Friday, 13 December 2024

ইউক্রেনে ড্রোন যুদ্ধ – বাকি বিশ্বের জন্যে শিক্ষা

১৪ই ডিসেম্বর ২০২৪

ইউক্রেনিয় সেনার হাতে 'ডিজেআই ম্যাভিক' ড্রোন; যার নিচে বাঁধা রয়েছে একটা গ্রেনেড। যুদ্ধ জয়ের কোন একক ম্যাজিক ফর্মূলা নয় ড্রোন। তবে ড্রোন ছাড়া যুদ্ধ জেতাও অসম্ভব হয়ে গেছে; যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে হয়েছিল ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। 


ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। যেসকল বিষয় এই যুদ্ধের মাঝে সবচাইতে বেশি আলোচিত হয়েছে, তার মাঝে শীর্ষে থাকবে ড্রোন। অনেকেই বলছেন যে, এই যুদ্ধের মাঝ দিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহের গতিপ্রকৃতিই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে ড্রোন ও অন্যান্য প্রযুক্তি এবং কৌশলের ব্যবহার সামনের দিনগুলিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বিশ্বের সকল সামরিক কৌশলীরাই এই যুদ্ধের দিকে নজর রাখছেন। ফ্রন্টলাইন থেকে বেশকিছু মিডিয়া নিয়মিত রিপোর্ট করছে; যেগুলি থেকে যুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

২০২২ সালে যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনিয়রা যখন তুর্কিদের তৈরি 'বায়রাকতার টিবি-২' ড্রোন ব্যবহার করে সফল হচ্ছিলো, তখন রুশদের ড্রোনের ব্যবহার খুব একটা উল্লেখ করার মতো ছিলো না। তখনও পর্যন্ত ইউক্রেনিয়রা রুশ আর্টিলারিকেই বেশি ভয় পেতো। কিন্তু ২০২২এর শেষের দিক থেকে রুশ ড্রোনের ব্যবহার বাড়তে থাকে। আর সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০২৩এর মাঝামাঝি সময়ে। ডনবাসের চাসিভ ইয়ার শহরের কাছে যুদ্ধে অংশ নেয়া ইউক্রেনিয় সেনারা বলছে যে, সেখানে দুই পক্ষের সৈন্যদের মাঝে সরাসরি যুদ্ধ খুব কমই হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুদ্ধ হচ্ছে ড্রোন এবং আর্টিলারি ব্যবহার করে।

ইইউ ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ইউক্রেনকে ১০ লক্ষ নতুন ড্রোন সরবরাহ করবে। অপরদিকে ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনী একটা নতুন ড্রোন কমান্ড গঠন করছে। ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় ১০ হাজার ড্রোন যেকোন মুহুর্তে আকাশে উড়ছে। ড্রোন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে ইউক্রেনের ৭৯তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেডের ওয়াবসাইটে। সেখানে স্নাইপার, রকেট-গ্রেনেড লঞ্চার এবং স্কাউট গানার পদের প্রায় একই পারিশ্রমিকে ড্রোন অপারেটর পদের জন্যে লোক চাওয়া হয়েছে। এই ব্রিগেডের বিভিন্ন সাব-ইউনিটের সাথে একটা 'এটাক ড্রোন কোম্পানি'কে দেখা যায়। এরকম অন্যান্য ব্রিগেডেও 'এটাক ড্রোন' কোম্পানি গঠন করা হয়েছে; যেমন ৯৫তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেড। ইউক্রেনের সেনারা ড্রোন সংগ্রহের জন্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে আন্তর্জাতিকভাবে সহায়তা চাচ্ছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে এই ড্রোন ইউনিটগুলি সাধারণভাবে 'এরো স্কাউট' বলে পরিচিত। ড্রোনের পাল্লার উপর নির্ভর করে এগুলি ফ্রন্টলাইন থেকে কয়েক কিঃমিঃ দূরে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং অন্যান্য ইউনিটের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ইউক্রেনিয় এবং রুশ সেনাবাহিনীর অনেক ইউনিটেই ড্রোন এখন একটা অপরিহার্য সরঞ্জাম। ইউক্রেনিয় এক সেনার মতে, ২ কিঃমিঃ দূরে বসে থাকা একজন সেনার ওড়ানো একটা ক্যামেরাসহ ড্রোন একটা রেকনাইস্যান্স কোম্পানির কাজ করে।
 
'এফপিভি' ড্রোন আটকাতে উক্রেনিয় সেনারা তাদের অবস্থানের চারিদিকে ক্যামুফ্লাজ নেট দিয়ে ঘিরে দিচ্ছে। সেনাদের জন্যে শত্রুর ড্রোন হয়ে গেছে একটা ত্রাসের বস্তু। ফ্রন্টলাইনে সেনারা বেশিরভাগ সময়ই কাটাচ্ছে মাটির নিচে; নতুবা কোন ড্রোন তাদের অবস্থান দেখে ফেলবে এবং তারা শত্রুর আর্টিলারি বা 'এফপিভি' ড্রোনের জন্যে টার্গেট হয়ে যাবে। 


