Saturday 3 October 2020

বৃদ্ধি পেলো আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার সংঘাতের আঞ্চলিক পরিধি

৩রা সেপ্টেম্বর ২০২০ 

আর্মেনিয়া তাদের সমর্থনে রাশিয়া এবং ফ্রান্সকে পেলেও ইরান সরাসরি পক্ষ নেয়নি। অপদিকে তুরস্ক প্রথম থেকেই আজেরবাইজানের পক্ষ নিয়েছে। উভয় পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও তাদের সমর্থক রাষ্ট্রগুলি যখন সরাসরি জড়াতে নারাজ, তখন দুই দেশের যুদ্ধ চালিয়ে নেবার সক্ষমতার উপরেই নির্ভর করছে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। ককেশাসে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আগে থেকে থাকলেও এখন তুরস্ক এবং ইরানের পরস্পরবিরোধী অবস্থান এই খেলায় নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।

আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে যখন আবারও যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তখন ককেশাসের এই ছোট্ট দুই দেশের আশেপাশের শক্তিশালী দেশগুলির ভূমিকা সামনে আসছে। ২৯শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়া দাবি করে যে, তাদের বিমান বাহিনীর একটা ‘সুখোই ২৫’ যুদ্ধবিমান তুর্কি বিমান বাহিনী ভূপাতিত করেছে। রাশিয়ার ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ‘সিএসটিও’ চুক্তি মোতাবেক আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলে রাশিয়ার সামরিক সহায়তা দেবার অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু এই দাবি নিয়ে রাশিয়া যেমন খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি, তেমনি তুরস্ক প্রায় সাথেসাথেই এই ঘটনা আস্বীকার করার কারণে রাশিয়া এবং তুরস্কের সরাসরি যুদ্ধে জড়াবার ইচ্ছা তেমন নেই বলেই প্রকাশ পায়। অপরদিকে এই দুই দেশ ছাড়াও আলোচনায় এসেছে ইরান। ইরানের সাথে আর্মেনিয়ার সীমান্ত বাণিজ্য হয় শুধুমাত্র ইরানের নরদুজ সীমান্ত শহরের মাঝ দিয়ে। সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা যায় যে, লরির উপরে করে সামরিক গাড়ি নরদুজ সীমান্ত অতিক্রম করছে। এই অঞ্চলটা মূলত আজেরি অধ্যুষিত, যারা আর্মেনিয়ার সাথে দ্বন্দ্বে আজেরবাইজানের পক্ষ নিচ্ছে। বড় শহর তাবরিজে আজেরিরা বিক্ষোভ করে এবং আর্মেনিয়া যাবার রাস্তা আটকাবার চেষ্টা করে। ইরানি পুলিশ লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহারে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে। একইসাথে ইরান আর্মেনিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের ঘটনাকে অসত্য বলে দাবি করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর থেকেই আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের সম্পর্কের মাঝে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ‘ইউএনপিও’এর হিসেবে ইরানের ৮ কোটি ১৮ লক্ষ জনসংখ্যার মাঝে প্রায় ৩ কোটিই তুর্কি আজেরি, যাদের অনেকেই ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের পূর্ব ও পশ্চিম আজেরবাইজান এবং আরদাবিল প্রদেশে বাস করে। আজেরিরা প্রায় সকলেই শিয়া সম্প্রদায়ের হলেও জাতিগতভাবে তুর্কি হওয়ায় তুরস্কের সাথে তাদের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। তুরস্ক আজেরবাইজানের সাথে সম্পর্ককে ‘এক জাতি দুই রাষ্ট্র’ বলে আখ্যা দেয়। জন্মের সময়েই আজেরবাইজানের নাম ইরানের আজেরি সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রদেশের নামানুসারে রাখার কারণে তা ইরানের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকি তৈরি করেছিল। অন্যদিকে ভৌগোলিক কারণেই আর্মেনিয়া ইরানের উপর নির্ভরশীল। পুরোপুরি স্থলবেষ্টিত আর্মেনিয়ার সীমানা রয়েছে আজেরবাইজান, জর্জিয়া, তুরস্ক এবং ইরানের সাথে। তবে শুধুমাত্র জর্জিয়া এবং ইরানের মাঝ দিয়েই আর্মেনিয়ার বেশিরভাগ বাণিজ্য সম্পাদিত হয়।

আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের সাথে ইরানের সীমানার অনেকখানি নির্ধারণ করছে আরাস নদী। পূর্বে আজেরবাইজানের বাহরামতেপে থেকে পশ্চিমে আজেরবাইজানের সাথে তুরস্ক এবং ইরানের সীমানা পর্যন্ত এই নদী চলে গিয়েছে। এই নদীর উপর ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মতিতে আজেরবাইজানের নাখচিভান শহরের দক্ষিণে ইরান একটা বাঁধ নির্মাণ করে। আবার ২০১০এর পর থেকে আজেরবাইজানের জাবরাইল জেলার সাথে ইরানের সীমান্তে আরাস নদীর উপর খুদা আফেরিনে আরেকটা বাঁধ নির্মাণের কাজে হাত দেয় ইরান। জাবরাইল জেলা বর্তমানে আর্মেনিয়দের দখলে থাকা নাগোর্নো কারাবাখের অংশ। আজেরবাইজানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভের বাবা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হায়দার আলিয়েভ এই বাঁধের বিপক্ষে ছিলেন। তার নীতি ছিল যে, আর্মেনিয়া যতদিন নাগোর্নো কারাবাখ ছেড়ে না যাবে, ততদিন আজেরবাইজান এই বাঁধ নির্মাণের অনুমতি দেবে না। তবুও ইরান এই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ২০১৬ সালে আঞ্চলিক চাপের মুখে ইরানকে বাঁধ নির্মাণ চালু রাখার জন্যে লিখিত অনুমতি দেয় আজেরবাইজান। চুক্তি মোতাবেক বাঁধের উত্তরে নাগোর্নো কারাবাখ আজেরবাইজানের অধীন হবার আগ পর্যন্ত এর উত্তর পাড়ে নাগোর্নো কারাবাখের ভেতর ১০ কিঃমিঃ পর্যন্ত এলাকার নিরাপত্তা ইরান নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। চুক্তির মাঝে আরাস নদীর উপর দিয়ে তৈরি সেতুর কথাও বলা হয়, যা কিনা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে আরও জটিল করছে বলে বলছে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’। খুদা আফেরিন এবং খোমারলুতে এই সেতুগুলি ব্যবহার করে নাগোর্নো কারাবাখ ইরান থেকে সামরিক সরঞ্জাম আনার ব্যবস্থা করলে সেটাও অবাস্তব হবে না।

তিন মাস আগে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে আরেক দফা সংঘাতের পর আজেরি মিডিয়া ফ্লাইট তথ্য দিয়ে বলে যে, রুশ সামরিক বাহিনীর ‘ইলুইশিন ৭৬’ পরিবহণ বিমান ২৫শে অগাস্ট থেকে শুরু করে প্রতিদিন রাশিয়া থেকে জর্জিয়া এবং আজেরবাইজানের আকাশসীমা বাইপাস করে কাস্পিয়ান সাগর এবং ইরানের আকাশসীমা ঘুরে আর্মেনিয়া যাচ্ছে। তারা বলে যে, এই বিমানে নিঃসন্দেহে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এর জবাবে বলেন যে, বিমানগুলি আর্মেনিয়ার গাইউমরিতে রুশ সামরিক ঘাঁটিতে কন্সট্রাকশন দ্রব্যাদি সরবরাহ করছিল। যদিও স্থলবেষ্টিত আর্মেনিয়ার ৭০ শতাংশ বাণিজ্য হয় জর্জিয়া হয়ে, তারপরেও রুশ সামরিক বিমানের ইরান হয়ে আর্মেনিয়া পৌঁছানোটা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক জটিলতাকে দেখিয়ে দেয়।

তুরস্কের সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে তুর্কি ইউরেশিয়া বিশ্লেষক এসরেফ ইয়ালিনকিলিচলি বলেন যে, আজেরবাইজান এবং ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদের নিয়ে একটা ‘গ্রেটার আজেরবাইজান’ তৈরি করার চিন্তা বহুদিন ধরেই ইরানের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে রয়েছে। ইরান এই চিন্তাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই আর্মেনিয়াকে সমর্থন দিয়ে আসছে। ইরানের আর্মেনিয়া নীতি অনেকক্ষেত্রেই আবার আজেরবাইজান এবং তুরস্ককে ব্যালান্স করার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। অরপদিকে বিশ্বায়নের কারণে ইরানের অভ্যন্তরের তুর্কি আজেরিরা আজেরবাইজান, তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের তুর্কিদের সাথে নিজেদের স্বার্থকে এক করে দেখতে শুরু করেছে।

