Friday 16 October 2020

কিরগিজস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ... ভূরাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে মধ্য এশিয়া

১৭ই অক্টোবর ২০২০ 

কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের রাস্তায় বিক্ষোভ। মধ্য এশিয়ার একমাত্র কিরগিজস্তানেই কিছুদিন পরপরই বিক্ষোভের মুখে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। আশেপাশের দেশগুলির সবগুলিতেই একনায়ক ক্ষমতাসীন। মধ্য এশিয়ায় ‘সিল্ক রোড’এর উপর অবস্থিত দেশটাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ চীনের ‘বিআরআই’ চিন্তাই হলো ‘নতুন সিল্ক রোড’, যা পূর্ব এবং পশ্চিমের মাঝে সুপার হাইওয়ে; চীনারা শুরু করলেও সকলেই চাইছে এর নিয়ন্ত্রণ নিতে।

১৫ই অক্টোবর মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার ফলাফল হিসেবে প্রেসিডেন্ট সুরনবাই জিনবেকভ পদত্যাগ করেন এবং নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন হন। সাদির জাপারভ মাত্র ক’দিন আগেও কারাগারে ছিলেন; এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। ২০১৩ সালে ‘কুমতর’ স্বর্ণ খনির আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে তার ১১ বছরের জেল হয়। ২০১০ সালে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট কুরমানবেক বাকিয়েভের সমর্থক ছিলেন তিনি। ‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বেশিরভাগ বিশ্লেষকই মনে করছেন যে, প্রায় অচেনা একজন রাজনীতিবিদ এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামীর প্রধানমন্ত্রী হবার অর্থই হলো পিছনে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। ৪ঠা অক্টোবরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আলমাজবেক আতামবায়েভকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসলেও পরে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন আক্রমণ করার পর প্রধানমন্ত্রী এবং স্পিকার পদত্যাগ করেন। কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা অত্র এলাকার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বুঝতে হলে কিরগিজস্তানসহ মধ্য এশিয়ার ভৌকৌশলগত বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করতে হবে।

ভূরাজনৈতিকভাবে আকারের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিরগিজস্তান

মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানের উত্তরে রয়েছে কাজাখস্তান, পশ্চিমে রয়েছে উজবেকিস্তান, দক্ষিণে তাজিকিস্তান এবং পূর্বে রয়েছে চীনের উইঘুর বা শিনজিয়াং। প্রায় ২ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ এই দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৬৩ লক্ষ। জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলিম; প্রায় ১৬ শতাংশ রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার মাধ্যমে দেশটার জন্ম। প্রায় ১৩’শ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে মধ্য এশিয়ার সবচাইতে গরীব দেশ কিরগিজস্তান। দেশটার প্রধান রপ্তানি পণ্যের মাঝে রয়েছে স্বর্ণ, কৃষিজ দ্রব্য, বিদ্যুৎ, তৈরি পোষাক, ইত্যাদি। মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশে মোটামুটিভাবে একনায়কতন্ত্র চললেও কিরগিজস্তানে পার্লামেন্টারি ব্যাবস্থা প্রচলিত হয়েছে। দেশটাতে বেশ কয়েকবার নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন হয়েছে এবং বেশ কয়েকবার ক্ষমতাসীন নেতৃত্বকে চাপের মুখে পদক্ষেপ করতে হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে কিরগিজস্তানের সম্পর্ক পশ্চিমাদের সাথে মোটামুটি ভালো; যদিও নিরাপত্তার দিক থেকে দেশটা রাশিয়ার উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। তদুপরি মধ্য এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাবের পর এবং একইসাথে চীনা বিনিয়োগ বাড়তে থাকায় এখানকার ভূরাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। অত্র এলাকায় পশ্চিমা দেশগুলির কূটনৈতিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে কাজাখস্তানের সবচাইতে বড় শহর আলমাতিতে পশ্চিমা দেশগুলির রাজনৈতিক অবস্থান। 


১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র কাজাখস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।পরের মাসে, অর্থাৎ ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্র আলমাতিতে তার দূতাবাস খোলে। কাজাখস্তানের রাজধানী ১৯৯৮ সালে আস্তানাতে চলে গেলে মার্কিন দূতাবাসও সেখানে চলে যায় ২০০৬ সালে। তবে আলমাতির গুরুত্ব বিচারে সেখানে দূতাবাসের একটা শাখা থেকে যায়। ২০০৯ সালে সেখানে একটা কনসুলেট জেনারেল খোলা হয়; যার কর্মকান্ডের মাঝে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাও রয়েছে। মার্কিন দূতাবাসের কথায় দেশটার রাজধানী সরে গেলেও আলমাতি দেশটার ‘দক্ষিণের রাজধানী’ রয়ে গেছে; যা বর্তমানে দেশটার সবচাইতে বড় শহর এবং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক রাজধানী। অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি করার পিছনে এই কূটনৈতিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটেনও আলমাতিতে একই বছরের অক্টোবরে তাদের দূতাবাস খোলে। ব্রিটিশরা অবশ্য পরবর্তীতে তাদের দূতাবাস নতুন রাজধানীতে সরিয়ে নেয়। রাজধানী নূর সুলতান, যার আগের নাম ছিল আস্তানা, বর্তমানে ৬৯টা দেশের দূতাবাসের ঠিকানা। তবে আলমাতিতে অবস্থান ধরে রেখেছে ১৯টা দেশ; যার মাঝে মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি ছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক এবং প্রতিবেশী চীন। অথচ প্রতিবেশী দেশ কিরগিজস্তানের রাজধানীতে রয়েছে মাত্র ১৩টা দেশের দূতাবাস। অনেক দেশই কিরগিজস্তানে তাদের কূটনৈতিক কর্মকান্ড কাজাখস্তান থেকেই চালিয়ে থাকে। একারণেই কিরগিজস্তানের রাজধানীতে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে আলমাতির একটা যোগসূত্র থেকে যায়।

কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মধ্য এশিয়া। আর মধ্য এশিয়া ভৌগোলিক আয়তনে যত বিশালই হোক না কেন, চীন থেকে মধ্য এশিয়ায় ঢোকার পথ কিন্তু খুবই সীমিত। পথগুলি চীনের শিনজিয়াং প্রদেশ বা উইঘুরের মাঝ দিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে প্রবেশ করে। এই পথগুলিই হাজার বছরের পুরোনো ‘সিল্ক রোড’। এর মূল পথগুলি ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে দক্ষিণে হিমালয় পর্বত এবং উত্তরে অতি শীতল সাইবেরিয়া এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। একটা পথ উইঘুরের কাশগর হয়ে হিমালয়ের উত্তরে তিয়েন শান পর্বতমালার মাঝ দিয়ে ফারগানা ভ্যালিতে পৌঁছে। আরেকটা পথ উইঘুরের উরুমচি থেকে তিয়েন শান পর্বতমালার উত্তর দিয়ে ইশিক কুল হ্রদ এবং বলখাশ হ্রদের মাঝ দিয়ে ফারগানা ভ্যালিতে পৌঁছায়। বর্তমানে বলখাশ হ্রদের উত্তরে সাইবেরিয়ার অতি শীতল অঞ্চলের মাঝ দিয়ে আরও কিছু পথ তৈরি করা হলেও তা বেশ ঘুরপথ হওয়ায় প্রাচীন ‘সিল্ক রোড’এর পথগুলিই এখনও প্রধান পথ হয়ে রয়েছে। এই পথগুলি বর্তমানের কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তানের মাঝ দিয়ে যায়। অর্থাৎ উইঘুর, কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তান হলো ‘বিআরআই’এর মধ্য এশিয়া রুটের প্রধান পথ। আর এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি হলো উইঘুরের কাশগর থেকে কিরগিজস্তানের ওশ; এবং উইঘুরের উরুমচি থেকে খরগোস হয়ে কাজাখস্তানের আলমাতি। আলমাতি বর্তমান কাজাখস্তানের সবচাইতে বড় শহর। আর কিরগিজস্তানের ওশ শহর কিরগিজস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহর হলেও এর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কিরগিজ রাজধানী বিশকেকএ। বিশকেক আবার অনেক ক্ষেত্রেই আলমাতির সাথে যুক্ত। অর্থাৎ আলমাতি এবং বিশকেক ‘বিআরআই’এর রুটগুলির নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে। 

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি। মার্কিন বিমান বাহিনীর শেষ ‘কেসি ১৩৫’ এয়ার রিফুয়েলিং বিমান ছেড়ে যাচ্ছে কিরগিজস্তানের মানাস বিমান ঘাঁটি। রুশ বাধার মুখে আফগানিস্তানের যুদ্ধের উপর ভর করে প্রায় ১৩ বছর কিরগিজস্তানে সামরিক লজিস্টিকস ঘাঁটি ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক উপস্থিতি অত্র অঞ্চলে মার্কিন প্রভাবকে যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকেও বাড়িয়েছে।

আফগান যুদ্ধ কিরগিজস্তানের গুরুত্বকে বাড়িয়েছে

২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধে জড়াবার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্য এশিয়াতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আফগান যুদ্ধের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র কিরগিজস্তানের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার লক্ষ্যে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকএর মানাস বিমান বন্দরকে লজিস্টিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া এতে তার নিজের উঠানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার হিসেবে দেখতে থাকে; যদিও রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের মালামালকে কাজাখস্তান পর্যন্ত রেল ট্রানজিট দিয়েছিল; যেখান থেকে তা কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান পৌঁছাতো। এভাবে মূলতঃ খাবারদাবারসহ কিছু সাধারণ পণ্য আফগানিস্তানে যেতো। জ্বালানি, সামরিক গাড়ি এবং ভারি রসদপাতিসহ বেশকিছু পণ্য আফগানিস্তানে পৌঁছাতো পাকিস্তানের মাঝ দিয়ে। আর সৈন্য এবং তাদের ব্যবহৃত অতি সংবেদনশীল জিনিসগুলি যেতো আকাশপথে কিরগিজস্তান হয়ে। দেশটার রুশ লবি সর্বদাই এই সামরিক রুটখানা বন্ধ করে দেবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপের অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে রুশ নেতৃত্বের ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ‘সিএসটিও’এর সদস্যপদের শর্ত হিসেবে রাশিয়া কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকএর অদূরে কান্টএ একটা সামরিক বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করার চুক্তি করে। মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তান এবং তাজিকিস্তান ছাড়াও আর্মেনিয়া এবং বেলারুশ ‘সিএসটিও’এর সদস্য। চুক্তি মোতাবেক এই দেশগুলি বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে রাশিয়া সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করার কথা রয়েছে। রুশ বিমান ঘাঁটি ব্যবহারের চুক্তিটা সর্বশেষ এবছরের জুন মাসে নবায়ন করা হয়েছে। বাৎসরিক সাড়ে ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এই ঘাঁটি ব্যবহার করছে রাশিয়া। এছাড়াও কিরগিজস্তানে রাশিয়ার আরও কয়েকটা ঘাঁটি রয়েছে; যার মাঝে রয়েছে ইসিক কুল হ্রদে রুশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ধ্বংসী টর্পেডো টেস্টিংএর ঘাঁটি।

