Saturday 10 October 2020

ককেশাসে যুদ্ধ ... শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউই

১০ই অক্টোবর ২০২০
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এই রাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আর তাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘৮২২’, ‘৮৫৩’, ‘৮৭৪’ এবং ‘৮৮৪’ নম্বর রেজোলিউশন অর্থহীনই রয়ে গিয়েছে। দন্তহীন জাতিসংঘের রেজোলিউশনের ব্যাপারে ভীত হবার কোন কারণ কারুর কাছেই ছিল না; বরং সকলেই হিসেব করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিরা কি চায়। গায়ের জোরই যেখানে সমস্যা সমাধানের একমাত্র কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে রাশিয়া ছাড়াও তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে; বেড়েছে লাশের মিছিল। বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থার কদর্য ফুটিয়ে তোলার জন্যে আর কি প্রয়োজন?

৯ই অক্টোবর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, পরদিন দুপুর থেকে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে সীমিতি আকারে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে চলেছে। এতে বলা হয় যে, এই যুদ্ধবিরতি বলবত হবে মূলতঃ মানবিক কারণে, যুদ্ধবন্দী আদানপ্রদান করতে, আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদে নিতে এবং লাশ হস্তান্তর করতে। রুশ বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, যুদ্ধবিরতির শর্তসমূহের উপর আলাদাভাবে আলোচনা এবং সমঝোতা হবে। ২৭শে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে কত হতাহত হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত করে কেউ বলতে না পারলেও উভয় পক্ষই অপর পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দাবি করেছে। কিন্তু এই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি বলবত করতেই প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেলো কেনো, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র হিসেবে দুই দেশের উপর ব্যাপক প্রভাব রাখে রাশিয়া; উভয় দেশের বেশিরভাগ অস্ত্রই সরবরাহ করেছে রাশিয়া। এছাড়াও আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা চুক্তিও রয়েছে, যার শর্ত অনুযায়ী আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলে রুশরা সামরিক সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ১০ দিন আর্মেনিয়ার সাথে চুক্তির ব্যাপারে চুপ থাকার পর ৭ই অক্টোবর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন যে, আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার চুক্তির মাঝে বিতর্কিত নাগোর্নো কারাবাখ নেই, যেখানে আজেরবাইজানের সাথে আর্মেনিয়দের যুদ্ধ চলছে। তিনি সহিংসতার কারণে অনেক মানুষের প্রাণহানিতে শোক প্রকাশ করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন যে, যুদ্ধটা যেহেতু আর্মেনিয়ার ভূখন্ডে হচ্ছে না, তাই এব্যাপারে রাশিয়ার তেমন কিছু করার নেই। ২৮ বছর আগে ১৯৯২ সালে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে ‘অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি এন্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ’ বা ‘ওএসসিই’এর অধীনে ‘মিনস্ক গ্রুপ’ নামে একটা সংস্থা গঠন করা হয়। এই সংস্থার কোচেয়ারম্যান রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় তিন দশকে এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অপরদিকে তুরস্ক বর্তমান যুদ্ধের শুরু থেকেই আজেরবাইজানকে সমর্থন করে আসছে; সামরিক সহায়তাও দিচ্ছে। আর গ্রুপের কোচেয়ারম্যান ফ্রান্স ইতোমধ্যেই আর্মেনিয়ার পক্ষে কথা বলেছে এবং এই বিবাদে তুরস্কের জড়ানোটা পছন্দ করেনি। নাগোর্নো কারাবাখের আজেরিদের নেতা তুরাল গাঞ্জালিয়েভ তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর কোচেয়ার থেকে ফ্রান্সের অপসারণ দাবি করেন। তিনি ফ্রান্সের স্থানে তুরস্ককে কোচেয়ারের পদে দেখতে চান বলে বলেন। গ্রুপের অপর সদস্য যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কথাসর্বস্বই থেকেছে। এমতাবস্থায় এরকম ধ্বংসাত্মক একটা যুদ্ধ থামাবার পিছনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অভাবটাই সামনে আসছে বারংবার।

