Saturday, 28 December 2024

চীনের আকাশে নতুন যুদ্ধবিমান – চীন-মার্কিন সংঘাত ঘনিয়ে আসছে

২৮শে ডিসেম্বর ২০২৪

চীন যত সময় পাবে, ততই সে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক শক্তির ব্যবধান কমিয়ে ফেলতে থাকবে; হয়তো একসময় চীনই এগিয়ে যাবে। আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন হাজির হয়েছে - অনিবার্য সংঘাতের আগে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কতটা সময় দেবে?


গত ২৬শে ডিসেম্বর চীনের আকাশে চীনাদের তৈরি দু'টা নতুন ডিজাইনের যুদ্ধবিমানের ওড়ার দৃশ্য সোশাল মিডিয়ায় আসার পর বিশ্বব্যাপী আলোড়ন পড়ে গেছে। চীনা প্রতিরক্ষা দপ্তর এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর কেউই এখনও এব্যাপারে কোন মন্তব্য করেনি। এই বিমানগুলির এখনও কোন অফিশিয়াল নাম জামা যায়নি। একই দিনে চীনা সরকারি মিডিয়া 'শিনহুয়া' জানাচ্ছে যে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুংএর জন্মদিনে চীনারা তাদের নৌবাহিনীর সর্বশেষ উভচর এসল্ট শিপ পানিতে ভাসিয়েছে। ‘রয়টার্স'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দু'টা বিমানের একটা বেশ বড়; যার আকৃতি অনেকটাই হীরার মতো। এটার তিনটা ইঞ্জিন ইনলেট রয়েছে; যার দু'টা রয়েছে বিমানের গা ঘেঁষে; আর বাকিটা রয়েছে উপরের দিকে। এধরণের তিন ইঞ্জিনের বিমান সচরাচর দেখা যায় না। দ্বিতীয় বিমানটা বেশ ছোট আকৃতির। 'এভিয়েশন উইক'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনা 'চেংডু' কোম্পানি থেকে ওড়া প্রথম বিমানটার সাথে একটা 'জে-২০এস' ফাইটার বিমানও উড়ছিলো। দ্বিতীয় বিমানটা উড়েছিলো 'শেনইয়াং' কোম্পানি থেকে। দু'টা বিমানই ছিল লেজবিহীন; যার অর্থ হলো, এগুলিকে কম্পিউটারের মাধ্যমে আকাশে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উভয় বিমানেই কোন ৯০ ড্রিগ্রি কোণ নেই; যা বলে দিচ্ছে যে, এগুলিকে রাডার এড়ানো মাথায় রেখেই ডিজাইন করা হয়েছে। এর আগে মার্কিনীদের তৈরি 'বি-২' এবং 'বি-২১' বোমারু বিমানও 'ফ্লাইং উইং' ডিজাইনের বা লেজবিহীন। এছাড়াও বিভিন্ন মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমানও লেজবিহীন; যেমন মার্কিন 'আরকিউ-১৭০' এবং চীনা 'সিএইচ-৭'। 'দ্যা ওয়ার জোন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, লেজবিহীন হবার অর্থ হলো রাডার এড়িয়ে চলার ক্ষেত্রে এই বিমানগুলি একধাপ এগিয়ে। কারণ এর মাধ্যমে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ব্যান্ডের রাডার সিগনাল এড়ানো সম্ভব হবে। তবে লেজ না থাকার কারণে সেই বিমানে যত শক্তিশালী কম্পিউটার সিস্টেমই থাকুক না কেন, সেটার ম্যানিউভার করার সক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম হবে। তথাপি দূরবর্তী মিশনে লম্বা সময় সুপারসনিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে এর সুবিধা রয়েছে।

'রয়টার্স'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিনীরা তাদের 'নেক্সট জেনারেশন এয়ার ডমিন্যান্স' বা 'এনজিএডি' নামের বিমান প্রকল্প কেমন হবে, সেব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন প্রশাসনের সময় সিদ্ধান্ত নেবে। ব্রিটিশ এবং জাপানিরা একত্রে পরবর্তী জেনারেশনের বিমান নিয়ে একটা প্রকল্পে একত্রে কাজ করছে। 'অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউট'এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ইউয়ান গ্রাহামের মতে, এই বিমানগুলি দেখিয়ে দেয় যে, চীনা বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলির নতুন কিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মনমানসিকতা রয়েছে। ডিজাইনগুলির ভালো খারাপ যা-ই থাকুক না কেন, এটা বলার অবকাশ নেই যে, ডিজাইনগুলির যথেষ্ট স্বকীয়তা রয়েছে। অনেকেই ধরেই নেয় যে, নতুন কোন কিছু মানেই সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু দেশগুলির কাছ থেকেই আসতে হবে। কিন্তু এখন চীনাদের মাঝে কোন হীনমন্যতা থাকলে তারা সেটা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রকাশিত 'চায়না মিলিটারি পাওয়ার' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চীনারা 'এইচ-২০' স্টেলথ বোমারু বিমান এবং মধ্যম পাল্লার ফাইটার-বোম্বার ডেভেলপ করছে। অপরদিকে চীনা বিমান নির্মাতা কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছেন যে, তারা ষষ্ঠ জেনারেশনের যুদ্ধবিমানের উপর গবেষণা চালাচ্ছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন বিমান বাহিনীর তৎকালীন 'এয়ার কম্ব্যাট কমান্ড'এর প্রধান জেনারেল মার্ক কেলি মন্তব্য করেছিলেন যে, চীনারাও মার্কিনীদের মতো ষষ্ঠ জেনারেশনের যুদ্ধবিমান নিয়ে কাজ করছে; যা হবে মূলতঃ 'সিস্টেম অব সিস্টেমস'। এর মাধ্যমে বিমানের রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে; কম্পিউটারের সক্ষমতাও বহুগুণে বাড়বে; সেন্সরগুলির সক্ষমতাও অনেক বেড়ে যাবে। একইসাথে নতুন যেকোন সিস্টেম এই বিমানের সাথে মুহুর্তের মাঝেই যুক্ত করে ফেলা যাবে।
 
এই বিমানগুলি দেখিয়ে দেয় যে, চীনা বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলির নতুন কিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মনমানসিকতা রয়েছে। ডিজাইনগুলির ভালো খারাপ যা-ই থাকুক না কেন, এটা বলার অবকাশ নেই যে, ডিজাইনগুলির যথেষ্ট স্বকীয়তা রয়েছে। অনেকেই ধরেই নেয় যে, নতুন কোন কিছু মানেই সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু দেশগুলির কাছ থেকেই আসতে হবে। কিন্তু এখন চীনাদের মাঝে কোন হীনমন্যতা থাকলে তারা সেটা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে। 


তিন ইঞ্জিনের বোমারু বিমান!

‘রয়টার্স'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে পাঁচজন সামরিক বিশ্লেষক মত দিয়েছেন যে, ডিজাইন দেখে বলা সম্ভব নয় যে, এগুলি রাডারে কতটা ধরা পড়বে অথবা এগুলির ভেতরে কিধরণের সরঞ্জাম রয়েছে। এছাড়াও এগুলি আকাশে কতটা ম্যানিউভার করতে সক্ষম বা এগুলির গতি কতটা হতে পারে, সেব্যাপারেও নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। এগুলি জানতে পারলেই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব যে, এগুলিকে পরবর্তী জেনারেশনের যুদ্ধবিমান বলা যাবে কিনা। 'এভিয়েশন উইক' ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তিন ইঞ্জিনের প্রথম বিমানটার নিচের দিকের ইঞ্জিন দু'টার ইনলেটগুলি 'ক্যারেট' ধরণের। আর উপরের ইঞ্জিনটার ইনলেট 'ডাইভার্টারলেস সুপারসনিক ইনলেট' বা 'ডিএসআই' ধরণের। বিমানের নিচের দিকের বডি এতটাই বড় যে, এর ভেতরে খুব সহজেই অস্ত্র রাখা যাবে। এর ল্যান্ডিং গিয়ারে ডাবল চাকা দেয়া হয়েছে; যা বলে দিচ্ছে যে, বিমানটাকে যথেষ্ট ভারি ফাইটার-বম্বার হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র সিনিয়র ফেলো জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, বিমানটার বিরাট আকৃতি এবং রাডার এড়ানোর ডিজাইন দেখে মনে হচ্ছে যে, এটা বহুল প্রতীক্ষিত চীনা আঞ্চলিক বোমারু বিমান; যা বহু উঁচু দিয়ে উড়ে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের সামরিক ঘাঁটি এবং যুদ্ধজাহাজে আঘাত হানতে পারবে। তবে হতেও পারে যে, এটা চীনাদের ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রকল্পের একটা অংশ।

'রয়াল এরোনটিক্যাল সোসাইটি'র এক লেখায় ব্রিটিশ এভিয়েশন বিশ্লেষক বিল সুইটম্যান বলছেন যে, পাশে 'জে-২০এস' বিমানটা থাকায় বোঝা যায় যে, ‘চেংডু'র বিমানটা লম্বায় প্রায় ৭৫ফুট এবং প্রস্থে প্রায় ৬৩ফুট। সেই হিসেবে এর উইং এরিয়া প্রায় ২ হাজার বর্গফুট; যার প্রায় পুরোটাই জ্বালানি বহণে ব্যবহার করা যাবে। বিমানের ডাবল-হুইল ল্যান্ডিং গিয়ার আজকাল ৪৫টন টেইক-অফ ওজনের নিচে কোন বিমানে দেওয়া হয় না। তিনি বলছেন যে, এই বিমানের টেইক-অফ ওজন ৫৪টন বা তারও বেশি হলেও তিনি অবাক হবেন না। এর ফলে এর উইং লোডিং হতে পারে প্রতি স্কয়ার ফুটে ২৭ কেজির মতো; যা তেমন আহামরি কিছু নয়; এবং ফুয়েল ফ্র্যাকশন হতে পারে দশমিক ৪এর মতো। বিমানের ডানার সুইপ এঙ্গেল দেখে মনে হচ্ছে এটা সর্বোচ্চ মাক ১ দশমিক ৮ গতিতে চলতে পারবে। বিমানটার ডানায় একেক পাশে ৫টা করে মোট ১০টা কন্ট্রোল সেগমেন্ট রয়েছে; যার বাইরের দু'টা ওড়ার সময় পুরোপুরিভাবে খোলা ছিল (হয়তো এয়ার ব্রেক হিসেবে)। 'বি-২' এবং 'বি-২১' বিমানের ওড়ার সময় দেখা গেছে যে, এই সেগমেন্টগুলি পুরোপুরিভাবে বন্ধ না করতে পারলে রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তবে চীনারা বিমানের উপর ব্যবহৃত ম্যাটেরিয়ালের ক্ষেত্রে বড় কোন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে কিনা, সেব্যাপারে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। 'বি-২' এবং 'বি-২১' বিমানগুলি তাদের ইঞ্জিনগুলির মাঝে শক্তির ব্যালান্সিংএর মাধ্যমে বিমান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। 'চেংডু' ফাইটারও হয়তো সেটা করবে।

'দ্যা ওয়ার জোন'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘চেংডু'র বিমানটাতে তিনটা ইঞ্জিন দেয়া হয়েছে; কারণ 'জে-২০' বিমানে ব্যবহৃত চীনাদের ডেভেলপ করা দু'টা 'ডব্লিউএস-১০সি' ইঞ্জিনের পক্ষে এত বড় বিমানের গতি এবং উচ্চতার টার্গেট ধরা সম্ভব হবে না। তবে বিল সুইটম্যান মনে করছেন যে, ইঞ্জিনের ক্ষমতার কারণে বিমানে এতবড় ডিজাইন পরিবর্তন না-ও আনা হয়ে থাকতে পারে। হয়তো মাঝের ইঞ্জিনটাকে টেক-অফ, ইনিশিয়াল ক্লাইম্ব এবং সুপারক্রুজের জন্যে ব্যবহার করা হবে। আর বাকি ইঞ্জিন দু'টাকে ব্যবহার করা হবে ফ্লাইট কন্ট্রোলের জন্যে। আর এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, তৃতীয় ইঞ্জিনটা কি বাকি দু'টার মতো একই ইঞ্জিন কিনা। বিমানটার অস্ত্র বহণ করার অভ্যন্তরীণ কম্পার্টমেন্ট ২৫ফুট লম্বা এবং ৭ফুট চওড়া। এছাড়াও এর দু'টা সাইড বে রয়েছে, যেগুলিতে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বা রাডার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করা সম্ভব। তবে অভ্যন্তরীণ কম্পার্টমেন্টের আকার বলে দিচ্ছে যে, এই বিমানে বড় আকারের টার্গেট (বিমান ঘাঁটি, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ) ধ্বংস করার জন্যে বড় আকারের অস্ত্র বহণ করা হবে। তবে এই বিমানে বহুসংখ্যক সুইসাইড ড্রোনও বহণ করা যেতে পারে; যা কিনা দূরবর্তী টার্গেটে হামলা করতে পারবে। দ্রুতগামী সুপারসনিক বিমান হবার কারণে এগুলি শত্রুর অপেক্ষাকৃত কাছের ঘাঁটিতে মোতায়েন করা যাবে। ধীরগতির বোমারু বিমানগুলিকে দূরবর্তী ঘাঁটিতে রাখতে হয়; যেখান থেকে পরিচালনা করতে গেলে আবার আকাশে রিফুয়েলিংএর জন্যে বিমান প্রয়োজন হয়; যেগুলি আবার শত্রুর বিমান ঘাঁটি থেকে দেড় হাজার কিঃমিঃ দূরে থাকলেও শত্রুর টার্গেটে পরিণত হতে পারে। 'দ্যা ওয়ার জোন'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যেহেতু চীনাদের আকাশে রিফুয়েলিং করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়, তাই দূরবর্তী টার্গেটে হামলা করার ক্ষেত্রে এধরণের বিমান খুবই উপযোগী হবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীগুলি যেসকল জায়গায় বিমান হামলার ভয় করতো না, সেগুলি এখন চীনা বিমানের পাল্লার মাঝে পড়ে যাবে। এই টার্গেটগুলির মাঝে থাকবে মার্কিন ট্যাংকার বিমান, পরিবহণ বিমান, আর্লি ওয়ার্নিং এওয়াকস বিমান, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান, গোয়েন্দা বিমান এবং ফরওয়ার্ড ঘাঁটিতে মোতায়েন থাকা জাহাজ ও বাহিনী। তাছাড়া শত্রুর মাঝ থেকে এই বিমানগুলি তথ্য পাঠাতে পারবে এবং একই সক্ষমতার মনুষ্যবিহীন ড্রোনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
 
'চেংডু' কোম্পানির ফাইটার-বোম্বার বিমান প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক ব্যালান্সের হিসেব পাল্টে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন তাদের দূরবর্তী দ্বীপ ঘাঁটিগুলিতে শুধুমাত্র চীনা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে চিন্তিত ছিল, তখন সেগুলি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, মনুষ্যবিহীন ড্রোন এবং দূরপাল্লার স্টেলথ বোমারু বিমানের মতো বহু প্রকার অস্ত্রের সমন্বিত আক্রমণের হুমকিতে পড়ে গিয়েছে। 


যুক্তরাষ্ট্র-চীন অনিবার্য সংঘাত!

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'স্টিমসন সেন্টার'এর সিনিয়র ফেলো কেলি গ্রীকো বলছেন যে, চীনারা দিনের বেলায় এই বিমানগুলিকে সবার সামনে দিয়ে ওড়াবার ব্যাবস্থা করেছে; যা উল্লেখ করার মতো। বিমানের ক্ষেত্রে চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিয়ে হয়তো কিছুটা ভালো অবস্থানে যেতে পারে। তবে মনুষ্যবিহীন বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে সেটা অপেক্ষকৃত কঠিন হতে পারে। যেহেতু পেন্টাগনে এই মুহুর্তে 'এনজিএডি' নিয়ে বিতর্ক চলছে, কাজেই এটা ধরেই নেয়া যায় যে, চীনাদের এই বিমানগুলি পেন্টাগণের আলোচনাকে নতুন করে উস্কে দেবে। 'এভিয়েশন উইক' বলছে যে, চীনারা সরকারিভাবে কিছু না বললেও তারা কয়েক ডজন ব্যক্তির ভুমি থেকে ধারণ করা ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করার উপর কোন সেন্সরশিপ প্রয়োগ করেনি। বিল সুইটম্যান বলছেন যে, একেকটা ছবি একেক দিন তোলা হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে; কিন্তু সবগুলিই একই দিনে সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করা হয়েছে। এর অর্থ হলো চীনারা নির্দিষ্ট করেই একই দিনে ছবিগুলিকে পোস্ট করেছে; অন্য কথায় এগুলি সাধারণ জনগণের তোলা ছবি নয়।

বিল সুইটম্যান বলছেন যে, ‘চেংডু'র ফাইটার-বোম্বার বিমানটা হয়তো কয়েক বছরের মাঝেই সার্ভিসে আসতে যাচ্ছে; যা পশ্চিমা সামরিক অবস্থানের জন্যে হুমকির কারণ হতে পারে। 'রয়টার্স' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনাদের সামরিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক প্রযুক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। কিছুদিন আগেই প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি গুয়ামে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার সিস্টেমের পরীক্ষা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমা চিন্তাবিদদের কপালে চিন্তার রেখাই বলে দিচ্ছে যে, চীনাদের এই দুই বিমানের উড্ডয়ন, বিশেষ করে 'চেংডু' কোম্পানির ফাইটার-বোম্বার বিমান প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক ব্যালান্সের হিসেব পাল্টে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন তাদের দূরবর্তী দ্বীপ ঘাঁটিগুলিতে শুধুমাত্র চীনা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে চিন্তিত ছিল, তখন সেগুলি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, মনুষ্যবিহীন ড্রোন এবং দূরপাল্লার স্টেলথ বোমারু বিমানের মতো বহু প্রকার অস্ত্রের সমন্বিত আক্রমণের হুমকিতে পড়ে গিয়েছে। মোটকথা চীন যত সময় পাবে, ততই সে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক শক্তির ব্যবধান কমিয়ে ফেলতে থাকবে; হয়তো একসময় চীনই এগিয়ে যাবে। আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন হাজির হয়েছে - অনিবার্য সংঘাতের আগে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কতটা সময় দেবে?