ড্রোন থেকে বাঁচার চেষ্টা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ

সেনাদের জন্যে শত্রুর ড্রোন হয়ে গেছে একটা ত্রাসের বস্তু। ফ্রন্টলাইনে সেনারা বেশিরভাগ সময়ই কাটাচ্ছে মাটির নিচে; নতুবা কোন ড্রোন তাদের অবস্থান দেখে ফেলবে এবং তারা শত্রুর আর্টিলারি বা 'এফপিভি' (ফার্স্ট পারসন ভিউ) ড্রোনের জন্যে টার্গেট হয়ে যাবে। গাড়িগুলিকে সর্বদাই লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। সাধারণতঃ শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই কিছুটা নিরাপদে গাড়ি চালানো যায়। এমনকি মাটির নিচের বাংকারের মাঝেও বিভিন্ন স্থানে পর্দা লাগানো থাকে, যাতে করে কোন 'এফপিভি' ড্রোন বাংকারে ঢুকে পড়ে বেশিদূরে যেতে না পারে। আহত রুশ সেনারা পরিখার ভেতর আশ্রয় নিলে ইউক্রেনিয়রা সুইসাইড ড্রোন ব্যবহার করে তাদেরকে সেখানেও শেষ করেছে। 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'এর এক প্রতিবেদনের ভিডিও রেকর্ড করার মাঝখানেই পর পর দু'টা রুশ 'এফপিভি' ড্রোন পাশের বিল্ডিংএর দরজায় হামলা করে। তবে সেগুলি মাটির নিচের বাংকারের ভেতর ঢুকতে পারেনি; যদিও সেনারা সকলে বাংকারের ভেতর সতর্ক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। ইউক্রেনিয় সেনারা সন্দেহ করে যে, রুশরা হয়তো ইউক্রেনিয় ড্রোনের ভিডিও সিগনাল ধরে ফেলে তাদের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করছে; তবে ইউক্রেনিয়দের ড্রোন ঘাঁটির সঠিক অবস্থান তারা হয়তো জানতে পারেনি। খানিকক্ষণ পরই ইউক্রেনিয়রাও রুশদের তৃতীয় আরেকটা 'এফপিভি' ড্রোনের ভিডিও সিগনাল ধরে ফেলে বুঝতে পারে যে রুশরা তাদের ঘাঁটি বরাবরই ড্রোন ওড়াচ্ছে। অন্য কথায় বলতে গেলে ইউক্রেনিয়রা লাইভ ভিডিও দেখতে পায় যে একটা ড্রোন তাদের ড্রোন ঘাঁটির উপর বাড়ির ছাদে কিভাবে আছড়ে পড়লো! ইউক্রেনিয়রা এতে নিশ্চিত হয় যে রুশরা তাদের ঘাঁটির অবস্থান জেনে ফেলেছে। তাই তারা রাতের বেলাতেই এই ঘাঁটি ছেড়ে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে।

সাধারণতঃ আকাশে ড্রোন ওড়ার শব্দ শোনা গেলেই সেনারা চুপচাপ গাছের নিচে বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আর যদি সেনারা বুঝতে পারে যে কাছাকাছি কোন 'এফপিভি' (ফার্ট পারসন ভিউ) ড্রোন রয়েছে, তাহলে তারা কোন গাছের সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে নির্দেশনা হলো কোন অবস্থাতেই নড়াচড়া করা যাবে না। 'এফপিভি' ড্রোন সাধারণতঃ ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে যেতে পারে না। একারণে সেনারা যখন নিজেদের অবস্থান তৈরি করে, তখন তারা সকল প্রকারের ঝোপঝাড় ব্যবহার করার চেষ্টা করে। একইসাথে তারা ক্যামুফ্লাজ নেট ব্যবহারে করে খোলা জায়গাগুলি বন্ধ করার ব্যবস্থা করে; যাতে করে 'এফপিভি' ড্রোন ঢুকতে না পারে। আর্টিলারি, ট্যাংক বা আর্মার্ড ভেহিকলগুলিকেও ক্যামুফ্লাজ নেটের মাধ্যমে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রাখা হয় 'এফপিভি' ড্রোন থেকে বাঁচাতে। রাশিয়াও তার সামরিক স্থাপনাগুলিকে ক্যামুফ্লাজ নেট দিয়ে ঘিরে রাখছে। আর বিভিন্ন আর্মার্ড ভেহিকল এবং বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উপর তারা লোহার খাঁচা দিয়ে ঘিরে দিচ্ছে; যাতে করে সুইসাইড ড্রোনের আক্রমণ কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা যায়। খাঁচার উপর সুইসাইড ড্রোন বিস্ফোরিত হলে সেটা মূল সরঞ্জামগুলিকে হয়তো কম ক্ষতিগ্রস্ত করবে। রুশরা তাদের কিছু ট্যাঙ্ককে এরূপ খাঁচা দিয়ে ঘিরে ফেলে সেগুলিকে আক্রমণের অগ্রভাগে ব্যবহার করছে। এগুলিকে বলা হচ্ছে 'টারটল ট্যাংক' বা কচ্ছপ ট্যাংক। অনেক সময়েই এই কচ্ছপ ট্যাঙ্কের উপর ইলেকট্রনিক জ্যামার বসানো থাকে, যাতে করে 'এফপিভি' ড্রোন এগুলিকে টার্গেট করতে না পারে। প্রথম 'টারটল' ট্যাঙ্কটা খুব সম্ভবতঃ রুশদের ৫ম মোটর রাইফেল ব্রিগেডের ছিল; যারা ২০২৪এর এপ্রিলে ক্রাসনোহরিভকা শহরে হামলা চালাচ্ছিলো। এই ব্রিগেডের সেনারা খুব সম্ভবতঃ আভদিভকা শহরে রুশদের হামলার সময় ইউক্রেনিয় 'এফপিভি' ড্রোনের আক্রমণে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতিকে মাথায় রেখেই এই ট্যাঙ্ক ডিজাইন করেছিলো। খুব দ্রুতই চাসিভ ইয়ার এবং খারকিভের ফ্রন্টলাইনে এরূপ 'টারটল' ট্যাঙ্ক দেখা যেতে থাকলো। এই ট্যাঙ্কগুলির ডিজাইন দেখলেই বোঝা যায় যে, এগুলি একজন অপরজনকে দেখে নিজেরা নিজেরা তাদের ওয়ার্কশপে তৈরি করে নিয়েছে।

ইউক্রেনিয় সেনারা কেউ কেউ ছোট্ট আকৃতির একটা ড্রোন ডিটেক্টর বহন করছে; যার মাধ্যমে তারা ১০কিঃমিঃএর মাঝে কোন ড্রোন থাকলে সেটার রেডিও সিগনাল ধরতে পারে। সিগনালের শক্তি থেকে তারা বুঝতে পারে ড্রোনটা কতটুকু দূরে রয়েছে। ইউক্রেনিয় সেনাদের কেউ কেউ পাম্প-একশন শটগানের সাথে বিশেষ প্রকারের গোলা বহণ করছে; যেগুলি 'এফপিভি' ড্রোন ধ্বংস করার জন্যে কাজে লাগে। তবে সর্বদা আকাশ থেকে কেউ দেখছে - এই ব্যাপারটাই একটা সৈন্যের মনে ভয় ধরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট; সে পরিখার ভেতরে থাকুক, অথবা খোলা জায়গায়ই থাকুক।


