Monday 5 October 2020

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ধ্বস কি আসন্ন?

০৫ই অক্টোবর ২০২০

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পশ্চিমা চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ মুক্ত বাজারের সাইনবোর্ড। সারা বিশ্বকে একটা মুক্ত বাজারের অধীনে আনার যে লক্ষ্য নিয়ে ‘ডব্লিউটিও’র যাত্রা শুরু, ২৫ বছর পর সেই লক্ষ্য অবাস্তব ঠেকছে। জাতিরাষ্ট্রগুলির নিজস্ব স্বার্থকে পেরিয়ে সংস্থার আইনগুলিকে প্রাধান্য দেবার জন্যে কেউই প্রস্তুত নয়; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রও। আর করোনাভাইরাসের মহামারি এবং মহামন্দার মাঝে জাতিরাষ্ট্রগুলিও ক্রমেই আরও রক্ষণশীল হচ্ছে; দূরে চলে যাচ্ছে সংস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য মুক্ত বাজার।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন’ বা ‘ডব্লিউটিও’এর নতুন ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচন চলছে। বিদায়ী ডিরেক্টর জেনারেল ব্রাজিলের নাগরিক রবার্তো আজেভেদো তার মেয়াদ শেষের এক বছর আগেই পদত্যাগ করার কারণে নির্বাচনী কর্মকান্ড আগেভাগেই শুরু করতে হয়েছে। ১৮ই সেপ্টেম্বর পাঁচজন প্রার্থী প্রাথমিক নির্বাচনে সামনে এসেছেন; এরা হলেন কেনিয়ার মন্ত্রী আমিনা মোহামেদ, নাইজেরিয়ার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী নগোজি ওকোঞ্জো ইওয়েআলা, দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ইয়ু মিউংহি, সৌদি আরবের মোহাম্মদ আল তুওয়াইজরি এবং ব্রিটেনের প্রাক্তন মন্ত্রী লায়াম ফক্স। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, সৌদি আরব আর ব্রিটেনের প্রার্থীরা প্রথম রাউন্ডের পরেও টিকে যাবেন, এটা অনেকেই ভাবেনি। তিনজন প্রার্থী বাদ পড়েছেন; যারা হলেন মেক্সিকোর জিসাস সীদ, মিশরের হামাদ মামদুহ এবং মলদোভার তুদর উলিয়ানভশি। ২৪শে সেপ্টেম্বর থেকে ৬ই অক্টোবর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে সংস্থার ১’শ ৬৪টা সদস্য দেশ ভোট দিয়ে প্রার্থীর সংখ্যা দুইয়ে নামিয়ে নিয়ে আসবে। সংস্থা বলছে যে, নভেম্বরের শুরুতেই তারা নতুন ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচিত করে ফেলতে চাইছেন। সংস্থাটা ভূরাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার জন্যে এটাই যথেষ্ট যে, কেউ কেউ মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ৩রা নভেম্বরের নির্বাচনের কারণে সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল নিয়োগের সময়সীমা বৃদ্ধি পেতে পারে। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, যে-ই ডিরেক্টর জেনারেল হোন না কেন, তার জন্যে বেশ কঠিন সময় অপেক্ষা করছে; বিশেষ করে করনাভাইরাসের মহামারি এবং বিশ্বব্যাপী মহামন্দার মাঝে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সকলেই রক্ষণশীল আচরণ করছে। আর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চরম আকার নিয়েছে, যেখানে বাণিজ্য যুদ্ধ একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংস্কারের দাবি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে জেঁকে ধরেছে। অনেকেই ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচন নিয়ে কথা বললেও এটা সংস্থার মূল চ্যালেঞ্জ নয়। বরং চ্যালেঞ্জগুলি এতটাই জটিল যে, তা সংস্থার ভবিষ্যৎকেই হুমকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। এই হুমকিকে বুঝতে সংস্থার ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাজার তৈরি করতে ১৯৪৭ সালে ‘জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস এন্ড ট্রেড’ বা ‘জিএটিটি’ বা ‘গ্যাট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩টা দেশ এর সদস্য ছিল। আর এই সংস্থা কার্যক্রম চালিয়ে যায় ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত; ১৯৯৫ সালে ‘উরুগুয়ে রাউন্ড’ আলোচনা শেষে ১’শ ২৩টা দেশের সমন্বয়ে ‘ডব্লিউটিও’ গঠন করা হয়। ‘গ্যাট’এর সদস্যরাষ্ট্রগুলি যে আইনের মাঝে ছিল, সেই আইন ‘ডব্লিউটিও’র মাঝেও চালিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যরাষ্ট্রগুলির মাঝে বাণিজ্যের দ্বন্দ্ব থামানো যায়নি। ১৯৯৫ সালের পর থেকে দ্বন্দ্বের কারণে সংস্থার আইনে কোন পরিবর্তনই আনা সম্ভব হয়নি। যেকারণে সদস্যদের মাঝে দ্বন্দ্ব নিরসনে আপিল বডি অনেক বেশি হারে আইনের ‘ব্যাখ্যা’র আশ্রয় নিয়েছে। বড় অর্থনীতির দেশগুলি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই সংস্থাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে; যেকারণে সংস্থার ২৫ বছরের ইতিহাস শুধুই সংঘাতে পরিপূর্ণ। বিশেষ করে ২০০১ সালে চীনকে সংস্থার সদস্য করে নেবার পর থেকে এই দ্বন্দ্ব নতুন গতি পেয়েছে। সংস্থার সদস্য হবার জন্যে চীনকে অন্যদের তৈরি আইন মেনে নিতে হয়েছে; মেনে নিতে হয়েছিল বেশকিছু শর্তও, যেগুলি পশ্চিমা আদর্শের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার বিষয়ে ছাড়া দেবার বিষয়ে বলা হয়। তবে আইনের ফাঁকফোঁকড়ে আটকে যায় সেসব বিষয়; ‘যুক্তিসঙ্গত সময়’এর সংজ্ঞার ব্যাপারে কেউই একমত হতে পারেনি। এই শর্তগুলি চীন কতদিনে এবং কিভাবে পূরণ করবে, তা এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বিভেদের কারণ।