Saturday, 21 December 2024

যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের ব্যবহার পরিবর্তিত হচ্ছে - ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা

২১শে ডিসেম্বর ২০২৪

রুশ অত্যাধুনিক 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার। ইউক্রেন যুদ্ধে এধরণের কমপক্ষে ৬২টা হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। ব্যবহারের জায়গা এবং কৌশলের কারণেই রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টারগুলি অত্যাধুনিক হবার পরেও ব্যাপক হারে ধ্বংস হয়েছে। কারণ প্রযুক্তিই শেষ কথা নয়। 


ইউক্রেনিয় বিমান বাহিনীর ১৮তম সিকোর্স্কি ব্রিগেডের হেলিকপ্টার পাইলটরা 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'কে বলছে যে, যখন রুশরা ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তারা তৎক্ষণাৎ জানতো কি করতে হবে। কারণ তারা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল যে, রুশরা তাদের বিমান ঘাঁটিগুলিতে হামলা শুরু করলে তাদের বিমানগুলিকে কিভাবে রক্ষা করতে হবে। তারা অতি দ্রুত তাদের বিমানগুলিকে সারা ইউক্রেন জুড়ে ছড়িয়ে দেয় এবং সকল মেইনটেন্যান্স ক্রুদেরকে বলা ছিল যে, কোথায় গিয়ে মিলিত হতে হবে। এভাবে তারা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে যুদ্ধের শুরু থেকেই রক্ষা করতে পেরেছে। তিন বছর ধরে রুশ বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরেও ইউক্রেন হেলিকপ্টার অপারেট করতে পারছে, এটা অনেকের কাছেই অবাক লাগার মতো। তবে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে ইউক্রেন যুদ্ধ হেলিকপ্টারের প্রয়োজনীতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে; যদিও তা প্রথমবারের মতো নয়।

ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার অপারেশন – শত্রুর রাডার ফাঁকি দেয়া

‘এএফপি'র সাথে কথা বলতে গিয়ে ইউক্রেনের একজন 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার পাইলট বর্ণনা করেন যে, কিভাবে তারা ফ্রন্টলাইনে রুশ অবস্থানের উপর আক্রমণ করেন। হেলিকপ্টারগুলি খুব নিচু দিয়ে উড়ে যায়, যাতে করে রুশ রাডারে সেগুলি একেবারে শেষ মুহুর্তে দেখা যায়। রুশরা একটা সময় ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলিকে অবশ্যই দেখতে পাবে। তবে পাইলটরা চেষ্টা করবে, যাতে করে সবচাইতে কম সময়ের জন্যে তাদেরকে দেখা যায়। এতে করে রুশরা হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে খুব কম সময় পাবে। প্রায় ৬ দশমিক ২কিঃমিঃ দূর থেকে হেলিকপ্টারগুলি ২০ ড্রিগ্রির মতো উপরের দিকে উঠে তাদের রকেটগুলি ফায়ার করে। তারা এরকম একটা মিশনে এক হেলিকপ্টার থেকে ৩০টা রকেট ছুঁড়েছেন বলে জানান। এই রকেটগুলি টার্গেটের ১'শ থেকে ২'শ মিটারের মাঝে আঘাত করতে সক্ষম। মিশনের আগেই তারা ঠিক করে রাখেন যে, কোন রুটে তারা ফেরত আসবেন। ইউক্রেনিয়রা তাদের নিজেদের হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া রকেটের নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত করার সক্ষমতা নিয়ে কথা না বললেও রুশদেরটা নিয়ে অবশ্য কথা বলছে। ইউক্রেনিয় মিডিয়া 'ইউনাইটেড ২৪'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লার বাইরে থেকেই রকেট ছুঁড়ছে। ভিডিওতে দেখা যায় যে, রুশ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টার তাদের নাক কিছুটা উপরের দিকে উঠিয়ে রকেটগুলি ছুঁড়ে দিচ্ছে। এভাবে ছোঁড়া রকেটের নিশানা কতটুকু নিখুঁত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ ৬কিঃমিঃ দূরত্ব থেকে রকেট ছুঁড়লে এক ডিগ্রি এদিক ওদিক হলেও টার্গেটের কয়েক'শ মিটার দূরে গিয়ে পড়বে।

ইউক্রেনিয় 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলির বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় হুমকি হলো রুশ ফাইটার জেট। একারণেই তারা রাডার ফাঁকি দিতে নিচু দিয়ে ওড়ে। 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টারগুলি সোভিয়েত আমলের ডিজাইনের হলেও গতির দিক থেকে (ঘন্টায় ৩২০ কিঃমিঃ) এগুলি সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারের সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম। অন্যান্য এটাক হেলিকপ্টার থেকে যা 'এমআই-২৪' হেলিকপ্টারকে আলাদা করে দেয় তা হলো, এগুলি ৮জন সেনা বহণ করতে সক্ষম। 
 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সিএসআইএস'এর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক ক্যানসিয়ান 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'কে বলছেন যে, সাধারণতঃ পরিবহণ হেলিকপ্টারগুলি ভূমির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে লুকিয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু এটাক হেলিকপ্টারগুলিকে শত্রুর উপর হামলা করতে হলে শত্রুর সামনাসামনি আসতেই হবে। ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে এগুলিতে এন্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র এবং পদাতিক সেনাদের অবস্থানের উপর হামলার জন্যে এগুলিতে রকেট বহণ করা হয়। এছাড়াও ভার্সনের উপর নির্ভর করে এগুলিতে মেশিনগান অথবা কামান থাকে। শত্রুর কাছাকাছি আসতে হয় বলে এটাক হেলিকপ্টারগুলি সাধারণতঃ বর্মাবৃত থাকে এবং এগুলির গতিও থাকে বেশি। ইউক্রেনিয়দের ব্যবহৃত 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টারগুলি সোভিয়েত আমলের ডিজাইনের হলেও গতির দিক থেকে (ঘন্টায় ৩২০ কিঃমিঃ) এগুলি সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারের সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম। অন্যান্য এটাক হেলিকপ্টার থেকে যা 'এমআই-২৪' হেলিকপ্টারকে আলাদা করে দেয় তা হলো, এগুলি ৮জন সেনা বহণ করতে সক্ষম। তবে এই হেলিকপ্টারে মার্কিন 'এপাচি' অথবা রুশদের সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারগুলির মতো সার্চ এবং টার্গেটিংএর জন্যে কোন রাডার নেই। একইসাথে সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারগুলির মতো রাতের বেলায় মিশন চালাবার সক্ষমতা এগুলির নেই। এছাড়াও শত্রুর সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বাঁচার জন্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও এতে নেই। 'স্ক্রিপস নিউজ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে একজন ইউক্রেনিয় 'এমআই-৮' পাইলট জানান যে, তার হেলিকপ্টারের ভেতরে বড় একটা ফুয়েল ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছে; যার ব্যবহারে হেলিকপ্টারটা একনাগাড়ে সাড়ে ৩ ঘন্টা আকাশে থাকতে পারে। ইউক্রেনিয় মিডিয়া 'ইউনাইটেড ২৪'এ বলা হয় যে, ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলির বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় হুমকি হলো রুশ ফাইটার জেট। একারণেই তারা রাডার ফাঁকি দিতে নিচু দিয়ে ওড়ে। ইউক্রেনিয়রা চেক রিপাবলিকের কাছ থেকে রুশ নির্মিত 'এমআই-৩৫' (এমআই-২৪এর রপ্তানি ভার্সন) এটাক হেলিকপ্টার পেয়েছে। এই হেলিকপ্টারগুলি এখন পশ্চিমা নির্মিত 'হাইড্রা-৭০' ৭০মিঃমিঃ রকেট ব্যবহার করছে। সোভিয়েত ডিজাইনের 'এস-৮' ৮০মিঃমিঃ রকেটের চাইতে এগুলির পাল্লা অপেক্ষাকৃত বেশি বলে জানান একজন ইউক্রেনিয় পাইলট। ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলি মূলতঃ ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ১১তম আর্মি এভিয়েশন ব্রিগেডের অন্তর্গত। যুদ্ধের আগে খেরসনে তাদের ঘাঁটি থাকলেও রুশ আক্রমণের পর থেকে হেলিকপ্টারগুলিকে ফ্রন্টলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তারা মার্কিনীদের কাছ থেকেও রুশ নির্মিত 'এমআই-১৭' হেলিকপ্টার পেয়েছে; যেগুলি আফগানিস্তানের জন্যে কেনা হয়েছিলো। এগুলি প্রযুক্তির দিক থেকে বেশ অগ্রগামী। 'দ্যা ওয়ার জোন' ম্যাগাজিনের হিসেবে এই হেলিকপ্টারের সংখ্যা ২০টার মতো হবে।
 
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'র‍্যান্ড কর্পোরেশন'এর জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মার্কিন ম্যারিন কোরের প্রাক্তন 'সুপার কোবরা' হেলিকপ্টার পাইলট কাইলিএন হান্টার 'বিজনেস ইনসাইডার'কে বলছেন যে, হেলিকপ্টার যখন খুব নিচু দিয়ে উড়ছে, তখন পাইলটের মিশন সম্পর্কে খেয়ার রাখা ছাড়াও বেশকিছুটা মনোযোগ চলে যায় হেলিকপ্টার ওড়াতে; যেমন গাছপালা, ইলেকট্রিক পোস্ট ইত্যাদি বাধা সম্পর্কে তাকে বিশেষভাবে সাবধান হতে হয়। একটু ভুল হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এছাড়াও আশেপাশের হুমকি সম্পর্কে পাইলটের সচেতনতা কমে যায়; কারণ খুব নিচুতে ওড়ার কারণে সে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায় না। একারণে যেকোন বিষয়ে পাইলটের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় একেবারেই কমে যায় এবং তাকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়। যেকোন দিক থেকে হেলিকপ্টারের জন্যে হুমকি আসতে পারে; সেটা শত্রুর একটা বাংকার হতে পারে; আবার একটা বিল্ডিংএর উপর থেকেও হতে পারে। নিচু দিয়ে উড়লে শত্রুর পক্ষে একটা হেলিকপ্টারকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি অত নিচুতে কাজ করে না। তবে নিচু দিয়ে ওড়ার সময় হেলিকপ্টারগুলি সৈন্যদের কাঁধে বহন করা বিমান-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও, বিমান বিধ্বংসী কামান এবং মেশিনগানের পাল্লার মাঝে পড়ে যায়।
 
রুশ 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টারের চ্যাফ-ফ্লেয়ার ডেকয়।যুদ্ধের প্রথম দিকের কয়েকটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি একা ইউক্রেনিয় এলাকার গভীরে অপারেট করতে গিয়ে কাঁধে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের হাতে ভূপাতিত হচ্ছে। এগুলিকে ভূপাতিত করা সহজ কাজ নয়। তথাপি একা একা উড়লে একটা বিমানের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো যায়।


রুশ হেলিকপ্টার অপারেশন – টীমওয়ার্ক

যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাসের মাঝেই রুশরা বুঝে ফেলেছে যে, তাদের হেলিকপ্টারগুলি ফ্রন্টলাইনের খুব বেশি কাছে গিয়ে ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। প্রথম দিকের কয়েকটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি একা ইউক্রেনিয় এলাকার গভীরে অপারেট করতে গিয়ে কাঁধে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের হাতে ভূপাতিত হচ্ছে। শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে বোকা বানাতে রুশ 'কেএ-৫২' এবং 'এমআই-২৮' হেলিকপ্টারগুলি দু'পাশে ৬৪টা করে মোট ১২৮টা চ্যাফ ও ফ্লেয়ার বহণ করে। একইসাথে ক্ষেপণাস্ত্রকে বোকা বানাতে এগুলিতে থাকে 'ডিরেকশনাল আইআর কাউন্টারমেজার'। এর বাইরেও এগুলির ককপিট ১২.৭মিঃমিঃ থেকে শুরু করে ২৩মিঃমিঃ ক্যালিবারের গুলি প্রতিরোধ করতে সক্ষম। অর্থাৎ এগুলিকে ভূপাতিত করা সহজ কাজ নয়। তথাপি একা একা উড়লে একটা বিমানের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো যায়।

তাই রুশরা খুব নিচু দিয়ে উড়ে 'হিট এন্ড রান' ট্যাকটিকসএর দিকে মনোযোগী হয়। তারা মিশনের ধরণ ভেদে হেলিকপ্টারের গ্রুপ নিয়ে অপারেট করেছে। এইরূপ একটা মিশনে দেখা যায় যে, খুব স্বল্প সময়ের জন্যে হেলিকপ্টারের নাক ২০-৩০ ডিগ্রি উঁচু করে শত্রুর অবস্থানের উপর ১০টা ১২২মিঃমিঃ 'এস-১৩' এবং ৪০টা ৮০মিঃমিঃ 'এস-৮' রকেট ছুঁড়েছে 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টার। একই সময়ে শত্রু যখন ব্যস্ত ছিল, তখন ‘কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে একটা স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটা টার্গেটে আঘাত করার আগ পর্যন্ত 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারটাকে আকাশে এক জায়গায় অবস্থান করতে হয়; যা হেলিকপ্টারটার জন্যে খুবই বিপজ্জনক। একারণে অন্যান্য হেলিকপ্টারগুলির সাহায্য প্রয়োজন হয়। একইসাথে সেই গ্রুপে ‘এমআই-৩৫', এবং 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার ছিল; যেগুলির কাজ ছিল দরকার বিশেষে শত্রুর অবস্থানে রকেট হামলা করা অথবা কোন হেলিকপ্টার ভূপাতিত হলে সেটার পাইলটদেরকে উদ্ধার করা। মোটকথা এটা হলো একটা টীমওয়ার্ক।
 
রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টারের নাক ৩০ ডিগ্রি উঁচু করে রকেট ছোঁড়া হচ্ছে। রুশরা খুব নিচু দিয়ে উড়ে 'হিট এন্ড রান' ট্যাকটিকসএর দিকে মনোযোগী হয়েছে। তারা মিশনের ধরণ ভেদে হেলিকপ্টারের গ্রুপ নিয়ে অপারেট করেছে। এইরূপ একটা মিশনে দেখা যায় যে, খুব স্বল্প সময়ের জন্যে হেলিকপ্টারের নাক ২০-৩০ ডিগ্রি উঁচু করে শত্রুর অবস্থানের উপর ১০টা ১২২মিঃমিঃ 'এস-১৩' এবং ৪০টা ৮০মিঃমিঃ 'এস-৮' রকেট ছুঁড়েছে 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টার। 


ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান বনাম রুশ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টার

২০২৩এর গ্রীষ্মে ইউক্রেনিয়রা অগ্রাভিযানে যাবার পর রুশ হেলিকপ্টারগুলি নতুন জীবন পেয়েছিল। ইউক্রেনিয় সেনা ইউনিটগুলি যতই এগিয়েছে, ততই তারা তাদের নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লার বাইরে চলে গিয়েছে। এই সুযোগটাই নিয়েছে রুশ হেলিকপ্টারগুলি। ২০২২ সালে রুশরা ইউক্রেনে হামলা করার সময় ইউক্রেনিয়রাও এই সুযোগটাই নিয়েছিল। রুশদের আক্রমণকারী বাহিনীর অগ্রভাগে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতি থাকার কারণে ইউক্রেন তুরস্কে নির্মিত 'বায়রাকতার টিবি-২' ড্রোন ব্যবহার করে বহু রুশ ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছিলো। ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান শুরুর পর ২০২৩এর জুনে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার (এক্স)এর এক বার্তায় বলা হয় যে, রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদেরকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে দিয়েছে। 'দ্যা ওয়ার জোন' ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায় যে, ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান শুরুর পর রুশরা বেরদিয়ান্সক বিমান ঘাঁটিতে অন্যান্য এলাকা থেকে ২০টার মতো হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছে; যার মাঝে রয়েছে ৫টা 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার, ৯টা 'এমআই-৮' অথবা 'এমআই-২৪', এবং ১৩টা 'কেএ-২৭' বা 'কেএ-২৯' হেলিকপ্টার, যেগুলি নৌবাহিনী ব্যবহার করে। ফ্রন্টলাইনের শেষ ১৫কিঃমিঃএর মাঝে নিচু দিয়ে উড়ে 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনের স্বল্প পাল্লার বা 'শোরাড' ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে থাকতে পারবে। আর রাতের বেলায় অপারেট করে অনেকাংশেই কাঁধে বহণ করা বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়াতে পারবে। সামরিক বিশ্লেষক গায় প্লপস্কি বলছেন যে, ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি দূরপাল্লার ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী 'ভিখর-১' ক্ষেপণাস্ত্র বহণের মূল প্ল্যাটফর্ম। লেজার গাইডেড এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা প্রায় ১০কিঃমিঃ। রুশরা হেলিকপ্টারের হেড-আপ ডিসপ্লের বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করেছে, যেখানে 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টার থেকে ৮কিঃমিঃ বা তার চাইতেও বেশি দূরত্ব থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে দেখা যায়।