তবে সাধারণভাবে ট্যাঙ্কগুলিকে এখন আর খোলা জায়গা দিয়ে দ্রুতগতিতে চালানো যাচ্ছে না; বরং সেগুলিকে লুকিয়ে রাখা আর্টিলারি হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। খোলা স্থানে গেলেই একটা ড্রোন সেই ট্যাঙ্ককে অচল করে ফেলে এবং আরেকটা ড্রোন এসে বাকি কাজটা শেষ করে, যাতে করে সেই ট্যাঙ্কটাকে আবারও মেরামত করে কাজে লাগানো সম্ভব না হয়। পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রকারের হুইল্ড এপিসি এবং 'এমআরএপি' বা 'এমর‍্যাপ'গুলি ইউক্রেনিয়রা ব্যবহার করছে সৈন্যদের বিভিন্ন অবস্থানে সেনা এবং রসদ আনানেয়ার কাজে। এই এপিসিগুলি সেনাদেরকে কিছুটা হলেও শত্রুর ড্রোন থেকে রক্ষা করতে পারে। সাম্প্রতিক একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন-নির্মিত 'ম্যাক্সপ্রো' ‘এমর‍্যাপ' গাড়ির উইন্ডশিল্ডের উপর একটা 'এফপিভি' ড্রোন বিস্ফোরিত হলেও তা গাড়ির খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। তবে এটা নিঃসন্দেহে সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ একেক ধরণের গাড়ির দুর্বলতা একেক রকম। তাই এপিসি কেন, ট্যাঙ্কও সুইসাইড ড্রোনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ইউক্রেনিয়রা তাদের আহত সেনাদেরকে শুধুমাত্র রাতের আঁধারে সরাবার কাজ করে। এমনকি খুব বেশি আহত না হলে সেনাদেরকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়না। কোন কোন ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সেনাদের মাঝে সরাসরি গোলাগুলিও হচ্ছে না। যেমন, চাসিভ ইয়ার শহর কিছুটা উঁচু জায়গায় এবং সেখান থেকে আশেপাশের এলাকা দিয়ে যদি কোন গাড়ি অগ্রগামী হয়, তাহলে ধূলার কারণে সেটা কয়েক কিঃমিঃ দূর থেকে দেখা যায়। ইউক্রেনিয় সেনারা তখন 'এফপিভি' ড্রোনের মাধ্যমে অগ্রগামী রুশ গাড়িগুলির উপর হামলা করে।

ইউক্রেনিয় সেনারা কেউ কেউ ছোট্ট আকৃতির একটা ড্রোন ডিটেক্টর বহন করছে; যার মাধ্যমে তারা ১০কিঃমিঃএর মাঝে কোন ড্রোন থাকলে সেটার রেডিও সিগনাল ধরতে পারে। সিগনালের শক্তি থেকে তারা বুঝতে পারে ড্রোনটা কতটুকু দূরে রয়েছে। ইউক্রেনিয় সেনাদের কেউ কেউ পাম্প-একশন শটগানের সাথে বিশেষ প্রকারের গোলা বহণ করছে; যেগুলি 'এফপিভি' ড্রোন ধ্বংস করার জন্যে কাজে লাগে। তবে ড্রোন থামানোর সবচাইতে ভালো উপায়গুলির একটা হলো ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার; যা জ্যামিংএর মাধ্যমে ড্রোন অপারেটরের সাথে ড্রোনের রেডিও সিগনালে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাশিয়া এই কাজে দুনিয়ার সেরা। ইউক্রেনিয়রাও কিছু ড্রোন জ্যামার ব্যবহার করে; যেগুলি নিজেদের সেনাদের অবস্থান হতে ৬০-ডিগ্রি ডিরেকশনে ২ কিঃমিঃ পর্যন্ত এলাকায় শত্রুর ড্রোন আসতে বাধা দেয়। ইউক্রেনিয়রা বলছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই রুশ জ্যামিংএর কারণে চীনা-নির্মিত 'ম্যাভিক' ড্রোনগুলি ১৫ফিট উচ্চতাতেও উড়তে পারে না। রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে হামলা চালিয়ে ইউক্রেনিয় সেনারা নিয়মিতই এহেন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।

আকাশে যখন তেমন কোন মেঘ থাকে না, তখন ইউক্রেনিয় সেনারা বলে যে, ‘আকাশ নোংড়া'। কারণ এই আবহাওয়ায় আকাশে রুশ ড্রোনের আনাগোণা বাড়বে এবং ইউক্রেনিয়রা তাদের আর্টিলারি থেকে একটা গোলা ছোঁড়া মাত্রই রুশরা ইউক্রেনিয়দের অবস্থান দেখে ফেলবে এবং সেখানে আর্টিলারি দিয়ে গোলাবর্ষণ করবে। অপরদিকে উইক্রেনিয়রা তাদের সুইসাইড ড্রোনগুলিকে ব্যবহার করছে নিজেদের আর্টিলারির প্রতিস্থাপক হিসেবে। এগুলি দিয়ে রুশ ফ্রন্টলাইনের ৩০কিঃমিঃ পর্যন্ত পিছনের টার্গেটে হামলা করছে ইউক্রেনিয়রা। একারণে 'এফপিভি' ড্রোনের পাইলটরা রুশ বাহিনীর জন্যে প্রধান টার্গেটরূপে আবির্ভূত হয়েছে। আবার ইউক্রেনিয়রাও মার্কিন সরবরাহকৃত 'হিমার্স' রকেট আর্টিলারিগুলিকে ব্যবহার করেছে রুশ 'এফপিভি' ড্রোনের ট্রেনিং সেন্টারের বিরুদ্ধে; যেখানে বেশ কয়েকজন 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ছাত্র নিহত হয়েছিল। এমনকি 'মোজেস' নাম নিয়ে বিখ্যাত হওয়া এক রুশ 'এফপিভি' ড্রোন পাইলটকে ইউক্রেনিয়রা বিশেষ ড্রোন মিশনে হত্যা করেছে। 'ডারউইন' ছদ্মনামের একজন ইউক্রেনিয় 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ৩'শএর বেশি রুশ টার্গেট ধ্বংস করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। মোটকথা উভয় পক্ষের জন্যেই শ্ত্রুর ড্রোন অপারেশনসএর ঘাঁটি খুঁজে সেগুলিকে ধ্বংস করাটা হয়ে গিয়েছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটা ড্রোন ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারলে অনেকগুলি ড্রোন এবং এগুলির পাইলটদের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব।