২০০৫ সালের জুলাই মাসে ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’এর আলোচনায় কিরগিজস্তান এবং উজবেকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরিয়ে নেবার জন্যে সমসীমা বেঁধে দেবার দাবি জানানো হয়। ‘এসসিও’এর সদস্য হিসেবে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের সাথে রয়েছে রাশিয়া এবং চীন। প্রায় ১৩ বছর ব্যবহার করার পর কিরগিজ সরকারের চাপের মুখে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র মানাসে তার লজিস্টিকস ঘাঁটিখানা বন্ধ করে দেয়। মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩৭৬তম এক্সপিডিশনারি উইংএর কমান্ডার কর্নেল জন মিলার্ড বলেন যে, এই সময়ের মাঝে মানাসের এই ঘাঁটি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ৫৩ লক্ষ সৈন্য আনা নেয়া করেছে; আর ১ লক্ষ ৩৬ হাজার বিমানকে আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিং করা হয়েছে; এবং ৪২ হাজার কার্গো পরিবহণ মিশন সম্পাদন করেছে। প্রায় ২ হাজার মার্কিন সেনা এই ঘাঁটিতে অবস্থান করতো। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০১১ সালে রুশ সমর্থিত আলমাজবেক আতামবায়েভ কিরগিজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর মানাসের ঘাঁটি বন্ধ করার জন্যে চাপ সৃষ্টি শুরু হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তিনি মস্কোর সাথে চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে কান্ট সামরিক ঘাঁটিকে রাশিয়ার কাছে আরও ১৫ বছরের জন্যে লিজ দেবার ব্যবস্থা করেন। বিনিময়ে মস্কো কিরগিজস্তানের ৫’শ মিলিয়ন ডলারের ঋণ মওকুফ করে। 

বলখাশ হ্রদের দক্ষিণের ‘জেতিসু’ বা ‘সাত নদী’ অঞ্চলের বড় শহর আলমাতি, যা কাজাখস্থানের প্রাক্তন রাজধানী। একই অঞ্চলের মাঝে পড়েছে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেক এবং চীনের উইঘুরের ইয়িনিং শহর। মূলতঃ মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলকে ঊনিশ শতকে রাশিয়া এবং চীন নিজেদের মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই বাউন্ডারিগুলি উভয় পাশের মানুষের বিশ্বাসগত এবং জাতিগত একাত্মতাকে মুছে ফেলতে পারেনি।


কিরগিজস্তান এবং মধ্য এশিয়ার ভৌগোলিক অসঙ্গতি


মধ্য এশিয়ার একেবারে পূর্বে অবস্থিত কিরগিজস্তান। তিয়েন শান পর্বতমালা দেশটাকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। রাজধানী বিশকেকএর অবস্থান দেশের একেবারে উত্তরে কাজাখস্তানের সীমানার কাছাকাছি। বিশকেকের জনসংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ; যা পুরো দেশের জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগ। সেখান থেকে কাজাখস্তানের সবচাইতে বড় শহর আলমাতি মাত্র ২’শ ৩৬ কিঃমিঃ দূরে; যেতে লাগে মাত্র ৪ ঘন্টা। নিকটবর্তী কাজাখস্তানের প্রায় ১৯ লক্ষ জনসংখ্যার আলমাতি শহরই বিশকেকের মানুষের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশকেক এবং আলমাতি তিয়েন শান পর্বতের উত্তরে ইশিক কুল হ্রদ এবং বলখাশ হ্রদের মাঝে অবস্থিত এলাকার অংশ; যা ঐতিহাসিকভাবে ‘জেতিসু’ বা ‘সাত নদী’ নামে পরিচিত। বলখাশ হ্রদে পরা সাতটা নদীর উপর ভিত্তি করেই এই নাম; যদিও বর্তমানে মূল নদী ইলি সহ পাঁচটা নদী অবশিষ্ট রয়েছে। এই অঞ্চলটা রাজনৈতিকভাবে ভাগাভাগি হয়ে বেশিরভাগটা পড়েছে কাজাখস্তানে; বাকিটা চীন এবং কিরগিজস্তানে। বিশকেক থেকে পাহাড়ি পথে কিরগিজস্তানের অপর গুরুত্বপূর্ণ শহর ওশ যেতে লাগে ১১ থেকে ১২ ঘন্টার উপরে। ওশ হলো তিয়েন শানের পশ্চিমে ফারগানা ভ্যালিতে অবস্থিত এক শহর। সেখান থেকে ফারগানা ভ্যালির অন্য শহরগুলি বেশি কাছে; যদিও সেই শহরগুলি উজবেকিস্তান বা তাজিকিস্তানের অংশ। মোটকথা, ফারগানা ভ্যালি এবং ‘জেতিসু’ দু’টা ভৌগোলিকভাবে আলাদা অঞ্চল; এবং এই অঞ্চলগুলিকে কৃত্রিমভাবে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং চীনের মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করা হয়েছে। জারের রাশিয়া এবং সোভিয়েত আমলে করা এই বিভাজনের বর্তমান ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। ১৮৫৪ সালে রুশরা আলমাতি শহরের গোড়াপত্তন করে; বিশকেক শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৮৬৮ সালে। এই শহরগুলি তিয়েন শান পর্বতমালার দক্ষিণে কাশগর থেকে ফারগানা ভ্যালিতে যাওয়া সিল্ক রোডের একটা বিকল্প তৈরি করে, যা মূলতঃ রাশিয়ার সাথে চীনের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা দেয়। একুশ শতকে এসে সেই একই কারণে এই শহরগুলি গুরুত্বপূর্ণ।