২০২২এর সেপ্টেম্বরে নতুন 'কেএ-৫২এম' ভার্সন সার্ভিসে এসেছে বলে রুশ বার্তা সংস্থা 'তাস' জানায়। ২০২১এর অগাস্টে এই হেলিকপ্টারগুলির উৎপাদন শুরু হয়; যেখানে বলা হয় যে, ২০২২ সালে ১৫টা এবং ২০২৩ সালে আরও ১৫টা হেলিকপ্টার ডেলিভারি দেয়া হবে। ২০২৩এর জুনে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেন যে, ২০২২এর তুলনায় ২০২৩এ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারের ডেলিভারির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এগুলি দূরপাল্লার 'এলএমইউআর' ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম, যেগুলির পাল্লা ১৪কিঃমিঃএর বেশি। রাতের বেলায় চলমান কোন টার্গেটের বিরুদ্ধে দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার সক্ষমতা রুশদের আর কোন বিমানের নেই। ২০২৩এর জুলাই মাসে সোশাল মিডিয়া টেলিগ্রামে রুশ 'ফাইটারবম্বার' চ্যানেলে এই নতুন 'কেএ-৫২এম' হেলিকপ্টারের কিছু ছবি আপলোড করা হয়। এছাড়াও ২০২৩এর জানুয়ারিতে 'ফাইটারবম্বার' চ্যানেলে সর্বাধুনিক 'এমআই-২৮এনএম' হেলিকপ্টারের ভিডিও আপলোড করা শুরু হয়; যেখানে এই হেলিকপ্টারগুলিকেও দূরপাল্লার 'এলএমইউআর' ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে দেখা যায়। মোটকথা, রুশরা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে থেকে অপারেট করার উদ্দেশ্যে আরও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করছে।
 
রাতের বেলায় শত্রুর ট্যাঙ্ক বহরের উপর ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছে রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার। ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি দূরপাল্লার ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী 'ভিখর-১' ক্ষেপণাস্ত্র বহণের মূল প্ল্যাটফর্ম। লেজার গাইডেড এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা প্রায় ১০কিঃমিঃ। যখন অন্যান্য রুশ হেলিকপ্টার শত্রুকে ব্যস্ত রেখেছে, তখন ‘কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে টার্গেট ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটা টার্গেটে আঘাত করার আগ পর্যন্ত 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারটাকে আকাশে এক জায়গায় অবস্থান করতে হয়; যা হেলিকপ্টারটার জন্যে খুবই বিপজ্জনক। একারণে অন্যান্য হেলিকপ্টারগুলির সাহায্য প্রয়োজন হয়। 


'ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার'এর গবেষক রাইলি বেইলি 'বিজনেস ইনসাইডার'কে বলেন যে, ইউক্রেনের শহরগুলির উপর রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে ইউক্রেনিয়রা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শহরগুলির আশেপাশে মোতায়েন করেছে। একারণে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সেনাদের উপর আকাশ প্রতিরক্ষার ঘাটতি হয়েছে এবং আক্রমণে যাওয়া সেনাদের সাথে থাকার মতো মোবাইল বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইউক্রেনের থাকছে না; যা রুশ হেলিকপ্টারগুলিকে অনেক বড় সুযোগ করে দিয়েছিল। ইউক্রেনিয়রা আক্রমণে যাবার আগ পর্যন্ত রুশ হেলিকপ্টারগুলিকে ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি খুব বেশি দেখা যাচ্ছিলো না। রুশরা খুব সম্ভবতঃ তাদের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে কিছুটা সাবধান হয়েছিলো। ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযানের সময় তাদের হেলিকপ্টারগুলি স্বল্প পাল্লার মিশনে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। তবে সেটা সম্ভব হয়েছে রুশদের শক্তিশালী মাইনফিল্ড, আর্টিলারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারএর সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করার ফলে। তাছাড়া রুশরা শক্তিশালী পরিখা নেটওয়ার্ক তৈরি করার যথেষ্ট সুযোগও পেয়েছিলো; যেখানে তারা মাইন, 'কনসারটিনা ওয়্যার' কাঁটাতারের বেড়া এবং 'ড্রাগনস টীথ' এন্টি-ট্যাঙ্ক বাধা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলো। এই বাধাগুলির সামনে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পশ্চিমা-নির্মিত ট্যাঙ্কগুলি আটকে গেলেই তারা রুশ এটাক হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য অস্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছিলো।

রুশ সামরিক ব্লগাররা দাবি করছে যে, রুশ বিমান বাহিনী ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের উপর দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং গ্লাইড বোমা দিয়ে আক্রমণ করেছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে। রুশদের এই ট্যাকটিকস থেকে নিজেদের সেনাদের বাঁচাতে ইউক্রেনিয়রা তাদের কিছু বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফ্রন্টলাইনে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু রাডার চালু করার সাথেসাথেই সেগুলির উপর রুশরা 'ল্যানসেট' এবং অন্যান্য সুইসাইড ড্রোন দিয়ে হামলা করছিলো। এছাড়াও একেবারে ফ্রন্টলাইনের উপরে হবার কারণে রুশরা তাদের স্নাইপার দল দিয়ে এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে এমবুশ করেছিলো। রাডার অপারেটরদের হত্যা করে রুশ সেনারা অল-টেরাইন ভেহিকল বা এটিভি ব্যবহার করে দ্রুত পালিয়ে গেছে। এর ফলে ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনিয়দের পক্ষে কোন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয়নি; যদিও সেটা না করলে ইউক্রেনিয় সেনারা রুশ বিমান আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারছিলো না। এভাবেই ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে রুশ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি অবাধে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছে।

রুশদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ হেলিকপ্টার হলো 'এমআই-৮এমটিপিআর-১ রাইচাগ'। এটা একটা সাধারণ 'এমআই-৮' পরিবহণ হেলিকপ্টার; যার ভিতরে রয়েছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সরঞ্জাম। 'দ্যা ওয়ার জোন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত রুশ সামরিক বাহিনীতে খুব সম্ভবতঃ এরকম ১৮টা হেলিকপ্টার ছিল। এগুলির কাজ হলো শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা রাডার জ্যামিং করা। এই কাজ করার জন্যে হেলিকপ্টারগুলি রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের ভেতরে অনেক উপর দিয়ে ওড়ে। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় শত্রুর রাডার জ্যামিং করে সেই অঞ্চলে নিজ বিমান বাহিনীর আক্রমণকে সহজ করে দেয় এই হেলিকপ্টার। ২০২৪এর নভেম্বরে রুশ বার্তা সংস্থা 'তাস' রাশিয়ার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি 'এফএসবি'র বরাত দিয়ে বলে যে, ইউক্রেনিয়রা একজন পাইলটকে দিয়ে এরকম একটা হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করার পরিকল্পনা করেছিল। রুশরা দাবি করছে যে, ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এই কাজে ইন্ধন দিয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় পশ্চিমারা বিভিন্নভাবে সোভিয়েত সামরিক সরঞ্জাম হাইজ্যাক করেছিলো। সোভিয়েত 'মিগ-২১', ‘মিগ-১৯' এবং 'মিগ-১৭' যুদ্ধবিমান ইস্রাইলের কাছ থেকে চড়া মূল্যে পেয়েছিল মার্কিনীরা; যেগুলিকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাইলট ট্রেনিংএর জন্যে 'টপগান' স্কুলের কারিকুলাম সাজিয়েছিলো। এই ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমের সফলতা নিয়ে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করার চেষ্টার খবর যদি সত্যি না-ও হয়, তথাপি ইউক্রেনিয়দের হাতে এধরণের ৬টা হেলিকপ্টার ধ্বংস হবার খবর বলে দেয় যে, ইউক্রেনিয়রা এগুলিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে টার্গেট করেছে।
 
২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০২২। রুশ পরিবহণ হেলিকপ্টারগুলি হস্টোমেল বিমানবন্দর দখলে এগুচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম কয়েক ঘন্টার মাঝেই রাজধানী কিয়েভের উত্তরে হস্টোমেল বিমানবন্দর দখলের রুশ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সেনা অবতরণ করিয়ে এই বিমানবন্দর দখলের প্রচেষ্টা ছিল। তবে এই মিশন ব্যর্থ হবার পিছনে যে হেলিকপ্টারের দুর্বলতা দায়ী ছিল না, তা বোঝা যায় যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হেলিকপ্টার ব্যবহারের দিকে তাকালে। 


হেলিকপ্টারই যখন টার্গেট

ডাচ ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ওয়েবসাইট 'ওরিক্স'এর হিসেবে রুশরা এখন পর্যন্ত ১৪৭টা হেলিকপ্টার হারিয়েছে; যার মাঝে ৪৪টা 'এমআই-৮' পরিবহণ হেলিকপ্টার (এর মাঝে ৬টা ‘এমআই-৮এমটিপিআর-১ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার হেলিকপ্টার), ১৮টা 'এমআই-২৪ বা এমআই-৩৫' এটাক হেলিকপ্টার, ১৫টা 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টার এবং ৬২টা 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার রয়েছে। ইউক্রেনিয়রা এই সময়ের মাঝে হারিয়েছে ৫০টা হেলিকপ্টার; যার মাঝে ৩১টা 'এমআই-৮ বা এমআই-১৭' পরিবহণ হেলিকপ্টার এবং ৮টা 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম কয়েক ঘন্টার মাঝেই রাজধানী কিয়েভের উত্তরে হস্টোমেল বিমানবন্দর দখলের রুশ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সেনা অবতরণ করিয়ে এই বিমানবন্দর দখলের প্রচেষ্টা ছিল। তবে এই মিশন ব্যর্থ হবার পিছনে যে হেলিকপ্টারের দুর্বলতা দায়ী ছিল না, তা বোঝা যায় যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হেলিকপ্টার ব্যবহারের দিকে তাকালে। সেবছরেরই ১লা এপ্রিল ইউক্রেনের 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার রাশিয়ার সীমান্তবর্তী শহর বেলগোরদের জ্বালানি ডিপোতে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। হামলায় ইউক্রেনিয়রা সম্পূর্ণ সারপ্রাইজ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো। ইউক্রেনিয়রা আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে না থাকার পরেও ব্যাপক সাফল্যের সাথে হেলিকপ্টার অপারেট করেছে। একেকজন পাইলট দিনে ১ থেকে ৩টা সর্টিও উড়িয়েছে; যা পাইলট, হেলিকপ্টার এবং মেইনটেন্যান্স সদস্যদের সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। যদিও এই সময়ে অনেক ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। কৃষ্ণ সাগরে রুশদের হাত থেকে স্নেইক আইল্যান্ড নামের ছোট্ট একটা দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে ইউক্রেনিয়রা সেখানে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে সেনা অবতরণও করিয়েছিল।

২০২৩এর গ্রীষ্মে ইউক্রেনের ব্যর্থ অগ্রাভিযানের সময় পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলি ধ্বংসে রুশ হেলিকপ্টারগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খুব সম্ভবতঃ একারণেই ইউক্রেনিয়রা রুশদের হেলিকপ্টার ঘাঁটিকে টার্গেট করেছিলো। গত ১৭ই অক্টোবর ২০২৩এ বেরদিয়ান্সক এবং লুহান্সকএ রুশ বিমান ঘাঁটির উপর ইউক্রেনিয়রা মার্কিন 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা হামলা করেছিলো। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, খুব সম্ভবতঃ বেরদিয়ান্সকএ ৯টা এবং লুহান্সকএ ৫টা রুশ হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। একইসাথে সেখানে বলা হয় যে, রুশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলিকে ফ্রন্টলাইনে তেমন দেখাই যাচ্ছিলো না। সেই শূণ্যস্থান পূরণ করছিলো রুশ হেলিকপ্টারগুলি। এই বিমান ঘাঁটিগুলি তারা ফরওয়ার্ড অপারেটিং বেইস হিসেবে ব্যবহার করছিলো। হয়তো এই হামলার ফলে রুশরা তাদের হেলিকপ্টারগুলি ফ্রন্টলাইন থেকে আরও দূরে নিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবে। ‘ওয়ার অন দ্যা রকস' পডকাস্টে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'কার্নেগি এনডাউমেন্ট'এর সিনিয়র ফেলো মাইকেল কফম্যান বলেন যে, রুশরা যদি আগে থেকেও জানতো যে ইউক্রেনিয়রা রুশ বিমান ঘাঁটিতে হামলা করবে, তারপরও তারা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতো না। কারণ প্রাথমিকভাবে ক্ষতি সহ্য করে তারপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াটা রুশদের কর্মপদ্ধতি হয়ে গিয়েছে। এই হামলায় খুব সম্ভবতঃ ১৬০কিঃমিঃ পাল্লার 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়; যেগুলির ওয়ারহেড ছিল মূলতঃ ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা। খালি যায়গায় পার্কিং করা বিমানগুলিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই এধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিলো। এই বিমান ঘাঁটিগুলি থেকে অপারেট করা 'কেএ-৫২ এলিগেটর' এবং 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান ভেস্তে যাবার পিছনে বড় কারণ ছিলো।
 
ইউক্রেনিয় 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারের ভেতর বসানো হয়েছে জ্বালানির ট্যাঙ্ক; যা হেলিকপ্টারটাকে সাড়ে ৩ ঘন্টা আকাশে থাকতে সহায়তা করে। ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ১২তম ব্রিগেডের একজন পাইলট বলেন যে, মারিউপোল মিশনে অংশ নেয়া পাইলটদের বলা হয়েছিলো যে তাদের ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে ভূপাতিত হবার। মারিউপোল থেকে উদ্ধার করা আহত একজন সেনা হেলিকপ্টারের পাইলটের নাম জানতে চেলেছিলেন। তিনি বলেন যে, পাইলটের নামে তার অনাগত সন্তানের নাম তিনি রাখবেন 'ওলেক্সান্ডার'।


ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার অপারেশন

সংখ্যায় কম এবং প্রযুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলিও যথেষ্ট সফলতার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। ইউক্রেনিয় মিডিয়া 'ইউনাইটেড ২৪'এর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে, ২০২২ সালের মার্চে কিভাবে ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার পাইলটরা অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ৮০ দিনের জন্যে অবরুদ্ধ মারিউপোল শহরের আজভস্টাল স্টীল কমপ্লেক্সে আটকে পড়া ৩ হাজার ইউক্রেনিয় সেনাকে রসদ সরবরাহ করেছিলো। তারা সেখানে সাপ্লাই পৌঁছে দেয়া ছাড়াও আজভ ব্যাটালিয়ন ও ইউক্রেনিয় সামরিক ইন্টেলিজেন্স 'জিইউআর'এর সদস্যদের মারিউপোলে নিয়ে যায় ও গুরুতর আহতদেরকে সেখান থেকে নিয়ে আসে। ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ১২তম ব্রিগেডের একজন পাইলট বলেন যে, এই মিশনে অংশ নেয়া পাইলটদের বলা হয়েছিলো যে তাদের ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে ভূপাতিত হবার। একারণে একজন পাইলটকেও সেখানে দ্বিতীয়বার পাঠানো হয়নি। নাইট ভিশন গগলস পড়ে 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারের পাইলটরা রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকার ১০০কিঃমিঃ ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা দক্ষিণে সমুদ্রের উপকূল পর্যন্ত যায়। এরপর সেখান থেকে পূর্বদিকে মোড় নিয়ে সমুদ্রের দিক থেকে মারিউপোলে হাজির হয়। এভাবে তারা মোট ৭টা অপারেশন সম্পাদন করেছিলো; যেখানে ১৬টা 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার অংশ নিয়েছিল। তবে প্রথমবারের পর থেকে তারা সারপ্রাইজ ফ্যাক্টরটা হারিয়ে ফেলে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ‘অপারেশন এয়ার করিডোর'এর মাধ্যমে ৮৫ জন আহত সেনাকে মারিউপোল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছিলো। এরূপ আহত একজন সেনা হেলিকপ্টারের পাইলটের নাম জানতে চেলেছিলেন। তিনি বলেন যে, পাইলটের নামে তার অনাগত সন্তানের নাম তিনি রাখবেন 'ওলেক্সান্ডার'।

'দ্যা ওয়ার জোন'এর সাথে সাক্ষাতে মারিউপোল মিশনে অংশ নেয়া 'জিইউআর'এর এক সদস্য বলেন যে, তারা হেলিকপ্টারের অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম খুলে ফেলে হাল্কা করে ফেলেছিল; যাতে করে মারিউপোলের সেনাদের জন্যে 'স্টিংগার' বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ‘এন'ল' এন্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র এবং 'স্টারলিঙ্ক' স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা বহণ করা যায়। দু'টা হেলিকপ্টারের সকলে বেসামরিক পোষাক পড়েছিলো; যাতে করে ভূপাতিত হলে জনগণের মাঝে মিশে যাওয়া যায়। রাত সাড়ে ৩টায় শুরু হয় তাদের মিশন। রাতের বেলায় পরিচালনার জন্যে নাইট ভিশন গগলস ব্যবহার করা হয়। ফ্রন্টলাইনের কাছে একটা স্থানে তারা রিফুয়েলং করে নেয়। এরপর মাটির মাত্র ১৫ ফুট উপর দিয়ে ঘন্টায় ২৪০কিঃমিঃ গতিতে তারা রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রায় ১'শ কিঃমিঃ দূরত্ব অতিক্রম করে। মিশনের গোপনীয়তা বজায় রাখতে তিনবার মিশন বাতিল করা ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্যে নেমে সকল সাপ্লাই নামানো হয় এবং ১৬ জন আহত যোদ্ধাকে তুলে নেয়া হয়। মারিউপোলের সেনারা রুশ সেনাদের সাথে গোলাগুলি করে তাদেরকে ব্যস্ত রাখে। সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ তারা ঘাঁটিতে ফিরে আসে। দ্বিতীয় মিশনের সময় রুশরা হেলিকপ্টারের দিকে গুলি ছোঁড়ে; কিন্তু এরপরেও তারা নিরাপদে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। পাইলটরা তাদের রুট বদল করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। একটা মিশনে ৪টা 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার ছিল; যেগুলির এসকর্ট হিসেবে ছিল একটা 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। এই মিশনে কমপক্ষে ৩৬ জন আহতকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। শেষ মিশনটা ছিল মে মাসের মাঝামাঝি; এর পরপরই ২ হাজারের বেশি ইউক্রেনিয় সেনা সেখানে আত্মসমর্পণ করে। মারিউপোলের সম্পূর্ণ অপারেশনে ৩টা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছিল।

