Saturday 24 October 2020

ফ্রান্সে ইসলাম ... কে কার বাস্তবতা?

২৫শে অক্টোবর ২০২০
ফ্রান্স এখন দ্বিধাবিভক্ত; মুসলিমরা কি ফ্রান্সের সেকুলার বাস্তবতার শিকার? নাকি ফরাসিরা ইসলামিক বাস্তবতার শিকার? তারা কি ইসলামোফোবিয়া কাটাতে ইসলামকে পরিবর্তন করতে উদ্যত হবে? নাকি সেকুলার আইনের চাপে সহিংসতাকে আরও বৃদ্ধি করবে? যেদিকেই তারা পা বাড়াক না কেন, ফরাসি রিপাবলিক যে আরও দুর্বল হচ্ছে, তা এখন নিশ্চিত। 


ফ্রান্সে এক শিক্ষককে হত্যার পর ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ তথাকথিত ‘উগ্রবাদী ইসলাম’এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন বলে ঘোষণা দেন। অভিযানের শুরুতেই এক মসজিদের ইমামের তথাকথিত ‘উগ্রবাদী’ চিন্তা ধারণ করার জন্যে মসজিদটাকেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়; এবং আরও কঠোর পদক্ষেপ আসছে বলে বলা হয়। কিছুদিন আগেই প্যারিস থেকে ৩০ কিঃমিঃ দূরে এক শহরে ৪৭ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ফরাসী কারিকুলাম অনুযায়ী বাকস্বাধীনতা বিষয়ে পড়াতে গিয়ে ২০১৫ সালে ‘শার্লি ইব্দো’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত রাসূল (সাঃ)এর ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেন। এরপর এক মুসলিম ছাত্রীর বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রদের সামনে অশ্লীল ছবি প্রদর্শনের অভিযোগ করেন। অনলাইন ভিডিওতে প্যাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা ছাড়াও তিনি প্যাটির পদচ্যুতি দাবি করেন। এরপর গত ১৬ই অক্টোবর ১৮ বছর বয়সী চেচেন বংশোদ্ভূত উদ্বাস্তু আব্দুল্লাখ আবুইয়েদোভিচ আনজোরভ প্যাটিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে। আনজোরভ এক অডিও বার্তায় বলে যে, সে রাসূল (সঃ)এর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে। এরপর পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে এক ছাত্র বলেন যে, প্যাটি প্রতিবছরই বাকস্বাধীনতা পড়াতে গিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ)এর ব্যাঙ্গচিত্র ছাত্রদের দেখাতেন। এই হত্যাকান্ডের দু’দিন পর আইফেল টাওয়ারের কাছে দু’জন মহিলা হিজাব পরিহিত দু’জন মুসলিম মহিলাকে ছুরিকাঘাত করে। আক্রমণের সময় তারা মুসলিম মহিলাদেরকে ‘নোংড়া আরব’ বলে গালি দেয়। এই ঘটনাগুলি ফরাসী সমাজে ইসলামোফোবিয়াকেই শুধু সামনে টেনে আনছে না, ফ্রান্সের সেকুলার সংস্কৃতির ভিতের মাঝে পরস্পরবিরোধী চিন্তাগুলিকেও আলোচনায় নিয়ে আসছে।

ফরাসীরা প্যাটির হত্যাকান্ডকে ফরাসী রিপাবলিকের উপর হামলা হিসেবে দেখছে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেছেন যে, প্যাটি হলো ফরাসি রিপাবলিকের প্রতিচ্ছবি। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে জাতীয় সঙ্গীতের পরপরই এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় প্যাটির জন্যে। পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ফেরান্ড বলেন যে, প্যাটির হত্যাকান্ডে ফ্রান্স ঐক্যবদ্ধ; কারণ প্যাটির পিছনেই রয়েছে ‘হিউম্যানিস্ট’ ফরাসি রিপাবলিক। ফরাসী স্বরাষ্ট্র দপ্তর বলছে যে, বন্ধ করে দেয়া মসজিদ থেকে প্যাটিকে ভীতি প্রদর্শন করার জন্যে আহ্বান করা হয়েছিল। তারা দাবি করছেন যে, মসজিদ থেকেই প্যাটির হত্যার ‘ফতওয়া’ আসে। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন আরও একধাপ এগিয়ে টেলিভিশনে এসে বলেন যে, ফ্রান্সের সুপারমার্কেটে বিভিন্ন জাতির জন্যে আলাদা খাবার পাওয়া যায়; এর ফলে ফ্রান্সের ঐক্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং বিচ্ছিন্নতা দানা বাঁধছে।

‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ফরাসি মানবাধিকারকর্মী ইয়াসির লুয়াতি বলেন যে, ফ্রান্সে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে সর্বত্র ক্যামেরা বসানো হয়েছে, অনেকগুলি আইন পাস হয়েছে এবং ইন্টারনেটে গোয়ান্দাগিরি করা হচ্ছে; কিন্তু তারপরেও এরূপ ঘটনা ঘটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতারই প্রকাশ। নির্বাচনের ১৮ মাস আগে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ মহামারি এবং অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে ঢাকতে এক ব্যাক্তির কর্মকান্ডকে ব্যবহার করে পুরো মুসলিম সমাজকে টার্গেট করছেন। ম্যাক্রঁ বলছেন যে, ফ্রান্স ঐক্যবদ্ধ; কিন্তু সেই ঐক্যের মাঝে মুসলিমরা নেই। একইসাথে তিনি ডানপন্থীদের মাঝেও তার সমর্থন বৃদ্ধি করতে চাইছেন। ইসলামোফোবিয়া কমাতে কাজ করা মুসলিম এনজিওগুলিকেও টার্গেট করা হচ্ছে। তবে ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবিরা ফ্রান্সে ইসলামোফোবিয়া রয়েছে, সেটা স্বীকার করতে নারাজ। ‘দ্যা গ্লোবাল পলিসি রিসার্চ’এর সিনিয়র ফেলো জাক রোঁলা বলছেন যে, ফ্রান্স নিজেকে সেকুলার ধারণার ঝান্ডাবাহী মনে করে; যেখানে মানুষের আইনকে স্রষ্টার আইন থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। আর ফরাসীরা এই চিন্তাকে রক্ষা করতে সবকিছু করবে। তিনি বলেন যে, ‘উগ্রবাদী ইসলাম’এর বিরুদ্ধে যথেষ্ট শক্ত ভূমিকা না নেয়ার সমালোচনা রয়েছে ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধে। ফ্রান্সের সমস্যা ইসলামোফোবিয়া নয়, বরং ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তাটাই আসল সমস্যা। ফরাসি পত্রিকা ‘লে ফিগারো’র প্রবীণ সাংবাদিক রনোঁ জিরাঁদ আরও কঠোর ধারণা পোষণ করেন। তিনি বলেন যে, মুসলিমরা ফ্রান্সে এসে বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সুবিধা পাবার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে বরং ফরাসি সেকুলার স্কুল, যা তাদের সমাজের একটা স্তম্ভ, সেটাকে আক্রমণ করেছে। তিনি বলেন যে, ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে মুসলিমরা রয়েছে; অনেক মসজিদও রয়েছে ফ্রান্সে। তবে ফ্রান্সের সেকুলার চিন্তা বলছে যে, ধর্ম এবং রাজনীতি থাকবে আলাদা। নিজের বাড়িতে ধর্মকর্ম করায় কোন বাধা থাকবে না; তবে প্রকাশ্যে ধর্মের কোন ভূমিকাই থাকবে না। যারা ফ্রান্সের এই চিন্তাধারাকে ভালোবাসতে পারে না, তাদের ফ্রান্স ছেড়ে চলে যাওয়া উচিৎ।

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৯০৫ সালে ফ্রান্সে যে সেকুলার আইন তৈরি হয়েছিল, তা ছিল মূলতঃ ক্যাথোলিক চার্চের প্রভাবকে কমাবার জন্যে। সেসময় ফ্রান্সের বেশিরভাগ জনগণই ছিল ক্যাথোলিক। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স তার উপনিবেশগুলিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে বহু মুসলিম ফ্রান্সে এসে হাজির হয়; এভাবেই ফ্রান্সে ইসলামের আবির্ভাব হয়। বর্তমানে ফ্রান্সে মুসলিম জনসংখ্যা একেবারে কম নয়; যা ফ্রান্সের বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সের লজ্জাজনক বিদায়ের পর ফরাসিদের কাছে ইসলামের একবিন্দু উপস্থিতিও অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ফ্রান্সে ক্যাথোলিক অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে এখনও রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে, তথাপি ইসলামের যেকোন দৃশ্যমান ব্যাপারকে ফরাসিরা তাদের সেকুলার চিন্তার বিরোধী হিসেবে দেখতে থাকে। যেমন হিজাব বর্তমানে ফ্রান্সে সবচাইতে আলোচ্য বিষয়গুলির একটা।

ফ্রান্স তার সেকুলার আদর্শের মাঝেই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। বাকস্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সেকুলার চিন্তার ভিত্তি হিসেবে ধরলেও ধর্মীয় আবেগকে আঘাত করেই তারা বাকস্বাধীনতাকে উপরে স্থান দিয়েছে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথোলিকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের অনুভূতি তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি; উল্টা মুসলিমদের ধর্মকর্ম পালনকে ফরাসীরা দেখেছে ফ্রান্সের সেকুলার ব্যবস্থার প্রতি হুমকি হিসেবে। ফ্রান্স এখন দ্বিধাবিভক্ত; মুসলিমরা কি ফ্রান্সের সেকুলার বাস্তবতার শিকার? নাকি ফরাসিরা ইসলামিক বাস্তবতার শিকার? তারা কি ইসলামোফোবিয়া কাটাতে ইসলামকে পরিবর্তন করতে উদ্যত হবে? নাকি সেকুলার আইনের চাপে সহিংসতাকে আরও বৃদ্ধি করবে? যেদিকেই তারা পা বাড়াক না কেন, ফরাসি রিপাবলিক যে আরও দুর্বল হচ্ছে, তা এখন নিশ্চিত। 

No comments:

Post a Comment