ইউক্রেনিয়দের ডেভেলপ করা হেক্সাকপ্টার 'ভ্যামপায়ার'; যেগুলিকে রুশরা 'বাবা ইয়াগা' বলে ডাকে। এগুলি থারমাল ক্যামেরা বহণ করে বলে রাতের বেলাতেই এগুলির ব্যবহার বেশি। কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্যে তৈরি করা এই ড্রোন ১৫ কেজি পর্যন্ত বোমা বহণ করতে পারে। ছোট টার্গেটের বিরুদ্ধে ৪টা ছোট বোমা অথবা বাংকার বা ট্যাংকের বিরুদ্ধে একটা বড় এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন ব্যবহৃত হতে পারে। এগুলির আরেকটা ব্যবহার হলো সিগনাল রিপিটার হিসেবে। অর্থাৎ অন্যান্য ছোট ড্রোনের পাল্লা বৃদ্ধি করার জন্যে এই ড্রোনগুলি সিগনাল রিলে করে থাকে। 

 

ড্রোনের ব্যবহার – সদা পরিবর্তনশীল

কিছু বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে, যারা শুধু ড্রোন দিয়েই যুদ্ধ করে। ইউক্রেনিয় এরূপ বিশেষায়িত ইউনিটগুলির মাঝে একটা হলো 'মাগইয়ার বার্ডস' বা 'মাদইয়ার বার্ডস'। এটা একটা ড্রোন কোম্পানি। ইউক্রেনিয় ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ রবার্ট ব্রোভদি এই ইউনিটের নেতা; যাকে সবাই 'মাদইয়ার' বলে ডাকে। তিনি নিজ উদ্যোগে অর্থ জোগাড় করে ড্রোন কিনে ব্যবহার করা শুরু করেন। তার ইউনিটে রয়েছে কয়েক ডজন ড্রোন পাইলট এবং কয়েক'শ ড্রোন। ২০২২এর এপ্রিল থেকে অগাস্ট পর্যন্ত তার ইউনিট ছিল ২৮তম মেকানাইজড ব্রিগেডের অধীনে। এই ইউনিটের প্রধান কাজ হলো, ১) ফ্রন্টলাইন টহল দেয়া; ২) শত্রুদের অবস্থান খুঁজে বের করা, ৩) আর্টিলারির জন্যে টার্গেট ঠিক করে দেয়া; ৪) ‘কামিকাজি' বা সুইসাইড ড্রোন দিয়ে শত্রুর টার্গেটে হামলা করা; এবং ৫) ড্রোন থেকে শত্রুর অবস্থানের উপর বোমাবর্ষণ করা। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মিশনের জন্যে তারা অনেক প্রকারের ড্রোন ব্যবহার করলেও সবচাইতে বেশি হলো চীনে নির্মিত 'ডিজেআই ম্যাভিক' ড্রোন। চতুর্থ মিশনের জন্যে তারা সবচাইতে বেশি ব্যবহার করে 'এফপিভি' বা 'ফার্স্ট পারসন ভিউ' ড্রোন। এগুলি খুব দ্রুত উড়তে সক্ষম এবং অন্যান্য ড্রোনের মতো হাল্কাভাবে তৈরি নয়; বরং এগুলির বডি তৈরি করা হয় কার্বন ফাইবার দিয়ে। এর ফলে এগুলিকে উড়ন্ত অবস্থা থেকে ফেলা খুব সহজ নয়।