ইউক্রেনিয়রা তাদের হেলিকপ্টারের জন্যে নতুন কাজ আবিষ্কার করেছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, ২০২৪এর মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়া তাদের 'শাহেদ-১৩৬' সুইসাইড ড্রোনের কর্মকান্ডে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। এতদিন ইউক্রেনিয়রা রাইফেল বা মেশিনগান দিয়ে ভূমি থেকে গুলি করে এই ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করতে পারতো। কিন্তু এখন এগুলি মেশিনগানের পাল্লার ঠিক বাইরে দিয়ে উড়ছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ইউক্রেনিয়রা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে কাজে লাগিয়েছে। প্রথমে ভূমির রাডার থেকে ড্রোনগুলির অবস্থান নির্ণয় করে সেখানে দু'টা হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। ইউক্রেনের বর্ডার গার্ডের 'এয়ারবাস এইচ-১২৫' হেলিকপ্টার তার ইলেকট্রো-অপটিক সরঞ্জাম এবং সার্চলাইটের মাধ্যমে ড্রোনটাকে খুঁজে নেয়। এরপর সঙ্গে থাকা সেনাবাহিনীর 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারকে টার্গেট বুঝিয়ে দেয়; যা একটা নিরাপদ স্থানের উপর মেশিনগান দিয়ে ড্রোনটাকে ভূপাতিত করে। 'আর্মি রেকগনিশন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়াও তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে ইউক্রেনিয় ড্রোন (আকাশে ওড়া এবং ম্যারিটাইম ড্রোন) ধ্বংস করতে ব্যবহার করছে।
 
রুশ হেলিকপ্টার টীমওয়ার্ক। একটা 'কে-৫২' এটাক হেলিকপ্টারকে সহায়তা দেয়ার জন্যে তার পেছনে উড়ছে একটা 'এমআই-৩৫' এটাক হেলিকপ্টার এবং একটা 'এমআই-৮' পরিবহণ হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হুমকি নতুন কিছু নয়। হুমকি যেমন রয়েছে; প্রতিরোধের প্রযুক্তি এবং ট্যাকটিকসও রয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো হেলিকপ্টারগুলি পদাতিক সেনা, আর্টিলারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সাইবার সক্ষমতার সাথে কতটা সমন্বিতভাবে কাজ করতে সক্ষম। 


বাকিরাও শিখছে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই ২০২৪এর ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন সেনাবাহিনী তাদের 'ফিউচার এটাক রেকনাইস্যান্স এয়ারক্রফট' বা 'এফএআরএ' প্রকল্প বাতিল করে দেয়। সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল র‍্যান্ডি জর্জ বলেন যে, আকাশ থেকে রেকনাইস্যান্স বা নজরদারি মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। অনেক মনুষ্যবিহীন যন্ত্রের মাঝে সেন্সর এবং অস্ত্র বহণ করা যাচ্ছে; যার সাথে মহাকাশের সক্ষমতাও রয়েছে। এগুলি একদিকে যেমন সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি এগুলির পাল্লা বড় এবং যথেষ্ট কম খরচেই পাওয়া যাচ্ছে। 'ফ্লাইট গ্লোবাল'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাতিল করে দেয়া 'এফএআরএ' স্কাউট হেলিকপ্টারের কাজগুলি এখন সেনাবাহিনী 'এএইচ-৬৪ এপাচি' এবং ভবিষ্যতে তাদের বহরে যুক্ত হওয়া ড্রোনের মাধ্যমে সম্পাদন করবে। এছাড়াও ইতোমধ্যেই ২০২০ সালে সেনাবাহিনী তাদের 'ব্ল্যাক হক' হেলিকপ্টার থেকে 'এলটিয়াস-৬০০' নামের ছোট ড্রোন ছুঁড়ে প্রমাণ করেছে যে, তাদের সার্ভিসে থাকা হেলিকপ্টারগুলিকে ড্রোন এবং এআইএর সমন্বয়ে ব্যবহার করে নজরদারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং ধ্বংসাত্মক সক্ষমতাকে অনেক গুণে বাড়িয়ে ফেলা সম্ভব। মার্কিন সেনাবাহিনী ইস্রাইলের 'রাফায়েল' কোম্পানির তৈরি 'স্পাইক এনলস' দূরপাল্লার ট্যাঙ্ক-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র 'এএইচ-৬৪ই এপাচি ভি৬' হেলিকপ্টার থেকে ব্যবহারের জন্যে পরীক্ষা চালাচ্ছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় ৫০কিঃমিঃ। 'রাফায়েল' বলছে যে, অনেক দেশই এখন তাদের 'এপাচি' হেলিকপ্টারের সাথে 'স্পাইক এনলস' ক্ষেপণাস্ত্র চাইছে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে যে, একটা হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে বাধা এখন অনেক। একারণে দূরপাল্লার আক্রমণ সক্ষমতা এখন গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি 'বোয়িং'এর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর টি জে জেমিসন 'দ্যা ওয়ার জোন'কে দেয়া সাক্ষাতে বলছেন যে, মার্কিন সেনাবাহিনী 'এএইচ-৬৪ এপাচি' হেলিকপ্টারকে ২০৬০ সাল পর্যন্ত সার্ভিসে রাখতে চাইছে। ১৯৮৪ সালে সার্ভিসে আসা এই হেলিকপ্টার বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এখন সর্বশেষ পরিবর্তন হিসেবে এর সাথে ড্রোনের ব্যবহার যুক্ত করা হচ্ছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী হেলিকপ্টার থেকে ড্রোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা ছাড়াও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, কমিউনিকেশন রিলে এবং শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার কাজ করা যাবে। শত্রুর ড্রোন ধ্বংস করাটা 'এপাচি'র একটা বড় কাজ হতে পারে। আগে 'এপাচি' হেলিকপ্টারকে পাহাড়, গাছপালা বা বিল্ডিংএর পেছনে লুকিয়ে থাকার জন্যে ডিজাইন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন ধরেই নেয়া হচ্ছে যে, এই হেলিকপ্টারগুলি শত্রুর অবস্থান থেকে অনেক দূরে থাকবে; সুতরাং লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ১৯৮০এর দশকে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক বহরের বিরুদ্ধে বড় আকারের যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে এই হেলিকপ্টারকে ডেভেলপ করা হলেও এখন একে শুধু এটাক হেলিকপ্টার হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এছাড়াও অনেকেই বলছেন যে, ৩'শ কিঃমিঃ দূরত্বে অপারেট করতে পারা 'এপাচি' প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এই সমুদ্রাঞ্চলে যেকোন যুদ্ধই হবে অনেক বেশি দূরত্বে। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, এটাক হেলিকপ্টারের ভবিষ্যৎ কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; বিশেষ করে যখন অর্থায়ন করার প্রশ্নটা সামনে আসছে।

‘দ্যা টেলিগ্রাফ'এর এক লেখায় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ডেভিড এক্স বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝ দিয়ে এটাক হেলিকপ্টারের প্রয়োজন নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এটাক হেলিকপ্টার কনসেপ্টের জন্মের পর অনেক দেশই এটাক হেলিকপ্টার যোগাড় করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের আগ পর্যন্ত শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে এটাক হেলিকপ্টারকে পড়তে হয়নি। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর ৩১টা 'এপাচি' এটাক হেলিকপ্টার ইরাকি সেনাবাহিনীর একটা ডিভিশনকে আক্রমণ করে। ফলশ্রুতিতে ২টা হেলিকপ্টার ধ্বংস হয় এবং বাকিগুলির প্রত্যেকটা ক্ষতির সন্মুখীন হয়। এই অপারেশন দেখিয়ে দিয়েছিল যে, সামনের দিনে কি আসতে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি এতটাই ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে যে, তারা ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লার বাইরে থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনিয়দের আক্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। শুধুমাত্র ২০২৩এর গ্রীষ্মে ইউক্রেনিয়রা অগ্রাভিযানে যাবার পরই রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি তাদের প্রয়োজন তুলে ধরতে পেরেছে। এরপর ইউক্রেনিয়রা রাশিয়ার কুর্স্কএ আক্রমণ করলে তারা 'ফার্স্ট পারসন ভিউ' বা 'এফপিভি' ড্রোন দিয়ে রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলিকে টার্গেট করতে থাকে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় না করে নিজেদের এটাক হেলিকপ্টারকে শত্রুর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় পাঠানোটা হবে আত্মহত্যার শামিল। এরপরেও বাকি থাকবে প্রতিপক্ষের 'এফপিভি' সুইসাইড ড্রোনগুলিকে নিষ্ক্রিয় করার।
 
রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার অপারেট করছে খোলা মাঠের মাঝে তৈরি করা অস্থায়ী বিমান ঘাঁটি থেকে। গত ১৭ই অক্টোবর ২০২৩এ বেরদিয়ান্সক এবং লুহান্সকএ রুশ বিমান ঘাঁটির উপর ইউক্রেনিয়রা মার্কিন 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা হামলা করেছিলো। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, খুব সম্ভবতঃ বেরদিয়ান্সকএ ৯টা এবং লুহান্সকএ ৫টা রুশ হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। এই হামলায় খুব সম্ভবতঃ ১৬০কিঃমিঃ পাল্লার 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়; যেগুলির ওয়ারহেড ছিল মূলতঃ ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা। খালি যায়গায় পার্কিং করা বিমানগুলিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই এধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিলো। এই বিমান ঘাঁটিগুলি থেকে অপারেট করা 'কেএ-৫২ এলিগেটর' এবং 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান ভেস্তে যাবার পিছনে বড় কারণ ছিলো।


তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসার 'ফ্লাইট গ্লোবাল'কে বলছেন যে, শুধুমাত্র ইউক্রেন যুদ্ধ থেকেই সকল শিক্ষা নিতে হবে; তা হতে পারে না। কারণ রুশ বা ইউক্রেনিয়দের যুদ্ধ করার ধরণ পশ্চিমাদের থেকে পুরোপুরি আলাদা। তিনি বলছেন যে, হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হুমকি তো নতুন কিছু নয়। হুমকি যেমন রয়েছে; প্রতিরোধের প্রযুক্তি এবং ট্যাকটিকসও রয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো হেলিকপ্টারগুলি পদাতিক সেনা, আর্টিলারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সাইবার সক্ষমতার সাথে কতটা সমন্বিতভাবে কাজ করতে সক্ষম। তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে হস্টোমেল বিমানবন্দরে রুশ হামলা ভেস্তে যাবার ব্যর্থতা হেলিকপ্টারের উপর দেয়া যাবে না। সেখানে পরিকল্পনা ঠিক ছিল না এবং অভিযানের গ্রুপগুলির মাঝে সমন্বয় ছিল না। সামনের দিনগুলিতে হেলিকপ্টারের সাথে মনুষ্যবিহীন যন্ত্রের সমন্বয় ঘটিয়ে সক্ষমতাকে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

ইউক্রেন যুদ্ধ আবারও প্রমাণ করলো যে, শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার কতটা অসহায়। তথাপি যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের ব্যবহার শেষ হয়ে যায়নি। হেলিকপ্টারকে যুদ্ধের নতুন বাস্তবতায় কিভাবে ব্যবহার করা হবে, সেব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। ড্রোন এবং এআইএর সমন্বয় ঘটিয়ে তাদের প্রায় ৮'শ 'এপাচি' এটাক হেলিকপ্টারকে সার্ভিসে রাখতে চাইছে মার্কিন সেনাবাহিনী। এর মূল কারণ হলো, মার্কিন সমরবিদেরা মনে করছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ এটাক হেলিকপ্টারের মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। যেহেতু যুদ্ধের বাস্তবতাকে নির্দিষ্ট করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না, তাই হেলিকপ্টারগুলিতে সফটওয়্যার আপডেট এমনভাবে দেয়া হচ্ছে, যাতে করে ভবিষ্যতে যেকোন প্রযুক্তি এর সাথে যুক্ত করে কাজে লাগানো যায়। ব্যবহারের জায়গা এবং কৌশলের কারণেই রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টারগুলি অত্যাধুনিক হবার পরেও ব্যাপক হারে ধ্বংস হয়েছে। কারণ প্রযুক্তিই শেষ কথা নয়। অপরদিকে অনেক পুরোনো ডিজাইনের 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারগুলি এখনও পরিবহণ এবং সার্চ-রেসকিউএর মতো গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সাহসিকতার বিকল্প হয় না। মারিউপোল অপারেশনে ইউক্রেনের সাহসী পাইলট ওলেক্সান্ডারের কাহিনীই বলে দেয় যে, যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টার সর্বদাই ধ্বংসের মুখে থাকবে; কিন্তু পাইলট ও ক্রুদের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার গল্পগুলিই মানুষকে আরও একদিন যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা দেবে।

Friday, 13 December 2024

ইউক্রেনে ড্রোন যুদ্ধ – বাকি বিশ্বের জন্যে শিক্ষা

১৪ই ডিসেম্বর ২০২৪

ইউক্রেনিয় সেনার হাতে 'ডিজেআই ম্যাভিক' ড্রোন; যার নিচে বাঁধা রয়েছে একটা গ্রেনেড। যুদ্ধ জয়ের কোন একক ম্যাজিক ফর্মূলা নয় ড্রোন। তবে ড্রোন ছাড়া যুদ্ধ জেতাও অসম্ভব হয়ে গেছে; যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে হয়েছিল ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। 


ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। যেসকল বিষয় এই যুদ্ধের মাঝে সবচাইতে বেশি আলোচিত হয়েছে, তার মাঝে শীর্ষে থাকবে ড্রোন। অনেকেই বলছেন যে, এই যুদ্ধের মাঝ দিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহের গতিপ্রকৃতিই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে ড্রোন ও অন্যান্য প্রযুক্তি এবং কৌশলের ব্যবহার সামনের দিনগুলিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বিশ্বের সকল সামরিক কৌশলীরাই এই যুদ্ধের দিকে নজর রাখছেন। ফ্রন্টলাইন থেকে বেশকিছু মিডিয়া নিয়মিত রিপোর্ট করছে; যেগুলি থেকে যুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

২০২২ সালে যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনিয়রা যখন তুর্কিদের তৈরি 'বায়রাকতার টিবি-২' ড্রোন ব্যবহার করে সফল হচ্ছিলো, তখন রুশদের ড্রোনের ব্যবহার খুব একটা উল্লেখ করার মতো ছিলো না। তখনও পর্যন্ত ইউক্রেনিয়রা রুশ আর্টিলারিকেই বেশি ভয় পেতো। কিন্তু ২০২২এর শেষের দিক থেকে রুশ ড্রোনের ব্যবহার বাড়তে থাকে। আর সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০২৩এর মাঝামাঝি সময়ে। ডনবাসের চাসিভ ইয়ার শহরের কাছে যুদ্ধে অংশ নেয়া ইউক্রেনিয় সেনারা বলছে যে, সেখানে দুই পক্ষের সৈন্যদের মাঝে সরাসরি যুদ্ধ খুব কমই হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুদ্ধ হচ্ছে ড্রোন এবং আর্টিলারি ব্যবহার করে।

ইইউ ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ইউক্রেনকে ১০ লক্ষ নতুন ড্রোন সরবরাহ করবে। অপরদিকে ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনী একটা নতুন ড্রোন কমান্ড গঠন করছে। ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় ১০ হাজার ড্রোন যেকোন মুহুর্তে আকাশে উড়ছে। ড্রোন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে ইউক্রেনের ৭৯তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেডের ওয়াবসাইটে। সেখানে স্নাইপার, রকেট-গ্রেনেড লঞ্চার এবং স্কাউট গানার পদের প্রায় একই পারিশ্রমিকে ড্রোন অপারেটর পদের জন্যে লোক চাওয়া হয়েছে। এই ব্রিগেডের বিভিন্ন সাব-ইউনিটের সাথে একটা 'এটাক ড্রোন কোম্পানি'কে দেখা যায়। এরকম অন্যান্য ব্রিগেডেও 'এটাক ড্রোন' কোম্পানি গঠন করা হয়েছে; যেমন ৯৫তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেড। ইউক্রেনের সেনারা ড্রোন সংগ্রহের জন্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে আন্তর্জাতিকভাবে সহায়তা চাচ্ছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে এই ড্রোন ইউনিটগুলি সাধারণভাবে 'এরো স্কাউট' বলে পরিচিত। ড্রোনের পাল্লার উপর নির্ভর করে এগুলি ফ্রন্টলাইন থেকে কয়েক কিঃমিঃ দূরে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং অন্যান্য ইউনিটের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ইউক্রেনিয় এবং রুশ সেনাবাহিনীর অনেক ইউনিটেই ড্রোন এখন একটা অপরিহার্য সরঞ্জাম। ইউক্রেনিয় এক সেনার মতে, ২ কিঃমিঃ দূরে বসে থাকা একজন সেনার ওড়ানো একটা ক্যামেরাসহ ড্রোন একটা রেকনাইস্যান্স কোম্পানির কাজ করে।
 
'এফপিভি' ড্রোন আটকাতে উক্রেনিয় সেনারা তাদের অবস্থানের চারিদিকে ক্যামুফ্লাজ নেট দিয়ে ঘিরে দিচ্ছে। সেনাদের জন্যে শত্রুর ড্রোন হয়ে গেছে একটা ত্রাসের বস্তু। ফ্রন্টলাইনে সেনারা বেশিরভাগ সময়ই কাটাচ্ছে মাটির নিচে; নতুবা কোন ড্রোন তাদের অবস্থান দেখে ফেলবে এবং তারা শত্রুর আর্টিলারি বা 'এফপিভি' ড্রোনের জন্যে টার্গেট হয়ে যাবে। 