মধ্য এশিয়ায় কয়েকটা বিশেষ অঞ্চলে প্রাকৃতিক কারণে পানির সহজলভ্যতার উপর ভিত্তি করে মানুষের বসতি স্থাপিত হয়েছে। বৃষ্টি না থাকার কারণে প্রায় মরু এই অঞ্চলে কিছু বরফগলা নদীর উপর নির্ভর করে মানুষ বেঁচে থাকে। এই অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যাওয়া সবচাইতে বড় বাউন্ডারি হলো তিয়েন শান পর্বতমালা। এই পর্বতমালার উত্তরে আলতাই পর্বতমালার দক্ষিণ পর্যন্ত রয়েছে ‘জুংগার বেসিন’; যার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শহর উইঘুরের উরুমচি। এখানে উরুমচি নদী ছাড়াও অনেকগুলি নদী নেমে এসেছে তিয়েন শান পর্বতমালা থেকে। উরুমচি থেকে তিয়েন শান পর্বত পেরিয়ে দক্ষিণে আসলে ‘তারিম বেসিন’; যেখানে তাকলা মাকান মরুভূমির মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তারিম, হোতান, ইয়ারকান্দ নদী এবং এগুলির শাখা প্রশাখাগুলি। তারিমের পশ্চিম প্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ শহর কাশগর; মধ্যযুগের সিল্ক রোড এই অঞ্চলের উপর দিয়েই গিয়েছে। তিয়েন শানের উত্তর পশ্চিমে রয়েছে ‘জেতিসু’ বা ‘সাত নদী’র অঞ্চল; যেখানে মূল নদী ইলি। আর তিয়েন শানের দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে উর্ভর ফারগানা ভ্যালি, যার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে শির দরিয়া নদী। ‘জুংগার’ এবং ‘তারিম’ মূলতঃ বর্তমানে চীনের উইঘুরের মাঝে পড়েছে। ‘জেতিসু’ ভাগাভাগি হয়েছে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং চীনের মাঝে। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক ভৌগোলিক অঞ্চলগুলিকে কৃত্রিম রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে ভাগাভাগি করা হয়েছে; সৃষ্টি হয়েছে বহু ধরনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। এই ভাগাভাগির পিছনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ‘সিল্ক রোড’এর নিয়ন্ত্রণ নেয়া। মূলতঃ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও রুশ এবং চীনা সাম্রাজ্যগুলি এই অঞ্চলকে ভাগবাটোয়ারা করে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে নেয়। এই অঞ্চলে রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং চীনা হান জাতির লোকদের ব্যাপক হারে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। এই কর্মকান্ডগুলি আজও এখানকার ভূরাজনীতিকে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। কৃত্রিম বাউন্ডারির মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষকে আলাদা করা হলেও বিশ্বাসগত এবং জাতিগত একাত্মতার প্রভাব খুব সহজেই সীমানা পার হয়ে যাচ্ছে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

ফারগানা ভ্যালি ... মরুর মাঝে ওয়েসিস


তিয়েন শান পর্বতমালা এবং গিসার আলাই পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত প্রায় ২২ হাজার বর্গকিঃমিঃএর ফারগানা ভ্যালির সমতলভূমি কতটা শুষ্ক, তার প্রমাণ হলো এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। ‘ক্লাইমেট ডাটা’র হিসেব মতে ফারগানাতে বছরে মাত্র ২’শ ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। মাসের হিসেবে তা বৃষ্টিপাতের আট মাসে গড়ে মাসে ২০ থেকে ৩০ মিঃমিঃ। আর গ্রীষ্মকালের শুষ্ক চার মাসে প্রায় নেই বললেই চলে। তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশে বৃষ্টির মৌসুমে মাসে গড়ে ৩’শ থেকে ৯’শ মিঃমিঃ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। তদুপরি এখানে চাষাবাদের কমতি নেই। ফারগানা ভ্যালি পুরো মধ্য এশিয়ার খাদ্যের জোগানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এখানে তুলা, গম, ধান, সব্জি, ফল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়। চাষাবাদের কারণেই ফারগানা হলো মধ্য এশিয়ার মাঝে সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। পুরো মধ্য এশিয়ার সাড়ে ৬ কোটি মানুষের মাঝে প্রায় দেড় কোটিই বাস করে ফারগানাতে, যা কিনা মধ্য এশিয়ার ভূমির মাত্র ৫ শতাংশ।

সোভিয়েতদের তৈরি করা রাজনৈতিক সীমানা

ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়েই পুরো ফারগানা ভ্যালির নিয়ন্ত্রণ ছিল যেকোন একটা রাজনৈতিক শক্তির হাতে। একসময় এর নিয়ন্ত্রণ ছিল পারস্যের হাতে; এরপর তা চলে যায় ইসলামিক সভত্যার অধীনে। ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গল আক্রমণের পর তা আবারো মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। মধ্যপ্রাচ্য এবং চীনের মাঝে স্থলবাণিজ্যপথ ‘সিল্ক রোড’এর উপর অবস্থিত হবার কারণে এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। ঊনিশ শতকে এই অঞ্চলে রুশদের আগ্রাসন শুরু হয়। ১৮৭৬ সাল নাগাদ তৎকালীন কোকান্দ খানাতের পুরো এলাকা রুশদের উপনিবেশ হয়ে যায় এবং দলে দলে রুশরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। বিংশ শতকে বলশেভিক বিপ্লবের পর এই অঞ্চল রুশদের হাত থেকে সোভিয়েতদের হাতে যায়। সোভিয়েতরা প্রথমবারের মতো মধ্য এশিয়াকে জাতি ভিত্তিতে, অর্থাৎ উজবেক, তাজিক, কাজাখ, তুর্কমেন এবং কিরগিজ পরিচয়ে ভাগ করা শুরু করে। উজবেক এবং তাজিকরা সমতলভূমিতে চাষাবাদের কাজ করলেও কাজাখ, তুর্কমেন এবং করগিজরা বেশিরভাগই ছিল যাযাবর। সোভিয়েতরা নতুন তৈরি করা সীমানা অনুযায়ী এই যাযাবরদেরকে এক জায়গায় থাকতে বাধ্য করে। ‘স্ট্রাটফর’ বলছে যে, সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের এই নীতির পিছনে মূল চিন্তাটা ছিল মধ্য এশিয়ায় পুনরায় একক কোন শক্তির উত্থান প্রতিহত করা, যা কিনা অত্র অঞ্চলে মস্কোর শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হতে পারে। তবে নতুন তৈরি করা সীমানাগুলি জাতিগত সীমানা পুরোপুরিভাবে মেনে চলেনি। এক রিপাবলিকে আরেক রিপাবলিকের বড়সড় একটা সংখ্যালঘু জনসংখ্যা থেকেই যায়। সোভিয়েত সময়ে মধ্য এশিয়া মস্কোর একচ্ছত্র অধিকারে থাকার ফলে এই সীমানাগুলির ফলাফল খুব বড় ছিল না। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তার দিক থেকে পুরো অঞ্চল একক সত্ত্বা হিসেবেই কাজ করেছে। তবে এই পুরো হিসেব পরিবর্তিত হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথেসাথে। 