পঞ্চম মিশনের জন্যে বিভিন্ন প্রকারের ড্রোন ব্যবহার করা হয়। ছোট্ট চীনা ড্রোনগুলির নিচে আরপিজি রকেটের ওয়ারহেড আটকে দিয়ে সেগুলিকে হামলায় ব্যবহার করা হয়। আর কিছু ড্রোন আছে বড়; যেমন ইউক্রেনিয়দের ডেভেলপ করা হেক্সাকপ্টার 'ভ্যামপায়ার'; যেগুলিকে রুশরা 'বাবা ইয়াগা' বলে ডাকে। এগুলি থারমাল ক্যামেরা বহণ করে বলে রাতের বেলাতেই এগুলির ব্যবহার বেশি। কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্যে তৈরি করা এই ড্রোন ১৫ কেজি পর্যন্ত বোমা বহণ করতে পারে। ছোট টার্গেটের বিরুদ্ধে ৪টা ছোট বোমা অথবা বাংকার বা ট্যাংকের বিরুদ্ধে একটা বড় এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন ব্যবহৃত হতে পারে। এগুলির আরেকটা ব্যবহার হলো সিগনাল রিপিটার হিসেবে। অর্থাৎ অন্যান্য ছোট ড্রোনের পাল্লা বৃদ্ধি করার জন্যে এই ড্রোনগুলি সিগনাল রিলে করে থাকে। ইউক্রেনিয়দের নিজেদের ডেভেলপ করা 'আর-১৮' অক্টোকপ্টার ড্রোন একেকটা ১ দশমিক ৬ কেজি ওজনের ৩টা এন্টি-ট্যাঙ্ক গ্রেনেড নিয়ে ৩'শ মিটার উঁচু থেকে শত্রুর টার্গেটের ১ বর্গমিটারের মাঝে ফেলতে পারে। শত্রুর ট্যাংক, আর্মার্ড ভেহিকল, কামান, ট্রাক ইত্যাদি ১৭কেজি ওজনের এই ড্রোনের মূল টার্গেট। এটা ৫কিঃমিঃ দূর পর্যন্ত যেতে পারে এবং ৪৫ মিনিট আকাশে টহল করতে সক্ষম। এগুলিতে থারমাল ক্যামেরা থাকে; অর্থাৎ রাতের বেলাতেও আকাশ থেকে দেখতে পারে। এছাড়াও 'পানিশার' নামে ইউক্রেনিয়দের ডেভেলপ করা একটা 'ফিক্সড-উইং' ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে; যার পাল্লা হলো ৪৫কিঃমিঃ। এই ড্রোন ব্যবহার করে তার ২৫মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের 'টর' বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও ধ্বংস করেছে। ২০২২এর অগাস্টে 'মাদইয়ার'এর ইউনিটকে বাখমুতে ৫৯তম মটরাইজড ব্রিগেডের অধীনে স্থানান্তর করা হয়; যেখানে তারা ২০২৩এর মার্চ পর্যন্ত যুদ্ধ করে। টানা ১১০ দিন যুদ্ধ করার পর তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসে। ২০২৩এর নভেম্বর থেকে এই ইউনিট খেরসনের কাছাকাছি ক্রিনকিতে ইউক্রেনিয় ম্যারিন কোরের ৪১৪তম ম্যারিন স্ট্রাইক ইউএভি ব্যাটালিয়নের অংশ হিসেবে যুদ্ধ করছে। রবার্ট ব্রোভদি তার ইউটিউব চ্যানেলে এখন পর্যন্ত ৩৩১টা ভিডিও আপলোড করেছেন। তিনি দাবি করছেন যে, তার কোম্পানির সক্ষমতা রয়েছে এক মাসে কয়েক'শ আর্মার্ড ভেহিকল ধ্বংস করার; যা তারা কাজে করে দেখিয়েছেন। তার ইউনিট একদিনে ৫০টা সর্টিও করেছে। ২০২৩এর জুন মাসের মাত্র ৪ দিনে এই ইউনিট রুশদের ৩৫টা আর্মার্ড ভেহিকল ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাদের দাবি যে, তাদের ধ্বংস করা শত্রুর সরঞ্জামের মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মাদইয়ার বলছেন যে, তারা এমন কিছু প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন, যাতে করে লুকিয়ে থাকা শত্রু সেনাদের খুঁজে বের করা যায়। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো শত্রু সৈন্যদের হেলমেট অথবা মেশিনগানের আউটলাইন খুঁজে বের করা। ইউক্রেনের ড্রোন পাইলটদের মাঝে কেউ কেউ বেশ নাম করেছেন। বিখ্যাত 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট 'ডারউইন' মাত্র ১৮ বছর বয়সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। মেডিক্যাল ছাত্র ডারউইন প্রথমে ডাক্তার হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এরপর একসময় সে 'এফপিভি' ড্রোনের একটা ইউনিটে যোগ দেয়; কারণ সে একসময় ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত ছিল। তার 'ডারউইন' নামটা তার সতীর্থ একজন সেনা দিয়েছিল।

নিজেদের ওয়ার্কশপে বোমা তৈরি করছে ইউক্রেনিয়রা; যেগুলি ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে শত্রুর অবস্থানের উপর ফেলা হচ্ছে। বোমার ফিনগুলি থ্রি-ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে। মূল টেকনিশিয়ান গোলার কম্পোনেটগুলি তৈরি করে স্টক করে রাখেন। এরপর সেনারা তাদের অবসর সময়ে ওয়ার্কশপে এসে এই গোলা এসেম্বলির কাজ করে - কেউ বোরিংএর কাজ করে; কেউ ফিন এসেম্বলির কাজ করে; কেউ কার্তুজ ভর্তি করার কাজ করে। 

 
তবে ড্রোন ব্যবহারে নিজস্ব সেনাদের সাপ্লাই দিয়ে জীবিত রাখার একটা চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। ইউক্রেনের চাসিভ ইয়ার শহর রুশ সেনাদের হাতে চলে যাবার পর সেখানে কিছু ইউক্রেনিয় সেনা আটকা পড়ে। এই সেনাদেরকে ৭০ দিন রুশ সেনারা ঘিরে রেখেছিল। যে ড্রোনগুলি রুশ সেনাদের উপর বোমা ফেলতো, সেই ড্রোনগুলিই আটকে পড়া সেনাদেরকে সাপ্লাই দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। আটকে পড়া সেনারা বলছে যে, তাদের জন্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমস্যা ছিল না। কারণ তার শত্রু সেনাদের হত্যা করে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলি নিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু পানি ছিলো সবচাইতে বড় সমস্যা। তারা ময়লা পানি ছেঁকে পান করছিলো। খাবারও ছিল তাদের জন্যে অতি জরুরি জিনিস। ড্রোনের মাধ্যমে তাদের জন্যে পানি, ড্রাইফুড, চকলেট, ক্যান্ডি, সিগারেট পাঠানো হয়েছিলো। তাদের রেডিও ওয়াকি টকির ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে ড্রোন দিয়ে তাদের জন্যে চার্জার এবং পাওয়ার ব্যাংক পাঠানো হয়। এগুলি ব্যবহার করে তারা হেডকোয়ার্টাসের সাথে যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলো।