ড্রোন থেকে বাঁচার চেষ্টা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ

সেনাদের জন্যে শত্রুর ড্রোন হয়ে গেছে একটা ত্রাসের বস্তু। ফ্রন্টলাইনে সেনারা বেশিরভাগ সময়ই কাটাচ্ছে মাটির নিচে; নতুবা কোন ড্রোন তাদের অবস্থান দেখে ফেলবে এবং তারা শত্রুর আর্টিলারি বা 'এফপিভি' (ফার্স্ট পারসন ভিউ) ড্রোনের জন্যে টার্গেট হয়ে যাবে। গাড়িগুলিকে সর্বদাই লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। সাধারণতঃ শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই কিছুটা নিরাপদে গাড়ি চালানো যায়। এমনকি মাটির নিচের বাংকারের মাঝেও বিভিন্ন স্থানে পর্দা লাগানো থাকে, যাতে করে কোন 'এফপিভি' ড্রোন বাংকারে ঢুকে পড়ে বেশিদূরে যেতে না পারে। আহত রুশ সেনারা পরিখার ভেতর আশ্রয় নিলে ইউক্রেনিয়রা সুইসাইড ড্রোন ব্যবহার করে তাদেরকে সেখানেও শেষ করেছে। 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'এর এক প্রতিবেদনের ভিডিও রেকর্ড করার মাঝখানেই পর পর দু'টা রুশ 'এফপিভি' ড্রোন পাশের বিল্ডিংএর দরজায় হামলা করে। তবে সেগুলি মাটির নিচের বাংকারের ভেতর ঢুকতে পারেনি; যদিও সেনারা সকলে বাংকারের ভেতর সতর্ক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। ইউক্রেনিয় সেনারা সন্দেহ করে যে, রুশরা হয়তো ইউক্রেনিয় ড্রোনের ভিডিও সিগনাল ধরে ফেলে তাদের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করছে; তবে ইউক্রেনিয়দের ড্রোন ঘাঁটির সঠিক অবস্থান তারা হয়তো জানতে পারেনি। খানিকক্ষণ পরই ইউক্রেনিয়রাও রুশদের তৃতীয় আরেকটা 'এফপিভি' ড্রোনের ভিডিও সিগনাল ধরে ফেলে বুঝতে পারে যে রুশরা তাদের ঘাঁটি বরাবরই ড্রোন ওড়াচ্ছে। অন্য কথায় বলতে গেলে ইউক্রেনিয়রা লাইভ ভিডিও দেখতে পায় যে একটা ড্রোন তাদের ড্রোন ঘাঁটির উপর বাড়ির ছাদে কিভাবে আছড়ে পড়লো! ইউক্রেনিয়রা এতে নিশ্চিত হয় যে রুশরা তাদের ঘাঁটির অবস্থান জেনে ফেলেছে। তাই তারা রাতের বেলাতেই এই ঘাঁটি ছেড়ে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে।

সাধারণতঃ আকাশে ড্রোন ওড়ার শব্দ শোনা গেলেই সেনারা চুপচাপ গাছের নিচে বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আর যদি সেনারা বুঝতে পারে যে কাছাকাছি কোন 'এফপিভি' (ফার্ট পারসন ভিউ) ড্রোন রয়েছে, তাহলে তারা কোন গাছের সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে নির্দেশনা হলো কোন অবস্থাতেই নড়াচড়া করা যাবে না। 'এফপিভি' ড্রোন সাধারণতঃ ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে যেতে পারে না। একারণে সেনারা যখন নিজেদের অবস্থান তৈরি করে, তখন তারা সকল প্রকারের ঝোপঝাড় ব্যবহার করার চেষ্টা করে। একইসাথে তারা ক্যামুফ্লাজ নেট ব্যবহারে করে খোলা জায়গাগুলি বন্ধ করার ব্যবস্থা করে; যাতে করে 'এফপিভি' ড্রোন ঢুকতে না পারে। আর্টিলারি, ট্যাংক বা আর্মার্ড ভেহিকলগুলিকেও ক্যামুফ্লাজ নেটের মাধ্যমে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রাখা হয় 'এফপিভি' ড্রোন থেকে বাঁচাতে। রাশিয়াও তার সামরিক স্থাপনাগুলিকে ক্যামুফ্লাজ নেট দিয়ে ঘিরে রাখছে। আর বিভিন্ন আর্মার্ড ভেহিকল এবং বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উপর তারা লোহার খাঁচা দিয়ে ঘিরে দিচ্ছে; যাতে করে সুইসাইড ড্রোনের আক্রমণ কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা যায়। খাঁচার উপর সুইসাইড ড্রোন বিস্ফোরিত হলে সেটা মূল সরঞ্জামগুলিকে হয়তো কম ক্ষতিগ্রস্ত করবে। রুশরা তাদের কিছু ট্যাঙ্ককে এরূপ খাঁচা দিয়ে ঘিরে ফেলে সেগুলিকে আক্রমণের অগ্রভাগে ব্যবহার করছে। এগুলিকে বলা হচ্ছে 'টারটল ট্যাংক' বা কচ্ছপ ট্যাংক। অনেক সময়েই এই কচ্ছপ ট্যাঙ্কের উপর ইলেকট্রনিক জ্যামার বসানো থাকে, যাতে করে 'এফপিভি' ড্রোন এগুলিকে টার্গেট করতে না পারে। প্রথম 'টারটল' ট্যাঙ্কটা খুব সম্ভবতঃ রুশদের ৫ম মোটর রাইফেল ব্রিগেডের ছিল; যারা ২০২৪এর এপ্রিলে ক্রাসনোহরিভকা শহরে হামলা চালাচ্ছিলো। এই ব্রিগেডের সেনারা খুব সম্ভবতঃ আভদিভকা শহরে রুশদের হামলার সময় ইউক্রেনিয় 'এফপিভি' ড্রোনের আক্রমণে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতিকে মাথায় রেখেই এই ট্যাঙ্ক ডিজাইন করেছিলো। খুব দ্রুতই চাসিভ ইয়ার এবং খারকিভের ফ্রন্টলাইনে এরূপ 'টারটল' ট্যাঙ্ক দেখা যেতে থাকলো। এই ট্যাঙ্কগুলির ডিজাইন দেখলেই বোঝা যায় যে, এগুলি একজন অপরজনকে দেখে নিজেরা নিজেরা তাদের ওয়ার্কশপে তৈরি করে নিয়েছে।

ইউক্রেনিয় সেনারা কেউ কেউ ছোট্ট আকৃতির একটা ড্রোন ডিটেক্টর বহন করছে; যার মাধ্যমে তারা ১০কিঃমিঃএর মাঝে কোন ড্রোন থাকলে সেটার রেডিও সিগনাল ধরতে পারে। সিগনালের শক্তি থেকে তারা বুঝতে পারে ড্রোনটা কতটুকু দূরে রয়েছে। ইউক্রেনিয় সেনাদের কেউ কেউ পাম্প-একশন শটগানের সাথে বিশেষ প্রকারের গোলা বহণ করছে; যেগুলি 'এফপিভি' ড্রোন ধ্বংস করার জন্যে কাজে লাগে। তবে সর্বদা আকাশ থেকে কেউ দেখছে - এই ব্যাপারটাই একটা সৈন্যের মনে ভয় ধরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট; সে পরিখার ভেতরে থাকুক, অথবা খোলা জায়গায়ই থাকুক।


তবে সাধারণভাবে ট্যাঙ্কগুলিকে এখন আর খোলা জায়গা দিয়ে দ্রুতগতিতে চালানো যাচ্ছে না; বরং সেগুলিকে লুকিয়ে রাখা আর্টিলারি হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। খোলা স্থানে গেলেই একটা ড্রোন সেই ট্যাঙ্ককে অচল করে ফেলে এবং আরেকটা ড্রোন এসে বাকি কাজটা শেষ করে, যাতে করে সেই ট্যাঙ্কটাকে আবারও মেরামত করে কাজে লাগানো সম্ভব না হয়। পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রকারের হুইল্ড এপিসি এবং 'এমআরএপি' বা 'এমর‍্যাপ'গুলি ইউক্রেনিয়রা ব্যবহার করছে সৈন্যদের বিভিন্ন অবস্থানে সেনা এবং রসদ আনানেয়ার কাজে। এই এপিসিগুলি সেনাদেরকে কিছুটা হলেও শত্রুর ড্রোন থেকে রক্ষা করতে পারে। সাম্প্রতিক একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন-নির্মিত 'ম্যাক্সপ্রো' ‘এমর‍্যাপ' গাড়ির উইন্ডশিল্ডের উপর একটা 'এফপিভি' ড্রোন বিস্ফোরিত হলেও তা গাড়ির খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। তবে এটা নিঃসন্দেহে সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ একেক ধরণের গাড়ির দুর্বলতা একেক রকম। তাই এপিসি কেন, ট্যাঙ্কও সুইসাইড ড্রোনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ইউক্রেনিয়রা তাদের আহত সেনাদেরকে শুধুমাত্র রাতের আঁধারে সরাবার কাজ করে। এমনকি খুব বেশি আহত না হলে সেনাদেরকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়না। কোন কোন ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সেনাদের মাঝে সরাসরি গোলাগুলিও হচ্ছে না। যেমন, চাসিভ ইয়ার শহর কিছুটা উঁচু জায়গায় এবং সেখান থেকে আশেপাশের এলাকা দিয়ে যদি কোন গাড়ি অগ্রগামী হয়, তাহলে ধূলার কারণে সেটা কয়েক কিঃমিঃ দূর থেকে দেখা যায়। ইউক্রেনিয় সেনারা তখন 'এফপিভি' ড্রোনের মাধ্যমে অগ্রগামী রুশ গাড়িগুলির উপর হামলা করে।

ইউক্রেনিয় সেনারা কেউ কেউ ছোট্ট আকৃতির একটা ড্রোন ডিটেক্টর বহন করছে; যার মাধ্যমে তারা ১০কিঃমিঃএর মাঝে কোন ড্রোন থাকলে সেটার রেডিও সিগনাল ধরতে পারে। সিগনালের শক্তি থেকে তারা বুঝতে পারে ড্রোনটা কতটুকু দূরে রয়েছে। ইউক্রেনিয় সেনাদের কেউ কেউ পাম্প-একশন শটগানের সাথে বিশেষ প্রকারের গোলা বহণ করছে; যেগুলি 'এফপিভি' ড্রোন ধ্বংস করার জন্যে কাজে লাগে। তবে ড্রোন থামানোর সবচাইতে ভালো উপায়গুলির একটা হলো ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার; যা জ্যামিংএর মাধ্যমে ড্রোন অপারেটরের সাথে ড্রোনের রেডিও সিগনালে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাশিয়া এই কাজে দুনিয়ার সেরা। ইউক্রেনিয়রাও কিছু ড্রোন জ্যামার ব্যবহার করে; যেগুলি নিজেদের সেনাদের অবস্থান হতে ৬০-ডিগ্রি ডিরেকশনে ২ কিঃমিঃ পর্যন্ত এলাকায় শত্রুর ড্রোন আসতে বাধা দেয়। ইউক্রেনিয়রা বলছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই রুশ জ্যামিংএর কারণে চীনা-নির্মিত 'ম্যাভিক' ড্রোনগুলি ১৫ফিট উচ্চতাতেও উড়তে পারে না। রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে হামলা চালিয়ে ইউক্রেনিয় সেনারা নিয়মিতই এহেন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।

আকাশে যখন তেমন কোন মেঘ থাকে না, তখন ইউক্রেনিয় সেনারা বলে যে, ‘আকাশ নোংড়া'। কারণ এই আবহাওয়ায় আকাশে রুশ ড্রোনের আনাগোণা বাড়বে এবং ইউক্রেনিয়রা তাদের আর্টিলারি থেকে একটা গোলা ছোঁড়া মাত্রই রুশরা ইউক্রেনিয়দের অবস্থান দেখে ফেলবে এবং সেখানে আর্টিলারি দিয়ে গোলাবর্ষণ করবে। অপরদিকে উইক্রেনিয়রা তাদের সুইসাইড ড্রোনগুলিকে ব্যবহার করছে নিজেদের আর্টিলারির প্রতিস্থাপক হিসেবে। এগুলি দিয়ে রুশ ফ্রন্টলাইনের ৩০কিঃমিঃ পর্যন্ত পিছনের টার্গেটে হামলা করছে ইউক্রেনিয়রা। একারণে 'এফপিভি' ড্রোনের পাইলটরা রুশ বাহিনীর জন্যে প্রধান টার্গেটরূপে আবির্ভূত হয়েছে। আবার ইউক্রেনিয়রাও মার্কিন সরবরাহকৃত 'হিমার্স' রকেট আর্টিলারিগুলিকে ব্যবহার করেছে রুশ 'এফপিভি' ড্রোনের ট্রেনিং সেন্টারের বিরুদ্ধে; যেখানে বেশ কয়েকজন 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ছাত্র নিহত হয়েছিল। এমনকি 'মোজেস' নাম নিয়ে বিখ্যাত হওয়া এক রুশ 'এফপিভি' ড্রোন পাইলটকে ইউক্রেনিয়রা বিশেষ ড্রোন মিশনে হত্যা করেছে। 'ডারউইন' ছদ্মনামের একজন ইউক্রেনিয় 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ৩'শএর বেশি রুশ টার্গেট ধ্বংস করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। মোটকথা উভয় পক্ষের জন্যেই শ্ত্রুর ড্রোন অপারেশনসএর ঘাঁটি খুঁজে সেগুলিকে ধ্বংস করাটা হয়ে গিয়েছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটা ড্রোন ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারলে অনেকগুলি ড্রোন এবং এগুলির পাইলটদের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব।

ইউক্রেনিয়দের ডেভেলপ করা হেক্সাকপ্টার 'ভ্যামপায়ার'; যেগুলিকে রুশরা 'বাবা ইয়াগা' বলে ডাকে। এগুলি থারমাল ক্যামেরা বহণ করে বলে রাতের বেলাতেই এগুলির ব্যবহার বেশি। কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্যে তৈরি করা এই ড্রোন ১৫ কেজি পর্যন্ত বোমা বহণ করতে পারে। ছোট টার্গেটের বিরুদ্ধে ৪টা ছোট বোমা অথবা বাংকার বা ট্যাংকের বিরুদ্ধে একটা বড় এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন ব্যবহৃত হতে পারে। এগুলির আরেকটা ব্যবহার হলো সিগনাল রিপিটার হিসেবে। অর্থাৎ অন্যান্য ছোট ড্রোনের পাল্লা বৃদ্ধি করার জন্যে এই ড্রোনগুলি সিগনাল রিলে করে থাকে। 

 

ড্রোনের ব্যবহার – সদা পরিবর্তনশীল

কিছু বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে, যারা শুধু ড্রোন দিয়েই যুদ্ধ করে। ইউক্রেনিয় এরূপ বিশেষায়িত ইউনিটগুলির মাঝে একটা হলো 'মাগইয়ার বার্ডস' বা 'মাদইয়ার বার্ডস'। এটা একটা ড্রোন কোম্পানি। ইউক্রেনিয় ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ রবার্ট ব্রোভদি এই ইউনিটের নেতা; যাকে সবাই 'মাদইয়ার' বলে ডাকে। তিনি নিজ উদ্যোগে অর্থ জোগাড় করে ড্রোন কিনে ব্যবহার করা শুরু করেন। তার ইউনিটে রয়েছে কয়েক ডজন ড্রোন পাইলট এবং কয়েক'শ ড্রোন। ২০২২এর এপ্রিল থেকে অগাস্ট পর্যন্ত তার ইউনিট ছিল ২৮তম মেকানাইজড ব্রিগেডের অধীনে। এই ইউনিটের প্রধান কাজ হলো, ১) ফ্রন্টলাইন টহল দেয়া; ২) শত্রুদের অবস্থান খুঁজে বের করা, ৩) আর্টিলারির জন্যে টার্গেট ঠিক করে দেয়া; ৪) ‘কামিকাজি' বা সুইসাইড ড্রোন দিয়ে শত্রুর টার্গেটে হামলা করা; এবং ৫) ড্রোন থেকে শত্রুর অবস্থানের উপর বোমাবর্ষণ করা। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মিশনের জন্যে তারা অনেক প্রকারের ড্রোন ব্যবহার করলেও সবচাইতে বেশি হলো চীনে নির্মিত 'ডিজেআই ম্যাভিক' ড্রোন। চতুর্থ মিশনের জন্যে তারা সবচাইতে বেশি ব্যবহার করে 'এফপিভি' বা 'ফার্স্ট পারসন ভিউ' ড্রোন। এগুলি খুব দ্রুত উড়তে সক্ষম এবং অন্যান্য ড্রোনের মতো হাল্কাভাবে তৈরি নয়; বরং এগুলির বডি তৈরি করা হয় কার্বন ফাইবার দিয়ে। এর ফলে এগুলিকে উড়ন্ত অবস্থা থেকে ফেলা খুব সহজ নয়।