 

নিজের স্বার্থের বিপক্ষে গেলেই যুক্তরাষ্ট্র সংস্থার আপিল বডির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর সংস্থার আইনগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা যুক্তির অভাব হয়নি। চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ‘ডব্লিউটিও’ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন হয়ে পড়েছে।


যুক্তরাষ্ট্র বনাম ‘ডব্লিউটিও’

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডগুলির মাঝে একটা হলো সদস্যরাষ্ট্রগুলির মাঝে বাণিজ্যিক বিরোধের নিষ্পত্তি করা। দ্বন্দ্ব নিরসণের পদ্ধতির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘এপেলেইট বডি’ বা আপিল বডি। এতে সাতজন সদস্য থাকার কথা রয়েছে, যারা মূলতঃ বিচারক। চার বছর মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া এই সদস্যারা সর্বোচ্চ দুইবার সদস্যপদ পেতে পারেন। সংস্থার নিয়মানুসারে সদস্যদের ‘স্বাধীনভাবে’ সিদ্ধান্ত দিতে পারার শর্ত রয়েছে। তাদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই সংস্থার দ্বন্দ্বগুলি নিরসন হয়ে আসছে। তবে আপিল বডির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রয়েছে। ২০১১ সালে বারাক ওবামা হোয়াইট হাউজে থাকার সময় আপিল বডির সদস্য জেনিফার হিলম্যানের পুনরায় নিয়োগ পাওয়া বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নিয়মানুসারে সদস্য যদি তার পদে বহাল থাকতে ইচ্ছুক থাকেন, তবে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরায় নিযুক্ত হয়ে যাবেন। তবে হিলম্যানের ক্ষেত্রে কোন কারণ উল্লেখ না করেই ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মজার ব্যাপার হলো, হিলম্যান একজন মার্কিন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অনাস্থা এসেছিল। আর একইসাথে কোন কারণ না দেখাবার ফলে ‘ডব্লিউটিও’র ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে অনেকেই স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে দেখতে শুরু করে। আবার আপিল বডির ‘স্বাধীনতা’র ব্যাপারেও সন্দেহ দেখা দেয়। হিলম্যানের এই ঘটনার পর একই রকম ব্যাপার ঘটে কোরিয়ার নাগরিক সিউং হোয়া চ্যাংএর ক্ষেত্রেও। ২০১৬ সালে তার দ্বিতীয় দফা নিয়োগের ক্ষেত্রে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে এবার জানা যায় যে, তিনটা রুলিং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েছে, যেখানে চ্যাং ছিলেন তিন সদস্যের আপিল কমিটির চেয়ারম্যান। মার্কিন প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাইকেল পাঙ্কএর কথায়, এই রুলিংগুলির প্রথমটা ছিল চীনের ১৭টা পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধমূলক শুল্কারোপ; চীন এক্ষেত্রে আপিল জিতেছিল। দ্বিতীয়টা ছিল চীনা পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের এন্টি ডাম্পিং শুল্কারোপ। আর তৃতীয়টা ছিল আর্জেন্টিনা এবং পানামার মাঝে পণ্য এবং সার্ভিসের উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ছিল তৃতীয় পক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র বলে যে, আর্জেন্টিনা যেভাবে পানামার বিপক্ষে মামলা জিতেছে, তা সংস্থার আইনের সাথে যায় না। মাইকেল পাঙ্ক আরও বলেন যে, সংস্থার আইনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘আইন তৈরি’ করার এখতিয়ার নেই আপিল বডির। তিনি আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, প্যানেল জুরি যদি আইনী জটিলতার কারণে কোন ইস্যুর সমাধান দিতে না পারে, তাহলে আপিল বডির উচিৎ নয় সেটার সমাধান করতে যাওয়া। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যখন কোন বাণিজ্য দ্বন্দ্ব নিয়ে দুই পক্ষের লড়াই শুরু হয়, তখন প্রথমেই প্যানেল জুরির সামনে শুনানি হয়। এই প্যানেল হলো এড হক প্রকৃতির; একেকটা বিশেষ সমস্যার জন্যে একেকটা বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয় এবং রিপোর্ট দেয়া শেষে প্যানেল ভেঙ্গে দেয়া হয়। এই রিপোর্ট পাঠানো হয় আপিল বডির কাছে। লিখিত বক্তব্যে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি টিম রাইফ বলেন যে, ওবামা প্রশাসন সংস্থার আইনকে সমুন্নত রাখা ছাড়াও মার্কিন কর্মী, কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে তুলে ধরবে। আরও বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে যে আইনগুলি তৈরি করা হয়েছে, সেগুলি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীন আপিল বডি নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করে নিতে পারে না।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় পশ্চিমা এক দেশের প্রতিনিধি অভিযোগ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্তের ফলে আপিল বডির সদস্যদের কাছে এই বার্তা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রুলিং না গেলে চাকুরি খোয়াতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দ্বন্দ্ব নিরসনে কি সিদ্ধান্ত দেবে, তা নির্ধারণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনের পদক্ষেপ ট্রাম্প প্রশাসন আরও একধাপ এগিয়ে নেয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র মরিশাসের নাগরিক শ্রী বাবু চেকিতান সেরভাসিংএর পুনরায় নিয়োগে ভেটো দিলে মাত্র তিনজন সদস্য অবশিষ্ট থাকে। আপিল বডিতে যেকোন শুনানি হতে হলে কমপক্ষে তিনজন সদস্য থাকতে হবে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, সংস্থার ৬৭টা সদস্য রাষ্ট্র ওয়াশিংটনের কাছে পিটিশন দেয়, যাতে যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো তুলে নেয়। আপিল বডির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিযোগগুলি রয়েছে, তার মাঝে প্রধান হলো বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দেয়া রিপোর্ট আপিল বডি অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন করে অথবা পুরোপুরি উল্টিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, এই কাজ করার ক্ষমতা আপিল বডির নেই। মার্কিনীরা আরও বলছে যে, সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ৯০ দিনের মাঝে আপিল বডির কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও সকল ক্ষেত্রেই আপিল বডির হস্তক্ষেপে রুলিংএ দেরি হয়। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, সংস্থার আইনে ফাঁকফোঁকড় থাকার কারণে আপিল বডির সদস্যরা নিজেদের মতো করে রুলিং দিচ্ছেন, যা কিনা নতুন আইন হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। তারা সদস্য রাষ্ট্রগুলির নিজস্ব আইনের ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন নিজেদের মতো করে। আপিল বডির সদস্যরা সংস্থার আইন নতুন করে তৈরি করে দিতে পারেন না। আইনের যে জায়গাটাতে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তা হলো ‘যুক্তিসংগত সময়’। রুলিংএর সময় কোন সদস্য রাষ্ট্রকে সংস্থার আইন মানার জন্যে ‘যুক্তিসংগত সময়’ বেধে দেয়ার কথা থাকলেও এই ‘যুক্তিসংগত সময়’ আসলে কত, তা নিয়ে একেকজনের ভাবনা একেক রকম। এই বেধে দেয়া সময়ের মাঝে কেউ যদি আইন বাস্তবায়ন না করে, তাহলেও তার বিরুদ্ধে তেমন কোন কিছুই করার নেই সংস্থার। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, সংস্থার আইন যদি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই সেই আইন বাস্তবায়ন করবে না। আগের প্রশাসনগুলির মতো চাপা না থেকে ট্রাম্প প্রশাসন এক্ষেত্রে একেবারে রাখঢাক না রেখেই বলছে যে, আপিল বডির সদস্যরা অন্য দেশের হবার কারণে তারা অন্য দেশের স্বার্থ দেখে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নয়। সংস্থায় একটা অলিখিত নিয়ম ছিল যে, আপিল বডির সাতজন সদস্যের মাঝে একজন করে আসবেন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাপান থেকে। বাকি সকল রাষ্ট্রের জন্যে থাকবে বাকি চারটা আসন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন আমেরিকান নাগরিককেই সদস্য পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