নিজেদের ওয়ার্কশপে বোমা তৈরি করছে ইউক্রেনিয়রা; যেগুলি ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে শত্রুর অবস্থানের উপর ফেলা হচ্ছে। বোমার ফিনগুলি থ্রি-ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে। চাসিভ ইয়ারে যুদ্ধ করা 'থান্ডার কোম্পানি' নামের ইউনিটের মধ্যবয়সী সেনাদের (পুরো ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের গড় বয়স ৪৩ বছর) এরকম একটা ছোট ওয়ার্কশপে ৫'শ শ্রাপনেল বোমা এবং ১ হাজারের বেশি আগুনে বোমা তৈরি করা হয়েছে। মূল টেকনিশিয়ান গোলার কম্পোনেটগুলি তৈরি করে স্টক করে রাখেন। এরপর সেনারা তাদের অবসর সময়ে ওয়ার্কশপে এসে এই গোলা এসেম্বলির কাজ করে - কেউ বোরিংএর কাজ করে; কেউ ফিন এসেম্বলির কাজ করে; কেউ কার্তুজ ভর্তি করার কাজ করে। আরেকটা ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কশপে 'এফপিভি' ড্রোন এসেম্বল করা হচ্ছে। তারা বলছে যে, যুদ্ধের শুরুর দিকে তারা সপ্তাহে ৫টা করে ড্রোন তৈরি করতো; এখন তারা দিনে ১'শটা ড্রোন তৈরি করে।

ইউক্রেনিয়রা একপ্রকারের ড্রোন ডেভেলপ করেছে, যেগুলি বোতলে করে ভীষণ প্রকারের দাহ্য একটা রাসায়নিক পদার্থ বহণ করে। ড্রোনটা যে পথ দিয়ে যায়, সেই পথ বরাবর আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে; অনেকটা ড্রাগনের মতো। এগুলি সাধারণতঃ কোন সামরিক গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় না; বরং রুশ সেনাদের পরিখা বরাবর এগুলিকে উড়িয়ে নেয়া হয়। এতে সেই পরিখার ভেতর থাকা রুশ সেনারা নিশ্চিত মৃত্যুর সন্মুখীন হয়। কোন কোন বিশ্লেষক এধরণের 'ড্রাগন' বা 'থারমাইট' ড্রোন ব্যবহারকে যুদ্ধাপরাধের সাথে তুলনা করেছেন।
 
রুশ 'টারটল' বা কচ্ছপ ট্যাংক। এগুলির উপরে জ্যামার বসানোর কারণে 'এফপিভি' ড্রোন এগুলিকে ধ্বংস করতে পারে না। তবে ট্যাঙ্কের উপর খাঁচা বসাবার কারণে ট্যাঙ্কের ক্রুরা আশেপাশে কিছুই দেখতে পায় না। আর ড্রোনের ভয়ে ট্যাঙ্কের সাথে সহায়তা দেয়ার জন্যে পদাতিক সেনাও থাকে না। এভাবে কোন ট্যাঙ্কের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোন প্রভাব তৈরি করা সম্ভব নয়।


ড্রোন আসলে কতটা সফল?

রিমোট কন্ট্রোল ড্রোনের মূল দুর্বলতা হলো, এটাকে রেডিও সিগনালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সিগনাল জ্যামিংএর মাধ্যমে ড্রোনের সাথে এর পাইলটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া সম্ভব। রুশরা সিগনাল জ্যামিংএ দুনিয়ার সেরা। ইউক্রেনিয়দের একটা ড্রোন ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, একটা রুশ 'টারটল ট্যাংক' ডনবাসে ক্রাসনোহরিভকা শহরে আক্রমণে এগুচ্ছে; সাথে রয়েছে আরেকটা ট্যাংক। ট্যাঙ্কগুলির আশেপাশে বেশকিছু ছোট বিস্ফোরণ হচ্ছে; যা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনিয় 'হিমার্স' রকেটের মাঝে থাকা 'ক্লাস্টার' বা গুচ্ছ বোমা। এর মাঝে ট্যাঙ্কগুলি থেকে কিছুটা দূরে দু'টা বিস্ফোরণ দেখা যায়। যদিও বোঝা যাচ্ছে না যে, এই বিস্ফোরণগুলি কিসের, তথাপি এগুলি 'এফপিভি' ড্রোন হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। খুব সম্ভবতঃ ট্যাঙ্কের উপরে বসানো জ্যামারের কারণে ড্রোনগুলি এর কাছে ভিড়তে পারছে না। এই আক্রমণে ইউক্রেনিয়রা অনেক চেষ্টা করেও রুশদের 'টারটল' ট্যাঙ্ক ধ্বংস করতে পারেনি; যদিও সেগুলি প্রচুর ব্যবহৃত হচ্ছিলো; যা রুশদের জ্যামার ব্যবহার করার দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এটা এমন নয় যে, রুশরা ড্রোন থেকে বাঁচার জাদুর ঔষধ পেয়ে গেছে; বরং তারা যে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল অবলম্বণ করছে, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। ভিডিওতে দেখা যায় যে, 'টারটল' ট্যাঙ্ক পুরো শহর জুড়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ঘুরছে। কারণ ট্যাঙ্কের উপর খাঁচা বসাবার কারণে ট্যাঙ্কের ক্রুরা আশেপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আর ড্রোনের ভয়ে ট্যাঙ্কের সাথে সহায়তা দেয়ার জন্যে পদাতিক সেনাও নেই। এভাবে কোন ট্যাঙ্কের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোন প্রভাব তৈরি করা সম্ভব নয়।