পঞ্চম মিশনের জন্যে বিভিন্ন প্রকারের ড্রোন ব্যবহার করা হয়। ছোট্ট চীনা ড্রোনগুলির নিচে আরপিজি রকেটের ওয়ারহেড আটকে দিয়ে সেগুলিকে হামলায় ব্যবহার করা হয়। আর কিছু ড্রোন আছে বড়; যেমন ইউক্রেনিয়দের ডেভেলপ করা হেক্সাকপ্টার 'ভ্যামপায়ার'; যেগুলিকে রুশরা 'বাবা ইয়াগা' বলে ডাকে। এগুলি থারমাল ক্যামেরা বহণ করে বলে রাতের বেলাতেই এগুলির ব্যবহার বেশি। কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্যে তৈরি করা এই ড্রোন ১৫ কেজি পর্যন্ত বোমা বহণ করতে পারে। ছোট টার্গেটের বিরুদ্ধে ৪টা ছোট বোমা অথবা বাংকার বা ট্যাংকের বিরুদ্ধে একটা বড় এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন ব্যবহৃত হতে পারে। এগুলির আরেকটা ব্যবহার হলো সিগনাল রিপিটার হিসেবে। অর্থাৎ অন্যান্য ছোট ড্রোনের পাল্লা বৃদ্ধি করার জন্যে এই ড্রোনগুলি সিগনাল রিলে করে থাকে। ইউক্রেনিয়দের নিজেদের ডেভেলপ করা 'আর-১৮' অক্টোকপ্টার ড্রোন একেকটা ১ দশমিক ৬ কেজি ওজনের ৩টা এন্টি-ট্যাঙ্ক গ্রেনেড নিয়ে ৩'শ মিটার উঁচু থেকে শত্রুর টার্গেটের ১ বর্গমিটারের মাঝে ফেলতে পারে। শত্রুর ট্যাংক, আর্মার্ড ভেহিকল, কামান, ট্রাক ইত্যাদি ১৭কেজি ওজনের এই ড্রোনের মূল টার্গেট। এটা ৫কিঃমিঃ দূর পর্যন্ত যেতে পারে এবং ৪৫ মিনিট আকাশে টহল করতে সক্ষম। এগুলিতে থারমাল ক্যামেরা থাকে; অর্থাৎ রাতের বেলাতেও আকাশ থেকে দেখতে পারে। এছাড়াও 'পানিশার' নামে ইউক্রেনিয়দের ডেভেলপ করা একটা 'ফিক্সড-উইং' ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে; যার পাল্লা হলো ৪৫কিঃমিঃ। এই ড্রোন ব্যবহার করে তার ২৫মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের 'টর' বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও ধ্বংস করেছে। ২০২২এর অগাস্টে 'মাদইয়ার'এর ইউনিটকে বাখমুতে ৫৯তম মটরাইজড ব্রিগেডের অধীনে স্থানান্তর করা হয়; যেখানে তারা ২০২৩এর মার্চ পর্যন্ত যুদ্ধ করে। টানা ১১০ দিন যুদ্ধ করার পর তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসে। ২০২৩এর নভেম্বর থেকে এই ইউনিট খেরসনের কাছাকাছি ক্রিনকিতে ইউক্রেনিয় ম্যারিন কোরের ৪১৪তম ম্যারিন স্ট্রাইক ইউএভি ব্যাটালিয়নের অংশ হিসেবে যুদ্ধ করছে। রবার্ট ব্রোভদি তার ইউটিউব চ্যানেলে এখন পর্যন্ত ৩৩১টা ভিডিও আপলোড করেছেন। তিনি দাবি করছেন যে, তার কোম্পানির সক্ষমতা রয়েছে এক মাসে কয়েক'শ আর্মার্ড ভেহিকল ধ্বংস করার; যা তারা কাজে করে দেখিয়েছেন। তার ইউনিট একদিনে ৫০টা সর্টিও করেছে। ২০২৩এর জুন মাসের মাত্র ৪ দিনে এই ইউনিট রুশদের ৩৫টা আর্মার্ড ভেহিকল ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাদের দাবি যে, তাদের ধ্বংস করা শত্রুর সরঞ্জামের মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মাদইয়ার বলছেন যে, তারা এমন কিছু প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন, যাতে করে লুকিয়ে থাকা শত্রু সেনাদের খুঁজে বের করা যায়। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো শত্রু সৈন্যদের হেলমেট অথবা মেশিনগানের আউটলাইন খুঁজে বের করা। ইউক্রেনের ড্রোন পাইলটদের মাঝে কেউ কেউ বেশ নাম করেছেন। বিখ্যাত 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট 'ডারউইন' মাত্র ১৮ বছর বয়সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। মেডিক্যাল ছাত্র ডারউইন প্রথমে ডাক্তার হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এরপর একসময় সে 'এফপিভি' ড্রোনের একটা ইউনিটে যোগ দেয়; কারণ সে একসময় ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত ছিল। তার 'ডারউইন' নামটা তার সতীর্থ একজন সেনা দিয়েছিল।

নিজেদের ওয়ার্কশপে বোমা তৈরি করছে ইউক্রেনিয়রা; যেগুলি ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে শত্রুর অবস্থানের উপর ফেলা হচ্ছে। বোমার ফিনগুলি থ্রি-ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে। মূল টেকনিশিয়ান গোলার কম্পোনেটগুলি তৈরি করে স্টক করে রাখেন। এরপর সেনারা তাদের অবসর সময়ে ওয়ার্কশপে এসে এই গোলা এসেম্বলির কাজ করে - কেউ বোরিংএর কাজ করে; কেউ ফিন এসেম্বলির কাজ করে; কেউ কার্তুজ ভর্তি করার কাজ করে। 

 
তবে ড্রোন ব্যবহারে নিজস্ব সেনাদের সাপ্লাই দিয়ে জীবিত রাখার একটা চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। ইউক্রেনের চাসিভ ইয়ার শহর রুশ সেনাদের হাতে চলে যাবার পর সেখানে কিছু ইউক্রেনিয় সেনা আটকা পড়ে। এই সেনাদেরকে ৭০ দিন রুশ সেনারা ঘিরে রেখেছিল। যে ড্রোনগুলি রুশ সেনাদের উপর বোমা ফেলতো, সেই ড্রোনগুলিই আটকে পড়া সেনাদেরকে সাপ্লাই দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। আটকে পড়া সেনারা বলছে যে, তাদের জন্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমস্যা ছিল না। কারণ তার শত্রু সেনাদের হত্যা করে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলি নিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু পানি ছিলো সবচাইতে বড় সমস্যা। তারা ময়লা পানি ছেঁকে পান করছিলো। খাবারও ছিল তাদের জন্যে অতি জরুরি জিনিস। ড্রোনের মাধ্যমে তাদের জন্যে পানি, ড্রাইফুড, চকলেট, ক্যান্ডি, সিগারেট পাঠানো হয়েছিলো। তাদের রেডিও ওয়াকি টকির ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে ড্রোন দিয়ে তাদের জন্যে চার্জার এবং পাওয়ার ব্যাংক পাঠানো হয়। এগুলি ব্যবহার করে তারা হেডকোয়ার্টাসের সাথে যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলো।

নিজেদের ওয়ার্কশপে বোমা তৈরি করছে ইউক্রেনিয়রা; যেগুলি ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে শত্রুর অবস্থানের উপর ফেলা হচ্ছে। বোমার ফিনগুলি থ্রি-ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে। চাসিভ ইয়ারে যুদ্ধ করা 'থান্ডার কোম্পানি' নামের ইউনিটের মধ্যবয়সী সেনাদের (পুরো ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের গড় বয়স ৪৩ বছর) এরকম একটা ছোট ওয়ার্কশপে ৫'শ শ্রাপনেল বোমা এবং ১ হাজারের বেশি আগুনে বোমা তৈরি করা হয়েছে। মূল টেকনিশিয়ান গোলার কম্পোনেটগুলি তৈরি করে স্টক করে রাখেন। এরপর সেনারা তাদের অবসর সময়ে ওয়ার্কশপে এসে এই গোলা এসেম্বলির কাজ করে - কেউ বোরিংএর কাজ করে; কেউ ফিন এসেম্বলির কাজ করে; কেউ কার্তুজ ভর্তি করার কাজ করে। আরেকটা ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কশপে 'এফপিভি' ড্রোন এসেম্বল করা হচ্ছে। তারা বলছে যে, যুদ্ধের শুরুর দিকে তারা সপ্তাহে ৫টা করে ড্রোন তৈরি করতো; এখন তারা দিনে ১'শটা ড্রোন তৈরি করে।

ইউক্রেনিয়রা একপ্রকারের ড্রোন ডেভেলপ করেছে, যেগুলি বোতলে করে ভীষণ প্রকারের দাহ্য একটা রাসায়নিক পদার্থ বহণ করে। ড্রোনটা যে পথ দিয়ে যায়, সেই পথ বরাবর আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে; অনেকটা ড্রাগনের মতো। এগুলি সাধারণতঃ কোন সামরিক গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় না; বরং রুশ সেনাদের পরিখা বরাবর এগুলিকে উড়িয়ে নেয়া হয়। এতে সেই পরিখার ভেতর থাকা রুশ সেনারা নিশ্চিত মৃত্যুর সন্মুখীন হয়। কোন কোন বিশ্লেষক এধরণের 'ড্রাগন' বা 'থারমাইট' ড্রোন ব্যবহারকে যুদ্ধাপরাধের সাথে তুলনা করেছেন।
 
রুশ 'টারটল' বা কচ্ছপ ট্যাংক। এগুলির উপরে জ্যামার বসানোর কারণে 'এফপিভি' ড্রোন এগুলিকে ধ্বংস করতে পারে না। তবে ট্যাঙ্কের উপর খাঁচা বসাবার কারণে ট্যাঙ্কের ক্রুরা আশেপাশে কিছুই দেখতে পায় না। আর ড্রোনের ভয়ে ট্যাঙ্কের সাথে সহায়তা দেয়ার জন্যে পদাতিক সেনাও থাকে না। এভাবে কোন ট্যাঙ্কের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোন প্রভাব তৈরি করা সম্ভব নয়।


ড্রোন আসলে কতটা সফল?

রিমোট কন্ট্রোল ড্রোনের মূল দুর্বলতা হলো, এটাকে রেডিও সিগনালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সিগনাল জ্যামিংএর মাধ্যমে ড্রোনের সাথে এর পাইলটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া সম্ভব। রুশরা সিগনাল জ্যামিংএ দুনিয়ার সেরা। ইউক্রেনিয়দের একটা ড্রোন ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, একটা রুশ 'টারটল ট্যাংক' ডনবাসে ক্রাসনোহরিভকা শহরে আক্রমণে এগুচ্ছে; সাথে রয়েছে আরেকটা ট্যাংক। ট্যাঙ্কগুলির আশেপাশে বেশকিছু ছোট বিস্ফোরণ হচ্ছে; যা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনিয় 'হিমার্স' রকেটের মাঝে থাকা 'ক্লাস্টার' বা গুচ্ছ বোমা। এর মাঝে ট্যাঙ্কগুলি থেকে কিছুটা দূরে দু'টা বিস্ফোরণ দেখা যায়। যদিও বোঝা যাচ্ছে না যে, এই বিস্ফোরণগুলি কিসের, তথাপি এগুলি 'এফপিভি' ড্রোন হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। খুব সম্ভবতঃ ট্যাঙ্কের উপরে বসানো জ্যামারের কারণে ড্রোনগুলি এর কাছে ভিড়তে পারছে না। এই আক্রমণে ইউক্রেনিয়রা অনেক চেষ্টা করেও রুশদের 'টারটল' ট্যাঙ্ক ধ্বংস করতে পারেনি; যদিও সেগুলি প্রচুর ব্যবহৃত হচ্ছিলো; যা রুশদের জ্যামার ব্যবহার করার দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এটা এমন নয় যে, রুশরা ড্রোন থেকে বাঁচার জাদুর ঔষধ পেয়ে গেছে; বরং তারা যে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল অবলম্বণ করছে, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। ভিডিওতে দেখা যায় যে, 'টারটল' ট্যাঙ্ক পুরো শহর জুড়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ঘুরছে। কারণ ট্যাঙ্কের উপর খাঁচা বসাবার কারণে ট্যাঙ্কের ক্রুরা আশেপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আর ড্রোনের ভয়ে ট্যাঙ্কের সাথে সহায়তা দেয়ার জন্যে পদাতিক সেনাও নেই। এভাবে কোন ট্যাঙ্কের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোন প্রভাব তৈরি করা সম্ভব নয়।

তবে শুধু রুশ ট্যাঙ্কই যে ড্রোন আক্রমণের সমস্যায় পড়েছে তা কিন্তু নয়। ২০২৪এর ফেব্রুয়ারি মাসে ডনবাসের আভদিভকা শহরের কাছে ইউক্রেনের ৪৭তম ব্রিগেডের মার্কিন-নির্মিত একটা 'এম-১এ১' ট্যাঙ্কের উপর ড্রোন হামলার ভিডিও প্রকাশিত হয়। সেখানে দাবি করা হয় যে, রুশরা একটা 'পিরানহা' ‘এফপিভি' ড্রোনের মাধ্যমে ট্যাঙ্কটাকে অচল করে ফেলেছে; যেটাকে বলা হচ্ছে 'মোবিলিটি কিল'; অর্থাৎ এই ট্যাঙ্কের ট্র্যাক বা ইঞ্জিনে আঘাত করে সেটাকে চলাচলের অনুপযুক্ত করে ফেলা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় আরেকটা ড্রোন এসে ট্যাঙ্কের পিছন দিকে আঘাত করার পর বিস্ফোরণে ট্যাঙ্কের গোলাবারুদে আগুন ধরে যায়। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মাঝে ইউক্রেন একই জায়গায় তিনটা 'এম-১এ১' ট্যাঙ্ক হারায়। এরপর এই মডেলের আরও ট্যাঙ্ক ধ্বংসের খবর পাওয়া যায়। পশ্চিমাদের দেয়া সর্বাধুনিক ১৩০টার মতো 'এম-১এ১', ব্রিটিশ 'চ্যালেঞ্জার-২' এবং জার্মান 'লেপার্ড-২' ট্যাঙ্কের মাঝে প্রায় ৪০টার মতো ট্যাঙ্ক ইতোমধ্যেই ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বের সেরা ট্যাঙ্ক হলেও এই ট্যাঙ্কগুলি ড্রোনের হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। আর ইউক্রেনিয়রাও ট্যাঙ্কগুলিকে খোলা জায়গায় ব্যবহার করছে খুব কমই। বেশিরভাগ সময়ই ট্যাঙ্কগুলিকে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে। এছাড়াও এই ট্যাঙ্কগুলি অত্যন্ত ভারি হওয়ায় ইউক্রেনের মাটিতে চলার জন্যে তেমন একটা উপযুক্ত নয়। ইউক্রেনের সেনারা বলছে যে, ট্যাঙ্কগুলি নরম কাদায় আটকে যাচ্ছে বিধায় এগুলিকে সর্বত্র ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

ইউক্রেনিয় সেনা 'এফপিভি' ড্রোন ওড়াচ্ছে। একজন অভিজ্ঞ এবং একজন অনভিজ্ঞ ড্রোন পাইলটের মাঝে পার্থক্য অনেক। 'এফপিভি' ড্রোনের পাইলটরা রুশ বাহিনীর জন্যে প্রধান টার্গেটরূপে আবির্ভূত হয়েছে। আবার ইউক্রেনিয়রাও মার্কিন সরবরাহকৃত 'হিমার্স' রকেট আর্টিলারিগুলিকে ব্যবহার করেছে রুশ 'এফপিভি' ড্রোনের ট্রেনিং সেন্টারের বিরুদ্ধে; যেখানে বেশ কয়েকজন 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ছাত্র নিহত হয়েছিল। এমনকি 'মোজেস' নাম নিয়ে বিখ্যাত হওয়া এক রুশ 'এফপিভি' ড্রোন পাইলটকে ইউক্রেনিয়রা বিশেষ ড্রোন মিশনে হত্যা করেছে। 'ডারউইন' ছদ্মনামের একজন ইউক্রেনিয় 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ৩'শএর বেশি রুশ টার্গেট ধ্বংস করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। মোটকথা উভয় পক্ষের জন্যেই শ্ত্রুর ড্রোন অপারেশনসএর ঘাঁটি খুঁজে সেগুলিকে ধ্বংস করাটা হয়ে গিয়েছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটা ড্রোন ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারলে অনেকগুলি ড্রোন এবং এগুলির পাইলটদের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব।

 
রুশ জ্যামিং মোকাবিলা করতে ইউক্রেন ব্যবহার করছে নিজেদের ডেভেলপ করা 'এসিএস-৩' ড্রোন; যা প্রকৃতপক্ষে 'রে-বার্ড-৩' নামের বেসামরিক ড্রোন থেকে ডেভেলপ করা। ফিক্সড উইংএর এই ড্রোন ওড়ার আগে একটা রুট নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়; যা বরাবর তা উড়তে থাকে; অর্থাৎ সরাসরি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না। ফলে কোন জ্যামিং এগুলির উপর কাজ করে না। এর প্রস্তুতকারক কোম্পানি একটা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ডেভেলপ করেছে; যার মাধ্যমে এই ড্রোনের তোলা ছবি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টার্গেট খুঁজে বের করা যায়। এই ড্রোন চলে পেট্রোল ইঞ্জিনে এবং একনাগারে ৩০ ঘন্টারও বেশি আকাশে থাকতে পারে। আড়াই লক্ষ ডলার মূল্যের এই ড্রোন একটা ক্যাটাপাল্টের মাধ্যমে ওড়ানো হয় এবং নামার সময় নির্দিষ্ট স্থানে এসে প্যারাশুট দিয়ে নামে। ২৩ কেজি ওজনের এই ড্রোন ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১৮০কিঃমিঃ গতিতে চলে এবং ৩ হাজার মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। এই ড্রোনগুলি রুশ ফ্রন্টলাইনের পিছনে ১৬০কিঃমিঃ পর্যন্ত অপারেট করেছে এবং একটা ড্রোনের ৮০টা মিশনও সফলভাবে সম্পাদনের রেকর্ড রয়েছে। মার্কিন সরবরাহকৃত 'হিমার্স' এবং অন্যান্য দূরপাল্লার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট খোঁজার জন্যে এই ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছে। গ্লাস-ফাইবার দিয়ে তৈরি করার কারণে এটা রাডারে খুবই ছোট আকৃতির দেখা যায়। ইউক্রেনিয়রা এই ড্রোন ইলেকট্রিক মোটর দিয়ে ওড়ানোর চেষ্টা করছে, যাতে করে এর হীট সিগনেচার আরও কমে যায় এবং থারমাল ক্যামেরা দিয়েও এটাকে টার্গেট করা না যায়। ২০২৪এর অগাস্টে একটা 'এসিএস-৩' ড্রোন ফ্রন্টলাইন থেকে ২'শ কিঃমিঃ দূরে রাশিয়ার ক্রাসনোদার শহরের কাছে ভূপাতিত করা হয়।