‘আল জাজিরা’র সাথে এক সাক্ষাতে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ অভিযোগ করেন যে, ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর মধ্যস্ততাকারীরা জাতিসংঘের রেজোলিউশন বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোন চাপ প্রয়োগ করে না। তিনি বলেন যে, আজেরবাইজান এই দ্বন্দ্ব নিরসনে আরও ৩০ বছর অপেক্ষা করতে পারবে না। ১৯৯০এর দশকে আর্মেনিয়রা আজেরবাইজানের ভূখন্ড হিসেবে স্বীকৃত নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চল সামরিকভাবে দখল করে নেয়। সেই যুদ্ধে পশ্চিমা এবং রুশ হিসেবে প্রায় ৩০ হাজার আজেরি মৃত্যুবরণ করে; প্রায় ৬ হাজার আর্মেনিয়ও মারা যায়। সোভিয়েত আমলে ১৯৮৮ সাল থেকে এই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়া নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় দুই দেশের মাঝে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। তবে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলের আগে এই যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের কোন রেজোলিউশন আসেনি। সেই একই বছরে নিরাপত্তা পরিষদের মোট ৪টা রেজোলিউশন আসলেও তা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ১২ই মে যখন রুশ মধ্যস্ততায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তখন নাগোর্নো কারাবাখের পুরোটাই আর্মেনিয়দের দখলে। শুধু তা-ই নয়, এর বাইরেও আজেরবাইজানের ৯ শতাংশ এলাকা আর্মেনিয়রা অধিকার করে নেয়।

আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার অফিশিয়াল সীমানা সোভিয়েত আমলে তৈরি; যা নিয়ে কেউই খুশি হতে পারেনি। জাতিসংঘ সেই সোভিয়েত সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েই ১৯৯২ সালের ২রা মার্চ দুই দেশকে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু গত তিন দশকে জাতিসংঘের এই সদস্যপদ এই দুই দেশের জন্যে দিতে পারেনি শান্তি। এখানে রুশ ইচ্ছাটার বাস্তবায়নকেই মেনে নিয়েছে জাতিসংঘ। একইসাথে ‘মিনস্ক গ্রুপ’এর মতো একটা অন্তসারশূণ্য সংস্থাকেও তাদের মেনে নিতে হয়েছে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে। রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থ থেকে বের হতে না পারার কারণে এই সমস্যার সমাধানও সোনার হরিণ থেকে গিয়েছে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ করলে ইউরোপের সাথে আফগানিস্তানের সামরিক এয়ার করিডোর তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ গুটি হয়ে দাঁড়ায় আজেরবাইজান এবং জর্জিয়া। ২০০৩ সালে গণভ্যুত্থানের মাধ্যমে জর্জিয়া রুশ প্রভাব থেকে দূরে সরে যায়। আজেরবাইজানের বাকুর তেলখনিগুলি থেকে উত্তোলিত তেল ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে রাশিয়া এবং আর্মেনিয়াকে বাইপাস করে ২০০৬ সালে জর্জিয়ার মাঝ দিয়ে পাইপলাইন চালু করা হয়। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে বসলে এই পাইপলাইনের ভবিষ্যৎ হুমকির মাঝে পড়ে যায়। ফলস্বরূপ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আজেরবাইজান তুরস্কের সাথে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ককেশাসে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারকে রাশিয়া সন্দেহের চোখেই দেখেছে। তবে এর ফলশ্রুতিতে অত্র অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ককেশাসে প্রভাব বিস্তার করার জন্যে অনেক দেশই এগিয়ে এসেছে; কিন্তু সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেই প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এই রাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আর তাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘৮২২’, ‘৮৫৩’, ‘৮৭৪’ এবং ‘৮৮৪’ নম্বর রেজোলিউশন অর্থহীনই রয়ে গিয়েছে। থেকে থেকে সংঘাতে জড়িয়েছে দুই দেশ; শক্তিশালী দেশগুলি তাতে দিয়েছে তাদের ইন্ধন। দন্তহীন জাতিসংঘের রেজোলিউশনের ব্যাপারে ভীত হবার কোন কারণ কারুর কাছেই ছিল না; বরং সকলেই হিসেব করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিরা কি চায়। গায়ের জোরই যেখানে সমস্যা সমাধানের একমাত্র কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে রাশিয়া ছাড়াও তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে; বেড়েছে লাশের মিছিল। বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থার কদর্য ফুটিয়ে তোলার জন্যে আর কি প্রয়োজন?

No comments:

Post a Comment