তবে শুধু রুশ ট্যাঙ্কই যে ড্রোন আক্রমণের সমস্যায় পড়েছে তা কিন্তু নয়। ২০২৪এর ফেব্রুয়ারি মাসে ডনবাসের আভদিভকা শহরের কাছে ইউক্রেনের ৪৭তম ব্রিগেডের মার্কিন-নির্মিত একটা 'এম-১এ১' ট্যাঙ্কের উপর ড্রোন হামলার ভিডিও প্রকাশিত হয়। সেখানে দাবি করা হয় যে, রুশরা একটা 'পিরানহা' ‘এফপিভি' ড্রোনের মাধ্যমে ট্যাঙ্কটাকে অচল করে ফেলেছে; যেটাকে বলা হচ্ছে 'মোবিলিটি কিল'; অর্থাৎ এই ট্যাঙ্কের ট্র্যাক বা ইঞ্জিনে আঘাত করে সেটাকে চলাচলের অনুপযুক্ত করে ফেলা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় আরেকটা ড্রোন এসে ট্যাঙ্কের পিছন দিকে আঘাত করার পর বিস্ফোরণে ট্যাঙ্কের গোলাবারুদে আগুন ধরে যায়। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মাঝে ইউক্রেন একই জায়গায় তিনটা 'এম-১এ১' ট্যাঙ্ক হারায়। এরপর এই মডেলের আরও ট্যাঙ্ক ধ্বংসের খবর পাওয়া যায়। পশ্চিমাদের দেয়া সর্বাধুনিক ১৩০টার মতো 'এম-১এ১', ব্রিটিশ 'চ্যালেঞ্জার-২' এবং জার্মান 'লেপার্ড-২' ট্যাঙ্কের মাঝে প্রায় ৪০টার মতো ট্যাঙ্ক ইতোমধ্যেই ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বের সেরা ট্যাঙ্ক হলেও এই ট্যাঙ্কগুলি ড্রোনের হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। আর ইউক্রেনিয়রাও ট্যাঙ্কগুলিকে খোলা জায়গায় ব্যবহার করছে খুব কমই। বেশিরভাগ সময়ই ট্যাঙ্কগুলিকে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে। এছাড়াও এই ট্যাঙ্কগুলি অত্যন্ত ভারি হওয়ায় ইউক্রেনের মাটিতে চলার জন্যে তেমন একটা উপযুক্ত নয়। ইউক্রেনের সেনারা বলছে যে, ট্যাঙ্কগুলি নরম কাদায় আটকে যাচ্ছে বিধায় এগুলিকে সর্বত্র ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

ইউক্রেনিয় সেনা 'এফপিভি' ড্রোন ওড়াচ্ছে। একজন অভিজ্ঞ এবং একজন অনভিজ্ঞ ড্রোন পাইলটের মাঝে পার্থক্য অনেক। 'এফপিভি' ড্রোনের পাইলটরা রুশ বাহিনীর জন্যে প্রধান টার্গেটরূপে আবির্ভূত হয়েছে। আবার ইউক্রেনিয়রাও মার্কিন সরবরাহকৃত 'হিমার্স' রকেট আর্টিলারিগুলিকে ব্যবহার করেছে রুশ 'এফপিভি' ড্রোনের ট্রেনিং সেন্টারের বিরুদ্ধে; যেখানে বেশ কয়েকজন 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ছাত্র নিহত হয়েছিল। এমনকি 'মোজেস' নাম নিয়ে বিখ্যাত হওয়া এক রুশ 'এফপিভি' ড্রোন পাইলটকে ইউক্রেনিয়রা বিশেষ ড্রোন মিশনে হত্যা করেছে। 'ডারউইন' ছদ্মনামের একজন ইউক্রেনিয় 'এফপিভি' ড্রোন পাইলট ৩'শএর বেশি রুশ টার্গেট ধ্বংস করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। মোটকথা উভয় পক্ষের জন্যেই শ্ত্রুর ড্রোন অপারেশনসএর ঘাঁটি খুঁজে সেগুলিকে ধ্বংস করাটা হয়ে গিয়েছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটা ড্রোন ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারলে অনেকগুলি ড্রোন এবং এগুলির পাইলটদের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব।

 
রুশ জ্যামিং মোকাবিলা করতে ইউক্রেন ব্যবহার করছে নিজেদের ডেভেলপ করা 'এসিএস-৩' ড্রোন; যা প্রকৃতপক্ষে 'রে-বার্ড-৩' নামের বেসামরিক ড্রোন থেকে ডেভেলপ করা। ফিক্সড উইংএর এই ড্রোন ওড়ার আগে একটা রুট নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়; যা বরাবর তা উড়তে থাকে; অর্থাৎ সরাসরি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না। ফলে কোন জ্যামিং এগুলির উপর কাজ করে না। এর প্রস্তুতকারক কোম্পানি একটা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ডেভেলপ করেছে; যার মাধ্যমে এই ড্রোনের তোলা ছবি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টার্গেট খুঁজে বের করা যায়। এই ড্রোন চলে পেট্রোল ইঞ্জিনে এবং একনাগারে ৩০ ঘন্টারও বেশি আকাশে থাকতে পারে। আড়াই লক্ষ ডলার মূল্যের এই ড্রোন একটা ক্যাটাপাল্টের মাধ্যমে ওড়ানো হয় এবং নামার সময় নির্দিষ্ট স্থানে এসে প্যারাশুট দিয়ে নামে। ২৩ কেজি ওজনের এই ড্রোন ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১৮০কিঃমিঃ গতিতে চলে এবং ৩ হাজার মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। এই ড্রোনগুলি রুশ ফ্রন্টলাইনের পিছনে ১৬০কিঃমিঃ পর্যন্ত অপারেট করেছে এবং একটা ড্রোনের ৮০টা মিশনও সফলভাবে সম্পাদনের রেকর্ড রয়েছে। মার্কিন সরবরাহকৃত 'হিমার্স' এবং অন্যান্য দূরপাল্লার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট খোঁজার জন্যে এই ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছে। গ্লাস-ফাইবার দিয়ে তৈরি করার কারণে এটা রাডারে খুবই ছোট আকৃতির দেখা যায়। ইউক্রেনিয়রা এই ড্রোন ইলেকট্রিক মোটর দিয়ে ওড়ানোর চেষ্টা করছে, যাতে করে এর হীট সিগনেচার আরও কমে যায় এবং থারমাল ক্যামেরা দিয়েও এটাকে টার্গেট করা না যায়। ২০২৪এর অগাস্টে একটা 'এসিএস-৩' ড্রোন ফ্রন্টলাইন থেকে ২'শ কিঃমিঃ দূরে রাশিয়ার ক্রাসনোদার শহরের কাছে ভূপাতিত করা হয়।