উভয় পক্ষই সোশাল মিডিয়াতে ড্রোনের সাফল্যের ভিডিও আপলোড করছে; কেউই তাদের নিজেদের ব্যর্থতাকে দেখাতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা ড্রোন সফল হতে পারে না। গড়ে একটা ড্রোনের সাফল্য পেতে হলে ৮-৯টা ড্রোনকে ব্যর্থ হতে হয়। হয় এগুলির ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যায়, অথবা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়, অথবা জ্যামিংএর মাধ্যমে অকার্যকরা করে ফেলা হয়। 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'এর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে, একটা 'এফপিভি' ড্রোন চালাতে চালাতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে সিগনাল জ্যামিংএর কারণে। ইউক্রেনিয় বর্ডার গার্ডের একটা 'এরো স্কাউট' ইউনিটএর কমান্ডার বলছেন যে, তারা একদিনে ১০টা পর্যন্ত ড্রোন হারিয়েছেন। আর একটা বোমারু ড্রোন টার্গেটের কাছে পৌঁছাতে পারলেই যে টার্গেটের উপর সাফল্যের সাথে বোমা ফেলতে পারবে, তারও কিন্তু গ্যারান্টি নেই; বিশেষ করে ড্রোন পাইলট যদি অনভিজ্ঞ হয়। কয়েক'শ ফুট উঁচু থেকে চলমান একটা টার্গেটের উপর নিখুঁতভাবে বোমা ফেলা মোটেই সহজ নয়। আর যদি বাতাস বেশি থাকে অথবা আবহাওয়া খারাপ থাকে, তাহলে ড্রোনের সাফল্য আরও অনেক কমে যায়। একারণেই ইউক্রেনিয়রা শুধুমাত্র ড্রোনের উপরেই নির্ভর করছে না। এখনও উভয় পক্ষের হতাহতের মূল কারণ হলো আর্টিলারি। একজন অনভিজ্ঞ 'এফপিভি' ড্রোন পাইলটের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে একটা ঘটনা থেকে। ইউক্রেনিয় একজন ইউনিট কমান্ডারের এসইউভি গাড়িতে 'এফপিভি' ড্রোন হামলা করে। প্রথম ড্রোনটা গাড়ির পিছন দিকে হামলা করে ব্যাপক ক্ষতি করে; তবে আরোহীদের কিছু হয়নি; কারণ তাদের গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ছিল। আরোহীরা গাড়ি থেকে বের হয়ে আধাঘন্টা লুকিয়ে থাকে। এর মাঝে দ্বিতীয় ড্রোন এসে গাড়ির পিছনের বাম্পারে আঘাত করে। দু'টা ড্রোনের আঘাতের পরেও গাড়ির ইঞ্জিন সচল থাকে এবং তারা সেটাকে চালিয়ে ঘাঁটিতে ফেরত আসেন। বেঁচে যাওয়া কমান্ডার বলছেন যে, একজন অভিজ্ঞ পাইলট তার ড্রোনটাকে ঘুরিয়ে এনে সামনের উইন্ডস্ক্রীন বরাবর হামলা করতো। এতে তাদের দু'জনেরই বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না।

একজন ইউক্রেনিয় সেনা 'এফপিভি' ড্রোনের সাথে ব্যাটারি প্যাক এবং আরপিজি গ্রেনেড লাগাচ্ছে। উভয় পক্ষই সোশাল মিডিয়াতে ড্রোনের সাফল্যের ভিডিও আপলোড করছে; কেউই তাদের নিজেদের ব্যর্থতাকে দেখাতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা ড্রোন সফল হতে পারে না। গড়ে একটা ড্রোনের সাফল্য পেতে হলে ৮-৯টা ড্রোনকে ব্যর্থ হতে হয়। হয় এগুলির ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যায়, অথবা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়, অথবা জ্যামিংএর মাধ্যমে অকার্যকরা করে ফেলা হয়।

 
যুদ্ধ জয়ের কোন একক ম্যাজিক ফর্মূলা নয় ড্রোন। তবে ড্রোন ছাড়া যুদ্ধ জেতাও অসম্ভব হয়ে গেছে; যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে হয়েছিল ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। একইসাথে যুদ্ধজয়ের সংজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইউক্রেন প্রচুর প্রযুক্তি ব্যবহারের পরেও সংখ্যার দিক থেকে যুদ্ধ হেরে যাচ্ছে; আর রাশিয়া নিজের ক্ষয়ক্ষতিকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্টিমরোলার চালিয়ে এগুচ্ছে। একদিকে যেমন শত্রুর শক্ত অবস্থান অতিক্রম করে আক্রমণে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে, তেমনি একবার কোন একটা দেশ অন্য দেশের ভূমি দখল করে ফেললে সেই ভূমি পুনরুদ্ধার করাও কঠিন হয়ে গেছে। যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার 'সারপ্রাইজ' আক্রমণ পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের খারকিভ এবং কুর্স্কএ সারপ্রাইজ হামলা প্রাথমিকভাবে সফলতা পেলেও শেষ পর্যন্ত কঠিন পরিখা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কম খরচে আক্রমণে যাওয়া ততক্ষণ পর্যন্তই সম্ভব, যতক্ষণ 'সারপ্রাইজ' ফ্যাক্টর কাজ করছে। শত্রু যদি সময় পেয়ে পরিখা খুঁড়ে অবস্থান নেয়, তাহলে তাকে সেখান থেকে উৎখাত করা অত্যধিক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। হয়তো ড্রোনের সুবাদে ডিফেন্সিভ লাইনে থাকা সেনাদের সুবিধা হয়েছে; কিন্তু আক্রমণে যাবার সময়েও ড্রোন ছাড়া চলছে না। তবে সর্বদা আকাশ থেকে কেউ দেখছে - এই ব্যাপারটাই একটা সৈন্যের মনে ভয় ধরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট; সে পরিখার ভেতরে থাকুক, অথবা খোলা জায়গায়ই থাকুক। আপাততঃ পরিখার ভেতরটাই সৈন্যদের জন্যে কিছুটা হলেও নিরাপদ। সেই হিসেবে আবারও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা যুদ্ধের দিকেই তাকাতে হচ্ছে। পরিখা থেকে সৈন্যদের উৎখাত করার নতুন কোন সহজ পদ্ধতি আসার আগ পর্যন্ত আক্রমণকারীকে শুধুমাত্র 'সারপ্রাইজ' ফ্যাক্টরের উপরেই নির্ভর করতে হবে।

Tuesday, 10 December 2024

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন – কি হতে চলেছে?

১০ই ডিসেম্বর ২০২৪

পশ্চিমারা মূলতঃ সিরিয়াকে দেখছে পশ্চিমা গণতন্ত্রের চশমা দিয়ে। যদি সিরিয়ার ভবিষ্যৎ পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সেটা তাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই পশ্চিমারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী সিরিয়া গড়তে তাদের প্রভাব ব্যবহার করতে প্রস্তুত। সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে কেউই খুব একটা আশাবাদী নয়। তবে গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ইসলামিক আইন বাস্তবায়নকে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্র চোখ রেখেছে যাতে সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের গ্রুপগুলিও থাকবে। যদি তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের এই ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে সিরিয়ার সকল গ্রুপের উপর যথেষ্ট প্রভাব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থিত কুর্দী গ্রুপ 'এসডিএফ'এর অধীনে আটক আইসিস সদস্যদেরকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।


১২ দিনে বাশারের পতন – কেউ কি সম্ভব ভেবেছিল?

সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন কতটা অবাক করার মতো ছিল, সেটা পশ্চিমা চিন্তাবিদদের কথা শুনলেই বোঝা যায়। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক 'ইউরেশিয়া গ্রুপ'এর প্রতিষ্ঠাতা ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার আসাদ সরকারের পতনের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে বলছিলেন যে, তিনি মনে করেন না যে, বাশার সরকারের পতনের কোনরূপ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তার ধারণা ছিল রাশিয়া এবং ইরান তাদের সকল শক্তি দিয়ে বাশারকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। একইসাথে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, তুরস্কের সহয়াতায় শুরু হওয়া এই আক্রমণের লক্ষ্য দামাস্কাস দখল ছিল না। কারণ সিরিয়ার এতবড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা তুরস্কের নেই। বিশেষ করে ইরান যদি সিরিয়া ত্যাগ করে চলে যায়, তাহলে এখানে সৃষ্ট শূণ্যাবস্থা মারাত্মক অনিশ্চয়তা এবং অরাজকতা জন্ম দিতে পারে। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'এমআই-৬'এর প্রাক্তন প্রধান জন সয়ার্স 'স্কাই নিউজ'এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, এত স্বল্প সময়ে বাশার সরকারের পতন ঘটে যাবে, সেটা কোন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা কেন, ‘এইচটিএস'এর নেতারাও হয়তো চিন্তা করতে পারেনি। বিশেষ করে বাশার আল-আসাদের অনুগত বাহিনী যে এত দ্রুত ভেঙ্গে যাবে, সেটা কেউই চিন্তা করতে পারেনি।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর মাইকেল ক্লার্ক 'স্কাই নিউজ'কে বলছেন যে, সিরিয়ার আগে অন্যান্য যুদ্ধেও একটা সেনাবাহিনীকে কয়েকদিনের মাঝে ধ্বসে পড়তে দেখা গেছে। যেমন, গাদ্দাফির পতনের পর দাবানলের মতো লিবিয়ার সবগুলি শহরের পতন হয়েছিল। ২০১৪ সালে আইসিসের উত্থানের সময়ও তারা দুই সপ্তাহের মাঝে ইরাক এবং সিরিয়ার বিশাল এলাকা দখলে নিয়ে নিয়েছিল। এবারে সিরিয়ার ক্ষেত্রে রুশ বিমান হামলা বিদ্রোহীদেরকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে মাইকেল ক্লার্ক অবাক হয়েছেন যে, সিরিয় সেনাবাহিনী একেবারেই যুদ্ধ করেনি। যখন সিরিয় সেনা অফিসাররা তাদের ইউনিট ছেড়ে পালাচ্ছিল, তখন সেনাদের বেসামরিক পোষাক পড়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর যখন এক স্থানে সেনাবাহিনী ধ্বসে পড়ে, তখন অন্যান্য এলাকার জন্যেও সেটা উদাহরণ হয়ে যায়। আসাদের বাহিনী তিনদিক থেকে তিনটা গ্রুপের আক্রমণের শিকার হয়েছিল; যেমন, উত্তর দিক থেকে আসছিল 'এইটিএস'; দক্ষিণে দেরা থেকে আসছিল 'সাউদার্ন ফ্রন্ট' নামে অনেকগুলি গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত একটা বাহিনী; আর পূর্বে দেইর-ইজ-জর থেকে আসছিল কুর্দীদের নেতৃত্বের আরেকটা বাহিনী। এতগুলি বাহিনীর আক্রমণের মুখে বিদ্রোহীরা যখন সিরিয় সেনাবাহিনীকে বলেছে যে, তোমরা যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেলে কারুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া হবে না, তখন সিরিয় সেনারা অস্ত্র ফেলে দিয়েছে। বাশারের পতনের সময় রাশিয়া এবং ইরান খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। রাশিয়ার খুব বেশি সেনা সিরিয়াতে ছিল না; তারা মূলতঃ বিমানশক্তি দিয়ে সহায়তা দিয়েছে। আর ইরান মূলতঃ 'আইআরজিসি'র 'আল-কুদস ফোর্স' এবং বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপের মাধ্যমে সহায়তা দিয়েছে। উভয়েই প্রকৃতপক্ষে কম খরচে বাশারকে টিকিয়ে রেখেছিল; মূল যুদ্ধটা বাশারের লোকেরাই করেছে। বাশারের লোকেরাই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ৬ লক্ষ মৃত্যুর মাঝে ৪ লক্ষ্যের জন্যে সরাসরি দায়ী। এই হত্যাকারীদের টিকিয়ে রাখতে খুব বেশি সহায়তার প্রয়োজন হয়নি; কারণ হত্যাকারীরা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতেই যুদ্ধ করেছে।

মাইকেল ক্লার্কের কথায় এটা পরিষ্কার যে, সিরিয়ার উত্তর থেকে আসা 'এইচটিএস'এর অধীন বাহিনী অনেকগুলি বাহিনীর একটা বাহিনী ছিল মাত্র। আর বাশারের পতনের আগে ইয়ান ব্রেমারের কথাতেও এটা বোঝা যায় যে, পশ্চিমারা হিসেব করেছিল যে, শুধুমাত্র 'এইচটিএস'এর পক্ষে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়। তারা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিল যে, ‘এইচটিএস' তাদের পূর্বের ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। একারণেই তুরস্ক 'এইচটিএস'কে সহায়তা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে 'এইচটিএস'এর অভিযানের সাথেসাথে বাকি সকল গ্রুপও যে অভিযানে যাবে, সেটা কেউই হিসেব করেনি। আর বাশারের সেনারাও যে যুদ্ধ না করে অস্ত্র ফেলে দেবে, সেটাও কেউ ভাবেনি। আবার রাশিয়া আর ইরানও যে বাশারকে রক্ষায় যথেষ্ট ছিল না, সেটাও অনেকেরই হিসেবের বাইরে ছিল।
 
বাশার আল-আসাদের পতন কেউই চিন্তা করতে পারেনি। তুরস্ক যে এই অভিযানের নেপথ্যে ছিল, তা পশ্চিমাদের কথাতেই পরিষ্কার। আর তুরস্ক বা পশ্চিমারা যে বাশারকে সরাতে চায়নি, সেটাও নিশ্চিত। তারা কেউই পরিকল্পনা করেনি যে, ‘এইচটিএস'এর সাথে বাকি সিরিয় গ্রুপগুলিও যুক্ত হবে; তারা চিন্তাও করেনি যে বাশারের বাহিনী যুদ্ধ করবে না; তারা বোঝেনি যে রাশিয়া এবং ইরান তাদের সমর্থন সরিয়ে নেবে। মোটকথা, সিরিয়ার বর্তমান ফলাফল কেউই পরিকল্পনা করেনি; সৃষ্টিকর্তা ব্যাতিরেকে। 


সিরিয়ার পট পরিবর্তনকে পশ্চিমারা কিভাবে দেখছে?

পশ্চিমারা মূলতঃ সিরিয়াকে দেখছে পশ্চিমা গণতন্ত্রের চশমা দিয়ে। যদি সিরিয়ার ভবিষ্যৎ পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সেটা তাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই পশ্চিমারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী সিরিয়া গড়তে তাদের প্রভাব ব্যবহার করতে প্রস্তুত। ‘বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ‘আস্তানা প্রসেস'এর অংশ হিসেবে তুরস্ক, রাশিয়া এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দোহাতে আলোচনা করছিলেন। এই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের মাঝে একটা ঐক্যে পৌঁছানো। তবে ক্ষমতা পরিবর্তনে বাশার আল-আসাদ কোনরূপ আগ্রহী ছিলেন না; যার মূল্য তাকে দিতে হয়েছে ক্ষমতা হারিয়ে। যদিও বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে থাকা 'হায়াত তাহরির আল-শাম' বা 'এইচটিএস'এর নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জুলানি বলেছেন যে, তারা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর চাইছেন, তথাপি যে ব্যাপারটা বাস্তবতা তা হলো 'এইটিএস' হলো অনেকগুলি গ্রুপের মাঝে একটা গ্রুপ। এখানে নতুন সিরিয়া যদি আফগানিস্তানের মতো (পশ্চিমা সংজ্ঞার) মানবাধিকার এবং নারী অধিকারকে পদদলিত করে, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। আবার লিবিয়ার মতো নিজেদের মাঝে যে তারা দ্বন্দ্বে জড়াবে না, সেটাও নিশ্চিত নয়।

জন সয়ার্স বলছেন যে, ১০-১২ বছর আগে তিনি যখন 'এমআই-৬'এর প্রধান ছিলেন, তখন তাদেরকে হিসেব করতে হয়েছে যে, সিরিয়ার কোন কোন বিদ্রোহী গ্রুপকে অস্ত্র সহায়তা দেয়া যায়। এর মাঝে 'এইচটিএস' ছিল সহায়তা না-পাওয়া গ্রুপের মাঝে। তবে গত ১০ বছরে 'এইটিএস'এর নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জুলানি তার দলকে 'আল-কায়েদা' থেকে দূরে সরিয়ে আনার জন্যে যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এবং গত দুই সপ্তাহে 'এইটিএস'এর কর্মকান্ড ছিল মুক্তিকামী বাহিনীর মতোই; সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মতো নয়। এবং এখন হয়তো ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সকে চিন্তা করতে হবে যে, তারা এখনও 'এইচটিএস'কে সন্ত্রাসী সংগঠন বলবে কিনা। কারণ এক দশক আগে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হয়েছিল বলে সেই যুক্তিতে বর্তমানে সিরিয়ায় সরকার গঠন করা একটা দলের সাথে ব্রিটিশরা কোনরূপ যোগাযোগ না রাখলে সেটা সত্যিই ভুল হবে।

সিরিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে সকলে ততটা আশাবাদী নন। মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশকে শাসন করতেই কোন না কোন প্রকারের স্বৈরশাসক প্রয়োজন হচ্ছে। একমাত্র ব্যাতিক্রম হয় তিউনিসিয়া; যেখানে কিছুদিনের জন্যে বহুদলীয় গণতন্ত্র চললেও সেটাও ধ্বসে গিয়ে আবারও একনায়কের অধীনে চলে গিয়েছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ।

তুরস্ক জিতেছে; কিন্তু যা সে জিতেছে, তা সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা, সেটা নিশ্চিত নয়। রাশিয়া হেরেছে। সিরিয়াতে রুশদের সামরিক ঘাঁটি রাখতে হলে তুরস্কের প্রভাবের (কতটা, তা নিশ্চিত নয়) উপর নির্ভর করতে হবে। এরদোগান এই ঘাঁটি নিয়ে পুতিনের সাথে দরকষাকষি করতে পারেন। 


তুরস্কের প্রভাব বাড়লো কি?