বৃষ্টিহীন মধ্য এশিয়ায় কিরিগিজস্তানের তক্তোগুল রিজার্ভার। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যে ১৯৭০এর দশকে নারিন নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই রিজার্ভার। নারিন নদীর পানির উপর উজবেকিস্তানের ফারগানা ভ্যালি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল; আবার কিরগিজস্তানের অর্থনীতিতে পানিবিদ্যুৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। কৃত্রিম রাজনৈতিক সীমানারা কারণে ফারগানা ভ্যালির বিরাট জনসংখ্যার পানির নিয়ন্ত্রণ ছোট্ট কিরগিজস্তানের হাতে।


কিরগিজস্তানের বিদ্যুৎ ব্যবসা, পশ্চিমা বিনিয়োগ এবং আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক

অর্থনৈতিকভাবে কিরগিজস্তান তার প্রতিবেশী দেশগুলির উপরে যথেষ্টই নির্ভরশীল; বিশেষ করে তেল গ্যাসের জন্যে। দেশটায় খনিজ তেল এবং গ্যাস তেমন একটা না থাকলেও এর পানিবিদ্যুৎ শক্তি উল্লেখযোগ্য। দেশটার জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ বিদ্যুৎ খাত থেকে আসে। আর উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯০ শতাংশই হলো পানিবিদ্যুৎ। তবে শীতকালে পানিবিদ্যুতের উৎপাদন কমে গেলে আমদানিকৃত হাইড্রোকার্বনের উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়; তাজিকিস্তান এবং কাজাখস্তান থেকে বিদ্যুৎ আমদানিও করতে হয়। ২০১০ সালের পর থেকে দেশে কয়লার উৎপাদন যেখানে ছিল সাড়ে ৪ লক্ষ টন, সেখানে ২০১৮ সাল নাগাদ তা বেড়ে হয় প্রায় ২৪ লক্ষ টন। মাত্র ৬৩ লক্ষ মানুষের দেশের জন্যে সংখ্যাটা বেশ বড়। সরকারের কয়লা উৎপাদন বৃদ্ধির পিছনে কারণ হলো বিদ্যুৎ এবং আমদানিকৃত তেল গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমানো। তদুপরি তেল গ্যাস আমদানির নেটওয়ার্ক কিরগিজস্তানের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালে রক্ষণাবেক্ষণের অর্থের অভাবে কিরগিজস্তানের গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্ক রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রমের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। দেশটা বেশিরভাগ তেল আমদানি করে রাশিয়া এবং কাজাখস্থান থেকে।

কিরগিজস্তানের পানিবিদ্যুতের উৎস হলো দেশটার পাহাড়ি নদীগুলি। মধ্য এশিয়ার পাহাড়গুলির মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পেয়েছে কিরগিজস্তান; বিশেষ করে তিয়েন শান পর্বতমালা। তিয়েন শানের পশ্চিমে অবস্থিত ফারগানা ভ্যালির উর্বরতার মূলে রয়েছে শির দরিয়া নদী এবং এর শাখা প্রশাখা। শির দরিয়া নদীর পানির সবচাইতে বড় উৎস হলো নারিন এবং কারা দরিয়া নদী। উভয় নদীর উৎপত্তিই কিরগিজস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে। অর্থাৎ কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ফারগানা ভ্যালির পানির উৎসের প্রায় পুরোটাই ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের হাতে। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পানির উৎসগুলির উপর বাঁধ দিয়েই কিরগিজরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। ফারগানা ভ্যালির নামানগান শহরের কাছে এই নদী দু’টা মিলিত হয়ে শির দরিয়া নদী তৈরি করেছে। নারিন নদীর উপর ১৯৭০এর দশকে সোভিয়েতরা শুরু করে বাঁধ নির্মাণ; উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন। সবচাইতে বড় পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প হলো ১২’শ মেগাওয়াট সক্ষমতার তক্তোগুল বাঁধ। এই বাঁধের ভাটিতে কুরপসাই, তাশ কুমির, শামালদাইসাই এবং উচ কুরগানস্ক নামে আরও চারটা বাঁধ নির্মাণ করা হয়, যেগুলির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যথাক্রমে ৮’শ, সাড়ে ৪’শ, ২’শ ৪০ এবং ১’শ ৮০ মেগাওয়াট। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও নারিন নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ অব্যাহত থাকে। তক্তোগুল রিজার্ভারের উজানে ২০১০ সালে রুশ অর্থায়নে তৈরি করা হয় ৩’শ ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কামবারাতা-২ বিদ্যুৎ প্রকল্প। কিরগিজস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক হলেও শীতকালে তাপমাত্রা শূণ্যের নিচে নেমে গেলে তা যথেষ্ট থাকে না। যেকারণে উজানে আরও দু’টা প্রকল্প নিয়েছে কিরগিজ সরকার, যেগুলির জন্যে অর্থায়ন নিয়ে সমস্যা ছাড়াও ভাটির দেশ উজবেকিস্তানকে রাজি করাবার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কামবারাতা-১ প্রকল্প হলো সর্ববৃহত, যার সক্ষমতা হবে ১৮’শ ৬০ মেগাওয়াট। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিরগিজস্তান খারাপ মৌসুমে বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাবে আর ভালো মৌসুমে বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে।

এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন তৈরির প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১২ সালে শুরু হওয়া ‘সেন্ট্রাল এশিয়া সাউথ এশিয়া ১০০০’ বা ‘সিএএসএ ১০০০’ নামের এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এর মূল অর্থ যোগানদাতা হলো বিশ্বব্যাংক; যাদের নেতৃত্ব অনুসরণ করে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকসহ আরও বেশকিছু সংস্থা এতে অর্থায়ন করছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো কিরগিস্তানকে গ্রিড লাইনের মাধ্যমে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা; মাঝে তাজিকিস্তানও যুক্ত থাকবে। এই লাইনের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালে যখন কিরগিজস্তানে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে, তখন তা আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে রপ্তানি করা হবে। তবে বর্তমানে যেহেতু চীনা বিনিয়োগে পাকিস্তানে অনেকগুলি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, তাই পাকিস্তান বলছে যে, গ্রিড লাইনটাকে এমনভাবে তৈরি করা হোক, যাতে দরকার হলে একই লাইন ব্যবহার করে পাকিস্তান থেকে যেন কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা যায়।

কিরগিজস্তানের পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামোর সুযোগ নিয়ে দেশটার বিদ্যুৎ শিল্পে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ১৯৭০এর দশকে তৈরি তক্তোগুল হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্পের সক্ষমতা কমে গিয়েছিল; যা কিনা কিরগিজস্তানের বিদ্যুৎ রপ্তানি করার সক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয়। ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ বা ‘এডিবি’র ২’শ ৭৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে ২০১২ সালে এই প্রকল্পের উন্নয়ন কাজে হাত দেয়া হয়। এতে ২০২৩ সালের মাঝে এর স্থাপিত সক্ষমতা ১২’শ মেগাওয়াট থেকে ১৪’শ ৪০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পে বেঁচে যাওয়া অর্থের মাধ্যমে ভাটির ১’শ ৮০ মেগাওয়াট সক্ষমতার উচ কুরগানস্ক বাঁধেরও উন্নয়ন করার কথা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে এডিবির সদস্যপদ পাবার পর থেকে কিরগিজস্তানকে এডিবি প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ এবং অনুদান দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক দেশটার কৃষি, পানিবিদ্যুৎ এবং পর্যটন খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। ১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংকের সদস্য হবার পর থেকে কিরগিজস্তান সংস্থাটা থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। একইসাথে সকল পশ্চিমা উন্নয়ন সংস্থাগুলির সহায়তাকে সমন্বয় করার দায়িত্বও নিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

রেমিট্যান্সের ভূরাজনীতি এবং রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা

কিরগিজস্তানের অর্থনীতি রেমিট্যান্সের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে ২০০০ সালে কিরগিজস্তানের রেমিট্যান্স আয় ছিল ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার; যা ছিল জিডিপির দশমিক ২ শতাংশেরও কম। ২০০৫ সালে রেমিট্যান্স এক লাফে ৩’শ মিলিয়ন ডলার পার হয়ে যায়; যা ছিল জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। ২০০৮ সাল নাগাদ তা পৌঁছে যায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে; যা জিডিপির প্রায় ২৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে; যা কিনা জিডিপির প্রায় ৩১ শতাংশ। আর ২০১৮ সালে তা পৌঁছে যায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে; যা কিনা জিডিপির ৩২ শতাংশ। বুঝতে বাকি থাকে না যে, কিরগিজস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব কতটা বেশি। বিশ্বব্যাংক বলছে যে, দেশটার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এর অর্থনীতির একটা খাতের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের কথাগুলিকে খতিয়ে দেখতে কিরগিজস্তানের রেমিট্যান্সের উৎসের দিকে তাকাতে হবে। কিরগিজস্তানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলি তাদের রেমিট্যান্সের জন্যে রাশিয়ার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রাশিয়া থেকে যে কয়টা দেশে রেমিট্যান্স যায়, তার মাঝে সর্বোচ্চ যায় উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানে। ২০১৮ সালে রাশিয়া থেকে যাওয়া মোট রেমিট্যান্সের ৬৮ শতাংশই গেছে এই তিন দেশে। বিশেষ করে কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানে কর্মসংস্থানের ব্যাপক স্বল্পতার কারণে দেশের একতা বড় সংখ্যক মানুষ রাশিয়াতে যায় কাজ করতে। তাজিকিস্তানের জিডিপির কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। যা এই দেশগুলিকে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি রেমিট্যান্স নির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। রাশিয়া এই মানুষগুলিকে মূলত কন্সট্রাকশন সেক্টরে কাজে লাগায়; যা মূলতঃ একটা মৌসুমী কর্মকান্ড। কিরগিজস্তানের রেমিট্যান্সের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ২০১২ সালের পর থেকে দেশটার রেমিট্যান্স তেমন একটা বাড়েনি। কারণ হিসেবে ২০১৪ সালে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধ্বসের কথা বলতেই হয়। সেবছর তেলের বাজারে মূল্য ধ্বস এবং ইউক্রেন যুদ্ধে জড়াবার কারণে রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ রাশিয়ার অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অর্থনীতি ছিল নিম্নগামী। এরপর সেখানে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। যেকারণে মধ্য এশিয়ার দেশগুলিও রাশিয়া থেকে বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 

কিরগিজস্তানের ‘কুমতর’ স্বর্ণ খনি। কানাডিয়ান একটা কোম্পানি ১৯৯২ সালে কোন টেন্ডার ছাড়াই এই খনির শতভাগ মালিকানা পেয়ে যায়। এরপর মারাত্মক পরিবেশগত দুর্ঘটনার পরেও এই কোম্পানি খনির মালিকানা ধরে রেখেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, খনিটা কিরগিজস্তানের অর্থনীতির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে দেশটাতে চীনা বিনিয়োগ নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

