন না থাকলে অন্য কিছু থাকবে; কিন্তু তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ হবে। তুরস্কের ব্যাপারটা ভূরাজনৈতিক। এর সাথে ড্রোন থাকা বাঁ না থাকার কোন সম্পর্ক নেই।

      Delete