২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২০
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশ্ব যখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তখন সৌদি আরবের, বিশেষ করে সৌদি নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো দেশটা যে খনিজ তেল বিক্রির উপর নিজেদের অর্থনীতিকে তৈরি করেছে, সেই তেলের বাজারই মহামারির মাঝে ধ্বসে পড়েছে। এর উপর দেশের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক অসন্তোষ সৌদি নেতৃত্বের ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর আঞ্চলিকভাবেও বিভিন্ন ইস্যুতে চাপের মাঝে রয়েছে সৌদিরা, যার মাঝে ইস্রাইলের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের অতি সংবেদনশীল ব্যাপারটাও রয়েছে। সৌদি আরবে প্রাক্তন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম প্যাটি ‘বিবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, সৌদি আরবের নিজস্ব কিছু শক্তিশালী স্তম্ভ রয়েছে, যার উপরে দেশটা টিকে রয়েছে। এর মাঝে একটা হলো তার তেল বিক্রির উপর তৈরি করা রাষ্ট্রীয় ফান্ড, যা কেউ কেউ ধারণা করেন ৩’শ ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে। আর সৌদি তেল কোম্পানি ‘আরামকো’ দেশটার আয়ের স্তম্ভ, যার মূল্যায়ন করা হয়েছে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৭’শ বিলিয়ন ডলারে। এর মাঝে দেড় শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে তারা ২৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তবে উইলিয়াম প্যাটির কথাগুলি সৌদি নেতৃত্বের সমস্যাগুলির সমাধান দেয় না।
সৌদি আরবের অর্থনীতি এখনও তেলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। অর্থনীতিকে তেল থেকে সরাতে যে পরিকল্পনাগুলি সৌদি সরকার করেছে, তা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে করোনাভাইরাস এবং এর ফলশ্রুতিতে তেলের বাজারে মূল্য ধ্বসের কারণে। খরচ কমাবার মাধ্যমে সৌদি সরকার ২৬ বিলিয়ন ডলার বাঁচাতে চাইলেও শুধু মার্চ মাসেই এই পরিমাণ অর্থ তারা হারিয়েছে। সৌদি অর্থমন্ত্রী নিজেই খরচ কমাবার প্রচেষ্টাগুলিকে দেশের মানুষের জন্যে কষ্টকর হবে বলে মন্তব্য করেন। মূল্য সংযোজন কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকারি খরচ কমানো হয়েছে ২২ শতাংশ। সৌদি তেল কোম্পানি ‘আরামকো’র তেল বিক্রির আয় জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝে ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। একই সময়ে সৌদি সরকারের বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাস এবং তেলের মূল্যধ্বস ২০১৬ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘোষিত ২০৩০ প্রকল্পকে ডুবিয়ে দেবার অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সৌদিরা যেসব প্রকল্প নিয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে পঞ্চম জেনারেশনের টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তির উপর নির্ভর ‘নিওম’ নামের হাইটেক শহর, যেখানে ৫’শ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে সৌদিদের। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর এসোসিয়েট ফেলো মাইকেল স্টিফেন্স বলছেন যে, সৌদি আরবের অর্থনীতি এমন এক সমস্যায় পতিত হয়েছে, যা থেকে উঠে দাঁড়াতে যথেষ্ট সময় লাগবে। কঠিন নীতি নেবার কারণে সৌদি আরবের কর্মসংস্থান তৈরিকারীরা সমস্যায় পড়ছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে আরও সমস্যা তৈরি করবে।
তবে কেউ কেউ মনে করছেন যে, সৌদি সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলি রয়েছে, তা তারা উতড়াতে পারবে। বৈরুতের ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি’র দানিয়া কোলাইতাত খতিব সৌদি আরবের ‘আরব নিউজ’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, সামনের দিনগুলিতে প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাঝেই সৌদিদের ভবিষ্যৎ রয়েছে। তবে এই মিশন বেশ শক্ত। কারণ চীনের মতো দেশ যেখানে তিন জেনারেশনে তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে, সৌদিদের সেটা করতে হবে এক জেনারেশনের মাঝেই। এই মুহুর্তে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে জার্মানি বা জাপানের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো মানবসম্পদ সৌদিদের নেই। প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের সৌদি আরবের জনসংখ্যা আরব দেশগুলির মাঝে অপেক্ষাকৃত বেশি হলেও সরকার তাদের খরচের ভার নেবার কারণে তারা রাষ্ট্রের জন্যে একটা বোঝা। ‘নিওম’ হাইটেক শহরে বিদেশীদেরই চাকুরি হবে বেশি। তবে সৌদি আরবের তরুণ জনসংখ্যাকে এক জেনারেশনের মাধ্যমে পরিবর্তন করে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, এক জেনারেশন পরেই ‘এপল’এর মতো হাইটেক কোম্পানিগুলি সৌদি আরবকে উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে মনে করবে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জের মাঝে রয়েছে সৌদি নেতৃত্ব। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ৩৪ বছর বয়সী বিন সালমান ধীরে ধীরে তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সকলকেই ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছেন; যা কিনা তাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতার অবস্থানে বসিয়েছে। তথাপি তার ক্ষমতা খুব সহজেই হুমকির মাঝে পড়ে যেতে পারে। বিন সালমান তার দেশের জন্যে যেসকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা যদি আগামী পাঁচ বছরের মাঝে দেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতিতে তেমন একটা পরিবর্তন না আনতে পারে, তাহলে সৌদিদের শক্তিশালী নেতৃত্ব রাতারাতিই নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়ে যাবে। সৌদি সরকার ইয়েমেনের যুদ্ধ এবং সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার কারণে পশ্চিমা দেশগুলিতে বেশ ধিকৃত হয়েছে। সৌদি আরবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো নেই বললেই চলে; নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলাও একেবারেই সম্ভব নয়। কিন্তু ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সরবরাহকৃত যুদ্ধাস্ত্রই ব্যবহার করেছে মানবতাবিরোধী অপরাধের পিছনে। সৌদি আরব বৈশ্বিক তেলের বাজারে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী যে, তাকে হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দেয়া একেবারেই সম্ভব নয়। ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মস্কোতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিন সালমানের বড় সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হলেও করোনাভাইরাসের মহামারির শুরুতে তেলের বাজারে ব্যাপক সরবরাহের মাধ্যমে বিন সালমান উভয় দেশের তেল কোম্পানিগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন; যা কিনা ওয়াশিংটন এবং মস্কো কেউই ভালো চোখে দেখেনি। পছন্দ হোক আর না হোক, সৌদি আরব পশ্চিমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুই থাকছে।
করোনাভাইরাসের মহামারি এবং তেলের বাজারে ধ্বসের কারণে বিন সালমানের ২০৩০ পরিকল্পনা আকাশ কুসুমই মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। দীর্ঘমেয়াদে কেউ কেউ স্বপ্ন দেখলেও তা বর্তমানের কঠিন বাস্তবতাকে ভুলিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতির তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাবার পরিকল্পনা কাগজে কলমে ভালো ঠেকলেও বাস্তবায়ন কঠিন। আরব দেশগুলির ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে এগুবার ফলে জনগণের কাছে সৌদি নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে ঠেকবে। আর এমতাবস্থায় সৌদিরা পশ্চিমাদের সমর্থনের উপরই নির্ভর করতে বাধ্য হবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামন্দার বাস্তবতার মাঝে কোনকিছুই এখন প্রশ্নাতীত নয়।
No comments:
Post a Comment