স্বর্ণ খনি এবং চীনা বিনিয়োগ

বিশ্ব ব্যাংকএর হিসেবে কিরগিজস্তানের জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ ‘কুমতর’ নামের স্বর্ণ খনি থেকে আসে। এই খনির শতভাগ মালিকানা কানাডিয় কোম্পানি ‘সেনটেরা গোল্ড’এর হাতে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে কোন টেন্ডার ডাকা ছাড়াই এই খনি কানাডিয়দের হাতে দিয়ে দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালে খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন শুরু হলে পরের বছরেই সেখানে মারাত্মক এক দুর্ঘটনা পর পুরো এলাকার ৫ হাজারের বেশি মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়। ব্যাপক পরিবেশগত সমস্যা থাকলেও কানাডিয়ান কোম্পানির কর্মকান্ড বন্ধ হয়নি। ২০০৪ সাল থেকে খনির মালিকানা নিয়ে কিরগিজ সরকারের সাথে কানাডিয়দের দ্বন্দ্ব শুরু হলেও আন্তর্জাতিক আদালত পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে কিরগিজ সরকার কোম্পানির সাথে চুক্তি করে মালিকানা কানাডিয়দের হাতেই রেখে দেয়। বলা হয় যে, ‘কুমতর’ কিরগিজস্তানের অর্থনীতির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কানাডিয়দের পিছন পিছন চীনারাও কিরগিজস্তানে স্বর্ণ খনিতে বিনিয়োগ করে। কিন্তু তারা তাদের সমস্যাগুলিকে সমাধান করতে হিমসিম খেয়েছে।

চীনারা কিরগিজস্তানে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থগুলিকে এগিয়ে নিতে চায় ‘বিআরআই’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে। কিন্তু কিরগিজস্তানে চীনারাদের রাজনৈতিক অবস্থান যে, কতটা দুর্বল, তা কয়েকটা প্রকল্পের সমস্যার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। ২০১৯এর অগাস্টে দেশের দক্ষিণে নারিন এলাকায় চীনা বিনিয়োগে চলা সলটন সারি স্বর্ণ খনিতে কর্মীদের সাথে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে ২০ জন আহত হবার পর খনির কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয় দেশের সরকার। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গ্রামবাসীরা অভিযোগ করে যে, খনি থেকে বের হওয়া বিষাক্ততা থেকে তাদের গবাদিপশু মারা যাচ্ছিল; যদিও সেখানকার পশু বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, পশু মৃত্যুর কারণ ছিল জীবাণুর সংক্রমণ। এরপর এবছরের ফেব্রুয়ারিতে চীনারা কিরগিজস্তানে একটা বড় প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ‘নারিন ফ্রি ইকনমিক জোন’ নামে একটা লজিস্টিক্যাল সেন্টার তৈরি করার প্রকল্প ছিল দেশটার দক্ষিণে আতবাশি অঞ্চলে। এই লজিস্টিক্যাল সেন্টারের মাধ্যমে চীনের কাশগর এর সাথে ফারগানা ভ্যালির ব্যবসা সহজ হতো। কিন্তু প্রকল্প অঞ্চলে শতশত মানুষের প্রতিবাদের মুখে চীনা কোম্পানি তাদের ২’শ ৮০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের কর্মকান্ড বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য ছিল যে, চীনারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিরগিজস্তানের জমি দখল করে নিচ্ছে। 

মধ্যযুগের ‘সিল্ক রোড’। মধ্য এশিয়া বিশাল এলাকা হলেও ভৌগোলিক কারণেই এই পথ মাত্র অল্প কিছু অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেই পথের উপরে হবার কারণেই কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তান ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। একুশ শতকের ‘নিউ সিল্ক রোড’ও এই দেশগুলি হয়েই যাচ্ছে।


নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

চীনের জন্যে কিরগিজস্তানে থেকে থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেখানে চীনের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে না পারাটা একটা আঞ্চলিক হুমকি। প্রাকৃতিক ভৌগোলিক অঞ্চলগুলিকে কৃত্রিমভাবে বিভাজনের মাধ্যমে রাশিয়া এবং চীন যে সীমানাগুলি তৈরি করেছে, তা আজ বহু ধরনের ভূরাজনৈতিক জটিলতার জন্ম দিচ্ছে। যেমন উজবেকিস্তানের পানির নিয়ন্ত্রণ কিরগিজস্তানের হাতে। কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেক আবার কাজাখস্তানের বড় শহর আলমাতির প্রভাবমুক্ত নয়। চীনের ‘বিআরআই’ চিন্তাটা কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তানের উপর পুরোপুরি নির্ভর থাকার কারণেই এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ চীনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই অঞ্চলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত প্রভাব এখনও সর্বোচ্চ। ১৯৯০এর দশক থেকেই এখানে পশ্চিমা দেশগুলির, বিশেষতঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়ছে। ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হতে থাকে। আর এই ভূরাজনৈতিক খেলার মাঠ হয়ে দাঁড়ায় কিরগিজস্তান; যেখানে কিছুদিন পরপরই গণবিক্ষোভে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। কিরগিজস্তানের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে পানিবিদ্যুৎ এবং স্বর্ণ খনিতে পশ্চিমারা অনেক বিনিয়োগ করলেও দেশটা এখনও রাশিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্সের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন অবরোধে এবং তেলের বাজারে ধ্বসের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি যখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে, তখন মধ্য এশিয়ার ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের আয়ও কমতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং বেকারত্ব একটা গণবিক্ষোভ উস্কে দেবার জন্যে যথেষ্ট।