‘বিবিসি'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরকে সহায়তা দিয়েছে। বিদ্রোহীদের বেশিরভাগই ইসলামপন্থী বা রাষ্ট্রের কর্মকান্ডের মাঝে ইসলামকে রাখার পক্ষপাতি; যেমন মুসলিম ব্রাদারহুড; তুরস্কের বর্তমান সরকার এদের মতোই। তবে এদের মাঝে কেউ কেউ রয়েছে, যারা ইসলামিক আইন দিয়েই রাষ্ট্র চালানোর পক্ষপাতি; এদের মাঝে জিহাদি গ্রুপও রয়েছে। তুরস্কের স্বার্থ রয়েছে তার দক্ষিণ সীমানায় একটা স্থিতিশীল সিরিয়া দেখার। এছাড়াও সিরিয়ার কুর্দীদের ব্যাপারেও তুরস্কের স্বার্থ রয়েছে। কুর্দিদের হাতে আইসিসের অনেক যুদ্ধবন্দী রয়েছে। মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, কুর্দীদের মাঝে 'পিকেকে' সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে, যেগুলির প্রভাবকে তুরস্ক নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। উত্তর সিরিয়াতে তুরস্কের তৈরি করা 'বাফার জোন'কেও তুরস্ক হয়তো বড় করতে চাইছে। আর তুরস্কে প্রায় ২০ লাখের মতো সিরিয় শরণার্থী রয়েছে; যাদেরকে তুরস্ক সিরিয়াতে ফেরত পাঠাতে চাইছে। 'সিএনএন'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রাক্তন মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক মতি দিচ্ছেন যে, তুরস্ক নিঃসন্দেহে 'এইচটিএস'এর পিছনে ছিল। এটা কুর্দীদের (যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গ্রুপগুলির) জন্যে ভালো খবর নয়। 'সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস' বা 'এসডিএফ' নামের কুর্দী গ্রুপকে (যাদেরকে তুরস্ক 'পিকেকে' সন্ত্রাসীর সহযোগী বলে থাকে) যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিচ্ছে। তবে তুরস্কের এরদোগান এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চান; যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে যায়। জেনারেল ক্লার্ক মনে করছেন যে, সিরিয়াতে যে সরকার গঠিত হবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত কিছু গ্রুপকে (তিনি খুব সম্ভব 'এসডিএফ'কে বোঝাচ্ছেন) হয়তো বাইরে রাখা হতে পারে। আর 'এসডিএফ'এর হাতে থাকা আইসিসের সদস্যরা যদি ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে পুরো অঞ্চলে ভয়াবহ পরিস্থতির অবতারণা হতে পারে।

'এইচটিএস'এর উত্থানের পেছনে তুরস্কের হাত ছিল কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে 'এমআই-৬'এর প্রাক্তন প্রধান জন সয়ার্স বলে যে, সহযোগিতা, ট্রেনিং এবং সাপ্লাইএর ক্ষেত্রে ‘এইচটিএস' তুরস্কের সবচাইতে কাছের বন্ধু ছিল না। তবে ঘটনাপ্রবাহ তুরস্কের জন্যে খুবই সুবিধাজনক দিকে গিয়েছে। এবং এই ঘটনার ফলে বর্তমানে তুরস্ক এই অঞ্চলে সবচাইতে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। বিজয়ীদের মাঝে অনেকগুলি গ্রুপ রয়েছে; তুরস্ক এই গ্রুপগুলিকে একত্রে নিয়ে এসে নতুন সরকার গঠনে বড় ভূমিকা নিতে পারে। সকলেই বাশারের অত্যাচারী সরকারের পরিবর্তন দেখতে চেয়েছে; তবে সামনের দিনগুলি যে অনিশ্চিত হবে, সেটা এড়িয়ে যাবার অবকাশ নেই। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন যে, বাশার সরকারের প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে না গিয়ে সরকার পরিবর্তনের কাজকে সহজ করার কাজ করছেন এবং একইসাথে বিজয়ী বিদ্রোহীরা কোন গ্রুপের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন প্রতিশোধের কর্মকান্ডে জড়িত হয়নি। আসাদ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় সরকার-বিরোধীদের উপরে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে; যেগুলির হিসেব কোন একটা সময় হলেও চুকাতে হবে।
 
সিরিয়ায় পট পরিবর্তনে সবচাইতে বড় ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ার। সিরিয়াতে রাশিয়ার দু'টা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে - তারতুসে নৌঘাঁটি এবং লাতাকিয়াতে বিমান ঘাঁটি। এরদোগান তার প্রভাব খাটিয়ে সিরিয়াতে রুশ সামরিক ঘাঁটি রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন; আবার দরকার হলে সেটা রাশিয়াকে না-ও দিতে পারেন। এরদোগান দরকার হলে পুতিনের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে এই নৌঘাঁটিকে ব্যবহার করতে পারেন।


রাশিয়া এবং ইরান কি কি হারালো?

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, সিরিয়ায় পট পরিবর্তনে সবচাইতে বড় ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ার। সিরিয়াতে রাশিয়ার দু'টা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে - তারতুসে নৌঘাঁটি এবং লাতাকিয়াতে বিমান ঘাঁটি। তারতুস হলো ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটি। এই ঘাঁটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে তার অবস্থান হারাবে। আর লাতাকিয়াতে বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে রাশিয়া আফ্রিকায় তাদের বন্ধু দেশগুলির সাথে যোগাযোগ রাখে। এক্ষেত্রে লাতাকিয়া একেবারে অবশ্য প্রয়োজনীয় না হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জন সয়ার্স মনে করছেন যে, সিরিয়ার ভবিষ্যতকে কিছুটা হলেও লিবিয়ার সাথে তুলনা দেয়া যেতে পারে; যেখানে গাদ্দাফী সরকারের পতনের পর বাইরের শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থে লিবিয়াকে বিভক্ত করেছে। নতুন সিরিয়াতে বাশার সরকারের অনুগতরা হয়তো কিছু এলাকায় সহিংসতার আশ্রয় নিতেও পারে। একইসাথে বাশারকে সহায়তা দেয়া রাশিয়াও চাইবে সিরিয়ার ভূমধ্যসাগর উপকূলে তারতুস বন্দরে তাদের সামরিক ঘাঁটিকে টিকিয়ে রাখতে। সেই হিসেবে তারাও সিরিয়ার নতুন সরকারের সাথে কোন এক প্রকার সমঝোতায় যেতে চাইবে। মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক বলছেন যে, এরদোগান তার প্রভাব খাটিয়ে সিরিয়াতে রুশ সামরিক ঘাঁটি রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন; আবার দরকার হলে সেটা রাশিয়াকে না-ও দিতে পারেন। এরদোগান দরকার হলে পুতিনের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে এই নৌঘাঁটিকে ব্যবহার করতে পারেন।

'বিবিসি'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, আরব বসন্তের সময় যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধু হোসনি মুবারককে রক্ষা করেনি; কিন্তু রাশিয়া বাশার আল-আসাদকে রক্ষা করেছে; যদিও এতে রাশিয়ার স্বার্থ ছিলো। সিরিয়ার তারতুস হারালে রাশিয়া লিবিয়ার খলিফা হাফতারের অধীনে থাকা বেনগাজিতে তাদের নৌঘাঁটি সরিয়ে নেবার চেষ্টা করতে পারে। এর মাধ্যমে সিরিয়ার ঘাঁটি হারিয়েও রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে থাকতে পারে। তবে এরপরেও সিরিয়ায় রাশিয়ার ভূকৌশলগত ক্ষতিই হয়েছে।

‘বিবিসি'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সিরিয়ার অনেকেই মনে করতো যে, দেশটা ইরানের নিয়ন্ত্রণে চলছিলো। ২০১৫ সালে রাশিয়ার বিমান হামলা এবং ইরানের 'আইআরজিসি' ও লেবাননের হিযবুল্লাহর সেনাদের সহায়তা ছাড়া বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় থাকতে পারতো না। সিরিয়াকে ব্যবহার করেই ইরান লেবাননে হিযবুল্লাহকে সহায়তা দিচ্ছিলো। কিন্তু ইস্রাইলের সাথে যুদ্ধ করে হিযবুল্লাহ এবং ইরানের কতটা ক্ষতি হয়েছে, সেটার ফলাফল এখন সিরিয়ায় দেখা গেলো। আর এর পুরোটাই শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে ৭ই অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে গাজা থেকে ইস্রাইলের উপর হামলা দিয়ে। সেই হামলা থেকেই শুরু হয়েছে একটা 'চেইন রিয়্যাকশন', যার ফলাফল প্রতিফলিত হয়েছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। আর এই সুযোগটাই সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কাজে লাগিয়েছে। তারা হিসেব করেছে যে, রাশিয়া ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত এবং ইরান ও হিযবুল্লাহ বাশারকে যথেষ্ট সহায়তা দেয়ার মতো শক্তিশালী অবস্থানে নেই।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, সিরিয়ার পরিবর্তনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতি হয়েছে ইরানের। লেবাননে তাদের প্রক্সি গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রাখতে ইরানের কাছে সিরিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। সিরিয়ায় ইরান তার অবস্থান হারালে লেবাননেও তাদের প্রক্সি গ্রুপ অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। তবে এহেন পরিস্থিতি ইরানকে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার দিকে ঠেলে দিতে পারে। মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্কও সিরিয়াতে ইরানের অবস্থান দুর্বল হওয়াতে খুশি হয়েছেন। তিনি বলছেন যে, ইস্রাইলের কর্মকান্ডই পরিস্থিতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছে। এর পেছনে বাইডেন প্রশাসনের সাফল্য রয়েছে। 'এমআই-৬'এর প্রাক্তন প্রধান জন সয়ার্স বলছেন যে, সিরিয়ার ঘটনাপ্রবাহ দেখে ইরান সরকারের মনে হতে পারে যে, এরূপ ঘটনা কোন একসময় ইরানেও ঘটে যেতে পারে। ইরান একদিকে যেমন যথেষ্ট উন্নত একটা দেশ, অপরদিকে সেদেশের সরকার বেশিরভাগ জনগণের সমর্থন ছাড়াই ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। আর কিছুদিন আগেই ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর ইস্রাইলের বিমান হামলার কারণে ইরানের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাও বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কাজেই এমতাবস্থায় ইরানের বেশ চিন্তিত হবারই কথা। সাম্প্রতিক সময়ে ইরান পশ্চিমাদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। পশ্চিমারাও চাইছে ইরান তাদের দাবিগুলি মেনে নিক; যেগুলির মাঝে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প এবং আঞ্চলিক মিলিশিয়াদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার পরিবর্তনে লাভবান হয়েছে কিনা, সেটা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী গ্রুপগুলির যথেষ্ট ক্ষতি করতে চাইছে। একারণেই তারা একটা-দু'টা হামলা না চালিয়ে ৭৫টা টার্গেটে বোমা ফেলেছে। তবে মার্কিন সেনারা সিরিয়াতে থাকবে কিনা, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেবার আগেই বলেছেন যে, তিনি সিরিয়া থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করবেন।

 
ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্র কি পেলো?

ইস্রাইল অতি দ্রুতই গোলান মালভূমির সাথে লাগোয়া কিছুটা 'বাফার জোন' দখল করে নিয়েছে। তারা হয়তো মনে করছে যে, এর মাধ্যমে গোলান মালভূমির নিরাপত্তা বাড়বে। একইসাথে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইস্রাইল বিমান হামলা চালাচ্ছে। যেমন, মিডিয়াতে পাওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, বাশার আল-আসাদের নৌবাহিনীর কয়েকটা মিসাইল বোট ইস্রাইলি বিমান হামলায় পুরোপুরিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। খুব সম্ভবতঃ ইস্রাইলিরা নিশ্চিত করতে চাইছে যে, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হাতে যাতে এমন কোন অস্ত্র না পড়ে, যা কিনা ভবিষ্যতে কখনও ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও সিরিয়াতে বিদ্রোহীদের জয়ের সাথেসাথে বিমান হামলার ব্যাপারে তাদের গুরুত্বের ক্রমকে পরিবর্তন করেছে। মার্কিনীরা পূর্ব সিরিয়াতে ৭৫টার মতো স্থানে 'বি-৫২', ‘এফ-১৫' এবং 'এ-১০' যুদ্ধবিমান দিয়ে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। 'সিএনএন'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন বিমান বাহিনীর সাবেক কর্নেল সেডরিক লেইটন বলছেন যে, এতদিন সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্র ছোটখাটো হামলা চালিয়ে গেলেও এবারের হামলা ছিলো উল্লেখ করার মতো।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, সিরিয়ার পরিবর্তনে বড় লাভ যে দুই দেশের হয়েছে, তার মাঝে একটা হলো ইস্রাইল। সিরিয়াতে বিশৃংখলা সৃষ্টি হলেও তা ইস্রাইলের জন্যে সুযোগ করে দিচ্ছে ইরানের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের। জন সয়ার্স বলছেন যে, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর থেকে পাঁচ দশকে সিরিয়ার সীমান্তে ইস্রাইলকে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। এতকাল ইস্রাইলের সাথে রাশিয়ার টেবিলের নিচে দিয়ে নোংড়া ধরণের অলিখিত চুক্তি ছিল। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া নিশ্চিত করতো যে, সিরিয়ার ভেতর থেকে ইস্রাইলের উপর কোন হামলা আসবে না। এর বিনিময়ে ইস্রাইল বাশারের সরকারকে উৎখাতের কোনরূপ চেষ্টা থেকে বিরত থাকবে। সিরিয়ার সরকার পরিবর্তনে ইস্রাইলের চিন্তিত হবার কথা। ইস্রাইল হয়তো সবচাইতে খারাপ সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নেবে; যেমন, যদি সিরিয় গ্রুপগুলি একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তবে এক্ষেত্রে ইস্রাইল সবচাইতে বড় সহায়তা পাবে তুরস্কের কাছ থেকে; কারণ তুরস্কের হাতেই থাকবে সিরিয়ার ক্ষমতার মূল চাবি।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার পরিবর্তনে লাভবান হয়েছে কিনা, সেটা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী গ্রুপগুলির যথেষ্ট ক্ষতি করতে চাইছে। একারণেই তারা একটা-দু'টা হামলা না চালিয়ে ৭৫টা টার্গেটে বোমা ফেলেছে। তবে মার্কিন সেনারা সিরিয়াতে থাকবে কিনা, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেবার আগেই বলেছেন যে, তিনি সিরিয়া থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করবেন।

‘বিবিসি' বলছে যে, দক্ষিণ-পূর্ব সিরিয়াতে ইরাক এবং জর্দানের সীমান্তে আল-তানফ-এ রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এখানে মার্কিন স্পেশাল ফোর্স এবং লজিস্টিকসের ৯'শএর মতো সেনা রয়েছে। এখান থেকে মার্কিনীরা পুরো এলাকার উপর নজরদারি করছে এবং সিরিয়ায় কোথায় তারা বিমান হামলা করবে, সেটা নির্ধারণ করছে।
 
বাশারের পতনে ইরান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সেটা লেবাননে হিযবুল্লাহর ক্ষতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। খুব সম্ভবতঃ লেবানন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইরান এবং হিযবুল্লাহর ক্ষতির হিসেব করেই তুরস্ক 'এইচটিএস'কে সমর্থন দিয়েছে। এর শুরুটা অবশ্য ছিল ২০২৩এর ৭ই অক্টোবর গাজা থেকে ইস্রাইলে হামলার মধ্য দিয়ে; যা লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াকে প্রভাবিত করেছে। তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইরান পারমাণবিক শক্তি হবার দিকে আরও বেশি অগ্রগামী হতে পারে। 


কি হতে চলেছে?

তুরস্ক জিতেছে; কিন্তু যা সে জিতেছে, তা সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা, সেটা নিশ্চিত নয়। রাশিয়া হেরেছে। সিরিয়াতে রুশদের সামরিক ঘাঁটি রাখতে হলে তুরস্কের প্রভাবের (কতটা, তা নিশ্চিত নয়) উপর নির্ভর করতে হবে। এরদোগান এই ঘাঁটি নিয়ে পুতিনের সাথে দরকষাকষি করতে পারেন। সিরিয়া হারালে রাশিয়া লিবিয়াতে ঘাঁটি করতে চাইতে পারে। ইরান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সেটা লেবাননে হিযবুল্লাহর ক্ষতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। খুব সম্ভবতঃ লেবানন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইরান এবং হিযবুল্লাহর ক্ষতির হিসেব করেই তুরস্ক 'এইচটিএস'কে সমর্থন দিয়েছে। এর শুরুটা অবশ্য ছিল ২০২৩এর ৭ই অক্টোবর গাজা থেকে ইস্রাইলে হামলার মধ্য দিয়ে; যা লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াকে প্রভাবিত করেছে। তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইরান পারমাণবিক শক্তি হবার দিকে আরও বেশি অগ্রগামী হতে পারে। ইস্রাইল জিতেছে; কিন্তু বিনিময়ে সে পেয়েছে অনিশ্চিত প্রতিবেশী। সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে কেউই খুব একটা আশাবাদী নয়। তবে গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ইসলামিক আইন বাস্তবায়নকে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্র চোখ রেখেছে যাতে সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের গ্রুপগুলিও থাকবে। যদি তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের এই ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে সিরিয়ার সকল গ্রুপের উপর যথেষ্ট প্রভাব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থিত কুর্দী গ্রুপ 'এসডিএফ'এর অধীনে আটক আইসিস সদস্যদেরকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

বাশার আল-আসাদের পতন কেউই চিন্তা করতে পারেনি। তুরস্ক যে এই অভিযানের নেপথ্যে ছিল, তা পশ্চিমাদের কথাতেই পরিষ্কার। আর তুরস্ক বা পশ্চিমারা যে বাশারকে সরাতে চায়নি, সেটাও নিশ্চিত। তারা কেউই পরিকল্পনা করেনি যে, ‘এইচটিএস'এর সাথে বাকি সিরিয় গ্রুপগুলিও যুক্ত হবে; তারা চিন্তাও করেনি যে বাশারের বাহিনী যুদ্ধ করবে না; তারা বোঝেনি যে রাশিয়া এবং ইরান তাদের সমর্থন সরিয়ে নেবে। মোটকথা, সিরিয়ার বর্তমান ফলাফল কেউই পরিকল্পনা করেনি; সৃষ্টিকর্তা ব্যাতিরেকে। সিরিয়ায় পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ধাঁচের সরকার গঠনে যারা আগ্রহী ছিলো, তাদের বাইরেও অনেকেই আসাদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছে। একারণেই সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। মোটকথা, বাশার আল-আসাদ ব্যতীত সিরিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত; যা তুরস্ক বা রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র, কেউই চায়নি; পরিকল্পনাও করেনি। কাজেই সিরিয়ার ভবিষ্যৎও যে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে না, সেটা বলাই যায়।