সংস্থার আপিল বিভাগের কর্মকান্ড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ২০১৯এর ডিসেম্বরে; যখন শেষ তিনজন সদস্যের মাঝে দুইজনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুনরায় নিয়োগের ব্যাপারে ভেটো দেয়। খুব সম্ভবতঃ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মৃত্যুর শুরু এখানেই। আম্পায়ার ছাড়া খেলা চলতেই পারে; কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে যে, আম্পায়ার ছাড়া খেলায় সমস্যা হবেই।


বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উপসংহার?

আসলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনের তোয়াক্কা করেনি কোনদিনই। জেনেভার ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক’এর চক্রবর্তী রাঘাবন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দ্বন্দ্ব নিরসনের বেশিরভাগ রুলিং বাস্তবায়ন না করার বিশেষ রেকর্ড রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এর মাঝে বেশিরভাগই হলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক এবং পাল্টা শুল্ক আরোপের ব্যাপারে রুলিং। অনেক আমদানির ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানিকারকের খরচকে কম হিসেব করে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, আপিল বডির রুলিং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই তারা এগুলির বাস্তবায়ন করেনি।

সংস্থার আপিল বিভাগের কর্মকান্ড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ২০১৯এর ডিসেম্বরে; যখন শেষ তিনজন সদস্যের মাঝে দুইজনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুনরায় নিয়োগের ব্যাপারে ভেটো দেয়। ‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে কথা বলতে গিয়ে লন্ডনের ‘বেরেনবার্গ ব্যাঙ্ক’এর প্রধান অর্থনীতিবিদ হোলগার শ্মাইডিং বলেন যে, খুব সম্ভবতঃ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মৃত্যুর শুরু এখানেই। আম্পায়ার ছাড়া খেলা চলতেই পারে; কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে যে, আম্পায়ার ছাড়া খেলায় সমস্যা হবেই। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’ বলছে যে, সংস্থার রেফারি চলে যাবার সাথে সাথে এর আলোও নিভে যাচ্ছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র সংস্থাকে দুর্বল করতে চাইলেও আরেক পক্ষ চাইছে এটাকে টিকিয়ে রাখতে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সংস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে একটা আলোচনার আয়োজন করে কানাডা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। গত বছরের নভেম্বরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ডেভিড ওয়াকার আপিল বডিকে নিয়ে কিছু প্রস্তাব দেন। তার লক্ষ্য ছিল আপিল বডির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং যুক্তরাষ্ট্র যা যা চেয়েছে, সেগুলি মেনে নেয়া। তার প্রস্তাবগুলির মাঝে ছিল, আপিল বডির সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের মাঝে দেবার ব্যাপারটা নিশ্চিত করা; আপিল বডির সদস্যরা যেন নিজেদের উপর অর্পিত ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কোন ধরনের উপদেশ দিতে না যান; পূর্বের দেয়া আপিল বডির রুলিংকে যেন তারা আইনের উদাহরণ হিসেবে না নেন; আর তারা যেন খেয়াল রাখেন যে সদস্য দেশগুলির উপর তারা যেন সংস্থার ১৯৯৫ সালের আইনের বাইরে নতুন কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ না করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও ওয়াকারের প্রস্তাবের সমর্থন রয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক ‘কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ ওয়াকারের চিন্তাগুলিকেই পুঁজি করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপিল বডিকে টিকিয়ে রাখা; নাহলে তা শুধু আপিল বডিকেই না, পুরো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ব্যবস্থাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। শিকাগোভিত্তিক আইন বিষয়ক কোম্পানি ‘বেকার ম্যাকেঞ্জি’ বলছে যে, ইতোমধ্যেই ইউরোপ এবং কানাডা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপিল বডির বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দ্বিপাক্ষিক দিকটাকে প্রাধান্য দিয়ে কানাডা এবং নরওয়ের সাথে আলোচনায় আপিল বডির মতোই একটা ব্যবস্থা নিজেরা তৈরি করে নিতে চাইছে। ওয়াকারের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তাগুলি সমাধানের চেষ্টা করা হলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ছোটখাটো কোন পরিবর্তন চাইছে না; বরং পুরো সংস্থাটার আমূল পরিবর্তন করতে চাইছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পশ্চিমা চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ মুক্ত বাজারের সাইনবোর্ড। সারা বিশ্বকে একটা মুক্ত বাজারের অধীনে আনার যে লক্ষ্য নিয়ে ‘ডব্লিউটিও’র যাত্রা শুরু, ২৫ বছর পরেও সেই লক্ষ্য অবাস্তব ঠেকছে। জাতিরাষ্ট্রগুলির নিজস্ব স্বার্থকে পেরিয়ে সংস্থার আইনগুলিকে প্রাধান্য দেবার জন্যে কেউই প্রস্তুত নয়; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রও। নিজের স্বার্থের বিপক্ষে গেলেই যুক্তরাষ্ট্র সংস্থার আপিল বডির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর সংস্থার আইনগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা যুক্তির অভাব হয়নি। চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ‘ডব্লিউটিও’ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আর করোনাভাইরাসের মহামারি এবং মহামন্দার মাঝে জাতিরাষ্ট্রগুলিও ক্রমেই আরও রক্ষণশীল হচ্ছে; দূরে চলে যাচ্ছে সংস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য মুক্ত বাজার। শুধু তা-ই নয়, এর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এহেন করুণ অবস্থা পুঁজিবাদী আদর্শের উপর একটা কঠিন আঘাত হিসেবেই এসেছে।

1 comment:

  1. মনে হচ্ছে capitalist economic system খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়বে, covid আর ইকনোমিক ডিপ্রেশন এটা ত্বরান্বিত করবে।

    ReplyDelete