ছয়দিন যুদ্ধ চলার পর ‘বিবিসি’ বলছে যে, আর্মেনিয়া ‘ওএসসিই মিনস্ক’এর মধ্যস্ততায় আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। অথচ এর দু’দিন আগেই আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকল পেশিনিয়ান বলেছিলেন যে, প্রচন্ড যুদ্ধ চলাকালীন আলোচনার কথা বলাটা একেবারেই ঠিক নয়। অন্যদিকে আজেরবাইজান এখনও বলছে যে, আর্মেনিয়রা তাদের দখলে থাকা এলাকা ছেড়ে না দিলে তারা আলোচনায় বসবে না। আর্মেনিয়া তাদের সমর্থনে রাশিয়া এবং ফ্রান্সকে পেলেও ইরান সরাসরি পক্ষ নেয়নি। অপদিকে তুরস্ক প্রথম থেকেই আজেরবাইজানের পক্ষ নিয়েছে। উভয় পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও তাদের সমর্থক রাষ্ট্রগুলি যখন সরাসরি জড়াতে নারাজ, তখন দুই দেশের যুদ্ধ চালিয়ে নেবার সক্ষমতার উপরেই নির্ভর করছে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। ককেশাসে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আগে থেকে থাকলেও এখন তুরস্ক এবং ইরানের পরস্পরবিরোধী অবস্থান এই খেলায় নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।

8 comments:

  1. মুসলিম বিশ্ব সংঘাতকে কেমন দৃষ্টিতে দেখছে

    ReplyDelete
    Replies
    1. জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিতে। নিজের লেখাগুলি পড়লে পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা।

      https://koushol.blogspot.com/2020/08/israel-uae-normalisation-importance.html

      https://koushol.blogspot.com/2020/08/kashmir-to-uighur-muslims-victims-of-nationalism.html

      https://koushol.blogspot.com/2020/09/saudi-pak-dispute-muslim-leaders-division.html

      Delete
  2. যদিও আমি তাই দেখছিলাম। কিন্তু ইরানের ভূমিকা তাকে কি রকম সমস্যায় ফেলবে আর্দশিক দিক থেকে

    ReplyDelete
    Replies
    1. যেহেতু ইরান একটা জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তাই এখানে আদর্শিক কোন দিক আলোচনার ব্যাপার নেই। বর্তমানে আদর্শিক রাষ্ট্র শুধু মাত্র পশ্চিমে পাওয়া যাবে - যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আরও কিছু দেশ, যারা পুঁজিবাদকে আদর্শ হিসেবে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়েছে এবং রক্ষা করে যাচ্ছে।

      Delete
  3. কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমের কথা অনুযায়ী যা বুঝলাম যে এই দ্বন্দ্বেে ইসরাইল তুরস্ক বনাম ফান্স রাশিয়া ও ইরান তাহলে বিট্রেন আমেরিকা কার পক্ষে

    ReplyDelete
    Replies
    1. আজেরবাইজান একটা আমেরিকান প্রজেক্ট। আফগান যুদ্ধের সময় আমেরিকা আজেরবাইজান এবং জর্জিয়াকে ডেভেলপ করে মধ্য এশিয়ার করিডোর হিসেবে। সেই হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে আজেরবাইজানের পাশে দেখতে চেয়েছে। তবে এখন কিছু ব্যাপার পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে থাকুক, আর না থাকুক, তুরস্ক আজেরবাইজান হয়ে মধ্য এশিয়ায় পাড়ি জমাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না যে, তুরস্ক এই নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে ছাপিয়ে যাক। যতক্ষন তা রাশিয়াকে ব্যালান্স করার জন্যে ব্যবহৃত হবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের পক্ষেই থাকবে। তবে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ বেগ পেতে হবে; বিশেষ করে এই মুহুর্তে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিম্নগামী।

      অপরপক্ষে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের নেটওয়ার্কটাই অনেক ক্ষেত্রে নিতে চাইবে; যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে আসতে চাইছে। আর যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থাকতে চাইছে, সেখানে ব্রিটেন ভিন্ন পথ নেবে। ব্রিটেনের কর্মকান্ডগুলি অনেক বেশি চতুর; সরাসরি চোখে পড়বে না। অন্যরা তাদের হয়ে কাজ করে দেবে; ফল খাবে সে।

      Delete
  4. Turkey এ-র Blue Homeland Policy নিয়ে বিস্তারিত লেখা পড়চে ইচ্ছুক৷ যদি লেখেন তবে খুব ভালো হয়।
    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Please read this writing....

      https://koushol.blogspot.com/2019/05/blue-homeland-naval-exercise-turkey-geopolitics.html

      Delete