এহেন পরিস্থিতিতে চীন তার অর্থনৈতিক স্বার্থগুলিকে সমুন্নত রাখতেও হিমসিম খাচ্ছে। তদুপরি উইঘুর বা শিনজিয়াং প্রদেশে চীনা সরকারের দমনপীড়নের সাথে বিশ্বাসগত এবং জাতিগতভাবে একাত্মতা প্রকাশ করা সীমানার ওপাড়ের কিরগিজ এবং কাজাখদেরকে চীনারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ঊনিশ শতক থেকে শুরু করে রাশিয়া এবং চীনের প্রচেষ্টায় মধ্য এশিয়ায় তৈরি করা কৃত্রিম বাউন্ডারিগুলির ব্যবস্থাপনাই আজ চীনের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া এবং চীনের তৈরি করা এই কৃত্রিম সীমানাগুলিই এখন পশ্চিমারা ব্যবহার করছে অত্র অঞ্চলে তাদের প্রভাব বৃদ্ধিতে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলির উপর রাজনৈতিক প্রভাব রাখা রাশিয়ার উপর চীনকে নির্ভর করতে হচ্ছে; যদিও মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া এবং চীনের স্বার্থ আলাদা। পূর্ব এবং পশ্চিমের মাঝে স্থলযোগাযোগের এক সুপারহাইওয়ে মধ্য এশিয়া; যা নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে চীনের ‘বিআরআই’ চিন্তার কারণে। চীনাদের হাত দিয়েই এর শুরু হলেও ‘বিআরআই’ নামের এই ‘নতুন সিল্ক রোড’এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে, তা নিয়েই এখন শুরু হয়েছে নতুন প্রতিযোগিতা। কিরিগিজস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতারই ফলাফল।



সূত্রঃ 


‘Who is Kyrgyzstan’s new prime minister, Sadyr Japarov?’, Al Jazeera, 15 October 2020
‘Rayimbek Matraimov: Do protests threaten Kyrgyzstan’s kingmaker?’, Al Jazeera, 13 October 2020
‘Seizure of Kyrgyzstan nears completion as president steps down’, Eurasianet, 15 October 2020
‘Fergana Climate (Uzbekistan)’ in Climate Data (https://en.climate-data.org/asia/uzbekistan/fergana-province/fergana-2780/)
‘Bangladesh Average Precipitation’ in Trading Economics (https://tradingeconomics.com/bangladesh/precipitation)
‘Kyrgyz Republic President, ADB Country Director Inspect Toktogul Hydropower Plant’, ADB News Release, 18 October 2019
‘Kyrgyzstan to hold talks on Kambarata HPP in Tashkent’ in Azer News, 21 February 2019
‘Kyrgyzstan Energy Profile: Country Report April 2020’, International Energy Agency
‘Central Asia: The Complexities Of The Fergana Valley’ by Stratfor in Forbes, 10 October 2013
‘Afghan Leader Inaugurates Construction of Key Regional Energy Project’, VOA News, 06 February 2020
‘Kyrgyz Lawmakers OK Bill On Amendments To Russian Military Base Agreement’, Radio Free Europe Radio Liberty, 12 June 2020
‘"Mission accomplished" for U.S. air base in pro-Moscow Kyrgyzstan’, Reuters, 06 March 2014
‘U.S. vacates base in Central Asia as Russia's clout rises’, Reuters, 03 June 2014
‘Kyrgyzstan Reveals More Russian Military Facilities’ by John C.K. Daly in Jamestown Foundation, Eurasia Daily Monitor Volume: 5 Issue 59, 28 March 2008
‘Personal remittances, received (% of GDP) - Kyrgyz Republic’, The World Bank (https://data.worldbank.org/indicator/BX.TRF.PWKR.DT.GD.ZS?locations=KG)
‘The World Bank in the Kyrgyz Republic’, The World Bank (https://www.worldbank.org/en/country/kyrgyzrepublic/overview)
‘Personal remittances, received (current US$) - Kyrgyz Republic’, The World Bank (https://data.worldbank.org/indicator/BX.TRF.PWKR.CD.DT?locations=KG)
U.S. Embassy & Consulate in Kazakhstan – History (https://kz.usembassy.gov/embassy-consulates/almaty/history/)
‘Kumtor Hostory’ (https://www.kumtor.kg/en/deposit/history/)
‘Mountain of gold’, Reuters, 03 October 2013
‘Conflict continues at Kyrgyzstan’s massive gold mine’, Al Jazeera, 19 February 2016
‘Kyrgyzstan halts work at Chinese gold mine after clashes’, Reuters, 07 August 2019
‘China-led $280 million Kyrgyzstan project abandoned after protests’, Reuters, 18 February 2020

2 comments:

  1. ইউক্রেন এর যুদ্ধের সাথে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট এর কারণ টা নিয়ে যদি আলোচনা করতেন তাহলে উপকৃত হতাম ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে রেভোলিউশন হয়েছিল; যার পরবর্তীতে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে এবং ডনবাসে যুদ্ধ শুরু করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়। রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করছে ঠিকই, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবরোধের কারণে বাণিজ্য করতে পারা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

      অন্যদিকে রাশিয়ার মূল রপ্তানি পণ্য হলো তেল-গ্যাস, যার বাজারে ধ্বসের কারণে রাশিয়ার আয় ভীষণভাবে কমে গিয়েছে। একইসাথে অবরোধের কারণে বাণিজ্য তো কমেছেই। ইউক্রেনের মাঝ দিয়ে রাশিয়ার গ্যাসের পাইপলাইন গিয়েছে ইউরোপে, যা এখন ব্যবহার করা বন্ধ; বেলারুশ, তুরস্ক এবং বল্টিক সাগরের পাইপলাইন ব্যবহার করা হচ্ছে এখন। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে ইউরোপ রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস কিনে রাশিয়ার অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখুক। অন্যদিকে ইউরোপ চাইছে না যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে। সুতরাং এই সংঘাত মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্র বনাম পশ্চিম ইউরোপ (মূলতঃ জার্মানি)। মাঝে অর্থনৈতিক চাপের মাঝে পড়ে রাশিয়া নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে লড়ছে।

      এসবকিছু মিলিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তবে এর মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপ নীতি; ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে সরকার পরিবর্তন এবং রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ।

      Delete