উভয় পক্ষই সোশাল মিডিয়াতে ড্রোনের সাফল্যের ভিডিও আপলোড করছে; কেউই তাদের নিজেদের ব্যর্থতাকে দেখাতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা ড্রোন সফল হতে পারে না। গড়ে একটা ড্রোনের সাফল্য পেতে হলে ৮-৯টা ড্রোনকে ব্যর্থ হতে হয়। হয় এগুলির ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যায়, অথবা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়, অথবা জ্যামিংএর মাধ্যমে অকার্যকরা করে ফেলা হয়। 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'এর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে, একটা 'এফপিভি' ড্রোন চালাতে চালাতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে সিগনাল জ্যামিংএর কারণে। ইউক্রেনিয় বর্ডার গার্ডের একটা 'এরো স্কাউট' ইউনিটএর কমান্ডার বলছেন যে, তারা একদিনে ১০টা পর্যন্ত ড্রোন হারিয়েছেন। আর একটা বোমারু ড্রোন টার্গেটের কাছে পৌঁছাতে পারলেই যে টার্গেটের উপর সাফল্যের সাথে বোমা ফেলতে পারবে, তারও কিন্তু গ্যারান্টি নেই; বিশেষ করে ড্রোন পাইলট যদি অনভিজ্ঞ হয়। কয়েক'শ ফুট উঁচু থেকে চলমান একটা টার্গেটের উপর নিখুঁতভাবে বোমা ফেলা মোটেই সহজ নয়। আর যদি বাতাস বেশি থাকে অথবা আবহাওয়া খারাপ থাকে, তাহলে ড্রোনের সাফল্য আরও অনেক কমে যায়। একারণেই ইউক্রেনিয়রা শুধুমাত্র ড্রোনের উপরেই নির্ভর করছে না। এখনও উভয় পক্ষের হতাহতের মূল কারণ হলো আর্টিলারি। একজন অনভিজ্ঞ 'এফপিভি' ড্রোন পাইলটের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে একটা ঘটনা থেকে। ইউক্রেনিয় একজন ইউনিট কমান্ডারের এসইউভি গাড়িতে 'এফপিভি' ড্রোন হামলা করে। প্রথম ড্রোনটা গাড়ির পিছন দিকে হামলা করে ব্যাপক ক্ষতি করে; তবে আরোহীদের কিছু হয়নি; কারণ তাদের গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ছিল। আরোহীরা গাড়ি থেকে বের হয়ে আধাঘন্টা লুকিয়ে থাকে। এর মাঝে দ্বিতীয় ড্রোন এসে গাড়ির পিছনের বাম্পারে আঘাত করে। দু'টা ড্রোনের আঘাতের পরেও গাড়ির ইঞ্জিন সচল থাকে এবং তারা সেটাকে চালিয়ে ঘাঁটিতে ফেরত আসেন। বেঁচে যাওয়া কমান্ডার বলছেন যে, একজন অভিজ্ঞ পাইলট তার ড্রোনটাকে ঘুরিয়ে এনে সামনের উইন্ডস্ক্রীন বরাবর হামলা করতো। এতে তাদের দু'জনেরই বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না।

একজন ইউক্রেনিয় সেনা 'এফপিভি' ড্রোনের সাথে ব্যাটারি প্যাক এবং আরপিজি গ্রেনেড লাগাচ্ছে। উভয় পক্ষই সোশাল মিডিয়াতে ড্রোনের সাফল্যের ভিডিও আপলোড করছে; কেউই তাদের নিজেদের ব্যর্থতাকে দেখাতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা ড্রোন সফল হতে পারে না। গড়ে একটা ড্রোনের সাফল্য পেতে হলে ৮-৯টা ড্রোনকে ব্যর্থ হতে হয়। হয় এগুলির ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যায়, অথবা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়, অথবা জ্যামিংএর মাধ্যমে অকার্যকরা করে ফেলা হয়।

 
যুদ্ধ জয়ের কোন একক ম্যাজিক ফর্মূলা নয় ড্রোন। তবে ড্রোন ছাড়া যুদ্ধ জেতাও অসম্ভব হয়ে গেছে; যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে হয়েছিল ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। একইসাথে যুদ্ধজয়ের সংজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইউক্রেন প্রচুর প্রযুক্তি ব্যবহারের পরেও সংখ্যার দিক থেকে যুদ্ধ হেরে যাচ্ছে; আর রাশিয়া নিজের ক্ষয়ক্ষতিকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্টিমরোলার চালিয়ে এগুচ্ছে। একদিকে যেমন শত্রুর শক্ত অবস্থান অতিক্রম করে আক্রমণে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে, তেমনি একবার কোন একটা দেশ অন্য দেশের ভূমি দখল করে ফেললে সেই ভূমি পুনরুদ্ধার করাও কঠিন হয়ে গেছে। যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার 'সারপ্রাইজ' আক্রমণ পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের খারকিভ এবং কুর্স্কএ সারপ্রাইজ হামলা প্রাথমিকভাবে সফলতা পেলেও শেষ পর্যন্ত কঠিন পরিখা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কম খরচে আক্রমণে যাওয়া ততক্ষণ পর্যন্তই সম্ভব, যতক্ষণ 'সারপ্রাইজ' ফ্যাক্টর কাজ করছে। শত্রু যদি সময় পেয়ে পরিখা খুঁড়ে অবস্থান নেয়, তাহলে তাকে সেখান থেকে উৎখাত করা অত্যধিক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। হয়তো ড্রোনের সুবাদে ডিফেন্সিভ লাইনে থাকা সেনাদের সুবিধা হয়েছে; কিন্তু আক্রমণে যাবার সময়েও ড্রোন ছাড়া চলছে না। তবে সর্বদা আকাশ থেকে কেউ দেখছে - এই ব্যাপারটাই একটা সৈন্যের মনে ভয় ধরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট; সে পরিখার ভেতরে থাকুক, অথবা খোলা জায়গায়ই থাকুক। আপাততঃ পরিখার ভেতরটাই সৈন্যদের জন্যে কিছুটা হলেও নিরাপদ। সেই হিসেবে আবারও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা যুদ্ধের দিকেই তাকাতে হচ্ছে। পরিখা থেকে সৈন্যদের উৎখাত করার নতুন কোন সহজ পদ্ধতি আসার আগ পর্যন্ত আক্রমণকারীকে শুধুমাত্র 'সারপ্রাইজ' ফ্যাক্টরের উপরেই নির্ভর করতে হবে।

No comments:

Post a Comment